পনর

 দেওঘরে রইলুম আঘাতে আঘাতে মূক অবশ ক্লান্ত মন প্রাণ নিয়ে। জীবনে যেন আর আঁট নেই, কোন লক্ষ্য নেই, একটা নির্দ্দিষ্ট গতি নেই। কার জন্যে কিসের জন্যে বেঁচে থাকা—জীবনের হাট জমানো, সুখসাধের ঘর বাঁধা? কোন একটা বড় আদর্শ বা লক্ষ্য তখনও জীবনকে আচ্ছন্ন ও আপাদ মস্তক দীপ্ত উজ্জ্বল করে জাগে নি। আদর্শ তখন যাও বা ছিল তা হচ্ছে স্বপ্ন—নিছক মানস তেমনি অলীক ও অস্পষ্ট, কাজে ফলাবার সুস্পষ্ট পথ নয়। সে সব স্বপ্নই গুঞ্জন করে একটি লাবণ্যমাখা মধুমাখা মানুষকে ঘিরে, আমার সাধ আশা তার নীড় রচনা করে আর একজনের চোখের নিবিড়তায়, আমার লক্ষ্যের সে অস্পষ্ট, মিলিয়ে যাওয়া পথরেখা উধাও হয় কার যেন রক্ত পদপল্লবটি ছুঁয়ে তারই কুঞ্জ দুয়ার অভিমুখে। একজন সঙ্গিনী হয়ে পাশে না বসলে জীবন-বীণা আমার বাজে না, রাঙা পা দুখানির সোণার কাঠি আমার বুকে সে না দিলে বুকের দীঘি ভরে পদ্ম ও কুমুদ ফোটে না। এ আমার কি হ’লো? আর এক জনকে না নিয়ে কি ছাই আমার চলার উপায় নেই? তাই যদি হ’লো তবে যাকে চাই তাকে পাই নে কেন? একি বিড়ম্বনা!

 দাদাদের টাকা আর নেব না, লেখাপড়া যখন ছেড়েছি তখন নিজের উপার্জ্জন নিজে করবো এই গোঁ ধরে আমি দেওঘরেই তিনটে প্রাইভেট টিউশনী নিলুম। মেজদা প্রতিশ্রুতি দিয়ে কথা রাখলেন না, এই অভিমানে আমার এলো স্বাবলম্বী হবার একরোখা গোঁ,—প্রাইভেট টিউশনী করে টাকা জমিয়ে নিজের খরচে আমার দিবাস্বপ্নের কৃষি-কুটীরটি গড়বো একদিন, এই হলো আমার জেদ। সকাল সন্ধ্যা তিন জায়গায় ছেলে পড়িয়ে আমি পেতুম মাত্র ২৮৲ টাকা; খাই খরচের জন্যে দিদিমার হাতে দেবার কথা হ’লো পনর, বাকি টাকা জমা হবে ডাকঘরের সেভিংস্ ব্যাঙ্কে। বোধ হয় একমাস এই মাথার ঘাম পায়ে ফেলে রোজগার চলেছিল। তখনও দিদিমাকে এক পয়সাও দিই নি, সব টাকাটাই ডাক ঘরের পাশ বইএ জমার অঙ্ক মোটা করে শোভা পাচ্ছে। আর আমার আশার পূর্ব্বাচল আলোয় আলোয় রঙীন করে তুলছে। এমন সময় আবার জীবনে আঁধি নিয়ে বিদ্যুৎ হেনে বাজ ডেকে ঝড় উঠলো।

 তার কিছু আগে আমার ভালবাসার সেই মেয়েটি আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেওঘরে এসেছে। দেখা আমাদের বড় একটা হ’তো না, কারণ তার মায়ের সতর্ক দৃষ্টি এড়িয়ে দু’জনে একান্ত হবার কোন উপায়ই আর ছিল না সেই কলকেতার ছাদের ঘটনার পর। তাই রোজ আমি লুকিয়ে একটা করে চিঠি দিতুম আর একটা করে তার মধুমাখা উত্তর পেতুম। সে লিখতো নিতান্তই সাদাসিধে চিঠি, তার গদ্যময় মোটা মনের সহজ ভাষায় একটু আদর সোহাগের চিনি মাখিয়ে চলনসই মিঠে করে লেখা দশ বারটি লাইন। তারই প্রতি ছত্রে প্রতি বর্ণে আমার চোখে কি মধুই যে ঝরতো, বার বার তাই পড়ে চোখের জল রাখতে পারতুম না। এই সময় আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছিলুম দু’জনে পরস্পরের জন্যে আজীবন চিরকৌমার্য্য নিয়ে আশা পথ চেয়ে থাকবো, একটি সুদূর ভবিষ্যৎ মিলনের সুদিনের প্রতীক্ষায়। এই চিঠির একখানি একদিন দৈবাৎ ধরা পড়ে গেল।

