আনন্দী বাঈ/ষষ্ঠ অধ্যায়


ষষ্ঠ অধ্যায়

পূর্ব্ব হইতে আনন্দী বাঈর স্বাস্থ্যহানি ঘটিয়াছিল। পরীক্ষা দান কালেই তিনি অতীব দুর্ব্বল হইয়া পড়িয়াছিলেন। তাঁহার উপাধিলাভের পরই পণ্ডিত রমা বাঈর কন্যা মনোরমার ভয়ানক অসুখ হয়। আনন্দী বাঈ সেজন্য কয়েক রাত্রি জাগরণ করিয়া তাহার শুশ্রূষা করেন। ইহাতে তাঁহার অসুস্থতা বৃদ্ধি পায়। এই অসুস্থতাকে অতিশ্রম-জনিত মনে করিয়া তিনি অতঃপর বিশ্রামলাভের জন্য স্বামীর সহিত রোশেল নগরে গমন করেন। তথায় কিছুদিন অবস্থান করিয়া কিঞ্চিৎ সুস্থ হইতে না হইতেই তাঁহাকে নিউ ইংল্যাণ্ডের ব্যাক্লে হাঁসপাতালে চিকিৎসাশাস্ত্র সম্বন্ধে কার্য্যমূলক (practical) জ্ঞানলাভের জন্য গমন করিতে হয়। সেখানে সমস্ত দিবারাত্রি রোগীদিগের পর্য্যবেক্ষণে নিযুক্ত থাকিতে বাধ্য হওয়ায় আবার তাঁহার স্বাস্থ্য-ভঙ্গ ঘটিল। পূর্ব্বাবধি তাহার শিরঃপীড়া ছিল। এক্ষণে তাহা বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হইল এবং দুর্ব্বলতার সহিত কাশি দেখা দিল। ইহা যে কোনও ভয়ঙ্কর রোগের পূর্ব্বলক্ষণ, তাহা সে সময়ে কেহই বুঝিতে পারিলেন না। কেবল বায়ুপরিবর্ত্তন ও বিশ্রাম লাভ করিলেই উহা নিরাকৃত হইবে ভাবিয়া সকলেই সেই ব্যবস্থা করিলেন। আনন্দী বাঈ কখনও তাঁহার স্বামীর সহিত, কখনও বা অন্য সঙ্গিনীর সহিত বোষ্টন, প্রভিডেন্স, হার্টফোর্ট, ডিলাওয়ার্কো, সিনসিনেটী, কার্লাইল প্রভৃতি স্বাস্থ্যকর স্থানে কয়েক মাস করিয়া বাস করিলেন। কিন্তু তাহাতে তাঁহার পীড়ার বিশেষ কোনও উপকার হইল না। পূর্ব্বোক্ত স্থানসমূহের মধ্যে বোষ্টন নগর, সিন্‌সিনেটী-স্থিত নায়াগরা নদীর জলপ্রপাত ও কার্লাইল নগরে “ইণ্ডিয়ান স্কুল” বা দক্ষিণ আমেরিকা-প্রবাসী হিন্দুদিগের জন্য প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয় প্রভৃতির সন্দর্শন করিয়া তিনি বিশেষ আনন্দ অনুভব করিয়াছিলেন।

 এই সময়ে বোম্বাই প্রদেশের অন্তর্গত কোহ্লাপুর নামক দেশীয় রাজ্যের অধিপতি স্বীয় রাজধানীতে একটি হাঁসপাতাল স্থাপন করিয়াছিলেন। আনন্দী বাঈ ঐ হাঁসপাতালে চিকিৎসয়িত্রীর পদ গ্রহণ করিবার জন্য নিমন্ত্রিত হইলেন। বহুদিন বিদেশে একাকিনী বাস করিয়া তাঁহারও স্বদেশে গিয়া আত্মীয় স্বজনগণের সহবাসে কালযাপন করিবার বাসনা অতীব প্রবলা হইয়াছিল। কিন্তু গোপাল রাও সে প্রস্তাবে বিরোধী হইলেন। তাঁহার রুশিয়া ও ইংলণ্ড প্রভৃতি দেশে গমনপূর্ব্বক ভারতীয় সামাজিক রীতি নীতির শ্রেষ্ঠত্ব-প্রতিপাদিনী বক্তৃতা করিবার ইচ্ছা ছিল। কাজেই আনন্দী বাঈ একাকিনী স্বদেশে প্রত্যাবৃত্ত হইবেন, স্থির করিলেন। পরিশেষে আনন্দী বাঈর স্বাস্থ্যের অবস্থা ও স্বদেশগমনে ব্যগ্রতা দেখিয়া গোপাল রাওকে স্বীয় সঙ্কল্পের পরিহার করিতে হইল। এই সময়ে আনন্দী বাঈ তাঁহার শ্বশ্রূকে যে কতিপয় পত্র লিখেন, তাহাতে তিনি শাশুড়ীকে কোহ্লাপুরে আসিয়া তাঁহার নিকট বাস করিতে অনুরোধ করিয়াছিলেন। শাশুড়ীর স্নেহলাভের ও তাঁহাকে সর্ব্বপ্রকার সুখী করিবার জন্য তাহার মনে যে এই সময়ে একটা ব্যাকুলতা জন্মিয়াছিল, তাহা এই সকল পত্রে স্পষ্ট বুঝিতে পারা যায়।

