আমার খাতা/আমার স্বপ্নকাহিনী
আমার স্বপ্ন কাহিনী।
(১)
আমার মাতৃবিয়োগের দুই দিনের পরের রাত্রে আমি যখন কাঁদিয়া কাঁদিয়া ক্লান্ত হইয়া নিদ্রিত হইয়াছিলাম সেই সময়ে স্বপ্ন দেখিলাম যে একজন কৃষ্ণ পরিচ্ছদে আপাদমস্তক আবৃত লোক আসিয়া আমার হাতে একখানি পত্র দিয়া নীরবে দাঁড়াইয়া রহিল। আমি কাগজখানি উল্টাইয়া পাল্টাইয়া তাহাতে কিছুই লেখা দেখিতে পাইলাম না, তখন তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলাম—
আমি ত এতে কিছু দেখিতে পাইলাম, তুমি কে?
তদুত্তরে সে জলদগম্ভীর স্বরে বলিল—
তোমার মা তোমাকে ডাকিয়াছেন তাই তোমাকে জানাইতে আসিয়াছি।
আমি জিজ্ঞাসা করিলাম—আমার মা কোথায়?
তাহাতে সে উত্তর করিল—
আমার সঙ্গে এস!
আমি তখন বিনা বাক্যব্যয়ে তাহার অনুগমন করিলাম। ঘরের বাহির হইয়া আমার দেহে একটা প্রবল আকর্ষণ অনুভব করিতে লাগিলাম, তখন বুঝিলাম সে আমাকে লইয়া শূন্যে উঠিতেছে।
অনন্ত নক্ষত্র খচিত নীলাকাশের মধ্য দিয়া আমাকে লইয়া চলিতে চলিতে হঠাৎ সে উর্দ্ধ হইতে নিম্নে অবতরণ করিবার ভাবে দাঁড়াইল। সম্মুখে এক প্রকাণ্ড শ্বেত প্রস্তরের অট্টালিকা ও এক সূক্ষ্ম কৃষ্ণবর্ণের রেশমি বস্ত্রের যবনিকা দেখিতে পাইলাম। সে যবনিকার মধ্যে প্রবেশ করিল, আমি দ্বারদেশে দাঁড়াইয়া রহিলাম। সে অল্পক্ষণ পরে আসিয়া দুই হস্তে যবনিকা সরাইয়া দিলে দুইভাগে বিভক্ত হইয়া গেল এবং অট্টালিকার মধ্যস্থিত কক্ষ প্রকাশ পাইল। দেখিলাম তাহা মর্ম্মর প্রস্তর নির্ম্মিত ও তাহার মধ্যস্থলে লাল মখমল মণ্ডিত সিংহাসন সদৃশ একখানি কৌচ। সেই কৌচের উপর আলুলায়িত কুন্তলা শুভ্রবসনা জ্যোতির্ম্ময়ী জননী দেবী—বামপার্শ্বে এক জ্যোতির্ময়ী রমণী উপবিষ্টা এবং দক্ষিণ পার্শ্বে আর এক তদ্রুপ রমণী দণ্ডায়মানা; উভয়ই অপরিচিত। এই দৃশ্য আমি অবাক হইয়া দেখিতেছি এমন সময়ে মা আমায় হাসিয়া বলিলেন—
তুমি কাঁদ তাতে আমার বড় ক্লেশ হয়, দেখ আমি এখন কেমন সুখে আছি আর আমার কোন কষ্ট নাই, আগে আমি রোগে বড় কষ্ট পাইয়াছিলাম দেখ এখন আমি কেমন শরীর পাইয়াছি। তুমি আর কাঁদিও না, তুমি কি মনে কর তুমি আমার জন্য কাঁদ? তা নয়, তুমি তোমারই জন্য কাঁদ এখন বুঝিলে ত, যাও—
