আনন্দী বাঈ/তৃতীয় অধ্যায়
গোপাল রাওয়ের ব্যবহার অন্য বিষয়ে যেরূপই হউক, একটী বিষয়ে তিনি অতীব দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন। স্বদেশীয় রমণী-সমাজের মঙ্গল কামনা তরুণ বয়স হইতেই তাঁহার হৃদয়ে গভীর ভাবে বদ্ধমূল হইয়াছিল। কিন্তু স্ত্রী-শিক্ষা ও স্ত্রী-স্বাধীনতা সম্বন্ধে তাঁহার সমসাময়িক সংস্কারকেরা যে আন্দোলন উপস্থিত করিয়াছিলেন, তিনি তাহার বিশেষ পক্ষপাতী ছিলেন না। মৌখিক আন্দোলন অপেক্ষা কার্যতঃ স্ত্রীজাতির হিতসাধনে তাহার অধিকতর মনোযোগ ছিল। এ বিষয়ে স্বীয় সহধর্ম্মিণীর বিশেষ সহায়তা-লাভের আকাঙ্ক্ষায় তিনি ধীর ও অবিচলিত ভাবে তাঁহাকে শিক্ষাদানপূর্ব্বক আপনার অভীষ্ট সাধনের উপযোগিনী করিয়া লইতেছিলেন। দেশের অবস্থার পর্য্যালোচনা করিয়া তাঁহার এইরূপ সংস্কার হইয়াছিল যে, উপযুক্ত চিকিৎসয়িত্রীর অভাবে ভারতীয় মহিলাকুলকে পদে পদে যেরূপ বিড়ম্বনা-ভোগ করিতে হয়, আর কিছুরই অভাবে সেরূপ হয় না। এই কারণে, অপর কোনও বিষয়ে বিশেষ লক্ষ্য না করিয়া সেই অভাব মোচনের জন্য তিনি নীরবে স্বীয় ক্ষুদ্র শক্তির নিয়োগ করিয়াছিলেন। দুঃসময়ের জন্য স্ত্রীকে স্বাধীনভাবে জীবিকার্জ্জনের যোগ্য করাও তাঁহার অন্যতর উদ্দেশ্য ছিল। শ্রীরামপুর হইতে আনন্দী বাঈ শ্রীমতী কার্পেণ্টারকে লিখিয়াছিলেন, “চিকিৎসা-বিদ্যা শিক্ষা করিয়া আমাদিগের দেশের একটি প্রধান অভাব দূর করিবার জন্য আমি নিতান্ত ব্যগ্র হইয়াছি। স্বামীর উপদেশ-গুণেই যে এ বিষয়ে আমার এইরূপ প্রবল আগ্রহ জন্মিয়াছে, একথা আমি স্বীকার করিতে বাধ্য। তাঁহার উপদেশ আমার হৃদয়ে এরূপ দৃঢ়ভাবে মুদ্রিত হইয়াছে যে, তাহা আর কিছুতেই অপনোদিত হইবার নহে। আমার এ সংকল্প কিছুতেই বিচলিত হইবে না।”