 আমেরিকা-ত্যাগের পূর্ব্বে আনন্দী বাঈকে ডাক্তারদিগের পরামর্শক্রমে কিছুদিন পার্ব্বত্য প্রদেশে রাখা হইয়াছিল। কিন্তু তাহাতেও তাঁহার স্বাস্থ্যোন্নতি ঘটিল না; বরং কাশির সঙ্গে ক্রমশঃ তাঁহার জ্বর দেখা দিল। এইরূপ অসুস্থ অবস্থায় তিনি একদিন সকলের নিষেধ অতিক্রম করিয়া একটি সঙ্কটাপন্না প্রসূতিকে প্রসব করাইবার জন্য তাহার গৃহে গমন করিয়াছিলেন। তথায় দশঘণ্টা কাল পরিশ্রম করায় ও প্রত্যাবর্ত্তন-কালে সহসা বৃষ্টির জলে সিক্ত হওয়ায় তাঁহার পীড়া অতিশয় বৃদ্ধি পাইল। পরোপকার-প্রণোদিতা হইয়া তিনি সেই রমণী ও তাহার গর্ভস্থ শিশুর প্রাণ রক্ষা করিলেন বটে, কিন্তু সেজন্য তাঁহাকে পরিশেষে আত্মপ্রাণ বিসর্জ্জন করিতে হইল। এই অত্যাচারে তাঁহার যে পীড়ার বৃদ্ধি হয়, তাহাতেই পরিশেষে তাঁহার জীবনান্ত ঘটে।

 এইরূপে পীড়-বৃদ্ধি হওয়ায় তাঁহাকে কিছুদিন ফিলাডেলফিয়ার স্ত্রীচিকিৎসালয়ে রাখিয়া চিকিৎসিত করান হয়। কিন্তু তাহাতে কোনও ফলোদয় না হওয়ায় তত্রত্য ডাক্তারেরা তাঁহাকে স্বদেশে গমন করিতে উপদেশ দান করিলেন। ইহার পর আনন্দী বাঈ দিন কয়েক নিজের ব্যবস্থানুসারে ঔষধ সেবন করিয়া বিশেষ উপকার লাভ করেন; কিন্তু সে উপকারও দীর্ঘকাল স্থায়ী হইল না। তাঁহার ক্ষয়কাশ রোগ হইয়াছে বুঝিতে পারিয়া গোপাল রাও ও তাঁহার হিতৈষী ব্যক্তিগণ অতীব চিন্তিত হইয়াছিলেন। কিন্তু স্বদেশে গিয়া কবিরাজী চিকিৎসায় তিনি নিশ্চিত আরোগ্য লাভ করিতে পারিবেন—এরূপ ভরসা অনন্দী বাঈর মনে বিলক্ষণ প্রবল ছিল।

