আনন্দমঠ (১৮৮৩)/দ্বিতীয় খণ্ড/তৃতীয় পরিচ্ছেদ

তৃতীয় পরিচ্ছেদ।

 শান্তি সাহেবকে ত্যাগ করিয়া হরিণীর ন্যায় ক্ষিপ্রচরণে বনমধ্যে কোথায় প্রবিষ্ট হইল। সাহেব কিছু পরে শুনিতে পাইলেন স্ত্রী কণ্ঠে গীত হইতেছে।

এ যৌবন জলতরঙ্গ রোধিবে কে?
হরে মুরারে! হরে মুরারে!

 আবার কোথায় শারঙ্গের মধুর নিক্বণে বাজিল তাই;—

এ যৌবন জলতরঙ্গ রোধিবে কে?

হরে মুরারে! হরে মুরারে!

 তাহার সঙ্গে পুরুষকণ্ঠ মিলিয়া গীত হইল,—

এ যৌবন জলতরঙ্গ রোধিবে কে?
হরে মুরারে! হরে মুরারে!

 তিন স্বরে এক হইয়া গানে বনের লতা সকল কাঁপাইয়া তুলিল। শান্তি গাইতে গাইতে চলিল।

“এই যৌবন জলতরঙ্গ রোধিবে কে?
হরে মুরারে! হরে মুরারে!
জলেতে তুফান হয়েছে,
আমার নূতন তরী, ভাসল সুখে,
মাঝিতে হাল ধরেছে,
হরে মুরারে। হরে মুরারে!
ভেঙ্গে বালির বাঁধ, পুরাই মনের সাধ,
জোয়ার গাঙ্গে জল ছুটেছে রাখিবে কে?
হরে মুরারে! হরে মুরারে!”

 সারঙ্গেও ঐ বাজিতেছিল,

জোয়ার গাঙ্গে জল ছুটেছে রাখিবে কে?
হরে মুরারে! হরে মুরারে!

 যেখানে অতি নিবিড় বন, ভিতরে কি আছে বাহির হইতে একেবারে অদৃশ্য, শান্তি তাহারই মধ্যে প্রবেশ করিল। সেইখানে সেই শাখাপল্লবরাশির মধ্যে লুক্কায়িত একটি ক্ষুদ্র কুটীর আছে। ডালের বাঁধন, পাতার ছাওয়া, কাঠের মেজে, তার উপরে মাটী ঢালা। তাহারই ভিতরে লতাদ্বার মোচন করিয়া শান্তি প্রবেশ করিল। সেখানে জীবানন্দ বসিয়া সারঙ্গ বাজাইতেছিলেন।

 জীবানন্দ শান্তিকে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন।

 “এত দিনের পর জোয়ার গাঙ্গে জল ছুটেছে কি?”

 শান্তিও হাসিয়া উত্তর করিল। “নালা ডোবায় কি জোয়ার গাঙ্গে জল ছুটে?”

 জীবানন্দ বিষণ্ণ হইয়া বলিলেন, “দেখ শান্তি! এক দিন আমার ব্রত ভঙ্গ হওয়ায় আমার প্রাণ ত উৎসর্গই হইয়াছে। যে পাপ তাহার প্রায়শ্চিত্ত করিতেই হইবে। এত দিন এ প্রায়শ্চিত্ত করিতাম, কেবল তোমার অনুরোধেই করি নাই। কিন্তু একটা ঘোরতর যুদ্ধের আর বিলম্ব নাই। সেই যুদ্ধের ক্ষেত্রে, আমার সে প্রায়শ্চিত্ত করিতে হইবে। এ প্রাণ পরিত্যাগ করিতেই হইবে। আমার মরিবার দিন পর্য্যন্তই কি ব্রহ্মচর্য্যা—”

 শান্তি বলিল “আমি তোমার ধর্ম্মপত্নী, সহধর্ম্মিণী, ধর্ম্মে সহায়। তুমি অতিশয় গুরুতর ধর্ম্ম গ্রহণ করিয়াছ। সেই ধর্ম্মের সহায়তার জন্যই আমি গৃহত্যাগ করিয়া আসিয়াছি। দুই জন একত্রে সেই ধর্ম্মাচরণ করিব বলিয়া গৃহত্যাগ করিয়া আসিয়া বনে বাস করিতেছি। তোমার ধর্ম্ম বৃদ্ধি করিব। ধর্ম্মপত্নী হইয়া, তোমার ধর্ম্মের বিঘ্ন করিব কেন? বিবাহ ইহকালের জন্য, এবং বিবাহ পরকালের জন্য। ইহকালের জন্য যে বিবাহ, মনে কর তাহা আমাদের হয় নাই। আমাদের বিবাহ কেবল পরকালের জন্য। পরকালে দ্বিগুণ ফল ফলিবে। হায় প্রভু! তুমিই আমার গুরু, আমি কি তোমায় ধর্ম্ম শিখাইব? তুমি বীর, আমি তোমায় বীরব্রত শিখাইব?”

 জীবানন্দ আহ্লাদে গদ্গদ হইয়া বলিল, “শিখাইলে ত আমিও শিখিলাম। তুমিই স্ত্রীকুলে ধন্যা।”

 শান্তি প্রফুল্লচিত্তে বলিতে লাগিল, “আরও দেখ গোঁসাই, ইহকালেই কি আমাদের বিবাহ নিস্ফল? তুমি আমায় ভালবাস, আমি তোমায় ভালবাসি, ইহা অপেক্ষা ইহকালে আর কি গুরুতর ফল আছে? বল বন্দে মাতরং।” তখন দুইজনে গলা মিলাইয়া “বন্দে মাতরং” গাইল। গাইতে গাইতে দুই জনেই কাঁদিয়াছিল।