কাবুল

 এই সেই কাবুল। অনেক ঐতিহাসিক তথ্য কাবুলের সংগে জড়িত আছে। অনেক দূরে দাঁড়িয়ে কাবুল সহরের দৃশ্য দেখলাম। পাহাড়ের উপর মস্ত বড় একটি দুর্গ কে তৈরী করেছিল জানিবার ইচ্ছা ছিল না। তবুও দুর্গটা দেখলাম ভাল করে। ভারতের যে কোন দুর্গ কাবুল দুৰ্গ হতে বড় এবং সংরক্ষিত; তবু আফগান জাতি একক ভারতের কতক অংশ বিজয় করে ভারত শাসন করেছিল। সতর জন পাঠান বঙ্গদেশ জয় করেছিল। এত সাহস, এত শক্তি তারা কোথা হতে পেয়েছিল? এই প্রশ্ন আপনা হতেই মনে আসে এবং এর সুমীমাংসা না হলে রহস্যে পরিণত হয়। রহস্যের ধার ধারতাম না। সেজন্য রহস্য বলে কিছু আমার কাছে ছিল না।

 অনেকক্ষন দাঁড়ালাম, তারপর আর ইচ্ছা হল না। সহরটার বাইরের দিকে চেয়ে থাকি। ইচ্ছা হল সহরটার ভেতর দিকটাই দেখি। সর্বপ্রথমই এলাম কাবুল হোটেলের কাছে। সাইকেলটা দাঁড় করিয়ে উপরে উঠলাম। আনন্দ করে এক কাপ ইংলিশ চা খেয়ে শরীরটার অবসাদ দূর করে বেড়িয়ে পড়লাম সহর দেখতে।

 সহর মামুলী ধরণের গড়া। যে কোন পাঞ্জাবী-সহর কাবুল সহর হতে বড়। ঘরগুলিও পাঞ্জাবী ধরণে তৈরী। বিশেষত্ব কিছুই অনুভব করলাম না-অন্তত বাড়ি ঘরের দিক থেকে। কোথাও নৃত্যগীতের অথবা সিনেমা হাউস ছিল না। নৃত্যগীত অথবা সিনেমা দেখা নাকি ধর্মবিরুদ্ধ কাজ। আমাদের দেশে যারা নৃত্যগীত অথবা সিনেমা দেখা পছন্দ করেন না তাদের পক্ষে কাবুল সহরে যেয়ে বসবাস করাই ভাল কিন্তু চায়ের দোকান সর্বত্র। চায়ের দোকানে আবার জাতিবিচার নেই। সবাই প্রবেশ করতে পারে এমন কি মেথর পর্যন্ত! সহরটাতে চক্কর লাগাতে দু ঘণ্টার বেশি লাগল না। বিদেশী রাষ্ট্রদূতদের। বাসস্থান থেকে আরম্ভ করে রাজবাড়ী দেখে ভাবলাম, এই ত কাবুল সহর। এখন বেড়িয়ে পড়লেই হয়, কিন্তু দেখা হয়েছে পাহাড় পর্বত, ইট-চুণের বাড়ি, যাদের প্রাণ নেই। এবার মানুষ দেখতে হবে। মানুষ দেখতে সময়ের দরকার। কোথাও না থেকে মানুষের সংগে মেলামেশা করা চলে না।

 অনেকক্ষণ ভ্রমণ করার পর হঠাৎ বুঝতে পারলাম সহরের বুক চিরে একটি নদী বয়ে যাচ্ছে। ইচ্ছা হল, জেনে নিই এই কল্পোলিনীই কি সেই নদী যার নাম কাবুল নদী? কিন্তু কাউকে সে কথা জিজ্ঞাসা না করে নদীতে নেমে হাত মুখ ভাল করে যখন মোজা পায়ে দিচ্ছিলাম তখন এক জন লোক জিজ্ঞাসা করল “তুমি কে?”

 আমি পথিক—যাকে তোমরা মুসাফির বল। আমি দুনিয়ার মুসাফির, এই হল আমার পরিচয়। জিজ্ঞাসু লোকটিকে প্রশ্ন করার সুযোগ পেলাম না; সে মুখ ফিরিয়ে চলে গেল। তার দিকে চেয়ে দেখলাম সে ধনী অথবা শিক্ষিত লোক নয়, গরীব লোক। গরীব লোক এই পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করতে পেরেছে তাই যথেষ্ট। আমাদের দেশের গরীব মুখ বুঝেই জীবনের শেষ করে, এখানের গরীব যে মুখ ফুটে প্রশ্ন করতে পারচ্ছে সে জন্য সে নিশ্চয়ই ধন্যবাদের পাত্র।

 কাবুলের কালী-মন্দিরেই প্রথমে যাব স্থির করেছিলাম। কালী-মন্দিরে যাবার একমাত্র কারণ হল, সেখানে নাকি একটা সরাই বা ধর্মশালা আছে। ভেবেছিলাম ধর্মশালাতেই গিয়ে দু এক দিন থাকিব, তারপর হোটেলে যেতে পারব। পথের লোককে জিজ্ঞাসা করে কালী-বাড়ীতে পৌঁছতে পারলাম এবং দরজার কড়া নাড়লাম। কয়েকবার কড়া নাড়তেই পুজারী দরজা খুলে দিলেন। লোকটিকে দেখে মনে হল তিনি মন্দিরে হয়তো কোন কারণে এসেছেন, পূজারী নন। লোকটির পোশাক মামুলী ধরনের পাঠানদের মত। তাঁকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম তিনিই পূজারী। তখন আমিও তাঁকে আমার পরিচয় দিলাম।

মুসাফিরখানার কথা জিজ্ঞাসা করে জানলাম, এখানে পৃথক কোন ধর্মশালা নাই। পূজারী মন্দির-সংলগ্ন একটা ঘর আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বললেন, অতিথি এলে ঐ ঘরটাতেই যায়গা করে দেওয়া হয়। সারাদিন সাইকেল চালিয়ে বড়ই দুর্বল হয়ে পড়েছিলাম, নতুন করে আস্তানা যোগাড় করার আর উৎসাহ মোটেই ছিল না। কাজেই পূজারীর প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলাম না।

 পূজারী আমাকে দাড় করিয়ে রেখেই ঘরে চলে গেলেন। আমি বারান্দায় দাড়িয়ে ঘরের গড়ন, মন্দিরের নির্মাণ-কৌশল এসব ভাল করে দেখতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর পূজারী ফিরে এসে আমাকে ঘরের ভেতরে নিয়ে গেলেন। ঘরের মধ্যে প্রজ্বলিত সন্দল ছিল, তারই পাশে বিশ্রাম করতে বসলাম। আমাকে ঘরের ভেতর বসিয়ে রেখে পূজারী আবার চলে গেলেন।

 মন্দিরে তিন খান মেটে ঘর। একটি উত্তরে, অপর দুটি পূর্ব এবং পশ্চিম দিকে অবস্থিত। প্রত্যেক ঘরের বারান্দার সংগেই পরস্পরের যোগাযোগ রয়েছে। শীতের দেশের ঘরগুলি এরূপ করেই তৈরী হয়ে থাকে। কালী-মন্দির উত্তরদিকে অবস্থিত। পূর্বদিকের ঘরে রান্না করা হয় এবং পশ্চিম দিকের ঘর অতিথির জন্য। ঠাকুর রান্নাঘরেই শোন বলে মনে হল। সন্দলের কাছে বেশীক্ষণ বসে থাকতে ভাল লাগল না, পাশেই একটা বড় বালিশ ছিল, তাতেই হেলান দিয়ে শুয়ে পড়লাম। কতক্ষণ শুয়েছিলাম জানি না, যখন ঘুম ভাঙল তখন দেখলাম পূজায়ী আমার ভোজনের বন্দোবস্ত করছেন। ভেবেছিলাম, তিনি হয়তো আমাকে বিছানার বাইরে বসে খেতে বলবেন, কিন্তু তা তিনি বলেন নি। বিছানার ওপরে বসেই খেয়ে নিলাম। আফগানিস্থানে এঁটোর বালাই নেই। যত এঁটোর বালাই শুধু ভারতেই। পৃথিবীর আর কোথাও এঁটো বলে কিছু নেই। আমাদের দেশের জ্ঞানীগণ বলেন, এঁটো মেনে চলা ভাল, তাতে নাকি খাস্থ্য ভাল থাকে। কিন্তু আমাদের দেশের লোকের অজ্ঞতা দারিদ্র এবং সর্বোপরি সরকারের ঔদাসীন্যের ফলে তারা নানা ভাবে স্বাস্থ্য হারাচ্ছে। তাদের মাঝে স্বাস্থ্যরক্ষার অজুহাতে এঁটোর গোঁড়ামিকে বজায় রাখার সার্থকতা কি তা বোঝা আমার পক্ষে শক্ত।

