আনন্দমঠ (১৮৮৩)/দ্বিতীয় খণ্ড/প্রথম পরিচ্ছেদ
দ্বিতীয় খণ্ড।
প্রথম পরিচ্ছেদ।
কাল ৭৬ সাল ঈশ্বর কৃপায় শেষ হইল। বাঙ্গালার ছয় আনা রকম মনুষ্যকে—কত কোটী তা কে জানে,—যমপুরে প্রেরণ করাইয়া সেই দুর্ব্বৎসর নিজে কালগ্রাসে পতিত হইল। ৭৭ সালে ঈশ্বর সুপ্রসন্ন হইলেন। সুবৃষ্টি হইল, পৃথিবী শস্যশালিনী হইল, যাহারা বাঁচিয়াছিল তাহারা পেট ভরিয়া খাইল। অনেকে অনাহারে বা অল্পাহারে রুগ্ন হইয়া ছিল, পূর্ণ আহার একেবারে সহ্য করিতে পারিল না। অনেকে তাহাতেই মরিল। পৃথিবী শস্যশালিনী কিন্তু জনশূন্য। গ্রামে গ্রামে খালি বাড়ি পড়িয়া, গবাদির বিশ্রামভূমি এবং প্রেতভয়ের কারণ হইয়া উঠিয়াছিল। গ্রামে গ্রামে শত শত উর্ব্বর ভূমিখণ্ড সকল অকর্ষিত, অনুৎপাদক হইয়া পড়িয়া রহিল, অথবা জঙ্গলে পুরিয়া গেল। দেশ জঙ্গলময় হইল। যেখানে হাস্যময় শ্যামল শস্যরাশি বিরাজ করিত, যেখানে অসংখ্য গোমহিষাদি বিচরণ করিত, যে সকল উদ্যান গ্রাম্য যুবক যুবতীর প্রমোদভূমি ছিল, সে সকল ক্রমে ঘোরতর জঙ্গল হইতে লাগিল। এক বৎসর, দুই বৎসর, তিন বৎসর গেল, জঙ্গল বাড়িতে লাগিল। যেস্থান মনুষ্যের সুখের স্থান ছিল, সেখানে নরমাংসলোলুপ ব্যাঘ্র আসিয়া হরিণাদির প্রতি ধাবমান হইতে লাগিল। যেখানে সুন্দরীর দল অলক্তকাঙ্কিত চরণে চরণভূষণ ধ্বনিত করিতে করিতে বয়স্যার সঙ্গে ব্যঙ্গ করিতে করিতে, উচ্চ হাসি হাসিতে হাসিতে যাইত, সেই খানে ভল্লুকে বিবর প্রস্তুত করিয়া শাবকাদি লালন পালন করিতে লাগিল। যেখানে শিশু সকল নবীন বয়সে সন্ধ্যাকালের মল্লিকাকুসুমতুল্য উৎফুল্ল হইয়া হৃদয়তৃপ্তিকর হাস্য হাসিত, সেই খানে আজি যূথে যূথে বন্যহস্তী সকল মদমত্ত হইয়া বৃক্ষের কাণ্ডসকল বিদীর্ণ করিতে লাগিল। যে খানে দুর্গোৎসব হইত, সে খানে শৃগালের বিবর, দোলমঞ্চে পেচকের আশ্রয়, নাটমন্দিরে বিষধর সর্প সকল দিবসে ভেকের অন্বেষণ করে। বাঙ্গালায় শস্য জন্মে, খাইবার লোক নাই; বিক্রেয় জন্মে কিনিবার লোক নাই; চাসা চাস করে টাকা পায় না, জমীদারের খাজনা দিতে পারে না; জমীদারেরা রাজার খাজনা দিতে পারে না, রাজা জমিদারী কাড়িয়া লওয়ায় জমীদারসম্প্রদায় হৃতসর্ব্বস্ব হইয়া দরিদ্র হইতে লাগিল। বসুমতী সুপ্রসবিনী হইলেন তবু আর ধন জন্মে না। কাহারও ঘরে ধন নাই। যে যাহার পায় কাড়িয়া খায়। চোর ডাকাতেরা মাথা তুলিল, সাধু ভীত হইয়া ঘরের মধ্যে লুকাইল।
