দশম কল্পনা

নৈরাশক্ষেত্র—মধ্যভাগে মরুপ্রদেশ—তাহাতে চিরপ্রদীপ্ত অনলকুণ্ড—হতাশের মূর্ত্তিদর্শন ও নিদ্রাভঙ্গ।

ধীরে ধীরে ঋষি চলে আগে আগে,
পশ্চাতে করি গমন;
শোকারণ্য ছাড়ি অন্য ধারে তার
উপনীত দুই জন।
কঠিন মৃত্তিকা, নিম্ন উচ্চ ভূমি,
ধরা নহে সমতল;
চলিতে চরণ স্থির নাহি রহে,
সে পথ হেন পিচ্ছল।
নাহি ডাকে পাখী, তরুর শাখায়
নীরবে বসিয়া রয়;
বিনা বায়ুবেগ নিত্য তরুতলে
ঝরে লতা পত্রচয়।
ক্রীড়ায় নিবৃত্ত ব্যাধগণ যবে
উজাড় করিয়া বন,
ফিরে গৃহমুখে, ত্যজিয়া কানন
আনন্দে করে গমন;
তখন যেমন ছাড়ি নানা দিক্‌
পুনঃ ফিরে যত পাখী,
ভ্রমে উড়ে উড়ে তরু চারি ধারে
ভয়ে না প্রবেশে শাখী।
নিরখি আসিয়া এথা সেই ভাবে
আছে যত নিকেতন,
চারি ধারে তার ভ্রমে নিরন্তর
হতাশ পরাণিগণ,
সাহস না করে পশিতে ভিতরে
ক্ষুণ্ণমন, নতশির,

শুষ্ক কণ্ঠদেশ, শুষ্ক রুক্ষ বেশ,
নয়নে না ঝরে নীর।
হেরি কত প্রাণী চলে অতি ধীরে
দেহে যেন নাহি বল,
শুষ্ক নীলোৎপল মুখছবি যেন,
করে চাপে বক্ষঃস্থল।
কত যুবা, আহা, নত পৃষ্ঠদণ্ড
চলে হেন ধীরে ধীরে,
প্রতি পাদক্ষেপে যেন রেণু গুণি
নিরখে মহী-শরীরে।
হেন ধীর গতি তবু কত জন
পড়ে নিত্য ভূমিতলে,
স্খলিত চরণ ধূলিতে লুটায়
পিচ্ছল সেহ অঞ্চলে।
পড়ে ক্ষিতিপৃষ্ঠে চলিতে চলিতে
বৃদ্ধ প্রাণী কত জন;
উঠিতে শকতি নাহিক আশ্রয়,
আশ্রয়ে ধরে পবন।
কোথাও পরাণী হেরি শত শত
বসিয়া দুর্গম স্থানে,
অনিমেষ আঁখি নীরস বদন
নিত্য হেরে শূন্য পানে;
চলে দিনমণি ভাসিয়া গগনে
চাহিয়া তাহার পথ
ছাড়ে দীর্ঘশ্বাস, বলে “হা বিধাতঃ,
ভাল দিলে মনোরথ;
করি বড় সাধ ধরিলাম হৃদে
কৃপণের যেন মণি,
এখন সে আশা হয়েছে গরল
দংশিছে যেমন ফণী।

কেন বিধি হেন আশ্বাসে ভুলায়ে
জ্বালিলে হৃদয়ে শিখা?
জানিতে যদ্যপি অগ্রে এ ললাটে
এ হেন অভাগ্য লিখা!"
এরূপে বিলাপ করিছে অনেকে,
কেহ বা উঠিয়া ধায়,
ভাবে যেন শূন্যে কোন সে আকৃতি
সহসা দেখিতে পায়।
গিয়া দ্রুতপদে করতল যুড়ে
বাহু প্রসারণ করি;
বাতাস মিলায় ঘুচে সে প্রমাদ,
পালটে আশা সম্বরি,
ফিরে অধোমুখ বসিয়া আবার
দিনমণি-পানে চায়,
দেখে শূন্যমার্গে ধীরে ধীরে সূর্য্য
গগনে ভাসিয়া যায়।
নিরখি সেখানে প্রাণী অন্য কত
মনস্তাপে ধীরে ধীরে
কণ্ঠ হ(ই)তে খুলি কুসুমের হার
নিরখিছে ফিরে ফিরে;
করি ছিন্ন ছিন্ন ফেলিছে ভূতলে
পদতলে দৃঢ় চাপি;
নেত্রে অশ্রুবিন্দু ফেলি মুহুর্ম্মুহু
উঠিছে সঘনে কাঁপি;
পদাঘাতে চূর্ণ খণ্ড খণ্ড হয়ে
সে মালা পড়ে যখন;
"উদ্‌যাপন” বলি ছাড়িয়া নিশ্বাস
সে প্রাণী করে গমন।
দেখি কত জন বসিয়া নির্জ্জনে
ধীরে চিত্রপট খুলে,

