আনন্দমঠ (১৮৮৩)/দ্বিতীয় খণ্ড/দ্বাদশ পরিচ্ছেদ

দ্বাদশ পরিচ্ছেদ।

 রণজয়ের পর, অজয়তীরে সত্যানন্দকে ঘেরিয়া বিজয়ী বীরবর্গ নানা উৎসব করিতে লাগিল। কেবল সত্যানন্দ বিমর্ষ, ভবানন্দের জন্য।

 এতক্ষণ বৈষ্ণবদিগের রণবাদ্য অধিক ছিল না, কিন্তু সেই সময় কোথা হইতে সহস্র সহস্র কাড়ানাগরা, ঢাক ঢোল, কাঁসি সানাই, তুরী ভেরী, রামসিঙ্গা দামামা আসিয়া জুটিল। জয়সূচকবাদ্যে কানন প্রান্তর নদীসকল শব্দ ও প্রতিধ্বনিতে পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল। এইরূপে সন্তানগণ অনেকক্ষণ ধরিয়া নানারূপ উৎসব করিলে পর সত্যানন্দ বলিলেন, “জগদীশ্বর আজ কৃপা করিয়াছেন, সন্তানধর্ম্মের জয় হইয়াছে, কিন্তু এক কাজ বাকি আছে। যাহারা আমাদিগের সঙ্গে উৎসব করিতে পাইল না, যাহারা আমাদের উৎসবের জন্য প্রাণ দিয়াছে, তাহাদিগকে ভুলিলে চলিবে না। যাহারা রণক্ষেত্রে নিহত হইয়া পড়িয়া আছে, চল যাই আমরা গিয়া তাহাদিগের সৎকার করি, বিশেষ যে মহাত্মা আমাদিগের জন্য এই রণজয় করিয়া প্রাণত্যাগ করিয়াছেন, চল মহান্ উৎসব করিয়া সেই ভবানন্দের সৎকার করি। তখন সন্তানদল “বন্দে মাতরং” বলিতে বলিতে নিহতদিগের সৎকারে চলিল। বহুলোক একত্রিত হইয়া হরিবোল দিতে দিতে ভারে ভারে চন্দন কাষ্ঠ বহিয়া আনিয়া ভবানন্দের চিতা রচনা করিল, এবং তাহাতে ভবানন্দকে শায়িত করিয়া, অগ্নি জ্বালিত করিয়া, চিতা বেড়িয়া বেড়িয়া হরে মুরারে গায়িতে লাগিল। ইহারা বিষ্ণুভক্ত, বৈষ্ণবসম্প্রদায়ভুক্ত নহে, অতএব দাহ করে।”

 কাননমধ্যে তৎপরে কেবল সত্যানন্দ, জীবানন্দ, মহেন্দ্র, নবীনানন্দ, ও ধীরানন্দ আসীন; গোপনে পাঁচজনে পরামর্শ করিতেছেন। সত্যানন্দ বলিলেন “এত দিন যে জন্য আমরা সর্ব্বধর্ম্ম সর্ব্বসুখ ত্যাগ করিয়াছিলাম, সেই ব্রত সফল হইয়াছে, এ প্রদেশে যবনের সেনা আর নাই, যাহা অবশিষ্ট আছে, একদণ্ড আমাদিগের নিকট টেঁকিবে না, তোমরা এখন কি পরামর্শ দাও।”

 জীবানন্দ বলিল “চলুন এই সময়ে গিয়া নগর অধিকার করি।”

 সত্য। আমারও সেই মত।

 ধীরানন্দ। সৈন্য কোথায়?

 জীব। কেন এই সৈন্য?

 ধীর। এই সৈন্য কই? কাহাকে দেখিতে পাইতেছেন?

 জীব। স্থানে স্থানে সব বিশ্রাম করিতেছে, ডঙ্কা দিলে অবশ্য পাওয়া যাইবে।

 ধীর। একজনকেও পাইবেন না।

 সত্য। কেন?

 ধীর। সবাই লুঠিতে বাহির হইয়াছে। গ্রাম সকল এখন অরক্ষিত। মুসলমানের গ্রাম আর রেশমের কুঠি লুঠিয়া সকলে ঘরে যাইবে। এখন কাহাকেও পাইবেন না। আমি খুঁজিয়া আসিয়াছি।

 সত্যানন্দ বিষণ্ণ হইলেন, বলিলেন, “যাই হোক, নগর ভিন্ন সমস্ত বীরভূম আমাদের অধিকৃত হইল। নগরের বাহিরে আর কেহ নাই যে আমাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়। অতএব বীরভূমিতে তোমরা সন্তানরাজ্য প্রচার কর। প্রজাদিগের নিকট হইতে কর আদায় কর এবং নগর অধিকার করিবার জন্য সেনা সংগ্রহ কর। হিন্দুর রাজ্য হইয়াছে শুনিলে, বহুতর সেনা, সন্তানের নিশান উড়াইবে।”

 তখন জীবানন্দ প্রভৃতি সত্যানন্দকে প্রণাম করিয়া বলিল “আমরা প্রণাম করিতেছি―হে মহারাজাধিরাজ! আজ্ঞা হয় ত আমরা এই কাননেই আপনার সিংহাসন স্থাপিত করি।”