এ দিকে সন্তানসম্প্রদায় নিত্য সচন্দন তুলসীদলে বিষ্ণুপাদপদ্ম পূজা করে, যার ঘরে বন্দুক পিস্তল আছে কাড়িয়া আনে। ভবানন্দ বলিয়া দিয়াছিলেন “ভাই! যদি এক দিকে এক ঘর মণি মাণিক্য হীরক প্রবালাদি দেখ আর একদিকে একটা ভাঙ্গা বন্দুক দেখ, মণি-মাণিক্য হীরক প্রবালাদি ছাড়িয়া ভাঙ্গা বন্দুকটী লইয়া আসিবে।”
তার পর, তাহারা গ্রামে গ্রামে চর পাঠাইতে লাগিল। চর গ্রামে গিয়া যেখানে হিন্দু দেখে, বলে ভাই বিষ্ণুপূজা করি? এই বলিয়া ২০।২৫ জন জড় করিয়া মুসলমানের গ্রামে আসিয়া পড়িয়া মুসলমানদের ঘরে আগুন দেয়। মুসলমানেরা প্রাণরক্ষায় ব্যতিব্যস্ত হয়, সন্তানেরা তাহাদের সর্ব্বস্ব লুঠ করিয়া নূতন বিষ্ণুভক্তদিগকে বিতরণ করে। লুঠের ভাগ পাইয়া গ্রাম্য লোকে প্রীত হইলে বিষ্ণুমন্দিরে আনিয়া বিগ্রহের পাদস্পর্শ করাইয়া তাহাদিগকে সন্তান করে। লোকে দেখিল সন্তানত্বে বিলক্ষণ লাভ আছে। বিশেষ মুসলমান-রাজ্যের অরাজকতায় ও অশাসনে সকলে মুসলমানের উপর বিরক্ত হইয়া উঠিয়াছিল। হিন্দুধর্ম্মের বিলোপে অনেক হিন্দুই হিন্দুত্ব স্থাপনের জন্য আগ্রহচিত্ত ছিল। অতএব দিনে দিনে সন্তানসংখ্যা বৃদ্ধি হইতে লাগিল। দিনে দিনে শত শত, মাসে মাসে সহস্র সহস্র সন্তান আসিয়া ভবানন্দ জীবানন্দের পাদপদ্মে প্রণাম করিয়া দলবদ্ধ হইয়া দিগ্দিগন্তরে মুসলমানকে শাসন করিতে বাহির হইতে লাগিল। যেখানে রাজপুরুষ পায়, ধরিয়া মারপিট করে, কখন কখন প্রাণবধ করে, যেখানে সরকারী টাকা পায় লুটিয়া লইয়া ঘরে আনে, যেখানে মুসলমানের গ্রাম পায় দগ্ধ করিয়া ভস্মাবশেষ করে।
তখন নগরের মহারাজাধিরাজের চৈতন্য হইল। সন্তানদিগের শাসনার্থে তিনি ভূরি ভূরি সৈন্য প্রেরণ করিতে লাগিলেন কিন্তু এখন সন্তানেরা দলবদ্ধ শস্ত্রযুক্ত এবং মহাদম্ভশালী। তাহাদিগের দর্পের সম্মুখে মুসলমান সৈন্য অগ্রসর হইতে পারে না। যদি অগ্রসর হয়, অমিতবলে সন্তানেরা তাহাদিগের উপর পড়িয়া তাহাদিগকে ছিন্ন ভিন্ন করিয়া হরিধ্বনি করিতে থাকে। যদি কখনও কোন সন্তানের দলকে যবনসৈনিকেরা পরাস্ত করে, তখনই আর এক দল সন্তান কোথা হইতে আসিয়া বিজেতাদিগের মাথা কাটিয়া ফেলিয়া দিয়া হরি হরি বলিতে বলিতে চলিয়া য়ায়। রাজা আসদ উলজমান বড় বিভ্রাটে পড়িলেন। অনেকগুলি গোলা, কামান, হাতী, ঘোড়া পাঠাইলেন, কিছুতেই সন্তানদিগের “জয় দগদীশ হরে” শব্দের নিবারণ নাই। আসদউলজমান দেখিলেন যে রাজ্যচ্যুত হই।
