আশাকানন/নবম কল্পনা
বিবেকের সহিত সাক্ষাৎ—আশার অন্তৰ্দ্ধান—বিবেকের অমুবর্তী হইয়া কাননের প্রান্তভাগ দর্শন। শোকারণ্য—তাহাতে প্রবেশ ও ভ্রমণ-শোকের মুর্ত্তি দর্শন ও তাহার পরিচয়।
আশার পশ্চাতে প্রাসাদ হইতে
আসিয়া কিঞ্চিং দূর,
জিজ্ঞাসি তাহারে কোন্ পথে এবে
ভ্রমিব তাহার পুর;
জিজ্ঞাসি কাননে সকলি কি হেন—
সকলি সৌন্দর্য্যময়?
কোন স্থানে কিছু সে কানন-মাঝে
কলঙ্ক-অঙ্কিত নয়?
শুনি হাসি আশা অতি সুমধুর
কহিলা আমার কাণে
"পাইবে দেখিতে ভুলিবে যাহাতে
উতলা হৈও না প্রাণে;
চল এই পথে" হেন কালে হেরি
জ্যোতির্ম্ময় ঋষি-বেশ,
তেজঃপুঞ্জ ধীর, অমল-বদন
শ্বেত-শ্মশ্রু, শ্বেত-কেশ
প্রাণী একজন আসি উপনীত
শিরেতে কিরণ-ছটা,
ছায়াশূন্য দেহ দেবের সদৃশ,
অঙ্গেতে সৌরভঘটা;
কহিলা আমারে "কুহকে ভুলিয়া
কোথা, বৎস, কর গতি!
দেখিছ যে অই আশা মায়াবিনী,
বড়ই কুটিলমতি।
করো না প্রত্যয় উহার বচনে
ভুলো না উহার ছলে,
হেন প্রবঞ্চক দেখিতে পাবে না
কদাপি অবনীতলে।
ছিল সত্য আগে অমর-আলয়ে,
সদা সত্যপ্রিয় অতি,
মিথ্যা, প্রবঞ্চনা না জানিত কভু,
সরল সুন্দর গতি।
বলিত যাহারে যখন যেরূপ
ফলিত বচন তথা;
ত্রিলোক ভুবনে আছিল সুখ্যাতি
মিথ্যা না হইত কথা।
ছিল বহু দিন সুখে স্বর্গধামে
ক্রমে দৈববিড়ম্বনা—
দানব দুরন্ত স্বর্গ লৈল হরি
অমরে করি ছলনা।
ইন্দ্রাদি দেবতা দনুজ-দৌরাত্ম্যে
স্বর্গপুরী পরিহরি,
ধরি ছদ্মবেশ করিলা ভ্রমণ
আসিয়া পৃথিবী'পরি;
স্বার্থ-পরবশ আশা না আইসে
অমরাবতীতে থাকে;
দানব-রাজত্ব- সময়ে স্বর্গেতে
স্বর্গের দুয়ার রাখে,
সেই পাপে ইন্দ্র দিলা অভিশাপ
গতি হ'বে ধরাতলে,
মানব-নিবাসে হইবে থাকিতে
চির দিন ভূমণ্ডলে।
তদবধি দুঃখে ভ্রমে কুহকিনী
ঘুরিয়া পৃথিবীময়,
কহে যত বাণী সকলি নিষ্ফল,
সকলি অলীক হয়।
চিরকাল হেন ভ্রমে এ কাননে
ভুলায়ে মানব যত,
নাহিক বিরাম ভ্রমে দিন দিন
শঠতা করি সতত।
নিরখি তোমারে সুকুমার অতি
সরল নির্ম্মল মন,
পড়িল বিপাকে উহার সংহতি
এখানে করি গমন;
করিয়া গোপন রেখেছে তোমারে
এ কানন গৃঢ় স্থল।
আ(ই)স সঙ্গে মম আমি চেতাইব
দেখাইব সে সকল।”
ঋষির বচন শ্রবণে কৌতুকী
আশার উদ্দেশে চাই,
হেরি চারি দিক্ কোন দিকে তারে
নিরখিতে নাহি পাই!
