আফগানিস্থান ভ্রমণ/কাবুলের পথে (২)
পরদিন প্রাতে স্থানীয় হিন্দুদের সংগে দেখা করতে গিয়েছিলাম। আমার সংগে একজন পাঠানও ছিলেন। পূর্বেই বলেছি, হিন্দুরা চার শ্রেণীতে বিভক্ত। আর্যসমাজীরা বলে “নমস্তে” সনাতনীরা বলে “জয় ধরম কি, জয় গোপালজী কি” শিখরা বলে “সৎ-শ্রী-আকাল”। নানকপন্থীরা সবই বলে। এর মানে হ’ল নানকপন্থীরা সুবিধাবাদী। যে যে-কথায় খুশী হয় তাকে সেই ধর্মেরই প্রচলিত অভিবাদন-শব্দ দ্বারা সন্তুষ্ট করে। আমি এত জটিলতায় না গিয়ে শুধু নমস্কারই বলতাম। কিন্তু এতে একমাত্র আর্যসমাজী ছাড়া আর সবাই আমার ওপর বিরূপ হয়ে উঠল; এমন কি আমাকে কিছুমাত্র ভদ্রতা দেখাতেও তারা কুষ্ঠিত হয়ে উঠল। আমি কিন্তু এদের দ্বারে ভিক্ষা করতে যাই নি, গিয়েছিলাম সংবাদ সংগ্রহ করতে। তাই একজনকে বললাম, “তোমাদের কাছে আমি ভিক্ষা চাইতে আসি নি, তোমাদের অবস্থা দেখতে এসেছি মাত্র। আমার সংগে কথা বললে তোমরাই উপকৃত হবে।”
আমার কথা শুনে কএক জন হিন্দু এমন ভাব দেখাতে লাগল যে, তারা যেন হতভম্ভ হয়ে গিয়েছে। আসল কথা হল, এরা বুঝতে পেরেছিল আমি সত্যিই ভিখারি নই, চাইতে আসি নি বরং দিতে এসেছি। নিমেষে তাদের আচরণের পরিবর্তন হল এবং শুরু হল আদর-আপ্যায়ন।
আমি হিন্দুদের বললাম, এখন স্থির হয়ে আমার কথা শোন। তোমাদের যা’ বলবার তা এমন ভাষায় বলবে, যে ভাষা আমার সংগের পাঠানও বুঝে। তোমরা আরবী এবং ফারসী কথা বেশি ব্যবহার কর বলেই আমাকে এত কথা বলতে হল। এখন বলতো জীবন কাটছে কেমন? জবাব সেই একই ভারতীয় ধরনের—দিন কেটে যাচ্ছে কোন মতে। এদের এরূপ প্রাণহীন মামুলী কথা আমার মোটেই ভাল লাগল না। পাঠানের দেশে এসেছি পাঠানের মত শক্তিমান কথা শুনতে চাই। পাঠানরা কখনও বেঁচে আছি মাত্র, কোনরূপে দিন কেটে যাচ্ছে, এসব কথা বলে না। তারা বলে—ভাল আছি, দেহে শক্তি আছে, মন খুশী আছে।
কথার মোড় ফিরিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম “হিন্দুদের নাকি গ্রাম হতে সরিয়ে এনে শহরবাসী করা হয়েছে, তার কারণ কিছু বলতে পার?”
একজন বললে, “কারণ তো কিছুই জানি না, তবে এই মাত্র জানি, এটা সরকারী আদেশ এবং তা মেনে চলাই আমাদের ধর্ম। সেজন্যই পৈতৃক ভিটা ছেড়ে চলে এসেছি।”
সংগের পাঠানটি বললে, “এরা কি কারণে শহরবাসী হয়েছে, তা এদের মুখে শুনতে পাবেন না। আমি বলছি শুনুন। যে সকল গ্রামে এখনও হিন্দুর বাস আছে এবং পূর্বে যে সকল গ্রামে হিন্দুর বাস ছিল, তাদের কাছে সবাই টাকা ধার করে। টাকা সুদে আসলে পরিশোধ করতে পারে না। সেজন্য চাষাদের জমি মহাজনদের মালিকানা স্বত্ত্বে পরিণত হয়। হিন্দুদের হাতে জমি চলে গেলে কোনরূপ ক্ষতি হত না যদি হিন্দুরা নিজে জমি চাষ করত, কিন্তু জমি চাষ করে মুসলমানরা। মুসলমানরা সাধারণত একগুঁয়ে এবং জেদী হয়। অপরের জমি চাষ করে অর্ধেকটা ফসল দিয়ে দেওয়া তাদের ধাতে সহ্য হয় না। এদিকে আইনও অমান্য করতে পারে না। সেজন্য দোটানা অবস্থায় অনিচ্ছায় কাজ করে; তারই ফলে আফগানিস্থানে ফসলের অভাব। আফগানিস্থানকে ফসলের অভাব থেকে মুক্ত করার জন্য হিন্দুদের গ্রাম হতে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
পৃথিবীতে কেউ পুরাপুরি সাধু হয়ে জন্মায় না। প্রত্যেকেরই লোভ, ক্রোধ ইত্যাদি রিপু অল্পবিস্তর আছে। গ্রামে থাকতে হলে নানারূপ জটিলতার মাঝে জীবন যাপন করতে হয়। অনেক সময় মারামারি কাটাকাটিও হয়ে যায়। আফগানিস্থানের হিন্দুরা গ্রামে বাস করে গ্রামের সুখস্বাচ্ছন্দ্য ভোগ করতে ভালবাসে কিন্তু গ্রাম্য জীবনের কষ্ট সহ্য করতে রাজি নয়। চিৎকার করে আকাশ ফাটিয়ে দিতে এরা বেশ পটু কিন্তু কেউ যদি একটা চড় মারে তবে সেই চড় ফিরিয়ে দেবার সাহস রাখে না। গ্রামের লোকের খবরদারি করতে পুলিশ সব সময় সক্ষম হয় না। নিজেদের আত্মরক্ষার ব্যবস্থা নিজেদেরই করতে হয়। কিন্তু হিন্দুৱা এদিকে একেবারে উদাসীন। যাদের আত্মরক্ষা করার ক্ষমতা নেই, তাদের গ্রামে বাস করা উচিত নয়। আফগান সরকার শান্তিপ্রিয় হিন্দুদের শহরবাসী করে ভালই করেছেন।”
আমার পোশাক হিন্দুদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। মাথায় শোলার হেট্, গায়ে কোট এবং পরনে ব্রিচেজ্। পাক্কা কাফেরি ধরণের পোশাক। এরূপ পোশাক সাধারণত হিন্দুরা ব্যবহার করতে সাহস করে না। তাদের ধারণা, এরূপ পোশাক পরলে ইউরোপীয় সভ্যতা-বিরোধী পাঠানগণ তাদের হত্যা করবে। সেজন্যই একজন জিজ্ঞাসা করেছিল আমার প্রাণের মায়া আছে কি না? আমার প্রাণের মায়া তখনও ছিল এখনও আছে, তা বলে সকল কাজেই কসাইখানার জীব হতে আমি রাজি ছিলাম না। আমি ওদের বলতে বাধ্য হলাম, তোমরা যে ভাবে থাক সে ভাবে আমি জীবন ধারণ করতে রাজি নই। আমার পোশাক আমার ইচ্ছামত হবে, কেউ যদি প্রতিবাদ করে তবে শক্তি অনুযায়ী সমুচিত প্রত্যুত্তর দেবে।
সংগের পাঠান ছেলেটির কাছে আরও শুনলাম, এরা একে অন্যে যখন ঝগড়া করে তখন মারামারির পরিবর্তে পরস্পরের কাপড়ই ছেঁড়ে। একজনের কাপড় যখন অন্যজন ছিঁড়তে আরম্ভ করে তখন চিৎকার করে হট্টগোল বাধিয়ে দেয়। পাঠানরা কখনও এরূপ দাংগা মেটাতে যায় না। দূর থেকে দেখে আর হাসে।
