আনন্দমঠ (১৮৮৩)/প্রথম খণ্ড/চতুর্ব্বিংশ পরিচ্ছেদ

চতুর্ব্বিংশ পরিচ্ছেদ।

 মহেন্দ্র সত্যানন্দের পাদবন্দনা করিয়া বিদায় হইলে, তাহার সঙ্গে যে দ্বিতীয় শিষ্য সেই দিন দীক্ষিত হইয়াছিলেন, তিনি আসিয়া সত্যানন্দকে প্রণাম করিলেন। সত্যানন্দ আশীর্ব্বাদ করিয়া কৃষ্ণাজিনের উপর বসিতে অনুমতি করিলেন। পরে অন্যান্য মিষ্ট কথার পর বলিলেন, “কেমন কৃষ্ণে তোমার গাঢ় ভক্তি আছে কি না?”

 শিষ্য বলিল, “কি প্রকারে বলিব। আমি যাহাকে ভক্তি মনে করি, হয় ত সে ভণ্ডামী, নয় ত আত্ম-প্রতারণা।”

 সত্যানন্দ সন্তুষ্ট হইয়া বলিলেন, “ভাল বিবেচনা করিয়াছ। যাহাতে ভক্তি দিন দিন প্রগাঢ় হয়, সেই অনুষ্ঠান করিও। আমি আশীর্ব্বাদ করিতেছি, তোমার যত্ন সফল হইবে। কেন না তুমি অতি নবীনবয়। বৎস, তোমায় কি বলিয়া ডাকিব, তাহা এ পর্য্যন্ত জিজ্ঞাসা করি নাই।”

 নূতন সন্তান বলিল, “আপনার যাহা অভিরুচি, আমি বৈষ্ণবের দাসানুদাস।”

 সত্য। তোমার নবীন বয়স দেখিয়া তোমায় নবীনানন্দ বলিতে ইচ্ছা করে—অতএব এই নাম তুমি গ্রহণ কর। কিন্তু একটা কথা জিজ্ঞাসা করি, তোমার পূর্ব্বে কি নাম ছিল? যদি বলিতে কোন বাধা থাকে, তথাপি বলিও। আমার কাছে বলিলে কর্ণান্তরে প্রবেশ করিবে না। সন্তান-ধর্ম্মের মর্ম্ম এই—যে, যাহা অবাচ্য, তাহাও গুরুর নিকট বলিতে হয়। বলিলে কোন ক্ষতি হয় না।

 শিষ্য। আমার নাম শান্তিরাম দেবশর্ম্মা।

 সত্য। তোমার নাম শান্তিমণি পাপিষ্ঠা। এই বলিয়া সত্যানন্দ শিষ্যের কাল কুচকুচে দেড় হাত লম্বা দাড়ি বাম হাতে জড়াইয়া ধরিয়া এক টান দিলেন। জাল দাড়ি খসিয়া পড়িল।

 সত্যানন্দ বলিলেন,

 “ছি মা! আমার সঙ্গে প্রতারণা—আর যদি আমাকেই ঠকাবে ত এ বয়সে দেড় হাত দাড়ি কেন? আর দাড়ি খাট করিলেও কণ্ঠের স্বর—ও চখের চাহনি, এ বুড়োর কাছে কি লুকাতে পার? যদি এমন নির্ব্বোধই হইতাম, তবে কি এত বড় কাজে হাত দিতাম?”

 শান্তি পোড়ারমুখী, তখন দুই চোক ঢাকা দিয়া কিছুক্ষণ অধোবদনে বসিল। পরক্ষণেই হাত নামাইয়া বুড়োর মুখের উপর বিলোল কটাক্ষ নিক্ষেপ করিয়া বলিল “প্রভু, দোষই বা কি করিয়াছি। স্ত্রী-বাহুতে কি কখন বল থাকে না?”

 সত্য। গোষ্পদে যেমন জল।

 শান্তি। সন্তানদিগের বাহুবল কি আপনি কখন পরীক্ষা করিয়া থাকেন?

 সত্য। থাকি।

 এই বলিয়া সত্যানন্দ, এক ইস্পাতের ধনুক, আর লোহার কতকটা তার আনিয়া দিলেন, বলিলেন যে “এই ইস্পাতের ধনুকে এই লোহার তারের গুণ দিতে হয়। গুণের পরিমাণ দুই হাত। গুণ দিতে দিতে ধনুক উঠিয়া পড়ে, যে গুণ দেয় তাকে ছুড়িয়া ফেলিয়া দেয়। যে গুণ দিতে পারে সেই প্রকৃত বলবান্‌।”

 শান্তি ধনুক ও তীর উত্তমরূপে পরীক্ষা করিয়া বলিল “সকল সন্তান কি এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়াছে?”