 কোহ্লাপুর দরবার হইতে আনন্দী বাঈর জন্য পাথেয় আসিলে তিনি শ্রীমতী কার্পেণ্টার প্রভৃতির সহিত সাক্ষাৎ করিয়া আমেরিকা-ত্যাগের আয়োজন করিতে লাগিলেন। এই সময়ে তাঁহার অধ্যাপিকা কুমারী বড্‌লে তাঁহার সহিত যে ব্যবহার করেন, তাঁহা উল্লেখযোগ্য। আনন্দী বাঈ তাঁহার উপদেশক্রমে খৃষ্টধর্ম্ম-গ্রহণ করেন নাই বলিয়া তিনি ইতঃপূর্বে তাঁহার বহু নির্যাতন করিয়াছিলেন। তাঁহার জন্য উপবাস ও কদন্নভক্ষণ করিতে বাধ্য হইয়া আনন্দী বাঈর স্বাস্থ্যভঙ্গ হইয়াছিল। এক্ষণে যাহাতে আন্দী বাঈ কোহ্লাপুরের হাসপাতালে চিকিৎসয়িত্রীর পদলাভ করিতে না পারেন, সে জন্য সেই আদর্শ (?) খৃষ্টীয়া অধ্যাপিকা অতি গোপনে প্রাণপণে চেষ্টা করিতে লাগিলেন। বলা বাহুল্য, তাঁহার উদ্দেশ্য সফল হয় নাই। ইহার পূর্ব্বে আনন্দী বাঈ বহুবার মিশনরিদিগের দ্বারা উৎপীড়িত হইয়াছিলেন। এই সকল কারণে পাদরিদিগকে ক্রূরপ্রকৃতি, বিশ্বাস-ঘাতক ও ভণ্ড বলিয়া তাঁহার ধারণা হইয়াছিল। স্বদেশে আসিয়া তাঁহার অসুস্থতা যখন বৃদ্ধি পায়, তখন তিনি অনেক সময়েই স্বপ্নে দেখিতেন যে, কোহ্লাপুরের স্ত্রী-চিকিৎসালয়ে মিশনরি রমণীদিগের সহিত তাঁহার কলহ উপস্থিত হইয়াছে এবং সে ব্যাপার মহারাজের দরবার পর্য্যন্ত গড়াইয়াছে।

 ১৮৮৬ খৃষ্টাব্দের ৯ই অক্টোবর আনন্দী বাঈ ও গোপাল রাও সাশ্রুনয়নে শ্রীমতী কার্পেণ্টারের শান্তি-নিকেতন পরিত্যাগ করিয়া বন্দর অভিমুখে যাত্রা করিলেন। বিদায়কালে আনন্দী বাঈ তাঁহার বান্ধবীদিগকে বলিয়াছিলেন যে, তিনি অবসর লইয়া আবার কিছু দিনের জন্য আমেরিকা পরিভ্রমণ করিতে আগমন করিবেন। আমেরিকার অনেক সজ্জন ব্যক্তি তাঁহার সহিত যেরূপ ব্যবহার করিয়াছিলেন, তাহাতে প্রকৃতপক্ষেই সেই দেশের প্রতি তাঁহার একটা স্বাভাবিক অনুরাগ জন্মিয়াছিল। তাই তিনি আমেরিকার সহিত সকল সম্বন্ধ ছিন্ন করিয়া স্বদেশে প্রত্যাবৃত্ত হইতে পারিলেন না। কিন্তু তাঁহার অন্যান্য মনোরথের ন্যায় পুনর্ব্বার আমেরিকা দর্শনের কামনাও অপূর্ণ রহিয়া গেল।

 শ্রীমতী কার্পেণ্টার তাঁহাকে জাহাজে তুলিয়া দিয়া মনঃকষ্টে গৃহে ফিরিলেন। আনন্দী বাঈ তাঁহার বিরহে অতিমাত্র দুঃখিত হইয়াছিলেন। যাত্রা-কালে দক্ষিণ চক্ষু স্পন্দিত হওয়ায় নানা দুশ্চিন্তায় তাঁহার চিত্ত ব্যাকুল হইল। তাহার উপর অর্ণবপোতের আন্দোলন। রুগ্নদেহ আনন্দী বাঈ সমুদ্রপীড়ায় অতিশয় কষ্ট পাইতে লাগিলেন। তাঁহার জ্বর, কাশি, অরুচি, দুর্ব্বলতা প্রভৃতি সমস্ত উপসর্গেরই বৃদ্ধি হইল। ১৩ই অক্টোবর রাত্রিকালে তাঁহার অবস্থা এরূপ শোচনীয় হইল যে, গোপাল রাও তাঁহার জীবনের আশা পরিত্যাগ করিলেন। কিন্তু সৌভাগ্যক্রমে পরদিন তাঁহার স্বাস্থ্যের সামান্য উন্নতি হইল।