 আহারের পর একবার কালীমূর্তি দেখতে গিয়াছিলাম। কালীমূর্তির কাছে নারায়ণেরও একটি বিগ্রহও ছিল। বিগ্রহগুলিকে যখন মনোযোগ সহকারে পর্যবেক্ষণ করছিলাম তখন নিশ্চয়ই ঠাকুর ভাবছিলেন আমি একজন মহাভক্ত। কিন্তু তিনি জানতেন না, আমি ভক্তির প্রেরণায় মূর্তিগুলির দিকে তাকিয়ে থাকিনি—দেখছিলাম শুধু তার গঠনপ্রণালী।

 কয়েক সপ্তাহ ক্রমাগত চলার ফলে শরীরটা নেতিয়ে পড়েছিল। সেজন্য খাওয়ার পর বাইরে যেতে ইচ্ছা হচ্ছিল না। সন্দলের কাছেই বসে আফগানিস্থানের মানচিত্র দেখতেছিলাম।

 বেলা বোধ হয় তখন ছ-টা। এরই মাঝে পূজারী তাঁর সহকারীসহ বাহির হতে ফিরে এসে বললেন “রাত্রে মন্দিরে থাকতে দেওয়া হবে না।” আমি তাঁদের কথা শুনে আস্তে ধীরে বললাম “যে-পর্যন্ত আমার থাকার অন্য বন্দোবস্ত না হচ্ছে সে পর্যন্ত আমি এখান থেকে নড়ব না এবং আমার অন্যত্র থাকার বন্দোবস্ত তাদেরই করতে হবে।” আমার দৃঢ়তা দেখে পূজারী দুজন বাইরে চলে গেলেন। কতক্ষণ পর আবার যখন তাঁরা ফিরে এলেন তখন তাঁদের সংগে আরও একজন দীর্ঘকায় বৃদ্ধ লোক ছিলেন। বৃদ্ধ এসেই আমাকে নমস্কার করে বললেন তিনি বিষ্ণু মন্দিরের পূজারী এবং তার মন্দিরেই আমার রাত কাটাবার সুবন্দোবস্ত হয়েছে। আমি কোন কথা না বলে সাইকেলটা টেনে নিয়ে তার সঙ্গে চললাম।

 আমাদের পথের বাঁদিকে রুশিয়ার কনসালের বাড়ী। কনসালের বাড়ীর উপর মস্তবড় একখানা আধুনিক রুশিয়ার পতাকা পত পত করে উড়ছিল। তারপরই ডানদিকে পড়ল জাপানী কনসালের বাড়ী। ছোট একটা সূর্য-মার্কা পুরাতন ময়লা কাপড় ঘরের দরজার কাছে ঝুলছিল। তারপরই আরম্ভ হল উচুভূমি। দু’দিকে সারি সারি মেটে ঘরগুলি দাঁড়িয়ে ছিল। প্রত্যেকটি ঘরেরই দরজা বন্ধ। পথে লোকের চলাচল নাই বললেই চলে।

 মেটে ঘরের সারি দেখে কতকক্ষণ চলার পর বিষ্ণু মন্দিরের পূজারীর বাড়ীর সামনে এলাম। কড়া নাড়া মাত্র একটি যুবক দরজা খুলে দিল। যুবকটিকে দেখে বেশ সরল বলে মনে হল। পরে জানলাম এই যুবক পূজারীর ছোট ছেলে। ছেলেটির গালভরা হাসি দেখে আপনা হতেই তার সংগে কথা বলতে ইচ্ছা হল এবং তারই সংগে কথা বলে ঘরে প্রবেশ করলাম।

 বিষ্ণু মন্দিরের পূজারী শ্রেণীতে সাহা মানে বৈশ্য। এখানেও তিনখানা ঘর এবং সেই একই ধরনে তৈরী। বসবার ঘরে এসে দেখলাম। আমার অপেক্ষায় অনেকগুলি লোক বসে আছে। তারা প্রত্যেকেই আমার সংগে কথা বলবার জন্য আগ্রহান্বিত হয়েই বোধ হয় অপেক্ষা করছিল। একজন ব্রাহ্মণও সেখানে ছিলেন। তাঁর একটু বিশেষত্ব ছিল। তিনি তাঁর প্রতিটি বক্তব্য শেষ করে উপসংহারে বলতেন, যারা ধর্ম বজায় রেখে চলতে পারে না তাদের ধর্ম পরিত্যাগ করাই উচিত। যেন ধর্মটাই মানুষের প্রাণ।

 দিনের অবসান হয়ে রাত্রি এল। সকলেই চলে গেল, থাকলাম শুধু আমি এবং পূজারীর একটি ছেলে। পরদিন প্রভাতে চা-পানের পর লক্ষ্য করলাম। এখানকার পূজারীর মনও যেন আমার ওপর বিরূপ। তাঁর সে ভাব বুঝতে পেরে বললাম, ঠাকুর মশায়, এখান হতে আমাকে তাড়াতে পারবেন না, আমি এক মাস এখানে থাকব। খরচ যা লাগে তা দেব, কিন্তু এখান হতে চলে যাও, অথবা এখানে এক দিনের বেশি থাকবার নিয়ম নেই—এসব কথা বললেই, হয়তো আপনাকেই এখান থেকে তল্পীতল্পা গুটাতে হবে। এটা দেবমন্দির, সকল হিন্দুর অর্থসাহায্যে এটা তৈরী হয়েছে, আমারও এতে অধিকার আছে। জানেন তো, হিন্দুস্থানের অনেক হিন্দু-মন্দিরই সাৰ্বজনীন হয়ে গেছে। আফগানিস্থানেও যদি আমি সেরূপ কিছু করতে প্রয়াসী হই তবে দরিদ্র হিন্দুরা নিশ্চয়ই আমার সহায় হবে। এরূপ অবস্থায় ভেতরের কথাটা আমাকে খুলে বলাই আপনার পক্ষে ভাল হবে। আমার অনুমান হয় আপনারা সরকারী হাঙ্গামাকে এড়াবার জন্যই এরূপ করছেন। তাই যদি হয় আমি আপনাকে আশ্বাস দিয়ে বলছি, সরকারের তরফ থেকে আপনার উপর কোন বিপদই আসবে না।

 পূজারীর সংগে আর কথা হল না। ঘরে বসে থাকতেও আর ইচ্ছা হল না, শহর দেখতে বেরিয়ে পড়লাম। কাবুল শহরের বুকের উপর যে প্রসিদ্ধ রাজপথ আছে তার নাম আমি জানতাম না, এখনও জানি না। তবে পথের প্রসিদ্ধির কারণ আমাকে জানতে হয়েছিল। এই পথের ওপরই হোটেল কাবুল।

 মন্দির হতে বের হয়েই এক বৃদ্ধ পাঠানের দোকান থেকে এক প্যাকেট রাশিয়ান সিগারেট কিনিলাম। দোকানী আমার মুখের দিকে একটু তাকাল, তারপর সিগারেট দিয়ে বিদায় করল। আর একটু এগিয়ে গিয়ে একটি চা-এর দোকান দেখতে পেলাম। আমার অভ্যাসই হল চা-এর দোকানে যাওয়া এবং সেখানে বসে নানারূপ সংবাদ সংগ্রহ করা। এই দোকানটি উচ্চ শ্রেণীর ইউরোপীয় ধরনের। সুন্দর এক একটি গোল টেবিলের চারপাশে ভেলভেট মোড়া সোফা। টেবিলের ওপর ছাইদানী এবং দেশলাই ছাড়া আর কিছু ছিল না। ডিপ্লোমেটরা টেবিলের ওপর বাজে জিনিস কিছুই পছন্দ করেন না। সেজন্য মনে হচ্ছিল এটাও ডিপ্লোমেটদেরই একটা আড্ডা।

 আফগানিস্থানে দু রকমের চা-এর প্রচলন আছে, যথা—ইংলিশ চা এবং “চায়”। দার্জিলিং, সিংহল এবং আসাম হতে আফগানিস্থানে যে চা যায় তাকে ইংলিশ চা বলা হয়। ইংলিশ চা-তে দুধ এবং চিনির দরকার হয়। “চায়” আসে চীন দেশ থেকে। সেই পাতা গরম জলে ভিজিয়ে দিলেই ক্বাথ বের হয়। সেই ক্বাথকেই বলে “চায়”। এই দোকানে “চায়” এর প্রচলন ছিল না। আমি চা-এর আদেশ দিয়ে একটি সিগারেট নিয়ে ধরানোর সময় আমার গরিবানা পোশাক দেখে বয় বললে “হুজুর