 সত্য। না, ইহা দ্বারা তাহাদিগের বল বুঝিয়াছি মাত্র।

 শান্তি। কেহ কি এ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয় নাই?

 সত্য। দুই জন মাত্র।

 শান্তি। জিজ্ঞাসা করিব কি, কে কে?

 সত্য। নিষেধ কিছু নাই। এক জন আমি।

 শান্তি। দ্বিতীয়?

 সত্য। জীবানন্দ।

শান্তি ধনুক লইল, তার লইল, অবহেলে তাহাতে গুণ দিয়া, সত্যানন্দের চরণতলে ফেলিয়া দিল।

 সত্যানন্দ বিস্মিত, ভীত এবং স্তম্ভিত হইয়া রহিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে বলিলেন, “একি! তুমি দেবী না মানবী?”

 শান্তি করযোড়ে বলিল, “আমি সামান্যা মানবী। কিন্তু আমি ব্রহ্মচারিণী।”

 সত্য। তাই বা কিসে? তুমি কি বালবিধবা? না বালবিধবারও এত বল হয় না, কেন না তাহারা একাহারী।

 শান্তি। আমি সধবা।

 সত্য। তোমার স্বামী নিরুদ্দিষ্ট?

 শান্তি। উদ্দিষ্ট। তাঁহার উদ্দেশেই আসিয়াছি।

 সহসা মেঘভাঙ্গা রৌদ্রের ন্যায় স্মৃতি সত্যানন্দের চিত্তকে প্রভাসিত করিল। তিনি বলিলেন, “মনে পড়িয়াছে, জীবানন্দের স্ত্রীর নাম শান্তি। তুমি কি জীবানন্দের ব্রাহ্মণী?”

 এবার জটাভারে নবীনানন্দ মুখ ঢাকিল। যেন কতকগুলা হাতীর শুঁড়, রাজীবরাজীর উপর পড়িল। সত্যানন্দ বলিতে লাগিলেন “কেন এ পাপাচার করিতে আসিলে?”

 শান্তি সহসা জটাভার পৃষ্ঠে বিক্ষিপ্ত করিয়া উন্নত মুখে বলিল,

 “পাপাচরণ কি প্রভু? পত্নী স্বামীর অনুসরণ করে সে কি পাপাচরণ? সন্তানধর্ম্মশাস্ত্র যদি একে পাপাচরণ বলে, তবে সন্তানধর্ম্ম অধর্ম্ম। আমি তাঁহার সহধর্ম্মিণী, তিনি ধর্ম্মাচরণে প্রবৃত্ত, আমি তাঁহার সঙ্গে ধর্ম্মাচরণ করিতে আসিয়াছি।”

 শান্তির তেজস্বিনী বাণী শুনিয়া, উন্নত গ্রীবা, স্ফীত বক্ষ, কম্পিত অধর এবং উজ্জ্বল তথচ অশ্রুপ্লুত চক্ষু দেখিয়া সত্যানন্দ প্রীত হইলেন। বলিলেন  ‘“তুমি সাধ্বী। কিন্তু দেখ মা—পত্নী কেবল গৃহধর্ম্মেই সহধর্ম্মিণী—বীর ধর্ম্মে রমণী কি?”

 শান্তি। কোন্ মহাবীর অপত্নীক হইয়া, বীর হইয়াছেন? রাম সীতা নহিলে কি বীর হইতেন? অর্জ্জুনের কতগুলি বিবাহ গণনা করুন দেখি? ভীমের যত বল ততগুলি পত্নী। কত বলিব? আপনাকে বলিতেই বা কেন হইবে?

 সত্য। কথা সত্য, কিন্তু রণক্ষেত্রে কোন্ বীর জায়া লইয়া আইসে?

 শান্তি। অর্জ্জুন যখন যাদবীসেনার সহিত অন্তরীক্ষ হইতে যুদ্ধ করিয়াছিলেন কে তাঁহার রথ চালাইয়াছিল? দ্রৌপদী সঙ্গে না থাকিলে পাণ্ডব কি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে যুঝিত?

 সত্য। তা হউক, সামান্য মনুষ্য দিগের মন স্ত্রীলোকে আসক্ত এবং কার্য্যবিরত করে। এই জন্য সন্তানের ব্রতই এই, যে রমণী জাতির সঙ্গে, একাসনে উপবেশন করিবে না। জীবানন্দ আমার দক্ষিণ হস্ত। তুমি আমার ডান হাত ভাঙ্গিয়া দিতে আসিয়াছ?

