আজাদী সৈনিকের ডায়েরী/তৌঙ্গউয়িঙ্গি ও ম্যাগউই

৯ই এপ্রিল ১৯৪৫: পোপা

 এখানেও ইহার মধ্যে একবার বৃটিশ এরোপ্লেন বোমা ফেলিয়া গিয়াছে।

 আজ কর্ণেল সেহগল অফিসারদের সঙ্গে আলোচনার জন্য একটি কন্‌ফারেন্স আহ্বান করিয়াছেন। তিনি বলিলেন—আমরা এখন হইতে ১২ তারিখে তৌঙ্গউয়িঙ্গি যাত্রা করিব।

১২ই এপ্রিল ১৯৪৫: তোঙ্গউয়িঙ্গির দিকে

 আমরা আজ পোপা ছাড়িলাম। পথে খবর পাওয়া গেল তৌঙ্গউয়িঙ্গি শত্রুর হাতে পড়িয়াছে। কর্ণেল সেহগল আমাদের বলিলেন যে এ ক্ষেত্রে আমাদের প্রোমের দিকে অপসরণ করাই ভালো।

১৪ই এপ্রিল ১৯৪৫; ম্যাগউই

 আমি ম্যাগউই আসিয়াছি। সংবাদ নৈরাশ্যময়। আমেরিকানরা অগ্রসর হইতেছে। তাহাদের বিপুল রণসম্ভার ও লোকবলের বিরুদ্ধে আমাদের ক্ষুদ্র বাহিনী কিছুই নয়। জাপানীদের অবস্থাও ভালো মনে হয় না।

 আজ এরােপ্লেনে রেঙ্গুনে রিপাের্ট যাইতেছে।

১৫ই এপ্রিল ১৯৪৫: রেঙ্গুন

 লেফট্‌ন্যাণ্ট জ্ঞান সিংএর বীরােচিত মৃত্যুর কথা পূর্বেই বলিয়াছিলাম। আজ কর্ণেল ধীলনের বিস্তৃত রিপাের্ট দেখিলাম। কর্ণেল ধীলন লিখিয়াছেন—


 “স্থানটি সমতল ভূমি। শত্রুর দৃষ্টি বা গুলি বর্ষণ এড়াইবার উপযুক্ত ‘কভার’ কিছু নাই। কেবল একটি অগভীর শুষ্ক ডােবা আছে। যেখানে তিনটি সামরিক গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা মিলিয়াছে, এই ডোবাটি ঠিক সেই জায়গায়। এই স্থানের ৪ মাইল উত্তর-পশ্চিমে একটি পাহাড় আছে—তাহার উচ্চতা ১৪২৩ ফিট। এই পাহাড়ের পিছনে শত্রু তাহার কামান রাখিয়াছে; সেখান হইতে রাস্তার চৌমাথা এবং তাহার দক্ষিণে যে স্থান তাহার উপর আক্রমণ চালানো যায়। এই জায়গাটি যদি দখল করা যায় তাহা হইলে শত্রুর পরিকল্পনা ব্যর্থ করা সম্ভব হইবে।

 এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে সেকেণ্ড লেফট্‌ন্যাণ্ট জ্ঞান সিংএর অধীনে আজাদ হিন্দ ফৌজের একটি কোম্পানি রাখা হইল। জ্ঞান সিং আজাদ হিন্দ ফৌজের অফিসার ট্রেনিং স্কুলে শিক্ষালাভ করিয়াছিলেন।

 এই কোম্পানীতে ৯৮ জন লােক ছিল। তাহাদের কোন মেসিন্ গান বা এমন কি হাল্‌কা কামানও ছিল না। দুটি এটি-কে (ট্যাঙ্ক বিধ্বংশী) মাইন্ ছাড়া তাহাদের আক্রমণ বা আত্মরক্ষার জন্য ছিল কেবল পুরাতন বন্দুক। তাহাদের উপর আদেশ ছিল—যে উপায়েই হউক শত্রুর অগ্রগতি বােধ করিতে হইবে।

 তাহারা দুইদিন এই স্থানে রহিল; শত্রু অগ্রসর হইল না।

 তারপর ১৬ই মার্চ (১৯৪৫) সকাল হইতে বিপক্ষের জঙ্গী বিমান তাহাদের উপর বোমা বর্ষণ এবং মেসিন গান্ হইতে গুলি চালাইতে আরম্ভ করিল। প্রায় বেলা ১১টার সময় বোমা নিঃশেষিত হইলে এরোপ্লেন্‌গুলি চলিয়া গেল। তারপর আরম্ভ হইল পাহাড়ের পিছন হইতে শত্রুর কামান গর্জ্জন।

 এই কামানের গোলাবর্ষণের আশ্রয়ে একদল যান্ত্রিক মোটার বাহিনী আমাদের সৈন্যদের দিকে অগ্রসর হইল। এই দলে ছিল ১৩টি ট্যাঙ্ক, ১১টি আর্মার্ড-কার্ এবং ১০টি ট্রাক্। এই দলের অর্দ্ধেক সোজা ডোবাটির দিকে চলিল। সেখানে আমাদের কোম্পানির দুইটি অগ্রগামী প্লেটুন্ ছিল। আর্মার্ড কারগুলি হইতে তাহাদের উপর বিস্ফোরক বর্ষিত হইতে লাগিল। কিন্তু আমাদের সৈনিকেরা ইহাতে ভীত হইল না এবং পরিখার মধ্যেই আমাদের পদাতিক বাহিনীর জন্য অপেক্ষা করিতে লাগিল।

