আফগানিস্থান ভ্রমণ/বোখারার বিশেষ ঘটনা
বোখারার বিশেষ ঘটনা
উত্তর-পশ্চিম দিক হতে প্রবল বায়ু বইছিল। তুষারপাতের খুবই সম্ভাবনা, তা সত্ত্বেও একটি যুবক বোখারার বিপরীত দিকে একরূপ দৌড়েই যাচ্ছিল। যুবক গন্তব্যস্থানে পৌঁছবার পূর্বেই তুষারপাত শুরু হ’ল। তুষারপাতে সে অভ্যস্ত বলেই এই দুর্যোগেও চলতে তার কষ্ট হয় নি। সে চিন্তা করছিল তার স্ত্রীর কথা। তার স্ত্রীর অভুক্ত মুখ যখনই মনে পড়ছিল, তখনই তার শরীরের রক্ত গরম হয়ে উঠতেছিল। কিন্তু বেশীক্ষণ সে এভাবে চলতে পারল না, হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে স্তুপাকৃতি বরফের উপর পড়ে গেল। যুবকের নাম মামুদ।
ওদিকে রুশ দেশের সীমান্তরক্ষীরা যুবককে দূরবীনের সাহায্যে লক্ষ্য করছিল। যুবককে পড়ে যেতে দেখে একজন সীমান্তরক্ষী দৌড়ে এসে তার মুখে ওয়াকী (রুশ দেশীয় মদ) ঢেলে দিল এবং হাতে দিল কতকটা কন্যুক (রুশ দেশীয় কড়া মদ) ঘসে। যুবকের জ্ঞান হ’ল; কিন্তু জ্ঞান হওয়ার পর যখন সে বুঝল যে তাকে মদ খাইয়ে রুশরা বাঁচিয়েছে, তখন রুশদের গালিগালাজ করল। বলল, “মদ খেয়ে জীবন লাভ করার চেয়ে মরাই তার পক্ষে ভাল ছিল।” ‘আল্লার’ কাছে এই ‘হারাম’ খাওয়ার জন্যে কি জবাব সে দেবে? কিন্তু সংগে সংগে যেই তার অভুক্ত স্ত্রীর কথা মনে হ’ল, অমনি তার জীবনদানের জন্য রুশীয় রক্ষীদের সে ধন্যবাদ জানাল এবং তাদের করমর্দন করে নিকটস্থ একটা কাফেতে গিয়ে প্রবেশ করল। যুবক তিনদিন অভুক্ত ছিল। অভুক্ত অবস্থায়ও পথ চলেছিল। অভুক্ত পাকস্থলীতে সামান্য মদ পড়াতেই তার নেশা হয়েছিল এবং নিকটস্থ চায়ের দোকানে প্রবেশ করে সামান্য গরম পাওয়াতে মাথায় রক্ত চড়েছিল। মাথায় রক্ত চড়াতে যুবকের জ্ঞান লোপ হয়। যারা চায়ের দোকানে বিশ্রাম করছিল তারা যুবকের সাহায্যার্থে আসে এবং যখন টের পেল যুবকের মুখ থেকে মদের গন্ধ বেরিয়ে আসছে, তখনই তারা সরে দাঁড়াল। মাতালকে সাহায্য করা আর নরক-যাত্রার পথ পরিষ্কার করা একই কথা। সুতরাং কেউ তার কাছে থাকল না। পুলিশ ডাকা হ’ল। পুলিশ তাকে বেশ দু’ ঘা লাগিয়ে তার অজ্ঞান দেহটাকেই হাজতে নিয়ে পুরে রাখল। একটা সংজ্ঞাহীন লোককে এভাবে হাজতে নিয়ে যেতে দেখেও কেউ কোন প্রতিবাদ করল না।
রাত্রেই মামুদের জ্ঞান হ’ল, কিন্তু তার শরীরে শক্তি ছিল না। ভেজা মেজেতে শুয়ে থাকল। সে ভাবছিল, কেন আমিনাকে সে বিয়ে করেছিল? আমিনা নির্দোষ বালিকা। তারই জন্য সে তার শিয়া পিতার গৃহ পরিত্যাগ করে একজন সুন্নি যুবককে বিয়ে করেছিল। যদি তাদের বিয়ে না হ’ত, তবে আমিনাকে তার পিতা পরিত্যাগ করতেন না, আমিনাও না খেতে পেয়ে আজ মৃত্যুর সম্মুখীন হ’ত না। রাত চারটার সময় মামুদ উঠে বসল। সে আল্লার দরগায় প্রার্থনা করল। প্রার্থনায় বলল, “হে আল্লা, আমি কোন পাপ করি নি, আমাকে বাঁচাও, আমার আমিনাকে রক্ষা কর।”
