আফগানিস্থান ভ্রমণ/কাবুলের পথে

কাবুলের পথে

 আমাদের দেশের উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত আফগানিস্থান। আফগানিস্থানের বাসিন্দাকে আমরা কাবুলি বলি এবং কাবুলিদের আমাদের দেশে মহাজনী কারবার করতেই দেখতে পাই। এরা আমাদের দেশে আসা-যাওয়া করে। আমরা কিন্তু ওদের দেশে অতি অল্পই গিয়ে থাকি। আমার ধারণা ছিল, ভারতের যে সকল লোক মুসলমান ধর্ম মেনে চলেন তাঁরা তাঁদের স্বধর্মাবলম্বীদের অধ্যুষিত দেশগুলিতে আসা-যাওয়া করেন; কিন্তু আফগানিস্থান, ইরান, আরব, সিরিয়া, লাবানন এবং তুর্কি ভ্রমণ করে দেখলাম, আমার এ ধারণা ঠিক নয়। আমাদের দেশের লোক ওদের দেশে কমই যায়। না যাবার কারণ হ’ল, পাসপোর্ট যোগাড় করতে খুব বেগ পেতে হয়। দ্বিতীয় কারণ হ’ল, আফগানিস্থান সম্বন্ধে অনেকগুলি ভীতিপ্রদ গল্প আমরা ছোটবেলা হতে শুনে এসেছি। আমরা সেই গল্পগুলিকে সত্য বলেই মনে করি, সেজন্যও অনেকে আফগানিস্থানে যেতে চান না। লাহোর, রাওলপিণ্ডি এবং পেশোয়ারে সেরূপ গল্প আমাকেও শুনানো হয়েছিল, কিন্তু আমি তাতে কান দিইনি। তারপর যখন আফগানিস্থানে গেলাম, তখন দেখলাম কাবুলিরাও আমাদের মতই মানুষ, এবং তাদের দেশটাও আমাদের দেশের মতই ‘মাটির’।

 চীন, জাপান, কোরিয়া, থাইলেণ্ড, ইন্দোচীন এবং মালয় দেশ ভ্রমণ করে যখন কলিকাতায় এলাম, তখন সংবাদপত্রের রিপোর্টারদের জানিয়েছিলাম যে আফগানিস্থান হয়ে ইউরোপ যাবার ইচ্ছা আমার আছে। ভাবিনি এতে আমার কোন ক্ষতি হবে। কথাটা প্রচার হওয়া মাত্রই জনকতক অজ্ঞাতকুলশীল ব্যক্তি আমার পাসপোর্ট দেখতে আগ্রহ প্রকাশ করেন। বিনা দ্বিধায় তাদের কৌতূহল চরিতার্থ করেছিলাম। পাসপোর্ট নিয়েছিলাম সিংগাপুর থেকে। ভুলবশত তাতে আফগানিস্থান শব্দটি লেখাইনি। যারা হিতৈষী সেজে আমার পাসপোর্ট দেখেছিলেন, তারা পাসপোর্টের এই ত্রুটি সম্বন্ধে সম্পূর্ণই নীরব ছিলেন। এমন কি দিল্লীর আফগান-কনসালও এ বিষয়ে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ না করে আফগানিস্থান যাবার ‘ভিসা’ দিয়েছিলেন।

 কলিকাতা হতে পেশোয়ারের পথে কোন দুর্ঘটনা ঘটেনি, শুধু গুজরাত শহরে একদিন সাইকেল থেকে পড়ে গিয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। জ্ঞান হ’লে বুঝেছিলাম শরীরের দুর্বলতাই এই পতনের একমাত্র কারণ। রোড-পুলিশ দয়া করে আমাকে উঠিয়ে পাশেই আর্যসমাজীদের পরিচালিত একটি মেয়েদের স্কুলে বহন করে নিয়ে গিয়েছিল। আশ্চর্যের বিষয়, মাতৃজাতির একজনও এই হতভাগ্যের চৈতন্য সম্পাদনের জন্য অগ্রসর হন নি। এমন দুর্ঘটনা যদি ইউরোপের কোথাও ঘটত, তবে মায়ের জাতই সর্বপ্রথম আমার সাহায্যার্থ এগিয়ে আসতেন।

 গুজরাতের ঘোল খেয়ে কয়েকদিনের মধ্যেই চাংগা হয়ে উঠলাম। এবার পেশোয়ারের দিকে রওনা হলাম এবং নির্বিঘ্নেই পেশোয়ার শহরে পা দেবার পরই কতকগুলি অতিরিক্ত-কৌতূহলী লোক আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে নানারূপ প্রশ্ন করতে থাকে। ওদের হাত হতে নিজকে বাঁচিয়ে নিকটস্থ একটা ধর্মশালায় উঠলাম। ধর্মশালার একটি রুম দখল করে একখানা চারপাই-এর উপর শ্রান্ত দেহটাকে এলিয়ে দিয়ে ভাবছিলাম “এ আবার কি?”

 বিকেলে ধর্মশালা হতে বেরুতে যাব এমন সময় দাশগুপ্ত নামে এক যুবকের সংগে দেখা হ’ল। পায়ে হেঁটে সে ভারত-ভ্রমণ করছিল। আলাপপরিচয় হবার পর আমাকে নিয়ে সে স্থানীয় কালীবাড়ীর দিকে রওনা হ’ল। কালীবাড়ী ধর্মস্থান বলে শুধু ধার্মিকেরাই যে সেখানে যাওয়া-আসা করে থাকেন, ধূর্ত পুলিশ কখনই তা মনে করে না। চোর ডাকাত ভিন্নও

বিদেশী সরকারের চক্ষে আর এক শ্রেণীর লোক যারা দেশভক্ত বলে বিশেষভাবে পরিচিত, তারাও যে কালীমাতার শরণাগত হন পুলিশ তা জানত; সেজন্য দেবালয়ে আশ্রয় নিতে কুণ্ঠিত হতাম, তা ছাড়া আমার মত দেবভক্তিহীনের পক্ষে দেবতার মন্দিরে আশ্রয় লওয়াটা অসঙ্গত বলেই মনে করতাম। কালীবাড়ীতে পৌঁছামাত্রই পূজারী ঠাকুর ভিজে-বেড়ালটির মত কাছে এসে জিজ্ঞাসা করলেন, “আপনি কবে আফগানিস্থানে যাবেন?” ভাবখানা যেন তিনি আমাকে বেশ ভাল করেই চেনেন।

 লোকটার কথার কোন জবাব দিতেও আমার প্রবৃত্তি হচ্ছিল না। তবুও ভদ্রতার খাতিরে বললাম, রওনা হ’লেই হ’ল আর কি। কাছে উপবিষ্ট একটা মোটা লোক বললে, অনেকেই বলে বটে আফগানিস্থানে যাবে, কিন্তু আসলে কেউ যায় না, যাবার ক্ষমতাও রাখে না।

 এদের কোন কথার জবাব না দিয়ে দাশগুপ্তকে নিয়ে বরাবর সিনেমা ঘরের দিকে চলে গেলাম। এ-সব প্রশ্ন বড় দুর্লক্ষণ বলে মনে হ’ল। মনে বড়ই ভয় হচ্ছিল, বোধ হয় আমার অগ্রগতির পথে কোন বাধাবিঘ্ন হতে পারে। চিন্তা করে ঠিক করলাম পরদিন সকালেই স্থানীয় আফগান-কন্‌সালের সংগে সাক্ষাৎ করব এবং তাঁর কাছ হতেই জানতে পারব আমার পাসপোর্টে কোন ত্রুটি আছে কিনা?

 পরদিন সকালেই আফগান-কন্‌সালের বাড়ী গেলাম। পাসপোর্ট দেখেই কন্‌সাল অফিসের একজন যুবক-কেরানী বললেন, আপনি আফগানিস্থানের দিকে রওনা হয়ে ভালই করেছেন। কি করে যে দিল্লীর কন্‌সাল-জেনারেল আপনার পাসপোর্টে ভিসা দিয়ে দিলেন, তা মোটেই বুঝতে পারছি না। যা হোক, এখন আপনি এখানকার সেক্রেটারিয়েটে গিয়ে পাসপোর্টে “আফগানিস্থান” শব্দটি লিখিয়ে নিয়ে আসুন, তবেই সকল হাংগামা হতে রক্ষা পাবেন।

 যুবকের কথামত সেক্রেটারিয়েটে গেলাম এবং একজন হিন্দু কেরানীর সংগে সাক্ষাৎ করলাম। কেরানী বেশ আরাম করে বসে ছিলেন। আমাকে দেখামাত্রই তাঁর যেন মেজাজ বদলে গেল। মেয়েলি সুরে জিজ্ঞাসা করলেন, “কি চাই আপনার? আপনার জন্য আমি কি করতে পারি? বলুন, বলুন, আমার যে মরবারও ফুরসৎ নেই।” তার মুরুব্বিয়ানায় আমি একটু হেসে বললাম, এই আমার পাসপোর্ট, এতে আফগানিস্থান শব্দটি লিখিয়ে নিতে চাই।

 আমার কথা শোনামাত্রই কেরানী চোখ দুটো কপালে তুলে বললেন, “এটা কি করে হয়? এ কখনও হতে পারে না।”

 আমি বললাম, একটু বসতে চাই, আপত্তি নেই তো?