নয়নের নীরে অঙ্কিত চিত্রের
একে একে রেখা তুলে;
করিয়া মার্জ্জিত সর্ব্ব অবয়ব
নিরঙ্ক করিয়া পরে,
বিছায়ে বিছায়ে সেই চিত্রপট
দুই করতলে ধরে;
পরশে হৃদয়ে পরশে মস্তকে
যতনে করে চুম্বন;
পরে ছিন্ন করি ফেলি ধরাতলে
সন্তাপে করে গমন।
বলে “রে এখন(ও) বিদীর্ণ হলি নে
হায় রে কঠিন হিয়া!
কি ফল বাঁচিয়া এ হেন মধুর
আশা বিসর্জ্জন দিয়া?
ভাবিতাম আগে না জানি কতই
কোমল মানব-মন;
ছিল যত দিন আশার হিল্লোল
করিত হৃদে ভ্রমণ।
বুঝেছি এখন লৌহ-ধাতুময়
কঠোর নরের হৃদি;
অনন্ত দুঃখের কারণ করিয়া
গঠিলা আমায় বিধি।”
কোনখানে দেখি প্রাণী শত শত
শয়ন করি ভূতলে,
পাষাণের ভার তুলিয়া বিষম
রাখিছে হৃদয়তলে;
কাঞ্চন মুকুট, মণিময় দণ্ড,
হেম-বিমণ্ডিত আসি,
ধূলি-সমাচ্ছন্ন, প্রতি জন পাশে
পড়েছে কতই খসি;

বলিছে “এখন বাঁচিয়া কি ফল
পাইয়া এ হেন ক্লেশ,
এ ছার সংসারে বৃথায় ভ্রমণ
ধরিয়া ভিক্ষুক-বেশ!
কত যে উৎসাহ কতই বাসনা
ধরিত আগে এ মন!
ভূধর-শরীর ভাবিতাম তুচ্ছ,
সামান্য তুচ্ছ গগন!
ভাবিতাম আগে জলধি গোষ্পদ,
ইন্দ্রপুরী ক্ষুদ্র অতি;
পরিণামে হায় হইল এ দশা,
এখন কোথায় গতি।”
বলিয়া এতেক ভগ্ন আসি লৈয়ে
হৃদয়ে করে প্রহার;
আবার ভূতলে পড়িয়া, বক্ষেতে
চাপায় পাষাণ-ভার;
উপরে উপরে শিলাখণ্ড তুলে
কতই চাপিছে বুকে;
করিছে আক্ষেপ কতই কাঁদিয়া
দারুণ মনের দুখে।
"কি কঠিন হিয়া" কহিছে কাঁদিয়া
"শিলা হেন হয় ছার,
না ভাঙ্গে সে বুক পরেছি যেখানে
বাসনা-ফণীর হার।”
বলিতে বলিতে উঠিয়া আবার
ক্রমে অগ্রভাগে যায়,
বৃক্ষ-অন্তরালে গিয়া কিছু দূরে
অরণ্য-মাঝে লুকায়।
বাড়িল কৌতুক কোথা প্রাণিগণ
এরূপে করে গমন