 কাপড় ছাড়তে গিয়ে স্নানের ঘরে সে বুঝি ফেলে এসেছিল আঁচলের খুঁটে বাঁধা চিঠি। মুখ অন্ধকার করে তার বাপ এসে আমায় যৎপরোনাস্তি তিরস্কার করলেন, তার চিঠিগুলি ফিরে চাইলেন। আমি তখনই পোষ্ট অফিস থেকে টাকা ক’টি তুলে নিয়ে আমার ঘর-ছাড়া নিরুদ্দেশ যাত্রার পথে পা বাড়ালুম। যাবার সময় বড় মামাকে লিখে গেলুম—আমায় যেন খোঁজা না হয়, কারণ আমি ইহা জীবনে আর ঘরে ফিরবো না। আস্‌রফিয়াকে নিয়ে জসিডি ষ্টেশনে গিয়ে প্রথমে আপ ট্রেনে শিমুলতলায় নামলুম, যাতে কেউ খুঁজতে এলে আমাকে না পায়। তার পর আবার ডাউন ট্রেনে করে যাত্রা করলুম বর্দ্ধমানের পথে। যদি কেউ খোঁজে কলকেতার পথেই খোঁজ করবে, এই ছিল আমার ধারণা, অথচ আমার মত বাঁধন ছেঁড়াকে খুঁজবে যে না কেউ তা’ ঠিক ভেবে উঠতে পারি নি।

 রাঙা মা আমার তখন বর্দ্ধমানে একটি বাড়ী ভাড়া করে আছেন। সঙ্গে আছে বন্ধু সুরেন। মা তো আমাকে পেয়ে আকাশের চাঁদ হাতে পেলেন, তখনই প্রতিশ্রুতি দিলেন তাঁর দপ্তরি পাড়ার বাড়ী বেচে আমায় কৃষির জন্যে টাকা দেবেন। এই বর্দ্ধমানে একমাস থাকার পর কলকেতায় মেসে এসে উঠলুম যোগাড় যন্ত্র করে মায়ের বাড়ীথানি বিক্রমপুরে দেবার উদ্দেশ্যে। এই দুঃসাধ্য সাধন করে তুলতে সুরেনের ও আমার কয়েক মাস লেগেছিল। সুরেন থাকতো কলেজ স্ট্রীট Y. M. C. Aতে আর আমি থাকতুম ওরই কাছে কর্ণওয়ালিস ষ্টীটের এক মেসে। হাতে টাকা নেই, উপার্জ্জন নেই, সহায় সম্বল কিছু নেই এই নির্ব্বান্ধব কলকেতার জনারণ্যে। নীচে য়্যাণ্ড্রু ইউল কোম্পানি সেই প্রথম এক পয়সা কাপের চায়ের দোকান খুলেছে আর তার পাশেই ব্রজেন দত্তের ষ্টুডেণ্টস্ লাইব্রেরী।

