আমার খাতা/আমার বাল্যজীবন
আমার খাতা।
আমার বাল্যজীবন।
প্রথম পরিচ্ছেদ।
অতি শৈশবে সামান্যমাত্র বুদ্ধির বিকাশ যখন হইয়াছে, তখন আমি আমার পিতার এড়েঁদহ কামারহাটিস্থ গঙ্গার ধারের বৃহৎ বাগানে বাস করিতাম, সুতরাং ঐ স্থান আমার শৈশবের লীলাভূমি ছিল। সেখানকার প্রত্যেক গাছপালার সহিত আমার শৈশবস্মৃতি জড়িত আছে। আমার সেই বাল্যকালের স্মৃতি এখনও আমার মনকে ব্যথিত ও আনন্দিত করে। আমার বাল্যকালের যে স্মৃতি হৃদয়ে আবদ্ধ রহিয়াছে, সেটুকু আমার সঙ্গেসঙ্গেই চলিয়া যাইবে। সেইজন্য বাল্যকালের কথা কিছু লিপিবদ্ধ করিয়া রাখিয়া যাইবার ইচ্ছা মনে অনেক দিন হইতে হইয়াছিল। এত দিনে তাহা কার্য্যে পরিণত হইল। আমি শৈশবে দুর্ব্বল, ভীত ও কৃশ ছিলাম এবং কঠিনকঠিন রোগ ভোগ করিয়া স্নায়বিক দুর্বলতাও জন্মিয়াছিল, কিন্তু আমি বড় চিন্তাশীলা ছিলাম, আমার পাঁচ বৎসর বয়সের কথা বেশ মনে আছে। আমি গাছের ফুল দেখিয়া অবাক্ হইয়া চাহিয়া থাকিতাম, সুন্দর ফুল চিত্রবিচিত্র প্রজাপতি ও ছোট ছোট পাখীদের বড় ভালবাসিতাম। শৈশবে ইহারাই আমার সঙ্গী ছিল; আমি প্রত্যহ বৈকালে দাসীর সহিত বাগানে বেড়াইতে যাইতাম ও সযত্নে কুসুম চয়ন করিয়া গঙ্গার ধারে সোপানের উপর বসিয়া কি যে আনন্দলাভ করিতাম তাহা আর কি বলিব। উর্দ্ধে দিগন্ত বিস্তৃত আকাশ, নিম্নে ফলফুলসুশোভিত উদ্যান, সম্মুখে ধীরপ্রবাহিনী গঙ্গা, আমি এই সৌন্দর্য্যের মধ্যে আত্মহারা হইয়া বসিয়া খাকিতাম। পরে একটি একটি করিয়া ফুল গঙ্গাবক্ষে ফেলিতাম। ফুলগুলি নাচিতে নাচিতে যাইত, ভাবিতাম, ফুল কোথায় যাইতেছে, আকাশের দিকে চাহিয়া কি একটা ভাবে মোহিত হইতাম। আমার রাশীকৃত খেলনা ছিল। মেয়েরা রাঁধাবাড়া ও বৌ-বৌ খেলে, আমি কখনও সে খেলা করি নাই, পাড়ার মেয়েরা যদি কখনও আমাকে খেলিবার নিমিত্ত অনুরোধ করিত, আমি একেবারে লজ্জায় মৃতপ্রায় হইতাম, তাহারা এক হাত ঘোমটা দিয়া গৃহিণীর ভান করিয়া খেলিত। তখন আমি আস্তে আস্তে সেখান হইতে সরিয়া যাইতাম, পাড়ার মেয়েরা আমায় বড় ভালবাসিত, তাহার মধ্যে ঘোষালদের একটি মেয়ের। সহিত আমার বড় ভাব ছিল। মেয়েটি সুন্দরী ও নোগা ছিল। সে প্রত্যহ দ্বিপ্রহরের সময় আমাদের বাড়ী আসিত। একদিন সে অন্য মেয়েদের সঙ্গে খেলায় যোগ না দিয়া আমাকে জিজ্ঞাসা করিল, ভাই, তোমার কি খেলা ভাললাগে? আমি ত কিছুক্ষণ ভেবে কিছুই ঠিক্ করিতে পারিলাম না। তথাপি তাহাকে সন্তুষ্ট করিবার নিমিত্ত বলিলাম আমার ফুল-খেলা ভাললাগে। এস ভাই আমার খেলনাগুলিকে ফুল দিয়া সাজাই। তখন সে ফুল তুলিয়া আনিল ও তাহাতে আমাতে পুতুলগুলিকে ফুল দিয়া সাজাইলাম। সেই দিন হইতে সে আমায় ফুল তুলিয়া মালা গাঁথিয়া দিত। সে যতক্ষণ আমার কাছে থাকিত এই তার খেলা ছিল। পরে বাড়ী গিয়া সে তাহার একখানি ছোট ঘরে হাঁড়িকুঁড়ি লইয়া রাঁধাবাড়া খেলা করিত। একদিন তাহার বাড়ী গিয়া দেখি, সে বিবস্ত্রা হইয়া খেলা করিতেছে দেখিয়া বলিলাম, ছি ভাই, কাপড় না পরিয়া কেন খেলা করিতেছ? এই কথা বলিয়াই আমার মনে এত কষ্ট হইয়া ছিল যে শত-চেষ্টাতেও তাহার সহিত কথা কহিতে পারি নাই। পরে বাড়ী আসিয়াও বারবার, সেই কথা মনে হইয়াছে। পরদিন সে আমাদের বাড়ী আসিলে তাহার নিকট ক্ষমা চাহিয়া তবে আমার মন স্থির হয়, আমার একটু সামান্য দোষ হইলে মন এত খারাপ হইত যে, সারাদিন তাহার জন্য মনের বিষন্নতা দূর হইত না। যদি কাহারও দুঃখের কথা শুনিতাম বা দেখিতাম, তাহা হইলে নির্জ্জনে বসিয়া ভয়ে ভয়ে কাঁদিতাম, পাছে কেহ দেখিতে পায়। আমার এই ভাব দেখিয়া মা বলিতেন, আমার এ মেয়ে বোধহয় পাগল হইবে। আমার ভাই বা বোন কেহ কোন দোষ করিলে তাহা আমার উপর আসিয়া পড়িত, কারণ আমি কোন কথার প্রতিবাদ করিতাম না, আমাকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করিলে কান্না ছাড়া আর আমার কিছুই সম্বল ছিল না। সেই জন্য আমার নাম ছিঁছকাঁদুনে হইয়াছিল, সুতরাং মা মনে করিতেন যে যত কিছু অকার্য্য আমার দ্বারাই সম্পন্ন হয়।
দাদা চঞ্চলপ্রকৃতি ছিলেন। প্রায়ই মার সংসারের আবশ্যক সকল দ্রব্য লোকসান করিয়া ফেলিতেন, আর তিরস্কার ও প্রহার আমার উপর দিয়াই যাইত,—দাদার অসাবধানতার ফল আমাকেই ভোগ করিতে হইত। আমি মনকে প্রবোধ দিতাম যে, আমি ত অপরাধ করি নাই, ঈশ্বর জানেন, দাদার কথা মা জানিলে দাদাকেই ত মা তিরস্কার ও প্রহার করিতেন, এই আমার একমাত্র সান্ত্বনা ছিল, যখনকার কথা বলিতেছি, তখন আমার বয়স আন্দাজ ৬ কি ৭ বৎসর তখন আমি বর্ণপরিচয় প্রথম ভাগ শেষ করিয়া দ্বিতীয় ভাগ পড়িতাম।
একদিনের ঘটনা। পূর্ব্বেই বলিয়াছি আমার মা সুগৃহিণী ছিলেন। তিনি একটা বাক্সো করিয়া ভাণ্ডার হইতে কিছুকিছু প্রয়োজনীয় দ্রব্য উপরে আনিয়া রাখিতেন। একদিন শীতকালে সকালে সেই বাক্সোর উপর দাদা উঠিয়াছিলেন, যেমন তাহা হইতে অবতরণ করিতে যাইবেন অমনি ইটের উপর বসান বাক্সো ইট হইতে সরিয়া যায় ও তন্মধ্যস্থ নারিকেল তৈল পড়িয়া যায়। দাদা সেখান হইতে আসিয়া আমার কাছে বলিলেন, আয় না, আমরা একটা খেলা করি, দাদা আমাকে খেলিতে ডাকিলেই ভয়ে আমার হৃৎকম্প হইত; কারণ দাদার দৌড়াদৌড়ি ভিন্ন অন্য খেলা ছিল না। আমি ভয়ে ভয়ে দাদার অনুসরণ করিলাম। দাদা ঘরের ভিতর যাইয়া খাটের উপর উঠিয়া একখানি জামেয়ার লইয়া তাঁহার ও আমার গায়ে জড়াইয়া দিয়া আমার কনিষ্ঠা ভগিনী সুষমাকে বলিলেন, তুই আমাদের ছুঁতে আয়, আমরা পালাই, সুষমা যেমন আমাদের ছুঁতে এল, অমনি দুএক পা সরিতে না সরিতেই আমরা জামেয়ার জড়াইয়া পড়িয়া গেলাম ও আমার কপালের কিয়দংশ ফুলিয়া উঠিল। দাদা আমার হাত ধরিয়া তুলিয়া বলিলেন, হাস, হাস; হাসি কি ছাই আসে। তখন চোখ দিয়া ঝর্ ঝর্ করিয়া জল পড়িতেছে, অনেক কষ্টে চোখের জল মুছিয়া স্থির হইয়া বসিলাম ও বলিলাম, আমার কপাল যে ফুলেছে। মা জিজ্ঞাসা করিলে কি বলিব, তখন দাদা বলিলেন, বলিস্ বাক্সোর উপর উঠিয়া খেলিতে গিয়া পড়িয়া গিয়াছি ও তেলও পড়িয়া গিয়াছে। আমি বলিলাম, মিথ্যা কথা কি করিয়া বলিব? তাহাতে দাদা বলিলেন তোর সত্য কথার জন্য আমি কি মার খাব, আমি অন্য উপায় দেখিয়া সেখান হইতে উঠিয়া গাড়ীবারান্দায় গিয়া বসিলাম।
শীতকালের কুহেলিকাচ্ছন্ন আকাশ—গঙ্গার পরপর দেখা যাইতেছে না। গঙ্গাবক্ষে দু একখানি নৌকা রহিয়াছে, নিশির শিশিরসিক্ত ফুল গুলি ফুটিয়া রহিয়াছে, কামিনী ফুলের গাছের উপর একটি মাছরাঙা পাখী বসিয়াছিল; আমি প্রকৃতির শোভা দেখিতেছিলাম; পাখী উড়িয়া গেল, আমার মনে আবার চিন্তা আসিল, কি করিয়া এই বিপদ হইতে উদ্ধার লাভ করিব। তাই একমনে ঈশ্বরকে ডাকিতে লাগিলাম, দয়াময়, তোমার দয়ার পরিচয় আমায় দেও, এমন সময় মা আসিলেন, আসিয়া আমার বিষন্ন মুখ দেখিয়া আমাকে কাছে ডাকিলেন ও আমার কপালের ফুলো দেখিয়া আমায় বলিলেন, কি হয়েছে মা, মাথা কি করিয়া ফুলিয়াছে? আমি কেবল দুটি কথা বলিলাম, যে আমি পড়ে গিয়েছি ও তেল পড়ে গেছে। তখন মা বলিলেন তেল পড়িয়া গিয়াছে গিয়াছে, আর কোথাও তো লাগে নাই? দাদা তখন পড়িতে গিয়াছেন। সকাল বেলায় দাদার তখন মাষ্টার আসিত, আমি ঈশ্বরের দয়া তখন প্রত্যক্ষ করিয়া ঈশ্বরকে প্রণাম করিলাম। সেকালে দাদা মাষ্টারের কাছে পড়িতেন, বিকেলে আমরা উভয়ে পণ্ডিত মহাশয়ের কাছে পড়িতাম। কোন কোন দিন পিতা আমাদের পরীক্ষা করিতেন, আমাকে আগে জিজ্ঞাসা করিয়া পরে দাদাকে জিজ্ঞাসা করিতেন, অবশ্য দাদা আমার চেয়ে অনেক বেশি পড়িতেন। তথাপি দাদা যেটা বলিতে পারিতেন না, আমি সেটা বলিতাম। এই রকম করিয়া দু একবার বলিলে পিতা আমাকে দাদার কান মলিয়া দিতে বলিতেন, আমি ভয়ে ভয়ে দাদার কানের কাছে হাত নিয়ে গেলে দাদা আস্তে আস্তে বলিতেন, দেখ, আমার কান মলে দিলে উপরে গিয়ে তোকে সাজা দেব, দেখ্বি তখন।