 ট্যাঙ্ক এবং আর্মার্ড কার্‌গুলি ইস্পাতনির্মিত দৈত্যের ন্যায় অগ্নি বর্ষণের দ্বারা নরককুণ্ডের সৃষ্টি করিয়া এত কাছে আসিয়া পড়িল যে তাহাদের ভারের চাপে আমাদের সৈনিকদের পিষিয়া মরিবার আশঙ্কা হইল। তাহাদের পথের উপর দুটি মাইন্ ছুঁড়িয়া ফেলা হইল। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে মাইন্ দুটিই ফাটিল না। কিন্তু একটা জিনিষ হইল—তাহার ফলে ঐ দৈত্যগুলির গতি বন্ধ হইয়া গেল। বন্ধ হইবার সঙ্গে সঙ্গে সেগুলি পিল্-বাক্সে পরিণত হইল এবং তাহার মধ্য হইতে অমানুষিক মৃত্যুবর্ষী মারণাস্ত্র বাহির হইতে লাগিল।

 এই দলটি এবং ব্যাটেলিয়নের হেড্ কোয়ার্টারের মধ্যে কোন যোগসূত্র ছিল না। জ্ঞান সিং বুঝিলেন যে তাঁহাদের রাইফেলের গুলি শত্রুর মোটারবাহিত মেসিন গান্, হাল্কা স্বতঃচালিত (অটোমেটিক্) এবং হাত গ্রেনেডের মোটেই সমকক্ষ নয় এবং পরিখায় থাকা মানে নিশ্চিত মৃত্যু বা বন্দী দশা; অথচ শত্রুর কোন ক্ষতির সম্ভাবনাই নাই। তখন তিনি আদেশ দিলেন—‘আক্রমণ কর’ (‘চার্জ্’)।

 এই আক্রমণে নেতৃত্ব করিলেন তিনি নিজে। তিনি উচ্চৈঃস্বরে বলিলেন—‘নেতাজীকি জয়’, ‘ইন্‌কিলাব্ জিন্দাবাদ’, ‘আজাদ হিন্দুস্থান জিন্দাবাদ’, ‘চলো দিল্লী’। সমস্ত সৈনিক একযোগে তাহার পুনরাবৃত্তি করিল এবং শত্রুর কামানের শব্দ ছাপাইয়া সেই ধ্বনি প্রতিধ্বনিত হইল। শত্রুর উৎকৃষ্ট যান্ত্রিক অস্ত্রসজ্জার বিরুদ্ধে আমাদের বীর সৈনিকদের ইহাই ছিল একমাত্র সম্বল। ভারতের নামে—ভারতের স্বাধীনতার জন্য তাহার শত্রুর মোটার বাহিনীর উপর ঝাঁপাইয়া পড়িল।

 শত্রু তখনি থামিয়া গেল। ইহার পর আরম্ভ হইল হাতাহাতি যুদ্ধ। দুই ঘণ্টা এইরূপ চলিল। আমাদের বীরবৃন্দ পরাজয় বরণ কিছুতেই করিবে না। তাহাদের মধ্যে ৪০ জন দ্বিগুণ-সংখ্যক শত্রু নাশ করিয়া প্রাণ বিসর্জ্জন দিল। তাহাদের অদম্য তেজে শত্রু বিপর্য্যস্ত হইয়া পশ্চাদপসরণ করিতে লাগিল।

 ঠিক সেই সময় জ্ঞান সিং তাঁহার ৩ নং প্লেটুনের কম্যাণ্ডার সেকেণ্ড্ লেফট্‌ন্যাণ্ট্ রাম সিংকে ডাকিয়া আদেশ দিতেছিলেন। এমন সময় একটি বুলেট আসিয়া তাঁহার মাথায় লাগিল। তিনি পড়িয়া গেলেন; অর্ডার আর তাঁহাকে দিতে হইল না।

 ইহার পর সেকেণ্ড লেফট্‌ন্যাণ্ট্ রাম সিং অবশিষ্ট সেনাদলকে একত্র করিয়া পুনরায় সংগঠিত করিলেন।

 লেফট্‌ন্যাণ্ট জ্ঞান সিং তাঁহার সৈনিকদের বলিতেন যে তিনি তাহাদেরই সঙ্গে মৃত্যুবরণ করিবেন। তিনি তাঁহার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করিয়াছিলেন এবং জীবনে মরণে তাঁহার সঙ্গীদের সহিতই ছিলেন। ইতিহাস চিরদিন এই গৌরবময় বীরত্বের কাহিনীর সাক্ষ্য থাকিবে। লেফট্‌ন্যাণ্ট জ্ঞান সিং এবং তাঁহার জীবনের আদর্শ ছিল আমাদের মহান্ নেতা—নেতাজীর আদর্শ। তাঁহারা রণক্ষেত্রে যুদ্ধে প্রাণ দান করিয়া আমাদের অনুসরণের জন্য এক ঐতিহ্য সৃষ্টি করিয়া গিয়াছেন। এই সকল বীর পরাজয় কাহাকে বলে জানেন নাই। স্বাধীন ভারতে বংশপরম্পরা তাঁহাদের স্মৃতি ভারতবাসী পূজা করিবে এবং এইরূপ উচ্চ আদর্শে জীবন গঠন করিতে ভারতবাসীকে অনুপ্রাণিত করিবে।”


 এই বীরত্বের কাহিনী সত্যই অপূর্ব। আজাদ হিন্দ বাহিনীর সভ্য বলিয়া গর্ব অনুভব করিলাম।