আনন্দমঠ (১৮৮৩)/দ্বিতীয় খণ্ড/ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ
ত্রয়োদশ পরিচ্ছেদ।
সেই রজনীতে হরিধ্বনিতে বীরভূমি পরিপূর্ণ হইল। সন্তানেরা দলে দলে যেখানে সেখানে উচ্চৈঃস্বরে কেহ “বন্দে মাতরং” কেহ “জগদীশ হরে” বলিয়া গাইয়া বেড়াইতে লাগিল। কেহ শত্রুসেনার অস্ত্র, কেহ বস্ত্র অপহরণ করিতে লাগিল। কেহ মৃতদেহের মুখে পদাঘাত, কেহ অন্য প্রকার উপদ্রব করিতে লাগিল। কেহ গ্রামাভিমুখে, কেহ নগরাভিমুখে ধাবমান হইয়া, পথিক বা গৃহস্থকে ধরিয়া বলে “বল বন্দে মাতরং নহিলে মারিয়া ফেলিব।” কেহ ময়রার দোকান লুঠিয়া খায়, কেহ গোয়ালার বাড়ী গিয়া হাঁড়ি পাড়িয়া দধিতে চুমুক মারে, কেহ বলে “আমরা ব্রজগোপ আসিয়াছি, গোপিনী কই?” সেই এক রাত্রের মধ্যে গ্রামে গ্রামে নগরে নগরে মহাকোলাহল পড়িয়া গেল। সকলে বলিল, “মুসলমান পরাভূত হইয়াছে, দেশ আবার হিন্দু হইয়াছে। সকলে একবার মুক্তকণ্ঠে হরি হরি বল।” গ্রাম্য লোকেরা মুসলমান দেখিলেই তাড়াইয়া মারিতে যায়। কেহ কেহ সেই রাত্রে দলবদ্ধ হইয়া মুসলমানদিগের পাড়ায় গিয়া তাহাদের ঘরে আগুন দিয়া সর্বস্ব লুঠিয়া লইতে লাগিল। অনেক যবন নিহত হইল, অনেক মুসলমান দাড়ি ফেলিয়া গায়ে মৃত্তিকা মাখিয়া হরিনাম করিতে আরম্ভ করিল, জিজ্ঞাসা করিলে বলিতে লাগিল, “মুই হেঁদু।”
দলে দলে ত্রস্ত মুসলমানেরা নগরাভিমুখে ধাবিত হইল। যেখানে মহারাজ বীরভূমাধিপতি আসাদ-উল্ জমান বাহাদুর রাজসিংহাসনে সুখে আসীন, সেই খানেই দারুণ রাজ্যধ্বংসসূচক বার্ত্তা পৌঁছিল। তখন অতি ব্যস্তে চারিদিকে রাজপুরুষেরা ছুটিল, রাজার অবশিষ্ট সিপাহী সুসজ্জিত হইয়া নগররক্ষার্থে শ্রেণীবদ্ধ হইল। রাজনগরের গড়ের ঘাটে ঘাটে, প্রকোষ্ঠ সকলে রক্ষকবর্গ সশস্ত্রে অতি সাবধানে, দ্বাররক্ষায় নিযুক্ত হইল। রাজধানী মধ্যে সমস্ত লোক সমস্তরাত্রি জাগরণ করিয়া, কি হয় কি হয় চিন্তা করিতে লাগিল। হিন্দুরা বলিতে লাগিল “আসুক সন্ন্যাসীরা আসুক, মা দুর্গা করুন, হিন্দুর অদৃষ্টে সেই দিন হউক।” মুসলমানের বলিতে লাগিল “আল্লা আকবর! এতনা রোজের পর কোরাণসরিফ বেবাক কি ঝুঁটো হলো; মোরা যে পাঁচু ওয়াক্ত নমাজ করি, তা এই তেলককাটা হেঁদুর দল ফতে করতে নারলাম। দুনিয়া সব ফাঁকি।” এইরূপে কেহ ক্রন্দন, কেহ হাস্য করিয়া সকলেই ঘোরতর আগ্রহের সহিত রাত্রি কাটাইতে লাগিল।
এ সকল কথা কল্যাণীর কাণে গেল—আবালবৃদ্ধবনিতা কাহারও অবিদিত ছিল না। কল্যাণী মনে মনে বলিল “জয় জগদীশ্বর! আজ তোমার কার্য্য সিদ্ধ হইয়াছে। আজ আমি স্বামিসন্দর্শনে যাত্রা করিব। হে মধুসূদন! আজ আমার সহায় হইও।”
