উনিশে মে: ভাষার সংকট/কথাকবিতা/বরাক উপত্যকার গল্প
বরাক উপত্যকার গল্প
শব্দ শিল্প আমজনতার জন্য হয়। জনসভার পাঁচালী ছাড়া সবই বুধ জনতার একান্ত ব্যাপার। তাই লেখালেখির পিছনে তাগিদ মূলত একটাই। প্রতিষ্ঠানের তাগিদ। প্রতিভার পোষক প্রতিষ্ঠান। যে-প্রতিষ্ঠান একটি পত্রিকা, ছোটো বড়ো বা মাঝারি। যে-প্রতিষ্ঠান একটি সাহিত্য মনস্ক গোষ্ঠী। যে প্রতিষ্ঠান বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনের ছোটো গল্প প্রতিযোগিতাও হতে পারে। কে কখন বরাক পারে সতেরো-আঠেরোটা গল্প একসাথে দেখেছে। প্রতিষ্ঠানের টানেই তো বেরিয়ে এল। বরাক পারের কোনো গল্পকার কেন লিখছেন না। জবাব কখনই স্পর্দ্ধাভরে দিতে পারেন না কেউ। বলতে পারেন না তেমন কোনো আশ্রয় নেই, কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। বদলে শুধু অর্থহীন বিনয়ী হাসি হাসেন। প্রতিযোগিতার উদ্দেশ্য সফলই তো বলতে হয়। শুরু তো হলো কিছু হওয়া। যদিও তিনজন মাত্র নির্দিষ্ট হলেন পুরস্কারের জন্য। বাকি পনেরো-ষোলোও তো পুরস্কার চেয়েই গল্প পাঠিয়েছিলেন। নির্দিষ্ট মানক ছিল বলেই প্রথম তিনজন ছাড়া বাকিদেরকে পুরস্কারের বাইরে রাখতে হলো। জনাদুয়েক ছাড়া অন্যদের লেখাও যথেষ্ট উৎসাহব্যঞ্জক।
প্রতিযোগিতার প্রধান দিক ছিল বরাক উপত্যকার সার্বিক প্রতিনিধিত্ব। লালা, কাটলিছড়া, হাইলাকান্দি, নিশ্চিন্তপুর, বদরপুর, করিমগঞ্জ, উদারবন্দ এবং শহর শিলচর সম্পূর্ণ উপস্থিত ছিল।
লিখিত আছে, বেদ অধ্যয়নের অধিকার সবার নেই। অধ্যয়ন পূর্ব জ্ঞানার্জন সম্পূর্ণ করা ছিল বাধ্যতামূলক। সব শিল্পের বাধ্যতামূলক সূতিকাগার আছে। আমরা গজদন্ত মনুমেণ্ট নিবাসী স্বয়ম্ভু শব্দশিল্পীরা ধরে নিই তেমন কোনো ধাত্রীর কেন প্রয়োজন। স্বীকার করে নেওয়া ভালো, অঙ্গুলিমেয় উজ্জ্বলতা ছাড়া সুগঠিত বাক্য চোখে পড়ে নি।
আর দায়দায়িত্ব। আছে অবশ্যই তবে সুচিন্তিত নির্দিষ্ট নয়। সে সমাজ যে পারিপার্শ্বিক গল্পকারের নয় তার জন্য কিসের দায়। প্রাচীন সামাজিক মূল্যবোধের সাথে পরিবর্তিত মূল্যবোধের ফারাক যে ব্যক্তিগত শূন্যতার সৃষ্টি করে, করতে পারে, তেমন কোনও প্রাসঙ্গিকতা নেই গল্পগুলিতে। কেউ কেউ যা দেখেছেন সাংবাদিকতা করেছেন। কেউ ব্যক্তিগত বর্ণহীন জীবনে রঙ ছিটিয়েছেন। বেতালভাবে কেউ গল্প বলা সিনেমার ঢঙে কথা লিখেছেন।