পরের দিন সকালে মামুদকে কাজির এজলাসে হাজির করা হ’ল। চায়ের দোকানের মালিক সাক্ষ্যে বলল, “মামুদ মাতাল অবস্থায় চায়ের দোকানে প্রবেশ করার পরই জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। আমরা তাকে সাহায্য করতে গিয়েছিলাম। কিন্তু তার মুখে মদের গন্ধ ছিল; সেজন্য পুলিশে সংবাদ দেওয়া ছাড়া গত্যন্তর ছিল না। হারামখেকোকে স্পর্শ করে কে নরকের পথ প্রশস্ত করবে বলুন, খোদাবন্দ (ধর্মাবতার)?”
সাবাস্ সাবাস্ উচ্চ নিনাদ হ’ল।
কাজি একরূপ চোখ বুজেই মামুদকে দু’মাসের সশ্রম কারাবাসের আদেশ দিলেন।
মামুকে জেলে নেওয়া হ’ল। কাজি ভাবলেন—আপদ বিদায় হ’ল, যেরূপ শীত পড়েছে তাতে আরও একটু হারাম না খেলে শরীর রক্ষা করা যাবে না। তাড়াতাড়ি করে কাজি গৃহে ফেরলেন এবং এক মাস আরক খেয়ে গোঁফে তা দিয়ে বললেন, কি আরাম!
গরীব লোকের কাছে আরকের অপর নাম সরাব এবং ধনী লোক যখন সরাব গলাধঃকরণ করেন, তখন তার নাম হয় আরক। মামুদ যদি সেই সংবাদটি রাখত, তবে তার এই বিপদ হ’ত না।
মামুদ এবং আমিনা একই গ্রামের বাসিন্দা। গ্রামের লোক দুই শ্রেণীতে বিভক্ত-মোগল এবং পাঠান। পাঠান সংখ্যায় কম, আর মোগল সংখ্যায় বেশী। মোগল শিয়া, পাঠান সুন্নি। উভয় শ্রেণীর লোকই দরিদ্র কিন্তু তা বলে কিছুই আসে-যায় না। মোগলের মেয়েকে বিয়ে করে ঘরে আনা পাঠানরা কখনই বরদাস্ত করত না। মোগল মিশ্রজাত, আর পাঠান আর্য এবং সম্মানিত। মোগল কৃষক, পাঠান ব্যবসায়ী। মোগল রাজত্ব করেছিল, পাঠান পরাজিত হয়েছিল। যুগযুগান্তের ইতিহাস পাঠান ভুলে নি, মোগল ভুলে গিয়েছিল। গ্রামে মোগলরা এক পাড়াতে বাস করত এবং অন্য পাড়াতে বাস করত পাঠান। মধ্যস্থলে একটি ছোট্ট নালা। একেবেঁকে কোনও মরুভূমিতে মিশে গিয়েছিল। এই নালাটি উপলক্ষ্য করে কত নরহত্যা হয়েছিল তার ইয়ত্তা নেই। কত কারবালা গড়ে উঠেছিল। এই নালার তীরে তার স্থিরতা ছিল না, কিন্তু মোগল শাসনকর্তা এ-সব পছন্দ করতেন না বলেই কারবালার সৃষ্টি হয় নি।
পাঠানের মেয়েরা পর্দানশীল, মোগলের মেয়ের স্বাধীন। তারা মাঠে-ঘাটে বেড়ায়। আমিনাও বেড়াত, লোকের সংগে কথা বলত, অনুর্বর জমিতে যে সকল তৃণলতা শুকিয়ে থাকত, কুড়িয়ে নিয়ে আসত। সময়মত আরবী এবং পারসী পদ্য মুখস্থ করত। তারপর একদিন আমিনা আরবী ভাষা শিক্ষা করার জন্য মৌলবী সাহেবের কাছে উপস্থিত হল। বর্ণ-পরিচয় হওয়ার পর মৌলবী সাহেব আমিনাকে আরবী ভাষায় কয়েকটি শব্দ লিখে দিলেন মুখস্থ করার জন্য। আমিনা আরবী ভাষা শিখবে না জানিয়ে দিয়ে মৌলবীকে বললে “আমি যে সকল অক্ষর শিখেছি তা দিয়ে কি মাতৃ-ভাষার কথা লেখা যায় না?