স্থানীয় হিন্দুদের কাছ হতে বিদায় নিয়ে সেদিনটি বিশ্রাম করলাম এবং পরদিন ফের পথে বেরিয়ে পড়লাম। এখান হতে কাবুলে দুটি পথ গিয়েছে। একটি পথ চারবাগ এবং বেনুধ হয়ে সোজা এক নম্বর কাবুলে গিয়েছে। আমার সেদিকে যাবার ইচ্ছা ছিল কিন্তু লোকমুখে শুনলাম, এই পথে জলের বড়ই অভাব, যদিও কাবুল নদী ঐ পথেই বয়ে এসেছে। পাঠানদের কথা বিশ্বাস করতে হয়; কারণ, তারা না জেনে কোন কথা বলে না। দ্বিতীয় পথ নিম্লা এবং দুই নম্বর কাবুল হয়ে প্রথম নম্বর কাবুলে পৌঁছেচে। প্রথম নম্বর কাবুল হল আফগানিস্থানের রাজধানী বা পায়তক্ত। দুই নম্বর কাবুল হল কাবুলের কাছেই একটি ছোট গ্রাম। এই গ্রামটির নামমাহাত্ম্য প্রথম নম্বরের কাবুল হতেও বেশি। পূর্বকালে অনেকে আসল কাবুল না যেয়ে নকল কাবুলে তাঁবু খাটাত এবং আসল কাবুল হতে যখন সৈন্য অতর্কিতে আগন্তুক আক্রমণকারীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ত তখন আত্মরক্ষা করতে পারত না। কোনও বৃটিশ জেনারেল নাকি নামের ভুলে দুই নম্বর কাবুলেই নির্বংশ হয়েছিলেন। আকবর হতে আওরংজেব পর্যন্ত মোগল বাদশাদের অনেক সেনানায়ক শুধু নামের গোলমালেই নাকি যুদ্ধ করতে না পেরে আফগানিস্থান হতে পালাতে বাধ্য হয়েছিলেন। হতে পারে এসব উপকথা, কিন্তু এই উপকথার মাঝে কিছুটা সত্য আছে বলেই আমার বিশ্বাস। নকল কাবুল অথবা দুই নম্বর কাবুলের কথা যথাস্থানে বলা হবে।
মানচিত্রে জালালাবাদ এবং কাবুলের সঠিক দূরত্ব ঠিক করা বড়ই কঠিন। তাই অনির্দিষ্ট দূরত্বের জন্য তৈরি হয়েই পথে বের হতে হল। এদিকের পথ পর্বতসংকুল। মোটরকারের পক্ষে বেশ উপযোগী বলতেই হবে, কিন্তু বাইসাইকেলের পক্ষে উপযোগী মোটেই নয়। পথের উপর ছোট-বড় পাথর ছড়ানো রয়েছে। যখনই সাইকেলের চাকা এরূপ পাথরের উপর গিয়ে পড়ে তখনই সাইকেল ছিটিকিয়ে যায় এবং শরীরে বেশ ঝাঁকুনি লাগে।
এদিকের পথে অনেকগুলি গ্রাম আছে। কোন গ্রামে মানুষের বসবাস আছে আর কোন গ্রামে লোকজন মোটেই নেই। দারিদ্র্যই বোধ হয় এর একমাত্র কারণ। আফগানিস্থান স্বাধীন বটে, কিন্তু এখনও দৈন্যদশা এদের ঘোচে নি; কেননা, যান্ত্রিক যুগে এরা এখনো পৌঁছতে পারেনি। যান্ত্রিক যুগে পৌঁছতে হলে শুধু স্বাধীনতাই সাহায্য করে না, আর্থিক এবং সামাজিক পরিবর্তনেরও সমূহ দরকার হয়। সে দিক দিয়ে আফগানিস্থান যে ভারতের পেছনে পড়ে আছে, একথা অনস্বীকার্য। রাজা আমান উল্লা সে দিকে মন দিয়েছিলেন মাত্র, কিন্তু এরই মাঝে বিদ্রোহ আরম্ভ হয়ে যায়। একটি বিদ্রোহ শেষ হবার পর আর একটি, তারপর নাদির খানের হত্যা। এরূপ দ্রুত রাষ্ট্রবিপ্লবে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নতি ব্যাহত হয় এবং ফলে আসে দুর্ভিক্ষ এবং নানাপ্রকারের ব্যাধি। আফগানিস্থানে দুর্ভিক্ষ এসেছিল কি আসেনি, সে সংবাদ আমি রাখি নি, তবে চোখে দেখেছি এদিকের লোক এখনও ম্রিয়মাণ অবস্থাতেই আছে।
আন্দাজ তিরিশ মাইল পথ চলে একটি ছোট গ্রামে পৌঁছলাম। গ্রামটি সমতলভূমিতে অবস্থিত। গ্রামের পাশ দিয়ে একটি ছোট জলস্রোত বয়ে চলেছে। তারই স্বচ্ছ জলে হাত-মুখ ধুয়ে গ্রামে প্রবেশ করতে যাচ্ছি এমন সময় কএকটা কুকুর আমাকে আক্রমণ করল। এদের মাঝে বুলডগ একটিও ছিল না। আমি কুকুরগুলিকে ঢিল মেরে যখন তাড়িয়ে দিচ্ছিলাম, তখন একজন লোক নিকটস্থ একটা ঘর হতে বেরিয়ে এল। লোকটি পাতলা এবং গৌরবর্ণ। ফারসি ভাষায় সে আমার সংগে কথা শুরু করল। ফারসি ভাষায় কথা বলাটা যেন একটা বাহাদুরি, আমি হিন্দুস্থানিতে বললাম, ‘ফারসি ভাষায় অভ্যন্ত নই।’ তখন লোকটি আমার সংগে হিন্দুস্থানি ভাষাতে কথা বলতে আরম্ভ করল। দেখলাম, সে বেশ হিন্দুস্থানী বলতে পারে। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম ‘এখানে রাত কাটাবার স্থান কোথাও হবে কি না?’ সে তৎক্ষণাৎ তার সঙ্গে যেতে বলল। আমি তার অনুসরণ করে একটি একচালা মেটে ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালাম। ঘরের দরজায় তালা লাগান ছিল। তালা খুলে দিয়ে সে একটা চারপাই দেখিয়ে বললে “এই চারপাইএর ওপর বসুন, আমি খাবারের এবং বিছানায় বন্দোবস্ত করছি।” এই বলেই লোকটি এক দিকে বেরিয়ে গেল, কিন্তু হঠাৎ কি মনে করে ফিরে এসে বললে “এক চারপাইএর উপর দুইজনে শুতে আপত্তি আছে কি না?” আমি বললাম “মুসাফির কখনও অন্যলোকের সংগে শোয় না, একথা কি আপনি জানেন না?” মাথা নত করে লোকটি ফের চলে গেল।
একচালা মেটে ঘরটি বেশ বড়। তার এক পাশে একটা বড় চারপাই পড়ে ছিল এবং তাতে বিছানাও পাতা ছিল। পাঞ্জাবী ধরণের চারপাইএর ওপর মোটা লেপ-তোশক পাতা দেখে ইচ্ছা হল একটু গড়িয়ে নিই, কিন্তু সে লোভ সংবরণ করতে হল, অপরের বিছানায় বিনা অনুমতিতে শোয়া নেহাত অন্যায় হবে ভেবে। আমি খালি চারপাইটার ওপরই বসে রইলাম।
কতক্ষণ পর লোকটি আরও কএকজন লোককে সংগে করে ফিরে এল। তন্মধ্যে কেউ কেউ আমার সংগে খাঁটি বাংলা ভাষায় কথা বলতে আরম্ভ করলেন। তাঁরা বাংলা ভাষায় কথা বলে বেশ আনন্দ পাচ্ছিলেন বলেই মনে হল। আমাদের কথা যাঁদের বোধগম্য হচ্ছিল না, তাঁরা আমাদের মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন। বাংলা ভাষায় আলাপকারীরা প্রত্যেকেই কলিকাতার খুঁটিনাটি বিষয়গুলি আমাকে জিজ্ঞাসা করতে ছিলেন। এদের বাংলা ভাষা শিক্ষা কারবার উপলক্ষে কলিকাতা আসার ফলেই হয়েছিল। রাত্রে খাওয়া থাকার বন্দোবস্ত হল কিন্তু কলিকাতা ফেরত পাঠানদের চিন্তিত হতে দেখে বললাম, “এটা কলিকাতাও নয়, ইণ্ডিয়াও নয়, এখানে আমি আপনাদেরই বাড়িতে খাব। অবশ্য কথাটা বলতে বেশ লজ্জাই হয়েছিল। একজন পাঠান বললেন “আপনি ঢাকবাংগালের লোক, জাদু নিশ্চয়ই জানেন।” এখানে “জাদু” মানে মন্ত্রশক্তি। আমি মন্ত্রশক্তিতে অবিশ্বাস করি জানালাম। তখন সে বললে, “তবেতো আপনি নিশ্চয়ই বাহাদুর বাংগালী হবেন। বাহাদুর বাংগালী মানে, যাদের বৃটিশ সরকার টেরারিস্ট নাম দিয়েছে।” কথাটার জবাব না দিয়ে এক কোণে চুপ করে উপবিষ্ট একটি পাঠানকে জিজ্ঞাসা করলাম, “আপনিও বোধ হয় বাংলা জানেন?”