সত্যজিৎ রায় মেট্রোপলিটন এলিট সমাজের কিছু চোরাক্ষত দেখিয়েছেন পিকু ছবিতে। এলিটের উল্টোপিঠে যারা থাকেন তাদের নিয়ে কথকতা করতে চেয়ে হতাশ করেছেন এক গল্পকার। বেড়ার আড়াল মানেন নি। অমরু কবি বেড়ার ফাঁকে লিখেছেন ‘সময়োপযোগী কাজ করে তিনি আমার লজ্জা দূর করলেন।’ কোন কাজ। বুঝো লোক যে জানো সন্ধান। বাঙালি কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কিছু চটুল পংক্তি এমত—— ‘তোমার বুক দেখলে আমার মেদিনীপুরের কথা মনে পড়ে/দেশ গ্রাম নয় শুদ্ধ ঐ মেদিনী শব্দটা/নাম বদলে মাঝে মাঝে মেদিনীদুপুর করতে ইচ্ছে হয়/ দুপুর মানে দু-খানা, দু-বুক' এতো খুলে না বললেও হতো। শক্তি কিন্তু কিছুই খুলে বলেননি। তবে শর্ত মেনে উদোম হয়েছেন। শর্ত মানে তো কিছু চাতুরি। মানতে হয় বড়ো কথা জানতে হয়।
ব্যতিক্রমী গল্প ছিল দুটি। মুসলমান সমাজের এক দুর্বল দিক ধরতে চেয়েছেন দুই শক্তিধর গল্পকার।
একটি গল্প তো টান টান ছিল গল্প বলার মুন্সিয়ানায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তালাকের অপকারিতা জাতীয় হিতোপদেশ হয়ে গেল। স্থানীয় ইসলামী ও বিশুদ্ধ তৎসম গুরুচণ্ডালী দোষে প্রতিযোগিতা থেকে ছিটকে গেল।
অতি সহজ কাঠামোর সার্থক হয়ে উঠতে পেরেছে 'কামাল উদ্দিন আহমেদের’ ‘অকিঞ্চন'। নামেই পুরো নম্বর ঘটনার সামান্যতা। যা মোটেই সামান্য নয়। না কি দুঃখী নায়কের কথা। গল্প সার্থক হয়ে উঠতে কোনো অপরিচিত পরিবেশে যেতে হয় না। মুখ্য চরিত্র তিনটি, জলীল, তার বউ জয়গুন ও জলীলের মা এবং পাড়ার মাতব্বর হাজী সাহেব তার কলেজ পড়া ভাইপো এবং ইমাম। সেই ‘শাস্তি' (রবীন্দ্রনাথ) গল্পের দুখিরাম জলীল মিয়া। বউকে তালাক দেয়, যে বউকে সে ভালোবাসে। জলীলের মা বধুনিগ্রহকারিনী বাঙালি শাশুড়ি। মার প্ররোচনায় ছেলে তালাক দেয় তখন আবার মার অন্যরূপ, পুত্রবধূ আমার মাটির তাল আমিই শুধু ভাঙব। পাশের বাড়ির চাচি বলে— বেটি খড়মর খুটি, একটা ভাঙলে আর একটা লাগাইতে কত সময় লাগব।—এ উপমা বরাক পারের নিজের। গল্পকার এত দরদ দিয়ে নিজের সমাজকে মানবিক সম্পর্ককে দেখেছেন, অবাক হতে হয়। শাস্ত্রের অকথিত কথা পড়ে নিয়ে ইমাম সাহেব যখন জলীলের তালাককে তালাক নয় বলে রায় দিয়েছেন তখন জলীল ভাবছে—জয়গুন কেন ফের তার ঘর করবে। একান্ত মানবীয় ভাবনা, ধর্মীয় কিংবা সামাজিক ভেটো যেখানে অকেজো। এই গল্পে ছোটোগল্প আছে, আলাদা করে কিছু নেই। যে গল্পটি নিয়ে প্রথম, দ্বিতীয়ের বিস্তর উতোর চাপান চলছে বিচারকদের মধ্যে। বিচারকরা মুগ্ধ। শুধু নিরলম্বব শব্দের অর্থ জানা নেই। কানে সিসে ঢালা কথাটা উপলব্ধিজাত নয়। এসব গল্পেটল্পেই থাকে। অকিঞ্চনে কথাটা কেন।
