উনিশে মে: ভাষার সংকট/কথাকবিতা/বরাক উপত্যকার কথাসাহিত্য
তৃতীয় ভুবনের লেখকদের নিয়ে গুছিয়ে লিখতে গেলে বিশাল পরিসর দরকার। আসাম রাজ্যের দুই নদী উপত্যকা বরাক ও ব্রহ্মপুত্র। ত্রিপুরা, মেঘালয়, নাগাদেশ, মণিপুর পর্যন্ত বিস্তৃত তার বিচরণ ক্ষেত্র। তাই অপারগতা হেতু সমৃদ্ধির একটি বিভাগকেই আলোকিত করার কথা ভাবা যেতে পারে। প্রতিবেদনের আলোচ্য হোক যর্জুবেদ, মানে গদ্যসাহিত্য। আপাতত শুধু বরাক উপত্যকায় সীমাবদ্ধ রাখা যেতে পারে গল্পকথার কথা। বরাক উপত্যকায় গল্প রচনার প্রথম দিনটি নিয়ে প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণার এখনও শেষ হয় নি। তাই একটি রেখা থেকেই শুরু করা যাক। যেহেতু সময় সত্তর বঙ্গজীবনে একটা যুগান্তের ইঙ্গিতবাহী, বাংলা গল্পে এক বাঁক ফেরার সময়, তাই সত্তরই সই। কলকাতায় রমানাথ রায়, শেখর বসু, বলরাম বসাক, সুব্রত সেনগুপ্তরা তখন শাস্ত্রবিরোধী লেখালেখির এক চার্বাকপন্থা নিয়ে মেতে আছেন। বাসুদেব দাশগুপ্তর 'রন্ধনশালা'য় সব রকমারি পাকপ্রণালী। বিমল কর, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় মধ্যগগনে দেদীপ্যমান। বাংলা ভাষার তখনও একটি মাত্র ভুবন। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস ও হাসান আজিজুল হক তখন বাংলা নামে শিশুদেশের নাগরিক। দ্বিতীয় ভুবনের আঁতুড় ঘর প্রস্তুত! সেই সময় বরাক উপত্যকায়ও সাহিত্যের এক নতুন ভুবন লালিত হচ্ছে। কবির শহর শিলচর ঘিরে তখন শক্তিপদ ব্রহ্মচারী, বিমল চৌধুরী, উদয়ন ঘোষ, শান্তনু ঘোষ, জিতেন নাগ, দীনেশ লাল রায়, কালীকুসুম চৌধুরী, উমা ভট্টাচার্য, রুচিরা শ্যাম, তপোধীর ভট্টাচার্য, দিলীপকান্তি লস্কর, রণজিৎ দাস, মনোতোষ চক্রবর্তীদের দাপট, হাইলাকান্দি থেকে বিজিৎকুমার ভট্টাচার্য ব্রজেন্দ্রকুমার সিংহ, দীপঙ্কর নাথ, কল্লোল চৌধুরী, ভক্ত সিং দিব্যেন্দু ভট্টাচার্য, আশুতোষ দাশ। ত্রিপুরা থেকে পীযুষ রাউত ও আরও অনেকে মিলে গড়ে তুলেছেন কবিতা কমিউন। প্রধান বা একমাত্র ভুবনেও তখন শাস্ত্রবিরোধী এক কাব্যশাস্ত্রও তার মহিমায় উজ্জ্বল। মধ্যরাত্রে কলকাতা শাসন করা কৃত্তিবাস তাদের সহযোদ্ধা পেয়ে যায় অতন্দ্র গোষ্ঠীকে। যর্জুবেদী ব্রাহ্মণরা তখন কোথায়। কোথায় কথাকার বরাক উপত্যকায়। কথা রচনার কোনো গতিপথ তখনও নেই। অসংগঠিত কুটির শিল্পের নিদর্শন কিছু উপন্যাস ও ছোটোগল্প রচনা শুরু হয়েছে। রামকুমার নন্দী মজুমদার থেকে যার শুরু শেখর দাশের 'মোহনা'তে নিশ্চিত ভাবেই তার ভিত্তি দৃঢ় হয়েছে সত্তর উত্তরে। সত্তর দশকে গণেশ দের 'কলংমার কূলে' নিশ্চিতভাবেই সাড়া-জাগানো উপন্যাস। রণজিৎ দাসের 'বিয়োগ পর্ব' তো পুর্ণ ভুবনেরই চর্চিত উপন্যাস। সর্বশেষ সংযোজন বনমালী গোস্বামীর ‘প্রথম গান’, ঝুমুর পাণ্ডের ‘গাঙগাথা’, দেবীপ্রসাদ সিংহর ‘দেশ’। বছর কুড়ি আগে অধ্যাপক ঊষারঞ্জন ভট্টাচার্য আঠাশটির কথা লিখেছিলেন, এতদিনে তা অর্দ্ধশত পেরিয়ে গেছে। নথিভুক্ত আঠাশটির কথা বলারও একটি উদ্দেশ্য আছে, আঠাশ থেকে পঞ্চাশে পৌঁছানোর প্রতিটি আখ্যানই হয়েছে লেখকের মাস্টার স্ট্রোক। খোলা বাজারে পণ্যের মান বজায় রাখতে হয় যে। নইলে আইএসও হলমার্ক হয় না। বরাক উপত্যকার প্রবন্ধ সাহিত্য আজ উপত্যকার সীমার বাইরেও প্রতিষ্ঠিত। প্রথম ও দ্বিতীয় ভুবনে সাহিত্যতত্ত্বের চর্চা তপোধীর ভট্টাচার্য ছাড়া হয় না। ইতিহাস প্রত্ন-ইতিহাস গবেষণায় সুজিৎ চৌধুরীর অবদান অনস্বীকার্য। তিনি তৈরি করে দিয়ে গেছেন সিলেট কাছাড়ের আত্মপরিচয়। ভাষিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লিখিত প্রবন্ধাবলীর জন্য কবি বিজিৎকুমার ভট্টাচার্য থাকবেন আমাদের নয়নের মণি হয়ে।