—নিশ্চয়ই জানি মহাশয়, আমি সদিয়া পর্যন্ত বেড়িয়ে এসেছি। আপনি দয়া করে আমার বাড়িতে আসবেন কি? আমি বললাম “আমার কোন আপত্তি নেই, তবে যে ভদ্রলোক আমাকে প্রথম ডেকে এনেছেন তাঁর অনুমতি চাই।”
সেই লোকটি কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল। সে আমাকে যাবার অনুমতি দিল। আমি তৎক্ষণাৎ আলিজানের বাড়ির দিকে রওয়ানা হলাম।
আলিজান এখানকার বর্ধিষ্ণু লোক, তাঁর অনেকগুলি ঘোড়া, খচ্চর ও উট আছে, চাষের জমি আছে, পরিবারে অনেকগুলি লোক আছে। তাঁর অনেকগুলি ছেলে মেয়ে। মেয়ে হওয়াটা পাঠানদের পক্ষে সৌভাগ্য। তিনটি মেয়ের পিতার সম্মানের অবধি নেই। আলিজানের বাড়ি বেশ বড়। সামনের ঘরে বসার পর আলিজান বললেন “আপনি নিশ্চয়ই পাঠানদের নিয়মকানুন জানেন? আপনাকে বাইরে গিয়ে শৌচ করতে হবে, স্নানের কোন ব্যবস্থা নেই, তবে হাতমুখ ধোবার জন্য গরম জল পাবেন। এখন বলুন কি খাবেন?” আমি বললাম, “যা আপনারা খান তাই খাব।” আলিজান তৎক্ষণাৎ চা বিস্কুট চিনি-মিশানো নারিকেল এবং অন্যান্য শুকনো ফল এনে হাজির করলেন। আমার আগমন উপলক্ষে আলিজানের বাড়িতে আজ গ্রামের গণ্যমান্য ব্যক্তি সবাই আহার করবেন।
আমাদের চা খাওয়া হচ্ছিল এমন সময় আলিজান তাঁর ভাইকে একটি দুম্বা কাটবার জন্য পাঠালেন, আমি সে কথাটা বেশ ভাল করেই বুঝতে পেরেছিলাম। দুম্বা সাধারণত বাড়িতে কাটা হয় না। কোন অতিথি থাকলে হত্যা কাজটি আরও গোপনে করা হয়, যাতে অতিথি মোটেই টের না পান। এটা হল পাঠানদের প্রথা এবং তাদের সভ্যতার অংগ। আমাদের দেশে হিন্দুরা পাঁঠা বলি দেয় সকলকে দেখিয়ে, মুসলমানরা ছাগল কাটে উঠানের ঠিক মধ্যস্থলে। এ বিষয়ে আফগানিস্থানের প্রথা যে শ্রেষ্ঠই তাতে কোন সন্দেহ নাই।
আফগান জাত বড়ই গল্পপ্রিয়, কিন্তু নিজের দেশের গল্প তারা বিদেশীকে শুনাতে রাজি নয়, তারা বরং বিদেশের কথাই শুনতে চায়। তাদের দৃষ্টান্ত অনুসারে আমাকেও আমাদের দেশের কথা উহ্য রাখতে হল। গল্প যখন জমে গেল তখন পোস্ত ভাষায় কথা শুরু হল। আমি যে পোস্ত ভাষা জানি না তাঁরা সে কথা অনেকেই ভুলে গেলেন। আমিও এমনি ভান করেছিলাম যেন তাদের সকল কথাই বুঝতে পেরেছি। গল্প যখন শেষ হয়ে গেল তখন খাবার তৈরী হয়ে গেছে। গল্পের আসরেই খাবার আনা হল। প্রকাণ্ড একটা থালা ভর্তি পোলাও আর একটা থালাতে দুম্বার মাংস। পাঠানেরা মাংসে বেশি মসলা ব্যবহার করে না। অল্প মসলা থাকায় পোলাও এবং মাংস মানিয়েছিল ভালই।
আমি ছিলাম প্রধান অতিথি, কাজেই খাদ্য হাতে নিয়ে মন্ত্র পড়বার কথা আমারই ছিল। কিন্তু আমি মন্ত্র জানি না বলে অন্য একজন বৃদ্ধ মন্ত্র পাঠ করে খেতে শুরু করার পর অন্যান্য সবাই খেতে আরম্ভ করলেন। ক্ষুধা বেশ ছিল। সেজন্যই বোধ হয় পাঠানদের সংগে তাল রেখে খেতে সক্ষম হয়েছিলাম। আহারান্তে আবার মন্ত্র পাঠ করা হল, তারপর এল চা। চা পান করে সকলকে বললাম “যদি কেহ কিছু মনে না করেন তবে আলিজান খাঁকে সকলের তরফ হতে ধন্যবাদ দেব।” আলিজান খাঁ বলায় অনেকেরই যেন মন বিগড়ে গেল। কিন্তু আমি ছাড়লাম না দু’এক জনের সম্মতির জন্য চারদিকে তাকালাম। অবশেষে যিনি মন্ত্র পড়ছিলেন তিনি সম্মতি দিলেন। আমি সকলের পক্ষ থেকে আলিজান খাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিশ্রামার্থ অন্য কামরায় চলে গেলাম। বংশমর্যাদাহীন আলিজান সেদিন হতেই বোধ হয় খাঁ হয়েছিলেন।
রাত্রে আলিজান আমার জন্য পরিচারক নিযুক্ত করলেন, কিন্তু সেই পরিচারককে বিদায় দিয়ে আরাম করে শুয়ে পড়লাম। সকাল বেলা উঠেই চলে যাব ভেবেছিলাম, কিন্তু আলিজান খাঁ সকালে কিছু খাবারের বন্দোবস্ত করলেন। আলিজান আমার কাছ হতে খাঁ উপাধি পেয়ে এত খুশী হয়েছিলেন যে বিদায়ের বেলা তিনি কতকগুলি আফগানি মুদ্রা পথ-খরচ হিসাবে দিয়েছিলেন।
আলিজান খাঁ-এর গ্রাম পরিত্যাগ করার পর আরম্ভ হল আবার পার্বত্য পথ। রোজ দশ মাইল করে পথ চলা আমার পক্ষে কঠিন হয়ে উঠল। কোনদিন পাঁচ মাইল যাবার পরই সেদিনের মত বিশ্রাম নিতে বাধ্য হতে হ’ত। বিশ্রাম করতাম পথের পাশেই। এতে আরাম বেশ হত। রুটি আমার কাছে মজুত থাকত। পথের পাশে ছোট ছোট ঝরনার জল খেয়ে তৃপ্ত হতাম। কোনরূপ দ্বিধা না করে পথের পাশেই শুয়ে থাকতাম। এরূপ ভাবে কয়েক দিন চলার পর শরীর দুর্বল হয়ে পড়ল। শরীর দুর্বল হলে মনেও আপনা হতেই ভয়-ভাবনা দেখা দেয়। মন যখন ভয়ে জড়সড় তখন পথিক নানারূপ বিভীষিকা দেখে। সেই বিভীষিকাই একদিন গাল গল্পে পরিণত হয়। আমি সেই বিভীষিকাজাত গল্প হতে রক্ষা পাবার জন্য আফগান জাতের ভালর দিকটাই ভাবতাম। সেজন্যই বোধ হয় আমার মুখ হতে জাতিবিদ্বেষের হলাহল বের হতে পারে নি।