এইরূপ মহৎ উদ্দেশ্যের দ্বারা পরিচালিত হইয়া এই মহারাষ্ট্রীয় দম্পতী স্বদেশ-পরিত্যাগ-পূর্ব্বক আমেরিকা গমনের সংকল্প করিয়াছিলেন। কেবল তাহাই নহে, পাশ্চাত্য ও দেশীয় চিকিৎসা-বিজ্ঞানের ঐক্যবিধান-পূর্ব্বক দেশের বর্ত্তমান অবস্থার উপযোগী চিকিৎসা-প্রণালীর প্রবর্ত্তন-কল্পে চেষ্টা করাও আনন্দী বাঈর অন্যতম লক্ষ্য ছিল। অর্থাভাবে তাঁহাদিগের সংকল্প অনেক দিন কার্য্যে পরিণত হয় নাই। কলিকাতায় আসিয়া গোপাল রাওয়ের কর্ম্মচ্যুতি ঘটিলে, তিনি স্বদেশে ফিরিয়া না গিয়া আমেরিকা যাত্রার আয়োজন করিতেছিলেন। কিন্তু কর্ত্তৃপক্ষ তাহাকে নির্দ্দোষ জানিয়া অল্পদিনের মধ্যেই পুনরায় স্বপদে প্রতিষ্ঠিত করায় তাঁহার আমেরিকা যাত্রা কিছু দিনের জন্য স্থগিত রহিল।
শ্রীরামপুরে কিছুদিন অবস্থানের পর গোপাল রাও সস্ত্রীক আমেরিকা গমনের জন্য কর্ত্তৃপক্ষের নিকট দুই বৎসরের অবকাশ প্রার্থনা করিলেন। তিনি ভাবিয়াছিলেন, পত্নীর সহিত তাঁহার আমেরিকায় থাকিবার সুবিধা হইলে, দুই বৎসরে আনন্দী বাঈর চিকিৎসা-বিজ্ঞান শিক্ষা পরিসমাপ্ত হইবে। কিন্তু রাজপুরুষেরা তাহাকে ছুটি দিতে অসম্মত হওয়ায় তাঁহার সংকল্পে বাধা পড়িল। তথাপি গোপাল রাও বিচলিত হইলেন না। বহু চিন্তার পর তিনি একদিন সহসা আনন্দী বাঈকে বলিলেন,—“আমি দেখিতেছি, আর বৃথা সময় নষ্ট করায় কোনও ফল নাই। অতএব তুমি একাকিনী আমেরিকায় গমন কর। আমি কিছুদিন পরে তথায় উপস্থিত হইবার চেষ্টা করিব।”
স্বামীর কথা শুনিয়া আনন্দী বাঈ বিস্মিত হইলেন। কিন্তু তাঁহার কোনও উত্তর-দানের পূর্ব্বেই গোপাল রাও বলিলেন,—“এ পর্য্যন্ত কোনও ব্রাহ্মণপত্নী একাকিনী বিদেশে গমন করেন নাই। অতএব তুমি এ বিষয়ে সকলের পথি-প্রদর্শিনী হও। স্বদেশীয় রীতিনীতির বিন্দুমাত্র পরিবর্ত্তন না করিয়া স্বীয় ব্যবহার-গুণে আমেরিকাবাসীকে হিন্দু রীতিনীতির পক্ষপাতী কর। স্ত্রীলোকের দ্বারা কোনও মহৎ কার্য্য সাধিত হয় না বলিয়া এদেশে যে প্রবাদ আছে, তুমি তাহা উপকথায় পরিণত কর। এদেশের অনেক সংস্কারক নারী জাতির মঙ্গলের জন্য বহুদিন হইতে মৌখিক আন্দোলন করিতেছেন, কিন্তু কার্য্যতঃ কাহারও দ্বারা কিছুই ঘটিয়া উঠিতেছে না। আমার ইচ্ছা, তুমি সেই দুষ্কর কার্য্য অংশতঃ সম্পাদন করিয়া সকলের উদাহরণ-স্থানীয়া হও।”