একদিন আমরা দুইজনে দুইখানা চেয়ারে বসিয়া আছি। সম্মুখে আর একখানি চৌকিতে পণ্ডিতমহাশয় বেত্রহস্তে বসিয়া আছেন, এমন সময়ে পিতা আসিয়া বলিলেন যে, আজ যে নড়্বে তাহাকে বেত মারবেন, বলিয়া চলিয়া গেলেন। বাগানে ভয়ানক মশা, আমার পায়ে একঠি মশা বসায় আমি যেমন পা নাড়িয়াছি, আর অমনি পণ্ডিত মহাশয় বেত্র আস্ফালন করিয়া আমাকে যেমন ভয় দেখাইতে যাইবেন, আর সেই বেত সজোরে আসিয়া আমার পায়ে লাগিল ও পা কাটিয়া রক্ত পড়িতে লাগিল। আর আমি অমনি দুই হাতে মুখ ঢাকিয়া নীরবে বসিয়া রহিলাম। পণ্ডিতমহাশয় অনেক করিয়া আমাকে পড়িতে বলিলেন, কিন্তু আমি কোন মতে মুখের হাত খুলিলাম না, তখন বাবা মহাশয় আসিয়া আমাকে তদবস্থায় দেখিয়া তাহার কারণ জিজ্ঞাসা করায় পণ্ডিতমহাশয় বলিলেন, যে বেত দিয়ে ভয় দেখাইতে গিয়া পায়ে লাগিয়া গেছে। বাবা মহাশয় আমাকে কাছে ডাকিয়া যখন দেখিলেন, যে আমার পায়ে রক্ত পড়িতেছে, তখন আমায় যে মানুষ করিতেছিল সেই দাসীকে ডাকিয়া আমাকে লইয়া যাইতে বলিলেন। দাসী আমাকে বড় ভালবাসিত, সে আমার পায়ে রক্ত দেখিয়া পণ্ডিতমহাশয়কে গালি দিতে দিতে আমার পায়ে তেলজল দিয়া দিতে লাগিল। আমাদের একজন সরকার ছিল, সে পণ্ডিতমহাশয়ের তিন চারি গাছি বেত জলে ফেলিয়াদিয়াছিল। বাবা মহাশয় এই কথা জানিতে পারিয়া তাহাকে নিষেধ করিয়া দেন। আমাদের বাড়ীর পরিবারের মধ্যে পিতামাতা ও পিতার এক খুল্লতাত-পত্নী ও তাঁহার বৃদ্ধ পিতামাতা ছিলেন। দিদিমা আমাদের এক প্রকার খেলার সঙ্গী ছিলেন। আমরা পড়িয়া আসার পর হইতে রাত্রি ৯টার পর পর্য্যন্ত খেলা ও গল্প করিয়া আমাদের জাগাইয়া রাখিতেন। সে খেলায় একটুকু নূতনত্ব ছিল। কোন দিন আমি ও দাদা বাগানের গাছ হইতাম, দিদিমা গোড়া খুঁড়িতেন, জল দিতেন, ফুল তুলিতেন, মালা গাঁথিতেন,—সমস্ত কল্পনায়। কোনকোন দিন রামায়ণ ও মহাভারত গল্পচ্ছলে বলিতেন। এ ছাড়া আমাদের নূতন একটি খেলা ছিল। তাহা জ্যোৎস্নাময়ী রজনী না হইলে হইত না। সে খেলা জগন্নাথক্ষেত্রে যাওয়া,—সেইটাই আমাদের সর্ব্বাপেক্ষা প্রিয় ছিল। আমাদের বারান্দায় একখানি জগন্নাথের পট টাঙ্গান ছিল। জ্যোৎস্নাময়ী রাত্রে বারান্দায় একখানি মাদুর পাতিয়া দিদিমা বসিতেন, আর আমরা দুই ভাইবোন তাঁহার কোলে মাথা রাখিয়া কৃত্রিম নিদ্রায় নিদ্রিত হইতাম। আর দিদিমা মুখে মুখে জগন্নাথক্ষেত্রে যাইবার আয়োজন করিতেন আর বলিতেন যে ইহারা নিদ্রিত হইয়াছে। ইহাদের রাখিয়া আমি যাইব আর আমরা অমনি জাগ্রত হইয়া বলিতাম যে আমরাও জগন্নাথক্ষেত্রে যাইব। আমরা যখন কিছুতেই থাকিতে চাহিতাম না। তখন দিদিমা বলিতেন অত দূরে হাঁটাপথ, একান্ত না থাক চল, এই বলিয়া সেই গাড়িবারান্দার এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পর্যন্ত দিদিমা বারবার আস্তে আস্তে যাওয়া-আসা করিতেন আর মুখে গান করিতেন।
“আঠার নালায় পড়ে যাত্রী,
তারে পার করহে শ্রীহরি,
সারারাত হেঁটে মলুম,
পোয়া বাট বই কয় না,
জয় জগন্নাথ দয়া কর।
আর তো দুখ সয় না।”
তার পর জগন্নাথক্ষেত্রে আসিয়া বাসা লওয়া, জগন্নাথ দর্শন ইত্যাদি সব কল্পনায় চলিত। আর সেই জ্যোৎস্না বারান্দায় আসিয়া পড়িত, সেইটে আমাদের সমুদ্র হইত। কত আনন্দে আমরা সেই সমুদ্রে স্নান করিতাম, ঝিনুক কুড়াইতাম ও প্রসাদ ভোজন করিয়া গৃহে ফিরিতাম। এই আমাদের নিশীথের খেলা। তখন হইতে আমি আমার মার গৃহকর্ম্মে অল্প অল্প সাহায্য করিতাম। মার মাসকাবারের জিনিষপত্র আসিত বেলা দ্বিপ্রহরে। মা যখন সেই সব দ্রব্য গুছাইয়া যথাস্থানে রাখিতেন, আমিও তাঁহার সঙ্গে সাহায্য করিতাম। আমার কাছে সামান্য কাগজও বাদ যাইত না, তাহা কুড়াইয়া লইয়া তাহাতে কি লেখা আছে দেখিতাম। তাহার মধ্য হইতে কত গল্প, হেঁয়ালী, গান পাইয়াছিলাম। তাহার মধ্যে একটি এইখানে উদ্ধত করিলাম। এক রাজার দুই রাণী ছিল, দুই রাণী থাকিলে যাহা হয়, এ ক্ষেত্রেও তাহাই হইল। এক দুয়ো ও অপরটি সুয়ো; দুয়ো রাণী যে বড় রাণী, সেটা অবশ্য বলিয়া দিতে হইবে না। একদিন গোয়ালিনী রাজার বাড়ী দুগ্ধ দিতে আসিয়াছে, বড় রাণীকে বিষন্ন বদনে বসিয়া থাকিতে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিল। হ্যাঁ রাণী মা, অমন মুখখানি ভার করিয়া কেন বসিয়া আছ? তখন রাণী বলিলেন, রাজা আমায় দেখিতে পারেন না, আমার যে কষ্ট, তাহা আর তোক কি বলিব। গোয়ালিনী বলিল, ও মা আমায় এতদিন তা বলতে হয়। কেন তোকে বল্লে কিহ ত?—কেন? আমার কাছে এমন এক কবিরাজ আছে যে, তাহার ঔষধে আমার হারান গরু আমি ফিরিয়া পাইয়াছি। রাণী বলিলেন সে কি রকম? গোয়নিলী বলিল, আমার ধবলি গরু হারিয়েছিল, সেই যেটার দুধ তোমাদের দিই, তা আমি বসে বসে কাঁদছিলাম, কবিরাজ আমাকে দেখিয়া বলিল, তোমার কি হয়েছে, বাছা, কাঁদছ কেন, তখন আমি বলিলাম, আমার গরু হারাইয়াছে, তাহাতে সে কবিরাজ আমাকে কতকগুলি হরিতকী পড়িয়া দিয়া গেল ও তাহা বাটিয়া খাইতে বলিল, আমি তাহা বাটিয়া খাইতে আমার পেট ছাড়িয়া দিল ও আমাকে বারবার বনের মধ্যে যাইতে হইল। সেখানে গিয়া দেখি আমার ধবলি ঘাস খাইতেছে, আমি তাহাকে তৎক্ষণাৎ ঘরে লইয়া আসি। আমি এখন গিয়া সেই কবিরাজকে তোমার কথা বলিব, রাণী বলিলেন, বলিস, তাহার পরদিন গোয়ালিনী রাণীর জন্য হরিতকীপড়া আনিল, রাণী তাহা খাইলেন রাণীর ভেদ হইতে লাগিল, রাজার নিকট খবর গেল। বড়রাণীর আসন্নকাল উপস্থিত। রাজা কবিরাজ লইয়া আসিলেন ও মনে করিতে লাগিলেন যে, আমারই অযতনে বুঝি রাণী মরিতে বসিয়াছেন। এই অনুতাপ রাজাকে বারবার বিদ্ধ করিতে লাগিল। তদবধি রাজা রাণীকে ভালবাসিতে লাগিলেন। রাণীও সুস্থ হইলেন। এমন সময় রাজার যুদ্ধ উপস্থিত হইল। নদীর পরপারে বিপক্ষের সেনা আসিয়া শিবির স্থাপন করিল, রাজা ম্লানমুখে রাণীর কাছে আসিলেন; রাণী তাহার কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন; রাজা বলিলেন, আমার যুদ্ধ উপস্থিত, বিপক্ষের সেনা অনেক, তাহাতে আমাদের যুদ্ধে জয়লাভ করা কঠিন। তখন রাণী বলিলেন, তাহার জন্য চিন্তা কি? আমি তাহার ব্যবস্থা করিতেছি। বলিয়া সেই গোয়ালিনীকে খবর দিলেন। গোয়ালিনী আসিয়া কবিরাজের নিকট হইতে পূর্ব্বের মত হরিতকীপড়া আনিয়া দিল। রাজার প্রত্যেক সৈন্যকে তাহা বাটিয়া খাওয়াইতে বলিল এবং নদীর ধারে মলত্যাগ করিতে বলিয়া দিল। সকাল হইতে সন্ধ্যা পর্যন্ত সমস্ত সৈন্য নদীর ধারে মলত্যাগ করায় অপর পক্ষ ভাবিল, যে-রাজার এত সৈন্য, ইহার সহিত আমরা যুদ্ধে পারিব না। তাহারা বিনাযুদ্ধে পলায়ন করিল। হরিতকীর এই গুণের জন্য কবিরাজ মহাশয় রাজার নিকট হইতে প্রভূত পারিতোষিক পাইলেন।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ।
“যাদৃশী ভাবনা যস্য সিদ্ধির্ভবতি তাদৃশী ”
