আনন্দমঠ (১৮৮৩)/দ্বিতীয় খণ্ড/ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ
ঊনবিংশ পরিচ্ছেদ।
পূর্ণিমার রাত্রি!—সেই ভীষণ রণক্ষেত্র এখন স্থির। সেই ঘোড়ার দড়বড়ি, বন্দুকের কড়কড়ি, কামানের গুম্,—সর্ব্ব-ব্যাপীধূম, আর কিছুই নাই। কেহ হুর্রে বলিতেছে না—কেহ হরিধ্বনি করিতেছে না। শব্দ করিতেছে—কেবল শৃগাল, কুক্কুর, গৃধিনী। সর্ব্বোপরি, আহত ব্যক্তির ক্ষণিক আর্ত্তনাদ। কেহ ছিন্নহস্ত, কেহ ভগ্নমস্তক, কাহারও পা ভাঙ্গিয়াছে, কাহারও পঞ্জর বিদ্ধ হইয়াছে, কেহ ঘোড়ার নীচে পড়িয়াছে। কেহ ডাকিতেছে মা! কেহ ডাকিতেছে বাপ! কেহ চায় জল, কাহারও কামনা মৃত্যু। ‘বাঙ্গালী, হিন্দুস্থানী, ইংরেজ, মুসলমান, একত্র জড়াজডি; জীবন্তে মৃতে; মনুষ্যে অশ্বে, মিশামিশি ঠেসাঠেসি হইয়া পড়িয়া রহিয়াছে। সেই মাঘ মাসের পূর্ণিমার রাত্রে, দারুণ শীতে, উজ্জ্বল জ্যোৎস্নালোকে সেই রণভূমি অতি ভয়ঙ্কর দেখাইতেছিল। সেখানে আসিতে কাহারও সাহস হয় না।
কাহারও সাহস হয় না, কিন্তু নিশীথকালে, এক রমণী সেই অগম্য রণক্ষেত্রে বিচরণ করিতেছিল। একটী মসাল জ্বালিয়া সেই শবরাশির মধ্যে সে কি খুঁজিতেছিল। প্রত্যেক মৃতদেহের মুখের কাছে মশাল লইয়া মুখ দেখিয়া, আবার অন্য শবের কাছে মশাল লইয়া যাইতেছিল। কোথাও, কোন নরদেহ মৃত অশ্বের নীচে পড়িয়াছে; সেখানে যুবতী, মশাল মাটিতে রাখিয়া, অশ্বটী দুই হাতে সরাইয়া নরদেহ উদ্ধার করিতেছিল। তার পর যখন দেখিতে পায়, যে যাকে খুঁজিতেছি সে নয়, তখন মসাল তুলিয়া লইয়া সরিয়া যায়। এইরূপ অনুসন্ধান করিয়া, যুবতী সকল মাঠ ফিরিল—যা খুঁজে তা কোথাও পাইল না। তখন মশাল ফেলিয়া, সেই শবরাশিপূর্ণ রুধিরাক্ত ভূমিতে লুঠাইয়া পড়িয়া কাঁদিতে লাগিল। সে শান্তি, জীবানন্দের দেহ খুঁজিতেছিল।
শান্তি লুঠাইয় পড়িয়া কাঁদিতে লাগিল, এমন সময়ে এক অতি মধুর সকরুণধ্বনি তাহার কর্ণরন্ধ্রে প্রবেশ করিল। কে যেন বলিতেছে, “উঠ মা! কাঁদিও না।” শান্তি চাহিয়া দেখিল—দেখিল সম্মুখে জ্যোস্নালোকে দাঁড়াইয়া, এক অপূর্ব্বদৃশ্য প্রকাণ্ডাকার জটাজুটধারী মহাপুরুষ।
শান্তি উঠিয়া দাঁড়াইল। যিনি আসিয়াছিলেন তিনি বলিলেন, “কাঁদিও না মা! জীবানন্দের দেহ আমি খুঁজিয়া দিতেছি। তুমি আমার সঙ্গে আইস।”