আর, সব গাছ ছাড়িয়ে এক অপৌরুষেয় শক্তির আবির্ভাব হয়েছিল পঞ্চাশ বছর আগে উনিশ শ একষট্টির উনিশে মে। আমাদের রক্তস্রোতে প্রবাহিত ভাষাজীবন উনিশে মে। এগারো জন শহিদ দধীচির রক্তে মাতৃভাষার অবগাহন হয়েছিল। হয়েছিল এক বিশালের আবির্ভাব। বাংলাভাষাভাষী বরাক উপত্যকায় সরকারি নির্দেশে অসমিয়া ভাষা সংস্কৃতি চাপিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে বারবার বরাক উপত্যকার পুণ্যভূমি ভাষাশহিদের রক্তে প্লাবিত হয়েছে, হয়েছে উর্বরা। ভাষাশহিদের রক্ত বরাক উপত্যকা কখনও ভোলে নি ভুলবে না। সেই অমোঘ শক্তি ছাড়া এখানে কালো কালো অক্ষরের কঙ্কালও কেউ গড়তে পারে না। সেই বিঘ্নহর্তা শক্তিকে প্রণাম না জানিয়ে আদাব না জানিয়ে এই উপত্যকার কেউই কোনো লেখার শ্রীগণেশ করতে পারে না। এরই অব্যবহৃত পরে অন্য এক সংঘশক্তিরও আবির্ভাব হয়। ‘কাছাড়া সাহিত্য পরিষদ’ এর ঐতিহাসিক উদয় এবং বিলয় ‘বরাক উপত্যকা বঙ্গসাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলন’ গঠনের মধ্য দিয়ে। বরাক উপত্যকার ভাষা সাহিত্য ও সংস্কৃতির ধাতৃমাতৃকা। মায়ের অঞ্চল ছায়ায় বেড়ে উঠছে উপত্যকার বাংলা সাহিত্যের পত্রপুষ্প।
বর্ণিত হল উত্তরাধিকার কথা, মননের কমলবন কথা। এবার পদার্পণ হোক তবে বিচরণ ক্ষেত্রে। ছোটোগল্প লিখিয়েদের কথা। শক্তিপদ ব্রহ্মচারী ও বিজিৎকুমার ভট্টাচার্য বলতেন বিশ্বজিৎ চৌধুরীর কথা। অসাধারণ গল্পকার। চোখে দেখিনি নাম শুনেছি দ্রোণাচার্যের। লেখা পড়েছি ‘সমীরের প্রতিদ্বন্ধী’, এমন কথাকার কেন যে ত্রিপুরার ভাগে পড়লেন। পরেশ দত্ত গল্প লিখেছেন ‘দেশ’ এ। মনে হত হিরো, এখনও লেখালেখির পঞ্চাশ পঞ্চান্ন পেরিয়েও সমান ক্রিয়াশীল। আমরা আমাদের মতো লিখতে শুরু করি। কিন্তু ছাপবে কে। কবিতা ছাপা সহজ, এক পাতায় একজন দু-জন তিনজনও হয়ে যায় সুজন কবি। গল্পের ফর্মাধরা কাগজ যোগাবে কে। শিলচরে বৎসরে একবার বেরোয় ‘সম্ভার’ বিজ্ঞাপনের ভার নিয়ে। ‘অরুণোদয়’ ও একবার। নিজস্ব লেখকদল আছে। মিনির হুজুগে কিছু মিনিগদ্য লেখা হয় ‘ডাউক’এ। সত্তরের শরতে এক বিস্ফোরণ হয়, বুদ্ধ হাসেন ‘অনিশ’ নামে। সম্পাদক শ্যামলেন্দু চক্রবর্তী ক্লিনস্যুইপ করেন। পনেরোটি গল্প পাঁচটি গদ্য এবং মাত্র তেরোটি কবিতা নিয়ে বেরোয় শারদীয়া অনিশ’। মূল্য একটাকা পঞ্চাশ পয়সা। নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা নিয়ে গদ্য প্রতিষ্ঠিত হয় বরাক উপত্যকায়। তারপর জয়ের দিন। বেরোয় ‘শতক্রতু’। ছোটো কথাকারদের রচনায় সমৃদ্ধ হতে থাকে বরাক সাহিত্য। ভাস্করানন্দ শর্মা ওরফে তপোধীর ভট্টাচার্য, মিথিলেশ ভট্টাচার্য শ্যামলেন্দু চক্রবর্তী শেখর দাশ হয়ে যান অনিশ শতক্রতু ঘরানার লেখক। করিমগঞ্জের অরিজিৎ চৌধুরী ঘরানার বাইরে থেকেও নিখুঁত গদ্যের লেখক। তখন