আনন্দমঠ (১৮৮৩)/দ্বিতীয় খণ্ড/সপ্তদশ পরিচ্ছেদ

সপ্তদশ পরিচ্ছেদ।

 তখন দুই জনে কানে কানে কি পরামর্শ করিল। পরামর্শ করিয়া জীবানন্দ এক বনে লুকাইল। শান্তি আর এক বনে প্রবেশ করিয়া এক অদ্ভূত রহস্যে প্রবৃত্ত হইল।

 শান্তি মরিতে যাইতেছিল, কিন্তু মৃত্যুকালে স্ত্রীবেশ ধরিবে ইহা স্থির করিয়াছিল। তাহার এই পুরুষবেশ জুয়াচুরি, মহেন্দ্র বলিয়ছে। জুয়াচুরি করিতে করিতে মরা হইবে না। সুতরাং ঝাঁপি টেপারিটি সঙ্গে আনিয়াছিল। তাহাতে তাহার সজ্জা সকল থাকিত। এখন নবীনানন্দ ঝাঁপি টেপারি খুলিয়া বেশপবির্ত্তনে প্রবৃত্ত হইল।

 চিকন রকম রসকলির উপর খয়েরের টিপ কাটিয়া তৎকালপ্রচলিত ফুর ফুরে কোঁকড়া কোঁকড়া কতকগুলো ঝাঁপটার গোছায় চাদমুখ খানি ঢাকিয়া, শান্তি একটী সারঙ্গ হস্তে বৈষ্ণবী বেশে, ইংরেজশিবিরে দর্শন দিল। দেখিয়া ভ্রমরকৃষ্ণশ্মশ্রুযুক্ত সিপাহীরা বড় মাতিয়া গেল। কেহ টপ্পা, কেহ গজল, কেহ শ্যামাবিষয়, কেহ কৃষ্ণবিষয়, ফরমাস করিয়া শুনিল? কেহ চাল দিল, কেহ দাল দিল; কেহ মিষ্ট দিল, কেহ পয়সা দিল, কেহ সিকি দিল। বৈষ্ণবী তখন শিবিরের অবস্থা স্বচক্ষে সবিশেষ দেখিয়া, চলিয়া যায়, সিপাহীরা জিজ্ঞাসা করিল “আবার কবে আসিবে?” বৈষ্ণবী বলিল “তা জানি না, আমার বাড়ী ঢের দূর।” সিপাহীরা জিজ্ঞাসা করিল “কত দূর?” বৈষ্ণবী বলিল “আমার বাড়ী পদচিহ্নে” এখন সেই দিন মেজর উড পদচিহ্নের কিছু খবর লইতেছিলেন। একজন সিপাহী তাহা জানিত। বৈষ্ণবীকে ডাকিয়া কাপ্তেন সাহেবের কাছে লইয়া গেল। কাপ্তেন সাহেব তাহাকে মেজর উডের কাছে লইয়া গেল! মেজর উডের কাছে গিয়া বৈষ্ণবী মধুর হাসি হাসিয়া, মর্ম্মভেদী কটাক্ষে উড সাহেবের মাথা ঘুরাইয়া দিয়া, খঞ্জনীতে আঘাত করিয়া, গান ধরিল।

 “ম্লেচ্ছনিবহনিধনে, কলয়সি করবালং।”

 উড সাহেব জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমার বাড়ী কোথা বিবি।”

 বিবি বলিল, “আমি বিবি নই, বৈষ্ণবী। বাড়ী পদচিহ্নে।”

 উড। Well that is Padsin! Padsin is it? “হুঁয়া একটো গর হ্যায়?

 বৈষ্ণবী বলিল ঘর?—কত ঘর আছে।”

 উড। গর নেই,—গর নেই,—গর,—গর।

 শান্তি। সাহেব, তোমার মনের কথা বুঝেছি। গড়?

 উড। ইয়েস ইয়েস, গর! গর! হ্যায়?

 শান্তি। গড় আছে। ভারি কেল্লা।

 উড। কেট্টে আড্‌মি।

 শান্তি। গড়ে কত লোক থাকে? বিশ পঞ্চাশ হাজার।

 উড। নন্সেন্স। একটো কেল্লেমে ডো চার হাজার রহে শক্তা। হুঁয়া পর আবি হ্যায়? ইয়া নিকেল গিয়া?

 শান্তি। আবার নেকলাবে কোথা?

 উড। মেলামে—কেয়া বোল্‌টা হ্যায়। কিণ্ডেল—

 শান্তি। কেঁদুলী—কেঁদুলীর মেলায় তারা যাবে না।

 উড। টোম কব আয়া হ্যায় হুঁয়াসে।

 শান্তি। কাল এসেছি সায়েব।

 উড। ও লোক আজ নিকেল গিয়া হোগা।

 শান্তি মনে মনে ভাবিতেছিল যে, “তামার বাপের শ্রাদ্ধের চাল যদি আমি না চড়াই, তবে আমার রসকলি কাটাই বৃথা। কতক্ষণে শিয়ালে তোমার মুণ্ড খাবে আমি দেখ্‌বো!” প্রকাশ্যে বলিল, “তা সাহেব হতে পারে, আজ বেরিয়ে গেলে যেতে পারে। অত খবর আমি জানি না, বৈষ্ণবী মানুষ, গান গেয়ে ভিক্ষা শিক্ষা করে খাই, অত খবর রাখিনে। বকে বকে গলা শুকিয়ে উঠলো, পয়সাটা সিকেটা দাও উঠে চলে যাই। আর ভাল করে বক্‌শিশ দাও তো না হয় পরশু এসে বলে যাব।”

 উড সাহেব ঝণাৎকরিয়া একটা নগদ টাকা ফেলিয়া দিয়া, বলিল—“পরশু নেহি বিবি।”

 শান্তি বলিল, “দূর বেটা! বৈষ্ণবী বল্‌; বিবি কি?”

