উনিশে মে: ভাষার সংকট/কথাকবিতা/কথাসাহিত্যের ধাত্রীবাড়ি

কথাসাহিত্যের ধাত্রীবাড়ি

সত্তরের আগে কবির শহর শিলচরে গদ্যের কোনও উপনগরী গড়ে ওঠেনি। তাঁবুও পড়েনি কোথাও। কিচ্ছার আদলে গোল গোল গল্পের গ্রাম ছিল। হইচই হবে মানবেন না অনেকে বলবেন অমুক ছিল তমুক ছিল। নামের দাবিদার বাড়বে। তবে বাড়াবাড়ির যদি কিছু হয়ে থাকে, তা হয়েছে অনিশ শতক্রতুর আমল থেকে। অনিশের অদ্বিতীয় এক এবং শতক্রতুর এক মেঘনাদ সম্পাদক ভাস্করানন্দ শর্মা এই দুই-এর আর্থিক আনুকূল্য এবং দক্ষতায় গড়ে উঠেছে গদ্যসাহিত্যের পৃষ্ঠভূমি।

 প্রবাল দ্বীপের চূড়া জলধি ভেদ করে উঠেছে। গদ্য চায় পরিসর আর পরিসর কিনতে হয় অর্থের বিনিময়ে। তাই দুই সম্পাদককে হতে হয় কাবুলের আন্তর্জাতিক বা ঘড়ি ট্রানজিস্টারের বিদেশি পণ্যবর্জনকারী স্বদেশি। ধাঁধার উত্তরে যদি রক্ষা পায় কায়রো নগরী, কাবুল ঘড়ি ইত্যাদির ধাঁধা বিক্রি করেই বীজধান কিনেছিল অনিশ শতক্রতু। নাগরিকতার বিন্যাসে কবিতা বাসমতীর সুঘ্রাণে বিকল্প কখনও হতে চায়নি গদ্যের কালাজোহা। গদ্যে পদ্যে বিরোধ নেই কোনও। এরকম কোনো সোনার পাথরপ্রতিমা কল্পনাও করেনি কেউ। নইলে কি আর কবিতাভূমির সদ্যপ্রয়াত রাজাধিরাজ শক্তিপদ ব্রহ্মচারী এক গদ্যশ্রমিককে বলতে পারতেন ‘কলজে ফাটানো লেখক’। সলতে পাকানোর কালের শেখর দাশ দু-চার কথা না লিখলে তো শুরুতেই দাঁড়ি বসাতে হয়।