 লণ্ডনে আসিয়া তাঁহাদিগকে পোত-পরিবর্ত্তন করিতে হইল। তাঁহারা অপর জাহাজের টিকিট ক্রয় করিয়া উহাতে উঠিবার জন্য গমন করিলেন। কিন্তু জাহাজের অধ্যক্ষ তাঁহাদিগকে “নেটিব” বা “কাল আদমি” বলিয়া জাহাজে চড়িতে নিষেধ করিল। তাঁহারা ভাড়ার টাকা ফিরিয়া পাইলেন এবং অন্য জাহাজের সন্ধান করিতে লাগিলেন। এই ঘটনায় নামা-উঠা ও ভ্রমণ করিতে বাধ্য হওয়ায় রুগ্না আনন্দী বাঈর বিশেষ কষ্ট হইয়াছিল। কিন্তু উপায়াভাবে তাঁহাকে সমস্তই সহ্য করিতে হইল।

 ইহার পর শীঘ্রই তাঁহাদিগের অপর জাহাজে গমনের সুবিধা হইল। অর্থাভাব-বশতঃ গোপাল রাও আনন্দী বাঈর জন্য একখানি প্রথম শ্রেণীর টিকিট কিনিয়া আপনাকে তাঁহার ভৃত্যরূপে পরিচিত করতঃ নিজের জন্য তৃতীয় শ্রেণীর টিকিট ক্রয় করিলেন। লণ্ডন ত্যাগ করিবার পর আনন্দী বাঈ কয়েক দিন সুস্থ ছিলেন। তাহাতে তাঁহার মনে হইল যে, তিনি সম্পূর্ণ স্বাস্থ্যলাভ করিয়াছেন, স্বদেশের সুখকর বায়ুসেবনে তিনি নিরাময় হইবেন। এই ভাবিয়া তিনি স্বীয় স্বাস্থ্যের প্রতি কিঞ্চিৎ অযত্ন প্রকাশ করিতে লাগিলেন। সুতরাং আবার পীড়া বৃদ্ধি পাইল।

 এইরূপ রুগ্ন অবস্থায় ১৬ই নবেম্বর তারিখে শ্রীমতী আনন্দী বাঈ জোশী বোম্বাই নগরীতে উপস্থিত হইলেন। গোপাল রাওয়ের বন্ধুবর্গ তাঁহাদিগের প্রত্যুদ্‌গমনের জন্য সমুদ্রতীরে উপস্থিত হইয়াছিলেন। আনন্দী বাঈ স্বদেশীয় বেশভূষায় সজ্জিত হইয়া অর্ণবপোত হইতে অবতরণ করিলে তাঁহারা পুষ্পবৃষ্টি-সহকারে তাঁহাকে অভিনন্দিত করিলেন। আনন্দী বাঈর আগমন-সংবাদ চারিদিকে প্রচারিত হওয়ায় নানা স্থানের লোকে সভাসমিতি করিয়া তাঁহাকে অভিনন্দনপত্র-প্রেরণে সম্মানিত করিতে লাগিলেন। অনেকে তারযোগেও আনন্দ প্রকাশ করিলেন। সংবাদপত্রের স্তম্ভসমূহ তাঁহার যশোগানে পরিপূর্ণ হইল।