গভীর রাত্রে কল্যাণী শয্যা ত্যাগ করিয়া উঠিয়া, একা খিড়কীর দ্বার খুলিয়া এদিক ওদিক চাহিয়া, কাহাকে কোথাও না দেখিয়া, ধীরে ধীরে নিঃশব্দে, গৌরীদেবীর পুরী হইতে রাজপথে নিষ্ক্রান্ত হইল। মনে মনে ইষ্টদেবতা স্মরণ করিয়া বলিল, “দেখ ঠাকুর, আজ যেন পদচিহ্নে তাঁর সাক্ষাৎ পাই।”
কল্যাণী নগরের ঘাটিতে আসিয়া উপস্থিত। পাহারাওয়ালা বলিল “কে যায়?” কল্যাণী ভীতস্বরে বলিল “আমি স্ত্রীলোক।” পাহারাওয়ালা বলিল “যাবার হুকুম নাই।” কথা দফাদারের কাণে গেল। দফাদার বলিল “বাহিরে যাইবার নিষেধ নাই, ভিতরে আসিবার নিষেধ।” শুনিয়া পাহারাওয়ালা কল্যাণীকে বলিল “যাও মায়ি, যাবার মানা নাই, লেকেন আজ কা বাতমে বড় আফত, কেয়া জানে মায়ি তোমার কি হোবে, তুমি কি ডেকেতের হাতে গিরবে, কি খানায় পড়িয়া মরিয়া যাবে, সে তো হাম কিছু জানে না, আজকা বাত মায়ি, তুমি বাহার না যাবে।”
কল্যাণী বলিল “বাবা আমি ভিখারিণী—আমার এক কড়া কপর্দ্দক নাই, আমায় ডাকাতে কিছু বলিবে না।”
পাহারাওয়ালা বলিল “বয়স আছে মায়ি, বয়স আছে, দুনিয়া মে ওহি তো জেওরাত হ্যায়! বল্কে হামি ডেকেত হতে পারি।” কল্যাণী দেখিল বড় বিপদ, কিছু কথা না কহিয়া, ধীরে ধীরে ঘাটি এড়াইয়া চলিয়া গেল। পাহারাওয়ালা দেখিল মায়ি রসিকতাটা বুঝিল না, তখন মনের দুঃখে গাঁজায় দম মারিয়া ঝিঁঝিট খাম্বাজে সোরির টপ্পা ধরিল। কল্যাণী চলিয়া গেল।
সে রাত্রে পথে দলে দলে পথিক, কেহ মার মার শব্দ করিতেছে, কেহ পালাও পালাও শব্দ করিতেছে, কেহ কান্দিতেছে, কেহ হাসিতেছে, যে যাহাকে দেখিতেছে, সে তাহাকে ধরিতে যাইতেছে। কল্যাণী অতিশয় কষ্টে পড়িলেন। পথ মনে নাই, কাহাকে জিজ্ঞাসা করিবার যো নাই, সকলে রণোন্মুখ কেবল লুকাইয়া লুকাইয়া অন্ধকারে পথ চলিতে হইতেছে। লুকাইয়া লুকাইয়া যাইতেও এক দল অতি উদ্ধত, উন্মত্ত বিদ্রোহীর হাতে তিনি পড়িয়া গেলেন। তাহারা ঘোর চীৎকার করিয়া তাহাকে ধরিতে আসিল। কল্যাণী তখন ঊর্দ্ধশ্বাসে পলায়ন করিয়া জঙ্গলমধ্যে প্রবেশ করিলেন। সেখানেও সঙ্গে সঙ্গে দুই একজন দস্যু তাঁহার পশ্চাতে ধাবিত হইল। একজন গিয়া তাঁহার অঞ্চল ধরিল, বলিল “তবে চাঁদ!” সেই সময়ে আর একজন অকস্মাৎ আসিয়া অত্যাচারকারী পুরুষকে এক ঘা লাঠি মারিল। সে আহত হইয়া পাছু হটিয়া গেল। এই ব্যক্তির সন্ন্যাসীর বেশ—কৃষ্ণাজিনে বক্ষ আবৃত বয়স অতি অল্প। সে কল্যাণীকে বলিল “তুমি ভয় করিও না, আমার সঙ্গে আইস—কোথায় যাইবে?”