হাইলাকান্দির মলয়কান্তি দে নিয়ে এলেন প্রতিবাদের নতুন ভাষা। ‘লাখ টেকার মানুষ বদরুজ্জমান চৌধুরী খুলে দিলেন এক বন্ধ ঘরের দরজা জানালা। মুসলমান সমাজে নারী অধিকারের কথা, নারীর প্রতি অবিচারের এমন নিখুঁত দলিল কেউ লেখেনি এ উপত্যকায়। তারও আগে লিখেছেন মোজাম্মিল আলি লস্কর। লিখছেন ইমাদ উদ্দিন বুলবুল গল্প উপন্যাস। হাইলাকান্দির মিহির কান্তি রায়, আশুতোষ দাস ও কল্লোল চৌধুরী নিভৃতে উন্মোচন করে চলেন মানব-মনের নিভৃত কথা, প্রাণের কথা, মাটির কথা। করিমগঞ্জের অরবিন্দ পাল কলেজ জীবনের পর আর কেন যে গল্প লেখেনি সেও এক বিস্ময়। আর এক বিশ্বজিৎ, বিশ্বজিৎ চৌধুরী কবি প্রাবন্ধিক সম্পাদক ও গল্পকার যুগপৎ। ‘শরিক সাহিত্য’ সম্পাদনার ফাঁকে ফাঁকে বর্তমান অস্থির সময় নিয়ে লেখা তার গল্প-ঝাঁপিও ছোটো নয়। কবির শহর শিলচর এর এই নবনাগরিকদের অভিনন্দন জানাতে ভোলেননি কবিকুলপতি শক্তিপদ ব্রহ্মচারী। রবিবারের যুগান্তর এ লিখলেন ‘কলজে ফাটানো লেখক শেখর দাশের কথা। রণজিৎ দাসও সাহিত্য পত্রিকার এক পত্রকারের প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়ে জানালেন, সোনার কলম দেওয়া হোক অরিজিৎ চৌধুরীকে। গর্বের বিষয় ২০১৬-য় ‘সাহিত্য’ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন অরিজিৎ। ২০১২-য় শতক্রতু’ সম্মানে ভূষিত হয়েছেন মিথিলেশ ভট্টাচার্য। এ বড়ো সুখের কথা। সাহিত্য সম্পাদক বিজিৎকুমার ভট্টাচার্য জানালেন, “আমার ধারণা গল্পপ্রধান অনিশ কিংবা শতক্রতু কাগজের সম্মান আরও দশগুণ বেড়ে যাবে যদি তা শুধু গল্পের জন্যই প্রকাশিত হয়। আবার কবিতা ও কবিতা বিষয়ক আলোচনার জন্য উত্তর-পূর্বাঞ্চলের একমাত্র অভিজাত সংকলন ‘সাহিত্য'তেও তখন কথাসাহিত্যের জল অচল। গল্প বিষয়ক একটি লেখা ছাপাতেও মোড়ক আলাদা করতে হয়। সাহিত্যের সঙ্গে ফ্রি গল্প বিষয়ক ক্রোড়পত্র। গদ্যের জন্য রক্ত ঝরানো দিনগুলির এক নির্মম প্রতিবেদন। শিলচরের প্রধান সড়ক সেণ্ট্রাল রোডের অশোকা রেস্টুরেণ্টে বিনি পয়সার ভোজ বিলিয়ে অনিশ বন্ধ হয়ে যায়। ঘড়ি রেডিও বিক্রি করেও পত্রিকার ও সাহিত্যের আড্ডার ধার শোধ হয় না শ্যামলেন্দু চক্রবর্তীর। কাবুলিওয়ালার ধার মেটাতে অপারগ শতক্রতুর সম্পাদকও বাড়িতে ঘোষণা করেন কারফিউ। পথে পথে কারফিউ। ফর্মা ফর্মা গদ্য ছাপানোর ধার শোধ হবে কী করে। তাই পাওনাদারের জন্য সান্ধ্য আইন। কবি বিজিৎকুমার ভট্টাচার্যর কবিতার অনুকরণে শতক্রতু সম্পাদক লেখেন ‘কারফিউ এলাকা বেড়ে বেড়ে যায়।’ বরাক উপত্যকার প্রভূত গদ্যদায়িনী শতক্রতুও বন্ধ হয়ে যায়। সম্পাদকের গভীর দুঃখের সাময়িক অভিব্যক্তি এরকম: 'আমরা বাংলা ভাষাতেই লিখি, অতএব আমরা বাংলা সাহিত্যের লেখক। কিন্তু আমাদের মতো শূদ্রজনদের জন্য একদিকে স্কাইলা এবং অন্যদিকে স্কেরাইবডিস। আমাদের কেউ তো মাথার দিব্যি দেয় নি তবুও কেউ বিক্রি করি স্বর্ণালঙ্কার কেউ বা রেডিও। শহরময় কার্ফু এলাকা বাড়ে, শিলচর থেকে কাবুল একটানা রেলপথ হয় এবং চুল দ্রুত লজ্জায় লাল থেকে গ্লানিতে সাদা হতে থাকে (তপোধীর ভট্টাচার্য, পূর্বশ্রী ১৯৮৭ ইং)।’