 শান্তি। আমি আপনার দক্ষিণ হস্তে বল বাড়াইতে আসিআছি। আমি ব্রহ্মচারিণী, প্রভুর কাছে ব্রহ্মচারিণীই থাকিব। আমি কেবল ধর্ম্মাচরণের জন্য আসিয়াছি; স্বামিসন্দর্শনের জন্য নয়। বিরহ-যন্ত্রণায় আমি কাতরা নই। স্বামীর ধর্ম্মচ্যুতির ভয়ে আমি কাতরা। বৃষ্টির অভাবে মহান্ মহীরুহও শুষ্ক হয়, আমি মহান্‌ মহীরুহতলে বৃষ্টি করিব। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।

 সত্য। সে কি? মহান্ মহীরুহেরও অনাবৃষ্টির ভয়? জীবানন্দের ধর্ম্মচ্যুতি?

 শান্তি। যাহা ঘটিয়াছে, তাহা আবার ঘটিতে পারে।

 সত্য। কি ঘটিয়াছে? জীবানন্দের ধর্ম্মচ্যুতি ঘটিয়াছে? হিমালয় গহ্বরে ডুবিয়াছে?

 শান্তি। কেবল সহধর্ম্মিণী-সাহায্যের অভাবে।

 সত্য। কি বলিতেছ, আমি কিছুই বুঝতেছি না।

 শান্তি। কাল মধ্যাহ্নে তিনি আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়াছিলেন। ব্রত ভঙ্গ হইয়াছে।

 এবার সেই পলিতকেশ ব্রহ্মচারী চক্ষু ঢাকিয়া কাঁদিতে বসিল। সত্যানন্দকে আর কেহ কখন কাঁদিতে দেখে নাই।

 শান্তি বলিল “প্রভু, আপনার চক্ষে জল কেন?”

 সত্য। প্রায়শ্চিত্ত কি জান?

 শান্তি। জানি, আত্মহত্যা।

 সত্য। তাই কাঁদিতেছি। জীবানন্দের শোকে কাঁদিতেছি।

 শান্তি। আমিও তাই আসিয়াছি; যাহাতে জীবানন্দ না মরে, সেই জন্য আসিয়াছি।

 সত্য। বৎসে, তোমার অভীষ্ট সিদ্ধ হউক। তোমার সকল অপরাধ মার্জ্জনা করিলাম। তুমি সন্তানমধ্যে পরিগণিত হইলে। আমি এতক্ষণ তোমার মর্ম্ম বুঝি নাই, তাই তিরস্কার করিতেছিলাম? আমি কি বুঝিব? বনচারী ব্রহ্মচারী বৈ ত নই। স্ত্রীলোেকর তুল্য হইব কি প্রকারে? জীবানন্দ মরিবে, আমিও রাখিতে পারিব না, তুমিও রাখিতে পারিবে না। জীবানন্দ আমার প্রাণাধিক প্রিয়, কিন্তু দেখ দক্ষিণ হস্ত গেলে দেবতার কার্য্য করিতে পারি না। যত দিন পার, জীবানন্দকে পৃথিবীতে রাখিও। সঙ্গে সঙ্গে আপনার ব্রহ্মচর্য্যা রাখিও। তুমি আমার প্রিয় শিষ্য হইলে। সন্তান মাত্রই আমার আনন্দ। এই জন্য সন্তানেরা সকলে আনন্দ নাম ধারণ করে। এ আনন্দমঠ। তুমিও আনন্দ নাম ধারণ কর। তোমার নাম নবীনানন্দই রহিল।

 শান্তি বলিলেন, “আনন্দমঠে আমি থাকিতে পাইব কি?

 সত্য। আজ আর কোথা যাইবে?

 শান্তি। তার পর?

 সত্য। মা ভবানীর মত তোমার ও ললাটে আগুন আছে; সন্তানসম্প্রদায় কেন দাহ করিবে? এই বলিয়া পরে আশীর্ব্বাদ করিয়া সত্যানন্দ শান্তিকে বিদায় করিলেন।

 শান্তি মনে মনে বলিল “র বেটা বুড়ো! আমার ললাটে আগুন! আমি পোড়া কপালি না, তোর মা পোড়া কপালি!” বস্তুত সত্যানন্দের সে অভিপ্রায় নহে—চক্ষের বিদ্যুতের কথাই তিনি বলিয়াছিলেন, কিন্তু তা কি বুড়ো বয়সে ছেলে মানুষকে বলা যায়?