লোকমুখে শুনলাম, অতি কাছেই একটি গ্রাম আছে। প্রতিজ্ঞা করলাম যতদিন শরীর সবল না হয় ততদিন গ্রাম ত্যাগ করে ফের পথে বের হব না। কিন্তু কোথায় গ্রাম, কতদূরে কে জানে? কতদূরে গ্রাম মানচিত্র দেখেও বুঝবার জো নেই। লোকের কথায় যা’ শুনি তাতেও আশ্বস্ত হতে পারি না। ‘‘চান্দ মাইল আস্ত” কথাটা বাজে কথাই মনে হতে লাগল। চান্দ মাইল আস্ত-এর অর্থ করে নিলাম গ্রামে পৌঁছতে আরও কয়েক মাইল মাত্র বাকি। কিন্তু সকাল বেলাও শুনলাম চান্দ মাইল, বিকালেও তাই—রাত্রি এক প্রহরের পরও সেই একই কথা-চান্দ মাইল আস্ত। ক্রমে এদের কথার উপর অনাস্থ হল, আর পথের সংবাদ কারো কাছ হতে না নিয়ে পথের পাশেই শুয়ে রাত কাটাতে হল।
তন্দ্রা অবস্থায় কারো নাক ডাকতে কখনও শুনি নি। আমি তখনও গভীর নিদ্রায় অভিভূত হই নি, অথচ আমার নাক ডাকছিল। নিজের নাসিকাগর্জন নিজেই শুনছিলাম এবং দৃঢ়সংকল্প করেছিলাম, ঘুম ভাংগলে সর্বপ্রথম কাজ হবে, নোট বইএ এই কথাগুলি লিখে রাখা। লিখেছিলাম বলেই এখানে পুনরাবৃত্তি করতে পারছি। সত্যকথা বলতে কোন দোষ নেই। যে দিন হতে আমি স্কুলে যেতে আরম্ভ করেছি সেই শৈশবকাল থেকে কখনও জাগ্রত অবস্থায় মরণের ভয়ে ভীত হই নি। তবে স্বপ্ন দেখে অনেক সময় আমি ভীত হতাম এবং প্রাণ নিয়ে পালাতে পারলেই যেন বাঁচতাম। আজও আমার সেই ভাব এসে পড়েছিল। কত রকমের ভূত প্রেত আমার চারদিকে যেন ঘুরছিল। চোখ খোলা রাখতে চেষ্টা করিছিলাম অথচ চোখ বুজে আসছিল। চেষ্টা করে বসে পড়লাম। তখনও অন্ধকার ছিল। আশে পাশে কিছুই দেখতে পাচ্ছিলাম না। আমার ধারণা ছিল ভরাপেটে শুলে নাকি নানারূপ ভীতিপ্রদ স্বপ্ন দেখা যায়। কিন্তু আমার পেট ভরা ছিল না, ছিল খালি পেট। পরে জেনেছিলাম একেবারে খালি পেট থাকলেও নাকি নানারূপ ভীতিপ্রদ স্বপ্ন দেখা যায়।
অন্ধকারে অনেক্ষণ বসে থাকতে ভাল লাগছিল না। নিকটস্থ নির্ঝরিণীতে হাত মুখ ধুয়ে ফের বসলাম। কতক্ষণ পর হঠাৎ অদূরে মোরগের ডাক শুনে বুঝলাম গ্রাম নিকটেই। আমার আর দেরী সইল না, তৎক্ষণাৎ গ্রামের দিকে পূর্ণ উদ্যমে সাইকেল চালালাম। কতক্ষণ যাবার পরই একটা জলভর্তি ছোট নালার ধারে এলাম। নালার ওপারেই একটি সরাই হতে হারিকেন লাস্পের আলো আসছিল। সেই আলোয় নূতন আশা মনকে সঞ্জীবিত করে তুলেছিল।
সরাইএর দরজা এবং নিকটস্থ কাফিখানার এক দরজা তখনও খোলা ছিল। কাফিখানাতে কএক জন লোক চা খাচ্ছিল। আমাকেও চা দিতে বললাম। গ্রামের মসজিদে যিনি আজান দেন তিনিও চা খাচ্ছিলেন এবং হাতের মালা টপকাচ্ছিলেন। মালা টপকানো এদেশে খুব প্রচলিত। মালা টপকানো সম্বন্ধে এখানে কিছুই বলব না, যদি পারি তবে পরে বলব। আমি কোথা হতে এসেছি, কোথায় যাব এবং কি কাজ করি মোল্লা জিজ্ঞাসা করলেন। সংক্ষেপে আমার পরিচয় দিলাম। মোল্লা আমার পিঠে হাত রেখে বললেন “বলুন তো কখনও ভূত প্রেত এবং জিন দেখেছেন কি না?” আমার হাতের ঘড়িটা বাতির কাছে নিয়ে দেখলাম তখন প্রায় পাঁচটা বেজেছে। বললাম এই দেখুন রাত আর মাত্র দেড় ঘণ্টা আছে, আজ একাকী বাইরে ছিলাম, ভূত প্রেত তো দেখিনি। লোকটি আমার কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারল না। এদিকে চায়ের পেয়ালাগুলি এক এক নিশ্বাসে উজাড় করছিলাম। বয় চায়ের পেয়াল ভর্তি করে দিচ্ছিল। শেষটায় মোল্লাকে বললাম “ভূত প্রেত আমাদের পেটে থাকে; এর মানে হ’ল যখনই আমাদের পেট গরম হয় তখনই নানারূপ স্বপ্ন দেখি। গত চার বৎসর যাবত দেশ বিদেশে ঘুরছি, অনেক বনে জংগলে রাত কাটিয়েছি, কোথাও কোনদিন ভূত প্রেত দেখিনি।”
মোল্লা জিজ্ঞাসা করলেন, ফিরিঙ্গী দাওয়াই বিশ্বাস করেন?
বললাম “নিশ্চই”।
মোল্লা একটা হাই তুলে বললেন “এটা, কাফেরির লক্ষণ”।
পাশের একজন লোক প্রতিবাদ করে বললে, ফিরিঙ্গী দাওয়াই না হলে আমাদের চলে না। হেকিমি দাওয়াই তো কোন কাজেই লাগে না। ইংলিশদের সংগে যখন লড়াই হয়েছিল, তখন ফিরিঙ্গী দাওয়াই না পেলে অনেক আহত সেপাই মরে যেত।
মোল্লা ত একদম চুপ। তাঁর দুরবস্থা দেখে আমার দুঃখ হল, তাকে বুঝিয়ে বললাম “না বুঝে কোন কিছুর বিরুদ্ধে চাটুপটু মত প্রকাশ করা আপনাদের মত শিক্ষিত লোকের পক্ষে অন্যায়। আপনারা ত চান দুনিয়ার ভাল, বিলাতী ঔষধ ব্যবহারে ক্ষতি কি?”