না, মোটেই শিবের গীত গাইছি না। এ আমাদের জাতীয় বিলাপ। উত্তর-পূর্বাঞ্চলের লিটল ম্যাগাজিনের নিয়তি কথা। বাংলা ভাষার লিটল ম্যাগাজিনের ললাট কথা। বাহিত উত্তরাধিকার। ছোটোগল্পের উত্তরাধিকার কি সত্তর থেকেই শুরু তৃতীয় ভুবনে। তাই তো মনে হয়। বিতর্ক হতেই পারে। শাস্ত্রবিরোধী একদিকে, হাংরি একদিকে, নিম আর একদিকে। দেশ অমৃত-র মতি নন্দী, বিমল কর, সমীর রক্ষিত, সুনীল, শীর্ষেন্দু, সন্দীপন, সিরাজরা। আর একদিকে সাধন ভগীরথ অভিজিৎ তপন অমর নলিনী কিন্নর শচিন স্বপ্নময়রা। ওপারে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, হাসান আজিজুল হক সেলিনা হোসেন হারুন হাবিব রাহাত খান মঞ্জু সরকার ওয়াসি আহমেদ জাকির তালুকদার স্বকৃত নোমান ও সুশান্ত সরকার। তখন থেকেই খোলা বাজার শুরু। দামি দামি লেন্স আসছে বিদেশ থেকে। মানে দেখার চোখ, বিদেশি সাহিত্য অধিগম্য হচ্ছে সহজে। লাতিন আমেরিকা থকে জটিল থেকে জটিলতর ভাষার জাদু কিন্তু মাটির মায়ায় জড়ানো। অদ্য একটি গদ্য লিখব মনস্ত করে আর কবিগানের আদলে গল্পলেখা চলবে না বুঝতে পেরেছে বরাক উপত্যকার তথা ত্রিপুরা সহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিস্তীর্ণ গদ্যমানচিত্রের রূপকাররা। ছোটোগল্পের শরীরে এল কোটালের জৌলুষ, তোলপাড়। অনেক কারুকাজ ও আলোর বিচ্ছুরণ। যেমন তেমন লিখলে চলছে না। বিশ্ব এখন একাকার, একের সঙ্গে সবার লড়াই, সব গাছ ছাড়িয়ে যেতে হবে। পশ্চিমের সাহিত্যতত্ত্ব তার মর্মভেদি ক্যামেরা দিয়ে দেখছে দাঁড়িকমা সেমিকোলন মধ্যবর্তী প্রতিবেদন পর্যন্ত। কিংবা তাও নয় দাঁড়ি কমাও নেই, প্রতিবেদনে যা নেই সেই অনুপস্থিত সত্যকেও উদ্ভাসিত করছে রহস্যের বাক্যভেদি বয়ন। তত্ত্বকথায় নতুন কোনো বিতর্ক উপস্থাপিত হয় না কারণ ডিম এবং পাখির জন্মকথাও আবহমানের। সব সত্যের মতো তত্ত্বও সত্য। তত্ত্ব হল পাউরুটি কিংবা ভাত চাপাটির নিহিত উপাদানগুলি বিশ্লেষণ করা। খাওয়ার আগে গুণকারী দিকগুলি জেনে নেওয়ায় মন্দ কী, পড়ার আগেও তেমন জানলে পাঠক উৎসুক হবে। পটুত্ব যে শিক্ষায় সমাপ্ত হয় এও সত্য। এইসময়ের এক কথাকার, কনিষ্ঠ এক তত্ত্ববেত্তাকে অনুরোধ করেছেন একটু সহজ করে ফুকো লাকা দেরিদা বাখতিন বুঝিয়ে দিতে যাতে পত্রবিহারি কথাকার আরও খ্যাতনামা হতে পারেন। অনিলবাবুর ব্যাকরণ পড়ে আমাদের ভাষা শিক্ষা হয়েছে। শব্দের সত্যজ্ঞান কিংবা তার শীলিত স্বভাব জেনেছি শঙ্খ ঘোষ, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত মারফত। সাহিত্য সমালোচনা শিখেছি বাংলা উপন্যাসের কালান্তার’ পড়ে, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়-এর ‘বাংলা ছোটোগল্প’ পড়ে। হঠাৎ করে তুমুল আন্দোলন শুরু হবে, পাশ্চাত্য সাহিত্যতত্ত্বের লেন্স কেনার জন্য হুড়োহুড়ি লেগে যাবে কে জানত। দেবেশ রায়, পার্থপ্রতিম বন্দ্যোপাধ্যায় আর তপোধীর ভট্টাচার্য খুল যা সিমসিম না বললে আমরা এখনও গোল গল্পের ভুল চাবি দিয়ে সঠিক তালা খোলার চেষ্টা চালিয়ে যেতাম। পাঠক আর বোকা নয়। পাঠককে ভেংচি কাটলে চলবে না, একশ শতাংশ না দিলে পরের ম্যাচে বাতিল। মাঠে দাঁড়িয়ে নাক খুঁটলে চলবে না, অকারণ বাঁদর বলা চলবে না, স্লেজিং ধরবে ওয়ার্লড টেল-এর পঁচিশটা ক্যামেরা, মাটির নীচের মাইক্রোফোন স্ট্যাম্পের ভিতর বিদ্যুত তরঙ্গ। লেখকের করার কিছু নেই। অথর ইজ ডেড। এখন সবাই