মৌলবী সাহেব তা অবাক হলেন, কেন সে মাতৃ-ভাষা শিখবে, সেই প্রশ্নটাই উঠল বড় হয়ে। অবশেষে মৌলবী সাহেব বললেন “আরবী শব্দ না শিখলে মরবার পর যখন পাপ পুণ্যের বিচার হবে তখন কোন্ ভাষায় আল্লার সংগে কথা বলবে?”
মৌলবীর কথা ধ্রুব সত্য গণ্য করে আমিনা আরবী শিক্ষায় মন সন্নিবেশ করল, কিন্তু মাতৃ-ভাষার প্রতি তার যে দরদ ছিল, সে দরদ একটুও না কমে ক্রমেই বেড়ে চলল। আমিনা মেধাবী মেয়ে, কয়েক মাসের মধ্যেই কোরান কণ্ঠস্থ করে ফেলল। কোরান পর্যন্তই মেয়েদের পড়বার অধিকার ছিল। মৌলবী সাহেব মেয়ের প্রতিভা দেখে ভীত হলেন এবং তাড়াতাড়ি তাকে মাদ্রাসা হতে বিদায় দিলেন।
ঘরে বসে আমিনা আরবী অক্ষরের সাহায্যেই মাতৃ-ভাষাতে চিঠি লিখতে আরম্ভ করল। মামুদ ছিল পাশের বাড়িতে দরজি। আমিনা দরজিদের চরিত্র বর্ণনা করে পদ্য লিখল। যে সকল দোষ আরোপ করে যুবক দরজিদের বিরুদ্ধে পদ্য লিখেছিল সেই দোষ হতে তখনও মামুদ বহু দূরে ছিল, কিন্তু দোষটির স্বরূপ সে জানত এবং সেই দোষে যদি দোষী হতে হয়। সেজন্যও প্রস্তুত ছিল। আমিনার মত একগুঁয়ে সে ছিল না। মোগল-প্রকৃতি তার ছিল না, ছিল পাঠানপ্রকৃতি। সব কিছু হতে উত্তীর্ণ হওয়াই হল পাঠানদের অভ্যাস। পাঠান সহনশীল, মোগল বিদ্রোহী। কিছুই সহ্য করতে রাজি নয়।
আমিনার সংগে মুরাদের পত্রালাপ আরম্ভ হল। সময় কেটে কেটে যাচ্ছিল। আমিনার মনে কি এক বিদ্রোহ ভাব জেগে উঠল। সে সামাজিক নিয়ম মানতে পারছিল না। পাড়ার লোক অস্থির হয়ে উঠছিল। বিয়ের পাত্র পাওয়া যাচ্ছিল না, এমন দুর্দান্ত মেয়েকে কে বিয়ে করবে? আমিনার বাবা এক দিন রাগ করে বলছিলেন, আমিনা যদি সমাজ-দ্রোহী কাজ করে তবে তাকে সুন্নিদের কাছেই বিয়ে দেওয়া হবে। সুন্নিরা সিয়ার কাছে বিধর্মী। বিধর্মীর কাছে বিয়ে হওয়া নরকবাসের তুল্য। আমিনা পিতার কাছ থেকে কঠোর শাস্তির কথা শুনল এবং ভাবল, নরকবাসটা কি রকম দেখাই যাবে এবং সময় ক্ষেপণ না করে দরিদ্র দরজি মামুদের কাছে সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব করে। আমিনার প্রস্তাবে মামুদ অবাক হয় এবং চিন্তিত হয়ে বলে, বিয়েত যা’ তা’ কথা নয়, একটু সময় দাও। উভয় সমাজই আমাদের পরিত্যাগ করবে, সামান্য দরজির কাজ থেকেও বরখাস্ত হব, তখন কি করে আত্মরক্ষা করব, সে কথা চিন্তা করা চাই।