 কিন্তু যাঁহার জন্য এত আনন্দ-প্রকাশ, তিনি রোগের আক্রমণে দিন দিন ক্লিষ্ট হইতে লাগিলেন। একে একে বোম্বাইয়ের অনেক ডাক্তারই তাঁহার চিকিৎসা করিলেন। কয়েকবার স্থান-পরিবর্ত্তনও করা হইল। কিন্তু কিছুতেই দুষ্ট ব্যাধির উপশম হইল না। পরিশেষে আনন্দী বাঈ পুণায় আসিলেন। সেখানকার জলবায়ুর গুণে ও আত্মীয়-স্বজনের সহবাসে প্রথম কয়েকদিন তাঁহার সামান্য স্বাস্থ্যোন্নতি ঘটিল। তাঁহার জননী ভগিনী প্রভৃতি স্বজনেরা তাঁহার সাক্ষাৎকার-লাভ ও সেবার জন্য পুণায় আসিয়াছিলেন। কিন্তু গোপাল রাওয়ের ন্যায় কেহই তাঁহার সেবা শুশ্রূষা করিতে পারেন নাই। সেই সময়ে গোপাল রাও যেরূপ যত্ন ও পরিশ্রম-সহকারে আনন্দী বাঈর শুশ্রূষা করিয়াছিলেন, অনেক জননীও বোধ হয় সন্তানের সেবায় সেরূপ যত্ন-প্রকাশ করিতে পারেন না। তিনি এক মুহূর্ত্তের জন্যও আনন্দী বাঈর নিকট হইতে দূরে থাকিতেন না। সহধর্মিণীর শয্যাপার্শ্বে বসিয়া তিনি অধিকাংশ রজনীই বিনিদ্রনয়নে অতিবাহিত করিতেন। দুর্ভাগ্যক্রমে তাঁহার এই পরিশ্রমের কোনও সার্থকতা হইল না; আনন্দী বাঈ দুরন্ত ব্যাধির পীড়নে ক্ষীণ হইতে ক্ষীণতর হইতে লাগিলেন। অনেক প্রকার ডাক্তারী ও কবিরাজী চিকিৎসা হইল। কিন্তু কোনও ঔষধে স্থায়ী উপকার হইল না। গোপাল রাও একেশ্বরবাদী হইলেও এসময়ে আনন্দী বাঈর জন্য ব্রাহ্মণের দ্বারা স্বস্ত্যয়ন, শান্তি, শিব-পূজা প্রভৃতি দৈব উপায়ের অবলম্বনেও বিরত হইলেন না।

 আনন্দী বাঈর অসুস্থতার বার্তা অবগত হইয়া প্রত্যহ বহুসংখ্যক ব্যক্তি তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিতেন। সংবাদ পত্রে তাঁহার শারীরিক অবস্থার সংবাদ প্রায় প্রত্যহই প্রকাশিত হইত। শ্রীযুক্ত বাল গঙ্গাধর তিলক মহোদয় এই দুঃসময়ে আনন্দী বাঈর চিকিৎসাদির জন্য স্বীয় শক্তির অধিক অর্থ সাহায্য করিয়াছিলেন।

 বহুদিন বিদেশে থাকায় স্বদেশীয় অন্নব্যঞ্জনাদির দর্শন-লাভ আনন্দী বাঈর পক্ষে দুর্ঘট হইয়াছিল। তিনি আমেরিকায় অবস্থান-কালেই তাঁহার দেশীয় অন্নব্যঞ্জন সেবনে প্রবল স্পৃহার বিষয় তাঁহার শাশুড়ীকে একখানি পত্রে লিখিয়া জানাইয়াছিলেন। অসুস্থ হইবার পর হইতে তাঁহার সে স্পৃহা অতীব বলবতী হইয়াছিল। স্বদেশে প্রত্যাগমনের পর ডাক্তারদিগের নিষেধ-বশে ও পথ্যানুরোধে আহারাদির বিষয়ে তিনি নিতান্ত সংযত ছিলেন। কিন্তু ক্রমশঃ তাঁহার সে সংযম বিলুপ্ত হইয়া আসিতেছিল। জীবনের আশা ক্রমশঃ ক্ষীণ হওয়ায় তাঁহার জননী কয়েক দিবস তাঁহাকে মনোনীত অন্ন-ব্যঞ্জনাদি সেবন করাইলেন। গোপাল রাও বলেন, ইহাতেই আনন্দী বাঈর ব্যাধি দুরারোগ্য হইয়া উঠিল। পরিশেষে একজন কবিরাজ তাঁহাকে যে ঔষধ সেবন করিতে দেয়, তাহার পথ্যস্বরূপ জলপান নিষিদ্ধ ছিল। ঐ ঔষধ সেবনকালে একদিন আনন্দী বাঈ তৃষ্ণায় অতিশয় কাতরা হইয়া ছট্‌ ফট্‌ করিতে লাগিলেন। কিন্তু বিপরীত ফললাভের ভয়ে কেহই তাঁহাকে জল দিতে সাহসী হইল না। তিনি চারি প্রহর কাল তৃষ্ণার যন্ত্রণায় ব্যাকুলা হইয়া নিতান্ত অস্থিরতা-প্রকাশ করিতে লাগিলেন। গোপাল রাও স্ত্রীর অবস্থা দেখিয়া ইতঃপূর্ব্বেই হতাশ হইয়াছিলেন। বাঁচিবেন বলিয়া আনন্দী বাঈ তাঁহাকে বারংবার আশ্বাস দান করিতেন। কিন্তু তাঁহার সে দিনকার অবস্থা দেখিয়া গোপাল রাওয়ের মনে হইল, বুঝি জলাভাবেই শেষে তাঁহার সহধর্ম্মিণীর প্রাণান্ত ঘটিবে। এই ভাবিয়া ও আনন্দী বাঈর যন্ত্রণায় উপেক্ষা প্রকাশ করিতে না পারিয়া তিনি তাঁহাকে কিঞ্চিৎ জলদান করিলেন। জল পান করিয়া রোগিণীর সুস্থতার লক্ষণ প্রকাশ পাইল। ক্রমশঃ সর্ব্বপ্রকার ব্যাকুলতার সহিত তাঁহার শরীরের উত্তাপও হ্রাস পাইতে লাগিল।