অথর। বড়ো বড়ো কথা হয়ে যাচ্ছে, দেবেশবাবু তপোধীরবাবুরা রাগ করবেন। আসল কথায় যে এলেম না। এলেমের কথাই আসল। এলএম মানে লিটল ম্যাগজিন। ছোটো পত্রিকা। যেখানে আমরা কথাকারেরা লেখালেখি করি। লিটল এর প্রতিপক্ষ বৃহৎ। ওখানে আমরা কেউ না। লেখালেখির পণ্য বাজারের বাইরে। প্রতিবাদ আর বিপ্লব হল ঘটমান বর্তমান। আমরা বর্তমানে থাকতে চাই, যা চলছে তাতেই থাকতে চাই। তাই বৃহতের সঙ্গ চাই না। বৃহৎ হল বিপ্লবোত্তর স্থিতাবস্থার ইজারাদার, সমঝোতা বৃহৎ মানে ফিনিশড প্রোডাক্ট। ফিনিশ মানে তো শেষ, লিটল হল আঁতুরঘর। লিটল হল খোলা আকাশ। লিটল মানে সৃষ্টি। নামে ছোটো হলেও সুজনের বাস এলএম এর তেঁতুল পাতায়।
আমাদের উপত্যকায়, আমাদের ভুবনে কোনো বৃহৎ নেই। কোনো প্রতিষ্ঠান নেই তাই আমাদের লড়াই আমাদের নিজস্ব। আমাদের লড়াই অপরিচয়ের। আবার অপরিচয়টাই আমাদের স্পর্দ্ধা, কারণ আমাদের কেউ চেনে না, আমরা আনকোরা, আমরা মেঘনাদ। আড়াল থেকে লড়াই করি বাংলা ভাষার সপক্ষে। বাংলা ভাষার যে দুটো ভুবন আছে তার প্রধান যে, অন্তত প্রধান বলে ভোট দিয়েছে যারা, মুকুট পরিয়েছে যারা তারা কোথায় থাকে কেউ জানে না। বরাক উপত্যকার নাম খুঁজে পাওয়া যাবে না বাঙালি ভুবনে। কোথায় যেন গুয়াহাটিতে, আগরতলায়, বাংলাদেশে, তিনসুকিয়ায়, ডিব্রুগড়ে ওখানে বাংলা ভাষায় কথা বলার লোক আছে তো, এসব প্রশ্ন তো নির্বিঘ্ন, অতি সাধারণ। কোনো এক স্পর্দ্ধিত লেখক এখনও এই উপত্যকাকে উপনিবেশ ভাবেন, ভাবেন তার বিজিত সাম্রাজ্যের ক্ষুদ্র অংশ। সভাপতি ভাড়া হয়ে যান এরোপ্লেনে, পানভোজনের পর বদহজমে লেখেন এখানকার বাঙালি মানে কিছু শিক্ষাদীক্ষাহীন রুচিহীন অসভ্য মানুষ, যারা নিজেদের সিলেটি বলে। ওদের কথা বলার ভাষাও উদ্ভট, কেউ বোঝে না এমনকি সিলেটিরাও বোঝে না। বরাক উপত্যকা আর তার অধিবাসীদের . খলনায়ক করে বাংলার এককালের প্রধান শারদীয় সাহিত্যের রত্নখনিতে লেখা হয় উপন্যাস এক শরতে। এ তো গেল অবজ্ঞা। অচেনার কথাও কম বেদনার নয়। তিনভুবনের ঊনষাটজন গল্পকারের এক দুর্লভ সংকলনের সম্পাদনা করেছেন বাংলা সাহিত্যের তিন বিখ্যাত কথাকার। প্রধান সম্পাদক হাসান আজিজুল হক সম্পাদকীয়তে স্বীকার করেছেন, ‘উত্তর-পূর্ব ভারতের গল্প সম্বন্ধে আমি কোনো মন্তব্য করতে পারিনা। সত্য কথা এই যে উত্তর-পূর্ব ভারতের গল্প সম্বন্ধে কোনো অবয়ব আমি গড়ে তুলতে পারিনি। আমার পাঠও খুব কম।’ নেই কথাকে খুব কম বলে সম্মান জানিয়েছেন প্রধান তবে হাসানদা, প্রধান সম্পাদক হতে গেলেন কেন। উত্তর-পূর্বের ষোলোটি গল্প কি তবে সম্পাদনার বাইরে ছিল। দুধভাত, মানে আছো থেকো, ভাই বলে ডাকতে যেওনা। উত্তর-পূর্ব ধারার সম্পাদক দুলাল ঘোষ কিন্তু তৃতীয় ভুবনের সংগ্রাম ও সমস্যার কথাই বললেন। 'এতদিন আমাদের কোনো সাহিত্য প্রতিষ্ঠান বা তেমন পৃষ্ঠপোষকতা ছিল না। এখনও নেই বললেই চলে। যতদূর পথ হেঁটে এসেছি আমরা, পথটিও নিজেদেরই তৈরি করে নিতে হয়েছে।’ লিটল ম্যাগাজিনের কথা সবাই জানি, খুবই সীমিত আয়ুষ্কাল। সাহিত্যে ধারাবাহিকতা তাই লিটল ম্যাগাজিন নির্ভর হয় না। বৃহৎ ক্ষেত্র চাই। নিয়মিত প্রকাশ প্রতিষ্ঠান ছাড়া সম্ভব নয়। সাহিত্যনির্ভর জীবিকা এই অঞ্চলের লেখকদের কাছে কল্পনার বিষয়। তা সত্ত্বেও বাংলা ছোটোগল্পে উত্তর-পূর্ব ভারতের অগ্রগতি গর্বের বিষয় বইকি। যদিও অনেক ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে নিতে হয়েছে অনেক সময়। এখানে যারা উৎকৃষ্ট গল্প রচনা করেছেন পরবর্তী সময়ে, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতার কারণে লেখালেখি ছেড়েও দিয়েছেন অনেকে। উত্তর-পূর্বের বাংলা গল্প তবু থেমে থাকেনি। ওদেরই পরিত্যক্ত কলম তুলে নিয়েছেন অন্য কেউ কেউ। দাপটের সঙ্গে লিখেও চলেছেন। এই হল 'অসীমান্তিক’ গল্পসংকলনের ভূমিকা থেকে নেওয়া আমাদের অপরিচয় ও পরিচয় মধ্যবর্তী প্রত্যয়ের দৃঢ়ভূমি।
আমরা দাপটের সঙ্গেই লিখছি। হাসানদাকে দোষ দিই না। এ অপরিচয় ভূগোলের, রবীন্দ্রনাথের কাল থেকেই অপরিচিতা এই অবগুণ্ঠিত ভুবন। তার ওপর একটি স্বাভাবিক উত্তরাধিকারও আছে আমাদের। ঔপনিবেশিক ভ্রাতৃত্ব। একই মাতৃদুগ্ধে লালিত হয়েছি বলে আমরা সম্পর্কে তুতো। কলোনিয়াল কাজিন। দুই ভাইয়ের সংসার পূর্ব-পশ্চিমে তো বেশ চলছিল। ঈশানে কেন আবার পুঞ্জমেঘের জমজমাটি। তৃতীয়টা আবার কোত্থেকে উদয় হয়। এত দাপটেরই বা কী আছে। গর্বিত তৃতীয় ভুবনকথাও বরাকবাসীর উপার্জন। বিতর্ক হয় ঈশান বাংলা আর তৃতীয় ভুবন নিয়ে। অধুনালুপ্ত সাহিত্য পত্রিকা কবি সাংবাদিক দেবাশিস চন্দ সম্পাদিত 'অনীশ্বর' এর ১৯৮১ সংখ্যায় বিতর্ক জমে ওঠে। তৃতীয় ভুবনের পক্ষেই রায়। গল্পকারদের দিকে ইশারা করে সুজিৎ চৌধুরী লিখলেন,
১। স্বদেশী মেট্রোপলিটান শহরগুলোর সঙ্গে তার মফস্সল অঞ্চলের এক ধরনের ঔপনিবেশিক সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছে আমাদের কলকাতামুখিতা তারই দ্যোতক।
২। এখানকার মানুষের রুটিরুজির সংগ্রাম, মানবিক সম্পর্কের সংকট, বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মানুষের মধ্যকার দ্বন্দ্ব ও সমন্বয়ের পটভূমি, সমস্তই যদি কলকাতার চশমা দিয়ে বিশ্লেষিত হয় তবে তা পণ্ডশ্রম হতে বাধ্য।
৩। দেশ বিভাগের আগে বাংলা সাহিত্যের একটিমাত্র কেন্দ্র ছিল, আজ ঢাকায় দ্বিতীয় কেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত, প্রয়োজনবোধে ঈশান বাংলায় বাংলা সাহিত্যের তৃতীয় কেন্দ্রের সূচনা ত্বরান্বিত করতে হবে।
শেখর দাশ কথাকার একটু চাঁছাছোলা। বলেন, ‘শোনা যায় আঞ্চলিকতার কথা। শিলচরের কথা অতএব মালুগ্রাম সেণ্ট্রাল রোড দেওয়ানজি বাজার। যদি হাইলাকান্দির হয় রাঙাউটি লক্ষ্মীশহর হার্বাটগঞ্জ ইত্যাদি। এ ধরণের কনজারভেটিভ আঞ্চলিকতার কোনো মানে নেই। হাস্যকরও বটে। অবশ্য শিলচরি গল্পে কোনো চরিত্র যদি আত্মহত্যায় উৎসাহী হয় তো নিশ্চয়ই হাওড়ার পুল থেকে গঙ্গায় ঝাঁপিয়ে পড়বে না। পড়া উচিতও নয়। যদি পড়তেই হয় হাতের পাশেই বরাকের উপর আছে নয়নলোভা একটি সেতু। আঞ্চলিকতা ব্যাপারটাই বড়ো গোলমেলে। কাশ্মীরী কাঠ দিয়ে কাজিরাঙার গণ্ডার তৈরি করছে ভারত বা পৃথিবীর যেকোনো অঞ্চলের শিল্পী। রক্ষণশীল আঞ্চলিকতার সুবেদারগণ এই শিল্পসৃষ্টিতে কীভাবে আঞ্চলিকতার চোখ রাঙানো রেখা টেনে দেবেন? মুশকিল, সত্যিই মুশকিল।