মার মুখ হইতে যেই—যাও—কথাটি বাহির হইল আমার ঘুম ভাঙ্গিয়া গেল।
(২)
একরাত্রে স্বপ্ন দেখিলাম যে একটি সুন্দরী স্ত্রীলোক লৌহনির্ম্মিত এক গেটের ধারে দাঁড়াইয়া আছে। সে গেটটির এমন ভীষণ আকৃতি যে তাহা দেখিলেই ভয় হয়, তাহার ভিতর দিয়া প্রবেশ ত দূরের কথা। সে গেটের লম্বা লম্বা শিকের আগাগুলি খুব ধারাল এবং তাহা এত ঘন-সন্নিবিষ্ট যে তাহার ভিতর একটা হাতও প্রবেশ করান যায় না। সেইথানে আমি কিছুক্ষণ দাঁড়াইবার পর সেই স্ত্রীলোকটি আমায় বলিল—মা, তুমি এর মধ্যে যাও।
আমি তাঁহাকে নাম জিজ্ঞাসা করায় তিনি বলিলেন—আমার নাম সুখদা।
কিন্তু ভয়ে আমি কিছুতেই ভিতরে যাইতে চাহিলাম না, তিনিও ছাড়িবেন না। অবশেষে তিনি বলিলেন—দেখ উপরে কত লোক আছে, সকলেই এই পথে গিয়াছেন তুমিও যাইতে পারিবে, যাও।
তখন আমি ভয়ে ভয়ে চক্ষু মুদ্রিত করিয়া তাহার ভিতরে প্রবেশ করিলাম এবং পরে চাহিয়া দেখিলাম যে অক্লেশেই তাহা পার হইয়া আসিয়াছি। সম্মুখে দেখিলাম একটি সরল সোপানশ্রেণী, তদুপরি আর একটি স্ত্রীলোক দণ্ডায়মানা রহিয়াছেন। তিনি অপেক্ষাকৃত কৃশ ও আরও সুন্দরী; আমায় দেখিয়া হাসি মুখে উপরে যাইতে বলিলেন। আমি সেই সোপান অতিক্রম করিয়া যখন উপরে পেৌঁছিলাম তখন তিনি সাদরে আমার হাত ধরিয়া লইলেন। তাঁহাকে দেখিয়া আমার ভক্তি হইল, আমি তাঁহাকে প্রণাম করিয়া নাম জিজ্ঞাসা করিলাম। তিনি বলিলেন—আমার নাম মোক্ষদা। উপরে যাইয়া এমন একটা আলো দেখিলাম তাহার কাছে বিজলিও হার মানে, তা যেমন উজ্জ্বল, তেমনি স্নিগ্ধ, এক কথায় বর্ণনা হয় না। নানাজাতীয় ফুলের গন্ধ ও সুখস্পর্শ সমীরণে আমার নিদ্রা ভঙ্গ হইল। আমি যে শয্যায় সেই শয্যায় রহিয়াছি, তখন আমার মনে হইল—
“আমি যে তিমিরে
আমি সে তিমিরে”
(৩)
আর একদিন নিশীথে স্বপ্ন দেখিলাম যে একজন লোক কৃষ্ণ পরিচ্ছদে আপাদমস্তক ঢাকিয়া আমার পশ্চাৎ পশ্চাৎ আসিতেছে। তাহাকে দেখিয়া আমি জিজ্ঞাসা করিলাম—
তুমি কে? কেন আমার পশ্চাৎ পশ্চাৎ আসিতেছ। তাহাতে সে উত্তর করিল—
আমি মৃতকে লই ও জীবিতের পশ্চাৎ পশ্চাৎ থাকি, আমাকে চিনিতে পারিতেছ না?
আমি বুঝিতে না পারিয়া তাহার দিকে অবাক হইয়া চাহিয়া রহিলাম। তখন সে আবার বলিল—আমায় চিনিতে পারিতেছ না? আমি কাল!