ঋষি কহে “বৎস, পাবে না দেখিতে
এখন তাহারে আর;
আমার নিকটে থাকে না সুস্থির
এমনি প্রকৃতি তার।
দেখিয়া আমারে নিকটে তোমার
অদৃশ্য হইলা ছলে,
গেলা ভুলাইতে অন্য কোন জনে,
আনিতে কাননস্থলে।”
শুনিয়া সে কথা তখন যেমন
ভাঙ্গিল নিদ্রার ঘোর;
নিদুলি ঘুচিলে উঠে যেন প্রাণী
পলাইলে পরে চোর!
কথায় প্রত্যয় হইল তাঁহার,
অগত্যা পশ্চাতে যাই,
আশাপুরী-প্রান্তে গাঢ়তর এক
অরণ্য দেখিতে পাই।
ঋষি কহে “বৎস, ভ্রমে এইখানে
আশাদগ্ধ প্রাণী যারা—
পতি, পুত্ত্র, ভ্রাতা, দারা, বন্ধু, পিতা,
জননী, বান্ধব-হারা।”
বাড়িল কৌতুক, যাই দ্রুতগতি
বন-দরশন আশে;
অরণ্য-নিকটে আসিয়া অস্থির,
স্তম্ভিত হইনু ত্রাসে।
যথা যবে ঝড় বহে ভয়ঙ্কর,
বায়ুমুখে মেঘ ছুটে,
অতি ঘোরতর দূর হ(ই)তে শূন্যে
হুহু শব্দ বেগে উঠে;
কানন হইতে তেমতি উচ্ছ্বাসে
উঠিছে গভীর রব;
শুনিয়া সে ধ্বনি কানন-বাহিরে
পরাণী নিস্তব্ধ সব;
ঘন হাহা রব, প্রচণ্ড নিশ্বাস,
উঠিছে ঝটিকা সম;
কভু শান্ত ভাব কভু ভয়ানক
এই সে তাহার ক্রম।
প্রবেশের মুখে সে অরণ্য-পাশে
দেখি প্রাণী একজন,
অতি ম্লান ভাব, হাতে ফুলমালা,
দুঃখেতে করে ভ্রমণ;
পড়িয়াছে কালি বদন-মগুলে,
গভীর চিন্তার রেখা,
ফেলি অশ্রুধারা চাহি ধরা-পানে
সতত ভ্রমিছে একা।
দেখিয়া তাহার কাতর অন্তর
উপনীত হই কাছে,
জিজ্ঞাসি কি হেতু ভ্রমে সেইখানে
কত দিন সেথা আছে?
কহিল সে জন "আশার কাননে
আছি আমি বহু দিন,
ভ্রমি এইরূপে দিবা বিভাবরী,
শরীর করেছি ক্ষীণ;
পক্ষ ঋতু মাস, বৎসর কতই,
অতীত হইল, হায়,
তবু কা'র গলে নারিলাম দিতে
এ ছার স্নেহ-মালায়।
কত যে পুরুষ, কত যে রমণী,
সাধনা করিনু কত—
গ্রহণ করিতে এ কুসুম-দাম
কেহ সে নহে সম্মত!
না জানি কি বুঝে পলায় অন্তরে
নিকটে দাঁড়াই যার;
তুলে যদি কভু দেই কা'র হাতে
ঠেলি ফেলে এই হার!
আহা কত প্রাণী হেরি এ কাননে
কতই আনন্দ পায়।
কি কব বিধিরে এ-হেন অমৃত
নাহি সে দিলা আমায়!