এখানের চায়ের দাম খুব বেশি এবং এখানে “চায়” বিক্রি হয় না।” আমি বললাম “চা-এর যদি বেশি দাম হয় তবে কাফি নিয়ে এস। দু’কাবুলির বেশি বোধ হয় হবে না।” লোকটি বুঝল আমার কাছে টাকাপয়সা আছে। সে ফের বলল “চা আনব না। কাফি আনব হুজুর?” কাফিই নিয়ে এস—বলে পকেট হতে কতকগুলি কাগজ বের করে সে দিকে মন দিলাম। অনেক দিনের জমানো কথা ডায়েরিতে লিখতে পারি নি। এরূপ নিরিবিলি এবং এত আরামদায়ক স্থানে বসলেই লিখতে ইচ্ছা হয়। আফগানিস্থানে কাফি মোটেই ব্যবহার হয় না। তাই বয় চা আনতেই বাধ্য হল। সে চা নিয়ে এলে তার মুখের দিকে একটু ভাল করে তাকিয়ে বুঝলাম লোকটি পাঠান নয়—বিদেশী; ছদ্মবেশে এখানে আছে। পরে বুঝতে পেরেছিলাম। এই লোকটি সত্যসত্যই পাঠান নয়—সে একজন ভারতবাসী।

 এক কাপ চা খেয়ে চায়ের পিপাসা মিটাল না। ফের পুনরায় এক কাপ চা আনতে বলার পূর্বেই প্রথম কাপের দাম চুকিয়ে দিতে যাব এমন সময় বয় বলল, “এক সঙ্গে দিলেই হবে।” কথা কয়টি শুনে আশ্চর্য হলাম। একেবারে খাঁটি বাঙলা ভাষা। একজন বাঙালী এই সুদূর দেশে চায়ের দোকানে বয়ের কাজ করছে দেখে যদিও চমৎকৃত হলাম তথাপি মুখে কিছুই প্রকাশ করলাম না। বয় দ্বিতীয়বার চা নিয়ে এলে বললাম “এক প্যাকেট সিগারেট আনিয়ে দিতে পারেন?” লোকটি হঠাৎ যেন আকাশ হতে পড়ল, তারপর বলল—“আপনি কি বললেন?” আমি বললাম, “হাম বলা, ইদার মে সিগারেট মিলেগা?”

 —জরুর জনাব, পয়সা দিজিয়ে—বলেই লোকটি হাত পাতল। পাঁচটি কাবুলি মুদ্রা তার হাতে দিয়ে বললাম, এই নাও। লোকটি সিগারেট নিয়ে এল এবং বাকি পয়সা ফিরিয়ে দিল।  চায়ের দোকান হতে বেরিয়ে আসার পর শুনলাম দুজন লোক হো হো করে হাসছে। যাকগে, বিদ্রূপের হাসি হাসল তো বয়েই গেল। এখন একবার বৈদেশিক সচিবের সংগে সাক্ষাত হলে ভাল হয়, মনে করে তাঁরই বাড়ির দিকে অগ্রসর হলাম। অলিগিলি পথ ধরে চলে যখন বেশ ঠাণ্ডা অনুভব করছিলাম, তখন ভাবলাম এখন আর বৈদেশিক সচিবের বাড়িতে যাবার দরকার নেই। চায়ের দোকানে গিয়ে আর এক পেয়ালা চা খেয়ে পুরোহিত মশায়ের আশ্রয়ে গিয়ে বিশ্রাম করাই উচিৎ। এই ভেবে চায়ের দোকানের দিকে চললাম।

 কিন্তু চায়ের দোকানের পথটার কোন হদিসই পেলাম না। অবশেষে পথচারীদের জিজ্ঞাসা করে কাবুল হোটেলে এলাম। কাবুল হোটেল পূর্বোক্ত চায়ের দোকানের কাছেই। দ্বিতীয় বার আমাকে চায়ের দোকানে ফিরে আসতে দেখে ছদ্মবেশী বয় একটু থাতমত খেয়ে গেল। ইংলিশ ভাষাতে বললাম “চা খেতে আমার বড়ই ভাল লাগে। এখানে আপনারাই সব চেয়ে সেরা চা প্রস্তুত করেন। আমাকে এখানে বারবার আসতেই হবে। আর এক কাপ চা দিন দয়া করে।” বয় চা নিয়ে এল। চা পান করে মন্দিরে ফিরে এলাম। পথে বার বার শুধু মনে পড়তে লাগল সেই কথাটি— “এক সঙ্গে দিলেই হবে।”

 এখানে আমার পোশাক সম্বন্ধে কিছু বলা দরকার। তখনও শীত আরম্ভ হয় নি। হাপ পেণ্ট পরিত্যাগ করে ব্রীচেস পরতে আরম্ভ করেছিলাম। ব্রীচেসের নীচে ছিল একটা গরম পাজামা। এতে শীত নিবারণ হ’ত বেশ ভাল করেই। শরীরে ছিল একটা সার্ট। তার উপর দুটি গরম গেঞ্জী। তার উপর আর একটা সার্ট। যখন বাইরে যেতাম তখন এর উপরে থাকত একটা গরম কোট। মাখায় থাকত সোলার হেট। এতেই অনুভব হবে শীত থেকে রক্ষা পাবার জন্য কিরূপ ব্যগ্র ছিলাম।

 মন্দিরে ফিরে এসে দেখলাম পূজারী আমার জন্যও রান্না করেছেন। কিন্তু তাঁর মনে সন্দেহের ঝড় উঠছে। সেই ঝড় কোন্ দিকে বইবে তা তিনিই জানেন। যাহোক্, আমি হাত মুখ ধুয়ে খেতে বসলাম। রান্না হয়েছিল খিচুড়ি। খিচুড়িতে প্রচুর ঘি দেওয়া হয়েছিল। এদেশে ঘি, দরিদ্র লোকের ভাগ্যে জুটে না। ঘি খান ধনীর দল। বিষ্ণু মন্দিরের পূজারীও একজন ধনী লোক। তাঁর বাড়িতেও সবসময় বস্তা বস্তা চাউল, চিনি এবং টিন ভর্তি ঘি মজুত থাকে।

 পূজারী ঠাকুর ভোজনের পূর্বে মন্ত্র উচ্চারণ করলেন, তারপর ধীরে ধীরে আঙুলের সাহায্যে খেতে আরম্ভ করলেন। অন্যান্যেরাও সেরূপ ভাবে খেতে আরম্ভ করল। শুধু আমি চামচের সাহায্যে খাওয়া সুরু করলাম। খাওয়া শেষ হয়ে গেলে পূজারী প্রত্যেকের থালা পরীক্ষা করে দেখলেন, খাদ্যের এক কণাও কারো থালাতে লেগে আছে কি না? পরিদর্শন হয়ে গেলে তিনি ভৃত্যকে থালাগুলি নিয়ে যেতে বললেন। চা তৈরীই ছিল। ভাত খাওয়ার পর চা খাওয়া হল। আহারাদির পালা শেষ হলে নাক ডাকিয়ে সবাই ঘুমিয়ে পড়লাম।

 বিকাল বেলা স্থানীয় হিন্দু প্রতিনিধি বলে কথিত একজন প্রৌঢ় ব্যক্তি আমার সংগে দেখা করতে এলেন। মুখ দেখেই লোকটিকে খল প্রকৃতির মনে হল। কায়দামাফিক নমস্কারের আদান-প্রদান সারা হলে প্রৌঢ় বললেন “আপনি আমাদের সম্মানিত অতিথি, কিন্তু বড়ই দুঃখের সহিত একটি কথা বলতে হচ্ছে—আপনি কথাগুলি মন দিয়ে শুনুন। এখানকার নিয়মমতে, যে-কোন ভারতবাসী এদেশে আসুক, কাবুলে পৌঁছাবার পরই তাদের প্রত্যেকেরই আমার কাছে রিপোর্ট করতে হয়, আপনি তা করেন নি। আমার এখন কর্তব্য হল, আপনাকে পুলিশ অফিসারের কাছে হাজির করা। তাঁর আদেশ অনুসারে প্রত্যেক কুড়ি দিন অন্তর আপনাকে পুলিশ স্টেশনে গিয়ে অথবা আমার কাছে এসে আপনি কি ভাবে জীবন কাটাচ্ছেন তার রিপোর্ট দিতে হবে। এ কথাটা পুলিশ অফিসারের সামনেই আপনাকে বুঝিয়ে দেওয়া আমার কর্তব্য। আমি দোভাষীরও কাজ করি। আপনি কাবুলে আসার পর আমার কাছেও যান নি, কোন পুলিশ অফিসারের কাছেও যাননি; সেজন্য হয়তো আপনাকে কষ্ট পেতে হবে। উপয়ন্তু আপনি আফগানিস্থানে পৌঁছেই পল্টনি অফিসার, ছাত্র এবং জনসাধারণের সংগে অবাধে মেলামেশা করছেন। এসব আফগান সরকারের মনঃপূত হবে কিনা জানি না। যা হোক আপনাকে কাল আমার সংগে পুলিশ স্টেশনে যেতে হবে।”