বলিয়াই হাসিল। তাহার সে হাস্যধ্বনি আমার বক্ষে আসিয়া বাজিল, আমি নীরবে চলিতে লাগিলাম, সেও আমার পশ্চাতে চলিল। কিয়দ্দূর যাইয়াই জনতার কোলাহলের শব্দ শুনিতে পাইলাম। আমি সবিস্ময়ে চাহিতে সে আমাকে অঙ্গুলি নির্দ্দেশ করিয়া এক কৃষ্ণবর্ণের যবনিকা দেখাইল। আমি তাহার নিকট অগ্রসর হইয়া দেখিলাম যবনিকার অন্তরালে কত লোক আসিতেছে যাইতেছে! উর্দ্ধে চন্দ্রাতপ, নিম্নে এক উচ্চাসন, আসনে একজন উপবিষ্ট, তাহার আশেপাশে, কত জনসমাগম। চতুর্দ্দিক এক অপূর্ব্ব আলোকে আলোকিত। অর্থ কিছুই বুঝিতে পারিলাম না, ঘুম ভাঙ্গিয়া গেল তখন স্বপ্ন রহস্য বুঝিতে পারিলাম—মানুষের চিত্ত মোহনিদ্রায় অচেতন থাকে বলিয়াই এ বিশ্বরহস্য সুপ্তাবস্থায় বুঝিতে পারা যায়।
(৪)
আর একদিন স্বপ্নে দেখি—এক বিশাল প্রান্তরের একটি বড় বৃক্ষের ছায়ায় আমরা দুইটি প্রাণী, আমি ও একটি অপরিচিত রমণী বসিয়া ধর্ম্মালোচনায় প্রবৃত্ত আছি। এ কথা সে কথার পর সে কিছুক্ষণ চুপকরিয়া থাকিয়া আমাকে বলিল—
তুমি যাইবল আর তাই বল, ঈশ্বরকে কি জানা যায়, না বোঝা যায়? না দেখিয়া আমরা কি করে জানিতে বা বুঝিতে পারিব?
আমি বলিলাম—এই যে বৃক্ষের ছায়ায় বসিয়া আছি ইহার শাখাপ্রশাখা সবইত দেখিতে পাইতেছ?
তাহাতে সে বলিল—হাঁ ইহা ত আমি চখের সামনে দেখিতেছি, ইহাকে আমি কি করিয়া বলিব—নাই?
আমি বলিলাম—ভাল, এই যে বৃহৎ বৃক্ষ রহিয়াছে ইহার মূল কি তুমি দেখিতে পাইতেছ?
সে বলিল—না!
আমি বলিলাম—বেশ, এই গাছের যে মূল আছে তা তুমি জান ত, এবং এটাও বেশ বোঝ যে গাছ থাকিলে তাহার মূল থাকিবেই। তেমনি এই জগতের কার্য্য দেখিয়া ও নিজের আত্মাকে উপলব্ধি করিয়া আমরা কারণ রূপে মূলে ঈশ্বরকে বুঝি, এই বোঝাই আমাদের ঈশ্বরকে দর্শন করা।
সে বলিল—এই গাছের গোড়া খুঁড়িলেই মূল দেখিতে পাইব, কিন্তু ঈশ্বরকে কি করিলে পাইব? তখন আমি বলিলাম যে তুমি কি এই গাছের গোড়া খুঁড়িয়া মূল বাহির করিবার শক্তি ধর?
তাহাতে সে বলিল—না।
আমি বলিলাম—তবে?
তাহাতে সে বলিল—যদি সে শক্তি লাভ করি তবে ত পারিব।
আমি বলিলাম—নিশ্চয়, আমি তাহা স্বীকার করি। আমরা এই জগতের তাবৎ পদার্থের মূল যদি জ্ঞানের দ্বারা খনন করিতে পারি তখন দেখি যে সকলেরই মূলে ঈশ্বর। তবে আমাদের খননের শক্তি নাই বলিয়া আমরা কেন বলিব যে ঈশ্বরকে জানা যায় না বা দেখা যায় না।
আমার ঘুম ভাঙ্গিয়া গেল। অবাক হইয়া ভাবিলাম—স্বপ্নে আমাকে এসব যুক্তি কে দিলে?—ভাবিয়া হৃদয় আনন্দে পূর্ণ হইল!