তখন সেই পুরুষ শান্তিকে রণক্ষেত্রের মধ্যস্থলে লইয়া গেলেন; সেখানে অসংখ্য শবরাশি উপর্য্যুপরি পড়িয়াছে। শান্তি তাহা সকল নাড়িতে পারে নাই। সেই শবরাশি নাড়িয়া, সেই মহাবলবান্ পুরুষ এক মৃতদেহ বাহির করিলেন। শান্তি চিনিল সেই জীবানন্দের দেহ। সর্ব্বাঙ্গ ক্ষতবিক্ষত, রুধিরে পরিপ্লুত। শান্তি, সামান্য স্ত্রীলোকের ন্যায় উচ্চৈঃস্বরে কাঁদিতে লাগিল।
আবার, তিনি বলিলেন, “কাঁদিও না মা! জীবানন্দ কি মরিয়াছে? স্থির হইয়া উহার দেহ পরীক্ষা করিয়া দেখ। আগে নাড়ী দেখ।”
শান্তি শবের নাড়ি টিপিয়া দেখিল, কিছু মাত্র গতি নাই। সেই পুরুষ বলিলেন, “বুকে হাত দিয়া দেখ।”
যেখানে হৃৎপিণ্ড, শাস্তি সেইখানে হাত দিয়া দেখিল, কিছুমাত্র গতি নাই; সব শীতল।
সেই পুরুষ আবার বলিলেন, “নাকের কাছে হাত দিয়া দেখ—কিছু মাত্র নিঃশ্বাস বহিতেছে কি?”
শান্তি দেখিল, কিছু মাত্র না।
সেই পুরুষ বলিলেন, “আবার দেখ, মুখের ভিতর আঙ্গুল দিয়া দেখ—কিছু মাত্র উষ্ণতা আছে কি না?” শান্তি আঙ্গুল দিয়া দেখিয়া বলিল, “বুঝিতে পারিতেছি না।” শান্তি আশামুগ্ধ হইয়াছিল।
মহাপুরুষ, বামহস্তে জীবানন্দের দেহ স্পর্শ করিলেন। বলিলেন, “তুমি ভয়ে হতাশ হইয়াছ! তাই বুঝিতে পারিতেছ না—শরীরে কিছু তাপ এখনও আছে বোধ হইতেছে। আবার দেখ দেখি।”
শান্তি তখন আবার নাড়ী দেখিল, কিছু গতি আছে। বিস্মিত হইয়া হৃৎপিণ্ডের উপর হাত রাখিল—একটু ধক্ ধক্ করিতেছে। নাকের আগে আঙ্গুল রাখিল—একটু নিশ্বাস বহিতেছে! মুখের ভিতর অল্প উষ্ণতা পাওয়া গেল। শাস্তি বিস্মিত হইয়া বলিল, “প্রাণ ছিল কি? না, আবার আসিয়াছে?”
তিনি বলিলেন, “তাও কি হয় মা! তুমি উহাকে বহিয়া পুষ্করিণীতীরে আনিতে পারিবে? আমি চিকিৎসক, উহার চিকিৎসা করিব।”
শান্তি অনায়াসে জীবানন্দকে কোলে তুলিয়া পুকুরের দিকে লইয়া চলিল। চিকিৎসক বলিলেন, “তুমি ইহাকে পুকুরে লইয়া গিয়া, রক্ত সকল ধুইয়া দাও। আমি ঔষধ লইয়া যাইতেছি।”
শন্তি জীবানন্দকে পুষ্করিণীতীরে লইয়া গিয়া রক্ত ধৌত করিল। তখনই চিকিৎসক বন্য লতা পাতার প্রলেপ লইয়া আসিয়া সকল ক্ষতমুখে দিল। তার পর, বারম্বার জীবানন্দের সর্ব্বাঙ্গে হাত বুলাইল। তখন জীবানন্দ এক দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়িয়া উঠিয়া বসিল। শান্তির মুখপানে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “যুদ্ধে করে জয় হইল?”
শান্তি বলিল, “তোমারই জয়। এই মহাত্মাকে প্রণাম কর।”
তখন উভয়ে দেখিল কেহ কোথাও নাই! কাহাকে প্রণাম করিবে?