মোল্লার একটু শান্তি হল। তিনি আমাকে তাঁর বাড়ীতে বিশ্রাম করার জন্য অনুরোধ করলেন, আমিও বিনা বাক্যব্যয়ে তাঁর অনুসরণ করলাম। মোল্লার বাড়ী মসজিদ হতে সামান্য দূরে। বাড়ীতে পৌঁছে তিনি অন্দরে প্রবেশ করলেন আর আমি বাড়ীর সামনে দাঁড়িয়ে চারদিক দেখতে ছিলাম। বাড়ীটি ছোটখাট দুর্গবিশেষ। এই ধরনের বাড়ীঘর তৈরী হয় যেখানে বন্য জীবের প্রচুর অত্যাচার। আফগানিস্থানের উত্তর দিকটাতে নেকড়ে বাঘ ভয়ানক অত্যাচার করে। প্রত্যেক পাঠানের বন্দুক পিস্তল এমন কি মেশিনগান পর্যন্তু থাকে, তবুও দল বেধে যখন নেকড়ে আক্রমণ করে তখন বন্দুক-কামানে কিছুই হয় না। নেকড়ের নাগালের বাইরে চলে যেতে হয়, নতুবা রক্ষা থাকে না।
পাঠানদের মধ্যে প্রচলিত কথা আছে, যদি বাঁচতে হয় তবে মরণের সময়ও শত্রুকে রুখতে হবে। যদি বাঁচত হয় তবে নেকড়ে বাঘের মত লড়তে হবে। মরণকে কোন মতেই ভয় করলে চলবে না। ‘‘কথাটা যখন শুনেছিলমে তখন মনে হয়েছিল নিজের দেশের কথা। আমাদের প্রাণের মায়া অপরিসীম, আমরা মরতে জানি না, বাঁচতেও জানি না। আমরা আমাদের ভবিষ্যত ঈশ্বরের ওপর ছেড়ে দিই। পাঠানরা আল্লাকে মানে, আল্লার নামে ভয়ও পায়, কিন্তু তা বলে নিজের দেশকে, নিজের মা-বোনকে রক্ষা করার সময় আল্লার ওপর সব ছেড়ে দেয় না। তারা বিপদের সময় “পয়মাল” স্বভাব প্রাপ্ত হয় এবং প্রাণও দেয় বীরের মত। একজন পাঠানকে বলেছিলাম মরণের সংগে পয়মালের উপমা দেওয়াটা উচিত হয় নি। পাঠান তেড়ে বললে” যখন মরতে যাব তখন যদি অন্য ভাব থাকে তবে পরাজয় অনিবার্য। শূকর যখন আক্রমণ করে তখন মরণের ভয় রাখে না। এসব কথা শোভা পায় তাদেরই যারা যে কোন মুহুর্তে মরণকে আমন্ত্রণ করতে পারে।
দাঁড়িয়ে পূর্বস্মৃতি জাগিয়ে তুলছিলাম আর দেখছিলাম মোল্লার বাড়িটা। আধঘণ্টার মাঝেই মোল্লা ফিরে এলেন এবং আমাকে বাড়ির ভেতর নিয়ে গেলেন। বাড়িতে অনেকগুলি ঘর। সামনের দিকের একটি ঘরে আমরা প্রবেশ করলাম। মোল্লা আমাকে সুসজ্জিত এক বিছানা দেখিয়ে বললেন, এতে শোবেন এবং অন্যান্য দরকারি কাজ সারতে হলে বাইরে যাবেন। চারপাইএর কাছেই একটি সন্দলও ছিল। সন্দলের কাছে না বসে চারপাইএর ওপর বসলাম এবং লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম।
বেলা দশটার সময় ঘুম ভাঙল। চটপট প্রাতকৃত্য সেরে ঠাণ্ডা জলে হাত মুখ ধুয়ে আবার খাটে এসে বসলাম এবং আরাম করে একটি সিগারেট ধরলাম। ইত্যবসরে মোল্লা কএকজন ছাত্রকে নিয়ে আমার ঘরে প্রবেশ করলেন। সবাইকে নমস্কার করলাম। তঁরা বিনিময়ে “আদাব” করলেন। এখানে স্তারেমশে শব্দের খুব কম ব্যবহারই দেখলাম। ছাত্রদের মাঝে একজন হিন্দুও ছিলেন। তার মাথায় ছিল বোখারার ফেজ। অন্যান্যদের মাথায় ছিল পাগড়ি। ছোট ছোট মাসাদের কাপড়ের পাগড়িগুলি দেখাচ্ছিল বেশ। যে কজন যুবক এসেছিলেন তাদের প্রত্যেকেরই শরীর নিখুঁত এবং নীরোগ। এরূপ নিখুঁত এবং নীরোগ দেহ আফগানিস্থানে কমই দেখা যায়। তাঁরা ছিলেন গম্ভীর এবং স্বল্পভাষী। তাঁদের ললাটে এবং মুখের ওপর চিন্তার রেখা পড়েছিল। চিস্তাশীলের মুখের ভংগিই অন্যরূপ। চিন্তারেখাযুক্ত মুখ আমার কাছে প্রিয়। আমি সেই প্রিয়দর্শন মুখগুলি দুচোখ ভরে দেখছিলাম। মোল্লা তাদের প্রত্যেককে আমার সংগে পরিচয় করিয়ে দিলেন, তাঁর নিজের ছেলেটিও বাদ পড়েনি। তঁরা প্রত্যেকেই মেডিকেল স্কুলের ছাত্র।
আলাপ পরিচয় হবার পর আমরা সকলেই দুইখানা করে পরোটা এবং চা খেলাম। তারপর কথা আরম্ভ হল। কিন্তু কথা বলতে আমার ভাল লাগছিল। না। সিগারেট ফুরিয়ে গিয়েছিল; সিগারেট না হলে যেন কি একটা অভাব অনুভব হয়। একজন ছাত্র আমার অবস্থাটা বুঝে নিকটস্থ একটা দোকান হতে এক প্যাকেট সিগারেট এনে দিলেন, আমি একটা সিগারেট ধরিয়ে ধাতস্থ হলাম। এখানেও আমিনা এবং মামুদের গল্পের পুনরাবৃত্তি হল। তারপর শুরু হল চীনের ডাকাতদের তথা কমিউনিস্টদের কথা। চীনের কমিউনিস্টরা ডাকাত বলেই সর্বপ্রথম সুখ্যাতি লাভ করেছিল। আমানউল্লা এবং বাচ্চা-ই-সিক্কার কথা কেউ বললেন না দেখে আমিই তাঁদের সম্বন্ধে প্রশ্ন করেছিলাম। সকলেই আমানউল্লার ছবি মন হতে মুছে ফেলেছিল কিন্তু অনেকে এখনও বাচ্চা-ই-সিক্কার কথা ভূলে নি।
মোল্লার বাড়ীতে চারদিন কাটিয়ে তাঁর পুত্র ইয়াকুবকে সংগে নিয়ে চললাম কাবুলের দিকে। ইয়াকুবের বয়স মাত্র একুশ। এরই মাঝে সে ফারসি এবং হিন্দুস্থানি ভাষা বেশ আয়ত্ত করে ফেলেছিল। পূর্বেই বলেছি এরা সবাই নিখুঁত এবং সবল যুবক। এই যুবককে সংগে নেবার কারণ একটু পরই বলব।
পঞ্চমদিন সকাল বেলা আমরা গ্রাম ছেড়ে বড় পথে এলাম। আমি আগে আর ইয়াকুব পেছনে। প্রায় মাইল দশেক চলার পর ইয়াকুব বললে সে একটু বিশ্রাম করবে। আমি তাতে রাজি হলাম এবং উভয়ে একটা পাথরের আড়ালে বসলাম। আমাদের সংগে রুটি এবং মুরগির তরকারি ছিল। উভয়ে বেশ করে খেয়ে নিলাম এবং তারপর কথা শুরু হল। ইয়াকুব বললে “বোখারার দৃষ্টান্ত তাকে উদ্বুদ্ধ করেছে, সে আফগানিস্থানকে বোখরায় পরিণত করবেই।”
আমি নির্বাক হয়ে শুধু তার কথা শুনছিলাম। সে ফের বলতে লাগল “পথেই আমি বুঝতে পারব মেডিকেল ছাত্রেরা কত দুঃখ কষ্ট সহ্য করছে।” আমি তাকে বললাম “যখন তোমার উপর অত্যাচার উৎপীড়ন চলবে তখন আমি চুপ করে থাকব না, বাধা দেব। তাতে যদি আমার আফগানিস্থান ভ্রমণ না হয়, না হবে, বেলুচিস্থান হয়ে ইরাণ যাব।” পাঠান জাত বড়ই ভাবপ্রবণ, আমার মুখের সামান্য এই কয়টি কথাতেই সে স্তব্ধ, গভীর হয়ে গেল। আমরা আরও কিছুক্ষণ বিশ্রাম করে পুনরায় অগ্রসর হলাম।
একটু যাবার পর পাশেই একটি কবর পড়ল। ইয়াকুব সাইকেল থেকে নেমে কবরে গিয়ে প্রার্থনা করে বললে, “কি প্রার্থনা করেছি জানেন”?