 পরদিন (১৮৮৭ সালের ২৬শে ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যা পর্য্যন্ত এইরূপ অবস্থায় কাটিয়া গেল। সন্ধ্যাকালে গোপাল রাও সহধর্ম্মিণীকে স্বহস্তে কিঞ্চিৎ দুগ্ধ পান করাইলেন। এতক্ষণ পর্য্যন্ত আনন্দী বাঈ বমি করিয়া সর্ব্বপ্রকার খাদ্যই উদ্‌গিরণ করিয়া ফেলিতেছিলেন। কিন্তু স্বামীর হস্তে দুগ্ধ পান করিয়া তিনি তাহা উদ্‌গিরণ করিলেন না। তাহার পর ঔষধ-সেবন করিয়া আনন্দী বাঈ অপেক্ষাকৃত সুস্থভাবে শয়ন করিলেন। গোপাল রাও তিন দিনের মধ্যে এক মুহূর্ত্তের জন্যও তাঁহার নিকট হইতে দূরে যান নাই, অথবা চক্ষু নিমীলিত করেন নাই। কিন্তু সে দিন সে সময়ে সহসা অজ্ঞাতসারে তাঁহার নিদ্রাকর্ষণ হইল। আনন্দী বাঈর জননী কন্যার পার্শ্বে বসিয়াছিলেন। রাত্রি দশ ঘটিকার সময় তাঁহারও নেত্রদ্বয় নিদ্রাভরে অলস হইয়া আসিল। এমন সময় সহসা আনন্দী বাঈ বমি করিয়া “মা গো” শব্দে চীৎকার করিলেন। তাঁহার জননী তৎক্ষণাৎ তাঁহার নিকটবর্ত্তী হইলেন। তখন—“আমার দ্বারা যতদূর হওয়া সম্ভব, তাই আমি করিলাম!”—এই কয়টি শব্দ তাঁহার কর্ণগোচর হইল। ইহাই আনন্দী বাঈর শেষ বাক্য। জননী দেখিলেন, তাঁহার কন্যার জীবন-প্রদীপ নির্ব্বাপিত হইয়া গিয়াছে। স্ত্রী-শিক্ষার যে বিজয়পতাকা এতদিন পাশ্চাত্য জন-সমাজকেও বিস্ময়ে স্তম্ভিত করিয়া রাখিয়াছিল, তাহা এইরূপে দুরন্ত কালের নিষ্ঠুরতায় অপহৃত হইল। ভারতবাসীর আশা-বৃক্ষ মুকুলিত হইয়া ফল-দানের পূর্ব্বেই অকস্মাৎ মৃত্যুর অশনি-সম্পাতে দগ্ধ হইয়া গেল! এই দুর্ঘটনা বিজ্ঞাপন করিয়া গোপাল রাও ২৮শে ফেব্রুয়ারি শ্রীমতী কার্পেণ্টারকে যে পত্র লিখিয়াছিলেন, তাহার কিয়দংশ উদ্ধৃত করিয়া এই শোককাহিনীর উপসংহার করিলাম।