ভাবি কত বার ছিঁড়িব এ দাম,
ছিঁড়িতে নাহিক পারি;
তাই দুঃখে ত্যজি প্রণয়ের ভূমি
এ বনে হয়েছি দ্বারী।”
এত কৈয়ে যায় দ্রুতবেগে চলি,
চক্ষে বিন্দু বিন্দু জল;
শুনিয়া কাতর অন্তরে যেমন
জ্বলিল কুট গরল।
ঋষির সংহতি প্রবেশি অরণ্যে
হেরি এবে চারি দিক্—
জর্জ্জরিত তরু, লতা, গুল্ম, পাতা
আকীর্ণ রাশি বল্মীক।
ভাঙ্গিয়া পড়িছে এথা তরুশাখা,
ওথা উন্মুলিত দারু;
হেলিয়া কোনটি রয়েছে শূন্যেতে
হৃত পুষ্প ফল চারু;
কাহার পল্লব ভাঙ্গিয়া দুলিছে,
বিকৃত কাহার চূড়া;
বিদ্যুৎ-আহত বিশীর্ণ কোনটি
মাটিতে পড়িছে গুঁড়া;
যেন বা দুরন্ত অনল-দাহনে
উচ্ছিন্ন করেছে তায়—
সে শোক-কানন শোভা-বিরহিত
দেখিতে তাহার(ই) প্রায়।
নিরখি আশ্চর্য্য প্রাণী সে কাননে
দুই রূপ, দুই ভাগে,
ধায় পরস্পর কানন-ভিতরে,
পাছে এক, অন্য আগে;
জীবিত যাহারা তাহারা পশ্চাতে,
অগ্রভাগে ছায়া যত;
কানন-ভিতরে করে পরিক্রম
অবিশ্রান্ত অবিরত।
হা হতোঽস্মি রব, শিব শিব ধ্বনি,
সতত জীবিত মুখে;
ছায়াবৃন্দ পাছে ঘুরিয়া ঘুরিয়া
ভ্রমিছে মনের দুখে।
কত যে প্রাচীন ভ্রমিছে সেখানে
প্রসারিয়া দুই বাহু;
বিশীর্ণ শরীর, ব্যাকুল বদন,
গ্রাসিয়াছে যেন রাহু।
কত শিশু-ছায়া ধায় অগ্রভাগে,
নিকটে আসিলে, হায়,
অমনি সরিয়া ফিরে ফিরে চাহি
দূরেতে পলায়ে যায়।
কোন বা যুবক বৃদ্ধের আকৃতি
ছায়ার পশ্চাতে ধায়;
ছায়া স্থির রহে যুবা ছুটি আসি
আলিঙ্গন করে তায়;
কোথা আলিঙ্গন, বৃথা সে পরশ,
শূন্য বাহু বক্ষঃস্থলে।
যুব দীর্ঘশ্বাসে ছায়া নিরখিয়া
ভাসে তপ্ত অশ্রুজলে।
কোন জন ধায় ছায়ার পশ্চাতে
বাড়াইয়া দুই হাত;
বহু দিন পরে যেন পুনরায়
দেখা পায় অকস্মাৎ;
কহে অনুনয় বিনয় করিয়া
"আ(ই)স সখে এক বার,
বাহুতে জড়ায়ে তব কণ্ঠদেশ
নিবারি চিত্তের ভার।
বহু দিন সখে ভাবি নিরস্তর
অই সুপ্রসন্ন মুখ;
নামে জপমালা করি করতলে
সম্বরি মনের দুখ।
বদন আকৃতি সকলি তেমতি
সমভাব সেই সব,
তবে কেন সখে কাছে গেলে সর,
কেন নাই মুখে রব।”
কেহ বা বলিছে ছুটিতে ছুটিতে
কোন এক ছায়া-পাছে—
"আ(ই)স ফিরে ঘরে ভাই প্রাণাধিক,
চল জননীর কাছে;
দিবা নিশি হায় করিছে ক্রন্দন
জননী তোমার তরে;
সাজায়ে রেখেছে সকলি তেমতি
সাজায়ে তোমার ঘরে;
সেই ঘর আছে, আছে সেই জায়া,
ভাই, বন্ধু সেই সব,
সেই দাস দাসী, সেই পরিজন,
গৃহে সেই কলরব;
কমলের দল সদৃশ তোমার
শিশুরা ফুটেছে এবে;
আ(ই)স ফিরে ঘরে ক্রোড়ে করি তায়
বদন আঘ্রাণ নেবে;”
বলিয়া দুঃখেতে করিয়া ক্রন্দন
পশ্চাতে ধাইছে তার,
ছায়ারূপী প্রাণী না শুনে সে কথা
দূরে যায় পুনঃ আর।
আহা সুরূপসী রামা কোন জন
দুই বাহু ঊর্দ্ধে তুলি
ছুটে ঊর্দ্ধশ্বাসে "নাথ নাথ” বলি
কুন্তল পড়িছে খুলি,
"দাঁড়াও বারেক ক্ষণকাল, নাথ,
জুড়াক তাপিত বুক,
বারেক তুলিয়া দেখাও আমারে
অই শশিসম মুখ;
ভ্রমি অনিবার এ আঁধার বনে
বরষ বরষ হায়।
সাগর-সলিলে ধ্রুবতারা যেন
নাবিক নিরখি যায়।
উঠিছে তরঙ্গ চারি পাশে তার
তরণী ছুটিছে আগে,
অনিমেষ আঁখি দেখিছে চাহিয়া
আকাশের সেই ভাগে!