জানিতে বাসনা, ঋষির পশ্চাতে
চলিনু আকুলমন।
পশ্চাতে তাদের চলি কত দূর
ক্রমে আসি উপনীত;
অনন্ত বিস্তার ঘোর মরুভূমি
হেরি হ'য়ে চমকিত;
হেরি চারি দিক্‌ যেন নিরন্তর
ধূমেতে আচ্ছন্ন রয়;
নাহি বৃক্ষ লতা! পশু-পক্ষী-রব!
বিকলাঙ্গ সমুদয়।
বারিশূন্য মরু ধু ধু করে সদা,
চলিতে নাহিক পথ,
কঠিন কর্কশ লবণ-মৃত্তিকা
উত্তপ্ত অনলবৎ;
পদ তালু জ্বলে হেন তপ্ত বালু,
সে তাপ নাহিক জ্ঞান,
দিক্‌-হারা হৈয়ে ভ্রমে সেইখানে
পরাণী আকুল প্রাণ;
বাণীশূন্য মুখ, ধূলিপূর্ণ কেশ,
শরীরে কালিম মলা,
সে মরু-প্রদেশে ভ্রমে প্রাণিগণ
অন্তরে হ'য়ে উতলা;
বিশীর্ণ বদন, বরণ পাণ্ডুর,
নীরবে করে ভ্রমণ;
নিশীথ সময়ে প্রেতযোনি যথা
দগ্ধ চিত্ত, দগ্ধ মন।
হেরে মরু-দেশ তৃষিত অন্তরে
চায় সে ধূমল শূন্যে;
নিরখি সে ভাব শরীরে কণ্টক
হৃদয় পুরে কারুণ্যে।

আশাভগ্ন, হায়, কত নারী নর,
কত যুবা বৃদ্ধ প্রাণী
ভ্রমে এই ভাবে সে মরু-প্রদেশে
বদনে মলিন গ্লানি!
যাই যত দূর ক্রমশঃ ততই
নেহারি ধূম প্রগাঢ়!
ঘনঘটা যেন বিছায়ে আকাশে
তিমিরে ঢাকে আষাঢ়।
ক্রমে অন্ধকার ঘেরে দশ দিশ,
প্রবেশি যেন পাতাল;
উঠে নিত্য ধূম ফুটে ক্ষিতিতল
কজ্জল বর্ণ করাল।
মাঝে মাঝে মাঝে বিকট কিরণ
চমকি চমকি ছুটে;
কাল-কাদম্বিনী- কোলেতে যেমন
বিদ্যুৎ গগনে লুটে;
ভাতে তীব্র ছটা ধাঁধিয়া নয়ন
মুহূর্ত্তে পুনঃ লুকায়;
গাঢ়তর যেন অন্ধকারজাল
সে মরু'পরে ছড়ায়।
সে বিকট জালে আকুল তরাসে
শিহরি চাহি তখন,
রোমাঞ্চিত দেহ কম্পিত হৃদয়
নিস্পন্দ দুহ নয়ন;
দেখি স্থানে স্থানে কত শব-দেহ
সেই বারিশূন্য স্থলে,
বিকৃত বদন বিবর্ণ শরীর
লতারজ্জু বান্ধা গলে।
পীড়িত হৃদয় কাঁপিতে কাঁপিতে
দ্রুতবেগে করি গতি,

হেরি এইরূপ যাই যত দূর
বাহিয়া উত্তপ্ত পথি,
ক্রমে যত যাই তত উষ্ণ বায়ু,
উষ্ণতর শুষ্ক মহী,
উঠে ঘোর তাপ ঘেরি চারি দিক্‌
শরীর চরণ দহি।
ক্রমে উপনীত বিশাল বিস্তৃত
ভয়ঙ্কর মরুভূমে,
শূন্য গুল্ম লতা হূ হূ কবে দিক্‌
আচ্ছন্ন নিবিড় ধূমে;
হূ হূ জ্বলে বালি অনন্ত বিস্তার
দশ দিকে পরকাশ।
ধূ ধূ করে শূন্য অনন্ত শরীর
দেখিতে পরাণে ত্রাস।
লবণ-বালুকা- বিকীর্ণ প্রদেশ
দারুণ উত্তাপ অঙ্গে;
খেলে যেন তাহে অনলেব ঢেউ
উত্তপ্ত বালুর সঙ্গে।
মরু মধ্যভাগে একমাত্র তরু
তাপে জীর্ণ কলেবর,
প্রাণী একজন তলদেশে তাব
দাঁড়াইয়া স্থিরতর;
হাতে রজ্জু ধরি দৃঢ় করি তায়
বান্ধিছে কঠিন ফাঁস,
আরোপি শাখাতে পরিছে গলায়
ছাড়িয়া বিকট শ্বাস;
বুলে তরুডালে শবদেহ যেন,
বুলি হেন কত ক্ষণ,
কণ্ঠ হইতে পুনঃ খুলিয়া আবার
রজ্জু করে উন্মোচন।