স্বামীর উপদেশামৃত-সেচনের ফলে আনন্দী বাঈর হৃদয়ক্ষেত্রে স্বদেশ-হিতৈষণার বীজ ইতঃপূর্ব্বেই উপ্ত ও অঙ্কুরিত হইয়াছিল। এই কারণে স্বামীর এই আদেশ-শ্রবণ-মাত্র তিনি তাহাতে সম্মতি প্রকাশ করিলেন। ইহার পর ভাবী বিরহের ও বৈদেশিক দুঃখ-কষ্টের কথা স্মরণ করিয়া তিনি কয়েকবার বিচলিতা হইয়াছিলেন। কিন্তু ভগবানের করুণায় দৃঢ় বিশ্বাস ও কর্ত্তব্য-পালনে অটল বাসনা-বশতঃ তিনি চিরপোষিত সংকল্পের পরিহার করিলেন না। এই বিষয়ে শ্রীমতী কার্পেণ্টারকে তিনি যে সকল পত্র লিখিয়াছিলেন, তাহাতে তাঁহার পতি-বিচ্ছেদ-সম্ভাবনায় উদ্বেগ, স্বামীর অর্থাভাবের জন্য দুঃখ প্রকাশ, তাঁহার আমেরিকা গমনে আত্মীয় বন্ধুগণের আপত্তি ও তাঁহার পাতিব্রত্যনাশের আশঙ্কা, তাঁহার দৃঢ়-চিত্ততা, স্বদেশ-ভগিনীগণের কল্যাণ-সাধনে উৎসাহ প্রভৃতি বিবিধ বিষয়ের চিত্র দেখিতে পাওয়া যায়। একখানি পত্রে তিনি স্বীয় শেষ সিদ্ধান্ত এইরূপে ব্যক্ত করিয়াছেন,—
“আমি প্রতিজ্ঞা করিয়াছি যে, যে কার্য্যের জন্য আমেরিকা যাইতেছি, তাহা যদি সুসিদ্ধ হয়, তাহা হইলেই আমি স্বদেশে প্রত্যাবৃত্ত হইব। যদি অকৃতকার্য্য হই, তবে ভারতে আর কাহাকেও মুখ দেখাইব না। প্রাচীন কালের হিন্দুরমণীগণ কিরূপ বুদ্ধিমতী, শৌর্য্যশালিনী ও পরোপকার-পরায়ণা ছিলেন, তাহা আমি জানি। সেই বংশে জন্মগ্রহণ করিয়া আমি তাঁহাদিগের নাম কখনই কলঙ্কিত করিব না। যেরূপে হউক, আমি স্বীয় কর্ত্তব্য-পালন করিব। আমার বিশ্বাস, কেহ আমার অনিষ্ট-সাধন করিতে পারিবে না। কারণ, একমাত্র ঈশ্বর ভিন্ন কেহ কাহারও ইষ্টানিষ্ট-সাধন করিতে পারে না। আমরা সকলেই যখন পরমেশ্বরের সন্তান, তখন কেন আমি বিপন্ন হইব? আমাকে আমার কর্ত্তব্যপালন করিতেই হইবে। “মন্ত্রের সাধন কিম্বা শরীর পাতন।” মরি বা বাঁচি, আমি সঙ্কল্প-চ্যুত হইব না। * * * * * আমি যাঁহার বাটীতে থাকিব, তিনি যেন আমাকে কন্যার মত দেখেন, ইহাই আমার প্রার্থনা। আমাকে তথায় অবস্থানকালে স্বহস্তে পাক করিতে হইবে। তাহাতে খরচও কিছু কম পড়িতে পারে।” এই সময়ে সেই বীরবালার বয়স ১৭ বৎসর মাত্র ছিল!