 কেরানী সামনের চেয়ারটা আমার দিকে এগিয়ে দিলেন। আমি বসলাম এবং চশমা খুলে নিজের হাতের রেখাগুলোর দিকে নিবিষ্টমনে তাকিয়ে রইলাম, যেন আমি হস্তরেখা-বিদ্যায় খুব ওস্তাদ। কেরানীও বেশীক্ষণ আর স্থির থাকতে পারলেন না, আমাকে সাগ্রহে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার হাতে কি দেখলেন? আমি মাথা ঝাঁকিয়ে গাম্ভীর্যের ভান করে বললাম, “দেখতে পাচ্ছি তিন দিনের মধ্যে আমি আফগানিস্থান পৌঁছব, তাতে আমাকে কেউ বাধা দিতে পারবে না।” আমার কথা শুনে কেরানীও তাঁর ডানহাতটা বাড়িয়ে দিয়ে নিজের ভাগ্যের কথা আমার কাছ থেকে জানতে চাইলেন। তাঁর হাত দেখে অনুমানের উপর নির্ভর করে যা বলেছিলাম, তাতেই তিনি খুশী হয়েছিলেন।

 আবার আমি তাঁর কাছে আমার কাজের কথা পাড়লাম। এবার কেরানী অনেকটা সদয়চিত্ত হয়েছেন এবং পরদিন সকালে দেখা করতে বললেন।

 হিন্দু কেরানীর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফেরার পথে দেখা হ’ল একটি মুসলমান কেরানীর সংগে। তিনি ডেকে নিয়ে আমাকে তাঁর রুমে বসালেন এবং বললেন, যে কাজের জন্যে আমি এতক্ষণ কথা বলছিলাম, সে কাজটি তাঁরই কাজ, অন্য কারও নয়। এই বলেই তিনি বললেন, দিন তো পাসপোর্ট, এখনই কাজটা সেরে দিচ্ছি। যুবক আমার হাত থেকে পাসপোর্ট নিয়ে তাতে আফগানিস্থান শব্দ লিখে দিলেন। তারপর বললেন, পরদিন সকালে আমি যেন প্রাইভেট সেক্রেটারির সংগে দেখা করি। বুঝলাম তিনি বেশ ভাল লোক, তাঁর দ্বারা আমার কিছু উপকারও হতে পারে।

 পরদিন সকালে যুবকের কথামত প্রাইভেট সেক্রেটারির সংগে সাক্ষাৎ করলাম। তিনি আমাকে পর্যটকরূপেই গ্রহণ করলেন, শাসক-শাসিতের সম্পর্ক ভুলে গিয়ে অন্তরংগভাবে আলাপ করলেন। ইংরেজ যুবক আমাকে তাঁদের দেশে যেতে উৎসাহিত করলেন এবং বিশেষভাবে বলে দিলেন, ব্রিটেনে গিয়ে যেন শিলিং হোস্টেল চেন-এর মেম্বর হই, সেই হোস্টেলগুলিতে থেকেই ব্রিটেনের জনগণের সত্যিকার চেহারা দেখতে পাব।

 দারিদ্র্য জিনিসটার রূপ পৃথিবীর সর্বত্রই এক হ’লেও দারিদ্র্যের কারণ সর্বত্র এক নয়। ব্রিটেন প্রকৃতির বিরুদ্ধে সর্বদাই লড়াই করে, প্রকৃতিকে আয়ত্তে এনে লক্ষ্মীর ভাণ্ডার লুঠ করবার চেষ্টা করছে। সে-লুঠের মোটা ভাগ পাচ্ছে যারা শক্তিমান, যারা সংখ্যায় মুষ্টিমেয় এবং লুণ্ঠনে যাদের প্রকৃত যোগ সবচেয়ে কম। আর যারা লক্ষ্মীর ভাণ্ডার জয় করে আনে, সেই সংখ্যাগরিষ্ঠদের ভাগেই বখরা পড়ে সবচেয়ে কম। যান্ত্রিক সভ্যতায় যে-সব দেশ বিশেষ পুষ্টিলাভ করেছে, সে-সব দেশে দারিদ্র্য টাকাকড়ি কম বলেই নয়, বণ্টনের দোষে। আর আমাদের দেশের দারিদ্র্য যান্ত্রিক সভ্যতা বা বৈদেশিক শোষণের জন্যে ততটা নয়, যতটা আমাদের স্বভাবের দোষে। আমাদের দার্শনিকগণ দারিদ্র্যকে উচ্চ আসন দিয়েছেন। মোটা ভাত মোটা কাপড়ে সন্তুষ্ট থেকে উচ্চ চিন্তা করার শিক্ষা আমরা পেয়ে এসেছি। তাই আমাদের দেশে প্রকৃতি তাঁর সব সম্পদ উন্মুক্ত করে ধরে রাখা সত্ত্বেও আমাদের দেশের লোক ক্ষুধায় কাতর, দেনায় জর্জরিত, স্বাস্থ্যে বঞ্চিত এবং পরানুগ্রহে লাঞ্ছিত। কষ্ট করে এদেশের লোক কিছু অর্জন কবতে পরান্মুখ, ভিক্ষাস্বরূপ অল্পস্বল্প পেলেই সন্তুষ্ট। এতে জীবন্মৃত হয়ে টিকে থাকা চলে, কিন্তু উচ্চ চিন্তা কখনই সম্ভব নয়। প্রভূত বাহ্যিক সম্পদ্ না হ’লে সভ্যতার উন্নতি কখনই হবে না, দরিদ্র জাতি মনুষ্যত্ব হারিয়ে ধ্বংসকে ডেকে আনবে। আমরা ভারতবাসীরাও তাই করছি।

 ইংরেজ যুবকের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যখন উঠলাম, তখন তিনি সবিনয়ে আমার হাতে দশটি টাকা দিয়ে বললেন, পর্যটকের পাথেয়ের জন্যে, এ তাঁর যৎসামান্য সাহায্য, আমি গ্রহণ করলেই তিনি কৃতার্থ হবেন।

 এই ইংরেজ যুবকের ভদ্র ব্যবহারে সেদিন আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম। প্রভুত্বের মোহে ইংরেজ তনয়গণ এদেশে অন্ধ, তাদেরই একজন এত বড় উচ্চপদের অধিকারী হয়েও আমার মত ধনমানহীন পরাধীন দেশের অধিবাসীর প্রতি যে আচরণ করলেন, তা অপ্রত্যাশিত।

 যা হোক, এবার আমি ভারতের সীমান্তের দিকে পা বাড়ালাম।

 সীমান্তে একটা কাস্টম হাউস আছে। কাস্টম অফিসার একজন ভারতীয়। তিনি পাঠানদের পাসপোর্টগুলি একরূপ না দেখেই সীলমোহর করলেন। তাঁর কার্যকলাপ দেখে আমি তখন ভাবছিলাম, একটা গোলাম অন্য একটা গোলামকে স্বাধীন দেশে যেতে দেখতেও রাজী নয়; এজন্যই এরূপ বাড়াবাড়িভাবে, আমার পাসপোর্ট পরীক্ষা করছে। অফিসার যখন পাসপোর্ট পরীক্ষা করে সীলমোহর করলেন, তখন আমি তাঁকে বললাম, মনে অনেক আঘাত লেগেছে নিশ্চয়ই আমাকে আটকে রাখতে পারেন নি বলে? দাসসুলভ মনোবৃত্তির এটাই বৈশিষ্ট্য। আপনি অথবা আমি যদি স্বাধীন জাতের লোক হতাম, তবে আমারই পাসপোর্টে সীলমোহর পড়ত সর্বাগ্রে। অফিসার নীরবে অন্য কাজে মন দিলেন।

 সীমান্ত পার হয়ে পার্বত্য উপত্যকার উপর দাঁড়িয়ে অনেকক্ষণ প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখলাম। উত্তরের হাওয়া এসে আমার নাকে মুখে ক্রমাগত ঝাপটা মারছিল। আমার মন আরও উত্তরে যাবার জন্য উন্মুখ ছিল। কিন্তু যেতে হবে দক্ষিণ-পশ্চিমের পথ ধরে। আরও দু’মাইল যাবার পর এলাম আফগান কাস্টম্ হাউসে। সেখানে পাসপোর্ট শুধু সীলমোহর লাগিয়ে ছেড়ে দেওয়া হ’ল। দক্ষিণ-পশ্চিমের প্রশস্ত পথটা ছেড়ে দিয়ে উত্তরের পথে অগ্রসর হলাম। আমার সামনে নগ্ন উন্নত তরঙ্গায়িত পর্বতমালা ক্রমে উচ্চ হতে উচ্চতর হয়ে আরও উত্তরে গিয়ে কালো মেঘের গায়ে মিশেছিল। সে-দৃশ্য একাকী দাঁড়িয়ে উপভোগ করতেছিলাম। সে-দৃশ্য আরও দেখবার জন্যে মন চাইছিল, দক্ষিণ দিকে যেতে মোটেই ইচ্ছা হচ্ছিল না। উত্তরের ঢেউ-খেলানো পর্বতমালা যেন আমায় দু’হাত বাড়িয়ে ডাকছিল কিন্তু আমার গন্তব্যপথ আমায় টানছিল দক্ষিণ-পশ্চিমের পথে।

 একটা পাথরের উপর বসে ভাবতেছিলাম, এই তো সেই আফগানিস্থান, আফগান জাতের বাসভূমি, যাদের বিরুদ্ধে আমাদের দেশের লোক কত ভ্রান্ত কাহিনী শুনে ভয়ে থর-থর করে কাঁপে। কিন্তু আমাকে তো এখনও কোন পাঠান আক্রমণ করছে না, আমি একাকী, আমার হাতে কোন অস্ত্র নেই। তারপর হঠাৎ চিন্তাধারা বদলে গেল। মনে হ’ল এটাতো বিদেশ নয়, এদেশ আমাদেরই। ঐ তো উত্তর দিক হতে হিমালয়ের শাখা হাত বাড়িয়ে আমাকে ডাকছে। ঐ তো কংকরময় সমতলভূমি, দুম্বা-রক্ষকগণ লাঠি হাতে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের গোলগাল মুখ দেখলেই মনে হয় ককেশাস রক্ত তাদের শরীরে বইছে। যদিও তাদের গায়ের পোস্তিন হতে একটা বিশ্রী গন্ধ বের হয়ে আসছে, তবুও তারা স্বাধীন। স্বাধীনতার গন্ধ এক-একবার মনকে কোন্ সুদূর ঊর্ধ্বলোকে নিয়ে যাচ্ছিল, কিন্তু যখনই মনে হতেছিল আমি বস্তুতপক্ষে পরাধীন দেশের লোক, তখনই কে যেন সজোরে আমাকে আছড়ে ফেলে দিতেছিল কঠিন মাটির ওপর। স্বাধীন দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে নিজের দেশের পরাধীনতার গ্লানিকে বেশ ভাল করে হৃদয়ংগম করতেছিলাম।

 সামনে চেয়ে দেখলাম একটা অন্ধকার আবরণ যেন ভারতমাতার মহিমামণ্ডিত মূর্তিকে ঢেকে রেখেছে, আর আমার হাত সেদিকে আপনি চলে যাচ্ছে অবাঞ্ছিত অন্ধকার-আচ্ছাদনটাকে সরিয়ে ফেলতে। স্বাধীন দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে মনে হচ্ছিল আমার কোনও অধিকার নেই স্বাধীন দেশে থাকতে। আমার গায়ের বাতাসও স্বাধীন দেশের বাতাসকে কলুষিত করে তুলবে। তাই মনের ভেতর থেকে আর্তস্বরে একই কথা বার বার বেরিয়ে আসছিল— স্বাধীনতা! স্বাধীনতা!