কখন অস্থির বেগে তরুতল
ত্যজিয়া উন্মাদ-প্রায়,
ছুটে মত্ত ভাবে সে মরু-প্রদেশে
প্রাণী সে কঙ্কালকায়;
চলে দিক্‌ শূন্য করি হুহুঙ্কার
ফেনপুঞ্জ মুখে উঠে,
জ্বলন্ত বালুকা- তাপে দগ্ধীভূত
অস্থির চরণে ছুটে,
ছিন্ন করে দেহ নখে বিদারিয়া
দন্তে ছিন্ন করে ত্বচ্‌;
বান্ধিয়া অঙ্গুলে ছিঁড়ে কেশজটা
মস্তক করে বিকচ;
রুধিরাক্ত তনু ধায় দশ দিকে
প্রাণিগণে খেদাইয়া—
আশাভগ্ন প্রাণী যত সে প্রদেশে
সম্মুখে ভ্রমে ছুটিয়া।
জ্বলে মরুমাঝে অনলের কুণ্ড
বিপুল মুখব্যাদান
ধূমল কালিম বজ্র ধাতু সম
শিলাখণ্ডে নিরমাণ;
উঠে বহ্নি-শিখা ভীম কুণ্ড-মুখে
জিহ্বা প্রসারণ করি;
ছুটে ছুটে উঠে দূর শূন্যপথে
ভীষণ গর্জ্জন ধরি;
লিহি লিহি করি উঠে বহ্নিজ্বালা
কূপ হইতে ভীম রঙ্গে;
জিহি লক্‌ লক্‌ ছুটিতে ছুটিতে
প্রসারে যেন ভুজঙ্গে;
অগনি প্রাণিগণে ধার একে একে
সেই মূর্ত্তি ভয়ঙ্কর

সে অনল-কুণ্ডে মুহূর্ত্তে মুহূর্ত্তে
নিক্ষেপে বহ্নির 'পর।
ঋষি কহে “বৎস, হের রে হতাশ
হতাশ-কূপ নেহার;
আশার কাননে পরিণাম এই
নিরূপিত বিধাতার!"
নেহারি আতঙ্কে কম্পিত শরীর,
ভয়ে শিরে কাঁপে কেশ—
ধু ধু করে দিক্‌ অনন্ত ব্যাদান
বালুময় মরুদেশ;
জলিছে অনল সে বিষম কুণ্ডে
আশাভগ্ন নারী নর
দশ দিক্‌ হৈতে হতাশ-তাড়িত
পড়ে তাহে নিরন্তর।
হেরি ক্ষণ কাল সে অনল-কুণ্ড
ব্যাকুলিত হয় প্রাণ;
বলি, “শীঘ্র ঋষি পরিহরি ইহা
চল কোন অন্য স্থান।
যেন সে কোন বা অর্ণবের কুলে
বসি নিরখিলে একা,
অকুল সাগরে নিত্য ঊর্ম্মিকুল
নেত্রপথে যায় দেখা;
হু হু চলে জল, অনন্ত জলধি,
অনন্ত ঘন উচ্ছ্বাস;
শূন্য অন্তরীক্ষে অগাধ অনন্ত
ব্যোমকায় পরকাশ;
পক্ষি-প্রাণি-শূন্য নিখিল গগন,
পক্ষি-প্রাণি-শূন্য সিন্ধু;
জলধি-গর্জ্জন কেবলি নিয়ত,
নাহি অন্য স্বরবিন্দু।

যথা সে অকূল জলধির তীরে
পরাণ আকুল হয়;
বসিলে একাকী শরীর জীবন
বোধ হয় শূন্যময়;
সেইরূপ এথা এ মরু-প্রদেশে
প্রবেশি আকুল দেহ
হতেছে আমার, শুন তপোধন,
ইথে পরিত্রাণ দেহ।”
বলিয়া নিরখি হেরি চারি দিক্‌—
ঋষি নাহি দেখি আর!
নিদ্রাভঙ্গে পুনঃ সেই তরুতল
হেরি দামোদরধার!
তেমতি কিরণ পড়ি দামোদরে
আলো করে দুই কূল,
তেমতি কিরণ তরুর শবীরে
রঞ্জিত করিছে ফুল!
দেখিতে দেখিতে ফিরিনু আবার,
প্রবেশি আপন গেহে;
পুনঃ সে ধরার আবর্ত্তে পড়িয়া
মজিনু জটিল স্নেহে।

সমাপ্ত