নিকটে বিজয়ী সন্তানসেনার বিষম কোলাহল শুনা যাইতেছিল, কিন্তু, শান্তি বা জীবানন্দ কেহই উঠিল না—সেই পূর্ণচন্দ্রের কিরণে সমুজ্জ্বল পুষ্করিণীর সোপানে বসিয়া রহিল। জীবানন্দের শরীর ঔষধের গুণে, অতি অল্প সময়েই সুস্থ হইয়া আসিল। তিনি বলিলেন, “শান্তি! সেই চিকিৎসকের ঔষধের আশ্চর্য্যগুণ! আমার শরীরে আর কোন বেদনা বা গ্লানি নাই—এখন কোথায় যাইবে চল। ঐ সন্তানসেনার জয়ের উৎসবের গোল শুনা যাইতেছে!”
শান্তি বলিল “আর ওখানে না। মার কার্য্যোদ্ধার হইয়াছে—এ দেশ সন্তানের হইয়াছে। আমরা রাজ্যের ভাগ চাহি না—এখন আর কি করিতে যাইব?”
জী। যা কাড়িয়া লইয়াছি, তা বাহুবলে রাখিতে হইবে।
শা। রাখিবার জন্য মহেন্দ্র আছেন, সত্যানন্দ স্বয়ং আছেন। তুমি প্রায়শ্চিত্ত করিয়া সন্তানধর্ম্মের জন্য দেহ ত্যাগ করিয়াছিলে; এ পুনঃপ্রাপ্ত দেহে সন্তানের আর কোন অধিকার নাই। আমরা সন্তানের পক্ষে মরিয়াছি। এখন আমাদের দেখিলে সন্তানেরা বলিবে জীবন যুদ্ধের সময়ে প্রায়শ্চিত্তভয়ে লুকাইয়াছিল, জয় হইয়াছে দেখিয়া রাজ্যের ভাগ লইতে আসিয়াছে।
জী। সে কি শান্তি? লোকের অপবাদভয়ে আপনার কাজ ছাড়িব? আমার কাজ মাতৃসেবা; যে যা বলুক না কেন, আমি মাতৃসেবাই করিব।
শা। তাতে তোমার আর অধিকার নাই—কেন না তোমার দেহ মাতৃসেবার জন্য পরিত্যাগ করিয়াছ। যদি আবার মার সেবা করিতে পাইলে, তবে তোমার প্রায়শ্চিত্ত কি হইল? মাতৃসেবায় বঞ্চিত হওয়াই, এ প্রায়শ্চিত্তের প্রধান অংশ। নহিলে শুধু তুচ্ছ প্রাণ পরিত্যাগ কি বড় একটা ভারি কাজ?
জী। শান্তি! তুমিই সার বুঝিতে পার। আমি এ প্রায়শ্চিত্ত অসম্পূর্ণ রাখিব না। আমার সুখ সন্তানধর্ম্মে—সে সুখে আপনাকে বঞ্চিত করিব। কিন্তু যাইব কোথায়? মাতৃসেবা ত্যাগ করিয়া, গৃহে গিয়া ত সুখভোগ করা হইবে না।
শা। তা কি আমি বলিতেছি? ছি! আমরা আর গৃহী নহি; এমনই দুইজনে সন্ন্যাসীই থাকিব—চিরব্রহ্মচর্য পালন করিব। চল, এখন গিয়া আমরা দেশে দেশে তীর্থদর্শন করিয়া বেড়াই।
জী। তার পর?
শা। তার পর—হিমালয়ের উপর কুটীর প্রস্তুত করিয়া, দুই জনে দেবতার আরাধনা কবিব—যাতে মার মঙ্গল হয়, সেই বর মাগিব। তখন দুইজনে উঠিয়া, হাত ধরাধরি করিয়া জ্যোৎস্নাময় নিশীথে অনন্তে অন্তর্হিত হইল।
হায়! আবার আসিবে কি মা! জীবানন্দের ন্যায় পুত্র, শান্তির ন্যায় কন্যা, আবার গর্ভে ধরিবে কি?