চিন্তায় চিন্তায় কয়েক সপ্তাহ কাটল। অবশেষে ঠিক হল সহরের বাইরে পরিত্যক্ত পুরাতন প্রতিমা মন্দিরে স্থান নিলেই গ্রাম্য সামাজিক অত্যাচার হতে রক্ষা পাওয়া যাবে। পূর্বকালের অনেক পরিত্যক্ত বাড়ি গ্রামের পাশে ছিল, সেই বাড়িগুলিকে ভূতের বাড়ি বলেই অনেকে নির্দেশ করত। ভূতের বাড়িতে থাকাও কম সাহসের কাজ নয়। তবুও আমিনা নিজের বাড়ি পরিত্যাগ করে ভূতের বাড়িতে মামুদের সংগে থাকতে রাজি হল। আমিনার এবং মামুদের বিয়ে বিনা পুরোহিতেই সমাপ্ত হয় এবং উভয়ে ভূতের বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে সুখে থাকতে আরম্ভ করে।
সুখ বেশি দিনের জন্য স্থায়ী হয় না। মামুদ এবং আমিনা যে সামান্য অর্থ নিয়ে বাড়ি হতে বেরিয়েছিল সেই অর্থ শেষ হল। ঘরে যে দিন একটি যবও ছিল না, সেদিন খাদ্য অন্বেষণে মামুদ ভূতের বাড়ি হতে বের হবার সময় আমিনাকে বলে গিয়েছিল, “ভয় করোনা আমিনা, শীঘ্রই রুটি নিয়ে ফিরে আসিব।”
মামুদ চলে গেলে আমিনা মনে মনে ঈশ্বরের কাছে স্বামীর প্রত্যাবর্তনের জন্যে প্রার্থনা করছিল। কিন্তু আমিনার প্রার্থনা ঈশ্বরের কানে পৌঁছল না। সাইবেরিয়ার নেকড়ের পাল তুষারপাতের সংগে সংগেই শহরে অত্যাচার শুরু করেছিল। মেষ, কুকুর, ঘোড়া, গর্দভ, মানুষ যা’ সামনে পেল তাই খেয়েই ক্ষুধার নিবৃত্তি করতেছিল।
আমিনার দরজা সাধারণ ওক কাঠের। একটি নেকড়ে লাফ দিয়ে দরজাতে পড়তেই দরজাটি চুরমার হয়ে গেল। আমিনাও নেকড়ের উদারস্থ হল, পড়ে রইল শুধু তার ক’খানা হাড়, আর তারই পাশে পড়ে রইল ছিন্ন কোরান।
ক্রমে তুষারপাত শেষ হল। গাছপালা সজীব ও সতেজ হয়ে উঠল, প্রান্তর প্লাবিত করে সূর্যকিরণ ঝলমল করে উঠল। কিন্তু দেখা গেল, পথে ঘাটে মাঠে ছড়িয়ে আছে মানুষের আর নানা জীবজন্তুর হাড়। সুর্যকিরণে হাড়গুলি চকচক করছিল; একদিন যে এই হাড়গুলিতে প্রাণের স্পন্দন ছিল, উজ্জ্বল সূর্যকিরণমালা যেন তারই আভাস প্রদান করছিল।