মুশকিল তো বটেই। সাহিত্যে অঞ্চল বলে কিছু হয় না। তবু আমরা ইউরোপীয় সাহিত্য, ভারতীয় সাহিত্য বলি, বলি নবাবিষ্কৃত লাতিন আমেরিকার স্বর্ণখনি। বরাক উপত্যকা তথা তৃতীয় ভুবনও অঞ্চল। এই অঞ্চলের নিজস্ব যন্ত্রণা আছে, সমস্যা আছে আনন্দ আছে বঞ্চনা আছে, আছে তার নিজস্ব রঙ্গরস, তার কার্নিভ্যাল। আছে সময়। তার যৌনতা তার প্রতিবাদ! অসংখ্য বাঙালি আজও পশ্চিম বাংলার বাইরে আসামে ত্রিপুরায় মেঘালয় নাগাল্যাণ্ড মণিপুরে বহুজন্ম ধরে যুদ্ধরত, তাদের খবর কেউ রাখে না। আমরা কলকাতা, পুরুলিয়া, বালুরঘাট, মেদিনীপুর, ঢাকা, চট্টগ্রাম, বগুড়া, রাজশাহী যেখানেই যাই না কেন আমাদের তৃতীয় ভুবনের দিকে মুখ ফেরাতে বলি, সহযোদ্ধার সম্মান জানাতে বলি। তরুণ রচনার অগ্নি' আর 'অন্য ভুবনের গল্পবিশ্ব' এই দুটি রচনায় তপোধীর ভট্টাচার্য বলেছেন, তৃতীয় ভুবনের বাঙালির কথা, 'এরা প্রত্যাখ্যাত ও দূরীকৃত অপর হিসেবে অনাদৃতই থেকে যান। সন্ত্রাসবাদ, আঞ্চলিক উপনিবেশবাদ, মৌলবাদ, আন্তর্জাতিক চক্রান্ত, সামন্তবাদ, অর্থনৈতিক অনগ্রসরতা ইত্যাদির সঙ্গে আক্ষরিক অর্থেই লড়াই করতে করতে এদের বেঁচে থাকার তাৎপর্য সম্পর্কে ক্ষণিকের বিষাদ বিলাস পর্যন্ত এগোনো বাঙালির প্রথম ভুবনের বাসিন্দাদের দায়বোধের সীমা। দ্বিতীয় ভুবনকে কোনো ভাবেই অস্বীকার করা যায় না বলে বাহান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি স্মরণে আমরা বছর বছর নড়ে চড়ে বসি। কিন্তু স্বাধীন ভারতবর্ষের গণতান্ত্রিক রাজ্য আসামের শিলচরে একষট্টি সালের উনিশে মে দশটি তরুণ ও একটি তরুণী যে বাংলাভাষার মর্যাদা রক্ষার লড়াইয়ে পুলিশের গুলিতে শহিদ হয়েছিল, বাহাত্তরের সতেরো অগস্ট ও ছিয়াশির একুশে জুলাই আরও তিনজন তরুণ প্রাণ দিয়েছিল তার কোনো হদিশ আমরা রাখি না। খবর রাখি না ক্রমশ বিপুল চক্রান্তের ফলে ত্রিপুরা কীভাবে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে পরিণত হয়েছে। মেঘালয়ের শিলঙে, আসামের বিভিন্ন গঞ্জে মহকুমা শহরে শুধুমাত্র বাংলা ভাষায় কথা বলার অপরাধে বাঙালিদের কীভাবে ধনেপ্রাণে সর্বস্বান্ত হতে হচ্ছে, সেই তথ্যও আমাদের জানা নেই। আসামের সরকারি চাকরির নিয়োগে কী ঘটছে, বহুদশকের বাংলা মাধ্যম স্কুলগুলিতে কীভাবে অসমিয়াকরণ ঘটানো হচ্ছে এসব কেউ জানি না।'
তাই, লেখাই আমাদের যুদ্ধ। আমাদের গল্প আমাদের অনুভূতির ভাষান্তর। আমাদের দিব্যাস্ত্র। ‘মানুষের ভাষা তবু অনুভূতিদেশ থেকে আলো না পেলে নিছক ক্রিয়া বিশেষণ এলোমেলো নিরাশ্রয় শব্দের কঙ্কাল', জীবনানন্দের নির্দেশ আমরা মেলে চলি। মানি বলেই নেতি কথাকে আমরা বর্জন করি সগর্বে, ইতির দলের সেনানী আমরা। ইতি কথায় শিকড় আছে, সার সত্য আছে। ইতিতে শেষও আছে জানি, আমরা অশেষ শেষ দেখতে চাই শেষ হতে চাই না। রাজনৈতিক ভূগোলের তেমনই ইচ্ছে ছিল। বদ্ধভূমিকে বধ্যভূমি করার চক্রান্তে আমাদের মুখের ভাষা আমাদের দুখিনি বর্ণমালাই জবাব দিয়েছে বারবার। অন্যভুবনের তাচ্ছিল্য থাকলেও আমরা শহিদের রক্ত ভুলিনি।
দুই
রেখো মা দাসেরে মনে।