একদিন সকাল বেলায় বাবা মহাশয় দিদিমা ও মা তিন জনে বসিয়া কি কথোপকথন করিতেছিলেন, তার মধ্যে “যাদৃশী ভাবনা” এই কথাটি ছিল, এই কথা শুনিয়া আমি সেখান হইতে চলিয়া আসিয়া আমার দাদাকে বলিলাম যে, মহাশয় বলিতেছেন যা ভাবা যায় তাই সিদ্ধ হয় এস আমরা পরীক্ষা করি তাই কিছুক্ষণ পরামর্শ করিয়া স্থির হইল যে, একজন সাহেব ও মেম তাহাদের ছেলেমেয়ে নিয়ে পথ ভুলে আমাদের বাগানে আসে এই বলিয়া আমরা দুজনে এক মনে ভাবিতে লাগিলাম, ঘড়ি দেখিলাম তখন বেলা ৮ টা। ৮টা হইতে সেই গাড়িবারান্দায় বসিয়া ভাবিতে সুরু করিলাম কেবল আহারের সময় উঠিয়া গিয়া ভাবিতে ভাবিতেই আহার করিয়া আসিয়া পুনরায় সেইখানে বসিয়া ভাবিতে লাগিলাম, যখন বেলা ২টা তখন আমাদের ভাবনা সত্যে পরিণত হইল। কোন্নগরে পাটের কলে যাইবার পথ ভুলিয়া ঐ সাহেব মেম ছেলেমেয়ে লইয়া আসিয়াছিল। তাহারা আমাদের বাগানে প্রবেশ করিবামাত্র প্রথমেই আমাদের চোখে পড়িল। আমাদের চিন্তার সফলতা দেখিয়া আমার হৃদয় আনন্দে পূর্ণ হইয়াছিল। আমি তাড়াতাড়ি বাবা মহাশয়ের নিকট যাইয়া বলিলাম যে আমরা বাগানে সাহেব মেম আনাইয়াছি, আপনি যাইয়া দেখুন। বাবা মহাশয় বলিলেন, সাহেব মেম আনাইয়াছিস কি রকম? তখন আমি বাবা মহাশয়কে আমাদের ভাবনার আনুপূর্ব্বক সমস্ত বিবরণ বলিলাম। বাবা মহাশয় এই কথা শুনিয়া আশ্চর্য্য হইয়া নীচে নামিতে যাইতেছিলেন, এমন সময় মালী আসিয়া সাহেবের আগমনসংবাদ দিল। বাবা মহাশয় নীচে যাইয়া সাহেবের সহিত দেখা করিয়া তাহাদের আসিবার কারণ অবগত হইলেন এবং আমাদের মালিকে সঙ্গে দিয়া তাহাদের গন্তব্য স্থানে পাঠাইয়া দিলেন।
আমাদের কোন আত্মীয়ার কন্যার বিবাহ উপলক্ষ্যে আমাদের কলিকাতায় আসিবার কথা হয়। তাহাতে আমার বড় আনন্দ হইয়াছিল। মা যখন যাত্রার আয়োজন করিতেছিলেন আমরা তখন আমাদের খেলনাগুলি এখানে ওখানে লুকাইয়া রাখিতেছিলাম। পরে গাড়ী আসিলে আমরা সকলে গাড়ীতে উঠিলাম। গাড়ীতে উঠিয়াই আমার মনে কষ্ট হইতেছিল যে আমরা কত ভারী, ঘোড়র কত কষ্ট হইতেছে, এই ভাবিতে ভাবিতে আমি সারাপথ বিষন্ন ও আড়ষ্ট হইয়া গাড়ীতে বসিয়াছিলাম। আমার এই প্রথম কোথাও যাওয়া বা গাড়ীচড়া। আমরা বেলা ২৷৷৹ টার সময় বাগান হইতে রওনা হইয়া সন্ধ্যা ৭টার সময় কলিকাতায় আত্মীয়ার বাড়ীতে আসিয়া পৌঁছিলাম।
পল্লীগ্রামের সেই শান্তভাব আর সহরের জনাকীর্ণতা ও কোলাহল দেখিয়া ভয়ে ও বিস্ময়ে অভিভূত হইয়াছিলাম। রাত্রি হইয়াছিল, আমরা আহারাদি করিয়া শয়ন করিলাম, পথে গাড়ীর ঘড়ঘড়ানির শব্দে বড়ই অশান্তি বোধ হইতে লাগিল পথশ্রমে আমরা ক্লান্ত হইয়াছিলাম, অল্পক্ষণ পরে নিদ্রিত হইয়া পড়িলাম পরদিন সকাল বেলায় উঠিয়া কলিকাতা আর এঁড়িয়াদহর তুলনা করিতে লাগিলাম। বিহঙ্গমের সুমধুর সুরলহরীর পরিবর্ত্তে কাকের কা কা শব্দে ও গাড়ীর ঘড় ঘড় শব্দে এমন খারাপ বোধ হইতে লাগিল যে, আবার পল্লীর সেই শান্তিময় ক্রোড়ে ফিরিয়া যাইবার ইচ্ছা হইতেছিল। চারিদিকে কেবল বাড়ী, কোথাও একটি নয়নতৃপ্তিকর গাছ দেখিবার যো নাই। তারপর কয়দিন বিবাহের গোলমালে আমার আর অন্য চিন্তার অবসর ছিলনা। বিবাহ হইয়া গেল, আমাদের আত্মীয়গণ পশ্চিমে চলিয়া গেলেন, আমরা সেই বাড়ীতেই রহিলাম। তার পর আমাদের বাগানে ফিরিবার আর কোন আয়োজন না দেখিয়া ভয়ে ভয়ে মার কাছে যাইয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, আমরা কবে যাইব, তখন মা আমাকে কোলে করিয়া অশ্রুপূর্ণলোচনে আমাকে বলিলেন যে আর আমরা সেখানে যাইব না। মার কথা শুনিয়া আমিও মার কোলে মাথা রাখিয়া অনেকক্ষণ কাঁদিলাম। মাও অশ্রুমোচন করিতেছিলেন, কাজেই আমাকে সান্ত্বনা দিতে পারেন নাই।
খানিক পরে হৃদয়ের ভার লঘু হইলে চোখ মুছিয়া জিজ্ঞাসা করিলাম, কেন যাওয়া হইবে না। তখন তিনি বলিলেন যে, আমার পিতার সহিত কাকা মহাশয়ের মকর্দ্দমা হইতেছিল, তিনি তাঁহার প্রাপ্য অংশ বাগানটীকে বিক্রয় করিয়া লইবে। কাজেই আর আমাদের যাওয়া হইবে না।
সেদিনটা আমার ভয়ানক কষ্টে কাটিল। বারবারই মনে হইতে লাগিল যে আসিবার সময় যদি জানিতাম যে এই আমাদের শেষ যাওয়া তাহা হইলে সেখানকার সকলের কাছে বিদায় লইয়া আসিতাম। সেখানকার ফুল ফলের গাছ, গঙ্গা ও বাড়ী আমার হৃদয়কে সহস্র স্নেহের বন্ধনে আবদ্ধ করিয়াছিল—তীব্র যন্ত্রণা দিয়া একে একে সেই সকল বন্ধন ছিন্ন হইয়া গেল। ভাবিলাম, শৈশবের সুখের স্বপ্নে মগ্ন ছিলাম তাই ত ভাঙ্গিয়া গেল।
আগে নিজের জীবনকে যেমন করিয়া নিয়োজিত করিয়াছিলাম, জীবননদী যে দিকে প্রবাহিত হইতেছিল তাহা অন্য দিকে প্রবাহিত হইল। তখন হইতে আমার হৃদয়ে ধর্ম্ম ও কর্ম্মের ভাব ধীরে ধীরে প্রবেশ করিল। ঐ সময় হইতে আমার কর্ম্মের জীবন আরব্ধ হইল।
আমাদের আগে অনেক দাসদাসী ছিল, এখানে আসিবার পর তাহাদের সকলকে ছাড়াইয়া দিয়া কেবল একজন ব্রাহ্মণ, একটি দাসী ও একজন চাকর রাখা হইল। একজন চাকর অনেক দিনের পুরাতন ছিল সে বিনা বেতনে আমাদের বাড়ীতে রহিল তাহাকে আমরা দাদাভাই বলিতাম। বাবা মহাশয়ের সেবার জন্য যে সব লোক ছিল তাহাদের ছাড়াইয়া দিয়া সে ভার মা স্বয়ং গ্রহণ করিলেন। আমিও মার সঙ্গে বাবা মহাশয়ের সেবা করিতাম। ঐ সময় একখানি নিত্যকর্মপদ্ধতি কিনিয়া শিবপূজা করিতাম।
অতি প্রত্যুষে সকলের আগে উঠিয়া স্নান করিতাম; মালিনী পূজার ফুল দিয়া যাইত; আমি চন্দন ঘসিয়া পূজার আয়োজন করিয়া লইয়া পূজায় বসিতাম। তখন আমার হৃদয় ভক্তিতে পূর্ণ হইত। পূজা শেষ হইলে আমি যাইয়া বাবা মহাশয়ের সেবা করিতাম। বাবা মহাশয়ের প্রয়োজনীয় সমস্ত কাজ শেষ হইলে বাবা মহাশয় যখন পাঠে নিযুক্ত হইতেন, তখন আমি যাইয়া মার জলখাবার পান ইত্যাদি দিয়া আসিতাম। মা গৃহকর্ম্মে যাইতেন। আমি আবার বাবা মহাশয়ের সেবায় নিযুক্ত হইতাম। আমার সকল কার্য্য শেষ হইলে দিদিমার কাছে যাইয়া পড়িতাম।
মা ও দিদিমা জয়মঙ্গলবার ও ইথুপূজা প্রভৃতি ব্রত করিতেন, আমিও তাঁহাদের সঙ্গে ঐ সব ব্রত করিতাম।
আমার পিতা সেখান হইতে অন্যত্র যাইবার জন্য অল্প ভাড়ায় একটি বাড়ী খুঁজিতেছিলেন। আহিরিটোলায় একটি দুমহল বাড়ী ৪০ টাকা মাসিক ভাড়ায় স্থির হইল। সেটা ভূতের বাড়ী বলিয়া কেহ ভাড়া না লওয়ায় তাহা “পড়ো” হইয়া পড়িয়াছিল। সেই বাড়ীটা বাবা মহাশয় ভাড়া লইয়া তাহার সংস্কার করিতে বলিয়া দিয়া বাড়ীতে ফিরিয়া মাকে বলিলেন, একটা বড় বাড়ী পাইয়াছি, তাহা ভূতের বাড়ী বলিয়া কেহ ভাড়া নিতনা, সেইটেকে আমি সারাইতে বলিয়া দিয়া আসিয়াছি। সেই কথা শুনিয়া আমার মনে মনে বড় ভয় হইতে লাগিল। আমার অভ্যাস নয় যে মুখ ফুটিয়া কাহাকেও কিছু বলি, কাজেই সেই ভাব আমার মনে চাপিয়া রাখিলাম। তার পর আমরা সকলে সেই বাড়ীতে উঠিয়া গেলাম। বাড়ীটা বড়, স্বভাবতই একটু ভয় ভয় করিত তার উপর ভূতের কথা শুনিয়া সর্ব্বদাই আতঙ্কিত থাকিতাম।
আমরা যে দিন সে বাড়ীতে যাইলাম সেই দিন আমাদের বাগানের একটি চাকর আমাদের কাছে চাকরী করিবার জন্য কাঁদিতে লাগিল; বাবা মহাশয় তাহাকে বলিলেন, আমার এখন সে সময় নাই যে তোমাকে মাইনে দিয়ে রাখব, তবে তুমি অন্যত্র চাকরীর চেষ্টা কর যে কদিন না জোটে সে কদিন এখানে থাক, খাও।
