আনন্দমঠ (১৮৮৩)/দ্বিতীয় খণ্ড/ষোড়শ পরিচ্ছেদ

ষোড়শ পরিচ্ছেদ।

 বীরভূমি মুসলমানের হাত ছাড়া হইয়াছে। মুসলমান কেহই এ কথা মানেন না—মনকে চোখ ঠারেন—বলেন কতকগুলা লুঠেরাতে বড় দৌরাত্ম্য করিতেছে—শাসন করিতেছি। এইরূপ কতকাল যাইত বলা যায় না কিন্তু এই সময়ে ভগবানের নিয়োগে ওয়ারেন হেষ্টিংস কলিকাতার গবর্ণর জেনারেল। ওয়ারেন হেষ্টিংস মনকে চোক ঠারিবার লোক নহেন—তাঁর সে বিদ্যা থাকিলে আজ ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য কোথায় থাকিত? আগৌনে বীরভূমি শাসনার্থ উড নামা দ্বিতীয় সেনাপতি নূতন সেনা লইয়া উপস্থিত হইলেন।

 উড দেখিলেন এ ইউরোপীয় যুদ্ধ নহে। শত্রুদিগের সেনা নাই, নগর নাই, রাজধানী নাই, দুর্গ নাই, অথচ সকলই তাহাদের অধীন। যে দিন যেখানে ব্রিটিশ সেনার শিবির, সেই দিনের জন্য সেস্থান ব্রিটিশসেনার অধীন—তার পরদিন ব্রিটিশসেনা চলিয়া গেল ত অমনি চারিদিকে “বন্দে মাতরং” গীত হইতে লাগিল। উড সাহেব খুঁজিয়া পান না কোথা হইতে ইহারা পিপীলিকার মত এক এক রাত্রে নির্গত হইয়া যে গ্রাম ইংরেজের বশীভূত হয় তাহ দাহ করিয়া যায়, অথবা অল্পসংখ্যক ব্রিটিশ সেনা পাইলে তৎক্ষণাৎ সংহার করে। অনুসন্ধান করিতে করিতে উড সাহেব জানিলেন যে, পদচিহ্নে ইহারা দুর্গনির্ম্মাণ করিয়া সেইখনে আপনাদিগের অস্ত্রাগার ও ধনাগার রক্ষা করিতেছে। অতএব সেই দুর্গ অধিকার করা বিধেয় বলিয়া স্থির করিলেন।

 চরের দ্বারা তিনি সম্বাদ লইতে লাগিলেন যে, পদচিহ্নে কত সন্তান থাকে। যে সম্বাদ পাইলেন তাহাতে তিনি সহসা দুর্গ আক্রমণ করা বিধেয় বিবেচনা করিলেন না। মনে মনে এক অপূর্ব্ব কৌশল উদ্ভাবন করিলেন।

 মাঘী পূর্ণিমা সম্মুখে উপস্থিত। তাঁহার শিবিরের অদূরবর্ত্তী কেন্দুবিল্লগ্রামে গোস্বামীর মেলা হইবে। এবার মেলায় বড় ঘটা। সহজে মেলায় লক্ষ লোকের সমাগম হইয়া থাকে। এবার বৈষ্ণবের রাজ্য হইয়াছে, বৈষ্ণবেরা মেলায় আসিয়া বড় জাঁক করিবে সংকল্প করিয়াছে। অতএব যাবতীয় সন্তানগণের পূর্ণিমার দিন কেন্দুবিল্লতে একত্র সমাগম হইবে, এমন সম্ভাবনা। মেজর উড বিবেচনা করিলেন যে পদচিহ্নের রক্ষকেরাও সকলেই মেলায় আসিবার সম্ভাবনা। সেই সময়েই সহসা পদচিহ্নে গিয়া দুর্গ অধিকৃত করবেন।

 এই অভিপ্রায় করিয়া, মেজর উড রটনা করিলেন, যে তিনি মেলার দিবস কেন্দুবিল্ল আক্রমণ করিবেন। এক ঠাঁই সকল বৈষ্ণব পাইয়া, একদিনে শত্রু নিঃশেষ করিবেন। বৈষ্ণবের মেলা হইতে দিবেন না।

 এ সম্বাদ গ্রামে গ্রামে প্রচারিত হইল। তখন যেখানে যে সন্তানসম্প্রদায়ভুক্ত ছিল, সে তৎক্ষণাৎ অস্ত্র গ্রহণ করিয়া মেলা রক্ষার জন্য কেন্দুবিল্ল অভিমুখে ধাবিত হইল। সকল সন্তানই কেন্দুবিল্লে আসিয়া মাঘী পূর্ণিমায় মিলিত হইল। মেজর উড যাহা ভাবিয়াছিলেন তাহাই ঠিক হইল! ইংরেজের সৌভাগ্যক্রমে মহেন্দ্রও ফাঁদে পা দিলেন। মহেন্দ্র পদচিহ্নের দুর্গে অল্পমাত্র সৈন্য রাখিয়া অধিকাংশ সৈন্য লইয়া কেন্দুবিল্লে যাত্রা করিলেন।

 এ সকল কথা হইবার আগেই জীবানন্দ ও শান্তি পদচিহ্ন হইতে বাহির হইয়া গিয়াছিল। তখন যুদ্ধের কোন কথা হয় নাই, যুদ্ধে তাহাদের তখন মন ছিল না। মাঘী পূর্ণিমায়, পুণ্যদিনে, শুভক্ষণে, জয়দেব গোস্বামীর তীর্থে, অজয়ের পবিত্র জলে প্রাণ বিসর্জ্জন করিয়া, প্রতিজ্ঞাভঙ্গ মহাপাপের প্রায়শ্চিত্ত করিবে, ইহাই তাহাদের অভিসন্ধি। কিন্তু পথে যাইতে যাইতে তাহারা শুনিল যে কেন্দুবিল্লে সমবেত সন্তানদিগের সঙ্গে রাজসৈন্যের মহাযুদ্ধ হইবে। তখন জীবানন্দ বলিল, “তবে যুদ্ধেই মরিব, শীঘ্র চল।”

 তাহারা শীঘ্র শীঘ্র চলিল। পথ এক স্থানে একটা টিলার উপর দিয়া গিয়াছে। টিলায় উঠিয়া, বীরদম্পতী দেখিতে পাইল—যে নিম্নে কিছু দূরে ইংরেজশিবির। শান্তি বলিল, “মরার কথা এখন থাক্‌—বল ‘বন্দে মাতরং’।”