যে সকল লোক অভুক্ত, রোগজীর্ণ, গৃহহীন তারাই ছিল বাইরে। তারাই হয় বরফে জমে মরেছিল নয় নেকড়ের উদরস্থ হয়েছিল। তাদেরই হাড় পড়ে রয়েছিল। এদের স্বর্গবাসের ব্যবস্থার জন্য মোল্লার দল বের হয়েছিল। যাকে যেখানে পেয়েছিল সেখানেই কবর দিয়েছিল। কেউ বললে, মৃত ব্যক্তিরা ছিল কামনার দাস; তাদের কামনা শেষ হয়েছে সেজন্যই এরা মরেছিল।
মুক্ত দরজা দিয়ে আলো এসে আমিনার হাড়ের উপর ঠিকরে পড়ছিল—হাড়গুলি উজ্জ্বল সুর্যকিরণে হাসছিল। মোল্লারা যখন আমিনার ঘরের কাছ দিয়ে যাচ্ছিল তখন আমিনার হাড় উপহাস করে যেন বলছিল, আর তোমাদের সাহায্যের দরকার নেই, আশার নিবৃত্তি এবার হয়েছে। মোল্লার দল ইতস্তত করছিল। আমিনাকে কবর দেবে কি না। একজন বলছিল “হাজার হোক ইসলাম ত ছিল, কবর দেওয়াই দরকার।”
ঘরে প্রবেশ করে মোল্লারা দেখলে ছিন্ন কোরানের পাতাগুলি বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পড়ে আছে, তখন আর তাদের সাহস হল না আমিনাকে কবর দিতে। পবিত্র গ্রন্থের অবমাননা যে করে, তার আবার করব কি! জাহান্নামই তার উপযুক্ত ঠাঁই। কোরানের ছেঁড়া পাতাগুলি মোল্লারা নতজানু হয়ে কুড়িয়ে নিয়ে গেল, আমিনার হাড়গুলি যেভাবে ঘরের মেঝেতে পড়ে ছিল তেমনি ভাবেই পড়ে রইল।
এদিকে জলে সিক্ত মেজের ওপর মামুদ পড়ে রয়েছিল। ঘণ্টা কয়েক পর মামুদের জ্ঞান হয়। আইন অনুযায়ী মামুদ কয়েকখানা রুটি খাবার অধিকার পেয়েছিল। তাকে রুটি দেওয়া হয়েছিল তারপর নিয়ে যাওয়া হয় কাজির কাছে। কাজির বিচারে মাতালের ছয় মাস সশ্রম কারাদণ্ড হয়। মামুদকে পুনরায় জেলে পাঠানো হল। মামুদ জেলে ঢুকে আমিনার কথাই চিন্তা করছিল। আমিনা আজ কোথায় এবং সেই বা কোথায়?
মামুদকে কাজের আদেশ দেওয়া হল। হুজুরের আদেশ মত ‘হা হুজুর’ বলে কাজে গেল। কতক্ষণ পর জেল দারোগা কি মনে করে মামুদকে পুনরায় ডাকল এবং মামুদকে চুপি চুপি কি বলে ফের কাজে পাঠিয়ে দিল।
সে কাজ করছিল মন দিয়ে, এমন সময় একটি সুন্দর যুবক জিজ্ঞাসা করল, “মামুদ, দারোগা তোকে কেন ডেকে নিয়ে গিয়েছিল রে?”
মামুদ মাথা নত রেখেই বললে, “তোমাদের ওপর নজর রাখবার জন্য আমার প্রতি আদেশ হয়েছে।”
—তুই কেমন করে নজর রাখবি বলতে পারিস?
—সে কথাতো দারোগা বলে নি!