 প্রৌঢ় যদিও আফগানিস্থানেরই বাসিন্দা এবং কোনও উপজাতিরই লোক নহেন, তবুও তাঁর কথায় গোলামী ভাবের বেশ একটা ছাপ ছিল। এত কষ্ট করে একটা স্বাধীন দেশে এসেছি, এখানেও দেখছি গোলামির প্রভাব। কিন্তু আমি পাঠান ছেলেদের সংগে থেকে মনের ভাব অনেকটা পরিবর্তন করেছিলাম। বললাম “মশাই, এসব আইন কানুনের ধার ধারি না, কাল সকালে যদি আমাকে পুলিশ স্টেশনে যেতে হয় তবে আপনি টমটম (এক-ঘোড়ার গাড়ি) নিয়ে আসবেন। নতুবা যাব না। আপনার শক্তি অনুযায়ী যা ইচ্ছা তা করতে পারেন।”

 প্রৌঢ় একটু কুপিত হয়ে বললেন “আপনার মত অনেক লোক দেখেছি সাহেব। এইতো তিন চার বৎসর পূর্বে পাঞ্জাব হতে কতকগুলি মুসলমান ছাত্র এসেছিলেন। তারা গোঁ ধরে বললেন, আমার সংগে সাক্ষাৎ করবেন না। মুসলমান অফিসার ছাড়া আর কারো সংগে কথা বলবেন না। কিন্তু তাঁরা জানতেন না এদেশে ধর্মের হিসাবে কর্মচারী নিয়োগ হয় না। রাষ্টগত ব্যাপারে সাম্প্রদায়িক কোন প্রশ্নই ওঠে না। আমি এখানে ভারতবর্ষের লোকজনের তদ‍্বির করি, সে যে-কোন ধর্মের লোকই হোক। কিন্তু তাঁরা তা চান নি। তাঁরা চেয়েছিলেন আমার স্থলে একজন মুসলমান নিযুক্ত হোক। আমি হলাম তিন যুগের ভুষণ্ডী কাক। আমান উল্লা, বাচ্চ-ই-সাক্কো, নাদির শা এই তিন জনকেই আমি দেখেছি। বর্তমান রাজা জাহির শা আমাকে নতুন নিয়োগপত্র দিয়েছেন। এর পূর্বেও আমি এ কাজই করতাম। আপনি বলছেন আমার কথা শুনবেন না, কালই দেখব আপনার কত শক্তি।”

 আমি বললাম “আমার প্রসংগ এখন বাদ দিয়ে বলুন তো ঐ পাঞ্জাবী মুসলমান যুবকদের কি হয়েছিল?”

 —তাঁদের হবে আর কি। এখানে হিন্দু-মুসলমান প্রশ্ন নাই, আমি আমার স্থানেই রয়ে গেলাম, তাঁদের তাড়িয়ে দেওয়া হল।

 আমি বললাম “আমাকেও না হয় তাড়িয়ে দেবেন, আর কি করতে পারেন। বলুন?”

 প্রৌঢ় হেসে বললেন, তবে এদেশে না এলেই পারতে।

 পরদিন ভোরবেলায় আবার তিনি এসে হাজির হলেন। আমি তখনও লেপের নিচেই ছিলাম। অনিচ্ছায় লেপ ছাড়তে হল। হাত ধুয়ে এক পেয়ালা চা খেয়ে বসলাম গিয়ে টমটমে। টমটম প্রবল বেগে পুলিশ স্টেশনের দিকে, চলল। সকাল বেলা যারা পথে বের হয়েছিল আমাকে ঐ প্রৌঢ় রাজকর্মচারীটির সংগে দেখে তারা অনেকেই মুখ ফিরিয়ে নিল। আমার মনে হল লোকটা নিশ্চয়ই অত্যন্ত নীচাশয়, নতুবা যে তাকে দেখছে সেই মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে কেন? আমি মনের ভাব গোপন না করে তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, “দেখছেন কি, যে আপনাকে দেখছে সে-ই ত মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে? আপনার প্রতি এ বিরাগের কারণ কি বলুন তো?”

 উত্তর হল, এসব কারণ এখন বলা হবে না, তোমাকে একবার পুলিশ স্টেশনে হাজির করি, তারপর অন্য সময় এসব কথা হবে।

 লক্ষ্য করলাম, লোকটির কথাবার্তায় ক্রমেই শিষ্টাচার লোপ পাচ্ছে।

 পুলিশ অফিসারের অফিস শহরের একটু বাইরে। বাড়িখানা একতাল মেটে ঘর। বর্তমান সভ্যতার ছাপ তাতে একটুও পড়েনি। বাড়ির বাইরে একটিও লোক ছিল না। এখানেও দরজায় গিয়ে কড়া নাড়তে হল। কড়া নাড়তেই একজন দরজা খুলে দিল, আমরা একটি ছোট রুমে বললাম। রুমটির সামনেই একটা লম্বা ঘর। সেই ঘরটার বিপরীত দিকেও আর একটা ঘর। সেই ঘরটাতে অফিসার বসে ছিলেন। কাবুল শহরের সবচেয়ে বড় অফিসারের বাসস্থান এবং তাঁর অফিসের সংগে আমাদের দেশের যে কোন থানার দারোগার অফিস এবং তাঁর থাকবার ঘরের তুলনা করতে পারা যায় না। কাবুলী দারোগার অফিস এবং থাকবার ঘর আমাদের দেশের থানা ও অফিসারের বাসগৃহের কাছে এত নিকৃষ্ট যে তুলনাই করা যায় না। কিন্তু কাবুলের পুলিশ আমাদের দেশের দারোগা মহাশয়দের মত উগ্রস্বভাব নন। তারা বেশ শান্ত এবং ভদ্র। তাঁরা ভাল করেই জানেন, রাজার রাজত্ব যে কোন সময় যেতে পারে, কিন্তু জনসাধারণ থাকবে। সর্বসাধারণের দেওয়া মাইনে আবার নতুন করে পেতে হলে সর্বসাধারণকে সন্তুষ্ট রাখা বিশেষ দরকার।

 পুলিশ অফিসার দু এক মিনিটের মধ্যে এসেই ফরাসী ভাষায় কথা বলতে বললেন। তিনি হয়তো ভেবেছিলেন আমি ফরাসী ভাষা জানি। আমি জানালাম, ফরাসী ভাষায় আমার বুৎপত্তি নেই, তবে হিন্দুস্থানী এবং ইংলিশ বলতে পারি। অফিসার ইংলিশ জানতেন। কিন্তু ইংলিশ বলতে তিনি মোটেই রাজী ছিলেন না। আমার কাছে কিন্তু ইংলিশ এবং ফ্রেঞ্চ উভয়ই বিদেশী। ফরাসী ভাষা আমার জানা না থাকায় এবং পুলিশ অফিসার ইংলিশ ভায়ায় কথা বলতে অনিচ্ছুক হওয়ায় আমরা হিন্দুস্থানী ভাষাকেই বাহন করে কথা বলতে আরম্ভ করলাম। প্রৌঢ় রাজকর্মচারী আমাদের কথাবার্তা শুনে অবাক হয়ে গেলেন। তিনি ভাবেন নি আফগানিস্থানের একজন উচ্চতম পদের পুলিশ অফিসার আমাকে এত সম্মান ও প্রীতি দেখাবেন। দুভাষী মহাশয় দাঁড়িয়েই ছিলেন। আমরা বসে কথা বলছিলাম এবং চা-ও খাচ্ছিলাম। কথা প্রসংগে পুলিশ অফিসার বললেন, আপনাকে প্রত্যেক কুড়িদিন অন্তর এখানে এসে অথবা নিকটস্থ পুলিশ স্টেশনে গিয়ে হাজিরা দিতে হবে।

 —আমাদের দেশে হাজার হাজার কাবুলি বসবাস করছে, তারা তো পুলিশ স্টেশনে কুড়িদিন অন্তর হাজিরা দেয় না?

