আনন্দমঠ (১৮৮৩)/দ্বিতীয় খণ্ড/চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ

চতুর্দ্দশ পরিচ্ছেদ।

 যখন শান্তি আপন আশ্রম ত্যাগ করিয়া গভীর রাত্রে নগরাভিমুখে যাত্রা করে, তখন জীবানন্দ আশ্রমে উপস্থিত ছিলেন। শান্তি জীবানন্দকে বলিল “আমি নগরে চলিলাম। মহেন্দ্রের স্ত্রীকে লইয়া আসিব। তুমি মহেন্দ্রকে বলিয়া রাখ যে উহার স্ত্রী আছে।”

 জীবানন্দ ভবানন্দের কাছে কল্যাণীর জীবন রক্ষা বৃত্তান্ত সকল অবগত হইয়াছিল—এবং তাহার বর্ত্তমান বাসস্থানও সর্ব্বস্থান- বিচারিণী শান্তির কাছে শুনিয়াছিল। ক্রমে ক্রমে সকল মহেন্দ্রকে শুনাইতে লাগিল।

 মহেন্দ্র প্রথমে বিশ্বাস করিলেন না। শেষে আনন্দে অভিভূত হইয়া মুগ্ধপ্রায় হইলেন।

 সেই রজনী প্রভাতে শান্তির সাহায্যে মহেন্দ্রের সঙ্গে কল্যাণীর সাক্ষাৎ হইল। নিস্তব্ধ কাননমধ্যে, ঘনবিন্যস্ত শালতরুশ্রেণীর অন্ধকার ছায়া মধ্যে, পশু পক্ষী ভগ্ননিদ্র হইবার পূর্ব্বে, তাহাদিগের পরস্পরের দর্শনলাভ হইল। সাক্ষী কেবল সেই নীলগগনবিহারী ম্লানকিরণ আকাশের নক্ষত্রনিচয়, আর সেই নিবাত নিষ্কম্প অনন্ত শালতরুশ্রেণী। দূরে কোন শীলাসংঘর্ষণনাদিনী, মধুর কল্লোলিনী, সংকীর্ণা নদীর তর তর শব্দ, কোথাও প্রাচীসমুদিত ঊষামুকুটজ্যোতিঃ সন্দর্শনে আহ্লাদিত এক কোকিলের রব।

 বেলা এক প্রহর হইল। সেখানে শান্তি জীবানন্দ আসিয়া দেখা দিল। কল্যাণী শান্তিকে বলিল—“আমরা আপনার কাছে বিনা মূল্যে বিক্রীত। আমাদের কন্যাটির সন্ধান বলিয়া দিয়া এ উপকার সম্পূর্ণ করুন।”

 শান্তি জীবানন্দের মুখের প্রতি চাহিয়া বলিল “আমি ঘুমাই। অষ্ট প্রহরের মধ্যে বসি নাই—দুই রাত্র ঘুমাই নাই—আমি যাই পুরুষ!”

 কল্যাণী ঈষৎ হাসিল। জীবানন্দ মহেন্দ্রের মুখপানে চাহিয়া বলিলেন, “সে ভার, আমার উপর রহিল। আপনারা পদচিহ্নে গমন করুন—সেইখানে কন্যাকে পাইবেন।”

 জীবানন্দ ভরূইপুরে নিমাইয়ের নিকট হইতে মেয়ে আনিতে গেলেন—কাজটা বড় সহজ বোধ হইল না।

 তখন নিমাই প্রথমে ঢোক গিলিল, একবার এদিক ওদিক চাহিল। তার পর একবার তার ঠোঁট নাক ফুলিল। তার পর সে কাঁদিয়া ফেলিল। তার পর বলিল, “আমি মেয়ে দিব না।”

 নিমাই, গোল হাতখানি উল্টাপিট চোখে দিয়া ঘুরাইয়া ঘুরাইয়া চক্ষু মুছিলে পর জীবানন্দ বলিল, “তা দিদি কাঁদ কেন, এমন দূর ও তো নয়—তাদের বাড়ী তুমি না হয় গেলে, মধ্যে মধ্যে দেখে এলে।”

 নিমাই ঠোঁট ফুলাইয়া বলিল, “তা তোমাদের মেয়ে তোমরা নিয়ে যাও না কেন? আমার কি?” নিমাই এই বলিয়া সুকুমারীকে আনিয়া রাগ করিয়া দুম করিয়া জীবানন্দের কাছে ফেলিয়া দিয়া পা ছড়াইয়া কাঁদিতে বসিল। সুতরাং জীবানন্দ তখন আর কিছু না বলিয়া এদিক ওদিক বাজে কথা কহিতে লাগিলেন। কিন্তু নিমাইয়ের রাগ পড়িল না। নিমাই উঠিয়া গিয়া সুকুমারীর কাপড়ের বোঁচকা, অলঙ্কারের বাক্স, চুলের দড়ি, খেলার পুতুল ঝুপঝাপ করিয়া আনিয়া জীবানন্দের সম্মুখে ফেলিয়া দিতে লাগিল। সুকুমারী সে সকল আপনি গুছাইতে লাগিল। সে নিমাইকে জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল ‘‘হাঁ মা—কোথায় যাব মা?” নিমাইয়ের আর সহ্য হইল না। নিমাই তখন সুকুকে কোলে লইয়া কাঁদিতে কাঁদিতে চলিয়া গেল।