এর বেশি আর কথা হল না। কিন্তু মামুদ বুঝলে, এই শিক্ষিত লোকগুলিকে দারোগা ভয় করে। সে জানত সুলতানকে আল্লা পাঠিয়েছেন পৃথিবীতে আইন বজায় রাখতে। তাঁকে যাঁরা সাহায্য করে তারাও খোদার বিশেষ প্রিয়পাত্র। যারা আল্লার ভক্ত তারা কেন এসব শিক্ষিত লোককে ভয় করে, তার কারণ মামুদ নিজের মনের মাঝেই খুঁজছিল কিন্তু উত্তর পাচ্ছিল না।
মেডিকেল কলেজের আবদ্ধ ছাত্ররা মামুদকে প্রায়ই নানারূপ প্রশ্ন করত, কিন্তু মামুদ কিছুই বলত না। একদিন কিন্তু তাকে মুখ খুলতে হয়েছিল। সে তার অন্তরের সঞ্চিত সকল কথা শিক্ষিত ছাত্রদের বলেছিল। মামুদের সকল কথা শোনার পর ছাত্রেরা তাকে বুঝিয়ে দেয়, এটা সামাজিক অত্যাচার, এই অত্যাচার হতে রক্ষা পেতে হলে সমাজের আমূল পরিবর্তন করতে হবে। মামুদ কখনও মনে করে নি, সন্মানিত পরিবারের কোন লোক তার প্রতি এত সহানুভূতি দেখাবে। সামান্য সহানুভূতি পেয়েই মামুদ অনেকটা শান্ত হয়েছিল। সন্মানিত লোকের কাছ থেকে সে কেন, তার বংশের কেহই সেরূপ সহানুভূতি পায় নি। বড় লোকের সংগে দরজির ছেলের কি সম্বন্ধ হতে পারে? শুক্রবারে নামাজের সময় মাত্র বড় লোকের সংগে নামাজ পড়তে দেখতে পায়, এর বেশি নয়।
মামুদের মন ক্রমেই ছাত্রদের প্রতি আকৃষ্ট হতেছিল। সে কোরানের বয়েত ভাল করেই জানত, এবার সে অক্ষর পরিচয়ে মন দিল। চতুর লোক নিরক্ষরকে অক্ষর শিক্ষা দিতে সত্বরই সক্ষম হয়। মামুদ অক্ষর শিখে বই পাঠে মন দিল। যে সকল বই সে পড়তেছিল সেগুলি অন্য ধরনের।
দুই মাস কারা জীবন কাটিয়ে মামুদ চলল তার আমিনার সংবাদ নিতে। পায়ে হাঁটা পথে মামুদের সাত দিন লেগেছিল বোখারায় পৌঁছতে। বোখারা পুনরায় বরফে ঢাকা পড়েছে। পথের দুদিকে জীব-জন্তুর কংকাল পড়ে ছিল। মামুদ আমিনার কথা যখনই ভাবছিল, তখনই অমঙ্গলের চিন্তা তাকে দমিয়ে দিচ্ছিল। অতিকষ্টে যখন সে আমিনার ঘরে পৌঁছিল, তখন দেখল ঘরের মেঝেতে কংকাল পড়ে আছে। আমিনার পায়ের জুতার একপাটি জুতা একদিকে এবং অন্যপাটি আরেক দিকে নিক্ষিপ্ত হয়েছিল। দু’খানা জুতাকেই সে হাতে নিয়ে দেখল তাতে রক্তের চাপ গাঢ় হয়ে রয়েছে। মামুদের কঠিন হাতের মুঠোর চাপে সেই জুতা থেকে জমাট বাধা কঠিন রক্তের টুকরোগুলি গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে মাটিতে ঝরে পড়ল। আমিনার যেটুকু অবশিষ্ট ছিল তাও গেল। মামুদ বুঝল তার আমিনা আর নেই। সমাজ-পরিত্যক্ত আমিনা ক্ষুধায় মরে নি, নেকড়ে বাঘে তাকে খেয়েছে। যদি সমাজ তাকে পরিত্যাগ না করত তবে আমিনা মরত না। বেঁচেই থাকত। আমিনার অপমৃত্যু হয়েছে। মামুদ আমিনার হাড়গুলি জড় করে মাটি খুঁড়ে কবর দিল। শহর হতে একখানা কাঠ সংগ্রহ করে তার উপর লিখল, আমিনার মৃত্যু হয়েছে সমাজের অত্যাচারে। তারপর মামুদ সেই কাঠটি আমিনার কবরের উপর স্থাপন করে মুখ ফিরিয়ে রওয়ানা দিল রুশ সীমান্তের দিকে। শরীর তার অত্যন্ত