 —সে সংবাদ আমরা রাখি। আমরাও চাই আপনারা আমাদের দেশে কুড়িদিন অন্তর পুলিশ স্টেশনে হাজিরা না দেন। লক্ষ্য করে দেখবেন যখনই আপনি কোন পুলিশ স্টেশনে হাজিরা পরওয়ানা নিয়ে হাজির হবেন, তখনই পুলিশ অফিসার আপনাকে সত্বর বিদায় দিতে পারলেই যেন রক্ষা পান এমনি ভাব দেখাবেন। আমরা এসৰ চাই না, তবে কিনা—

 —আর বলতে হবে না, আমরা মানুষ নই বলেই এই ব্যবস্থা।

 —আপনারা আমাদের মত হন এই আপনাদের কাছে প্রার্থনা। নিন, আর এক পেয়ালা চা খান।

 —আর চা খেয়ে লাভ নেই—এখন বিদায় হতে চাই, কিছুই ভাল লাগছে না।

 —আপনার ইচ্ছা। এখানে আটকে রাখার জন্য আপনাকে আনা হয় নি। যখনই দরকার হবে তখনই উর্দু ভাষাভাষীদের তত্বাবধায়ককে বলবেন, তাঁর সাধ্যায়ত্ত হলে তিনি সাহায্য করবেন, নতুবা আমার কাছে চলে আসবেন।

 —এই ভদ্রলোক কি হিন্দু-তত্ত্বাবধায়ক নন?

 —না, ইনি তত হিন্দু নন, দুভাষী।

 —তবে তিনি হিন্দু-প্রতিনিধি বলে পরিচয় দেন কেন?

 —প্রকৃতপক্ষে হিন্দুস্থানের যত লোক এখানে বসবাস করে তাদের ভালমন্দ তিনি দেখতে থাকেন। হিন্দুস্থানের বাসিন্দাকে বৃটিশরা বলে ইণ্ডিয়ান, ফরাসীরা বলে হিদুঁ। আমরা এখানে বৈদেশিক ভাষা ফ্রেঞ্চ ব্যবহার করি, সেজন্যই এঁকে হিন্দু-প্রতিনিধি বলা অসংগত হয়নি।

 —আপনি বললেন হিন্দুস্থানের বাসিন্দা উর্দুতে কথা বলে; আমরা কিন্তু উর্দু বলতে অন্য আর একটা ভাষা বুঝি। —আপনারা যাই বুঝুন, আমরা বুঝি ভারতের সর্বসাধারণ যে মিশ্রভাষা বলে তারই নাম উর্দু-মানে হল মিশ্রভাষা।

 পুলিস অফিসারে সদ্ব্যবহার দেখে হিন্দু তত্ত্ববধায়কের মনের পরিবর্তন হল। পথে এসে তিনি আমার সংগে মধুর বচনে আলাপ করলেন এবং বললেন যে পূজাৱীকে বলে কয়ে তিনি আমার আরও ভালভাবে থাকবার বন্দোবস্ত করে দেবেন। বিষ্ণু মন্দিরে এসে তিনি আমার সামনেই পোন্ত ভাষায় পূজারী ঠাকুরকে কি বললেন। দেখতে দেখতে পূজাৱী ঠাকুরেরও মনোভাবের আশ্চর্য পরিবর্তন হয়ে গেল। আমি কতকটা নিশ্চিন্ত হলাম।

 কয়েকদিন থেকে আমার স্নান হয়নি। কাবুলে আসার পর স্নানগারের সন্ধানও কারো কাছে জিজ্ঞাসা করিনি। পূজারীকে স্নানাগারের কথা জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন “মন্দিরে স্নানাগার নাই, সরকারী স্নানাগারে গেলেই সুবিধা হবে। তারপরেই বললেন, হিন্দুরা সাধারণত রাত্রিবেলাই স্নানাগারে স্নান করতে যায়, আমিও যেন তাই করি।” জিজ্ঞাসা করলাম “দিনে হিন্দুৱা স্নানাগারে যায় না কেন?” পূজারী বললেন “যায় না কেন, তা হিন্দুপ্রতিনিধিকে জিজ্ঞাসা করুন।” হিন্দুপ্রতিনিধিকে জিজ্ঞাসা করার পূর্বেই তিনি বললেন “মুসলমানের দিনে স্নান করতে যায়, আমরা যাই রাত্রে।” আমি বললাম “এই জটিল সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামাবার ফুরসৎ আমার নেই। ইচ্ছা করলে দিনের বেলাতেও স্নান করা যায়, এইটেই হচ্ছে আপনার কথার সারমর্ম নয় কি?” হিন্দুপ্রতিনিধি আমতা আমতা করতে লাগলেন দেখে চটে গেলাম। বললাম “স্নানাগারটি কোথায় দেখিয়ে দেবার জন্য একজন লোক দিলেই হবে, এখনই আমি স্নান করতে যাব।”

 পূজারীর বড় ছেলে কাছেই বসে ছিল, সে আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতে রাজি হল। আমরা উভয়ে ঘর হতে বেরিয়ে স্নানাগারের দিকে রওনা হলাম।  পথে মাংসের, মাছের এবং সব্জির বাজার দেখে গেলাম। ইচ্ছা, পরে এসে কিছু সব্জি কিনে নিয়ে যাব। কতকগুলি মাংসের দোকানে দেখলাম ইহুদিরাই শুধু মাংস কিনছে, হিন্দু অথবা মুসলমান সেখানে যাচ্ছে না। পূজারীর ছেলে বলল, “এখানে ইহুদিদের জন্য পৃথক কসাইখানা আছে। ইহুদিরা মুসলমানদের জবাই করা জীবের মাংস খায় না। ইহুদিদের জীবহত্যার পদ্ধতি মুসলমানদের মত নয়, তার শুধু কণ্ঠনালিটাই কাটে, মুসলমানরা তা না করে গলার দুদিকের দুটা রগ পর্যন্ত কেটে দেয়।” দু’রকমের কশাইখানা দেখে মনে হল ইচ্ছা করলেই এখানে আচার ব্যবহারের পার্থক্য বজায় রাখতে পারা যায়। উভয়ে স্নানাগারের কাছে এলাম। পূজারীর বড় ছেলে আমাকে স্নানাগারের দরজার কাছে রেখেই নিকটস্থ একটি হিন্দু দোকানে গা-ঢাকা দিয়ে বসে রইল।

 স্নানাগারে প্রবেশ করেই স্নানাগার-রক্ষককে ডেকে জিজ্ঞাসা করলাম “মাথার টুপিটা কোথায় রাখা যায়?” সে কাছেই একটা খুঁটি দেখিয়ে দিল। সেখানে কোট, টুপি, মাফলার ইত্যাদি রেখে স্নানাগারের দিকে যাচ্ছি এমন সময় দারোয়ান বললে “আপ মুসলমান হায়?”

 আমি বললাম “নেহি। সাবুন কিদার হায়, টাওয়েল কিদার হায়? তুম্ বহুত বুদ্ধ‌ু আদমি হ্যায়, মুসলমানিসে তোমরা কিয়া জরুরত?”

 —হুজুর কুছ নেই, আবি সব চিজ্, লে আতাহে।

 —জলদি লে আও।

 সাবান এবং টাওয়েল বাথরুমে রেখে দিয়ে বয় সেলাম ঠুকে বললে “সব ঠিক হ্যায়।”

 স্নানাগারে প্রায় ঘণ্টা খানেক ছিলাম। স্নান করে যখন স্নানাগার হতে বের হলাম তখন আমি নতুন মানুষ। কাপড়-পরে স্নানাগারের ফি এক কাবুলি দারোয়ানের হাতে দিয়ে আর এক কাবুলি তাকে বকশিস দিলাম এবং বললাম “ফের তিন রোজ বাদ আসব। হাম মুসলমান নেই, হিন্দুস্থানকা বাঙালী হিন্দু।” দারোয়ান আমার মুখের দিকে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল।

 যতদিন কাবুলে ছিলাম, প্রত্যেক তিন দিন অন্তর স্নান করতে যেতাম। দারোয়ান আমার ধর্ম সম্বন্ধে আর কখনও প্রশ্ন করেনি। তাকে আর বকশিসও দেই নি। একদিন একজন উচ্চশ্রেণীর অফিসারকে জিজ্ঞাসা করলাম “হিন্দুদের দিনে স্নান করতে দেওয়া হয় না কেন?”

 তিনি বললেন, আপনাকে কি দিনে স্নান করতে দেয় নি?

