আনন্দমঠ (১৮৮৩)/দ্বিতীয় খণ্ড/অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ

অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ।

 উড্‌ পাকা ইংরেজ। ঘাটিতে ঘাটিতে, তাহার লোক ছিল। শীঘ্র তাহার নিকটে খবর পৌঁছিল, যে সেই বৈষ্ণবীটা লিণ্ডলে সাহেবকে ফেলিয়া দিয়া আপনি ঘোড়ায় চড়িয়া কোথায় চলিয়া গিয়াছে। শুনিয়াই মেজর উড্‌ বলিলেন “An imp of Satan! Strike the tents."  তখন ঠক্ ঠক্ খটা খট্‌ তাম্বুর খোঁটায় মুগুরের ঘা পড়িতে লাগিল। মেঘরচিত অমরাবতীর ন্যায় বস্ত্রনগরী অন্তর্হিতা হইল। মাল গাড়িতে বোঝাই হইল। মানুষ ঘোড়ায় অথবা আপনার পায়ে। হিন্দু মুসলমান মাদরাজী গোরা বন্দুক ঘাড়ে মস্‌ মস্ করিয়া চলিল। কামানের গাড়ি ঘড়োর ঘড়োর করিতে করিতে চলিল।

 এদিকে মহেন্দ্র সন্তানসেনা লইয়া ক্রমে কেন্দুবিল্লের পথে অগ্রসর। সেই দিন বৈকালে মহেন্দ্র ভাবিল, বেলা পড়িয়া আসিল। শিবির সংস্থাপন করা যাক।

 তখন শিবির সংস্থাপন উচিত বোধ হইল। বৈষ্ণবের তাঁবু নাই। গাছ তলায় গুণ চট বা কাঁথা পাতিয়া, শয়ন করে। একটু হরিচরণামৃত খাইয়া রাত্রি যাপন করে। ক্ষুধা যে টুকু বাকি থাকে, স্বপ্নে বৈষ্ণবী ঠাকুরাণীর অধরামৃত পান করিয়া পরিপূরণ করে। শিবিরোপযোগী নিকটে একটী স্থান ছিল। একটা বড় বাগান—আম কঁঠাল বাবলা তেঁতুল। মহেন্দ্র আজ্ঞা দিলেন “এই খানেই শিবির কর।” তারি পাশে একটা পাহাড় ছিল, উঠিতে বড় বন্ধুর, মহেন্দ্র একবার ভাবিলেন এ পাহাড়ের উপর শিবির করিলেও হয়। স্থান টা দেখিয়া আসিবেন মনে করিলেন।

 এই ভাবিয়া মহেন্দ্র অশ্বে আরোহণ করিয়া ধীরে ধীরে পর্ব্বতশিখরে উঠিতে আরম্ভ করিলেন। তিনি কিছু দূর উঠিলে পর এক যুবা যোদ্ধা বৈষ্ণবসেনামধ্যে প্রবিষ্ট হইয়া বলিল, “চল, পর্ব্বতে, চড়।” নিকটে যাহারা ছিল তাহারা বিস্মিত হইয়া বলিল “কেন?”

 যোদ্ধা এক শিলাখণ্ডের উপর উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, “চল এই জ্যোৎস্নারাত্রে ঐ পর্ব্বতশিখরে, নূতন বসন্তের নূতন ফুলের গন্ধ শুঁকিতে শুঁকিতে আজ আমাদের শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধ করিতে হইবে।” সন্তানেরা দেখিল সেনাপতি জীবানন্দ।

 তখন “হরে মুরারে” উচ্চ শব্দ করিয়া যাবতীয় সন্তানসেনা বল্লমে ভর করিয়া উঁচু হইয়া উঠিল। এবং সেই সেনা জীবানন্দের অনুকরণ পূর্ব্বক বেগে পর্ব্বতশিখরে আরোহণ করিতে লাগিল। একজন সজ্জিত অশ্ব আনিয়া জীবানন্দকে দিল। দূর হইতে মহেন্দ্র দেখিয়া বিস্মিত হইল। ভাবিল একি এ? না বলিতে ইহারা আসে কেন?

 এই ভাবিয়া মহেন্দ্র ঘোড়ার মুখ ফিরাইয়া ঘোড়ার পিঠে চাবুকের ঘায়ের ধোঁয়া উঠাইয়া দিয়া পর্ব্বত অবতরণ করিতে লাগিলেন। সন্তানবাহিনীর অগ্রবর্ত্তী জীবানন্দের সাক্ষাৎ পাইয়া, জিজ্ঞাসা করিলেন। “এ আবার কি আনন্দ।”

 জীবানন্দ হাসিয়া বলিল। “অজি বড় আনন্দ। পাহাড়ের ওপিঠে উড সাহেব। যে আগে উপরে উঠ্‌বে তারি জিত।”

 তখন জীবানন্দ সন্তানসৈন্যের প্রতি ডাকিয়া বলিলেন;

 “চেন তোমরা! আমি জীবানন্দ গোস্বামী। অজয়তীরে সহস্র ইংরেজের প্রাণবধ করিয়াছি।”

 তুমুল নিনাদে পর্ব্বত কন্দর কানন প্রান্তর সব ধ্বনিত করিয়া শব্দ হইল “চিনি আমরা! তুমি জীবানন্দ গোস্বামী।”

 জীব। বল হরে মুরারে!