গোপাল রাও বোম্বাইয়ের থিয়সফিক্যাল সোসাইটীর সভ্য ছিলেন। এই কারণে আনন্দী বাঈর আমেরিকা গমনের সংবাদ শ্রবণ করিয়া কর্ণেল অল্কট মহোদয় তাঁহাকে আমেরিকার একজন বিচারপতির নামে একখানি অনুরোধ-পত্র লিখিয়া দিলেন। ইহার পর উপযুক্ত সহযাত্রীর অনুসন্ধানে ও অপর নানা কারণে বহু দিবস অতিবাহিত হইয়া গেল। এদিকে আনন্দী বাঈ আমেরিকা যাইবেন, এই কথা সংবাদপত্রে প্রচারিত হওয়ায় তাঁহার আত্মীয় স্বজন ও বন্ধুবান্ধবেরা নানা প্রকারে তাঁহাকে বাধা দিতে লাগিলেন। তাঁহার অনেক হিতৈষী ব্যক্তিও এই সময়ে তাঁহার শত্রুতাচরণে প্রবৃত্ত হইলেন। কিন্তু আনন্দী বাঈ কিছুতেই সংকল্প ত্যাগ করিলেন না।
আনন্দী বাঈর আমেরিকায় গমনের কারণ-সম্বন্ধে অনেকে তাঁহাকে অনেক প্রকারের প্রশ্ন করিতেছিলেন। সেই সকল প্রশ্নের উত্তর-দানের জন্য আনন্দী বাঈ স্থানীয় বিদ্যালয়গৃহে সভা আহূত করিয়া স্বীয় বক্তব্য ইংরাজী ভাষায় বক্তৃতাকারে প্রকাশ করেন। সে বক্তৃতা সেই সময়ের অধিকাংশ দেশীয় ও ইংরাজী সংবাদপত্রে প্রকাশিত হইয়াছিল। সপ্তদশবর্ষীয়া ব্রাহ্মণ-যুবতীর মুখে প্রকাশ্য সভায় ইংরাজী ভাষাতে সেই অনর্গল বক্তৃতা শ্রবণ করিয়া অনেকেই মুগ্ধ হইয়াছিলেন। সে দিনকার বক্তৃতায় আনন্দী বাঈ যে ছয়টি প্রশ্নের উত্তর দিয়াছিলেন, সেগুলি এই,
১। আমি কেন আমেরিকায় যাইতেছি?
২। ভারতবর্ষে থাকিয়া কি শিক্ষালাভ অসম্ভব?
৩। আমি একাকিনী যাইতেছি কেন?
৪। আমেরিকা হইতে ফিরিয়া আসিলে সামাজিকগণ আমায় জাতিচ্যুত করিবেন কি না?
৫। যদি বিদেশে আমার কোনও বিপদ ঘটে, তাহা হইলে আমি কি করিব?
৬। আজ পর্য্যন্ত কোনও রমণী যে কার্য্য করেন নাই, সে কার্য্যে আমি হস্তক্ষেপ করিতেছি কেন?
প্রথম প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “এ দেশীয় মহিলাসমাজের যত প্রকার অভাব আছে, তন্মধ্যে চিকিৎসা-শাস্ত্রে জ্ঞানসম্পন্না রমণীর অভাবই সর্ব্ব প্রধান। এ দেশের অনেক সভাসমিতি স্ত্রী-শিক্ষা, স্ত্রী-স্বাধীনতা ও শিল্প-কলা-বিজ্ঞানাদির প্রবর্ত্তন-বিষয়ে যত্নশীল হইয়াছেন; কিন্তু দেশীয় রমণীদিগকে আমেরিকার ন্যায় সভ্য দেশে প্রেরণ-পূর্ব্বক চিকিৎসা-শাস্ত্রে পারদর্শিনী করিয়া তাঁহাদিগের দ্বারা এদেশে চিকিৎসা-বিদ্যার বিস্তার-বিষয়ে কেহই মনোযোগ দেয় নাই। ইউরোপীয় বা আমেরিকা দেশীয় চিকিৎসয়িত্রীরা এদেশের রীতি-নীতি-বিষয়ে অনভিজ্ঞা ও ভিন্ন ধর্ম্মাবলম্বিনী। এ কারণে তাঁহাদিগের দ্বারা এদেশীয় রমণীবৃন্দের চিকিৎসা-কার্য্য সুচারুরূপে সম্পন্ন হয় না। ভারতীয় মহিলাকুলের এই গুরুতর অভাব দূর করিবার জন্য আমি স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া আমেরিকায় ডাক্তারী বিদ্যা শিক্ষা করিতে যাইতেছি।”
দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তরে তিনি যাহা বলেন, তাহার মর্ম্ম এইরূপ,—“মান্দ্রাজ ভিন্ন ভারতের আর কুত্রাপি ভালরূপে ডাক্তারী শিখিবার কলেজ নাই। অন্যত্র যাহা আছে, তাহাতে ধাত্রীবিদ্যার অধিক আর কিছুই শিখান হয় না। মান্দ্রাজেও হিন্দুরমণীর শিক্ষার কোনও বিশেষ বন্দোবস্ত নাই। আমিও ডাক্তারি শিখিবার জন্য ধর্মান্তরগ্রহণ করিতে অনিচ্ছুক। সুতরাং আমার পক্ষে এদেশে কোনও স্থানে শিক্ষার সুবিধা নাই।” বোম্বাই, কলিকাতা ও শ্রীরামপুরে অবস্থান-কালে দুষ্ট ও ইতর জনেরা তাঁহার প্রতি পরিহাস-বিদ্রূপাদি বর্ষণ করিয়া তাহাকে কিরূপ ব্যথিত করিত, অনেক ভদ্রনামধারী ব্যক্তিও যেরূপে তাঁহার অলীক কুৎসা-রটনা দ্বারা তৃপ্তিলাভ করিত, এই প্রসঙ্গে তিনি তাহারও বর্ণনা করেন এবং বলেন যে, আমেরিকায় এ সকল বিভ্রাট ঘটিবার সম্ভাবনা নাই।
তৃতীয় প্রশ্নের উত্তরে তিনি স্বীয় স্বামীর দারিদ্র্যের উল্লেখ করিতে বাধ্য হন। তদ্ভিন্ন তাঁহার শ্বশুর, শ্বশ্রূ ও অল্পবয়স্ক দেবরাদির ভরণপোষণের ভার যখন তাঁহার স্বামীর উপরই ন্যস্ত ছিল, তখন তাঁহাদিগকে অসহায় অবস্থায় ফেলিয়া স্ত্রীর রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আমেরিকায় গমন গোপাল রাওয়ের পক্ষে যুক্তি সঙ্গত কার্য্য বলিয়া তিনি বিবেচনা করেন নাই।
আমেরিকায় গমন-হেতু সামাজিক দণ্ডের বিষয় উল্লেখ করিয়া তিনি বলেন,—“আমি যদি সেখানে সম্পূর্ণ হিন্দুভাবে অবস্থান করি, তাহা হইলে কেন আমাকে সমাজচ্যুত হইতে হইবে, তাহা আমি বুঝিতে পারি না। আমি বেশ-ভূষা ও আচার-ব্যবহারাদি সর্ব্ববিষয়ে আমার পূর্ব্বপুরুষদিগের প্রদর্শিত মার্গের অনুসরণ করিব, সংকল্প করিয়াছি। যেখানেই গমন করি না কেন, আমি যে হিন্দু রমণী, ইহা আমি কখনও ভুলিব না। ইহার পরও যদি কেহ আমায় সমাজচ্যুত করিতে চাহেন, তবে তাঁহারা এখনই তাহা করিতে পারেন। সেজন্য আমি ভীত নহি।”
পঞ্চম প্রশ্ন সম্বন্ধে তিনি বলেন, বিপদ স্বদেশে বিদেশে সর্ব্বত্র সকলেরই ঘটিয়া থাকে ও ঘটিতে পারে, সেজন্য দেশহিতকর অনুষ্ঠানে কাহারও বিরত হওয়া উচিত নহে।
শেষ প্রশ্নের উত্তরে শিবি ও ময়ূরধ্বজ রাজার উপাখ্যান বিবৃত করিয়া তিনি বলেন, “বহু জন-সমাজের হিতের জন্য ব্যক্তিগত শ্রম স্বীকারে পশ্চাৎপদ হওয়া বিবেক-সম্পন্ন ব্যক্তির কর্ত্তব্য নহে। যে সমাজে বাস করিতেছি, অহরহঃ যে সমাজের নিকট হইতে নানা প্রকার সাহায্য প্রাপ্ত হইতেছি, সেই সমাজের হিতসাধনের জন্য, প্রাপ্ত উপকারের পরিশোধ করিবার জন্য, কষ্ট স্বীকার করা প্রত্যেকেরই কর্ত্তব্য। অপরে সে কর্ত্তব্য-পালনে ঔদাস্য-প্রকাশ করিয়াছে বলিয়া আমাকেও কি তাহাই করিতে হইবে?”