 —আমাকে দেবে না কেন, স্থানীয় হিন্দুদের কথা বলছি।

 —ওদের কথা বলবেন না, ওরা নিজেরাই এজন্য দায়ী। গেলেই হয়, কেউ বাধা দেয় না। কিন্তু এরা এত ভীরু এবং কাপুরুষ যে কিছু বলবার পূর্বেই সরে পড়ে। এজন্যই এদের এই দুর্দশা।

 স্নান করে বাইরে এসে নিকটস্থ একটি চায়ের দোকানে প্রবেশ করলাম। এই দোকানে “সবজ্ চা” বিক্রি হয়। চায়ের এতই পিপাসা হয়েছিল যে চার পেয়ালা চা খাবার পর চায়ের পিপাসা মিটেছিল। দোকানি এবং অন্যান্য লোক আমার দেশ কোথায় জিজ্ঞাসা করল। যখন শুনল আমি কলকাতা হতে কাবুলে সাইকেলে করে এসেছি, তখন তারা প্রত্যেকেই আমার করমর্দন করল। এদের কথা শুনে মনে হল, বাংলা দেশে কোন ধর্মে প্রভাব নেই, আছে শুধু তুকতাক, মন্ত্রতন্ত্রের প্রভাব। একজন বললে “বাঙালীরা যাদুশক্তির প্রভাবে বাঘকে কুকুর বানিয়ে রাখে।” এদের এই রকমের আজগুবি কথার প্রতিবাদ করে লাভ হবে না জানতাম—সেজন্য কিছুই বলিনি।

 মন্দিরে ফিরে না এসে ফের সেই বড় চায়ের দোকানে গেলাম। বয় ছিল না —একজন শিখ তখন বয়ের কাজ করছিলেন। তিনি খোলাখুলিভাবেই আমাকে জানালেন, যদিও তিনি ভারতবাসী, তবু বৃটিশের প্রজা নন, তিনি সোভিয়েটের সভ্য। এখানেই থাকেন, তবে স্বেচ্ছায়ই তিনি এ দোকানে এসে কাজ করেন।

সোভিয়েট রাষ্ট্র সম্বন্ধে আপাততঃ কিছুই বললেন না, ভবিষ্যতে জানাবেন আশ্বাস দিলেন। আমি চা খেয়ে বৈদেশিক সচিবের বাড়ির দিকে রওনা হলাম। ইচ্ছা, আফগানিস্থানের বৈদেশিক সচিবের সংগে সাক্ষাৎ করা; চায়ের দোকান হতে বৈদেশিক সচিবের বাড়ি বেশিদূরে ছিল না। কাবুল হোটেলের পাশেই তাঁর আফিস।

 বৈদেশিক সচিবের বাড়ির সামনে কোন পুলিশ তো ছিলই না, একটি দারোয়ানকেও দেখতে না পেয়ে সন্দেহ হয়, তবে কি এটা বৈদেশিক সচিবের বাসভবন নয়। হয়তো আমি ভুল করেছি। কিন্তু ভুল করি নি ঠিক স্থানেই এসেছিলাম। বারান্দা পার হয়ে একটা দরজায় ধাক্কা দিতেই এক ভদ্রলোক ফরাসি ভাষায় জিজ্ঞাসা করলেন, কি চাই। আমি হিন্দুস্থানিতে বললাম, বৈদেশিক সচিবের সংগে সাক্ষাৎ করতে এসেছি। একথা শুনেই তিনি আমাকে বসতে দিয়ে বৈদেশিক সচিবকে খবর দিতে গেলেন। বসে বসে ভাবছিলাম, স্বাধীন দেশের ধরণেই আলাদা। এত বড় একজন অফিসার অথচ তাঁর অফিস, তাঁর বাড়ি-ঘর দেখলে মনে হয় যেন একজন অতি সাধারণ লোক এখানে বাস করেন। যারা গৌরী সেনের টাকায় কাজ চালায় তারাই নবাবী চালে চলে।

 বৈদেশিক সচিব তখনই নিজে বাইরে এসে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন “কি চাই?”

 —আপনার অটোগ্রাফ।

 —আপনি কে?

 —আমি একজন ভূ-পর্যটক।

 —আমি ভূ-পর্যটকদের অটোগ্রাফ দিই না।

 —আপনাকে ধন্যবাদ। বলতে পারেন এখানকার প্রধান মন্ত্রী থাকেন কোথায়?

 —বহু দূরে।

 —তবুও কত দূর?

 —আমি জানি না।

 এই বলেই তিনি বিদায় নিলেন। বৈদেশিক সচিবের উক্তিতে একটুও দুঃখ হই নি, জানতাম এখানকার বৈদেশিক সচিব প্রধান মন্ত্রীর আজ্ঞাবাহী ভৃত্য মাত্র। তবুও অবনত মস্তকে যখন মন্দিরে ফিরে যাচ্ছিলাম তখন কাবুল হোটেলের বয় ডেকে বললে, ওপরে এজন হিন্দু আমাকে ডাকছেন। হোটেলের ওপর উঠবার সময় হোটেলের জাঁকজমক লক্ষ্য করলাম। দারোয়ানকে কোন মতেই বুঝতে দিই নি আমি এসব লক্ষ্য করছি।

 দুদিকে সারি দিয়ে বড় বড় রুম। ঠিক মধ্যস্থল দিয়ে পথ। ঘরের দোতলায় কাঠের মেঝে কিন্তু বেশ পরিষ্কার, তারই ওপর দামী কারপেট বিছানো। কারপেটে নানারূপ ফুল আঁকা। এই বিচিত্র কারুকার্যমণ্ডিত কার্পেটের সৌন্দর্য অবলোকন করে এই কথাটাই আমার মনে জাগল যে দরিদ্র শিল্পীর অক্লান্ত পরিশ্রমে এটি নির্মিত হয়েছে সে তার মজুরি ঠিকমত পায়নি। ফুলদানিটিও বেশ পরিপাটি করে সাজানো। বেশি আর লক্ষ্য করতে পারলাম না, একজন পাঞ্জাবী ভদ্রলোক বাইরে এসে আমার করমর্দন করে তাদের রুমের ভেতর নিয়ে চললেন।

 “আপনি নিশ্চয়ই ভারতবাসী। মাথায় আপনার শোলার হ্যাট, পরনে ইউরোপীয় পোশাক, আপনি বেপরোয়া হয়ে পথ চলছেন। পাঠানরা আপনাকে কিছুই বলছে না কিন্তু আমরা তা পারি না। মোটরে আসতেই আমাদের বিপদ হয়েছিল।” জিজ্ঞাসা করে জানলাম তাঁদের বিপদটা আর কিছুই নয়, মোটর ড্রাইভার একবার মোটর থামিয়ে জংগলে গিয়েছিল, ইত্যবসরে এক বন্দুকধারী পাঠান তার বন্দুক তাঁদের কাছে বিক্রি করতে চাইছিল। বন্দুক তাঁরা কিনেন নি, উপরক্ত বন্দুকবিক্রেতাকে ডাকাত, আফ্রিদী, গলাকাটা এসব মারাত্মক বিশেষণে ভূষিত করে বিদায় করে দিয়ে কোনো মতে পৈতৃক প্রাণ নিয়ে কাবুলে এসেছেন। তাদের বিপদের কথা শুনে বৈদেশিক সচিবের নিকট অপমানের গ্লানিটা অনেক কমে গিয়েছিল। তাঁরা বলছিলেন জাপানী টিপ্ বাতি বিক্রয় করার জন্য এখানে এসে তাঁরা ফ্যাসাদে পড়েছেন। বৈষ্ণবধর্মের অনুশাসন অনুসারে শব্জী-ভোজীদের বন্দুক দেখাই অন্যায়, সুতরাং বন্দুক ক্রয়বিক্রয়ের কথা উচ্চারণ করলে বোধ হয় তাঁদের বৈষ্ণবী আর্ম-এক্টে পড়ে অনন্ত কালের জন্য নরকগামী হতে হবে। এসব বিপদে ফের পা দিতে তাঁরা নারাজ। সেজন্য প্রস্তাব করলেন, যদি আমার সুযোগ এবং সুবিধা হয় তবে আমায় দ্বারাই টিপ্ বাতির কারবারটি এ যাত্রার মত সেরে নিয়ে চিরতরে তাঁরা কাবুল শহরকে নমস্কার জানিয়ে বিদায় নেবেন। তাঁদের ক্লীবসুলভ দীন ভাব দেখে আমার দয়া হল। বললাম কাল সকালে এসেই তাঁদের কাজ যাতে কালই শেষ হয় তার বন্দোবস্ত করব। পর দিন তাঁদের কাজ করে দিয়েছিলাম এবং সেই কাজের মজুরী স্বরূপ তারা আমাকে কাবুল হোটেলেই মুরগীর মাংস এবং পোলাও খাইয়ে দিয়েছিলেন। তাঁরা কোনরূপে মাংস দিয়ে আমাকে ভোজন করাতে রাজি ছিলেন না। আমিও শাকসব্জী দিয়ে উদর পূর্তি করতে নারাজ ছিলাম। দায়ে পড়লে অনেকেই ইচ্ছার বিরুদ্ধে অনেক কাজ করতে বাধ্য হয়। শাক-ভোজী মহাশয়দের কন্যাদায় ছিল না, ছিল ব্যাবসাদায়। তা হতে এ যাত্রার মত আমার সাহায্যে রক্ষা পাওয়ায় মাংস দিয়ে ভোজন করাতে বাধ্য হয়েছিলেন।