বাহিরের ঘরে সে একাকী শয়ন করিত। তাহার কাছে ভূতের কোন কথা বলা হয় নাই, তাই সে একাকী শয়ন করিত। আমাদের এই বাড়ীর একটা বড় ঘরে প্রত্যহ রাত্রে ঢিল পড়িত, সেই ঘরের সার্সিটি ভাঙ্গা ছিল, তাহার ভিতর দিয়া ঢিল ঘরের ভিতর আসিয়া পড়িত। দুই তিন দিন এইরূপ ঢিল পড়ার পর বাবা মহাশয় সেই চাকরকে বলিলেন যে আজ তুই আর আমি ঐ ঘরে শুইব। তখন সেই চাকর কিছুতেই শয়ন করিতে চাহিল না। সে বলিল, ওহি ঘর মে শয়তান হ্যায় ইটা ফেক্তা হ্যায় হাম উস ঘর মে নেহি সোয়ঙ্গে। বাবা মহাশয় তাহাকে অনেক করিয়া বলিলেন, তোর ভয় কি আমার কাছে থাকবি। তাহাতে সে রাজি হইল। বড় ঘরে, এক প্রান্তে বাবা মহাশয়ের শয্যা প্রস্তুত হইল। বাতি ও দেশলাই রাখিয়া বাবা মহাশয় সেই ঘরে শয়ন করিলেন। রাত্রি দ্বিপ্রহরের সময় দুড়দাড় শব্দে ঘরে ইঁট পড়িতে আরম্ভ হইল। তখন বাবা মহাশয় বাতি জ্বলিয়া এমনভাবে আনিলেন যে বাহির হইতে সে ঘরে যে আলো আছে জানা গেল না।
জানলার কাছে আলো আনিতেই দেখিতে পাইলেন, পাশের বাড়ীর পাইখানার ছাতে দাঁড়াইয়া উলঙ্গ হইয়া এলোচুলে একজন ইঁট ফেলিতেছিল; বাবা মহাশয়কে দেখিয়া সে দৌড়িয়া পলাইয়া গেল। তাহার পর দিন অনুসন্ধানে জানা গেল যে এই বাড়ীর পাশের বাড়ীতে কতকগুলি পতিতা স্ত্রীলোেক থাকে, তাহারাই প্রেতাত্মা সাজিয়া এই বাড়ীতে ভাড়াটিয়া থাকিতে দিত না। সেই দিন বাড়ীওয়ালাকে ডাকাইয়া তাহাদের বিধিমত ভয় দেখানর পর হইতে আর তাহারা ওরূপ করিত। কিন্তু তাই বলিয়া সে বাড়ীতে যে ভূত ছিল না তাহা নহে, কারণ ভূত অনুগ্রহ করিয়া একদিন আমাকে দেখা দিয়াছিলেন। একদিন সন্ধ্যার সময় একাকী একটা ঘরে ছিলাম, সে ঘরটা তিনটী কাঠের সিঁড়ি দিয়া উঠিতে হয়; দেখিলাম, আমার ছোট বোনের মত কিম্বা তাহার অপেক্ষা কিছু বড় হইবে এলো চুলে কে হিঃ হিঃ শব্দে হাসিয়া চকিতে পলাইয়া গেল। কাঠের সিঁড়ি দিয়া নামিবার শব্দ শুনিলাম। আমি ভাবিলাম আমার বোন সুষমা বুঝি আমায় ভয় দেখাইয়া গেল, তাই আমি ভীত না হইয়া, দিদিমা দিদিমা বলিয়া ডাকিতে ডাকিতে দিদিমার কাছে গিয়া দেখি দিদিমা আহ্নিক করিতেছেন, সুষমা তাঁহার কাছে বসিয়া আছে। আমি দিদিমাকে বলিলাম, সুষমা আমাকে ভয় দেখাইয়া আসিয়াছে। দিদিমা বলিলেন, কখন? আমি বলিলাম এই মাত্র। তাহাতে দিদিমা অতিমাত্র বিস্ময় প্রকাশ করিয়া বলিলেন, ওমা ওতো আধ ঘণ্টা আমার কাছে বসিয়া আছে ও তোমায় ভয় দেখায় নাই। দিদিমা যেই ঐ কথা বলিলেন তখনই আমার এত ভয় হইল যে বুকের মধ্যে গুর্ গুর্ করিয়া উঠিল, আমি সেখানে বসিয়া পড়িলাম, সর্ব্বশরীর দিয়া ঘর্ম্ম বাহির হইতে লাগিল। দিদিমা তাঁহার জপের মালা আমার মাথায় দিয়া বলিলেন, রাম নাম কর, ঈশ্বরের নামে কোন ভয় থাকে না। ঈশ্বরের নাম করিতে করিতে মনে বল আসিল। মার কাছে গিয়া ভয় পাবার কথা বলিলে মা বলিলেন, ও কিছুই নয়, সন্ধ্যার সময় একলা ছিলি তাই মনে মনে ভয়ে ঐরূপ দেখিয়াছিস্, আর কখন একলা থাকিস্নে। মা আমায় সাহস দিবার জন্য ঐ কথাগুলি বলিলেন। সেই অবধি আমি আর সন্ধ্যা বেলায় মার ও দিদিমার কাছছাড়া হইতাম না।
তখন আমি ও দাদা আর আমাদের দুটি, ভাই হইয়াছিল। সেই সময় হইতে মা আমায় গৃহকর্ম্ম শিক্ষা দিতেন। তিনি রান্নাঘরে একটি আসনে আমাকে বসাইয়া রাখিতেন ও যে সকল অন্নব্যঞ্জন রন্ধন করিতেন আমি সেই সকল দেখিয়া দেখিয়া শিখিতাম। পরে মা জিজ্ঞাসা করিয়া আমার পরীক্ষা লইতেন। এইরূপে ছয় মাসে সমস্ত গৃহকর্ম্ম শিক্ষা দিয়া পড়িবার জন্য অবসর দিলেন। একদিন বৈকালে আমাদের সেই এঁড়েদহস্থ বাগানের পণ্ডিত মহাশয় অনেক অনুসন্ধান করিয়া আমাদের বাড়ী আসিলেন। তাঁহাকে দেখিয়া আমাদের সকলেরই আনন্দ হইল। তিনি আমাদের পরিবারভুক্ত হইয়া রহিলেন। অন্য যায়গায় গৃহশিক্ষকতা করিয়া যাহা পাইতেন তাহা বাড়ীতে পাঠাইয়া দিতেন।ঐ সময় আমি বাংলা ব্যাকরণ সীতার বনবাস মেঘনাদবধ কাব্য প্রভৃতি পড়িতাম। ঐ সময় হইতে আমি কাব্য পাঠ করিয়া কিছু কিছু রসবোধ করিবার শক্তি লাভ করিয়াছিলাম।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ।
এই সময় আমি জগতে ঈশ্বরের চক্ষু নামে একটি কবিতা লিখিয়া ভয়ে ভয়ে পণ্ডিত মহাশয়কে দেখাইতে লইয়া যাই। ঐ ভয়টা আমার প্রকৃতিগতই ছিল। পণ্ডিত মহাশয় বড় রহস্যপ্রিয় লোক ছিলেন। আমার কবিতা দেখিয়া অত্যন্ত আহ্লাদিত হইয়া বলিলেন, এ যে তোমার গুরুমারা বিদ্যে হয়েছে! বলিয়া হাসিতে হাসিতে বাবা মহাশয়কে আমার কবিতাটি দেখাইয়া বলিলেন, দেখুন গুরুর রচনা শক্তি নাই শিষ্যের হইয়াছে। বাবা মহাশয় দেখিয়া আহ্লাদিত হইয়া বলিলেন যে প্রথমে যখন এত ভাল রচনা করিয়াছ তখন চেষ্টা করিলে আরো ভাল লিখতে পারিবে। আমি বাবা মহাশয়ের কাছে উৎসাহ পাইয়া আরো অনেক কবিতা লিখি। তন্মধ্যে কতকগুলি এইখানে উদ্ধত করিলাম।
জগতে ঈশ্বরের চক্ষু।
হে মানব পাপ করি কোথা লুকাইবে?
জগতে তাঁহার চক্ষু দেখনা ভাবিয়ে!
অন্ধকার গিরিগুহা খনির ভিতর
যেখানে যাইবে তুমি সেখানে ঈশ্বর।
পাপ করি মনে মনে রাখ লুকাইয়া।
মনেতে আছেন তিনি লবেন জানিয়া।
তিনি হন আমাদের হৃদয়ের স্বামী
আমাদের আত্মা তাঁর হয় অনুগামী।
প্রবৃত্তির স্রোতে মোরা যাই যবে ভেসে
ধর্ম্ম না সহায় হলে রক্ষা পাই কিসে?
তাঁহার করুণাধারা সেখানেতে বহে,
ধর্ম্মকে সহায় দেন উদ্ধার উপায়ে।
পাপেতে মোদের আত্মা হইলে মলিন
ভয়ে ভীত হই সদা অনুতাপে ক্ষীণ।
সেখানেও হন তিনি মোদের সহায়,
অজ্ঞান তিমির নাশি জ্ঞানের উদয়।
ধর্ম্ম।
দিন দিন কর তুমি ধন উপার্জ্জন,
মনে মনে ভাব তুমি, কে পায় এখন!
জাননা কালের কাছে নাহি ধনমান,
ধর্ম্মই কালের কাছে অমূল্য রতন।
তাই বলি, কর তুমি ধর্ম্ম উপার্জ্জন,
এই সব পড়ে রবে, সহ রোগ শোক
ধর্ম্মই তোমার সহ যাবে পরলোক।
প্রকৃতি।
প্রকৃতি নূতন শোভা করেছে ধারণ,
ফলে ফুলে সাজিয়াছে কুসুম কানন।
বসুন্ধরা সাজিয়াছে নবদুর্ব্বাদলে
মোহিছে মানবমন পাপিয়ার দলে।
ধীরে ধীরে বহিতেছে মধুর মলয়
ফুলবাসে মানবের মন হরে লয়।
রজনীর শোভা।
ধীরে ধীরে বহিতেছে
জাহ্নবীর ধারা,
আকাশে ফুটিয়া আছে
আকাশের তারা
কাননে ফুটিয়া আছে
কাননের ফুল,
অনিল আনিয়া গন্ধ
করিছে আকুল।
জলেতে ফুটিয়া আছে
কুমদিনীবালা
পবন তাহার সহ
করিতেছে খেলা
হেরিয়া নিশীথ শোভা
মুগ্ধ প্রাণমন,
শান্ত শিব রূপে তুমি
দিলে দরশন।
ফুল।
তুইলো কাননবালা
কুসুম সুন্দরী,
ফুটে থাক যবে তুমি
বন আলো করি,
হেরে তোর বিমোহিনী
রূপ মনোহর,
কত যে আনন্দ হয়
হৃদয়ে আমার।
কোমলতা পবিত্রতা
একাধারে পাব কোথা
তোর মত এমন সুন্দর।
বঙ্গ বালা কম-করে
দেবতা পূজার তরে
তোমারে চয়ন করে
হরিষ অন্তর প্রজাপতি
মনসুখে ঘুমায়
তোমার বুকে, মধু
দিয়া তুমি তারে
করলো আদর।
বর বধূ দুইজনে বাঁধে
যবে প্রেমের বাঁধনে
সেখানেও আছ তুমি
কুসুমের হার।
ঐ সময়ে আমি আমার পিতার কাছে কাব্য সম্বন্ধে আমার স্বাধীন মত ব্যক্ত করিতাম। এক এক দিন সন্ধ্যাবেলায় বাবা মহাশয় কাব্য আলোচনা করিতেন। আমিও তাঁহাদের কাছে থাকিয়া সেই আনন্দের ভাগী হইতাম। মা ও দিদিমারা অনন্ত প্রভৃতি ব্রত করিতেন আমাদের কুল-পুরোহিত ব্রত কথা সংস্কৃতে বলিতেন। আমি তাহা মা ও দিদিমাকে বাংলাতে বুঝাইয়া দিতাম। আমি সংস্কৃত না পড়িয়া বুঝিতে পারিতাম। আমাদের পুরোহিত এই দেখিয়া আমায় অত্যন্ত স্নেহ করিতেন ও মাকে বলিতেন যে তোমাদের এ মেয়ে শাপ ভ্রষ্টা।
