স্নেহ, ভক্তি, বাৎসল্য, প্রণয় প্রভৃতির নিবাসে প্রবেশ করিবার পূর্ব্বে এই অঞ্চল অতিক্রম করিয়া যাইতে হয়—কর্ম্মক্ষেত্র এবং স্নেহাদি অঞ্চলের মধ্যবর্ত্তিনী নদী—তদুপরিস্থিত পরিণয় সেতু—তাহাতে প্র্যণিগণের গতিবিধি।

কর্ম্মক্ষেত্র এবে করি পরিহার,
আশার সহিত পরে
উপনীত হই আসি এক স্থানে
নিরখি আনন্দভরে—

নব দূর্ব্বাময় ভূমি সমতল
বিস্তার বহুল দূর,
প্রান্তভাগে তার পড়েছে ঢলিয়া
নীল নভঃ সুমধুর;
তরুণ তপন তরুর শিখরে
ঘন চিকিচিকি করে;
শাখা বল্লী যেন ভানুরশ্মি মাখি
দুলিছে সুখের ভরে;
প্রফুল্ল ভাস্কর কিরণ প্রকাশি
প্রফুল্ল করেছে বন;
মৃদুতর তাপ পরশি শরীর
স্নিগ্ধ করে অনুক্ষণ।
হেমন্ত-প্রভাতে যেন সুমধুর
সূর্য্যের মৃদুল ভাতি
সুখে ভুঞ্জে লোক আলোকে বসিয়া
কিরণে শরীর পাতি,
এথা সেইরূপ পশু পক্ষী প্রাণী
ভ্রমে সুখে নিরস্তর
অঙ্গেতে মাখিয়া স্নিগ্ধ নিরমল
উজ্জ্বল ভানুর কর।
চারি দিকে কত নেহারি সেখানে
তৃণমাঠ গোষ্ঠ'পরে
নিজ নিজ বৎস লৈয়ে গাভী মেষ
নিরন্তর সুখে চরে;
শস্য নানা জাতি ক্ষিতি-শোভাকর
বীজ পুষ্প ধরি কোলে
কিরণে ডুবিয়া পবন-হিল্লোলে
হেলিয়া হেলিয়া দোলে।
নিরখি চৌদিকে কৌতুকে সেখানে
শস্যস্তম্ভ নতশির

কাঞ্চনবরণ মঞ্জরী পরিয়া
ভূষণ যেন মহীর।
মনোহর চিত্র যেন সেই স্থান
চিত্রিত ধরণী-বুকে;
কিরণে সুন্দর চলে পথবাহী
প্রাণী সেথা কত সুখে।
চলি কত পথ ক্রমে এইরূপে
আসি শেষে কত দূর
নিরখি সম্মুখে চমকিত চিত্ত
সুসজ্জ গৃহ প্রচুর;
শোভে সৌধরাজি অভ্র-অঙ্গে যেন
চিত্রিত সুন্দর ছবি;
রঞ্জিত করিয়া তাহে যেন সুখে
কিরণ ঢালিছে রবি।
দেবালয় সব সেই সৌধরাজি
সুরচিত্ত-মনোহর,
স্তরে স্তরে স্তরে অবিমুক্ত শ্রেণী
শোভিছে তটের 'পর।
চলিছে তরঙ্গ খরতর বেগে
ভিত্তি প্রক্ষালন করি,
উঠিছে পড়ছে আবর্ত্তে ঘুরিছে
সূর্য্যপ্রভা জটে ধরি;
ছল ছল ছল ছুটিছে তটিনী
কুল কুল কুল নাদ,
থর থর থর কাঁপিছে সলিল
ঝর ঝর ঝরে বাঁধ,
ঘর্‌ ঘর্‌ ঘর্‌ ঘুরছে আবর্ত্ত
কর্‌ কর্‌ কর্‌ ডাক;
লপট ঝপট ঝাঁপিছে তরঙ্গ
থমক থমক থাক;