 কতক্ষণ পথ চলার পরই একটি ছোট গ্রাম পেলাম। গ্রামে গোলাবাড়ী নেই। গ্রামের একমাত্র দোকান অর্ধেকটা খোলা। যে অংশে বেনের দোকানের জিনিস বিক্রী হয় সে অংশটাই শুধু খোলা, অন্য অংশটা বন্ধ। উঁকি মেরে দেখলাম অন্য অংশটাতে গোস্ত-রুটি রয়েছে। ক্ষিদে বেশ ছিল, তাই দোকানদারকে বল্‌লাম গোস্ত-রুটি দেবার জন্যে। দোকানদার বললে, রোজার মাসে সে খাদ্য বিক্রী করবে না। আমি বললাম, তুমি না হয় উপোস করে স্বর্গে যাবে, আমি স্বর্গে যেতে চাইনে, বেঁচে থাকতে চাই। তারপর আমি মুসলমান ধর্মের লোকও নই, আমার কাছে খাদ্য বিক্রী করতে কি আপত্তি থাকতে পারে? উপরন্তু আমি ক্ষুধায় কাতর। দোকানদার বললে, যদি নিজের হাতে খাবার নিয়ে খাই তবে বিক্রী করতে তার কোন আপত্তি নেই। আমি তাতে রাজী হলাম।

 একটা ডালাতে কতকগুলো পাঠান-রুটি এক টুকরা ময়লা কাপড় দিয়ে ঢাকা ছিল। রুটিগুলি চাপাতি হতে চারগুণ বড় এবং ঢের পাতলা। রুটি হতে বেশ মিষ্টি গন্ধ বের হয়ে আসছিল। দু’খানি রুটি বের করে নিয়ে ডালাটিকে পূর্বের মত ঢেকে রেখে নিকটস্থ একটা হাঁড়িতে হাত দেওয়ামাত্র দোকানী চীৎকার করে উঠল। বললে, এটাতে যে-মাংস আছে তা তুমি খেতে পার না, দাঁড়াও আমি গরম জল নিয়ে আসছি। বুঝলাম তাতে গোমাংস ছিল। গরম জল এনে দেবার পর অন্য হাঁড়ি হতে দু’ টুকরা মুরগীর মাংস বের করে নিলাম। এ-সব হোটেলে মুরগীটাকে মাত্র চার টুকরা করেই পাক করা হয়। দু’ টুকরা মুরগীর মাংস এবং দু’খানা পাঠান-রুটি অবলীলাক্রমে উদরস্থ করলাম।

 ভোজনের তৃপ্তি মুখেই ফুটে ওঠে। আমার মুখাবয়বে সেই তৃপ্তির ভাব ফুটে ওঠায় পাঠানও খুশী হয়েছিল। ভারতের এক প্রান্ত হতে অপর প্রান্ত পর্যন্ত বেড়িয়ে অনুভব করেছি, ভোজন করিয়ে তৃপ্ত হতে অনেকেই চায়। বর্তমানে অভাবের তাড়নায় এই ভাবটি লোপ পেতে বসেছে। পাঠান যদিও পয়সা নিয়েই আমার কাছে খাদ্য বিক্রী করেছিল, তবুও তার মুখে আনন্দের দীপ্তি ফুটে উঠতে দেখে স্বভাবতঃই ভারতীয় কৃষ্টির কথা মনে পড়ল। বিদায় নেবার বেলা মাথায় টুপি রেখেই তাকে আমি যুক্তকরে নমস্কার করলাম। পাঠানও আমাকে নমস্কার বলে জোড়হাত করতে ভুলেনি। কিন্তু আমাদের আচারব্যবহারের কথা মনে হওয়ামাত্র মাথা নত হয়ে এল। অনেক দুঃখ হ’ল কিন্তু প্রতিবাদের উপায় ছিল না; ভাবছিলাম কবে স্বাধীন হব এবং পাঠানদের মত উদারচিত্তে উপবাসের দিনেও একজন পাঠানকে নিজের ঘরে বসিয়ে খাওয়াতে পারব।

 দোকান থেকে বেরিয়ে পথে দাঁড়ালাম; তারপর মাইল পাঁচেক যাবার পর দূর থেকে একটি টিলার উপর একটি বাংলো ধরণের বাড়ী দেখতে পেলাম। এদিকে পথ যদিও প্রশস্ত এবং সমতল, তবুও অযত্নের জন্য বড় বড় পাথর পথকে দুর্গম করে রেখেছে। খুব কষ্টে সাইকেল ঠেলে অগ্রসর হচ্ছি, এমন সময় একজন সেপাই আমাকে বাংলোয় যাবার জন্য ইংগিত করলে। বিনা বাক্যব্যয়ে তার অনুসরণ করলাম। বাংলোতে যাবার পর একজন অফিসার পরিষ্কার হিন্দুস্থানীতে আমার সঙ্গে কথা বলতে আরম্ভ করলেন। হিন্দুস্থানী ভাষা উর্দু ও নয় হিন্দিও নয়, এ দু’টার মাঝামাঝি। হিন্দুস্থানী রোমান অক্ষরে সাধারণত লেখা হয়; এই ভাষা ভবিষ্যতে রোমান অক্ষরে লিখিত হয়ে ইণ্ডিয়ার রাষ্ট্রভাষা হবে, এতে কোন সন্দেহ নাই।

 অফিসার অনেকদিন হংকং-এ ছিলেন। তাঁর পোশাক দেখেই অনুমান করেছিলাম তিনি একজন উঁচুদরের অফিসার হবেন। আমার ধারণা যে ঠিক তা তাঁর সংগে কথাবার্তাতেই বুঝতে পেরেছিলাম। আফগানিস্থানে যাদের সংগে পরিচিত হয়েছিলাম তাদের অধিকাংশই ঈশ্বরের নামে আমাকে আশীর্বাদ করেছিলেন। কিন্তু এই অফিসারটি আমাকে জানালেন শুভেচ্ছা।

 কাবুল, কান্দাহার, গজনী ইত্যাদি ভ্রমণ করে আফগানিস্থানের সৈনিক বিভাগের অনেক কথাই পরে জেনেছিলাম। আফগানিস্থানে নানা শ্রেণীর লোকের বাস। কতকগুলি সম্প্রদায়, মিলে আফগান জাতের গড়ন হয়েছে। সমস্ত সম্প্রদায়ই একই ধর্মের অন্তর্গত নয়, একই সম্প্রদায়ে আবার বিভিন্ন ধর্মও আছে। যেমন হিলজাই সম্প্রদায়। এই সম্প্রদায়ে হিন্দুও আছে, মুসলমানও আছে। ওরা যখন স্বগ্রামে বসবাস করে, তখন নিজেদের সুবিধার্থে হিন্দু এবং মুসলমান বলে পরিচিত হয়, কিন্তু বিদেশে গেলে সবাই হিলজাই বলেই পরিচয় দেয়। আমাদের দেশে যত কাবুলিওয়ালা দেখতে পাই তাদের মধ্যে অনেক হিন্দু আছে, আমরা তাদের চিনতে পারি না। আমাদের কাছে এরা সবাই পাঠান ও মুসলমান।

 লোকসংখ্যা অনুযায়ী প্রত্যেক সম্প্রদায়ই দেশরক্ষার্থে সেপাই সরবরাহ করতে বাধ্য। সম্প্রদায়ে কত হিন্দু কত মুসলমান আছে তার কোন প্রশ্নই ওঠে না। আফগান সরকার ভাল করেই অবগত আছেন কোন্ সম্প্রদায়ে লোকসংখ্যা কত। তাঁরা প্রত্যেক সম্প্রদায়ের মণ্ডলকে জানিয়ে দেন যে তাকে এত সেপাই বৎসরে দিতে হবে। মণ্ডল আদেশ পাওয়ামাত্র নির্ধারিত প্রথামত সেপাই সরবরাহ করেন। এতে সম্প্রদায়ের হিন্দুরা বাদ পড়ে না। হিন্দুরা সাধারণত সেপাই-এর কাজ করে না, তারা নিজের সম্প্রদায় হতেই ভাড়া করে লোক পাঠায়। এরূপ ভাড়াটে সেপাই সরকার হতে প্রাপ্য মাইনে তো পায়ই, উপরন্তু যে তাকে ভাড়া করে পাঠায় সেও মাইনে দেয়। এই ভাড়াটে সেপাইদের সংগে অন্য যে-কোন পরাধীন দেশের সেপাই-এর সংগে তুলনা দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু যারা ভাড়াটে নয় তারা নিঃশংকচিত্তে আপন আপন কাজ করে যায়। অফিসারদের সামনেই তারা সিগারেট ফুঁকছে, হাসি ঠাট্টা করছে। কিন্তু ভারাটে সেপাইরা সকল সময়ই সন্ত্রস্ত, এদের এই আড়ষ্টভাব অফিসারগণও পছন্দ করেন না। ব্যারাক হতে এই অভিজ্ঞতা অর্জন করে আবার পথে এলাম।

 ব্যারাক হ’ল একটি ঘাঁটি। যে কেউ আফগানিস্থানে যাক, তাকেই এখানে গিয়ে প্রশ্নের জবাব দিয়ে আসতে হয়। আমাকে কোন প্রশ্ন করা হয়নি দেখে মনটা বেশ উৎফুল্ল হয়েছিল। পর্যটকের বেশ আদর আছে বলে মনে হ’ল। পূর্বেই বলেছি আফগানিস্থানে ভারতের লোক অতি অল্পই যায়। অফিসারের সংগে কথা বলে জেনেছিলাম, আমার আফগানিস্থান প্রবেশ করার পূর্বে তিনজন পারসী যুবক সাইকেলে কয়েক মাস পূর্বে এসেছিলেন এবং তার ছয় বৎসর পূর্বে একজন বাঙালী বৈষ্ণব একতারা হাতে করে, হরিনাম গাইতে গাইতে কাবুল গিয়েছিলেন। গত ছয় বৎসরের হিসাব মতে আফগানিস্থানে পর্যটক হিসাবে আমি হলাম পঞ্চম ব্যক্তি। আফগানিস্থানে পর্যটকের স্থান সাধারণ লোক হতে অনেক উচ্চে, এই বিষয়টি পরে জেনেছিলাম।