সেইরূপে নাথ জাগি দিবা নিশি
সেইরূপে দুঃখে চাই;
তবু এ দুরন্ত অকূল সাগরে
কুল নাহি খুঁজে পাই;
কবে পুনরায় আবার তেমতি
পাইব হৃদয়ে স্থান।
শুনিব মধুর সুধা-সম স্বর
জুড়াবে শরীর প্রাণ!"
এইরূপে সেথা কত শত জন
ছায়া অন্বেষণ করি,
ভ্রমিছে আক্ষেপ- রোদন করিয়া
আঁধার কানন ভরি;
ভ্রমে অবিচ্ছেদ, সদা খেদস্বর
শিরে বক্ষে করাঘাত,
ঘন দীর্ঘশ্বাস, অবিরল ধারা
যুগল নয়নে পাত।
তাহাদের মুখ চাহি ক্ষণকাল
দুঃখেতে পুরে হৃদয়,
কহি, হায় বিধি নবীন পঙ্কজ
শুকালে এমন হয়।
সৃষ্টির গৌরব প্রকাশিত যায়
এ-হেন তরুণী-মুখ
তাপদগ্ধ হৈয়ে মানবের মনে
দেয় কি এতই দুখ!
হীরা, মুক্তা, চুনী, বিধু, পদ্মফুলে
কলঙ্ক দেখিতে পারি;
তরুণীর মুখে দগ্ধ শোকছায়া
কদাপি দেখিতে নারি!
এরূপে আক্ষেপ করিয়া তখন
ক্রমে হই অগ্রসর;
ক্রমশঃ বাতাস বেগে অল্প অল্প
আঘাতে বদন'পর।
ক্রমে অগ্রসর হই যত আরো
বায়ু গুরুতর তত;
গাছের পল্লব লতা পাতা ক্রমে
বায়ুভরে অবনত।
ক্রমে বৃদ্ধি ঝড় প্রবল পবন
বুকে মুখে বেগে পড়ে;
অতি কষ্টে ধীরে হই অগ্রসর,
স্থির হৈতে নারি ঝড়ে।
যথা অন্তরীক্ষে বায়ু প্রতিমুখে
বিহঙ্গ যখন ধায়,
আগু হৈলে কিছু প্রবল বাতাসে
দূরে ফেলে পুনরায়,
পক্ষ প্রসারিয়া স্থির ভাবে কভু
বহু ক্ষণ শূন্যে রয়;
আগু হ(ই)তে নারে না পারে ফিরিতে
অবিচল পক্ষদ্বয়;
সেইরূপে যাই জিজ্ঞাসি ঋষিরে
কহ এ কি তপোধন—
কোথা হ(ই)তে হেন এই স্থানে বেগে
এরূপে বহে পবন?
অন্য দিকে হেরি ঝড়ের আকার
কিছু নাহি হয় দৃষ্টি;
বহিছে এখানে প্রচণ্ড বাতাস
এ কি অদভুত সৃষ্টি?