—বল কি বলেছ। বলেই তার মুখের দিকে তাকালাম।
সে মাথা নত করে বললে, শেষের দিনে যেন ঈশ্বর এই পবিত্র ইসলাম আত্মার সদগতি করেন।
—বুঝেছি হে, আমি এখানে যদি মারি তবে আমার আত্মার জন্য সেরূপ প্রার্থনা করবে না, যেহেতু আমি ইসলাম ধর্মের লোক নই।
সে একটু হেসে বললে, “আমাদের দেশের লোকের ধারণা কিরূপ তা বুঝাবার জন্যই এরূপ বললাম, এসব কথা মনে রাখবেন না। এগিয়ে চলুন, আজ আমাদের একটা ছোট গ্রামে পৌছানার কথা আছে, সেখানে আপনি যেমন লেকচার দেবেন আমিও তেমনি লেকচার দেব।”
পাহাড়ের গায়ে গ্রাম। গ্রামটি ছোট হলেও বেশ পরিষ্কার। আমরা কিন্তু একটা আবর্জনাপূর্ণ ঘরে প্রবেশ করলাম, যেন আমাদের দেশের একটা গোয়াল ঘর। ঘরে প্রবেশ করা মাত্র দুৰ্গন্ধ অনুভব করলাম। ঘরটা দিনের বেলাতেও অন্ধকার। এরূপ ঘরে বসতে ইচ্ছা হচ্ছিল না। শুধু ইয়াকুবের অনুরোধেই বসতে হয়েছিল। আমরা ঘরে প্রবেশ করা মাত্রই তিনটি প্রৌঢ় লোক ইয়াকুবকে ঘিরে দাঁড়াল। ইয়াকুব প্রত্যেকের সংগে করমর্দন করল, আলিংগন করল না। আমিও করমর্দন করলাম। একটি লোক ঘরে আগুন জ্বালাল এবং আমাদের বসবার জন্য কারপেট দেখিয়ে দিল। আমরা তাতেই বসলাম। অল্প সময়েই চা তৈরি হল। আমাদের চা খেতে দিয়ে তিনটি লোকই কিসের জন্য গ্রামে গেল সেটা কিছুই বুঝলাম না।
অনেকক্ষণ কথা বলে বুঝলাম, প্রগতিশীল যুবকগণ করমর্দনই করে, অলিংগন করে না এবং যদি কেউ পূর্বপ্রথাকে সম্মান দেখাতে বলে তবে তারা বিনা তর্কে এমনই একটা ভংগি করে যে কেউ আর তাদের আলিংগনের জন্য অনুরোধ করবে না।
আফগান জাত নানা সম্প্রদায়ে বিভক্ত তা পূর্বেই বলেছি। ইয়াকুব সেই শ্রেণীগুলি ডিংগিয়ে আর এক স্তরে উঠেছিল। তার নাকে নভিক ছাপ রয়েছে, চোখ কটা, চুল পিংগলবর্ণ। তা বলে সে কখনও আর্য বলে নিজের পরিচয় দেয় নি। সাধারণত আফগানিস্থানে দ্রাবিড়, আর্য, মোংগল এবং সিমেটিক্দের মাঝে বিবাহ চলে। কিন্তু মোংগলরা এই তিন শ্রেণীর লোকদের সংগে বৈবাহিকসম্পর্ক স্থাপন করে না কারণ মোগলরা প্রায়ই শিয়া। শিয়া এবং সুন্নিতে কেন বিয়ে হয় না সে কথা আমি জানতে চেষ্টা করি নি। যে তিনটি লোক গ্রামে চলে গিয়েছিল তারা মোংগল নয়, যে লোকটি চা এবং রান্নার বন্দোবস্ত করছিল সে মোংগল। সে আলির ভক্ত, মোহাম্মদের নাম সে নেয় না। কিন্তু এই দুর্গন্ধযুক্ত ঘরে মোংগল এবং অমোংগলের একত্র সমাবেশ দেখে সন্দেহ হল, এরা নিশ্চয়ই কোন রাজনৈতিক দলের লোক। ইয়াকুবকে এ সম্বন্ধে কিছুই বললাম না। বালিশে হাত দুটা ছড়িয়ে দিয়ে ওপর দিকে চেয়ে রইলাম। লোক তিন জন ফিরে আসার পর রান্নার বন্দোবস্ত হল। পাঠানদের পাক-প্রণালী আমাদের মত নয়। একদম সদাসিদে। দোকানের নান, চাপাতি আর নুন মাখানো টুকরা মাংস। মাংসগুলিকে একটা লোহার শিকে গেঁথে নেওয়া হল। চায়ের সকল বন্দোবস্তই ছিল। আমাদের খাওয়া এবং হাতমুখ ধুয়ে বসতে আধা ঘণ্টার বেশি লাগিল না।
পাঠানরা বড়ই গল্পপ্রিয় একথা আগেই বলেছি। গল্পের দিকে আমি ঝুকিনি; তারাই গল্প আরম্ভ করেছিল। আমি শ্রোতা। ফারসি ভাষায় কথা বলছিল, কারণ মোংগল লোকটি পারতপক্ষে পোস্ত ভাষায় কথা বলত না। এদের কথায় ইন্ক্লাব শব্দটি বার বার উচ্চারিত হতে শুনে ভীত হয়ে পড়েছিলাম। কারণ লাহোর একটি সংবাদপত্রের নাম ছিল ইন্ক্লাব। সেই সংবাদপত্রের কাজই ছিল সাম্প্রদায়িক বিভেদ জাগিয়ে রাখা। ভাবলাম হয়তো এরাও আমাকে নিয়ে একটা বিরোধের সৃষ্টি করছে। আমি তখনও ইন্ক্লাব শব্দের অর্থ কি জানতাম না। ইয়াকুবকে বললাম, আমার ধর্ম নিয়ে যদি গুয়া কোন প্রশ্ন উঠিয়ে থাকে। তবে বলে দাও আমি তোমার সংগ এখনই পরিত্যাগ করে বাইরে গিয়ে শোব, আমার সে অভ্যাস আছে। ইয়াকুব আমার কথা শুনে আশমান হতে পড়ল, সে জিজ্ঞাসা করলে, “এই কথাটার মানে কি বলুন তা? আমি বললাম “এরা বার বার ইন্ক্লাব বলছে। লাহোরে একটি সাপ্তাহিক কাগজ আছে যার নাম ইন্ক্লাব, সেই কাগজের কাজই হল সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ জাগিয়ে রাখা। আমার ভয় হচ্ছে এখানেও সেই সাম্প্রদায়িব বিদ্বেষ প্রবেশ করেছে।”
ইয়াকুব বললে “ইন্ক্লাব মানে কি জানেন না?”
আমি বললাম, ইন্ক্লাব মানে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়ানো বলেই মনে হয়।
ইয়াকুব হেসে বললে “আপনাদের দেশে ইন্ক্লাব মানে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ হতে পারে, কিন্তু এখানে তার অর্থ বিদ্রোহ। যাকগে চুপ করে থাকুন, এ কথাটি কখনও মুখে আনবেন না।”
ভাবলাম স্থানভেদে শব্দেরও বিভিন্ন অর্থ হয়ে থাকে। লাহোরে ইন্ক্লাব সাপ্তাহিক আরবী অক্ষরে ছাপা হত, অতএব তাতে বিদ্রোহ প্রচার করা হ’ত কি সাম্প্রদায়িক বিরোধ জাগিয়ে রাখা হ’ত তা আমি ঠিক করে বলতে পারি না। তবে আমাকে অনেকেই বলেছিল এই কাগজখানা আর্যসমাজীদের উণ্টো কথাই বলে।
ইয়াকুব এবং অপর চারজন লোক অনেকক্ষণ নিজেদের মধ্যে কথা বলে আমার মুখের দিকে তাকাল এবং খুব চিন্তা করে জিজ্ঞাসা করলে “তুম্ কাবুল যাওগে?”