শ্রীরামপুরের কলেজেও তিনি এই মর্ম্মে একটী বক্তৃতা করেন। ইহার পরে শিক্ষিত সমাজের অনেকে তাঁহাকে উৎসাহ দান করিয়া পত্র লিখেন। ডাক বিভাগের ডিরেক্টর এই সংবাদ অবগত হইয়া আনন্দী বাঈকে সাহায্য-স্বরূপ এক শত টাকার একখানি নোট পাঠাইয়া দেন। আমেরিকা-যুক্তরাজ্যের কলিকাতাস্থ রাজদূতও তাঁহাকে আমেরিকার দুই জন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তির নামে দুই খানি অনুরোধ পত্র প্রদান করেন। তিনি তাঁহার উদ্দেশ্যের প্রশংসা পূর্ব্বক আমেরিকার একখানি সংবাদ-পত্রে তাঁহার সচিত্র জীবনচরিত লিখিয়াও তাঁহার প্রতি আমেরিকাবাসীর সহানুভূতি উদ্রিক্ত করিলেন। ডাক্তার থোবার্ণ নামক জনৈক কলিকাতা-প্রবাসী আমেরিকান মিশনরীর নিকট হইতেও আনন্দী বাঈ পাদরি সাহেবের আমেরিকাস্থিত বন্ধুবান্ধবের নামে অনুরোেধ-পত্র সংগ্রহ করিতে সমর্থ হইলেন।
১৮৮৩ খৃষ্টাব্দের ৭ই এপ্রিল আনন্দী বাঈর আমেরিকা যাত্রার দিবস নির্দ্ধারিত হইল। প্রথমতঃ গোপাল রাও তাঁহার সহিত এডেন বা নিতান্ত পক্ষে মান্দ্রাজ পর্য্যন্ত গমন করিবেন, স্থির করিয়াছিলেন। কিন্তু অর্থ ও অবকাশের অভাবে তাঁহাকে সে সংকল্পও ত্যাগ করিতে হইল। পরিশেষে শ্রীমতী জন্সন নাম্নী একটি মহিলা তাঁহাকে সঙ্গে করিয়া লইয়া যাইবেন বলিয়া আশ্বাস প্রদান করিলেন। ফিলেডেলফিয়ার “ওল্ড স্কুল” নামক চিকিৎসা-বিদ্যালয়ে যাঁহারা অধ্যয়ন-অধ্যাপনা করেন তাঁহাদিগের সকলেই রমণী,—সেখানে পুরুষের সঞ্চারমাত্র নাই। আনন্দী বাঈ সেই বিদ্যালয়ে গিয়া চিকিৎসা-বিজ্ঞান শিক্ষা করিবেন, স্থির করিলেন।
অতঃপর যাত্রার আয়োজন আরব্ধ হইল। আমেরিকায় এদেশীয় পদার্থ দুর্লভ বলিয়া আনন্দী বাঈ প্রচুর পরিমাণে চুড়ি, কাঁচুলী, দেশীয় কাপড়, মারাঠী সাড়ী ও উৎকৃষ্ট দেশীয় সিন্দূর প্রভৃতি সঙ্গে লইলেন। আনন্দী বাঈ বৈদেশীক দ্রব্য-ব্যবহারের ঘোর বিরোধিনী ছিলেন। এই কারণে তাঁহাকে তিন বৎসর ব্যবহারের উপযোগী সমস্ত দ্রব্য এখান হইতে লইয়া যাইতে হইয়াছিল। আমেরিকায় এখানকার অপেক্ষা শীতের প্রকোপ অধিক। শুদ্ধ কঞ্চুলিকা দ্বারা