 পর্ব্বত কন্দর কানন প্রান্তর সহস্র সহস্র কণ্ঠে ধ্বনিত হইল, “হরে মুরারে!”

 জীব। পাহাড়ের ওপিঠে শত্রু। আজ এই পর্ব্বতশিখরে, এই নীলাম্বরী যামিনী সাক্ষাৎকার, সন্তানেরা রণ করিবে। দ্রুত আইস, যে আগে শিখরে উঠিবে, সেই জিতিবে। বল, “বন্দে মাতরং।”

 তখন পর্ব্বত কন্দর কানন প্রান্তর ধ্বনিত করিয়া গীতধ্বনি উঠিল “বন্দে মাতরং।” ধীরে ধীরে সন্তানসেনা পর্ব্বতশিখর আরোহণ করিতে লাগিল; কিন্তু তাহারা সহসা সভয়ে দেখিল, মহেন্দ্র সিংহ অতি দ্রুতবেগে পর্ব্বত অবতরণ করিতে করিতে তূর্য্যনিনাদ করিতেছে। দেখিতে দেখিতে পর্ব্বতশিখরদেশে নীলাকাশপটে কামানশ্রেণীসহিত, ইংরেজের গোলন্দাজ সেনা শোভিত হইয়াছে। উচ্চৈঃস্বরে বৈষ্ণবী সেনা গায়িল,

তুমি বিদ্যা তুমি ভক্তি,
তুমি মা বাহুতে শক্তি
ত্বং হি প্রাণাঃ শরীরে।

 কিন্তু ইংরেজের কামানের গুড়ুম গুড়ুম গুম শব্দে, সে মহাগীতিশব্দ ভাসিয়া গেল। শত শত সন্তান হত আহত হইয়া, অশ্ব অস্ত্র সহিত, পর্ব্বত সানুদেশে শয়ান হইল। আবার গুড়ুম গুম দধিচির অস্থিকে ব্যঙ্গ করিয়া সমুদ্রের তরঙ্গভঙ্গকে তুচ্ছ করিয়া, ইংরেজের বজ্র গড়াইতে লাগিল। চাসার কর্ত্তনীসম্মুখে সুপক্ব ধান্যের ন্যার সন্তানসেনা খণ্ডবিখণ্ড হইয়া ধরাশায়ী হইতে লাগিল। বৃথায় জীবানন্দ, বৃথায় মহেন্দ্র যত্ন করিতে লাগিল। পতনশীল শিলারাশির ন্যায় সন্তানসেনা পর্ব্বতসানু হইতে ফিরিতে লাগিল। কে কোথায় পলায় ঠিকানা নাই। তখন একেবারে সকলের বিনাশসাধনের জন্য হুর্‌রে! হুর্‌রে! শব্দ করিতে করিতে গোরার পণ্টন পাহাড় হইতে নামিল। সঙ্গীন উঁচু করিয়া অতি দ্রুতবেগে, পর্ব্বতবিমুক্ত বিশালতটিনীপ্রপাতবৎ দুর্দ্দমনীয় অলঙ্ঘ্য অজেয় ব্রিটিশসেনা, পলায়নপর সন্তানসেনার পশ্চাৎ ধাবিত হইল? জীবা-

নন্দ একবার মাত্র মহেন্দ্রের সাক্ষাৎ পাইয়া বলিলেন, “আজ শেষ। এস এই খানে মরি।”

 মহেন্দ্র বলিল, “মরিলে যদি রণজয় হইত তবে মরিতাম। বৃথা মৃত্যু বীরের ধর্ম্ম নহে।”

 জীব। আমি বৃথাই মরিব। তবু যুদ্ধে মরিব। তখন পাছু ফিরিয়া, উচ্চৈঃস্বরে জীবানন্দ ডাকিল, “কে হরিনাম করিতে করিতে মরিতে চাও, আমার সঙ্গে আইস।”

 অনেকে অগ্রসর হইল। জীবানন্দ বলিল, “অমন নহে। হরিসাক্ষাৎ শপথ কর, জীবন্তে ফিরিবে না।”

 যাহারা আগু হইয়াছিল, তাহারা পিছাইল। জীবানন্দ বলিলেন,

 “কেহ আসিবে না? তবে আমি একা চলিলাম।”

 জীবানন্দ অশ্বপৃষ্ঠে উঁচু হইয়া বহুদূর পশ্চাৎস্থিত মহেন্দ্রকে ডাকিয়া বলিলেন, “ভাই! নবীনানন্দকে বলিও আমি চলিলাম। লোকান্তরে সাক্ষাৎ হইবে।”