প্রথম পুরষ্কার প্রাপ্ত গল্প দেবব্রত চৌধুরীর ‘সাধভক্ষণ'। বরাক পারের আর এক গল্প যা চাবুকের মতো মেদহীন শপাং শরীরে বসে যায়। অসাধারণ নামকরণ। চোরের মা জোর গলায় কাঁদল পুলিশ লকআপে ছেলে মারা যাওয়ার পর, পোয়াতি বউ কাঁদল না। চোরের মা কাঙালিভোজন থেকে সুখাদ্য এনে পোয়াতি বউকে খেতে দেয় সাধের খাবার, বউ খেতে চায় না। চোরের মা বলে, তুই হাদ না খাইলে হিডা নু আভাইত্যা অইয়া চোর চামারর জন্ম লইব। যেটা আসছে। চোরের মারও সাধ বিশ্বকে শিশুর বাসযোগ্য করে যাওয়ার। গল্পকারের এক বিস্ফোরক উন্মোচন। বরাকপারের নিজের বিষয়। নিখাদ যন্ত্রণা থেকে উঠে আসা। দাক্ষী, সুখিন্দ নামগুলো আমাদের প্রাকৃত জনদের, অবন্তী তো নগরিকা। শুধু বরাকপারে ‘র’ এবং ‘ড়’ নিয়ে বিভ্রান্তি থেকেই গেল। চন্দ্রবিন্দুর ব্যবহারেও তাই। কালীপুজো ও চোরের মৃতপিতার নামের আগে চন্দ্রবিন্দু কেন।
তৃতীয় চরমানুষ। গল্পকার শুভঙ্কর চন্দ। এক বাঁজা বউ আর তার স্বামীর গল্প। বাঁজা শব্দটা অনুচ্চারিত রাখলেই ভারহীন নিখুঁত ছোটোগল্প হয়ে যেত। কাছাড় জেলায়ও তো চর আছে, ব্রহ্মপুত্র পারে যেতে হলো কেন গল্পকারকে।
এ গেল মোটামুটি প্রতিযোগিতা।
বরাকপার কথাটা অনেকবারই ব্যবহার করলাম। কিন্তু বরাকপারকে তেমন করে চিনলাম কই।
কামাল উদ্দিন কিছুটা চিনিয়েছেন, বড় সচেতনভাবে জানিয়ে দিয়েছেন তিনি কিছু বলতে চান। দেবব্রত গল্প বলেছেন তরতরিয়ে শুভঙ্কর সুন্দর কথক। কোনো ঘরানা তৈরি না হলেও আশান্বিত হওয়ার ঈশারা রয়েছে।
শুরুতে যা বলছিলাম পাঁচালি ছাড়া শব্দশিল্পের পুরোটাই বুধজনতার। আমি তাই মানি। গল্পকারদের গল্প তো আর দাক্ষী, সুখিন্দ, জলীল, জয়গুণ, আতরজান, অবন্তী বা হাজী সাহেবরা পড়বে না। পড়ব আমরাই। আমরা, যারা বিদেশি, দেশি সাহিত্য নিয়ে কিঞ্চিৎ অধিক নাড়াচাড়া করি স্থানীয় লেখাজোখাকে দুরছাই করার জন্য। আমরা কেউই খুব একটা কিছু হতে পারি নি। কাউকে হতে দিতে গেলেও তুলাদণ্ডে দেখে নিতে চাই অল্প বিদ্যা দিয়ে। তাই পুরষ্কার যাঁরা পেলেন ও পাননি এবং ভাল গল্প লিখেছেন তাঁদের কাছে সবিনয়ে জানাচ্ছি, ঘ্রাণে অর্ধভোজনের তৃপ্তি পেলাম না। টগবগে সপ্রতিভতা, মুন্সিয়ানা, অনেক জানার সুবাস তেমন ম’ ম’ করল না। খেদ নেই শুভেচ্ছা জানাচ্ছি—আরম্ভ শুভ হোক। অ্যাণ্টিগুয়ার প্রতিকূল সমুদ্র বাতাসে নেয়াপাতি পিটিয়েই তো ভিভ রিচার্ডস ক্রিকেটের রাজা। ব্যাকরণ জেনেই তো এখন উনি ব্যাকরণ ভাঙ্গার ওস্তাদ। বাংলা বানান এবং বাগ্বিধিতে কিছু জটিলতা আছে। জট খোলার সোনার কাঠি খুঁজে পেতে হবে গদ্যকারকে। ব্যাকরণে বরাকপারের বাঙালি গদ্যকাররা কবিদের থেকে যথেষ্ট পিছিয়ে। শুধু কবিরা কেন গদ্যকাররাও বেদাঙ্গ শিখেই ব্যাকরণ শুরু করুন।