দুর্বল, এবার রুশ সীমান্তে পৌঁছতে পুরো সাতদিন লাগল। সেখানে পৌঁছে আর সে বৃথা সময় নষ্ট করল না, সরাসরি রুশ দেশে প্রবেশ করে, মজুর দলে ভিড়ে পড়ল, কাজে মন দিল। খাদ্যের অভাবে যে শরীর ভেংগে পড়ছিল, সেই শরীর নতুন করে গড়ে তুলল। মামুদের মনে জাগল বোখারার সমাজের দোষ-ত্রুটি, কুসংস্কার সুধরাবার আকাংখা। এক দিকে কাজ এবং কমিউনিজমের পাঠ মামুদ একই সংগে চালাল।
দু’ বৎসর রুশ দেশে থেকে মামুদ দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করল, যতদিন মজুর এবং কৃষকের দাবি পূরণ না হবে, যতদিন বোখারাকে সে সোসিয়েলিস্ট স্টেটে পরিণত করতে না পারবে, ততদিন সে রুশ দেশে যাবে না। তারই মত অক্লান্ত কর্মীদের সহায়তায় মামুদ সমাজ-বিপ্লবের প্রবর্তন করল এবং তাতে কৃতকার্য হয়ে আমিনার মত শত সহস্র রমণীকে হারেম হতে মুক্ত করল। বোখারা দেশ রুশ সভার (সভিয়েটের) অন্তর্ভুক্ত হল।
কিন্তু মামুদ এবং তার সহকর্মীদের মনে শান্তি ছিল না। কাজ করার সংগে সংগে কুটনৈতিক সাম্রাজ্যবাদীদের আসন্ন চক্রান্তের ভয়ও তাদের মনে জাগরূক হচ্ছিল।
এদিকে আর এক ঘটনা ঘটবার সময় এসেছিল। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা অনোয়ার পাশাকে বোখার স্টেট আক্রমণে তৈরী করেছিল। গেল ইস্লাম, গেল তুরুক জাত এই বুলি প্রচারিত হচ্ছিল। বোখারা স্টেটের ভেতরে যারা ইসলাম ছাড়া আর কিছু বুঝত না তারা আনোয়ার পাশাকে সাহায্য করতে আশ্বাস দিয়েছিল। বাহির হতে আনোয়ার পাশা সৈন্য নিয়ে বোখারা স্টেটের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। ফল কিন্তু ভাল হয় নি। পেছন দিক থেকে মামুদের মত দেশপ্রেমিক, মানুষ হিতৈষী, মরণ বিজয়ী যুবকেরা আনোয়ার পাশাকে আক্রমণ করেন এবং সেখানেই প্রতিক্রিয়াশীলদের দুষ্কর্মের যবনিকা পাত হয়।
গল্পটি যদিও ছোট এবং এর ঐতিহাসিক নিশ্চয়তা কতটুকু বিবেচ্য বিষয় তবুও এতে আমার মন আকৃষ্ট হয়েছিল। তারপরই সে বললে, “আমরা হিন্দুদের ভয়ানক ভয় করি। হিন্দুরা কখনও কোন বিদ্রোহে যোগ দেয় না। যখনই যে দল জয়ী হয়েছে তারা সেই দলেরই মন যুগিয়ে চলেছে। এদের নিজেদের কোন স্বাধীন সত্তা নেই। এরা নিরীহ রাজভক্ত প্রজা। বর্তমানে “সরকতে আসাম” অর্থাৎ কাবুল বেঙ্কের অর্ধেক অংশ হিন্দুদের, বাকি অর্ধেক রাজ পরিবারের। প্রকৃত পক্ষে রাজপরিবারের সংগে হিন্দুদের অর্থনীতির দিক দিয়ে বিশেষ সম্বন্ধ রয়েছে।
ছেলেটিকে হঠাৎ একজন বয়স্ক যুবক বাধা দিয়ে বললে, এসব বাজে কথা রেখে দাও হে, এখন আমরা আরও গল্প শুনিব, শুধু হিন্দু আর রাজপরিবারের কথা শুনে কাজে নেই। দুনিয়ার অনেক কিছু জানবার রয়েছে। আমি বাধা দিয়ে বললাম “একে বলতে দিন, বাধা দিচ্ছেন কেন।” ছেলেটি বললে, “আপনাকে কি আর বলব আমাদের অবস্থা কাহিল হয়ে গেছে।”
আরও অনেক কথা হয়েছিল, কিন্তু এখানে তা বাড়িয়ে লাভ নেই।