আজাদী সৈনিকের ডায়েরী/মণিপুর অভিযানের ব্যর্থতার কারণ

১লা আগষ্ট ১৯৪৪:

 অমর মণিপুর ও কোহিমা অধিকার করিয়াছিলাম। কিন্তু ভারতের মাটিতে পদার্পণ করিয়া আবার ফিরিয়া আসিতে হইয়াছে। মণিপুরে আমাদের অভিযানের ব্যর্থতা অনেকের মনে হতাশা র সৃষ্টি করিয়াছে। মণিপুরে বর্ষার ফলে রণক্ষেত্রের রাস্তা কর্দমে পূর্ণ হইয়া যাওয়ায় সৈন্য় চলাচল এবং খাদ্য ও অস্ত্রাদি প্রেরণ অসম্ভব হইয়া পড়ে। তাহার উপর আকাশ হইতে বিমান বাহিনীর সাহায্য পাইলে আমাদের বীর সৈনিকদের অগ্রগতি রুদ্ধ হইত না। আজ নেতাজীর বিবরণ লোকের মনে পুনরায় অংশার সঞ্চার করিয়াছে—অমাদের নূতন অভিযান শীঘ্রই আরম্ভ হইবে। নেতাজী বলিয়াছেন:—

 ‘আজাদ হিন্দ বাহিনীর অগ্রবর্ত্তী দলণ্ডলি ১৯৪৪ সানের মার্চ মাসে ভারত-ব্রহ্ম সীমান্ত অতিক্রম করে। সুতরাং এখন ভরিতের স্বাধীনতার জন্য ভারতের মাটিতেই যুদ্ধ আরম্ভ হইয়াছে।

 ‘ব্রিটিশগণ এক শতাব্দীর অধিক কাল ভারতকে অধীন করিয়া রাখিয়াছেন এবং তাঁহাদের হইয়া লড়িবার জন্য বিদেশী সৈন্য আমদানী করিয়াছেন। এই প্রকারে আমাদের বিরুদ্ধে এক প্রবল শক্তিশালী বাহিনী নিযুক্ত হইয়াছে। আমাদের সৈন্যরা আমাদের দাবীর যৌক্তিকতায় অনুপ্রাণিত হইয়া ভারত ব্রহ্ম সীমান্ত অতিক্রমের পর অধিকতর সুসজ্জিত বিভিন্ন জাতীয় শত্রুসৈন্যের সম্মুখীন হইয়াছে এবং প্রত্যেক যুদ্ধে তাহাদের পরাজিত করিয়াছে। দেখা গিয়াছে যে আমাদের সৈন্যরা অধিকতর সুশিক্ষিত এবং শৃঙ্খলাপরায়ণ। স্বাধীনতা লাভের জন্য মৃত্যুপণ করিয়া অটল সঙ্কল্প লইয়া তাহারা অনায়াসে শত্রুপক্ষ অপেক্ষা নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করে। প্রত্যেকবার পরাজিত হওয়ায় শত্রুর মনোবল ক্ষুণ্ণ হইয়াছে।

 ‘অত্যন্ত কঠিন অবস্থার মধ্যেও যুদ্ধ করিয়া আমাদের অফিসার ও সৈন্যগণ অসীম সাহস ও বীরত্বের পরিচয় দিয়াছেন এবং সকলের প্রশংসাভাজন হইয়াছেন। দেহের রক্ত এবং জীবন দান করিয়া এই সকল বীর যে ঐতিহ্যের সৃষ্টি করিয়াছেন ভারতের ভাবী সৈনিকগণকে তাহা রক্ষা করিয়া চলিতে হইবে।

 ‘যখন ইম্ফল আক্রমণের আয়োজন সমস্ত ঠিক, সেই সময় প্রবল বৃষ্টি আরম্ভ হয় এবং রণকৌশলের দিক হইতে ইম্ফল আক্রমণ অসম্ভব হইয়া পড়ে। প্রাকৃতিক বাধাবিপত্তির ফলে আমাদের আক্রমণ স্থগিত রাখিতে হয়। আক্রমণ স্থগিত রাখার পর দেখা গেল যে, আমাদের সৈন্যগণ যে সকল স্থান অধিকার করিয়াছিল, সেগুলি দখল করিয়া রাখা অসুবিধাজনক হইয়া পড়িয়াছে। আত্মরক্ষার পক্ষে অধিকতর অনুকূল স্থান লাভের জন্য আমাদের সৈন্যদের সরাইয়া লইবার প্রয়োজন দেখা যায়।