 উড। পরশু নেহি, আজ রাৎকো হামকো খবর মিলনা চাহিয়ে।

 শান্তি। বন্দুক মাথায় দিয়ে সরাপ টনে সরসের তেল নাকে দিয়ে ঘুমোয়। আজ আমি দশ কোশ রাস্তা যাব আস্‌বো ওঁকে খবর এনে দেব! ছুঁচো বেটা কোথাকার।

 উড। ছুঁচো বেটা কেস্কা কয়তা হ্যায়।

 শান্তি। যে বড় বীর—ভারি জাঁদরেল।

 উড। Great General হাম হো শক্তা হ্যায়—ক্লাইবকা মাফিক। লেকেন আজ হামকো খবর মিলনে চাহিয়ে। শও রুপেয়া বখসিস দেঙ্গে।

 শান্তি। শই দাও আর হাজারই দাও, বিশক্রোশ এ দুখানা ঠেঙ্গে হবে না।

 উড। ঘোড়ে পর।

 শান্তি। ঘোড়ায় চড়তে জান্‌লে আর তোমার তাঁবুতে এসে সারেঙ্গ বাজিয়ে ভিক্ষে করি।

 উড। গদি পর লে যায়েগা।

 শান্তি। কোলে বসিয়ে নিয়ে যাবে? আমার লজ্জা নাই?

 উড। ক্যা মুস্কিল, পান্‌শো রূপেয়া দেঙ্গে।

 শান্তি। কে যাবে, তুমি নিজে যাবে?

 উড তখন অঙ্গুলিনির্দেশ পূর্ব্বক সম্মুখে দণ্ডায়মান লিণ্ডলে নামক, এক জন যুবা এন্‌সাইনকে দেখাইয়া, তাহাকে বলিলেন “লিণ্ডলে তুমি যাবে?” লিণ্ডলে শান্তির রূপ যৌবন দেখিয়া বলিল “আহ্লাদ পূর্ব্বক।”

 তখন ভারি একটা আরবী ঘোড়া সজ্জিত হইয়া আসিলে লিণ্ডলেও তৈয়ার হইল। শান্তিকে ধরিয়া ঘোড়ায় তুলিতে গেল। শান্তি বলিল “ছি, এত লোকের মাজখানে? আমার কি আর কিছু লজ্জা নাই। আগে চল ছাউনি ছাড়াই।”

 লিণ্ডলে ঘোড়ায় চলিল। ঘোড়া ধীরে ধীরে হাঁটাইয়া লইয়া চলিল। শান্তি পশ্চাৎ পশ্চাৎ হাঁটিয়া চলিল। এইরূপে তাহারা শিবিরের বাহিরে আসিল।

 শিবিরের বাহিরে আসিলে নির্জ্জন প্রান্তর পাইয়া, শান্তি লিণ্ডলের পায়ের উপর পা দিয়া এক লাফে ঘোড়ায় চড়িল। লিণ্ডল হাসিয়া বলিল “তুমি যে পাকা ঘোড়সওয়ার।”

 শান্তি বলিল, “আমরা এমন পাকা ঘোড়সওয়ার, যে তোমার সঙ্গে চড়িতে লজ্জা করে। ছি! রেকাব পায়ে দিয়ে ঘোড়ায় চড়া!”

 একবার বড়াই করিবার জন্য লিণ্ডলে রেকাব হইতে পা লইল। শান্তি অমনি নির্ব্বোধ ইংরেজের গলদেশে হস্তার্পণ করিয়া ঘোড়া হইতে ফেলিয়া দিল। শান্তি তখন অশ্বপৃষ্ঠে রীতিমত আসন গ্রহণ করিয়া ঘোড়ার পেটে মলের ঘা মারিয়া, বায়ুবেগে আরবীকে ছুটাইয়া দিল। শান্তি চারিবৎসর সন্তান সৈন্যের সঙ্গে সঙ্গে ফিরিয়া অশ্বারোহণবিদ্যা শিখিয়াছিল। তা না শিখিলে জীবানন্দের সঙ্গে কি বাস করিতে পারিত? লিণ্ডলে পা ভাঙ্গিয়া পড়িয়া রহিলেন। শান্তি বায়ুবেগে অশ্বপৃষ্ঠে চলিল।

 যে বনে জীবানন্দ লুকাইয়াছিল, শান্তি সেই খানে গিয়া, জীবানন্দকে সকল সম্বাদ অবগত করাইল। জীবানন্দ বলিল, “তবে আমি শীঘ্র গিয়া, মহেন্দ্রকে সতর্ক করি। তুমি কেন্দুবিল্লে গিয়া সত্যানন্দকে খবর দাও। তুমি ঘোডায় যাও—প্রভু যেন শীঘ্র সম্বাদ পান।” তখন দুই জনে দুই দিকে ধারিত হইল। বলা বৃথা শান্তি আবার নবীনানন্দ হইল।