 এদের কাজকর্ম সম্পন্ন করে দিয়ে পরের দিন বেলা তিনটার সময় প্রধান মন্ত্রীর বাড়ির দিকে রওনা হলাম। অবশ্য এর পূর্বে চায়ের দোকানে পূর্বপরিচিত বয়ের কাছ হতে প্রধান মন্ত্রীর বাড়ির অনেক কথাই জেনে নিয়েছিলাম।

 পথের উপর বরফ জমে পাথর হয়ে রয়েছিল। ঠাণ্ডা বাতাস প্রবল বেগে বইছিল। পথে গরিব লোক ছাড়া আর কেউ চলছিল না। দু’পাশের বাড়ির দরজাগুলি বন্ধ ছিল। নীরবে পথ চলছিলাম। প্রধান মন্ত্রী আমার সংগে কথা বলবেন কি না, সে কথা ভাবছিলাম না। অনেক বড় লোকই সময়ের অভাবে কথা বলেন নি, এখনও অনেকে দেখা করতে গেলে প্রথমেই ভাবেন হয়তো ভিক্ষা চাইতে গিয়েছি। পর্যটকের উপযুক্ত মর্যাদা দিতে দুনিয়ায় মানুষ আজও হয়ত কুষ্ঠিত কিন্তু এমন দিন নিশ্চয়ই আসবে যখন পৃথিবীর সংস্কৃতির ভাণ্ডারে তাদের অবদান যোগ্য-সমাদর লাভ করবে।

 পথ চলায় সময় হঠাৎ চোখের জ্যোতি কমে আসছিল। অন্ধ হয়ে যাচ্ছি বলে মনে হছিল। ভ্রমণ বোধ হয় এখানেই শেষ হতে চলল। মহা বিপদ। যারা ঈশ্বর আছে বলে কিছু বিশ্বাস করে তারা বেশ সুখী বলেই তখন মনে হল। তারা হয়তো এ অবস্থায় পড়ে ঈশ্বরের নাম নিয়ে কান্না জুড়ে দিত। কিন্তু আমার সে পথও বন্ধ। মাথার মাঝে চিন্তা-স্রোত বইছিল। সেই চিন্তাধারার গতি যে কত দ্রুত তা আমি বুঝিয়ে বলতে পারব না। ভাবছিলাম কি করে শরীরটাকে ধ্বংস করে এই দুঃসহ যন্ত্রণার হাত থেকে রেহাই পাওয়া যায়। হঠাৎ মনে হল সংগে কিছু বিষাক্ত দ্রব্য বা প্রাণঘাতী অস্ত্র থাকলে হয়তো বা তখনকার মনের অবস্থায় ভবলীলা সাংগ হতে দেরী হত না। কিন্তু হঠাৎ অন্ধ হয়ে যাবার কারণ কি? কেন চোখে দেখতে পাচ্ছি না? শীতের জন্য নয়তো? সেদিন তাপমান যন্ত্রে উত্তাপ-শূন্য ডিগ্রী হতে সতেরো ডিগ্রী নীচে নেমে গিয়েছিল। মনে হল প্রবল ঠাণ্ডাই চোখের জ্যোতি লোপ হবার একমাত্র কারণ। চোখ দুটাকে গরম করার জন্য দু'হাতে রাগড়িয়ে দিলাম। তারপর হাতের তেলা দুটোকে ঘসে গরম করে চোখে বার-বার লাগালাম। একটু একটু করে যদিও দৃষ্টি ফিরে আসছিল। কিন্তু এদিকে পা দুখানা অবশ হয়ে যাচ্ছিল। এরূপভাবে পা ঠাণ্ডা হয়ে অবশ হতে শুরু হলেই মনে করতে হবে মৃত্যু আসন্ন। ক্ষীণপ্রভ চক্ষুদুটি মেলে তাকালাম। সব কিছুই ঝাপসা দেখাচ্ছিল, মনে হল প্রায় কুড়ি হাত দূরে একটি চায়ের দোকান রয়েছে। এই দোকানে যেতে পারলেই আমার প্রাণ বাঁচবে। পা কিন্তু নাড়ছিল না। তখন চিৎকার করা ছাড়া আর উপায় ছিল না। চিৎকাৱ ক’রে লোক ডাকছিলাম। চিৎকার শুনে চায়ের দোকান হতে কয়েকজন পাঠান বেরিয়ে এসে আমাকে চায়ের দোকানে নিয়ে গিয়ে পায়ের জুতা খুলে ফেলে বরফ দিয়ে পা ঘসে দিল। কিছুক্ষণ ধলাই-মলাই করার পর পা দুটাতে শক্তি ফিরে এল। তারপর তারা উপর্যুপরি কয়েক পেয়াল চা খাওয়ালে। চা খেয়ে শরীরে শক্তি এল, চোখের দৃষ্টি ভাল করেই ফিরে পেলাম। অবশেষে পা দুটোকে আগুনের কাছে রেখে চুপ করে বসে রইলাম এবং প্রায় এক ঘণ্টা পর সম্পূর্ণ সুস্থ বোধ করলাম। তখন আমার মনে যে কি আনন্দ! যে সকল পাঠান আমাকে সাহায্য করেছিল এবং যতগুলি পাঠান ঘরে বসে ছিল, তাদের প্রত্যেককে চা-এর নিমন্ত্রণ করলাম। দোকানী প্রত্যেককে চা দিল। প্রত্যেক পাঠান আমার ব্যবহারে খুশী হল। একজন বলল “আপনাকে আমরা সাহায্য করেছি, কর্তব্যের খাতিরে। আমরা সবাই খোদার বান্দা, খোদারই অনুগ্রহে আজ আপনি বেঁচে গেছেন। খোদার দয়ায় আমরা এখানে না থাকলে আপনার মৃত্যু অনিবার্য ছিল।

 আমি লোকটির কথার জবাবে শুধু বললাম, আপনাদেরই অনুগ্রহ।

 প্রচুর পরিমাণে চা খেয়ে পাঠানদের শরীর বেশ গরম হয়েছিল, সেজন্যই বোধহয় গল্পও জমে উঠেছিল বেশ। গল্প নানা রকমের। রাজা, প্রজা, ধনী, দরিদ্র সবাই এই গল্পস্রোতে ভেসে যাচ্ছিলেন। আমিও বাচ্চা-ই-সাক্কোকে সেই গল্পস্রোতে ভাসাতে চেষ্টা করলাম। আমার চেষ্টা সফল হল, তার একটি কারণ ছিল। এই পাঠানগুলি আমাকে প্রাণে বাঁচিয়েছিল। পাঠানরা সকল সময়ই কতকগুলি নিজস্ব নিয়ম মেনে চলে। নানা পরিবর্তনের মাঝেও তারা ঐ নিয়মগুলি পালন করে আসছে। যার প্রাণরক্ষা করা হয় তার সামনে কোনও গোপনীয় কথা প্রকাশ করলেও উভয় পক্ষেরই কোন ক্ষতির সম্ভাবনা থাকে না। প্রাণরক্ষকের বিরুদ্ধে আজ পর্যন্ত কেউ দাঁড়ায় নি। ইহাই আফগান হিন্দু এবং সুন্নিদের একটা মস্ত জাতীয় বৈশিষ্ট্য। বাচ্চা-ই-সাক্কোর সম্বন্ধে এদের কাছ হতে যা শুনেছিলাম তা কখনও আফগানিস্থানে থাকার সময় কারো কাছে বলিনি। আজও আমার ভ্রমণ-কাহিনীতে এই ঘটনাটি স্থান পেত না, কিন্তু আফগানিস্থান এমনই এক স্তরে আজ পৌঁছেছে যদি আমি যা শুনেছিলাম এখন তা’ প্রকাশ করি তবে আমার প্রাণরক্ষকদের কোন ক্ষতি হবে না। তারপর এটাও মনে রাখতে হবে, যা’ বলতে যাচ্ছি তা চায়ের দোকানের গল্প।

 মানুষ মানুষে ভেদ ঘুচিয়ে দেবার জন্য যিশু ক্র‌ুশবিদ্ধ হলেন, বুদ্ধ এত ত্যাগ স্বীকার করলেন, নানক সকল ধর্ম মিলিয়ে নতুন ধর্ম তৈরী করলেন, কিন্তু মানুষ সমান স্তরে এল না। মানুষের মধ্যে ছোটজাত বড়জাত রয়ে গেল, ছোটলোক বড়লোকের তারতম্য রয়ে গেল। বাচ্চা-ই-সাক্কো ছোট জাত। তঁর অভু্যদয়ের দরকার ছিল। যখন দেখা গেল বাচ্চা-ই-সাক্কো হবিব উল্লা হয়ে আর্থিক জগতে পুজিবাদী এবং উঁচুজাতের উপর টেক্কা দিয়েছে তখনই আবার উঁচুজাতের মাথা ঘুলিয়ে গেল, নাদির সাহের দরকার হল।