 এই বলিয়া সেই বীরপুরুষ লৌহবৃষ্টি মধ্যে বেগে অশ্বচালন করিলেন। বামহস্তে বল্লম, দক্ষিণে বন্দুক, মুখে হরে মুরারে! হরে মুরারে! হরে মুরারে! যুদ্ধের সম্ভাবনা নাই। এ সাহসে কোন ফল নাই—তথাপি হরে মুরারে! হরে মুরারে! গায়িতে গায়িতে জীবানন্দ শত্রুব্যূহমধ্যে প্রবেশ করিলেন।

 পলায়নপর সন্তানদিগকে মহেন্দ্র ডাকিয়া বলিল “দেখ, একবার তোমরা ফিরিয়া জীবানন্দ গোঁসাইকে দেখ। দেখিলে মরিবে না।”

 ফিরিয়া কতকগুলি সন্তান জীবানন্দের অমানুষী কীর্ত্তি দেখিল। প্রথমে বিস্মিত হইল, তার পর বলিল “জীবানন্দ মরিতে জানে, আমরা জানি না? চল জীবানন্দের সঙ্গে আমরাও বৈকুণ্ঠে যাই।”  এই কথা শুনিয়া, কতকগুলি সন্তান ফিরিল। তাহাদের দেখাদেখি আর কতকগুলি ফিরিল, তাহাদের দেখাদেখি আরও কতকগুলি ফিরিল। বড় একটা গণ্ডগোল উপস্থিত হইল। জীবানন্দ শত্রুব্যূহ প্রবেশ করিয়াছিলেন; সন্তানের আর কেহই তাঁহাকে দেখিতে পাইল না।

 এ দিকে সমস্ত রণক্ষেত্র হইতে সন্তানগণ দেখিতে পাইল, যে কতক সন্তানেরা আবার ফিরিতেছে। সকলেই মনে করিল সন্তানের জয় হইয়াছে, সন্তান শত্রুকে তাড়াইয়া যাইতেছে। তখন সমস্ত সন্তানসৈন্য মার মার শব্দে ফিরিয়া ইংরেজসৈন্যের উপর ধাবিত হইল।

 এদিকে ইংরেজসেনার মধ্যে একটা ভারি হুলস্থূল পড়িয়া গেল। সিপাহীর যুদ্ধে আর যত্ন না করিয়া দুই পাশ দিয়া পলাইতেছে; গোরারাও ফিরিয়া সঙ্গীন খাড়া করিয়া শিখরাভিমুখে ধাবমান হইতেছে। ইতস্ততঃ নিরীক্ষণ করিয়া মহেন্দ্র দেখিলেন, পর্ব্বতশিখরে অসংখ্য সন্তানসেনা দেখা যাইতেছে। তাহারা বীরদর্পে অবতরণ করিয়া, ইংরেজসেনা আক্রমণ করিতেছে। তখন ডাকিয়া সন্তানগণকে বলিলেন,

 “সন্তানগণ! ঐ দেখ পর্ব্বতশিখরে প্রভু সত্যানন্দ গোস্বামীর ধ্বংস দেখা যাইতেছে। আজ স্বয়ং মুরারি মধুকৈটভ-নিসূদন কংস কেশি-বিনাশন, রণে অবতীর্ণ, লক্ষ সন্তান পর্ব্বতপৃষ্ঠে। বল হরে মুরারে! হরে মুরারে! উঠ! মুসলমানের বুকে পিঠে চাপিয়া মার। লক্ষ সন্তান পর্ব্বতপিঠে।”

 তখন হরে মুরারের ভীষণ ধ্বনিতে পর্ব্বত কন্দর, কানন প্রান্তর মথিত হইতে লাগিল। সকল সন্তান মাভৈঃ মাভৈঃ রবে ললিততাল ধ্বনিসম্বলিত অস্ত্রের ঝঞ্ঝনায় সর্ব্ব জীব বিমোহিত করিল।

তেজে মহেন্দ্রের বাহিনী পর্ব্বত আরোহণ করিতে লাগিল। শিলাপ্রতিঘাতপ্রতিপ্রেরিত নির্ঝরিণীবৎ রাজসেনা বিলোড়িত, স্তম্ভিত, ভীত হইল। সেই সময়ে পঞ্চবিংশতি সহস্র সন্তানসেনা লইয়া স্বয়ং সত্যানন্দ ব্রহ্মচারী পর্ব্বত শিখর হইতে, সমুদ্র প্রপাতবৎ তাহাদের উপর বিক্ষিপ্ত হইলেন। তুমুল যুদ্ধ হইল।

 যেমন দুই খণ্ড প্রকাণ্ড প্রস্তরের সঙ্ঘর্ষে ক্ষুদ্র মক্ষিকা নিষ্পেষিত হইয়া যায়, তেমনি দুই সন্তানসেনা সঙ্ঘর্ষে সেই বিশাল রাজসৈন্য, পর্ব্বতসানুদেশে, নিঃশেষ নিষ্পেষিত হইল।

 ওয়ারেণ হেষ্টিংসের কাছে সংবাদ লইয়া যায়, এমন লোক রহিল না।