আমি বললাম “সেরূপই ইচ্ছা”।
মোংগল লোকটি বললে “হাসিয়ার হো কে বাত করো, ইন্ক্লাব কী মতলব মালুম নেই আউর মুসাফির বল্কে জাহির করতা হায়, সরাম নেই হোতা?”
মনে মনে বললাম “জাহান্নামে যাক তোমার ইন্ক্লাব, যেরূপ ঠাণ্ডা পড়েছে তাতে প্রাণ বাঁচানই দায়। মুখে বললাম, একটু আগুন ধরাও না মোল্লা সাহেব, আমার শরীর যে কাঁপছে। আমার কথা শুনে সবাই এক সংগে হেসে উঠল।
দুর্গন্ধযুক্ত স্থানটাতে কোন মতে রাত কাটিয়ে পরদিন সকালে সকলের সংগে করমর্দন করে বিদায় নিলাম। ইয়াকুব পথে এসে মুখ খুললে, আমি মুখ বন্ধ করলাম। আমি প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে চললাম আর ইয়াকুব বকে যাচ্ছিল। শেষটায় সে বললে “পাহাড়টার গায়ে আপনি কি দেখছেন?”
—প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখছি হে?
ইয়াকুব প্রাকৃতিক দৃশ্য পছন্দ করত না। সে বললে “এই পাহাড়ে অনেক ধাতব পদার্থ আছে, যদি জিয়লজিষ্ট এখানে অনুসন্ধান করেন তবে হয়ত স্বর্ণ খনিও পেতে পারেন, কিন্তু আমাদের দুর্ভাগ্য এখনও আমাদের দেশে সেরূপ বন্দোবস্ত হয় নি।”
দ্ধিপ্রহরে আমরা একটি ফেরিওয়ালাকে পথে পেলাম, সে গ্রামান্তরে যাচ্ছিল। সে রুটি ফেরী করে বিক্রি করছিল। তার কাছ থেকে রুটি কিনে দ্বিপ্রহরের ভোজন শেষ করে নিলাম। এরূপ ফেরিওয়ালা আর কোথাও দেখি নি। এক গ্রাম হতে অন্য গ্রামে ফেরি করে জিনিস বিক্রি করতে দেখা যায় না এবং সম্ভবও নয়। কারণ গ্রামগুলি অনেক দূরে দূরে। তবে এই ফেরিওয়ালা কে? পরে জেনেছিলাম। এই লোকটি ফেরিওয়ালা নয়, ইয়াকুবেরই একটি আত্মীয়-পূর্বে সংবাদ পেয়ে আমাদের জন্য খাদ্য নিয়ে এনেছিল। তবে সে রুটির দাম নিল বেশ? বোধ হয় আমি যাতে চিনতে না পারি এইই ছিল তার উদ্দেশ্য। খাবার খেয়ে একটু বিশ্রাম করবার জন্য আমরা একটি স্থান বেছে নিলাম।
স্থানটি পরিষ্কার এবং পাহাড়ের আড়ালে। সামনে বিস্তীর্ণ মাঠ, তারপরই আর একটা পর্বত। অন্য একটা পর্বতের উপর কালো ছায়া বেশ সুন্দর দেখাচ্ছিল। ভাবপ্রবণতায় অভিভূত হয়ে পড়লে বাস্তবকে ভুলে যেতে হয়। আসলে পাহাড়পর্বত পাথরের টিবি বৈত নয়। ইয়াকুব কিন্তু এরই মাঝে শুয়ে পড়েছিল। এরূপ পরিশ্রম সে কখনও করেনি তাই ঘুম তার চোখে লেগেই ছিল। আমরা আরও দুটো দিন বাইরে কাটিয়ে কাবুলের সন্নিকটে এলাম। আমার আনন্দ হছিল কাবুল দেখব বলে, আর ইয়াকুবের মুখ গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে উঠছিল কষ্টের সম্মুখীন হতে হবে বলে। ইয়াকুবের মুখ এবার সত্যিই মলিন দেখাচ্ছিল। তাকে জিজ্ঞাসা করে জানলাম আর একটু এগিয়ে গেলেই ঘাঁটি পাওয়া যাবে। সেখানে তাকে বলতে হবে কেন সে কাবুল যাচ্ছে। সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে সে পাচ্ছিল না। তাকে অভয় দিয়ে বললাম “তুমি বলবে, কাফেরটাকে অনুসরণ করে চলেছ এবং দেখছ সে এসলামের কোনও ক্ষতি করছে কি না।” যুবক যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।
কতক্ষণ যাবার পরই আমরা একটা ঘাঁটিতে পৌঁছলাম। ঘাঁটিতে কোন সেপাই ছিলনা, মুফতি পোশাক পরে একজন অফিসার বসেছিলেন। এসেই পাসপোর্টখানা তাঁর হাতে দেবার পর ইংগিতে তিনি আমাকে ঘাঁটি পার হবার আদেশ নিলেন। হন্ হন্ করে চলে গিয়ে একটু দূরে ইয়াকুবের অপেক্ষায় দাঁড়ালাম। এদিকে ইয়াকুব এসেই চোখ মুখ লাল করে কাস্টম অফিসারকে কি বললে এবং কাস্টম পার হয়ে চলে এল।
আমি তখনও দাঁড়িয়েছিলাম। সে আমাকে তদাবস্থায় রেখেই এগিয়ে চলে গেল, যেন আমার সংগে তার পরিচয় নেই। কতক্ষণ যাবার পর উভয়ে মিলিত হলাম। ইয়াকুব বললে, “আমার উপদেশে নাকি বেশ কাজ হয়েছে।”
আমরা সে দিন আর বেশি দূর না গিয়ে একটি সাবেকি ধরণের গৃহস্থের বাড়িতে অতিথি হলাম। গৃহস্থও আমাদের মামুলি ভাবেই গ্রহণ করলেন। রাত্রে খাবার জন্য আমরা প্রত্যেকে মাত্র দু’খানা করে রুটি খেতে পেয়েছিলাম। দারিদ্র গৃহস্থ একটু তরকারি দিতেও সক্ষম হন নি। আমি বারবার ইয়াকুবকে ইংগিতে বুঝিয়ে দিচ্ছিলাম, গৃহস্থ যেন কোন মতেই আমাদের অন্তরংগ ভাব বুঝতে না পারেন। ঘুমাবার সময়ও দু'জন দুদিকে ঘুমালাম, মাঝে শুল গৃহস্বামী। গৃহস্বামী আমাকে যা খেতে দিয়েছিলেন ইয়াকুব তার একটুও বেশি পায় নি। ইয়াকুব ইসলাম ধর্মের রক্ষকরূপে ঘরে প্রবেশ করেছিল এবং আমার নামে নানা রকম বদনাম করেছিল। কিন্তু গৃহস্থ উভয়কেই মুসাফির ভেবে সমান ব্যবহারই করেছিলেন। প্রথম ঘাঁটি-টি হ’ল পূর্বকথিত দু নম্বর কাবুল। এ স্থানটার সম্বন্ধেই নানারূপ কাহিনী প্রচলিত আছে। এই স্থানটি সমতল এবং জলেরও বেশ সুবিধা আছে। শোনা যায় লড়াইএর সময় জল বিষাক্ত করে দেওয়া হ’ত; কিন্তু এখানে সে বন্দোবস্ত ছিল না। এজন্যই বোধহয় বৈদেশিক আক্রমণকারীরা পূর্বে এসব স্থানেই তাঁবু ফেলত। কিন্তু তাদের চোখের সামনে পর্বতমালাতে পাঠান সৈন্য লুকিয়ে থাকতে পারে, সেটাও