 সত্যানন্দ তাঁহার জীবনে এই প্রথম কোপ প্রকাশ করিলেন। বলিলেন “ছি! আমায় কি শূন্য কুম্ভ মনে কর? আমরা রাজা কেহ নহি―আমরা সন্ন্যাসী। এখন দেশের রাজা বৈকুণ্ঠনাথ স্বয়ং। নগর অধিকার হইলে, যাহার শিরে তোমাদিগের ইচ্ছা হয় রাজমুকুট পরাইও, কিন্তু ইহা নিশ্চিত জানিও যে আমি এই ব্রহ্মচর্য্য ভিন্ন আর কোন আশ্রমই স্বীকার করিব না। এক্ষণে তোমরা স্ব স্ব কর্ম্মে যাও।”

 তখন চারি জনে ব্রহ্মচারীকে প্রণাম করিয়া গাত্রোত্থান করিল। সত্যানন্দ তখন অন্যের অলক্ষিতে ইঙ্গিত করিয়া মহেন্দ্রকে রাখিলেন। আর তিন জন চলিয়া গেল, মহেন্দ্র রহিল। সত্যানন্দ তখন মহেন্দ্রকে বলিলেন, “তোমরা সকলে বিষ্ণুমণ্ডপে শপথ করিয়া সন্তানধর্ম্ম গ্রহণ করিয়াছিলে। ভবানন্দ ও জীবানন্দ দুই জনেই প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করিয়াছে, ভবানন্দ আজ তাহার স্বীকৃত প্রায়শ্চিত্ত করিল, আমার সর্ব্বদা ভয় কোন্ দিন জীবানন্দ প্রায়শ্চিত্ত করিয়া দেহ বিসর্জ্জন করে। কিন্তু আমার এক ভরসা আছে, কোন নিগূঢ় কারণে সে এক্ষণে মরিতে পারিবে না। তুমি একা প্রতিজ্ঞা রক্ষা করিয়াছ। এক্ষণে সন্তানের কার্য্যোদ্ধার হইল, প্রতিজ্ঞাছিল যে, যতদিন না সন্তানের কার্য্যোদ্ধার হয়, ততদিন তুমি স্ত্রী কন্যার মুখ দর্শন করিবে না, এক্ষণে কার্য্যোদ্ধার হইয়াছে, এখন আবার সংসারী হইতে পার।”

 মহেন্দ্রের চক্ষে দরবিদরিত ধারা বহিল। মহেন্দ্র বলিল “ঠাকুর, সংসারী হইব কাহাকে লইয়া? স্ত্রী ত আত্মঘাতিনী হইয়াছেন, আর কন্যা কোথায় যে তাতো জানি না। কোথায় বা সন্ধান পাইব? আপনি বলিয়াছেন জীবিত আছে, ইহাই জানি আর কিছু জানি না।”

 মাথার উপর গাছের ডালে বসিয়া কে বলিল “আমি জানি কন্যা কোথায় আছে।” মহেন্দ্র উন্মুখ হইয়া বলিলেন “তুমি কে?”

 সত্যানন্দ একটু রুষ্টভাবে উন্মুখ হইয়া বলিলেন, “নবীনানন্দ! আমি তোমাকে বিদায় দিয়াছিলাম! তুমি এখনও এখানে কেন?”

 শান্তি গাছের উপর হইতে বলিল, “প্রভু, স্বর্গে মর্ত্ত্যে আপনার অধিকার আছে, গাছের ডালে কি?”

 এই বলিয়া ঝুপ করিয়া শান্তি নামিয়া পড়িল। সত্যানন্দ মহেন্দ্রকে বলিলেন, “ইনি নবীনানন্দ গোস্বামী—অতি পবিত্রচেতা, আমার প্রিয়শিষ্য। ইনি তোমার কন্যার সন্ধান বলিয়া দিবেন।” এই বলিয়া সত্যানন্দ শান্তিকে কিছু ইঙ্গিত করিলেন। শান্তি তাহা বুঝিয়া প্রণাম করিয়া বিদায় হয়, তখন মহেন্দ্র বলিলেন “কোথায় তোমার সঙ্গে সাক্ষাৎ হইবে?”

 শান্তি বলিল, “আমার আশ্রমে আসুন।” এই বলিয়া শান্তি আগে আগে চলিল।

 তখন মহেন্দ্র ব্রহ্মচারীর পাদবন্দনা করিয়া বিদায় হইলেন এবং শান্তির সঙ্গে সঙ্গে তাহার আশ্রমে উপস্থিত হইলেন। তখন অনেক রাত্রি হইয়াছে। তথ্যপি শান্তি বিশ্রাম না করিয়া নগরাভিমুখে যাত্রা করিল।

 সকলে চলিয়া গেলে, ব্রহ্মচারী, একা ভূমে প্রণত হইয়া, মাটিতে মস্তক স্থাপন করিয়া মনে মনে জগদীশ্বরের ধ্যান করিতে লাগিলেন। রাত্রি প্রভাত হইয়া আসিল। এমন সময় কে আসিয়া তাঁহার মস্তক স্পর্শ করিয়া বলিল, “আমি আসিয়াছি।”

 ব্রহ্মচারী উঠিয়া চমকিত হইয়া অতি ব্যগ্রভাবে বলিলেন ‘‘আপনি আসিয়াছেন? কেন?” যে আসিয়াছিল সে বলিল “দিন পূর্ণ হইয়াছে।” ব্রহ্মচারী বলিলেন, “হে প্রভু! আজ ক্ষমা করুন। আগামী মাঘী পূর্ণিমায় আমি আপনার আজ্ঞা পালন করিব।”