 সাইকেল চলছে। আমার পায়ে শক্তি আছে। নতুন দেশের নতুন গন্ধে মাতোয়ারা হয়ে পথ চলছি। আফগান জাতের কথা, তাদের দেশের আবহাওয়ার কথা একটার পর একটা মনে আসছিল। ভয়ানক অনুতাপ হচ্ছিল আফগানিস্থান সম্বন্ধে নানা বিকৃত এবং কল্পনাপ্রসূত কাহিনী এককালে বিশ্বাস করেছিলাম বলে। আফগানিস্থানে এসে দেখছি এ-সব মিথ্যা এবং গাঁজাখুরি গল্প। কোথায় ডাকাতের অত্যাচার আর কোথায় হিন্দু-বিদ্বেষ? কেউ তো এখনও এল না আমাকে কল্‌মা পড়িয়ে মুসলমান করতে। মনে মনে মিথ্যা রটনাকারীদের কঠোর ভর্ৎসনা করে সাইকেলে পেডেল করছিলাম। দু’ একখানা পর্ণকুটীর পথের পাশে দেখতে পেলাম। কুটীরগুলির কাছে গিয়েছি, কুটীরবাসীদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছি ওদের মনোভাব জানবার জন্য। কিন্তু কই কেউ তো আমাকে হত্যা করলে না? অনেকের বাড়ীতেই ছোরা এবং ছোট বন্দুক ছিল, কিন্তু আমাকে তা দিয়ে আক্রমণ করেনি।

 আমাদের দেশে যেমন করে সূর্য অস্ত যায়, ওদের দেশেও ঠিক তেমনি সূর্য অস্ত যাচ্ছে। আমি ডাক্কা নামক ছোট একটি গ্রামের কাছে পৌঁছলাম। দূর হতে গ্রামের প্রকৃত চেহারা মালুম হল না। গ্রামে শ্রী ছিল না। গ্রামে প্রবেশ করে বুঝলাম সত্যই গ্রাম শ্রীহীন।

 রাত্রে থাকার জন্য গ্রামের প্রায় সমুদয়টাই ঘুরলাম। শেষটায় যখন কোথাও স্থান পেলুম না, তখন কুমিদানের অফিসে গেলাম। আমাদের দেশে যেমন পাঁচ-সাতটা গ্রাম নিয়ে একটা পুলিশ স্টেসন থাকে, আফগানিস্থানে কিন্তু তা নয়। এখানে প্রত্যেক গ্রামেই একজন করে দারোগা আছেন। দারোগাকে কুমিদান বলে। ডাক্কার কুমিদান একজন যুবক। তিনি আমাকে সাদরে গ্রহণ করলেন। দেশ-বিদেশের সংবাদ অবগত হবার জন্য নানারূপ প্রশ্ন করলেন। তাঁকে আমার অভিজ্ঞতা বলবার পর বিনয়সহকারে জানালাম, আমি এখানকার হিন্দুদের অবস্থা জানতে চাই, যদি দয়া করে সে-বিষয়ে সাহায্য করেন তবে বাধিত হব। আমার প্রস্তাব শুনে কুমিদান খুব সন্তুষ্ট হলেন বলে মনে হ’ল না।

 যা হোক, তিনি একজন লোক আমার সংগে দিয়ে হিন্দুদের বাড়ীর দিকে পাঠিয়ে দিলেন। রাত্রের অন্ধকারে কয়েকটি হিন্দু বাড়ীতে গিয়ে দেখলাম এরা নির্জীবের মত দিন কাটিয়ে যাচ্ছে। এদের শরীরে তেজবীর্য আছে বলে মনে হয় না। প্রত্যেকের শরীর রুগ্ন এবং দেখলেই মনে হয় আয়েসী। ওরা আমাকে একটুও প্রীতির চক্ষে দেখলে না। তারা হয়ত এই ভেবে শংকিত হচ্ছিল যে আমি তাদের বাড়ীতে থাকতে গিয়েছি। একজন হিন্দুকে দেখে যারা শংকিত হয়, অতিথি গ্রহণে ভীত হয়, তাদের বাড়ীতে থাকা পাগলের পাগলামী ছাড়া আর কি হতে পারে। অবশেষে কুমিদানের বাড়ী ফিরে এলাম।

 ফিরে এসে দেখলাম কুমিদানের মুখ ভার। এখানকার হিন্দুরা মুসলমানের বাড়ীতে খায় না, সেজন্য কুমিদান আমার খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থার জন্য ভাবিত হয়ে পড়েছিলেন। কুমিদান সুন্নি মুসলমান। তাঁকে চিন্তান্বিত দেখে বললাম, মহাশয়, আমি হিন্দুদের বাড়ীতে গিয়েছি বলে হয়তো ভেবেছেন আমি ওদের মতই মনোবৃত্তি পোষণ করি—এটা আপনার ভুল ধারণা। আমি গিয়েছিলাম, এখানকার হিন্দুরা কেমন করে ধ্বংসের পথে এগিয়ে চলেছে তা দেখতে। যদি দেশে গিয়ে বলতে পারি, নতুনের প্রতি সম্পূর্ণ বিমুখ হয়ে শুধু পুরাতন আচার-পদ্ধতি আঁকড়ে ধরে থাকলে কি করে একটা জাত ধরাপৃষ্ঠ হতে বিলুপ্ত হতে থাকে, তাতে হিন্দুদের উপকার হতে পারে। এই হতভাগারা টাকার কুমীর, অথচ কৃপণ। ওরা নিজেদের স্বাস্থ্যের জন্যও টাকা খরচ করে না, টাকা খরচ করে স্বর্গে যাবার জন্য। এদের মুখে হাসি নেই, এরা অতিথি দেখলে ভয় পায়। এদের এই অবস্থা মরবার পূর্বলক্ষণ ছাড়া আর কিছু নয়। সনাতনী হিন্দুরা নিজের ধ্বংসের কারণ না অন্বেষণ করে অপরের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দিয়েই সুখী হয়। আফগানিস্থানের শিয়া শ্রেণীর মুসলমানও মাইনোরিটি, তারাও পাঠানদের পছন্দ করে না, কিন্তু তাদের সামাজিক রীতিনীতিতে গ্রহণ করার ক্ষমতা থাকায় পাঠানদের একটুও ভয় করে না। সনাতনী হিন্দুদের যদি গ্রহণ করার ক্ষমতা থাকত, তবে কখনও পাঠানের ঘাড়ে সকল দোষ চাপিয়ে দিয়ে মুখ বুজে থাকত না।

 খাওয়ার বন্দোবস্ত হ’ল। খেতে বসলাম। ভাত, দুম্বার মাংস এবং কাঁচা পেঁয়াজ। ভাতে ঘি দেওয়া ছিল না। হিন্দুরা চাউলে ঘি মাখিয়ে রান্না করে, এতে অগ্নিমান্দ্য হয়। কিন্তু সাদা ভাতে অগ্নিবৃদ্ধি হয়। খেতে বসে মাংস এবং ভাত কুমিদানের চেয়েও দ্বিগুণ খেতে সক্ষম হয়েছিলাম। যদি কুমিদান আমার শক্তির পরিচয় চাইতেন, তবে তাঁকে প্রতিযোগিতায় পরাস্ত করতে বেগ পেতে হত না।

 আফগান জাতকে যারা নিষ্ঠুর নরঘাতী বলে চিত্রিত করেছে, তাদের প্রতি ঘৃণা হয়েছিল এবং আহারের পর কুমিদানকে আফগানিস্থান সম্বন্ধীয় সেই সব মিথ্যা রটনাগুলির কথা বলেছিলাম। শুনে তিনি দুঃখ করে বলেছিলেন, এ তো সামান্য কথা, পৃথিবীতে কত হীন মিথ্যাবাদীই আছে যারা তিলকে তাল করে লোকসমাজে প্রচার করে। পরে বুঝতে পেরেছিলাম, আফগানিস্থানের পাঠানদের বিরুদ্ধাচরণ সনাতনী হিন্দুরাই বেশী করেছে।

 পরদিন অল্প সময়ই গ্রামে ছিলাম। এই সময়টুকুতেই বুঝতে পেরেছিলাম, গ্রামের ধ্বংসোন্মুখ হিন্দুদের খুশী করার জন্য গ্রামের ভেতর কোন মুসলমান গোহত্যা করে না। গোহত্যা হয় গ্রামের বাইরে বহুদূরে। কাটা মাংস গ্রামে গোপনে আসে, এবং গোপনেই বিক্রী হয়ে থাকে। আফগানরা এমনিভাবেই হিন্দুদের মনস্তুষ্টি করে থাকে। অথচ আজ যে হিন্দু যুবতী নিষিদ্ধ মাংস দেখে বমি করে, সেই রমণী যখন শরীরের ক্ষুধা মেটাবার জন্য গ্রামের কোন মুসলমান যুবকের সংগে চলে যায়, তখন আর ভক্ষ্যাভক্ষ্যের কথা মনে থাকে না। উদারতার গুণে কোন কোন হিন্দু উন্নতির পথে অগ্রসর হচ্ছে, পক্ষান্তরে ঐ গুণটির অভাবে অনেকে নিজেদের সর্বনাশ ডেকে আনছে।