একদিন সকাল বেলায় মা ও বাবামহাশয় আমার বিবাহের কথা বলিতেছিলেন শুনিয়া আমার মনে ভয়ানক কষ্ট হইল ও কান্না আসিল। আমি একাকী বাহিরের ঘরে যাইয়া নির্জ্জনে কাঁদিতে ছিলাম এবং ভাবিতে ছিলাম যে মা আমাকে বাড়ী হইতে বিদায় করিবার জন্য এত ব্যস্ত কেন? কিয়ৎক্ষণ পরে আমি চোখ মুছিয়া ফিরিয়া দেখিলাম, একজন অল্প বয়সের সুন্দর চেহারার লোক আমার পশ্চাতে দাঁড়াইয়া আছে। তাহার পরণে কালাপেড়ে ধবধবে ধুতি ও গায়ে পরিষ্কার পাঞ্জাবি ও উড়ানি। পায়ে কালো বার্ণিস করা জুতা, মাথার চুল কোঁকড়ান সিঁথিকাটা। আমি ফিরিলেই সে হাঁসিয়া বলিল, তুমি যে জন্য কাঁদিতেছ আমি সেই জন্য আসিয়াছি। আমি তোমার বিবাহের সম্বন্ধ করিতে আসিয়াছি, বলিয়া মুখটিপিয়া হাসিতে লাগিল। আমি হঠাৎ একটা লোককে দেখিয়া ভয় পাইয়া বলিলাম, আপনি সরুন, আমি বাবা মহাশয়কে ডেকে দিচ্ছি। তাহাতে সে আমাকে কিছু না বলিয়া সেইখানে সেইভাবে দাঁড়াইয়া রহিল। আমি তখন তাহাকে পুনরায় মিনতি করিয়া বলিলাম আপনি সরুন, আমি গিয়া বাবা মহাশয়কে ডাকিয়া দিই। তখন সে দুইহাত প্রসারিত করিয়া আমার পথ রোধ করিয়া দাঁড়াইল। তখন আমি মনে মনে ভাবিলাম যে এখান হইতেই চিৎকার করি। মুখে কিছু বলি নাই যেই এই কথা ভাবিয়াছি অমনি সে হাত সরাইয়া আমাকে যাইতে বলিল। তখন আমি সংকোচের সহিত আমার কাপড় সামলাইয়া বাড়ীর ভিতর ছুটিয়া গিয়া বাবা মহাশয়কে তাড়া তাড়ি বলিলাম বাহিরে কে একজন লোক আসিয়াছে আপনি যাইয়া দেখুন। বাবা মহাশয় এই কথা শুনিয়া তৎক্ষণাৎ বাহিরে আসিলেন; আসিয়া কাহাকেও দেখিতে না পাইয়া বরাবর সিঁড়ি দিয়া রাস্তার মোড় অবধি দেখিয়া আসিলেন। কাহাকেও দেখিতে পাইলেন না। বাহির হইতে কেহ আসিয়া এত শীঘ্র চলিয়া যাইতে পারে না, আর যদি বা বাহির হইতে কেহ আসিত; তবে সে আমার মনের কথা কিরূপে জানিতে পারিবে? ইহা অলৌকিক ঘটনা ভিন্ন আর কিছুই নহে, মা ও বাবামহাশয় এই সিদ্ধান্ত করিলেন।
আর একটি হাস্যকর ঘটনা। একদিন আমাদের বাড়ীতে বৈকালে অপরিচিতা তিনটি স্ত্রীলোক আসিলেন। আমরা তাহাদের অভ্যর্থনা করিয়া বাড়ীর ভিতর লইয়া আসিয়া বসাইলাম। তাঁহারা কিছুতেই আপনাদের পরিচয় দিলেন না তবে তাঁহাদের মধ্যে একজন বলিলেন, এইটি আমার মাসী ও দ্বিতীয়টি আমার পুত্রবধু। তখন আমরা সেই ভূতের বাড়ী ছাড়িয়া চোর বাগানে একটি বাড়ীতে বাস করিতাম। নবাগতা রমণীগণ যদিও তাহাদের নিজের পরিচয় দিলেন না কিন্তু তাঁহাদের কথা-বার্তায় বোঝা গেল যে তাহারা আমাদের সকলকেই চেনেন। নানা প্রকার গল্প সল্প ও কথা বার্ত্তার পর আমাদের সেদিন কি রান্না, হইয়াছিল সেই বিষয় জিজ্ঞাসা করিলেন। রান্নার কথা বলিবার সময় মা বলিয়াছিলেন যে ইঁচোড়ের দালনা হইয়াছে। মার মুখ হইতে ইঁচোড় কথাটি বাহির হইবা মাত্র ইঁ-ইঁ-চোড় আবার কি বলিয়া হি হি করিয়া হাসিয়া উঠিলেন। মা ও অপ্রস্তুত হইয়া চুপ করিয়া রহিলেন। মাকে তদবস্থায় দেখিয়া আমার মনে আঘাৎ লাগিল। আমি তাঁহাদিগকে জিজ্ঞাসা করিলাম, আপনারা কি বলেন? তাহাতে তিনি তৎক্ষণাৎ বলিলেন আমরা বলি এঁচোড়। আমিও তাঁহারই মতন সুরে বলিলাম এ্যাঁ-এ্যঁ-চোড় আবার কি?—বলিয়া না হাসিয়া চুপ করিয়া বসিয়া রহিলাম। তিনিও কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া আবার কথাবার্ত্তা আরম্ভ করিলেন। পরে তাহারা বিদায় লইয়া গাড়ীতে উঠিয়া তবে নিজেদের পরিচয় দিলেন তখন আমরা বুঝিতে পারিলাম যে, তাঁহারা বাবা মহাশয়ের এক বন্ধুর পরিবারের লোক।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ।
এখন হইতেই আমার বিবাহের চেষ্টা চলিতে লাগিল। মা ইহাকে উহাকে বলিয়া যত সম্বন্ধে আনিতেন বাবা মহাশয় নানা ওজর আপত্তি তুলিয়া তাহাদের ফিরাইয়া দিতেন। এই রকম করিয়া তের বৎসর কাটিয়া গেল। ঐ সময়ের মধ্যে আমি রামায়ণ, মহাভারত, সুশীলার উপাখ্যান প্রভৃতি ভাল ভাল বই অনেক পড়িয়াছিলাম। ঋজুপাঠ নামে সংস্কৃত বইখানিও পড়িয়াছিলাম।
একদিন আমার পিস্তুত ভগিনী আসিয়া মাকে বলিলেন যে এবার আমি একটি ভাল পাত্রের সন্ধান পাইয়াছি। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের প্রিয় শিষ্য, তিনি তাহাকে অত্যন্ত স্নেহ করেন, চরিত্র খুব ভাল ও কবি। এমন আর পাওয়া যাইবে না। এবার আর যেন মামা মহাশয় অমত করেন। তুমি বলিয়া কহিয়া মত করিও। এই কথা বলিয়া তিনি চলিয়া গেলেন। পরে বাবা মহাশয় বাড়ীতে আসিলে মা তাঁহাকে দিদি যাহা বলিয়াছিলেন সেই কথা বলিলেন। বাবা মহাশয় সমস্ত শুনিয়া চুপ করিরা রহিলেন। তাহা দেখিয়া মা বলিলেন, তুমি যে চুপ করিয়া রহিলে? কত পাত্র এল কাহাকেও মনে ধরিল, তবে তুমি কি মনে করিয়াছ মেয়ের বিবাহ দিবেনা? বাবা মহাশয় বলিলেন, আমিত সব শুনিলাম তার পর ভাবিয়া দেখি, যাহা হয় করিব। তাহার পর দিন দিদি আসিয়া খবর দিলেন যে সে পাত্রটি মাঘোৎসব করিতে চুঁচুড়া হইতে জোড়াসাঁকোয় আসিয়াছে ইহা শুনিয়া মা বাবামহাশয়কে সেই দিনই জোড়াসাঁকোয় পাঠাইয়া দিলেন। বাবা মহাশয় জোড়াসাঁকো যাইয়া পাত্র দেখিয়া আসিলেন এবং তাহার পরদিন পাত্রটি আমাকে দেখিতে আসিবেন এইরূপ কথা ছিল কিন্তু সেদিন কোন সঙ্গী না পাওয়ায় একাকীআসিতে পারিলেন না। তাহার পর দিন বৈকালে আমার পিসে মহাশয়ের সঙ্গে আসিবেন বলিয়া একখানি চিঠি লিখিলেন—এই চিঠি পাইয়া অবধি ভয় ও লজ্জায় আমার বুকের ভিতর ধড় ধড় করিতে লাগিল ও আমি কি করে সম্মুখে বাহির হইব এই ভাবনাই বার বার মনে হইতে লাগিল। সে দিন বৈকালে খুব ঝড় হইয়াছিল বাহিরেও ঝটিকা আর আমার হৃদয়ের মধ্যেও ভাবনার ঝটিকা বহিতেছিল। যাহা হউক কিছুক্ষণ পরে ঝড় থামিলে মেঘও কাটিল তখন তিনি আমার পিসে মহাশয়কে সঙ্গে লইয়া আমাদের বাড়ী আসিলেন।
আমি ভাবিতে ছিলাম যে আমার এই দর্শন রূপ বিপদ হইতে উদ্ধার হইতে পারিলেই বাঁচি। পরে তিনি উপরে আসিলেন, দিদিমা আমাকে লইয়া সেইখানে গেলেন, তিনি আমাকে দু একটি পদ্য ও গদ্য পড়িতে দিলেন, এবং আর দু একটি প্রশ্ন করিবার পর আমি অব্যাহতি পাইলাম। তিনি জলযােগ করিতে বসিলেন সেখানেও দিদিমা আমাকে ডাকিয়া ৰসাইলেন—কি দায়! তিনি জলযােগের পর নিচে যাইয়া বাবা মহাশয়কে বলিলেন যে আমি মহর্ষির কাছে যাইয়া পরে আসিয়া দিনস্থির করিব। এই বলিয়া ১১ই মাঘ সারিয়া চুঁচড়ায় ফিরিয়া গেলেন, তাহার পরে আসিয়া ৯ই ফাল্গুন দিন স্থির করিয়া জোড়াসাঁকোস্থ সকলকে এবং বাবামহাশয় ও দাদাকে নিমন্ত্রণ করিয়া পুনরায় চুঁচড়ায় চলিয়া গেলেন। মহর্ষি সমারােহ করিয়া তাঁহার দীক্ষা দিলেন, এই দীক্ষার দিনে মহর্ষি তাঁহাকে যে উপদেশ দেন তাহা অনুষ্ঠান পদ্ধতিতে ছাপা রহিয়াছে। দীক্ষা হইয়া যাইবার পর তিনি একবার দেশে যান পরে দেশ হইতে কলিকাতায় আসেন। আমার বিবাহের আয়ােজন হইতে লাগিল, চিন্তার তরঙ্গের পর তরঙ্গ আসিয়া আমার হৃদয়ে আঘাৎ করিতে লাগিল, মনে হইতে লাগিল যে আমার মতন একটা অপদার্থকে কি ভাবে গ্রহণ করিবেন। আমি এক স্বতন্ত্র প্রকৃতির লোক, খেতে ভুলে যাই, কাজ কর্ম্ম করিতে ভুলে যাই, যদি কেহ আমাকে বলে কাঁদিস্ না আমি অমনি কাঁদিয়া ফেলি, কাহারও কষ্টের কথা শুনিলে কাঁদিয়া আকুল হই, আকুল ক্রন্দনেও হৃদয়ে শান্তি আসিত না। কেহ জোরে কথা কহিলে আমার হৃৎকম্প উপস্থিত হইত—ই সব দেখে শুনে মা আমায় বলিতেন তোর দুঃখে শেয়াল কুকুর কাঁদিবে—সেই কথা মনে হইয়া আমার ভাবনা হইতেছিল।