তথায় শীত নিবারিত হইবার সম্ভাবনা নাই দেখিয়া আনন্দী বাঈ জামা প্রস্তুত করিবার জন্য পশ্চিমাঞ্চলের “ধোসা” প্রভৃতির ন্যায় অতি কর্কশ ঊর্ণ বস্ত্রাদি বহু পরিমাণে ক্রয় করিয়াছিলেন। আমেরিকাবাসীকে দেখাইবার জন্য তিনি রামচন্দ্র, শঙ্কর, পার্ব্বতী প্রভৃতি দেবদেবীর চিত্রাদিও সঙ্গে লইয়াছিলেন। ফলতঃ, তাঁহার আমেরিকা-গমনে বর্ত্তমানকালের তামসিকতা বা বিলাসিতার লেশ মাত্র ছিল না। তিনি আশ্রমচারিণী তপস্বিনী ঋষি-কন্যার ন্যায় জ্ঞানাকাঙ্ক্ষিণী হইয়া অতি পবিত্রভাবে খৃষ্ট রাজ্য আমেরিকায় গমন করিয়াছিলেন। যৌবনে চিত্তের এরূপ সংযম অধুনা বড় দুর্লভ।
৬ই এপ্রিল রাত্রি ১১টা পর্যন্ত যাত্রার সমস্ত আয়োজন শেষ করিয়া আনন্দী বাঈ সমস্ত দিবসের পরিশ্রমের পর শয্যাগতা হইলেন। সে রজনীতে গোপাল রাওয়ের নিদ্রাকর্ষণ হইল না। সপ্তদশবর্ষীয়া যুবতী স্ত্রীকে দেশের ও তাহার নিজের মঙ্গলের জন্য সমুদ্র পারে নির্বাসিত করিতে প্রবৃত্ত হইয়া তিনি ভাল কি মন্দ কার্য্য করিতেছেন, তাঁহার হৃদয়ের স্নেহ-সর্বস্ব দান করিয়া তিনি যাহাকে এতদিন পালিত ও বর্দ্ধিত করিয়াছেন, অপরিচিত দূর দেশে কে তাহার রক্ষণাবেক্ষণ করিবে, তিনিই বা কিরূপে প্রিয়তমার বিরহে একাকী কালযাপন করিতে পারিবেন প্রভৃতি বিবিধ চিন্তায় সমস্ত রাত্রি তাহার মস্তিষ্ক ঘূর্ণ্যমান হইতেছিল।
সমীপবর্ত্তী গির্জার ঘড়িতে ঢঙ্ ঢঙ্ ঢঙ্ করিয়া তিনটা রাজিবামাত্র গোপাল রাও সহধর্ম্মিণীর নিদ্রাভঙ্গ করিয়া তাঁহাকে যাত্রার জন্য প্রস্তুত হইতে বলিলেন। আনন্দী বাঈ শয্যার উপর উঠিয়া বসিবামাত্র প্রবল শোকাবেগে গোপাল রাওয়ের কণ্ঠ-রোধ হইল। মুহূর্ত্ত পরে প্রিয়তম স্বামীর ও মাতৃকল্পা জন্মভূমির শান্তিস্নিগ্ধ ক্রোড় হইতে বহুদূরে নির্ব্বাসিত হইতে হইবে ভাবিয়া আনন্দী বাঈ উদ্বেলচিত্ত হইলেন। তাঁহারও কথা কহিবার শক্তিমাত্র রহিল না। তিনি শোক-গম্ভীর চিত্তে আত্মীয় বন্ধুগণকে অভিবাদন করিয়া স্বামীর সহিত শকটারোহণে বন্দর অভিমুখে যাত্রা করিলেন। পথি-মধ্যে উভয়েরই নিস্পন্দ দৃষ্টি পরস্পরের মুখমণ্ডলের প্রতি নিবদ্ধ ছিল। তাঁহাদের মধ্যে কেহই বিদায়সম্ভাষণের জন্য বাক্যস্ফুর্তি করিতে পারিলেন না।