ঋষি কহে “বৎস, চল কিছু আগে
স্বচক্ষে দেখিবে সব;
কোথা হ(ই)তে ইহা কখন কি ভাব
কিরূপে হয় উদ্ভব।”
যাইতে যাইতে দেখি এক স্থানে
প্রচণ্ড ঝটিকা বহে;
সম্মুখে তাহার পশু পক্ষী জীব
তৃণ আদি স্থির নহে;
ধূলিতে ধূলিতে গগন আচ্ছন্ন,
ঘন বেগে শিলাপাত;
বৃষ্টিধারারূপে বরিষে কঙ্কর
বিনা মেঘে বজ্রাঘাত।
যথা সে তরঙ্গ সাগর হইতে
প্রবেশি নদীর মুখে
মত্ত বেগে ধায় তুলারাশি হেন
ফেনস্তূপ লৈয়ে বুকে,
ছুটে তরী-কুল তীর সম তেজে,
তীরেতে আছাড়ি পড়ে;
তরঙ্গ-তাড়িত বেগে পুনরায়
নদীগর্ভে ধায় রড়ে;
সেইরূপ এথা কত শত প্রাণী
ঝড়মুখে বেগে ধায়,
ঘন রুদ্ধশ্বাস আকুল কুন্তল
ধরা না পরশে পায়;
কত শত যুবা বৃদ্ধ নর নারী
বিধাবিত বেগে ঝড়ে,
কভু এক স্থানে কভু অন্য দিকে
আছাড়ি আছাড়ি পড়ে।
নিরখি সেখানে কিরণ ঢাকিয়া
আকাশে পড়েছে ছায়া,
বরষায় যথা তপন ঢাকিয়া
প্রকাশে মেঘের কায়া।
অথবা যেমন শূন্যে পঙ্গপাল
উড়িলে আঁধার-জাল,
পড়ে ধরাতলে ছায়া বিছাইয়া
ঢাকিয়া গগন-ভাল
তেমতি আকার ছায়া সে প্রদেশে
আঁধারিয়া নভঃস্থল,
ছুটিয়া ছুটিয়া ঘুরিছে শূন্যেতে
ছন্ন করি সে অঞ্চল।
অস্থির শরীর ছায়ার পরশে
শুষ্ক কণ্ঠ, রুদ্ধ স্বর,
চঞ্চল নয়ন তপোধন-পাশে
নিরবি শূন্যের 'পর;
যেন কালি-মাখা ঘোর গাঢ় মেঘ
শূন্যপথে উড়ি যায়;
ঝড়বেগে গতি দুলিয়া দুলিয়া
ধূম বিনির্গত তায়।
ভ্রমিছে সে মেঘ অন্ধকার করি
প্রসারে আকাশ যুড়ে;
সে মেঘের ছায়া পড়ে যার গায়
উত্তাপে তখনি পুড়ে।
শুকায় রুধির শরীরে আমার
তুণ্ডে নাহি সরে ভাষ,
অশ্রুপূর্ণ আঁখি ঋষির বদন
নিরখি পাইয়া ত্রাস।
ঋষি কহে “বৎস, অই কাল মেঘ
এ আশা-কাননে শিখা;
বৃথা যে এ বন উহার(ই) শরীরে
কালির অক্ষরে লিখা!
পক্ষী নহে উহা ও কালি মূরতি
করাল কালের ছায়া,
প্রাণিগণে দহি ঘুরে নিত্য এথা
এরূপে প্রসারি কায়া।”
বলিতে বলিতে ভুলিয়া আপনা
তপোধন কয় শোকে—
"হায় রে বিধাতঃ, এ কালিম ছায়া
ছড়ালি কেন ভূলোকে!
জগতে যা আছে মধুর সুন্দর
গঠিয়া তাহার পর
গঠিলে বিধাতঃ সকলের শ্রেষ্ঠ
প্রাণীরূপ মনোহর?
বিষমাখা তার কণ্টক আবার
গঠিলে কেন এ কাল?
মর্ত্তে পাঠাইয়া স্বর্গের পুতলি
পথে দিলে কাঁটাজাল!
সুচিত্র পটেতে কালি মাখাইতে
কেন এত ভাল বাস?
জগতের সুখ নিদারুণ বিধি
এরূপে কেন বিনাশ?”
এরূপে বিলাপ করেন সে ঋষি
আতঙ্কে সম্মুখে চাই,
দূর প্রান্ত দেশে গৈরিক-মিশ্রিত
স্তূপ নিরখিতে পাই।
সেই স্তূপ-অঙ্গে অন্ধ গুহা এক,
উত্থিত হইয়া তায়,
ঘন ঘন শ্বাস প্রচণ্ড বাতাস
ঝড়ের আকারে ধায়।
অতি কষ্টে দোঁহে সেই গুহা-পাশে
আসি হই উপনীত;
নিকটে আসিয়া দেখিয়া স্তম্ভিত,
ভয়ে চিত্ত চমকিত।
গহ্বর-ভিতরে বসি এক প্রাণী
প্রচণ্ড নিশ্বাস ছাড়ে;
সেই দীর্ঘশ্বাসে জনমি বাতাস
ঝড় সম বেগে বাড়ে।
কালির বরণ পাষাণ-নির্ম্মিত
যেন সে কঠিন কায়া;
শরীরে বিস্তৃত যেন অন্ধকার
ঘোরতর গাঢ় ছায়া।
মাঝে মাঝে মাঝে কাঁপে সর্ব্ব অঙ্গ
হুঙ্কার-ধ্বনি নাসায়;
ছিন্ন ভিন্ন বেশ, রুক্ষ ধূম্র কেশ
মস্তকে বিচ্ছিন্ন, হায়!