একটি বড় বাড়ীতে বিবাহের জন্য বাবা মহাশয় আমাদের লইয়া যান। বিবাহের দিন সকাল বেলায় গাত্র হরিদ্রা হইবার পর তিনি আমাকে একখানি পুস্তক উপহার দিয়া বহির্ব্বাটিতে চলিয়া গেলেন। উৎসব আনন্দে, আত্মীয় স্বজনে বাড়ী পূর্ণ—আমি একাকী নির্জ্জনে বসিয়া চিন্তায় মগ্ন ছিলাম, ভাবিতে ছিলাম যে এই উৎসব আনন্দের মধ্যে আমার হৃদয় কেন বিষাদে পূর্ণ, সকলেরই ত বিবাহ হয়, সকলকেই ত পিতা মাতাকে ছাড়িয়া যাইতে হয়, তবে আমার হৃদয় কেন বিষাদে পূর্ণ? এইরূপ কিছুক্ষণ চিন্তা করিবার পর যেমন উঠিলাম অমনি মাথা ঘুরিয়া পড়িয়া দেওয়ালে মাথায় আঘাৎ পাইলাম। পরে মার কাছে যাইয়া দেখিলাম যে মা ও আমার ভগ্নিরা সকলে মোনা মুনি ভাসাইতে ব্যস্ত। মোনা মুনি এক প্রকার ক্ষুদ্র ফল, ফল দুটি জলে ভাসাইয়া নব দম্পতির ভবিষ্যৎ জীবনের সুখ-দুঃখের সম্ভাবনা জানিবার চেষ্টা করা হয়, ফল দুটি জলে ভাসিয়া একত্রিত হইলে শুভ ও তাহার বিপরীত অশুভ। মা ও ভগ্নিরা জলে মোনা মুনি ভাসাইয়া সতৃষ্ণ নয়নে দেখিতেছিলেন যে জোড়া লাগে কিনা, মোনা মুনি জোড়া লাগিল। তখন সকলে হাইআমলা প্রভৃতি অন্যান্য অনুষ্টানে মনোনিবেশ করিলেন। এতক্ষণ আমাকে ছাড়িয়া অন্যান্য অনুষ্ঠান হইতেছিল সন্ধ্যা হয় হয় এমন সময় মা আমাকে ডাকিলেন, এইবার আমার পালা আরম্ভ হইল। কনে সাজান নাওয়ান ইত্যাদি শেষ করিয়া আমাকে সকলে মিলিয়া ঘিরিয়া বসিলেন ও নানাপ্রকার রহস্যালাপ চলিতে লাগিল। মা আমাকে পূর্ব্ব হইতে বিশেষ করিয়া সতর্ক করিয়া দিলেন যে শুভ কর্ম্মে আমি যেন চখের জল না ফেলি, কারণ মা জানিতেন যে চোখের জল আমার কাছে বড় সুলভ।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
এমন সময় বর আসিতেছে, বর আসিতেছে বলিয়া একটা গোলযোগ উঠিল, যাহারা আমার কাছে বসিয়া ছিল তাহারা সকলে বর দেখিতে চলিয়া গেল ও বর দেখিয়া ফিরিবার সময় বলিতে বলিতে আসিতেছিল বর বড় অন্ধকার, কারণ তাহারা মনে করিয়াছিল যে, আলোকমালায় সজ্জিত নানাবিধ বাজনা বাদ্য সহযোগে বর দেখিতে পাইবে, তাহার বিপরীত দেখিয়া তাহারা নিরুৎসাহে বলিতেছিল বর বড় অন্ধকার।
পরে স্ত্রী-আচার শুভদৃষ্টি মাল্যবিনিময় আদি যথা নিয়মে সম্পন্ন হইল। এইবার সম্প্রদান হইবে। তখন আমার হৃদয় স্পন্দিত হইতে লাগিল, পা আর চলে না, আমার এক ভগিনীপতি আমার হাত ধরিয়া লইয়া গেলেন। আমরা যথা নিয়মে আসন গ্রহণ করিবার পর সম্প্রদান আরম্ভ হইল, আমার শীতল ও লজ্জাকম্পিত হস্ত উঁহার হাতে স্থাপন করাতে আমার প্রাণে একটা নির্ভরের ভাব আসিল। পরে সম্প্রদান শেষ হইলে আমরা উভয়ে উপরের একটি সজ্জিত কক্ষে বসিলাম। আমার ভগিনীরা উঁহার চারিদিকে ঘিরিয়া বসিলেন। নানাপ্রকার রহস্যাদি হইবার পর আমরা নিদ্রিত হইলাম। পর দিন প্রাতে উদীচ্য ক্রিয়াদি করিয়া তৎপরদিন চুঁচুড়য় চলিয়া গেলেন ও তাহার ৫৷৭ দিন পরে আমাকে লইয়া যাইবার জন্য আসিলেন। বাবা মহাশয় কাপড় বাক্স ইত্যাদি আবশ্যকীয় দ্রব্যাদি ক্রয় করিয়া আনিলেন, মা বাক্সেতে এটা সেটা দিয়া সাজাইতেছেন ও এক একবার আমার দিকে স্নেহ-বিগলিত নয়নে চাহিতেছেন। আমার সে সব দিকে লক্ষ্য নাই, কেবল ভাবিতেছি কি করিয়া সকলকে ছাড়িয়া থাকিব।
দিন সুখেরই হউক আর দুঃখেরই হউক দিন কাহারও মুখাপেক্ষা করে না। সে দিন গেল, প্রভাত হইল, আমার ভগিনী ছলছল নেত্রে আমার কাছে আসিয়া দাঁড়াইল, আমি নীরবে বক্ষে ধরিলাম। ঝর্ঝর্ করিয়া চোখে জল পড়িতে লাগিল কিছুক্ষণ পরে প্রকৃতস্থ হইয়া সুষমাকে বলিলাম—ভাই, বাবামহাশয়ের সেবা করো ও মায়ের সাহায্য করিও আমার অভাব যেন ওঁরা না বোধ করেন। স্ত্রীলোক যাহার জন্য সৃষ্ট, যেখানে তাহার গতি, আমি সেইখানে চলিলাম; এতদিন এখানে আমার যাহা কর্তব্য ছিল আজ তাহা শেষ হইল, আশীর্ব্বাদ করি তুমি সুখী হও।
আহারাদি করিয়া বেলা দুইটার ট্রেণে আমাদের যাইতে হইবে, পণ্ডিত মহাশয় আমাদের পৌঁছাইতে যাইবেন। কিছুক্ষণ পরে আমরা যাইবার জন্য প্রস্তুত হইলাম, প্রণাম ও আশীর্ব্বাদের পর চোখের জলে ভাসিতে ভাসিতে গাড়ীতে যাইয়া বসিলাম। গাড়ী জনাকীর্ণ হাবড়া ষ্টেশনে আসিয়া থামিল, আমি ইতিপূর্ব্বে কখন রেলে চড়ি নাই বা স্টেশনেও আসি নাই সুতরাং ভিড় দেখিয়া আমার বড় লজ্জা করিতেছিল। কিছুক্ষণ পরে রেল আসিতে আমরা তাহাতে উঠিলাম ও চুঁচুড়ার ষ্টেসনে আমরা নামিলাম। সেখানে ঘোড়ারগাড়ী লইয়া মহর্ষির সরকার অপেক্ষা করিতেছিল আমরা সেই গাড়ীতে আরোহণ করিয়া মহর্ষির বাড়ীর ফটকে গাড়ী হইতে অবতরণ করিলাম, নিস্তব্ধ বাড়ী আমাকে নীরবে বরণ করিয়া লইল।
উনি আসিয়া চারি টাকা আমার হাতে দিয়া পণ্ডিত মহাশয়কে প্রণাম করিতে বলিলেন, পণ্ডিত মহাশয় সেই চারি টাকা পাইয়া গঙ্গা পার হইয়া বাড়ী গেলেন।
পরদিন সকাল বেলায় কর্ত্তাদাদামহাশয় বেড়াইয়া আসিয়া আমাদিগকে ডাকিলেন আমরা প্রণাম করিলে আশীর্ব্বাদ করিয়া পূর্ব্বে রক্ষিত পাশাপাশি দুইখানি চৌকিতে বসিতে অনুমতি করিলেন। আমরা বসিবার পর সস্নেহে আমাদের সহিত কথা কহিতে লাগিলেন। তাঁহার শান্ত উজ্জ্বল মূর্ত্তি দেখিয়া আমার হৃদয় ভক্তিবিগলিত হইয়া তাঁহার চরণ স্পর্শ করিল। তাঁহাকে, আমি একবার খুব ছোট বেলায় দেখিয়াছিলাম আর এই দেখিলাম। সেই দিন থেকে তিনি আমাকে দেবী বলিয়া সম্বোধন করিতেন ও আমাকে বলিয়া দিলেন—প্রতি বুধবার সন্ধ্যার সময় আমার কাছে আসিবে আমি তোমাকে ধর্ম্ম উপদেশ দিব ও কথাবার্তা কহিব।
সেই হইতে এক বুধবার আমাকে মন্ত্র দেন। আমি একদিন তাঁহাকে পুনর্জন্ম সম্বন্ধে প্রশ্ন করি তাহাতে তিনি এই কথা বলেন যে মনুষ্য মরিয়াই যে ইহলোকে আসিতে হইবে একথা আমার মনে হয় না, অনন্ত লোকলোকান্তর মধ্যে, যে কোন লোকে হউক জন্ম লইবে।
আমি যখন চুঁচুড়ায় ছিলাম তখন আমার কাছে একজন দাসী ছিল, তাহার বর্দ্ধমানে বাড়ী, তাহার নিকট অনেক ছড়া শিখিয়াছিলাম তাহার মধ্যে দু-একটি এইখানে লিখিলাম। তাহাদের দেশে ভাঁজু ও ভাদু বলিয়া দুই রকম পূজা হয় একটা নিশীথে ও একটা দিনে। ভাঁজুটা নিশীথের পূজা সেই ভাঁজুর ছড়া এইখানে উদ্ধত করিলাম। ভাঁজু পূজায় পুরুষেরা কেউ যেতে পারে না, মেয়েরা নাচে ও গান করে। তবে পুরুষেরা যে লুক্কাইত ভাবে সেই উৎসবে যোগ না দেয় তা নয়, তবে প্রকাশ্যে যোগ দিতে পারে না, কারণ সেটা মেয়েদের উৎসব।
ভাঁজুর ছড়া।
এক কলসি গঙ্গাজল
এক কলসি ঘি।
বৎসর অন্তর আসেন ভাঁজু,
নাচব না ত কি॥১
ভাঁজু লো কলকলানি,
মাটির লো সরা।
ভাঁজুর গলায় দেব আমি
পঞ্চ ফুলের মালা॥২
পূর্ণিমার চাঁদ দেখে
তেঁতুল হল বঙ্ক।
গড়ের গুগুলি বলে
আমি হব শঙ্খ॥
ওগো ভাঁজু
কি করতে পারো।
আইবুড়ো ছেলের
বিয়ে দিতে নারো॥৩
তার পরদিন সকালে ভাঁজুর বিসর্জ্জন হয় তার ছড়া—
এই পথে যেও ভাঁজু,
এই পথে যেও।
বেনা গাছে কড়ি আছে,
দুধ কিনে খেও॥১
ঐ পথে যেও ভাঁজু,
ঐ পথে যেও।
বেনা গাছে কড়ি আছে,
সন্দেশ কিনে খেও॥২
ইত্যাদি—ইত্যাদি—ইত্যাদি॥
এই গেল ভাঁজুর ছড়া আর ভাদুর ভাদ্র মাসের সংক্রান্তির দিন, কি অন্য কোন দিন, পূজা হয় তাহা ঠিক আমার মনে নাই, তবে তাহাদের মধ্যে দুই দলে ছড়া কাটাকাটি হয় তাহার দুই একটি নমুনা দিলাম—
আমার ভাদু নেয়ে এল,
পরতে দেব কি?
ঘরে আছে পাটের শাড়ি,
বার করে দি।
ওদের ভাদু নেয়ে এল,
পরতে দেব কি?
ঘরে আছে ছেঁড়া কানি,
বার করে দি॥১
অপর পক্ষের লোক গাহিল—
আমার ভাদু নেয়ে এল,
খেতে দেব কি?
ঘরে আছে খাসা মণ্ডা,
বার করে দি॥
ওদের ভাদু নেয়ে এল,
খেতে দেব কি?