 কথাসাহিত্যের ধাত্রীবাড়ির নাম তাই কবিতাভবন। কবিতার আঁতুড়ে যে ওঁয়া করেনি সে কেমন কথক। কবিতায় শুরু করলে বিচিত্রগামী হওয়া যায়। কবিতার প্যাডেল ঘুরিয়ে যাওয়া যায় সকলখানে। বন মাদ্রিদ শ্রীকোণা ঋক সাম ঘুরে পৌঁছানো যায় যজুর্বেদে। উল্টোপায়ে হাঁটার চেষ্টাও করেননি আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বা দেবেশ রায় এমনকি সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়। প্রতিপক্ষ হিসেবে জোর সওয়াল করতে পারে আত্মপ্রকাশ ঘাসফুল বা জিপসীর তাঁবু। মনন ও নির্মাণের চূড়ান্তে কবিতা বলেই হয়তো ইতিহাসের পথ এমত। ভাষা সাহিত্যের জাদুশব্দ খুল যা সিমসিম গড়তে পারে কবিতাই। কবিতার পথ দিয়ে না গিয়ে সরাসরি পাথর ঠেলে পাহাড় চূড়ায় উঠেছেন অনেক গদ্যশ্রমিক আর পাথর-গদ্য গড়িয়ে পড়েছে হুড়মুড়িয়ে যেমন পড়ে। আবার ওঠে। কবিকে ভয় করলে গদ্যটাও লেখা হবে না ঠিকঠাক। কবির কথায় থাকে কল্পনা, বিভ্রমও কিছুটা। সবটা মানলে চলে? কবি বলেন, ‘নাভির নিচে আর নেমো না।’ সেই সত্য হলো। গদ্যশরীরকে অবহেলা করলে চলবে কেন। কবিই যদি শেষ কথা বলবেন তবে দিস্তে-পর দিস্তে ভরিয়ে গদ্য কেন। ‘নষ্ট শশা” ‘হরিণেরা’ নামের গদ্য কেন। নন্দিনীকে দিয়ে গদ্যরাজার অ্যামবিগুইটি তৈরি হয়। কবি বীরেন্দ্রনাথ রক্ষিত চুম্বনকে তরমুজ খাওয়ার মতো বললেই লেখা হয় ‘তরমুজ’ নামের কথাকাহিনি। তাহলে কি কবিতা গদ্যের পরিপূরক শক্তি। না না এসব বিতর্কে জড়িয়ে পড়া মন্দকথা। কবিতা কথার প্রতিবন্ধকও নয়। তবে কবিতায় আছে লোভের আঠা। দুরন্ত গদ্য লিখতে কবিতার দ্বারস্থ হতেই হয়। আপন কবিত্ব থাকলে খরচ বাঁচল কাস্টিং এর নইলে ধারের কারবার। কবিতায় ভাবকল্পের ছড়াছড়ি। রবীন্দ্র কবিতার প্রতিটি শব্দই এক-একটি অনন্য বাগ্‌ধারার হীরকদ্যুতি। আছেন কবি জীবনানন্দ। জয় শক্তি সুনীল। উৎপল কুমার বসুকে গদ্যে টেনে আনার সাহস করবেন না কেউ। উনুনে ফুঁ দেওয়ার বাঁশের চোঙকে কেউ লিখতে পারবেন ‘ফুঁ দেওয়ার বাঁশের সরল শাখা।’ কবিতা কি তবে বেশি বলছে। নাকি নাগরিক বুদ্ধিগ্রাহ্য কবিতায় গ্রামীণ সারল্য বেমানান। চাতুর্যে বিদ্ধ করতে হবে পাঠককে। জটিল জীবনকে আরও জটিল করে দেওয়া। কবিতা যে শুনি মেঘলা দুপুর নাম নিয়েছে কোন সকালে। সত্য সকলই সত্য। জটিল নয় দুর্বোধ্যও নয় কবিতা। পুরোনো শব্দে নতুন মাত্রা দিয়ে, উদ্ভাবনীর পরশ দিয়ে কবিতার ভাষাকে জাগিয়ে রাখতে হয়। জীবন্ত ভাষাও যে মরণশীল। আয়ু বড়ো কম। শব্দ আর বাক্যের রসায়ন কতদিন চলে। পুনঃপৌনিকতা দোষে দুষ্ট হবেই। বিদ্যাসাগরের ভাষা যদি বঙ্কিমে সংস্কৃত, বঙ্কিম রবীন্দ্রনাথে, জীবনানন্দ ব্যবহারে শানিত। সুনীল শক্তি শঙ্খ জয় পর্যন্ত গিয়েই থেমে গেছে দিগন্ত রেখা। এরপর হয়তো নতুন আরম্ভ। ওইখানে যেয়ো না কো কয়ো নাকো কথা ঐ যুবকের সাথে। ‘কো’ এর অনুপ্রাস উঠিয়ে দিলে কোথায় থাকেন জি দাস কবি। বাঙালি এখন আর কথায় ‘কো’ ব্যবহার করে না। জেলার ভাষা নিয়ে কোনো বিরোধ ছিল না অখণ্ড বাংলায়। এখন দ্বিখণ্ডিত-র চাপে দিশাহারা প্রথম ভুবন। পশ্চিমবাংলা ভুবনের ভাষা তার স্থানীয় রূপ হারিয়েছে। ওপার থেকে যে সমৃদ্ধ কথ্য ভাষা নিয়ে এসেছেন ভানুবাবুরা। শান্তিপুরের ভাষা বলে কোনও ভাষা নেই আর। বাংলার গ্রাম নেই শহর নেই চরিত্রবান। ব্যোমকেশ-এর মেসবাড়ি নেই। কিনু গোয়ালার গলি পর্যন্ত নেই। ধলেশ্বরী নদীতীরে পিসিদের গ্রাম কবেই ধুয়ে মুছে সাফ। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার আর পুলকবাবুর রোজগার বন্ধ। জয় দাদার কবিতাপাঠক খুঁজতে যেতে হয় বিগত শতাব্দীতে। বেণীমাধব তো লোপাপিসির গান। নবীন বাঙালির জন্মের ওপরও ‘রোক’ লেগে লেছে। বাঙালি মেয়ে বাংলা পড়ে না। এক বিদেশি আর দুই স্বদেশি ভাষার দ্রবণ এখন বাঙালির ঘরে। e-ভাষায় কবিতা লেখা হচ্ছে। পৃথিবীর সব জীবন্ত ভাষাই এখন নতুন বাঁক মুখে। বাঁচবে না ঠুটো থাকবে। রিমেক কবিতা হচ্ছে যে। বিখ্যাত কবিতার লাইন নতুন করে গড়াপেটা হচ্ছে। এরা কারা। দূরের মানুষ কাছের মানুষ। খুব কাছের সৃষ্টিশীল কবি এরা। এরাও পাঠক চান, উদ্দেশ্যহীন লেখালেখির মানে হয় না। তারা কবিতার চলন বদলে ভাষা বদলে দক্ষতার পরীক্ষক হতে চান। কবিতার ভাষা বদলে যাওয়া মানে তো যুগান্তর। গতি নেওয়া বাঁক খাওয়া। বড়ো বড়ো ড্যাম হচ্ছে ভাষামুখে। ইঙ্গমার্কিন বিশ্বায়নের বর্জ্য। সত্য এরকম হয় না,কবিতাও এরকম হয় না। এ সত্যভ্রম। ভ্রমের ‘কুড়ুলায়’ পাক খাচ্ছে কথা-সাহিত্যিকরাও। কথা রচনার উৎসধারা কবিতা বলেই এত কথা। স্বভাষায় কবিতা লেখালেখি বন্ধ হয়ে গেলে একই উপাদানে গঠিত কথাশরীর অক্ষত থাকে কী করে। ভাষা সাহিত্যকে সচল বাঁচিয়ে রাখার যতই প্রতিজ্ঞা হোক বাচনিক, কাজের বেলা কতটুকু। বাঙালি পরিচয় শুধু কিছু পরিচিত পদবিতেই টিকে থাকবে নিশ্চিত। চেনা মানুষ বাঙালি বলে এ বাঙালির কথা নয় শুধু। এত যে অপরিচিত দক্ষিণ ভারতীয় ভাষা, এখন সান টিভি এশিয়ানেট খুললেও সব বুঝতে পারি। রক্ষণশীল ইংরেজের ভাষা-অভিধান এখন বিশ্বকে গ্রাস করে নিচ্ছে। আমেরিকায়ও তাই। তিন আরবি ভাষা-বিশারদ নিয়ে এক মজার গল্প প্রচলিত আছে সাহিত্যসভায়। তিনজনের কেউই একে অপরের ভাষা বোঝেন না। আদি মধ্য এবং বর্তমান আরবি নিয়ে তিনজনের বিশারদি। ইংরেজি এবং কম্পিউটার হয়েছে এখন ভ্যাম্পায়ার। নীরক্ত সমাজে এখন নেই কোনও মানবিক সম্পর্ক। আমাদের সন্তান দুধভাত চেনে না। মা-মাসি চেনে না, আত্মীস্বজন না। ঈদ-বড়দিন-পুজো চেনে মানসিক বিভ্রান্তি কাটাতে। কিন্তু বাউল ফকির চেনে না। চৌকো বাড়ির কোথাও কোনও ‘চাল’ নেই। বৃষ্টির ঝমঝমি নেই। শহরে গ্রীষ্মের দাবদাহ নেই এসি মেশিনের বিশ্বায়নে। এরকমই জীবন নবীন কিশোরের। তো বিশ্বপ্রকৃতি যেমন তেমনই তো হবে কবিতা। প্রকৃতির খেলাঘরে হিজল অশ্বত্থ সোনাঝুরি না থাকলেও বসন্তবউরি বউ কথা কও না ডাকলেও বসন্ত হয়। শ্রাবণ না এলেও জুন-এর ছয়-সাতে মনসুন আসে। স্যুইমিং পুকুর থাকে, থাকে জ্যাকুজি পেণ্টহাউস ক্লাব ক্যুজিন তন্দুরের ভ্রম। একটা লণ্ডভণ্ড কাণ্ডের প্রস্তুতি। ঝড় এলে চলে যাওয়ার সময় দিতে হয়। আর ঝড় মানে তো নতুন শুরুর আরম্ভ। প্রতীত জীবনের মায়া সরিয়ে কবিতার রূপরসগন্ধস্পর্শশ্রুতি সবই ফিরে আসবে অবিকল। পুরোনো পৃথিবী বিক্রি হয়ে যাওয়ার একটা গুজব যেন ছড়িয়েছিল কারা। প্রমোটারও ঠিক হয়ে আছে। ক্রেটিড কার্ডে পাঁচশ টাকা স্যুয়াইপ করলেই কণ্ডোভিল এর ভিলেজ। অ্যাপার্টম্যাণ্ট ঘর আছে দুপ্লে ট্রিপ্লে। মল সি-থ্রি আইনক্স। রে থেকে রামগোপাল ঋত্বিক সব দেখা যাবে। বুকশপে শরটচন্দ্রা থেকে ঝুম্পার বুকও পাওয়া যাবে। গরিবের জন্য এল আই জি আছে নন্দন চত্বরে। কবিতা কথাসাহিত্য এবং সংগীত উৎসব। উড়িষ্যার ভুবনেশ্বরেও আছে একটি নন্দন চত্বর। গুজবে কান দিলে মন্দ কী।

 বিজ্ঞাপনের চাতুর্যে ভুল করে যারা কবির শহর শিলচর ছেড়ে চলে এল তিলোত্তমা নগরীতে তাদের কী হইবে তবে। ভেবেছিল যারা কবিতা পড়বে শুনবে, আর মনের সুখে কথা লিখবে। বিশ্বায়ন আর পণ্যায়ন প্রক্রিয়ার এসব বর্জ্য নিয়ে বিশ্বনিখিল এখন উদ্বিগ্ন। শেকড়হীনতার বিভ্রম কি ইতিহাসের পরিহাস না স্বখাতসলিল। এখন দাঁড়ি বসানোরও যে জায়গা নেই। অর্ধযতি দিয়ে শুধু এগিয়ে যাওয়ার খেলা। একটু পা চালিয়ে ভাই, বাক্য শেষ করতে পারলেই তো কবিতাভবনের মন্দিরদ্বার।