নব জলধর সলিল-বরণ
কিরণ ফুটিছে তায়;
লুটিতে লুটিতে ছুটিতে ছুটিতে
সৈকতে হিল্লোল ধায়;
তটে দেবালয়, জলে ঢেউ-খেলা,
রৌদ্র-খেলা তার সঙ্গে;
আনন্দে নিরখি নয়ন বিস্ফারি
দেখি সে কতই রঙ্গে।
দেখি মনোহর নদীর উপর
সেতু বিরচিত আছে,
যুগল যুগল পরাণী সেখানে
দাঁড়ায়ে তাহার কাছে।
দেবালয় যত কত যে সুন্দর,
অসাধ্য বর্ণন তার;
উচ্চে বেদধ্বনি প্রতি দেবালয়ে,
শুনে সুখ দেবতার।
সদা শঙ্খ ঘণ্টা সুমঙ্গল ধ্বনি
হয় মন্ত্র উচ্চারণ:
চন্দন-চচ্চিত কুসুমের ঘ্রাণে
প্রফুল্লিত করে মন;
স্তব স্তোত্র পাঠ জয় জয় নাদ
সর্ব্বত্র উঠে গম্ভীর;
বিধাতার নাম ভক্ত-কণ্ঠ-স্রুত
রোমাঞ্চ করে শরীর।
হয় নিত্য নিত্য গীত বাদ্য ধ্বনি
কত মত মহোৎসব,
নিয়ত সেখানে ধ্বনিত কেবল
সুখদ আনন্দ-রব।
সহাস্য বদন প্রাণী কত জন
প্রতি দেবালয়-দ্বারে

পূজি অভিপ্রেত দেব নিজ নিজ
উপনীত সেতু-ধারে।
সেতুমুখে প্রাণী দেখি কত জন
ধান দূর্ব্বা লৈয়ে হাতে
আশীর্ব্বাদ করি করিছে পরশ
পথিকমণ্ডলী-মাথে;
দিয়া দূর্ব্বা ধান ধরি করে করে
দুই দুই সুখী প্রাণী
জনেক পুরুষ রমণী জনেক
বদ্ধ করে উভপাণি;
বাঁধে গ্রন্থি দৃঢ় অঞ্চলে অঞ্চলে
শুভ বিধি দৃষ্টি শুভ;
খুলিয়া অঙ্গুরী পরায় অঙ্গুলে
শুচি মনে উভে উভ;
অগ্নি সাক্ষী করি মাল্য করে দান
কণ্ঠে কণ্ঠে এ উহার;
করেছে প্রতিজ্ঞা উভয়ে আনন্দে
সেতু হৈবে দোঁহে পার।
এইরূপে বাহু বাহুতে বান্ধিয়া
প্রাণী দোঁহে সেতু'পর
উঠিছে আনন্দে প্রকম্পিত বুক
প্রস্ফুট সুখে অস্তর।
কত হেন রূপ নিরখি কৌতুকে
মনোসুখে নিরন্তর
উঠিছে দম্পতি হাসিতে হাসিতে
বিচিত্র সেতুর 'পর।
আশা কহে “বৎস, সম্মুখে তোমার
দেখ যে সুন্দর সেতু,
আমার কাননে কৌশলে রচিত
কেবল সুখের হেতু;

পরিণয়-সেতু নামে পরিচিত
এ কানন-মাঝে ইহা;
আ(ই)সে ইথে লোক মিটাইতে শেষে
কানন-ভ্রমণ-স্পৃহা;
এই সেতু বাহি দম্পতি যে কেহ
পারে হৈতে নদী পার,
এ কানন-মাঝে আছে যত সুখ
নিত্য প্রাপ্তি হয় তার।
দেখিছ যে অই নদী অন্য পারে
দিব্য উপবন যত,
প্রবেশিতে তায় আমার কৌশলে
আছে মাত্র এই পথ;
সদা প্রীতিকর, সতত সুন্দর,
আই সব উপবন,
পবিত্র নির্ম্মল অতি রম্য স্থল
প্রাণীর শান্তি-কানন;
বিচিত্র গঠন অপূর্ব্ব কৌশলে
সেতু বিরচিত এই,
সেই হয় পার নিগূঢ় সন্ধান
বুঝেছে ইহার যেই।”
এত কৈয়ে আশা আমারে লইয়া
সেতু কৈলা আরোহণ;
সেতুমুখে সুখে নবীন আনন্দে
কৌতুকে করি গমন।
দুই ধারে দেখি রঞ্জিত বসন
ভূষিত সুন্দর সেতু;
বসন্ত-বায়ুতে স্তুম্ভে স্তম্ভে তাহে
উড়ে শ্বেত পীত কেতু;
গ্রথিত সুন্দর বন্ধনে বিবিধ
সজ্জিত কেতনকুলে