 ডাক্কা গ্রাম পরিত্যাগ করার পূর্বে স্থানীয় বাড়ীঘরের দিকে একটু লক্ষ্য করতেই দেখতে পেলাম, অনেক বাড়ীর দেওয়ালে বন্দুকের গুলিবিদ্ধ হয়ে যে ছিদ্র হয়েছিল, তা এখনও বন্ধ করা হয়নি। ভবিষ্যৎ বংশধরদের দেখাবার জন্যই হয়তো গুলিবিদ্ধ দেওয়ালগুলি যেমন ছিল, তেমনি অবস্থায়ই রাখা হয়েছে। এরূপ কয়েকটি ঘর দেখার পর চিন্তিত হয়ে পড়লাম, কারণ এই ছিদ্রগুলি ভারতীয় সেপাইদের কুকীর্তির নিদর্শনচিহ্ন। ভারতীয় সেপাই-এর বিরুদ্ধে পাঠানদের মনে বিদ্বেষ চিরদিন জাগরূক থাকবে, এটা নিশ্চিত। এ দৃশ্য আমি আর বেশীক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখলাম না, গন্তব্যপথে রওনা হলাম।

 গ্রাম পার হয়েই বড় রাস্তায় আসলাম। রাস্তা প্রশস্ত। পথের একদিকে ঢালু সমতলভূমি, অন্যদিকে দুরে কৃষ্ণাভ পর্বতমালা। অনেকক্ষণ সেই দৃশ্য দেখলাম। মনে হল, পর্বত বৃক্ষরাজিতে পূর্ণ বলেই হয়তো ধোঁয়াটে দেখাচ্ছে, কিন্তু শেষে বুঝতে পারলাম আমার ধারণা সত্য নয়। এদিকের পর্বতে বৃক্ষের বড়ই অভাব। পর্বতের নিজেরই কৃষ্ণ ছায়া পড়ে পর্বতকে অন্ধকার দেখাচ্ছে।

 পর্যটকের অগ্রগতিকে মাঝে মাঝে ব্যাহত করে এই সব মনোরম প্রাকৃতিক দৃশ্য—যাহা পথের দু’ধারে অপরূপ ঐশ্চর্যশালিনী হয়ে রয়েছে। অনেকক্ষণ সেই সৌন্দর্য দেখলাম। হঠাৎ মনে হ’ল আমি রাজপথে দাঁড়িয়ে আছি। এদিকে হোটেল নাই, খাবারের দোকান নাই—আশ্রয় নিতে হবে।

 সৌন্দর্যের মায়াপুরীর মোহ কাটিয়ে আবার চললাম বন্ধুর পথের ওপর দিয়ে সাইকেল চালিয়ে। পথ দুর্গম। কিন্তু তাই বলে কি পথ চলা বন্ধ করতে পারা যায়?

 সাত মাইল যাবার পর একটা ছোট্ট গ্রাম পেলাম। গ্রামে লোকজনের বসতি কম। গ্রাম উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত। পথের দু’পাশে মাটির ঘর। এখানে গৃহনির্মাণ-পদ্ধতি আমাদের দেশের মত নয়। আমাদের দেশে ঘরগুলি ক্রমেই পথকে গলা টিপে মারতে চেষ্টা করে, আর ওদের ঘরগুলি ক্রমেই সরে পথকে প্রসারিত করে দিচ্ছে। আর্য-সংস্কৃতির এটাই বিশেষত্ব।

 গ্রামে বেশীক্ষণ দাঁড়ালাম না, আরও এগিয়ে গিয়ে সন্ধ্যার মধ্যে জালালাবাদ পৌঁছতেই হবে। সেইখানেই রাত্রিবাস করব মনস্থ করেছিলাম। সেজন্য গ্রামটার ভেতর প্রবেশ করে অল্পক্ষণ মাত্র ঘোরাফেরা করে দেখলাম। গ্রামে লোক ছিল না। পরে শুনেছিলাম, এই গ্রামে শিয়া শ্রেণীর লোক বাস করে। আফগানিস্থানের শিয়ারা অন্য জাতের লোক। ওরা জাতে মোংগল বা মোগল। ভাষাও ওদের পৃথক। এরা আলু চাষ করতে বেশ পটু। তখন নাকি আলু উঠিয়ে আনার সময় ছিল; সেজন্য গ্রামের লোক সপরিবারে আলুর ক্ষেতে চলে গিয়েছিল।

 এদের গৃহনির্মাণ-পদ্ধতি পাঠানদের মত নয়। এখনও এরা আদিম মোংগল জাতির মতই ঘর তৈরী করে। আদিম মোংগল ধরনের ঘর ভারতের বাইরে সর্বত্রই দেখা যায়। ভারতের মধ্যে এখনও বাংলা, আসাম এবং উড়িষ্যাতে মোংগল পদ্ধতির ঘর বিরল নয়। পুরীতে যারা জগন্নাথদেবের মন্দির দেখতে যান তাঁরা যদি পূজারীদের ঘরগুলি ভাল করে পর্যবেক্ষণ করেন, তবেই বুঝতে পারবেন মোংগল ধরনের ঘর কি রকমের হয়। এশিয়ার অনেক দেশে মোগলদের বসবাস দেখেছি। চেংগিজ খান মোগল ছিলেন। পৃথিবীর সভ্য সমাজ এখনও তাঁর নাম শুনলে আতংকে কম্পিত হয়। হিন্দুস্থানের শাহান্‌শা আকবরের নাম আমাদের দেশে কে না জানে? কিন্তু গ্রাম্য মোংগলদের চাল-চলন ও দরিদ্রতা দেখলে লজ্জা হয় এবং মনে হয়, এদেরই পূর্বপুরুষ কি অতীতে আমাদের পূর্বপুরুষকে পরাজিত করেছিল এবং বহু বৎসরব্যাপী রাজত্ব করেছিল?

 গ্রাম পরিত্যাগ করে পথে এলাম। পূর্ণ উদ্যমে সাইকেল চালাতেছিলাম। বিকালের দিকে একখানা মাঝারি গোছের গ্রামে এলাম। এ-সব গ্রামে থাকবার কোন কষ্ট নেই। কেন কষ্ট পেতে হয় না, সে সম্বন্ধে দু’-একটি কথা বলা দরকার মনে করি। রাত্রে আফগানিস্থানের পার্বত্য অঞ্চলে ভয়ানক শীত অনুভূত হয়। শীতের সময় বাইরে থাকা অসম্ভব। গরমের সময় বাইরে ঘুমাতে হ’লে কম্বলের দরকার হয়। গ্রামে মুসাফিরখানা ছিল না; সেজন্য রাত কাটাবার জন্যে আমাকে মসজিদে আশ্রয় নিতে হ’ল। যিনি মসজিদে আজান দেন তাঁরই সংগে আমার সর্বপ্রথম আলাপ হয়। তিনি আমার বাড়ী কোথায় এবং আমি কোন্ ধর্মের লোক জিজ্ঞাসা করলেন। তাঁকে বললাম-এইমাত্র জেনে রাখুন আমি মুসলমান নই। মুসলমান নই শুনে তিনি একটুও দ্বিধাবোধ করলেন না। তাড়াতাড়ি করে মসজিদের এক কোণে একটি লম্বা তাকিয়া, ছোট তোশক এবং কম্বলসমেত একটি লেপ এনে দিলেন, আর আমাকে বাইরে রুটির দোকানে খেয়ে আসতে বললেন। তাঁর নির্দেশমত আমি রুটির দোকানে যেয়ে ঢুকলাম। তারপর আমি যখন গভীর নিদ্রায় নিদ্রিত ছিলাম, তখন মোল্লা আমাকে জাগালেন এবং বললেন, এখন আর রাত নেই, আজান করা হবে। আপনি হয়ত ঘুমের মাঝে হঠাৎ ভয় খেয়ে যাবেন, সেজন্যই ডেকে দিলাম।

 একবার ঘুম ভেংগে যাবার পর আর ঘুমাতে ইচ্ছা করে না। উঠে বসলাম এবং একটা সিগারেট ধরিয়ে নানা কথা ভাবতে আরম্ভ করলাম। হিন্দুস্থানের মুসলমানদের মতে আমি কাফের, আমাকে কলমা পড়িয়ে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করা তাদের পক্ষে একটা বিশেষ পুণ্যের কাজ; কিন্তু এখানে দেখছি তার বিপরীত। এখানে লোকের সাধারণ বুদ্ধি আছে বলেই মোল্লা আমাকে ডেকে উঠিয়েছিলেন। সাধারণ বুদ্ধি সহজে আসে না। সাধারণ বুদ্ধির বিকাশ হয় ঘাত-প্রতিঘাতের ভেতর দিয়ে। যে দেশ এবং যে জাতি স্বাধীন, তাদের জীবন ঘাত-প্রতিঘাতের ভিতর দিয়েই কাটে।

 পূর্বদিকে মাথা রেখে শুয়েছিলাম। মোল্লা সেজন্য প্রতিবাদ করেননি। এমন কি কেউ ভ্রূক্ষেপও করেনি। পরদিন প্রাতে বিদায়ের সময় মোল্লা বলেছিলেন, আপনার অনেক অসুবিধা হয়েছে নিশ্চয়ই, সেজন্য ক্ষমা করবেন। দুঃখের বিষয়, আমাদের গ্রামে মুসাফিরখানা নেই।

 মোল্লাকে আতিথেয়তার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে পথে বেরিয়ে পড়লাম। বেশী কথা বলবার সময় ছিল না। তখন স্বদেশের কথা চিন্তা করছিলাম। ভাবছিলাম স্বাধীনতার কত গুণ। পরাধীন ভারতের জাতিভেদের বিরুদ্ধে আমার হৃদয় বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল। পরাধীন ভারতের মুসলমানরা বর্ণহিন্দুদের গোঁড়ামি বেশ ভাল করেই নকল করেছিল। তারা স্বাধীন মুসলমান দেশগুলির পদাংক অনুসরণ করা দূরের কথা, নিজেদের আদর্শ ভুলে গিয়ে সর্বনাশের পথেই এগিয়ে চলেছিল।