 “মাসী মা! আজ আমি আপনাকে কি বলিয়া ডাকি বুঝিতে পারিতেছি না। আজ আমার মাথায় আকাশ ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে। সেই সৌন্দর্য্য, ধৈর্য্য, ক্ষমা ও শান্তির নিলয়-স্বরূপিণী ডাঃ জোশী আজ কোথায়? * * * মৃত্যুর দিবসটা তাহার বেশ সুখেই গিয়াছিল, বলিয়া বোধ হয়। * * * * সাধারণতঃ সামান্য শব্দেই আমার ঘুম ভাঙ্গে। কিন্তু সেদিন তাহার মৃত্যুকালে আমি এরূপ গাঢ় নিদ্রায় অভিভূত হইয়াছিলাম যে, আমার শ্বশ্রূ ও শ্যালক প্রভৃতি কয়েক জন পুনঃ পুনঃ চীৎকার করিয়াও সহজে আমার নিদ্রা ভঙ্গ করিতে পারেন নাই! * * * মরণের কয়েক সপ্তাহ পূর্ব্ব হইতে সে বড় কষ্ট ভোগ করিতেছিল; কিন্তু পাছে আমি হতাশ হই, এই ভয়ে একদিনের জন্যও সে স্বীয় যন্ত্রণার কথা ব্যক্ত করে নাই, বরং সর্ব্বদা প্রফুল্লভাব দেখাইবারই চেষ্টা করিত। এখানে আসিবার পর হইতে সে অতীব ধর্ম্মশীলা হইয়াছিল। ইতর জাতীয় বা খৃষ্টধর্ম্মাবলম্বী ব্যক্তিদিগকে সে আর পূর্ব্ববৎ স্পর্শ করিত না; কারণ হিন্দু সমাজে হিন্দুর ন্যায় আচরণ কর্ত্তব্য, তাহার এইরূপ মত ছিল। তাহার এইরূপ ব্যবহারের ফলে আমার পরিচিত ব্যক্তির মধ্যে কেহই আমাদিগের সহিত অনাত্মীয়ের ন্যায় ব্যবহার করে নাই। আমরা আমেরিকা হইতে ফিরিয়া আসিয়া প্রায়শ্চিত্ত করি নাই, তথাপি আমাদিগের সহিত সাক্ষাৎ ও আমাদিগকে সহায়তা করিতে আমাদের স্বজাতীয়দিগের মধ্যে কেহই সঙ্কোচ-প্রকাশ করেন নাই। অতি গোঁড়া হিন্দুরাও আমার স্ত্রীর সহিত সদ্ব্যবহার করিয়াছেন। খৃষ্টান, স্বধর্ম্মভ্রষ্ট বা জাতিচ্যুত ব্যক্তির সহিত সাধারণতঃ লোকে যেরূপ ব্যবহার করে, তাহার সহিত কেহই সেরূপ ব্যবহার করে নাই। তাহাকে সুখী ও সন্তুষ্ট করিবার জন্য সকল ব্রাহ্মণই তাহার অনুষ্ঠিত ব্রাহ্মণ-ভোজন-কার্য্যে উপস্থিত হইয়া নিঃসঙ্কোচে অন্নগ্রহণ করিতেন। তদ্দর্শনে এদেশের সংস্কারকদিগের বিস্ময়োদ্রেক হইত। তাহার মনস্তুষ্টির জন্য যাহা কিছু করা আবশ্যক, লোকে তাহা সমস্তই করিয়াছিল। সে কিছুদিন বাঁচিলে এ সকলের সার্থকতা হইত। * * * এদেশে বড় লোকেরও যদি কোনও জাতি-বিষয়ক গোলযোগ থাকে, তাহা হইলে তাহার শবদেহ তুলিবার জন্য সহজে লোক পাওয়া যায় না। কিন্তু আমরা মার্কিণ-ফেরৎ হইলেও তাহার শব-বাহনের জন্য প্রয়োজনের অপেক্ষা অধিক লোক স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া উপস্থিত হইয়াছিল। যথাশাস্ত্র অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া করিবার জন্য ব্রাহ্মণ পাওয়া যাইবে কি না, সে বিষয়েও আমার সন্দেহ ছিল। কিন্তু তাহাও নিরাকৃত হইল। যাহা যাহা আবশ্যক, সকলই নির্ব্বিঘ্নে সুসিদ্ধ হইল। সর্ব্বপ্রকার সম্ভাবিত বিঘ্নকে আমরা জয় করিলাম। কিন্তু মৃত্যুর আকস্মিক আক্রমণ ব্যর্থ করিতে পারিলাম না।”