ক। পদচিহ্নে।
আগন্তুক বিস্মিত ও চমকিত হইল, বলিল “সে কি, পদচিহ্নে?” এই বলিয়া আগন্তুক কল্যাণীর দুই স্কন্ধে হস্ত স্থাপন করিয়া মুখ পানে সেই অন্ধকারে অতি যত্নের সহিত নিরীক্ষণ করিতে লাগিল।
কল্যাণী অকস্মাৎ পুরুষস্পর্শে রোমাঞ্চিত, ভীত, ক্ষুব্ধ, বিস্মিত অশ্রুবিপ্লুত হইল—এমন সাধ্য নাই যে পলায়ন করে, ভীতিবিহ্বলা হইয়া গিয়াছিল। আগন্তুকের নিরীক্ষণ শেষ হইলে সে বলিল “হরে মুরারে! চিনেছি যে, তুমি পোড়ার মুখী কল্যাণী!”
কল্যাণী ভীত হইয়া জিজ্ঞাসা করিল “আপনি কে?”
আগন্তুক বলিল “আমি তোমার দাসানুদাস—হে সুন্দরি! আমার প্রতি প্রসন্ন হও।”
কুল্যাণী অতি দ্রুতবেগে সেখান হইতে সরিয়া গিয়া, তর্জ্জন গর্জ্জন করিয়া বলিল “এই অপমান করিবার জন্যই কি আপনি আমাকে রক্ষা করিলেন? দেখিতেছি ব্রহ্মচারীর বেশ, ব্রহ্মচারীর কি এই ধর্ম্ম? আমি আজ নিঃসহায়, নহিলে তোমার মুখে আমি নাথি মারিতাম।”
ব্রহ্মচারী বলিল, “অয়ি স্মিতবদনে! আমি বহুদিবসাবধি, তোমার ঐ বরবপুর স্পর্শ কামনা করিতেছি।” এই বলিয়া ব্রহ্মচারী দ্রুতবেগে ধাবমান হইয়া কল্যাণীকে ধরিয়া গাঢ় আলিঙ্গন করিল। তখন কল্যাণী খিল খিল করিয়া হাসিল, বলিল, “ও পোড়া কপাল! আগে বলতে হয় ভাই, যে আমারও ঐ দশা।” শান্তি বলিল “ভাই মহেন্দ্রের খোঁজে চলিয়াছ।”
কল্যাণী বলিল। “তুমি কে, তুমি যে সব জান দেখিতেছি।”
শান্তি বলিল, “আমি ব্রহ্মচারী—সন্তানসেনার অধিনায়ক—ঘোরতর বীরপুরুষ! আমি সব জানি। আজ পথে সিপাহী আর সন্তানের যে দৌরাত্ম্য তুমি আজ পদচিহ্নে যাইতে পরিবে না।”
কল্যাণী কাঁদিতে লাগিল।
শান্তি চোখ ঘুরাইয়া বলিল “ভয় কি? আমরা নয়নবাণে সহস্র শক্র বধ করি। চল পদচিহ্নে যাই।”
কল্যাণী এরূপ বুদ্ধিমতী স্ত্রীলোকের সহায়তা পাইয়া যেন হাত বাড়াইয়া স্বর্গ পাইল। বলিল, “তুমি যেখানে লইয়া যাইবে সেইখানে যাইব।”
শান্তি তখন তাহাকে সঙ্গে করিয়া বন্যপথে লইয়া চলিল।