তাদের জানা উচিত ছিল। হরিসিং লিলুয়া এবং রাজপুত সৈন্য যখন কাবুল আক্রমণ করেছিলেন তখন তারা এখানে তাঁবু ফেলে বিশ্রাম করেন নি। প্রত্যেকেই এই স্থানটিকে বাঁয়ে রেখে আরও উজানে গিয়ে, পেছন দিক হতে আসল কাবুল আক্রমণ করেছিলেন। কাবুলে যত আক্রমণকারী এসেছিলেন, তন্মধ্যে কারো নাম ইতিহাস ছাড়া আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না, কিন্তু হরিসিং লিলুয়ার নাম আজও শিশুদের ঘুম পাড়ানি গানের সংগে জড়িয়ে রয়েছে। হরিসিং লিলুয়া কখনও সমতল ভূমিতে বিশ্রামের ব্যবস্থা করে নিজেকে বিপন্ন করেন নি। তিনি নতুন নতুন দুর্গ গঠন করে তাতেই শিখ সেপাইদের থাকবার বন্দোবস্ত করেছিলেন। আজও সেই দুৰ্গমালা বর্তমান। বৃটিশও হরিসিং লিলুয়ার অনুকরণ করে কাবুলের কাছেই একটা দুৰ্গ তৈরি করেছিলেন, আজ সেই দুৰ্গ খালি পড়ে আছে, একখানা ঘরও তাতে নেই, শুধু চারদিকে দেওয়াল দেখতে পাওয়া যায়। আমি সেই পুরাতন দুর্গ দেখতে যাই নি। দুর্গ দুৰ্গ-ই, শাসিত এবং শাসকের মধ্যে একটি পর্দা মাত্র। যখনই শাসকের শক্তি ক্ষয় হয় তখন দুর্গের দেওয়ালই শুধু থাকে, ঘর সেখানে থাকে না।
সকালে উঠেই আবার আমরা পথে এলাম। পথ দুৰ্গম নয়। তবে উল্টা বাতাস বইছিল। উল্টা বাতাসে চলা ভয়ানক কষ্টকর। সেজন্য আমরা একটা ঘরের আড়ালে শুয়ে পড়লাম। ইয়াকুব আমার ঘুমে বাধা দেয় নি। সে আমার সংগে সংগে যেতে পছন্দ করছিল এবং কাবুলে যত দেরি করে পৌঁছতে পারি তারই উপায় খুঁজছিল। প্রায় তিনটার সময় যখন ঘুম ভাঙল তখন ইয়াকুব বললে, আজ এখানেই থাকা যাক, রুটি নিয়ে আসছি বলেই ইয়াকুব চলে গেল।
ইয়াকুব কখনও ভারতবর্ষে আসে নি, আসবার ইচ্ছাও ছিল না। সে ভারতবর্ষ না দেখে দেখতে চাইছিল রুশ দেশ এবং উত্তর চীন। চীনের সংবাদ পাবার তরে ভারি আগ্রহ। কথায় কথায় বললাম “কুসংস্কারের দিক দিয়ে এবং খাদ্যের দিক দিয়ে ভারতবর্ষের সংগে পাঠানদের বেশ মিল রয়েছে। তন্ত্রমন্ত্র, ভূতপ্রেত পাঠানদের ঘাড়ে যেমন চেপে বসেছে, ভারতবাসীর ঘাড়েও তেমনি চেপে আছে। পাঠানরা ভাল রুটি তরকারি অথবা ডাল ভাতই খেয়ে থাকে, ভারতবাসীরাও তাই খায়। পৃথিবীর অনেক স্থানে গিয়েছি, সর্বত্র দেখেছি ভারতবাসী এবং পাঠান একত্রে বসবাস করে। আমেরিকায় পাঠান নিজেদের হিন্দু বলে পরিচয় দেয় এবং দাবি করে তারাই আসল এবং পবিত্র হিন্দু। বাঙালী মুসলমানকে পাঠানরা কোনদিনই হিন্দু বলে স্বীকার করত না, এখনও করে না। সেজন্য ডিট্রয় শহরে পাঠান এবং পাঞ্জাবী মুসলমান মিলে গড়েছে হিন্দু সভা আর অন্যান্য ভারতবাসী সবাই মিলে গড়েছে ইণ্ডিয়া এসোসিয়েসন্। পাঠানরা হেসে আমেরিকানদের বলে, আমাদের দেশেও ইণ্ডিয়ান আছে, ঐ দেখো তাদের এসোসিয়েসন। ডিট্রয় যাবার পর যখন আমি ইণ্ডিয়া এসোসিয়েসন উঠিয়ে দিয়ে হিন্দু এসোসিয়েসন নাম দেবার প্রস্তাব করি তখন অনেকেই আমার প্রতি রাগ করেছিল। তার একমাত্র কারণ পাঠানদের সংগে বাংগালী মুসলমানদের মনের মিল ছিল না। অথচ প্রত্যেকেই নিজেদের খাঁটি হিন্দু বলে প্রমান করতে চাইত।
আমরা যে স্থানে বিশ্রাম করছিলাম তার একদিকে একটি পুরাতন ঘর আর অন্যদিকে বিস্তীর্ণ মাঠ। মাঠ খালি।
শীত সমাগত। রাত্রি যখন গভীর তখন একদল পুলিশ আমাদের দিকে আসছিল। পুলিশ দেখেই ইয়াকুব পলায়ন করল, আমি একলা শুয়ে থাকলাম। পুলিশ আমাকে একাকী দেখে সাহসী বলে খুব প্রশংসা করে নিজেদের কাজে গেল।
ইয়াকুব ফিরে এসে বলল “খুব বেঁচে গেছ। পুলিশ যদি তোমাকে আমার সংগে দেখত তবে আর রক্ষা ছিল না, নিশ্চয়ই করাগারে অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য আবদ্ধ রাখত।”
আফগানিস্থানের জেলে খাদ্যের সুবন্দোবস্ত নাই। এখনও আফগান কারাগার আদিম অবস্থাতেই আছে। অনেক কারাগারে খাদ্য সরবরাহ করা হয় না। বাইরে থেকে কয়েদীকেই খাদ্য যোগাড় করে আনতে হয়। সেজন্য অনেক কয়েদীকে ডাণ্ডা বেড়ি পায়ে পথে ঘাটে দেখা যায়। বর্তমানে যদি কারাগারের পুরাতন প্রথা উঠে গিয়ে নতুন নিয়মের প্রবর্তন হয়ে থাকে ভালই। আমি কাবুলে থাকার সময় আব্দুল্লা নামে এক ভদ্রলোক বলেছিলেন যে আফগানিস্থানে অনেক আইনকানুন সত্বরই রদবদল হবে। তাঁকে শুভস্য শীঘ্রং করতে বলেছিলাম। তিনি হেসে বলেছিলেন, এদেশের কারাগারে আপনার আগমনের সম্ভবনা আছে নাকি? তাঁকে বলেছিলাম, আমার শত্রুও যেন এরূপ কষ্টে না পড়ে।
রাত কাটল। পরদিন ফের রওয়ানা হলাম এবং দুটি কাস্টম হাউস পার হয়ে কাবুল শহরে পৌঁছলাম। কাবুল শহরে পৌছবার পূর্বে ইয়াকুবের সংগে কথা হল, যদি আমি কান্দাহারে মোটরে করে যাই তবে সেও যাবে এবং উভয়ে একত্রে থাকবার জন্য সাধ্যমত চেষ্টা করব। কিন্তু কাবুলে পৌঁছেই ইয়াকুব অন্যত্র চলে গেলে, কারণ তার গতিবিধি পুলিশ পছন্দ করছিল না। ইয়াকুবও ছিল নাছোড়বান্দা ছেলে, কান্দাহারে আবার সে আমার সংগে হিরাত যাবে বলে মিলিত হয়েছিল। সে সব কথা পরে হবে।