ঘরে আছে পচা মণ্ডা,
বার করে দি॥২
আর ভাদুর দু-একটা গানও লিখিলাম বোধ হয় পাঠকের নিতান্ত অপ্রীতিকর হইবে না—
গীত।
নীচে কোটা উপর কোটা,
মধ্যে কোটা ইঁদারা।
আমার ভাদু দালান দিচ্ছে,
সুরকী কুটতে যাস তোরা॥
সুরকী কোটা যেমন তেমন,
ইটে কোটা ভার হল।
কেমন করে ঘর যাব ভাদু,
মেঘ নেমে আঁধার করে এল।৷১
চালে ধরে চালকুমড়ো,
ভুয়ে ধরে কদু।
হাট-তলা দিয়ে ডাক ডাকছে,
সেই পরাণের বঁধু।৷২
ঠাকুরবাড়ির কাল তুলসী,
পাতা ঝরঝর করে।
ঠাকুর গেছেন পরবাস,
মনটি কেমন করে॥
কেষ্ট গেছেন বিষ্ণুপুর,
না বলা করিয়ে।
আদেক রাতে এলেন,
কেষ্ট পাঁচুনি হারায়ে॥
সে কেষ্ট ফেরেন বনে বনে।
রক্তকুশেরী কাঁটা ফুটিল চরণে॥
হাতে কম্বল তেলের বাটি,
কানে কদম ফুল।
আমার কেষ্ট নাইতে যাবেন,
কালিদহের কুল।৷৩
এইরূপ করিয়া একমাস কাটিয়া যাবার পর উনি আমাকে আমার পিত্রালয়ে লইয়া আসেন। আমি আসিবার দিন কার্ত্তাদাদামহাশয়কে প্রণাম করিয়া বিদায় লইলাম তিনি আমাকে আশীর্ব্বাদ করিয়া বলিলেন—যাও, আবার শীঘ্র আনিব। উনি আমায় কলিকাতায় আমাদের বাড়ীতে রাখিয়া, ১লা বৈশাখ নব বর্ষের উপাসনা শেষ করিয়া, চুঁচড়ায় চলিয়া গেলেন। আমি একমাস, মার কাছে রহিলাম, পরে আষাঢ় মাসে উনি আসিয়া আবার আমাকে চুঁচড়ায় লইয়া গেলেন। এবার আমাকে আর একটা স্বতন্ত্র বাড়ীতে লইয়া গেলেন। আমরা যে বাড়ীতে ছিলাম তাহা তখন সংস্কার হইতেছিল, বাড়ীর বাগানটি নানা জাতীয় ফুল ফলে সুশোভিত ছিল, উদ্যানে নানাজাতীয় ফুল ফুটিয়া বাগানটি আলো করিয়া থাকিত, আমি দিনের বেলায় ফুল তুলিয়া এগাছের ওগাছের ধারে ধারে ঘুরিতাম, ক্লান্ত হইলে গাছের ছায়ায় বসিয়াম, ও বৈকাল হইলে ফুলময় সাজে সাজিতাম, উনি আবার সেই ফুল সাজা দেখে আমাকে বনদেবী বলিতেন। সেখানে একমাস বড় সুখেই কাটিয়াছিল কারণ সেখানে আমার ভালবাসার দুইটি জিনিষ পাইয়াছিলাম—গঙ্গা ও ফুল। একমাস পরে আমরা পুনরায় মাধব দত্তের বাড়ীতে ফিরিয়া যাইলাম এবং সেখান হইতে শ্বশুরবাড়ী ১লা শ্রাবণ রওনা হইলাম। যাবার দিন অতি প্রত্যুষে কর্ত্তাদাদামহাশয়কে প্রণাম করিতে যাইয়া দেখি একখানি ইজিচেয়ারে আবক্ষ বস্ত্রের দ্বারা আবৃত করিয়া সূর্যের উদয় দেখিতে ছিলেন, আমরা প্রণাম করায় সময়োচিত দুই একটি উপদেশ দিয়া আশীর্ব্বাদ করিয়া বিদায় দিলেন। আমরা গঙ্গা পার হইয়া নৈহাটিতে ট্রেনে উঠিলাম। হৃদয়পুরে আমার শ্বশুরবাড়ী, যাইতে হইলে রামনগর স্টেশনে নামিতে হয়, সেখান হইতে পাল্কি বা গরুর গাড়ীতে যেতে হয়। বেলা দুই প্রহরের সময় আমাদের ট্রেন রামনগর ষ্টেশনে পৌঁছিলে আমরা দেখি যে দুইখানি পাল্কি আমাদের জন্য পূর্ব্ব হইতে অপেক্ষা করিতেছে। আমরা দুইজনে দুইখানি পাল্কিতে উঠিলাম এবং দাসীকে ও জিনিষপত্রগুলিকে একখানি গরুর গাড়ীতে চড়াইয়া দিয়া যাত্রা করিলাম। দুইখানি পাল্কি পাশাপাশি চলিল তখন মধ্যাহ্ণকাল প্রখর সূর্যকিরণে নিস্তব্ধ প্রান্তরে কাকের কা কা শব্দ ভিন্ন আর কিছুই শ্রুতিগোচর হইতে ছিল না। এইরূপে আমরা মাঠের পর মাঠ, গ্রামের পর গ্রাম, পার হইয়া চলিলাম। একটি গ্রামের কাছে যখন পাল্কি যাইতেছিল রৌদ্রাভ্যাস্ত কতকগুলি গ্রাম্য বালক রৌদ্রে দৌড়াদৌড়ি করিতেছিল, বাহকদের শব্দে-ঐ বর কনে আসিতেছে— বলিয়া ছুটিয়া আসিল, আমার আপাদ মস্তক দেখিল, ও আমার পরণের লাল কাপড় দেখিয়া বলিল—এই কনে যাইতেছে, আর একজন আমার পায়ে জুতা দেখিয়া বলিল—ওরে কনে নয়রে, দেখছিস্না পায়ে জুতা আছে, ও বর! তাহাদের বিচার শক্তি দেখিয়া আমি মনে মনে হাসিলাম। কিছুদূর যাইতে না যাইতে ঘুঘুর করুণস্বরে প্রাণ করুণরসে পূর্ণ হইয়া গেল, বাহকদিগের প্রতি চাহিয়া দেখি দারুণ গ্রীষ্মে তাহারা গলদ ঘর্ম্ম হইয়াছে, তাহাদের দেখিয়া বড় কষ্ট হইল, ভাবিলাম—দয়াময়, তোমার রাজ্যে মানুষ কষ্ট পায় কেন? আমি দিব্য পাল্কিতে আরামে যাইতেছি, আর বেচারারা পেটের দায়ে এত ক্লেশ ভোগ করিতেছে; কেহ যদি ইহাদিগকে অমনি টাকা দিত তাহা হইলে ইহাদের আর এত ক্লেশ ভোগ করিতে হইত না। আমি আমার পাল্কির দরজা বন্ধ করিয়া দিলাম ও নিজেও তাহাদের ক্লেশের ভাগী হইবার জন্য চুপ করিয়া বসিয়া রহিলাম।
অনেকক্ষণ পরে একটা গ্রামে বড় গাছের ছায়ায় তাহারা বিশ্রামের জন্য পাল্কি নামাইল, উনি আমার পাল্কির দ্বার বন্ধ দেখিয়া খুলিয়া দিলেন ও আমাকে ঘর্ম্মাক্ত কলেবর দেখিয়া ভাবিলেন আমি ভয় পাইয়া থাকিব; বলিলেন—ভয় কি এখানে নাব, এস আমরা প্রকৃতির শোভা দেখি। তখন রৌদ্রের তেজ কমিয়াছে ও মৃদু মন্দ উষ্ণ সমীরণ বহিতেছে, বৃক্ষ অন্তরালে একটি বউ কথা কও পাখী বসিয়া ডাকিতেছে। আমি পাল্কি হইতে নামিয়া দেখিলাম দুরে নীলের ক্ষেত্রসকল নীল সতেজ গাছে পুর্ণ, আমরা সেই নীলের ক্ষেত্রে কিছু পদচারণা করিয়া পুনরায় পাল্কিতে উঠিলাম। বাহকেরা আমাদের লইয়া চলিল, আমরা গ্রাম্য শোভা দেখিতে দেখিতে চলিলাম।
ক্রমে সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনাইয়া আসিল, তখন অন্ধকারের মধ্য দিয়াই আমরা চলিলাম। এই অন্ধকারে অচেনা পথে ও অপরিচিত স্থানে যাইতে কে জানে কেন আমার মহাযাত্রার কথা স্মরণ হইল সঙ্গে সঙ্গে একটি দীর্ঘ নিশ্বাসও পড়িল ও সেই অন্ধকারের মধ্যে আমাদের প্রিয়তমের সুন্দর হস্ত দেখিতে পাইলাম। সেই হস্ত ধারণ করিয়া আমরা জীবনের পথে ও মরণের পরপারে চলিয়া যাইব মনে করিয়া আমার হৃদয়ে শান্তি ও নির্ভর আসিল। তখন আমি চক্ষু মুদ্রিত করিয়া আমাদের প্রাণের প্রাণকে ভাবিতে ভাবিতে চলিলাম। কতক্ষণ এই অবস্থায় ছিলাম জানি না—চাহিয়া দেখি পাল্কি আমার শ্বশুর গৃহের দ্বারে আসিয়া প্রবেশ করিল ও বাহকগণ পাল্কি নামাইল।
আমার ভাশুরঝি ও মাসাস্শাশুড়ি আসিয়া আমাকে বাড়ির মধ্যে লইয়া গেলেন। ১৫ দিন আমি সেখানে ছিলাম। আমার সমবয়সি ভাশুরঝির সহিত আমার বড় ভাব হইয়াছিল সে বড় ভাল মেয়ে, বড় সরলা ছিল, সে আর ইহলোকে নাই আমাকে পাইয়া তাহার ক্ষুদ্র হৃদয়খানি আমার কাছে উন্মুক্ত করিয়াছিল তাহার সাহচর্য্যে আমার হৃদয় বিশেষ আনন্দ পাইয়াছিল। সেই জন্য তাহার দুই একটি কথা আমার বাল্যজীবনের স্মৃতির সহিত আজও জড়িত আছে।
ফিরিয়া চুঁচড়ায় আসিয়া আবার মার, কাছে আসিলাম—কে জানিত এই আমার শেষ মার কাছে যাওয়া। সেই অতীত কালের স্মৃতি আজও যেন আমার প্রত্যক্ষ বোধ হইতেছে। ভবিষ্যৎ তুমি যদি বর্ত্তমানে পরিণত না হইতে, তবে অতীতের স্মৃতির মর্ম্ম পীড়া আমাকে ভোগ করিতে হইত না। স্মৃতির তীব্র বেদনায় যখন প্রাণে জ্বালা আসে তখন বিস্মৃতির সলিলে তাহা নিবারণ করিতে ইচ্ছা হয় না বিস্মৃতির অতলসলিলে ডোবা, এবং স্মৃতির মর্ম্ম জ্বালা সহ্য করা এই দুয়ের মধ্যবর্ত্তী পথ আর নাই; এই দুয়ের অতীত পথ আছে, তাহা ভগবান। মার কাছে ভাদ্র মাসে আসিয়াছিলাম অগ্রহায়ণ মাসে উনি মহর্ষির সহিত ভ্রমণে বাহির হইলেন। উনি যখন বাহির হন তখন আমার জ্বর বিকার হইয়াছিল। ভ্রমণে যাইবার পূর্ব্বে আমার সঙ্গে দেখা করিয়াছিলেন ও রওনা হইবার দিন আমাকে একখানি পত্র দিয়া গিয়াছিলেন, তখন আমার জীবন মরণের অভিনয় হইতেছিল, চিঠির একবর্ণও পড়িতে পারি নাই। পরে আমার স্বামী বম্বে গিয়া তার করিয়া আমার সংবাদ লন, একমাস কি দেড়মাস পরে তবে আমি আরোগ্য লাভ, করি। জীবনের যে অংশ সুখে কাটিয়াছে তাহা বাল্যকালের পরবর্ত্তী শোকের প্রবল আঘাতে ভগ্ন হইয়া গিয়াছে, ও সেই ভগ্নতরি এখনও ধীরে ধীরে চলিতেছে, কবে কুল পাইব তাহা বিধাতাই জানেন। মাঘও গেল, ফাল্গুনও যায় যায়, উনি বম্বে হইতে আসিয়া দেশে যান। ২৩ ফাল্গুন রাতে আমার একটি কন্যা সন্তান হয়, আমি মা হইলাম, রমণী জীবনের এই শেষ পরিণতি, ইহাতেই রমণী মহিমাময়ী, এইখানে প্রেম পূর্ণতা লাভ করে, দুইটি হৃদয়কে এক করিয়া দেয়। পর দিন উনি আসিলেন, মা কত আনন্দে তাঁর সেই ছোট নাতনিটিকে ওনার কোলে দিলেন, সেই সুন্দর ফুলের মত ছোট কন্যাটিকে দেখিয়া আমারও যে আনন্দ হয় নাই তাহা