স্তম্ভ মাঝে মাঝে নবীন পল্লব
মঞ্জরী সহিত দুলে।
বহিছে মৃদুল মৃদুল পবন,
পড়িছে শীতল ছায়া;
মধুপ্রিয় পাখী বসিয়া পল্লবে
কিরণে ঝাড়িছে কায়া;
উঠে চারু বাস বায়ু আমোদিয়া
ঢলিতে ঢলিতে যায়;
চলে প্রাণিগণ মুগ্ধ নব রসে
বায়ু, গন্ধে স্নিগ্ধকায়।
সেতুমুখে হেন যাই কত দূর,
পাই পরে মধ্য স্থান;
ঘোর রৌদ্রভাপ সেথা খরতর,
উত্তাপে আকুল প্রাণ।
উত্তপ্ত বালুকা প্রচণ্ড কিরণে
করে দগ্ধ পদতল;
শুষ্ক কণ্ঠতালু আকুল তৃষ্ণায়
প্রাণিগণ চাহে জল।
নীচে ভয়ঙ্কর বহে বেগবতী
স্রোতস্বতী কোলাহলে,
ঘন ঘূণিপাক ভীষণ গর্জ্জন
তীব্রতর বেগে চলে,
মাঝে মাঝে মাঝে ভূকম্পনে যেন
সেতু করে টল টল;
ঘন হুহুঙ্কার বহে মাঝে মাঝে
দুরন্ত ঝটি প্রবল।
অস্থির চরণ প্রাণী কত এবে
মুখে প্রকাশিত ভয়,
চঞ্চল নয়ন, অস্থির শরীর,
চলে কষ্টে সেতুময়।

যথা যবে ঝড়ে উৎপীড়িত বন,
যতেক বিহঙ্গচয়
ছিন্ন ভিন্ন দেহ রুক্ষ শুষ্ক পাখা
অস্থির শরীর হয়,
আকুল নয়ন চাহে চতুর্দ্দিক্‌
চঞ্চুপুট ভয়ে জড়,
শূন্য কলরব ঘন তরুশাখা
নখে নখে ধরে দড়,
কত পড়ে তলে ভগ্ন শাখা সহ
ভগ্ন পাখা, ভগ্ন পদ,
পড়ে পুনঃ কত হৈয়ে গত-জীব
চঞ্চুবিদ্ধ করি ছদ;
শত শত প্রাণী এথা সেই ভাবে
সেতু হৈতে পড়ে জলে—
সেতু-কম্পে কেহ, কেহ পিপাসায়,
কেহ ঝটিকার বলে।
পড়ে একবার না পারে উঠিতে
বিষম তরঙ্গে ভাসে,
কত জন হেন, পুনঃ কত জন
তলগামী হয় ত্রাসে।
কদাচ কখন ভাসিতে ভাসিতে
কেহ আসি লভে কূল,
কপালে যাদের ঘটে এ ঘটন
দৈব সে তাহার মূল।
কতই পরাণী, নিরাখ চমকি,
ভাসিছে নদীর জলে,
সেতুমুখস্থিত প্রাণিগণ সবে
দেখে তাহে কুতুহলে;
কেহ ভাসে একা কেহ যা যুগল
নদীর আবর্ত্তে ঘুরে;

ভাসে নদীময় প্রাণী স্ত্রী পুরুষ
দু'কুল আক্ষেপে পূরে।
আসি কত জন তটের নিকটে
ক্ষণে বাড়াইছে হাত,
বালিমুঠি ধরি পুনঃ ঘূর্ণিজলে
ঘুরে পড়ে অকস্মাৎ।
ভাসে এইরূপে প্রাণী কত জন
সেতু হৈতে পড়ি নীরে,
চলে অন্য প্রাণী সেতুর উপরে
দেখিতে দেখিতে ধীরে।
দেখিয়া দুঃখেতে ভাবিতে ভাবিতে
আরো কত দূর যাই,
ছাড়ি মধ্য ভাগ ক্রমশঃ আসিয়া
সেতু-প্রান্ত শেষে পাই।
এখানে নিরখি অতি মনোহর
আবার শীতল ছায়া
পড়েছে সেতুতে, পরশি তখনি
শীতল হইল কায়া;
পড়িছে যে এত প্রাণী নদীজলে
তবু হেরি সেই স্থানে
লক্ষ লক্ষ জন চলেছে আনন্দে
সদা প্রফুল্লিত প্রাণে;
চলে চিত্তসুখে সদাতৃপ্ত মন
অক্ষুণ্ণ শান্ত হৃদয়;
মধুমক্ষি সম সে বনে তাহারা
করয়ে মধু সঞ্চয়।
কেন যে বিধাতা সবার ভাগ্যেতে
এ ফল নাহিক দিল!
কেন এত জনে বিমুখ হইয়া
বিপাক-স্রোতে ফেলিল!

কেন বা যে হেন সেতুর নির্ম্মাণ
রচিত এত কৌশলে!
কেন এত প্রাণী উঠিয়া সেতুতে
মগ্ন হয় পুনঃ জলে!
এইরূপ চিন্তা ধরি চিত্তে নানা
আশার সহিত যাই;
সেতু হৈয়ে পার প্রাণী-শান্তিবন
হাসিছে দেখিতে পাই।