 আজ যদি এটা আফগানিস্থানের মসজিদ না হয়ে ভারতের কোন মন্দির অথবা মসজিদ হত, তবে আমাকে এই শীতের রাতে বাইরে শুয়ে নিমোনিয়ায় আক্রান্ত হতে হ’ত। মন্দিরের গোঁড়া পুরোহিত এবং মসজিদের মোল্লা কেউ আমার বিরুদ্ধ আচরণকে উদার দৃষ্টিতে দেখতে পারত কিনা সন্দেহ। এসব কথা যতই ভাবতেছিলাম ততই মন বিগড়ে যাচ্ছিল। কিন্তু কালাপাহাড়ী যুগ চলে গিয়েছে। নতুন যুগের নতুন চিন্তা-পদ্ধতির সাথে তাল রেখে নতুনভাবে আমাদের চলতে হবে। মন্দির বা মসজিদের ইঁট-পাথরকে না ভেংগেও ধর্মগত, সম্প্রদায়গত সংকীর্ণতার উচ্ছেদ করে মন্দির বা মসজিদকে আমরা বৃহত্তর মানবতার উদার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত করতে পারি। তা যদি না পারি, তবে জাতি হিসেবে আমরাও একদিন মন্দির বা মসজিদের ভঙ্গুর ইট-পাথরের মতই জীর্ণতা প্রাপ্ত হয়ে ভূগর্ভে সমাধি লাভ করব।

 এমনি ধরনের চিন্তা করে যখন পথ চলছিলাম, হঠাৎ কোথা হতে একটা বুলডগ্ আক্রমণ করল। বুলডগের চরিত্র জানতাম, সেইজন্যই সাইকেল হতে নেমে পড়লাম। বুলডগের আক্রমণ এবং নেকড়ে বাঘের আক্রমণ একই রকমের। সাইকেল হতে নেমে দাঁড়াতে দেখে বুলডগ্‌টা একটু থম্‌কে দাঁড়াল এবং পরে কাছে এসে আমার গা শুঁকতে লাগল, কিন্তু কামড়াল না। আফগানী বুলডগের একটা সহজ বুদ্ধি আছে। চোর-ডাকাতকে ওরা চেনে এবং তাদের আট্‌কে রাখে এবং কামড়ায়ও। তবে আফগানিস্থানে বুলডগের সংখ্যা খুবই কম। শীতের সময় যখন সাইবেরিয়া হতে নেকড়ে বাঘের দল আফগানিস্থানে অভিযান চালায়, তখন অনেকেই তাদের বুলডগ্‌কে ঘরে বেঁধে রাখে। অনেকে আবার ছেড়েও দেয়। যারা ছেড়ে দেয় তাদের বুলডগ্ কচিৎ ফিরে আসে। নেকড়ের দল বুলডগ্ খেয়ে ফেলে। যদি কোনও একটি ফিরে আসে, তবে খালি মুখে সে ফিরে আসে না, নিহত নেকড়েকেও জয়ের চিহ্নস্বরূপ মুখে করে নিয়ে আসে।

 বুলডগের সামনে যখন পাথরের মত দাঁড়িয়েছিলাম, তখন একজন লোক সম্ভবত আমাকে বিপন্ন ভেবেই বুলডগ্‌টার দিকে তেড়ে এলেন। কাছে এসেই বুলডগ্‌টাকে এমন এক চপেটাঘাত করলেন। আঘাত পেয়ে কুকুরটা একটু দূরে দাঁড়াল। ভদ্রলোক প্রৌঢ়, জাতে খিলজাই। তাঁর দেহ দীর্ঘ, বুক উচু, মাথায় লম্বা চুল, দাড়ি কামানো। বিশুদ্ধ হিন্দুস্থানীতে তিনি বললেন,—এভাবেই বুলডগের হাত হতে বাঁচতে হয়। আপনি কে এবং যাবেন কোথায়? আমি বললাম, “আমি একজন বাঙালী, বেরিয়েছি পৃথিবী ভ্রমণ করতে।”

 আফগানিস্থানকে সকল সময়ই ভারতেরই একটি অংশ বলে মনে করেছি। সেজন্যই আফগানিস্থানে ইণ্ডিয়ান অথবা অন্য কোন প্রচলিত শব্দে নিজের পরিচয় দেই নি।

 আফগানিস্থানে উর্দু ভাষার প্রচলন শুধু হিন্দুদের মাঝেই আবদ্ধ, কিন্তু অন্যান্যরা হিন্দুস্থানীই জানে এবং উর্দু মোটেই পছন্দ করে না। নমুনাস্বরূপ দু’একটি কথা বলতে পারি। মুসলমানরা বলে—তোমারা নাম কিয়া হায়? তুম কিদার যাওগে? ‘তোমারা কাম বন্ যায়েগা। হিন্দুরা বলে,—ইসমে সরীফ? আপকা দৈলতখানা? আপ কামইয়াব হো যাওগে। আফগানিস্থানে হিন্দুস্থানী এবং উর্দুর স্রোত ভারত হতে যায়নি, ইরান হতে এসেছে।

 ইরান এবং আফগানিস্থানের মধ্যে সীমানা নিয়ে ঝগড়া হয়; সেজন্যই পাঠানরা ইরানী শব্দ ব্যবহার পছন্দ করে না, তারা চায় পোস্ত শব্দ ব্যবহার করতে। দুঃখের বিষয়, ইরানে গিয়ে দেখলাম ইরানী ভাষা হতে আরবী শব্দের ব্যবহার পরিত্যাগ আরম্ভ হয়েছে। ফলে ইরানে এবং আফগানিস্থানে ফ্রেঞ্চ, ইংলিশ, জার্মান এবং পুরাতন ভাষার ব্যবহার আরম্ভ হয়েছে।

 আমার উদ্ধারকর্তা পাঠান খিলজাই গোষ্ঠীর। খিলজাইরা বড়ই অতিথি পরায়ণ, কিন্তু প্রথমত তাঁর আতিথ্য গ্রহণ করতে রাজী হইনি। ভাবছিলাম জালালাবাদ অতি সন্নিকট, সেজন্য তাঁকে বলছিলাম আজই জালালাবাদে পৌঁছানো দরকার। পাঠান হেসে বললেন, আজ কেন—আগামীকল্যও জালালাবাদে পৌঁছানো সম্ভব হবে না, অতএব চলুন আমার বাড়ীতেই।

 আমার কাছে আফগানিস্থানের ছোট একখানা মানচিত্র ছিল। তা দেখে বুঝতে পারিনি জালালাবাদ কত দূর; তাই অগত্যা পাঠানের বাড়ী অতিথি হলাম। পাঠানের বাড়ী নিকটস্থ একটি ছোট গ্রামে। ভাবছিলাম গ্রাম কাছেই। কিন্তু গ্রাম ছিল বেশ দূরে এবং পাহাড়ের অন্তরালে। পথের পাশে গ্রাম করে সেখানে বাস করা এদের অভ্যাস নেই। গ্রাম্যপথে সাইকেল নিয়ে চলাফেরা করা বড়ই কষ্টকর কাজ। পাঠানের যদিও কষ্ট হচ্ছিল না, আমার কিন্তু ঘাম বেরিয়ে গিয়েছিল।

 পাঠান ধনী নন্, অবস্থা অসচ্ছলও নয়। তাঁর ফলের বাগান ও ঘাসের জমি পরিমাণে খুব কম নয় বলেই মনে হ’ল। পাঠান বিবাহিত। বাড়ীতে আর একটি যুবককে দেখে ভেবেছিলাম, এই লোকটি হয়ত গৃহস্বামীর ছোট ভাই হবে; কিন্তু সেই লোকটি একজন জায়গীরদার মাত্র। জায়গীরদার মানে হ’ল, যে শুধু খায়, থাকে এবং বাড়ীর কাজকর্ম দেখাশোনা করে। আফগানিস্থানে জায়গীরদার হওয়ার সম্মানের বিষয় নয়—সকল সময়ই মাথা নত করে থাকতে হয়। এজন্য পারতপক্ষে কেহ জায়গীরদার হতে রাজী হয় না। জায়গীরদার পৃথক একটা কামরায় থাকেন। অতিথি-অভ্যাগত এলে জায়গীরদার নিজের ঘর ছেড়ে চলে যান না, তার ঘরেই অতিথির থাকবার বন্দোবস্ত হয় এবং তিনিই অতিথির আদর-যত্ন করেন।

 আমার যাবার আধ ঘণ্টা পরেই জায়গীরদার হাতমুখ ধোওয়ার জল দিলেন। একখানা ভাল কার্পেটের ওপর সাদা চাদর বিছিয়ে খাবারের জায়গা করলেন। তারপর ভিতর-বাড়ী হতে যা নিয়ে এলেন দেখে জিহ্বা হতে সহস্র ধারায় জল বের হয়ে আসছিল। কি সুন্দর মোলায়েম ভাত এবং তার পাশেই বড় বড় করে দুম্বার কাবাব। পাঠান বাইরে ছিলেন, তিনি এসেই হাত ভাল করে ধুলেন। হাত ভাল করে ধোওয়া হয় মাটির সাহায্যে। এখনও আফগানিস্থানের সর্বত্র সাবানের প্রচলন হয়নি, এখনও আফগান জাত প্রকৃতির অনুগত; সেজন্যই মাটির সাহায্যেই তারা হাত পরিষ্কার করে। সাবান কখন যে মাটিকে বেদখল করবে, পাঠানদের উপরই তা সম্পূর্ণ নির্ভর করে।

 ক্ষুধার সময় উত্তম খাদ্য পেলে লোকে আকণ্ঠ আহার করে। আমিও তাই করলাম। আহার সমাপ্ত হওয়ার পর পাঠান দেশ-বিদেশের গল্প শোনার জন্য গ্রামের লোকদের ডেকে আনলেন। দেখে আশ্চর্য হলাম, সেই গ্রামে একজন বাঙালীও ঘরবাড়ী বেঁধে স্থায়িভাবে বসবাস করছিলেন। এই ভদ্রলোক ঘরের এক কোণে বসেছিলেন এবং আমাদের দেশের অনেক খুঁটিনাটি প্রশ্ন করতেছিলেন। তাঁর প্রশ্নের উত্তর দিতে আমায় রীতিমত বেগ পেতে হচ্ছিল। শেষটায় উপায়ান্তর না দেখে নিজের ভাষায় বললাম,—যদিও আপনার পরনে কাবুলি পোশাক, পোস্ত ভাষায় অনর্গল কথা বলছেন কিন্তু আপনি আমাকে যে সকল প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলেন, সেই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার মত অভিজ্ঞতা আমার নেই। আমি কলিকাতার বাসিন্দা অথবা একসঙ্গে দু’মাসও কলিকাতায় থাকিনি। সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি অথবা বিপিন পাল মহাশয়ের দর্শন পাওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়নি। তারপর অন্যান্য যে সকল বিপ্লবী-নেতার নাম করলেন তাঁদের নামও শুনতে পাইনি। আমি পাড়াগাঁয়ের লোক। ছিট্‌কে এসে পড়ি একেবারে বেলুচিস্থানে। পল্টনের কেরানীর কাজ করার পর যে সময় পেতাম, সেই সময়ে অন্যান্য শিক্ষণীয় বিষয় নিয়েই সময় কাটাতাম। পল্টনের কাজ শেষ হলে চলে যাই সিঙ্গাপুরে, সেখান থেকেই আমার ভ্রমণ আরম্ভ হয়েছে।