নয়। শিশুর সুন্দর মুখশ্রীতে আমি বিশ্বসৌন্দর্য্যের আভাস পাইতাম, মনে মনে স্বর্গসুখ ভোগ করিতাম। আমি আমার সুখস্বপ্নে মগ্ন আছি এমন সময়ে ১৬ চৈত্রে জননীকে অশেষ ক্লেশ দিয়া তাঁর এক পুত্র সন্তান ভূমিষ্ট হইল। পরে ২১ দিনে যথাবিহিত ষষ্ঠী পূজা হইয়া গেলে একদিন নিশীথে মার গায়ে হাত দিয়া দেখি ভয়ানক গরম। সেই গরম আমার হৃদয়ে যেন বৈদ্যুতিক আঘাত করিল আমি বলিলাম—মা, তোমার গা এত গরম কেন? মা বলিলেন—আমার বড় জ্বর হইয়াছে ও ঘাড়ে এত ব্যথা যে আমি উঠিতে পারিতেছি না। আমার ভগ্নীকে উঠাইয়া আগুণ করিয়া তাপ দিতে দিতে ক্রমে নিশা বঅসান হইল, প্রভাত সমিরণের শীতল স্পর্শে চিন্তাক্লিষ্ট প্রাণে শান্তি আসিল। মার ব্যথা একটু উপশম হওয়ায় মা উঠিয়া হাত মুখ ধুইলেন। পরে ডাক্তার আসিয়া মায়ের হাত দেখিয়া বলিল—নাড়ীর গতি বড় এলোমেল তোমরা ভাল ডাক্তার ডাকাও—এই বলিয়া হোমিওপ্যাথিক ঔষধ দিয়া চলিয়া গেল। ঔষধ ও পথ্য খাওয়ান হইল, বৈকালে ঘর্ম্ম হইয়া জ্বর ত্যাগ হইয়া গেল। পর দিন একটু ডালের যুস ও ঔষধ খাওয়ান হইল সন্ধ্যার সময় পুনরায় জ্বর প্রবল হইল ও বড় ডাক্তার ডাকান হইল। ডাক্তার আসিয়া বুক পরীক্ষা করিয়া নিউমোনিয়া হইয়াছে বলিয়া ঔষধ দিয়া চলে গেলেন। আমি মার কাছে আসিয়া দেখি মা প্রলাপ বকিতেছেন, আমাকে জোরে ডাকিয়া ওনার নাম করিয়া বলিলেন—সে আসিয়াছে তাহার খাবার দেখিয়া দেও। আমি কপালে করাঘাত করিলাম, কে যেন আমার মনের ভিতর বলিতে লাগিল মা আর বাঁচিবেন না। এই মনের ভাব কিছুতেই মন হইতে দূর করিতে পারিলাম না। চিকিৎসা চলিতে লাগিল রোগ উপশম না হইয়া ক্রমে বৃদ্ধি পাইতে লাগিল। ১২ দিনের দিন সকাল বেলা মার কাছে বসিয়া আছি এমন সময় মার জ্ঞান ফিরিয়া আসিল। মা আমাকে আরও নিকটে ডাকিয়া হাত তুলিলেন। হাত কাঁপিতেছে দেখিয়া মার হাত আমার হাতের ভিতর লইলাম, আমার চখেরজলে মার হাত ভিজিয়া গেল, মা আমাকে বলিলেন—তুমি কাঁদিতেছ কেন আবার আমি সেরে উঠব, আবার বল পাব, তুমি জল খেয়ে এসে আমার কাছে বস। আমি বলিলাম—আমি খেয়েছি। মা বলিলেন—কেন মিথ্যে কথা বলিতেছ তোমার মুখ শুখন, যাও খেয়ে এস। অগত্যা উঠিয়া গিয়া যৎকিঞ্চিৎ জলযোগ করিয়া আবার মার কাছে আসিয়া বসিলাম। ক্রমে বেলা বাড়িতে লাগিল। একে বৈশাখ মাস, তাহাতে বেলা দ্বিপ্রহর, মা। জ্বালায় ছট ফট করিতে লাগিলেন। উত্তাপ পরীক্ষা করায় দেখা গেল ১০৭ ডিগ্রি জ্বর। জ্বালায় মা অস্থির হইয়া বলিতে লাগিলেন—এ দাহ জ্বালা সহিতে পারে না বালা।
তখন মা অর্দ্ধ জ্ঞানশূন্য। কিছুক্ষণ এই জ্বালা সহ্য করিবার পর যখন রৌদ্রের তেজ কমিয়া আসল তখন মার জ্বালাও কথঞ্চিৎ উপসম হওয়ায় তিনি নিস্তব্ধ হইলেন। ক্রমে যখন রাত ৮টা বাজিল তখন ডাক্তার জ্বর পরীক্ষা করিয়া বলিলেন ১০৮ ডিগ্রি—দেখিতে দেখিতে তাহা ৯ ডিগ্রিতে পরিণত হইল। তখন সব ডাক্তাররা বসিয়া বলাবলি করিতে লাগিলেন যে এত উত্তাপে লোকের প্রাণ থাকে না, এই জুর ত্যাগের সময় প্রাণ বিয়োগের আশঙ্কা। আমি এই কথা শুনিতে শুনিতেই অবসন্ন হইয়া ঘরের মেজের উপর শুইয়া পড়িলাম। সেই ঘরে মা খাটের উপর ছিলেন।
কিছুক্ষণ পরে আমার ভগিনীর আকুল ক্রন্দনে আমার ঘুম ভাঙ্গিয়া গেল, তাড়া তাড়ি উঠিয়া দেখি মার চখের তারা উর্দ্ধে উঠিয়াছে পেটও ফাঁপিয়াছে, ডাক্তার সেই জন্য টারপেনাণ্টাইন খাওয়াইতেছিল কিন্তু মা সে টুকু তখন গলধঃকরণ করিতে পারিতেছেন না। বাবা মহাশয় তাড়াতাড়ি ডাক্তার বেহারি বাবুকে ডাকিতে গেলেন। ডাক্তার আমাকে মার পা ধরিতে বলিলেন। ঐরূপ দুই তিনটা ফিটের পর মার শ্বাস আরম্ভ হইল। তখন ডাক্তার নীচে নামিয়া গিয়া বলিলেন—দেখি বেহারি বাবু আসছেন কি না—এই বলিয়া তিনি চলিয়া গেলেন।
আমরা ভাই ভগ্নি কজনে প্রাণের কাতরতায় কেবল ঘর বাহির করিতেছি এমন সময় বাবামহাশয় বেহারি বাবুকে লইয়া আসিলেন। ডাক্তার মাকে দেখিয়াই ঘর হইতে বাহির করিতে বলিয়া চলিয়া গেলেন। আমার ছোট ভাই বোনেরা সব চিৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিল। যখন বাবামহাশয় ও দাদা মাকে খাট হইতে নামাইতেছিলেন তখন আমার চোখে জল নাই, ঠিক যেন মন্ত্রচালিতের ন্যায় মায়ের শয্যার এক অংশ ধরিয়া মাকে ছাদে উন্মুক্ত আকাশের তলে লইয়া শোয়াইলাম। মুখের দিকে চাহিয়া দেখি মার চক্ষু তখন অর্দ্ধ নিমিলিত, প্রাণ দেহ পরিত্যাগের জন্য উর্দ্ধে উঠিতেছে। আমি তখন রোরূদ্যমানা ছোট ভগ্নিটিকে বলিলাম—আয় কাঁদবার অনেক সময় আছে এখন মার আত্মার কল্যাণের জন্য ঈশ্বরকে প্রাণ ভরিয়া ডাকি— এই বলিয়া করযোড়ে কাতরে মায়ের মাকে ডাকিয়া তাঁর কোলে আমার মাকে দিলাম। ফিরিয়া আসিয়া দেখি তখন মার প্রাণ দেহ পরিত্যাগ করিয়া অমর ধামে চলিয়া গিয়াছে, আর শূন্য দেহ পড়িয়া আছে। তখন আকুল হইয়া আমার বুক ফাটিয়া চোখ দিয়া জল পড়িতে লাগিল, কোনমতে কম্পিত হস্তে আলতা সিঁদুর প্রভৃতি দিয়া মার মৃতদেহ সাজাইয়া দিলাম, মাকে লইয়া গেল। স্বর্ণপ্রতিমা দগ্ধ হইতে চলিল, আমি দগ্ধ হৃদয়ে গৃহে পড়িয়া রহিলাম। দুই দিন শোকে দুঃখে কাটিয়া গেল। আমাদের কাঁদিতে দেখিলে বাবামহাশয় নিষেধ করিয়া বলিতেন—কাঁদিও না, কাঁদিলে মৃত আত্মার ক্লেশ হয়।
মার মৃত্যুর পর তিন দিনের দিন রাত্রে আমি এক আশ্চর্য্য স্বপ্ন দেখিয়াছিলাম তাহা পর অধ্যায়ে স্বল্পকাহিনীতে লিপিবদ্ধ করিয়াছি, সেইজন্য আর এখানে তাহার পুনরুল্লেখ করিলাম না। পরদিন চতুর্থী; কন্যার কর্ত্তব্য শেষ করিলাম। পাঁচ দিনের দিন আমি একটি কবিতা লিখিয়াছিলাম তাহা এইখানে উদ্ধৃত করিলাম—পাঁচটি দিবস গত হইল জননি
দেখিনে তোমার মাতঃ চরণ দুখানি।
ক্ষণেক তোমার কাছে হইলে অন্তর
মনে করিয়াছ মাগো যুগযুগান্তর।
এখন মোদের ছাড়ি হইয়ে অন্তর
কেমনে রয়েছ মাগো বল নিরন্তর?
কত অপরাধ মাগো করিয়াছি আমি
তাই কি মোদের ছেড়ে চলেগেলে তুমি?
এজনমে আর কি মা করিব শ্রবন
স্নেহ মাখা তোমার সে মধুর বচন?
আর কি কোলেতে শুয়ে জুড়াব জীবন,
আর কি দেখিতে পাব তোমার আনন?
২
দুখেতে কাতর হলে সান্ত্বনাদায়িনী
এমন কাহারে আর পাইব জননী?
অধম তনয়া মাগো আমি যে তোমার
কৃপাকরি অপরাধ ক্ষমিও আমার।
যতদিন রবে মাগো এদেহে জীবন
তাবৎ পূজিব মাগো তোমার চরণ।
বসাইয়া তব মূর্ত্তী মানস আসনে
ভক্তি ফুলহার দিয়া পূজিব যতনে।
মাতৃ বিয়োগে আমার বিবাহিত জীবনের আনন্দ ও সুখ অর্দ্ধেক চলিয়া গেল। তখন বুঝিলাম যে মানব এসংসারে কখন নিরবচ্ছিন্ন সুখ ভোগ করেনা। চতুর্দ্দশ বৎসরের বালিকার হর্ষোৎফুল্ল জীবনকে শোকের আঘাতে বিপর্য্যস্ত করিয়া দিল। এই সময় হইতে প্রায়ই আমি শোকের আঘাত পাইয়া চলিলাম, আমার শৈশব জীবনের স্মৃতিও এইখানে শেষ করিলাম। আমার জীবনের আর সব অধ্যায় অপরের কোন কাজে আসিবেনা তাহা আমাতেই রহিয়া গেল। সেই দুঃখময় অপূর্ণ কৃষ্ণ-অধ্যায় খুলিয়া কাহার নিকট ধরিব, তাই এইখানে ইতি করিলাম।
আমার হৃদয়ের গভীর ভক্তি ও প্রণতির সহিত স্বর্গীয় পতিদেবতার চরণে আমার রচনা ও স্বপ্ন কাহিনী উৎসগীকৃত হইল—
দেব!
তুমি স্বর্গে আমি মর্ত্তে, আমি ইহলোকে তুমি পরলোকে, বাহির হইতে দেখিতে গেলে তোমাতে আমাতে বহুদূরে অবস্থান করিতেছি কিন্তু আমার অন্তরের নিভৃত আসনে তুমি চির বিরাজিত, বাহিরের কোলাহল সেখানে পশেনা।
তুমি আমার আরাধ্য দেবতা ও আমি তোমার চির সেবিকা এই সম্পর্ক আমাদের কেহই ছিন্ন করিতে পারিবেনা। আমরা যখন দুইজনে ইহলোকে ছিলাম তখন কোন কথা বলিতে হইলে বাক্যের দ্বারা প্রকাশ না করিলে তুমি জানিতে পারিতে না, আর এখন মনের কথা মনে না উঠিতেই তুমি তাহা জানিতে পারিতেছ। আমার ইচ্ছা ছিল আমার এই খাতা হাসিতে হাসিতে তোমার হাতে দিব কিন্তু বিধাতার ইচ্ছা অন্যরূপ। এখন এ খাতা তোমার হাতে দিব সে শক্তি আমার নাই, তাই অশ্রু জলের সহিত আমার এই খাতাখানি শেষের সম্বল তোমার চরণে উপহার দিলাম। মূল্যহীন জিনিষ মুল্যবান হয় যখন তাহা ভালবাসায় উজ্জ্বল হয়।