তখন তিনি কাতরে ইংরেজকে চিঠী লিখিলেন। লিখিলেন যে, কোন মতে আমি আর রাজস্ব সংগ্রহ করিতে পারি না বা পাঠাইতে পারি না; আপনারা রক্ষা করেন তবেই খাজনা আদায় করিব, নচেৎ আপনারা আসিয়া আদায় করুন। ইংরেজেরা পূর্ব হইতে নিজে কতক কতক খাজনা আদায় করিতে ছিলেন কিন্তু এখন তাহাদিগেরও যত্ন বিফল হইতে লাগিল। এই সময়ে প্রথিতনামা ভারতীয় ইংরেজকুলের প্রাতঃসূর্য্য ওয়ারণ হেষ্টিংস সাহেব ভারতবর্ষের গভর্ণর জেনারেল। কলিকাতায় বসিয়া লোহার শিকল গড়িয়া তিনি মনে মনে বিচার করিলেন, যে এই শিকল আমি সদ্বীপা সসাগরা ভারতভূমিকে বাঁধিব। একদিন জগদীশ্বর সিংহাসনে বসিয়া নিঃসন্দেহ বলিয়াছিলেন তথাস্তু। কিন্তু সে দিন এখনও দূবে। আজিকার দিনে সন্তানদিগের ভীষণ হরিধ্বনিতে ওয়ারণ হেষ্টিংসও বিকম্পিত হইলেন।
ওয়ারণ হেষ্টিংস প্রথমে ফৌজদারী সৈন্যের দ্বারা বিদ্রোহ নিবারণের চেষ্টা করিয়াছিলেন কিন্তু ফৌজদারী সিপাহীর এমনি অবস্থা হইয়াছিল যে তাহারা কোন বৃদ্ধাস্ত্রীলোকের মুখেও হরিনাম শুনিলে পলায়ন করিত। অতএব নিরুপায় দেখিয়া ওয়ারণ হেষ্টিংস কাপ্তেন টমাস নামক একজন সুদক্ষ সৈনিককে অধিনায়ক করিয়া এক দল কোম্পনীর সৈন্য বিদ্রোহ নিবারণ জন্য বীরভূম প্রদেশে প্রেরণ করিলেন।
কাপ্তেন টমাস বীরভূম পৌঁছিয়া বিদ্রোহ নিবারণের অতি উত্তম বন্দোবস্ত করিতে লাগিলেন রাজার সৈন্য ও জমীদারদিগের সৈন্য চাহিয়া লইয়া কোম্পানির সুশিক্ষিত সদস্ত্রযুক্ত অত্যন্ত বলিষ্ঠ দেশী বিদেশী সৈন্যের সঙ্গে মিশাইলেন। পরে সেই মিলিত সৈন্য দলে দলে বিভক্ত করিয়া সে সকলের আধিপত্যে উপযুক্ত যোদ্ধৃবর্গকে নিযুক্ত করিলেন। পরে সেই সকল যোদ্ধৃবর্গকে দেশ ভাগ করিয়া দিলেন; বলিয়া দিলেন তুমি অমুক প্রদেশে জেলিয়ার মত জাল দিয়া ছাঁকিতে ছাঁকিতে যাইবে। যেখানে বিদ্রোহী দেখিবে পিপীলিকার মত তাহার প্রাণ সংহার করিবে। কোম্পানির সৈনিকেরা কেহ গাঁজা, কেহ রম মারিয়া বন্দুকে সঙ্গীন চড়াইয়া সন্তানবধে ধাবিত হইল। কিন্তু সন্তানেরা এখন অসংখ্য অজেয়, কাপ্তেন টমাসের সৈন্যদল চাসার কাস্তের নিকট শস্যের মত কর্ত্তিত হইতে লাগিল। হরি হরি ধ্বনিতে কাপ্তেন টমাসের কর্ণ বধির হইয়া গেল। এইরূপে ১১৮০ সাল বীরভূমে সন্তান নাম কীর্ত্তিত করিতে লাগিল।