 বাচ্চা-ই-সাক্কো মাত্র আট মাস রাজত্ব করেছিলেন। তাঁর রাজত্ব-সময়ে আফগানিস্থানের কি অবস্থা ছিল সেই সম্বন্ধে কেউ কিছু বলেন নি। আমি পর্যটক মাত্র। ঐতিহাসিক জ্ঞান অর্জন করবার জন্য সে দেশে যাই নি। সে দেশের লোকও বাচ্চা-ই-সাক্কোর সম্বন্ধে তখন অনেকটা নীরব হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু গোপনে যারা বাচ্চা-ই-সাক্কোর সম্বন্ধে কথা বলত তাদের কথা শুনতে আমার বেশ ভাল লাগত। যারা আমার প্রাণ বঁচিয়েছিল, বাচ্চা-ই-সাক্কো এদেরই সমশ্রেণীর লোক। কুহীস্থান নামক যায়গা হতে এরা কাবুলে এসে বসবাস করছে। কুহীস্থানই বাচ্চা-ই-সাক্কোর জন্মস্থান। বাচ্চা-ই-সাক্কো হিলজাই সম্প্রদায়ের লোক।

 কাংড়া জেলা নিবাসী চেলারাম গত মহাযুদ্ধের চাকুরি শেষ করে, তৃতীয় আফগান যুদ্ধে যোগদান করেছিলেন। আফগান যুদ্ধ শেষ হলে তাঁকে চাকরি ছাড়িয়ে দেওয়া হয়। তিনি বাড়িতে ফিরে আসেন। বাড়িতে এসে বেশি দিন নিশ্চিন্ত মনে থাকতে পারেন নি। আফগানিস্থানে চাকরির অন্বেষণে যান। আফগানিস্থানে যাবার পর তাঁর মতিগতি ভাল ছিল না। কোনও কারণবশত তাঁকে জেলে যেতে হয়। তখন আমান উল্লার রাজত্ব কাল বলেই চেলারাম, বিকালাঙ্গ না হয়েই জেলে গিয়েছিলেন। আজও আফগানিস্থানে চোরের হাত কেটে ফেলা হয়।

 আমান উল্লা সমাজ-সংস্কারে মন দিয়েছিলেন। জেল-সংস্কার করবার তাঁর ফুরসত হয় নি। তখন জেলে গেলে কয়েদীদের বাইরে থেকে খাদ্য সংগ্রহ করে আনতে হত। এখনও বোধ হয় সেই নিয়মই আছে তবে গত কয়েক বৎসরের সংবাদ আমি সঠিক জানি না। চেলারামও বাইরে থেকেই খাবার সংগ্রহ করতেন। একদিকে জেলের খাটুনি তারপর খাদ্য সংগ্রহ করে আনা ভয়ানক পরিশ্রমের কাজ। বেশি পরিশ্রম করলে সুনিদ্রা হয়। একদিন সকালবেলা চেলারাম যখন নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছিলেন, তখন তাঁর মাথার টিকি দেখে, তিনি যে হিন্দু সকলেই বুঝতে পেরেছিল। হিন্দুরা খুব কমই জেলে যায়। সেজন্যই বোধহয় হিন্দুদের জেলে দেখলে অন্যান্য কয়েদীরা সকলে মিলে তাদের উপর অনর্থক অত্যাচার করে। চেলারামকেও অনর্থক নাজেহাল করার জন্য অন্যান্য কয়েদীরা একজোট হল। চেলারাম বুঝলেন এবার তাঁর প্রাণান্ত হবে। যখন তাঁর উপর সত্যই অত্যাচার শুরু হল তখন কাছে দণ্ডায়মান এক গভীর প্রকৃতির লোকের পায়ে ধরে চেলারাম প্রাণভিক্ষা চাইলেন। সেই লোকটিই বাচ্চ-ই-সাক্কো। যার কথায় এতগুলি লোক এক জন হিন্দু কয়েদীকে হত্যা করল না তাঁর নিশ্চয়ই বিশেষত্ব ছিল। এখানে বিশেষত্ব শব্দ ব্যবহার করেছি নানা কারণে; ভারতের হিন্দু এক দিন বুঝতে পারবে এই বিশেষত্ব কি চিজ্।

 চেলারামের মনের পরিবর্তন হয়ে গেল। চেলারাম বুঝলেন টাকাই পরমার্থ নয়। তারপর বিদ্রোহ হল। বিদ্রোহে বাচ্চা-ই-সাকো কৃতকার্য হয়ে হবিবুল্লা নাম নিলেন। কিন্তু তাঁরও মতিগতি বদলে গেল। চেলারাম ধর্মের গোঁড়ামি আফগানিস্থান হতে নিমূল করতে বন্ধপরিকর হলেন। বাচ্চা-ই-সাক্কো ছোটজাত বড়জাত এ দুটা কথা পৃথিবী হতে লোপ করতে উদ্যোগী হয়ে দেখলেন, এ যাবার নয়, যে পর্যন্ত রুশ দেশের দৃষ্টান্ত অনুসরণ করা না যায়। চেলারাম এবং বাচ্চা-ই-সাক্কো উভয়ে একমত হয়ে এ কাজে ব্রতী হলেন, কিন্তু পেরে উঠলেন না। নাদীর শা এসে তাঁদের সোনার সংসারে আগুন ধরিয়ে দিলেন। চেলারাম পালালেন। বাচ্চ-ই-সাক্কোকে ফাঁসি দেওয়া হল। ছোটলোকের রাজত্ব আট মাসের মাঝেই শেষ হল। ইউরোপীয় লেখকগণ বলেছেন বাচ্চা-ই-সাক্কো উত্তর হতে এসে কাবুল আক্রমণ করেছিলেন। আমি শুনেছি বাচ্চা-ই-সাক্কো জেল থেকে বের হয়ে বিদ্রোহ করেন।


 বিদ্রোহ সম্বন্ধেও অনেক কথা শোনা যায়। কাবুলীরা প্রকাশ্যেই বলত পাঞ্জাবী মুসলমান, বেলুচি এবং আফ্রিদী সেপাই যদি বাচ্চাকে সাহায্য না করত তবে বাচ্চা যুদ্ধে জয়ী হতে পারতেন না। বৃটিশ কি অন্য কোনও সরকার (সঠিক কথা বলতে কেহই প্রস্তুত ছিলেন না) বিদেশী লোককে পূর্ব হতেই রেখে ছিলেন যুদ্ধ করতে। বিদেশী লোক বাচ্চাকে সর্বদিক দিয়ে সাহায্য করার জন্য বাচ্চ বিজয়ী হতে পেরেছিলেন। আবার যখন নাদির সাহ বিদেশ হতে এসে কাবুল আক্রমণ


করেছিলেন তখনও বিদেশী সৈন্য নাদির সাহকে সাহায্য করেছিলেন—এই তথ্য সর্বজন জ্ঞাত। বিদেশী সৈন্য বলতে বৃটিশ অথবা রূশ সৈন্য নয়।—ভারতীয় মুফতি সৈন্য। সেই সময়ে চীনাদের সাসনড়ে এবং অন্যান্য স্থানে ভারতীয় মুফতি সৈন্যের বেশ প্রসার ছিল।

 বাচ্চা-ই-সাক্কোর কাহিনী শ্রবণ করে মন্দিরে আসতে হল, কারণ সন্ধ্যার পর আর প্রধান মন্ত্রীর বাড়ী যাওয়া চলে না এবং এত শীতের মাঝে পথে চলাও সমীচীন নয়। আসামাই মন্দিরে ফিরে গিয়ে পূজারীকে সেদিনকার বিপদের কথা বলতে পূজারী খুসি এবং আশ্চর্যান্বিত হয়ে বললেন “প্রাণটা তাহলে রক্ষা পেল এবারের মত। পাঠানরা কিন্তু হিন্দুদের মোটেই সাহায্য করে না।” পূজারীর কথা শুনে মনে মনে বেশ একটু হাসলাম।

 সাহায্য না করারই কথা। অতীতযুগ হতে এদেশের নীচ জাতের প্রতি এরাই অর্থাৎ তথাকথিত আভিজাতরাই অত্যাচার করেছে বেশি। ধর্মের দিক দিয়েও কত পরিবর্তনের ঢেউ এসেছে তা সত্বেও এখন পর্যন্ত এদের প্রতিপত্তির অবসান হয়নি, গরিবের উপর অত্যাচারের উপশম হয় নি। এখানে আমি হিন্দু মুসলমানের কথা ভুলেই গিয়াছিলাম। আমি এখন ভাবছিলাম অত্যাচারী এবং অত্যাচারিতদের কথা।