বন্দরে উপস্থিত হইয়া আনন্দী বাঈ ষ্টীমারে আরোহণ করিলেন। শ্রীমতী জন্সনের হস্তে স্বীয় পত্নীকে সমর্পণ করিয়া গোপাল রাও বলিলেন, “স্বল্প ব্যয়ে অথচ যথাসম্ভব সুখস্বাচ্ছন্দ্যের সহিত যাহাতে আমার স্ত্রী আমেরিকায় পৌঁছিতে পারেন, আপনি তাহার চেষ্টা করিলে আমি সুখী হইব।” এই কথা শুনিয়া জন্সন সাহেব অতীব উদ্ধতভাবে উত্তর করিলেন,—“তাহা হইতে পারে না। আমার স্ত্রীর সহিত থাকিলে তোমার স্ত্রীকে আমার স্ত্রীর তুল্য অর্থব্যয় করিতে হইবে!” এই উত্তরে গোপাল রাও বজ্রাহত হইলেন। কিন্তু তখন আর প্রত্যাবর্ত্তনের সময় ছিল না। সুতরাং তিনি আনন্দী বাইকে সতর্ক করিয়া দিয়া পরিশেষে বলিলেন,—“তুমি করুণাময় সর্বসাক্ষী পরমেশ্বরের উপর নির্ভর করিয়া থাকিও।”
অতঃপর আর সেখানে দাঁড়াইতে না পারিয়া গোপাল রাও অশ্রুমোচন করিতে করিতে গৃহাভিমুখী হইলেন; এদিকে আনন্দী বাঈর নিরুদ্ধ শোকাবেগ তাঁহার স্ফুরদধর-নাসাপুটে উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিল। তিনি আর রোদন-সম্বরণ করিতে পারিলেন না। প্রবল অশ্রুধারায় তাহার গণ্ডস্থল প্লাবিত ও বস্ত্রাঞ্চল অভিষিক্ত হইল। ষ্টীমার যতক্ষণ দৃষ্টিপথের বহির্ভূত না হইল, ততক্ষণ তাঁহার অশ্রুপ্লত দৃষ্টি গোপাল রাওয়ের প্রতি স্থাপিত ছিল। গোপাল রাও অন্তর্হিত হইবার পরও বহুক্ষণ পর্যন্ত আনন্দী বাঈ চিত্রার্পিতার ন্যায় স্বামীর ধ্যানে নিমগ্ন ছিলেন!
এইরূপে দেশের হিতকর কার্যে আপনার প্রাণের প্রতিমাকে বিসর্জ্জন করিয়া গোপাল রাও শূন্য হৃদয়ে গৃহে প্রত্যাবৃত্ত হইলেন। ইহার পর তাহার অবস্থা যেরূপ হইল, তাহা সীতা দেবীর নির্ব্বাসনকারী রামচন্দ্রের সহিত সম্পূর্ণরূপেই তুলনীয়। তিনি তিন মাসের ছুটী লইয়া সন্ন্যাসীর বেশে ভারতবর্ষের নানাস্থানে ভ্রমণ-পূর্ব্বক চিত্তকে শান্ত করিবার চেষ্টা করেন। সে সময়ে তাঁহার হৃদয় এরূপ শোকবিদ্ধ হইয়াছিল যে, তিনি কোনও স্থানে দুই দিনের অধিক অবস্থান করিতে পারেন নাই।