 অন্যান্য লোকের সংগে কথা শেষ করে তাঁর সংগেই পুনরায় কথা বলতে আরম্ভ করি। অবশেষে ভদ্রলোক আমাকে তাঁর বাড়ীতে নিমন্ত্রণ করেন। পাঠান মহাশয়কে সংগে নিয়েই রাত্রে তাঁর বাড়ীতে যাই।

 ভদ্রলোক অবিবাহিত। বাড়ীতে দু’টি লোক কাজ করে। উভয়েই প্রৌঢ়। তাঁর বাড়ী দেখে মনে হ’ল, তিনি একজন ধনী এবং আত্মগোপনকারী। সবই দেখতে হয় কিন্তু উপযাচক হয়ে কিছুই জিজ্ঞাসা করতে নেই। তিনি সেখানে কি করেন, কি করে খরচ চলে—জিজ্ঞাসা করিনি, পাঠান মহাশয়কেও এ সম্বন্ধে কিছুই বলিনি। রাষ্ট্রনীতিক্ষেত্রে সর্বত্র সন্দেহ বিরাজমান, বিশেষ করে যাঁরা বিদেশে লুকিয়ে থাকেন।

 খাদ্যের পরিবেশন আমাদের প্রথাতেই হয়েছিল। খেতে বসে বাঙালী ভদ্রলোক বললেন, “এখান থেকে একটা পথ রুশ-সীমান্তের দিকে চলে গেছে। পায়ে হাঁটার পথ, সাইকেল চালানো অসম্ভব। আপনার সংগে যদি সাইকেল না থাকত, তবে সেই পথ দেখিয়ে দিতাম অথবা সীমান্ত পর্যন্ত সংগে যেতেও চেষ্টা করতাম। ভদ্রলোকের বদান্যতায় সুখী হয়েছিলাম কিন্তু পথের সন্ধান ছাড়া আর কোন কথাই বলা হয়নি।

 পাঠানের বাড়ীতে ফিরে দেখলাম, উত্তম বিছানার বন্দোবস্ত হয়েছে। জায়গীরদার পাশের বিছানায় শুয়ে আছেন। লোকটি বেশ সুপুরুষ। পরে জায়গীরদারদের সম্বন্ধে নানা বিষয় জানতে পেরেছিলাম এবং ভাবতে পারছিলাম না, আফগানিস্থানের মত স্থানে যেখানে আর্য সংস্কৃতির অস্তিত্ব এখনও বর্তমান, সেখানে জায়গীরদার-প্রথা কি করে চলতে পারে। হয়ত অনেকে জিজ্ঞাসা করবেন জায়গীরদারের কাজ কি? এ-সব প্রশ্নের উত্তর দিতে আমি অক্ষম এবং আমার ভাষাজ্ঞানও তত নাই যার মারফতে এ-সব কথা বলতে পারি।

 পরদিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি আবহাওয়া একদম বদলে গেছে। প্রভাত-সূর্য ধোঁয়াটে রংএর মেঘের আড়াল থেকে কোনমতে পৃথিবীর অন্ধকার দূর করছে। বাতাস একদম বন্ধ। তুষারপাত সত্বরই হবে। লক্ষণ দেখে অনুমান করলাম, তুষারপাত শুরু হতে দু’সপ্তাহ লাগবে। এরূপ আবহাওয়া সাইকেলে ভ্রমণের পক্ষে বেশ সুবিধাজনক। প্রবল বাতাসের সংগেই তুষারপাত শুরু হয়।

 সাইকেলটা বাইরে এনে পাঠান এবং তাঁর জায়গীরদারের সংগে করমর্দন করে রওনা হলাম। পথে এসে বুঝলাম পথটা ক্রমেই উঁচু হয়ে চলেছে। একেবারে বেশী দূর যেতে সক্ষম হলাম না। বার বার নামতে হচ্ছিল। যখনই নেমেছি তখনই দূরের পাহাড়ের দিকে চেয়ে তার দৃশ্য দেখছি। সে-সব দৃশ্য চিরদিন আমার মনে আঁকা থাকবে। এই পর্বতমালা আফগানিস্থান হতে শুরু হয়নি, শুরু হয়েছে হিমালয় হতে, এবং শেষ হয়েছে ককেশাসে। পার্বত্য জাতির অনেক স্ত্রী-পুরুষকে নির্ভীক স্বাধীনভাবে পাহাড়িয়া পথে বিচরণ করতে দেখলাম। স্বাধীনভাবে ভ্রমণকারীদের দু’-একজনের সংগে আলাপ হয়েছিল। তাদের কাহিনী শুনে মনে হচ্ছিল, ভ্রমণে যদি রোমাঞ্চ থাকে তবে ভ্রমণেই আছে কত বিচিত্র সে অভিজ্ঞতা। যা’ হোক, বড় পথ দিয়ে চলেছি। ডাকাত আমার মত লোকেরও যদি পিছু নেয়, তবে সে-ডাকাত ডাকাতই নয়—সে চোর অথবা ছেঁচড়। চোর ছেঁচড়ের ভয়ে যারা ভীত, রোমাঞ্চ অনুভব করবার ক্ষমতা তাদের থাকে না।

 আমার পূর্বোক্ত আশ্রয়দাতা পাঠান যা বলেছিলেন তাই সত্য হ’ল। বিকালেও কোন গ্রামের চিহ্নও দেখলাম না, জালালাবাদ আরও কতদূর—কে জানে। চিন্তিত হয়ে পড়লাম। যদি তুষারপাত আরম্ভ হয়, তবে বাইরে থাকা ভয়ানক কষ্টকর হবে। একবার চীনদেশে তুষারপাতের সময় বাইরে ছিলাম। নানারূপ গাছ-গাছড়া থাকায় সেখানে অনেকটা সুবিধা পেয়েছিলাম, কিন্তু এখানে একটি গাছও নেই। অদূরে হয়ত গাছ আছে এই ভেবে তাড়াতাড়ি চলতেছিলাম। একটু দূরে একটা পাহাড়ের উপর উঠে দেখি নিকটেই কতকগুলি গাছ। বাড়ীঘর দেখতে না পেলেও গাছ দেখেই মনে শান্তি এল, শরীরে শক্তি এল।

 এই বৃক্ষরাজি জালালাবাদের না হোক, অন্তত যে-কোন লোকালয়ের অস্তিত্বের সন্ধান দিচ্ছিল। যতই কাছে যাচ্ছিলাম ততই দু’-একখানা করে ঘর দৃষ্টিপথে আসতেছিল। একজন পথিকের কাছে শুনলাম, জালালাবাদ শহরের কাছে এসে পৌঁছেছি। প্রবল বেগে সাইকেল চালিয়ে শহরে পৌঁছলাম।

 শহর শ্রীহীন। লোকজন নেই বললেই চলে। শহরের সামনেই একটি চত্বর। চত্বরটির চারদিকে পাইন বৃক্ষ সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে। দু’টি গাছ এতই সুন্দর যে, দেখলেই পাঠানদের সৌন্দর্য-জ্ঞান আছে মনে হয়। গাছ দু’টি সুন্দর ডালপাতায় সমৃদ্ধ হয়ে ক্রমেই আকাশের দিকে উঠছিল। চত্বরের চারদিকে চেয়ে দেখলাম, ছোট ছোট নালা দিয়ে জল বয়ে যাচ্ছে। জল স্বচ্ছ। স্বচ্ছ জলে মাছ খেলছে, কাউকে ভয় করছে না। মাছ দেখামাত্রই বাঙালীর জন্মগত সংস্কার মাথাঝাড়া দিয়ে উঠল। ইচ্ছা হ’ল মাছ ধরি, কিন্তু মাছ ধরার সরঞ্জাম কোথায়? সুতরাং মাছ দেখেই সুখী হলাম, মাছ ধরে খাওয়ার বাসনাকে দমন করতে হ’ল।

 গাছ এবং মাছের প্রতি আমার খরদৃষ্টি দেখে একজন যুবক আমার কাছে এল। যুবকের পরনে ইউরোপীয় পোশাক। নেকটাইটি বেশ ভালভাবেই আঁটা, মাথায় বোখারার গরম ফেজ। এরূপ ফেজ রুশ দেশে এখনও প্রচলিত আছে। যুবক এসেই আমার জাতি, ধর্ম, নাম, ব্যাবসা ইত্যাদি জিজ্ঞাসা করল। তার সম্বন্ধে আমি কোন কৌতূহল প্রকাশ করি নি। এটা আমার অভ্যাস। যুবককে নিয়ে নিকটস্থ একটা চায়ের দোকানে গেলাম। বলা বাহুল্য, চায়ের দোকানে টেবিল চেয়ার ছিল না। কার্পেট বিছানো ছিল। দলে দলে লোক কার্পেটের ওপর গোল হয়ে বসে চা খাচ্ছিল। নানা ভাষাভাষী লোকের সমাগম দেখলাম। তবে পোশাক তাদের সকলেরই এক রকমের। আমাদের প্রবেশ করতে দেখে কেউ কিছু বললে না। বিদেশী লোক দেখা তাদের অভ্যাস আছে এবং তারা ভাল করেই জানে কোন্ বৈদেশিক কি মতলব হাসিল করবার জন্য তাদের দেশে আসে। ইতালীয়, জার্মানী, জাপানী এবং বৃটিশরাই আফগানিস্থানে বেশীর ভাগ যায়। রুশরা অতি অল্পই আসে, এবং এলেও তারা জালালাবাদের মত শহরে থাকে না।