 ছেলে বেলা থেকে ধুঁইয়ে ধুঁইয়ে “মিনার” নাম দিয়ে একটা উপন্যাস লিখেছিলুম, ষ্টুডেণ্টস্ লাইব্রেরীর এই ব্রজেন বাবু সেখানা ছাপাবার ভার নিলেন। সে বই যখন বেরুল তখন আমি কোথায় তা এখন আর মনে নেই, সে ছেলেমানুষী লেখা খেলো বই কখন কেউ দেখেছে বা বিক্রী হয়েছে বলে মনে হয় না। এই সময়টা কলকেতায় আমার বড় দুঃস্থ অবস্থায় কাটে। অর্থোপার্জ্জনের কোন উপায় নেই, সংস্থান নেই, সে রকম কোন শিক্ষা দীক্ষাও নেই; খবরের কাগজে wanted columnএ চাকরী খালি দেখে দরখাস্ত করছি আর মেসের ভাত খাচ্ছি। দু তিন মাসের টাকা মেসে দেনা জমে গেল, ম্যানেজার মুখ অন্ধকার করে তাগাদা জানাতে লাগলেন। কোন উপায় না দেখে আমি গেলুম উডল্যাণ্ড্‌সে কুচবিহারে রাজবাড়ীতে রড়দা’র কাছে। বড়দা আমার দুঃস্থ অবস্থার কথা শুনে বললেন, “আচ্ছা, অমুক দিন আসিস্, যা পারি দেব।” সেই ক’দিন ম্যানেজারের সামনে না পড়ে দিন কাটানো ভার হয়ে উঠলো, নীচে চায়ের দোকানে চা খাওয়া আর রাস্তায় রাস্তায় ঘোরা ছাড়া উপায়ান্তর রইল না। নির্দ্দিষ্ট দিনে ভোর আটটায় গিয়ে দেখি দাদা ঘুমচ্ছেন, আমাকে দেখে বালিসের তলায় হাত দিয়ে ত্রিশ না চল্লিশ টাকার নোট বার করে দিলেন, বললেন, “এখন এই নে, তারপরে আবার দেব।” আমায় রাজ পরিবারের টেবিলে খেতে বললেন, লাজুক আমি তাঁর ঘরে বসেই একটা অমলেট আর রুটি মাখন খেয়ে নিলুম। এই সময় মনে আছে আলিপুরের ব্রীজের কাছ থেকে একটা জসকালো ফিটন গাড়ী ভাড়া করে তাই হাঁকিয়ে ষ্টাইলের উপর গিয়ে দাঁড়াতুম রাজপ্রাসাদের গাড়ী বারাণ্ডায়, তাই দেখে চাপরাস বাঁধা দরোয়ান ও বয়রা ছুটে আসতো এবং খুব খাতির করে আমাকে বসিয়ে দাদাকে খবর দিত। অথচ সমস্ত পথটাই গেছি হেঁটে বা ট্রামে হটর হটর করে, ফিটনের ভাড়া দিয়েছি চার আনা। তারপরে হেঁটে গিয়ে দেখেছি দাদার নিজের চাকর ছাড়া আর কেউ ছুটেও আসে না, খাতিরও করে না। বড় লোকের বাড়ীর এই কায়দায় ওরা কখন কখন খুবই বেকায়দায় পড়তে পারে কারণ রোণাল্ডশের মত লাট সাহেবও তো একদিন পদব্রজে এসে দেখা দিতে পারেন। মহাত্মাজী এলে বোধ হয় হাজার করা নয়শ নিরানব্বইটা বড়লোকের বাড়ীতে গলাধাক্কা খান যদি সঙ্গে হোমরা চোমরা লেজুড়গুলি না চলে। তবে সৌভাগ্য ক্রমে মহাত্মাজীর মুখটা সবারই চেনা, এই যা রক্ষে।

 আমাদের দেশের সভ্যতায় এ কৃত্রিম বড়মানুষীর জিনিসটা কিছু এমন কদর্য্য ভাবে ছিল না, কারণ এদেশে চির দিনই রাজরাজড়ার ঘরে পূজা পেয়ে এসেছে সাধু; ল্যাঙটা ফকির ও সাদাসিধে পণ্ডিত, কবি ও চিত্রকর। পূর্ব্ব যুগে অষ্ট অলঙ্কারে ছত্র চামরে সেজে দরবারে বসার সময় পর্য্যন্ত রাজাও থাকতেন প্রায় ঐ মহাত্মাজীরই মত বেশে। অন্ততঃ অজন্তা ইলোরার পাথরে কাটা মূর্ত্তিগুলিতে ঐ রকমই স্নিগ্ধ শুচি একটি নিরাভরণ সৌম্য বেশের পারিপাট্যই দেখতে পাই। কৃত্রিম বিশাস আরম্ভ হ’লো মোগলাই আমল থেকে, তবু তারও মধ্যে ছিল একটা চারু শিল্পের ললিতস্পর্শ ও মানুষের গরিমার ছবি। প্রফুল্লের রাণী গিরির ঠাটের মত তা’তে মন প্রাণ হৃদয় শক্তির মহিমায় ও লাবণ্যে মুগ্ধ করে দিত, মানুষের অন্তরেরই বিভূত্তি ও ঐশ্বর্য্যের হচ্ছে ও-গুলি যেন খুব সহজ সুন্দর বহিঃ প্রকাশ। অহঙ্কার বা বৃথা ধন গর্ব্বের আড়ষ্ট ও কুৎসিৎ ভঙ্গী তাতে ছিল না বললেই হয়। নিছক মূদ্রা রাক্ষসের আসুরিক পূজারী তখনও মানুষ পূরো মাত্রায় হয় নি। এটা একেবারে আধুনিক ইঙ্গবঙ্গ ধারা।

 দাদার কাছে টাকাটা পেয়ে আমি মেসের পাওনা চুকিয়ে তবে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলুম, এত দিন পর ম্যানেজারের সামনেই আবার বুক ফুলিয়ে সহজ মানুষের অসঙ্কোচ ভাবে আসা যাওয়া করা সম্ভব হয়ে উঠলো। কিন্তু মেসের ঋণ পরিশোষ করে যৎসামান্য টাকাই হাতে রইল, তা দিয়ে টেনে-টুনে আর এক মাস চালানো যেতে পারে। তার পর? তার পর যে কি হবে তা’ দেখে চলা আমার জীবনে আজ অবধি তো হ’লো না, সংসারীর হিসেব করে চলা বুঝি বিধাতা পুরুষ কুষ্টিতে লেখেনই নি। এক একবার একটা না একটা ঘটনার ধারা বছর কয়েক ধরে জীবন নটমঞ্চ জুড়ে চলেছে, তারপর যখন পালা সাঙ্গ হয়ে এসেছে তখন হঠাৎ পূর্ণচ্ছেদ টেনে দিয়ে কালো যবনিকা নেমে এসেছে। তারপর আবার হাট জমিয়ে দর্শকের মন প্রাণ হরে নিয়ে যে কি খেলা আরম্ভ হবে—কোন্ নতুন পালার মহলা চলবে তা’ আমি আগে থেকে কখন বুঝতে পারি নি।