করে আচ্ছাদন করিয়া বদন
বসি ভাবে হেঁট মাথা;
বসি হেন ভাব যেন সে মূরতি
সেই গুহা-অঙ্গে গাঁথা।
সম্ভাষি আমারে কহে তপোধন
"শোকমূর্ত্তি এই হের,
আশার কাননে ইহা হ(ই)তে ঘটে
বহু বিঘ্ন বহু ফের।”
ঋষিরে জিজ্ঞাসি কেন তপোধন
মুখে আচ্ছাদন-কর?
না দেখিনু কভু বদন হইতে
উহা ত হয় অস্তর।
সে কথা শুনিয়া ছাড়ি দীর্ঘশ্বাস
শোকমূর্ত্তি দুঃখে বলে,
বলিতে বলিতে করের অঙ্গুলি
তিতিল নয়নজলে;
"এ কথা জান না কে তুমি এখানে
ভ্রমিছ আশাকানন;
শিশু নহ তাহা বুঝিয়াছি স্বরে,
হবে কোন যুবাজন।
আমি হতভাগ্য আছি এই স্থানে
চারি যুগ এই হাল;
বিধাতা আমায় করিলা সৃজন
করিয়া লোক-জঞ্জাল।
মৃত্যু নাই মম যে আসে নিকটে
সেই পায় নানা ক্লেশ;
সেই হেতু এথা থাকি এ নির্জ্জনে
দুঃখে ছাড়িয়াছি দেশ।
না দেখাই কারে এ ছার বদন
তাহার কারণ বলি—
দেখির যাহারে, বিধাতার শাপে
তখনি সে যাবে জ্বলি।
কত অনুনয় করিনু বিধির
লইতে এ পাপ প্রাণ,
এ কাল-কটাক্ষ হইতে আমার
প্রাণীরে করিতে ত্রাণ;
না শুনিলা বিধি শুধু এই বর
দিলা সে করুণা করি—
শিশুর বদন হেরিতে কেবল
পাইব নয়ন ভরি;
এ কটাক্ষ-দাহ শিশুরে কেবল
দাহন করিতে নারে,
নতুবা মুহূর্ত্তে দগ্ধ করি তাপে
অন্য প্রাণী সবাকারে;
কোথা নাহি যাই থাকি একা এথা
তবু সে বিধি আমায়;
বিড়ম্বন করে প্রেরিয়া পরাণী
আমারে কত জ্বালায়;
বর্ষে যত বার খুলি দগ্ধ আঁখি
তখন(ই) যে থাকে কাছে,
তার সম বুঝি আশার কাননে
অভাগা নাহিক আছে।
আসিতে আসিতে দেখিয়াছ পথে
সহস্র সহস্র প্রাণী
ভ্রমিছে দুঃখেতে, এ কটাক্ষ-দোষে,
শুনায়ে কাতর বাণী।
না থাক এখানে যাও অন্য স্থান
বাঁচিতে যদ্যপি চাও;
আমার নিকটে থাকিয়া এখানে
কেন এ সন্তাপ পাও।”
যথা যবে কোন গৃহীর আলয়ে
মৃত্যু উপস্থিত হয়,
রোদন-নিনাদ বিলাপ-শোচনা
বিদীর্ণ করে আলয়;
তখন যেমন বন্ধু কোন জন
বিমর্ষ মলিন বেশ,
কালের ছায়াতে কালিম বদন
বাহিরায় বহির্দ্দেশ;
অন্ধকারময় হেরে চারি দিক্
ব্রহ্মাণ্ড মলিন-কায়;
শুষ্ক কণ্ঠ তালু ঘন ঊর্দ্ধশ্বাস
হৃদয় জ্বলে শিখায়;
ধরাতল যেন অধীর হইয়া
সতত কাঁপিতে থাকে,
ভয়ে ভয়ে যেন কণ্টক-উপরে
ধরাতে চরণ রাখে;
সেইরূপে এবে নিরখিয়া শোক
করি স্থান পরিহার,
যাই ঋষি-সহ ঋষি কহে মৃদু
বদনে চিন্তার ভার;—
"নিরখিলা শোক নিরখিলা তার
অরণ্যে কাল-প্রতিমা;
চল যাই এবে দেখিবে আশার
কোথা সে কাননসীমা।”