 দু’ পেয়ালা চা নিঃশেষ করে তৃতীয় পেয়ালায় যখন চুমুক দিচ্ছিলাম, তখন আরও কয়েকজন লোক চায়ের দোকানে প্রবেশ করল। তাদের মাথায় মাশাদী কাপড়ের পাগ্‌ড়ী, পরনে পায়জামা, সার্ট এবং ইংলিশ কোট। দেখেই মনে হ’ল এরা ছাত্র। আমার প্রথম পরিচিত লোকটির সংগে তারা করমর্দন করল, তারপর কাছে বসে ইরানী ভাষায় কথা বলতে আরম্ভ করল। এখানে ইরানী ভাষায় কথা বলা আভিজাত্যের লক্ষণ। এদিকে ছাত্র-সমাজে এখনও ফরাসী ভাষার প্রচলন রয়েছে। দু’-একজন দেখা যায় যারা পোস্ত এবং হিন্দুস্থানীই বলে বেশী। হিন্দুস্থানীয় অপর নাম উর্দু। উর্দু শব্দের মানে মিশ্রিত। মিশ্রিত ভাষার প্রচলন এখানে বেশ আছে। আমিও মিশ্র ভাষাতেই কথা বলছিলাম। তবে লক্ষ্ণৌয়ে যে মিশ্র ভাষা ব্যবহার হয় এখানে তার প্রচলন নাই।

 ইউরোপীয় পোশাক পরিহিত যুবকটি ধর্মে হিন্দু। হিন্দুরা চার ভাগে বিভক্ত—সনাতনী, আর্যসমাজী, নানকপন্থী এবং শিখ। শিখ এবং নানকপন্থীদের মধ্যে প্রভেদ আচার-ব্যবহারেই—ধর্মের দিক দিয়ে কোন প্রভেদ নেই। নানকপন্থীরা দাড়ি-গোঁফ, হাতে লোহার বালা এবং নেংটি ও কৃপাণ ব্যবহার করে না। শিখরা ধূমপান করে না, কিন্তু তারা সেটি-ও করে। আফগানিস্থানে আর্যসমাজীরা অপ্রকাশ্যেই থাকতে ভালবাসেন, সেজন্য তাঁদের প্রকাশ্যে কোন শ্রেণী নেই—তাঁরা সনাতনীদেরই অন্তর্ভুক্ত। ভেতরে ভেতরে কিন্তু সনাতনী এবং আর্যসমাজীদের মধ্যে এত বিবাদ যে, আমাদের দেশে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যেও তত বিবাদ নেই। এই বিবাদের একমাত্র কারণ হ’ল, আর্যসমাজীরা জাতিভেদ মানে না এবং বিধবা বিবাহ করে। বিধবা-বিবাহ এমনিভাবে প্রচলিত যে, তিন-চার সন্তানের জননীরও এরা পুনরায় বিবাহ দেয় এবং অতি বৃদ্ধ বিধবা ছাড়া অন্য বিধবার মুখদর্শনই পাপ বলে গণ্য হয়। এতে আর্যসমাজীদের সংখ্যা বেড়েই চলছে, আর সনাতনীরা সংখ্যালঘিষ্ঠে পরিণত হচ্ছে।

 চায়ের দোকানে বসে কথা বলা নবাগত যুবকগণ পছন্দ করছিল না। ছোট চায়ের দোকানে বসে গোপন কথা বলা-কওয়া চলে না। নবাগত যুবকদের একজন তাঁর বাড়ীতেই আমাকে নিয়ে যাওয়া সঙ্গত মনে করল। আমরা কাফিখানা পরিত্যাগ করে শহরের দিকে চললাম। একটি ছোট বাজারের ভেতর দিয়ে যেতে হ’ল। কতকগুলি হিন্দু দোকানী বেচা-কেনা করছিল। তাদের শুধু দেখেই গেলাম, কিন্তু কথা বলতে ইচ্ছা হ’ল না। তা বলে আমার হিন্দুপ্রেম ছিল না—একথা বলা চলে না।

 পাঠান ছেলেটি আমাকে তার বাড়ীতে একটি রুমে বসাল। রুমখানা ছোট হ’লেও সজ্জিত। একদিকে একটি কাঠের বাক্সের উপর কয়েকখানা বই পড়েছিল, কোরানখানাও সযত্নে কাপড় দিয়ে বেঁধে একটি ছোটখাট তাকে রাখা হয়েছিল। ঘরে একখানাও টেবিল-চেয়ার ছিল না। ঘরের ঠিক মধ্যস্থলে একটি ছোট গর্ত, তাতে রাত্রে সামান্য পরিমাণ কাঠকয়লার আগুন জ্বালানো হয় এবং যদি বেশী শীত পড়ে, তবে বিছানাটা টেনে নিয়ে তারই কাছে শুতে হয়।

 যুবক তার বাবাকে ডেকে আনল। তিনি আমাকে কয়েকটি কথা জিজ্ঞাসা করেই বাইরে গেলেন। বুঝলাম ভোজনের বন্দোবস্ত হবে এবং অনেকে নিমন্ত্রিতও হবে। খরচ হবে অনেক এবং যুবককে আমার বক্তব্য বলতে পারব না, সেজন্য তাকে বললাম, “তোমার বাবাকে ফিরিয়ে নিয়ে এস, পুরাতন প্রথায় অতিথিসেবা মোটেই পছন্দ করি না।” যুবকের বাবা ফিরে এলেন এবং আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন—রুটি কি ভাত খেতে ভালবাসি। ভাতই পছন্দ করি জানালাম। এতে তিনি সুখী হলেন। যুবকের পিতা চলে গেলে যুবক চা (চাই) নিয়ে এল এবং সকলকেই চা খেতে দিল। তারপর ভ্রমণ-কথা বলতে আরম্ভ করলাম।

 সুখের বিষয়, ছাত্রেরা কখনও জিজ্ঞাসা করেনি, ক’টা বাঘ একসংগে আমাকে আক্রমণ করেছিল; ডাকাতের দল পথে ওৎ পেতে বসে রয়েছিল কিনা? তারা জিজ্ঞাসা করেছিল চীন দেশের ছাত্রদের কথা; জাপানীরা কি সত্যিই হারিকিরি করে নিজের সম্মান, দেশের এবং রাজার সম্মান বাঁচাবার জন্যে? নতুন ধরনের নতুন প্রশ্ন। জন্মের পর হতেই এরা শুনছে রাষ্ট্র-বিপ্লবের কথা। এরাও মহৎ উদ্দেশ্যে মরণকে বরণ করতে পশ্চাৎপদ হয় না। বাঘের কথা, ডাকাতের কথার মত তুচ্ছ বিষয় নিয়ে প্রশ্ন করার মনোবৃত্তি তাদের ছিল না। জাপানীরা কেন হারিকিরি করে, সে বিষয়েই চিন্তা করছিল। যখন শুন্‌ল হারিকিরি হ’ল এক প্রকার পাগলামি, তখন তারা শান্ত হ’ল।

 ভ্রমণ-কথা কিছুটা বলার পরই স্থানীয় হিন্দুদের কথা উত্থাপন করলাম। একজন বললে, এরা আজব লোক। সকল সময়ই এদের পরমার্থিক চিন্তা এবং কি করে গ্রামকে গ্রাম করায়ত্ত করা যায় তারই চেষ্টা। এরা কখনও কূটনীতিতে যোগ দেয় না, যখনই যিনি রাজা হন তাঁরই আনুগত্য স্বীকার করে। গতানুগতিক অবস্থার ব্যতিক্রম ভাবতেও পারে না। সরকারী বেঙ্কের অর্ধেক অংশ হিন্দুদেরই। যত জমি দেখতে পাবেন, সবটারই মালিকানা স্বত্ব তাদের, অথচ তারা নিরীহ এবং সকলকেই ভয় করে চলে।

 আমাদের দেশের নবাব সিরাজের কথা এখনও লোকে বলে; এমন লোকও আছে যারা সিরাজের জন্য চোখের জলও ফেলে। তারপর যারা আরও একটু উচ্চস্তরের, তারা পঞ্চ ব্রাহ্মণ, লক্ষ্মণ সেন, বল্লাল সেন—এদের কথা বলে আসর গরম করে তোলে। আমার জন্ম ও শিক্ষা-দীক্ষা সেই সমাজেই। সামাজিক দোষগুণ হতে তখনও রেহাই পাই নি। সেজন্যই বোধ হয় রাজা আমানউল্লার কথা এদের কাছে জিজ্ঞাসা করতে বড়ই ইচ্ছা হয়েছিল; কিন্তু এরা কোন রাজার কথা একবারও বললে না। এদের রাজভক্তি এবং প্রজাসুলভ বশ্যতার ভাব নেই, এরা নিজেরাই যেন এক-একজন রাজা। অথচ যখনই কোন স্বদেশবাসীর সংগে আফগানিস্থানে দেখা হয়েছে, তখনই তিনি রাজাদের চৌদ্দপুরুষের ইতিবৃত্ত বলতে কসুর করেন নি। আমি এই যুবকদের কাছে সেরূপ কিছুই না শুনে একটু দুঃখিত হয়েছিলাম। আমাদের দেশে রাজতন্ত্রের মহিমা প্রচারের জন্যে ‘দিল্লীশ্বরোবা জগদীশ্বরোবা’ কথাটা সৃষ্টি হয়েছিল; অতএব আমার মত লোক সেই ধুয়ার জের না টেনে যায় কোথায়? নিজের দেশে যদি রাজা না থাকে, তবে অপরের দেশের রাজার কথা শ্রবণ করেও আমাদের আনন্দ হওয়ার কথা।

 পর্যটকের কাজ হল, এক দেশের সংবাদ অন্য দেশে বহন করে নিয়ে যাওয়া। এখানে সংবাদ পাওয়ার বদলে সংবাদ দিতেই হ’ল, সংবাদ পাওয়া গেল না। অনেক চেষ্টা করেও জানতে পারলাম না, আমানউল্লা কি করে দেশত্যাগী হয়েছিলেন। এমন কি বাচ্চা-ই-সিক্কা কোথায় কিভাবে হত হয়েছিলেন, তাও তারা বললে না। বাধ্য হয়েই অন্যান্য কথা নিয়েই সময় কাটাতে হ’ল। সেই কথাগুলির মধ্যে বোখারার একটি বিশেষ ঘটনা এদের কাছ থেকেই শুনেছিলাম।