 ‘এই সিদ্ধান্ত অনুসারে আমাদের সৈন্যগণকে আত্মরক্ষার পক্ষে অধিকতর অনুকূল স্থানে সরাইয়া লইয়া আসা হইয়াছে।

 ‘যুদ্ধ বিরতির এই সময়ের মধ্যে আমরা আমাদের আয়োজন এমন সম্পূর্ণ করিয়া তুলিব, যে আবহাওয়া ভালো হইবার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা পুনরায় আক্রমণ করিতে পারিব।

 ‘যুদ্ধক্ষেত্রের কয়েক অংশে শত্রুকে একবার পরাজিত করিবার পব, চূড়ান্ত জয়লাভ এবং আক্রমণকারী ইঙ্গ মার্কিন সৈন্যদলের ধ্বংসসাধন সম্বন্ধে আমাদের বিশ্বাস দশগুণ বৃদ্ধি পাইয়াছে। আমাদের সমস্ত আয়োজন সম্পূর্ণ হইবামাত্র আমরা পুনরায় উন্নততর রণনৈপুণ্য, অদম্য সাহস এবং আমাদের অফিসার ও সৈন্যদের কর্ত্তব্যের প্রতি অবিচলিত নিষ্ঠা লইয়া শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড আক্রমণ চালাইব। জয়লাভ আমরা নিশ্চয়ই করিব।

 ‘এই যুদ্ধে আমাদের যে সকল বীর নিহত হইয়াছেন, তাঁহাদের পরলোকগত আত্মা ভারতবর্ষের স্বাধীনতালাভের সংগ্রামের পরবর্ত্তী অধ্যায়ে মাদিগকে আরও বীরত্বপূর্ণ কার্য্য করিতে উৎসাহিত করিবে।’

৫ই আগষ্ট ১৯৪৪:

 আজ সিঙ্গাপুর হইতে লেফটন্যাণ্ট মূর্ত্তি আসিয়াছেন। তিনি আমায় বলিলেন—‘তুমি টোকিও মিলিটারী একাডেমীর শিক্ষার সুযোগ লইলে না। এরূপ সুযোগ খুব কমই আসিবে। বৃদ্ধ না হইলে আমি যাইতাম।’

 তাঁহার নিকট জানিলাম, গত ১০ই মার্চ শিক্ষার্থীদের প্রথম দল টোকিও গিয়াছে; সেই দলে ৩৫ জন ছিল। ইহারা টোকিও মিলিটারী একাডেমী এবং বিমান বাহিনী শিক্ষালয়ে শিক্ষালাভ করিতেছে। আগামী মাসে আরও ১৫ জন যাইবে।

৭ই আগষ্ট ১৯৪৪:

 আজাদ হিন্দ ব্যাঙ্কে আজ টাকা অনিতে গিয়াছিলাম। ব্যাঙ্কের কাজ খুব ভালো চলিতেছে এবং এই অল্প সময়ের মধ্যে ইহা প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়াছে। ভারতীয় ব্যবসায়ীদের ব্যাঙ্কের অভাবে অসুবিধা হইতেছিল; এখন সেই অসুবিধা দূর হইয়াছে। বর্মীরা পর্য্যন্ত এই ব্যাঙ্কেই টাকা রাখা বেশী নিরাপদ মনে করে।

 ব্যাঙ্কের একজন কর্মচারীর নিকট জানিলাম-ব্যাঙ্কে অজাদ হিন্দ গভর্ণমেণ্টেরই জমা আছে ১ কোটি ৫৩ লক্ষ ডলার; তাহা ছাড়া সাধারণের আমানত জমা আছে।

 আজাদ হিন্দ গভর্ণমেণ্ট স্থাপনের পর হইতে এদেশে ভারতীয়দের সম্মান এবং প্রতিপত্তি বৃদ্ধি পাইয়াছে। পূর্বে ইহারা ছিল এদেশে নিরুপায় প্রবাসী—সহায়হীন। বিদেশী রাষ্ট্রের দয়ার উপর নির্ভর করিতে হইত এবং লুণ্ঠন ও অত্যাচারের হাত হইতে রক্ষার কেহ ছিল। আজ আর সে দিন নাই। প্রবাসী ভারতবাসী আজ সঙ্ঘবদ্ধ ও শক্তিশালী। অনেক ভারতীয় ব্যবসায় করিয়া প্রচুর অর্থ উপার্জ্জন করিতেছে।