 ভেবেছিলুম করবো কৃষি কিন্তু হয়ে পড়লুম দোকানদার সেই ইতিহাস এবার বলতে বসছি। মায়ের বাড়ীখানি তিন হাজার আড়াই হাজারে বিক্রি না করেও আর উপায়ান্তর ছিল না, কারণ, মা ঋণ করে একতলা বাড়ীকে দোতলা করেছিলেন, সেই ঋণ এতদিন ধরে গোকুলে কেষ্ট ঠাকুরটির মত চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ছিল। এমন ঋণ আছে যার আসল তবু হয়তো না খেয়ে দেয়ে কখনও বা পরিশোধ করা যেত যদি সুদেরও পার পাওয়া যেত; সুদের সুদ, তার সুদ এবং সবগুলি অচিরাৎ আসলে পরিণত হয়ে আবার তার সুদ, এবম্প্রকার ছারপোকার বংশকেই মেরে উচ্ছন্ন করতে গৃহস্থ নাকের জলে চোখের জলে এক হয়, কাজেই তার পক্ষে আসলের কাছেও ঘেঁষা দায় হয়ে উঠে। দেশ যদি কখন স্বাধীন হয় তা’ হলে কাবুলী বেণে ও মহাজনরূপ রক্তশোষক জানোয়ারগুলি যাতে সুন্দরবনের নরখাদক বাঘের মত ক্রমে নির্ব্বংশ হয়ে আসে সে চেষ্টা বিধিমতে করতে হবে। ভ্যাম্পায়ারের মত মানুষকে দরিদ্র ও বিপন্ন দেখলেই সে মানুষের করবে রক্ত শোষণ—তার দৈন্যকে করবে নিজের অর্থ-লালসার ব্যবসার পুঁজি, এর চেয়ে ঘৃণ্য ও নিষ্ঠুর ব্যাপার আর কি আছে? বাঘের মত ধরে নখে ছিঁড়ে পাঁচ মিনিটের মধ্যে উদরসাৎ করা এর চেয়ে ঢের কম নির্ম্মম। য়ুরোপে Inquisition এর যুগে যত রকম যন্ত্রণা দেবার যন্ত্র ও উপায় ছিল তার মধ্যে ছিল একটা পাথরের ঘর। অপরাধীকে তার মধ্যে পুরে রাখলেই তারই চোখের ওপর শনৈঃ শনৈঃ সেই দুয়ার জানলা হীন ঘরের চারটি নিরেট দেয়াল সরে সরে ছোট হয়ে আসতো, তারপর সেই ক্রম অপরিসর জায়গায় আটকা পড়ে একটুখানি বাতাসের অভাবে খাবি খেতে খেতে সে বেচারী কি ভাবে চেপ্টে পিষে যেত সেই নিষ্ঠুর দেয়ালের চাপে তার ভয়াবহত্ব কল্পনায় সামান্য মাত্র অনুভব করা যায়। কুসীদজীবী মহাজন বা সুদখোর কাবুলীর চক্রবৃদ্ধি হারে বাড়ন্ত ঋণের চাপে পড়ে স্ত্রী-পুত্র নিয়ে মানুষের ঠিক তেমনি অবস্থাই হয়। তার মনের শান্তি যায়, চোখের নিদ্রা যায়, ক্ষুধা তৃষ্ণা যায়, মান সম্ভ্রম যায়, বাস্তুভিটা যায়, শেষে ছেলেপুলের হাত ধরে দেশান্তরী হতে হয় যদি তার আগে শ্রীঘর না অদৃষ্টে জোটে। মানুষের ধারণা বিধাতার জীবজগতে সে-ই সকলের শ্রেষ্ঠ উন্নত সৃষ্টি, কিন্তু একথাও ঠিক যে ক্রূরতায় বুদ্ধিজীবী সে পশুকেও পরাস্ত করেছে। মানুষ হয়তো সত্য সত্যই শ্রেষ্ঠ, খুব উঁচু শিখরের গায়েই পাতালপুরীর মত নীচু খাত ও গহ্বর থাকে।