মনের কথা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। বলার কথাও অনেক, সময় অনেক নয় জানি, পরিসরও নয়। থামার কথা ভাবতে হয়। কিন্তু সলতে পাকানোর কথা জানলে সন্ধ্যাদীপের শিখাটিও যে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হবে। এবার তবে তাদের কথাই হোক, হোক উজ্জ্বল উদ্ধার, প্রিয় গল্পকারদের সঙ্গেই পরিচয় হোক। তালিকায় কম করে শ-দুয়েক গল্পকারের নাম দেখা যাচ্ছে, তৃতীয় ভুবনের বিস্তীর্ণ প্রান্তরে। বরাক ত্রিপুরা আসাম নাগাদেশ মণিপুর নিয়ে এই বিশাল বাংলায় কথা বলা অঞ্চলে। এদের মধ্যে জনাপঞ্চাশেক অমিতাভ বচ্চন থাকতে পারেন। রাজনীতিতে বেড়াতে আসার মতো দু-চারটে গল্প লিখেই চলে গেলেন। রাজনীতি আর গল্পলেখা একইরকম ভাবেন অনেকে। খুব সহজ, বখে গেলেই চাবুক, কলম নিলেই হিরো। অনেকের দল বুঝতেই চান না গল্প লেখা কোনও স্বপ্নাদ্য বটিকা নয়। গল্প লিখতে দুঃসাধ্য শ্রম দিতে হয়, গল্প লিখতে মুনিষ খাটতে হয়, হয় বলেই গদ্যশ্রমিক। কড়ি বরগা চুনসুরকি সঠিক মাপে দিতে হয়, এলিভেশনটা আকর্ষণীয় না হলে কী করে বুঝবেন ফারাক। ঝাড়াই বাছাই না করলে কী করে বুঝবেন যারা থাকল তারাই সব সময়ের। নাওয়া খাওয়া বিশ্রাম এমনকি ঘুমের মধ্যেও সদাসৃষ্টিশীল থাকতে হয়। যারা থাকলেন তারাই আলেকজাণ্ডার। আমাদের সহযোদ্ধা।
অধুনা গুয়াহাটি-কলকাতা নিবাসী দেবীপ্রসাদ সিংহ এক অসাধারণ কথাযোদ্ধা 'রূপকথার প্রত্যাবর্তন' তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ। গল্পবিদ্যার এক অতি প্রয়োজনীয় সংহিতা। তাঁর কথায়, ‘গল্প বলবে অরৈখিক শৈলী, উন্মুক্ত অস্ত, অ্যামবিগুইটি।'
শেখর দাশ ‘কলজে' ফাটাতে জানেন। চুয়াত্তরে শুরু করে, শতক্রতুর দ্বিতীয় ইনিংস এই একুশ শতকেও সমান চৌখুশ, 'প্লেইড ডিফেসিভলি' যেমন জানেন প্যাভেলিয়ানের ওপর দিয়ে ছক্কা হাঁকানোতেও সমান দক্ষ। প্রথম ইনিংসের শতক্রতুর সেই দুরন্ত গল্পগুলি বড়ো পরিশীলিত, কপিবুক এখন। শেখর আবিষ্কারক তপোধীর ভট্টাচার্য লেখেন “ ‘ক্রমশ তাপ’ থেকে ‘শ্বেত রক্তকণা’ যে অ্যাবসার্ডিটির নতুন গ্রন্থনা। চেতনার চেয়ে বড়ো অবচেতন, ভাষার চেয়ে গুরুত্ব পরাভাষার। বাংলা সাহিত্যে ‘জোড় শালিখ’, ‘ফেরারী’, ‘ডায়নোসরের ফুসফুস’ শব্দের প্রতিচ্ছবি’র মতো গল্প আবার কবে লেখা হবে কে জানে।”
‘সাহিত্য' পুরস্কার প্রাপ্ত লেখক অরিজিৎ চৌধুরী টানা ইনিংস খেলেছেন নির্ভুল। রূপদক্ষ শিল্পী, যে সমাজে বাস করেন, যে সম্পর্কে সময়ের ঘুড়ি উড়ছে আকাশে, সেই লাটাই এর সুতো চেনেন হৃদয়তন্ত্রীর মতো, তাই তার ভাষা মেদহীন কিন্তু সরাসরি। গল্পে ঢুকে যান এবং এক দুর্নিবার আকর্ষণে পরিণতির দিকে নিয়ে যান। আসাম দেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলের নিজস্ব কিছু সমস্যা আছে ভাষার ধর্মের এবং জাতির। আগুন’নামের ছোটোগল্প ‘পু ঘোষ’ নামের বড়ো গল্পে অরিজিৎ বড়ো জরুরী। বড়ো বেশি দায়বদ্ধ।
করিমগঞ্জের সুব্রত কুমার রায় এখন কলকাতায়। ব্যাঙ্কের পদস্থ হওয়া কি মেধায় ভাগ বসাচ্ছে। ‘দেওলা' গল্পে যেমন কেড়ে ছিলেন পাঠকের মন, তারপর আর আনমনা হতে দেন নি। ‘আরশিনগরের রূপকথা’র পর অনেক গল্প লেখা হয়েছে, সুব্রত নিজেকে সমৃদ্ধ করেছেন। তৃতীয় ভুবন-গল্পে মিথ ও জাদুর জাদুতে ইউরোপ ও লাতিন আমেরিকার গল্পবলার ঢং পাল্টে বাংলা ভুবনে প্রতিস্থাপিত করার অন্যতম স্থপতি তিনি। প্রথম গল্পগ্রন্থ হর্হে লুই বর্হেসকে উৎসর্গ করেন নি কিন্তু এক উন্মুক্ত প্রবন্ধে বন্ধনহীন গ্রন্থি বেঁধে দিয়েছেন এরকম, 'যেহেতু সাহিত্যের শুরুতে থাকে মিথ এবং শেষেও তাই।’ এর পর স্পেস দিয়ে বর্হেস নাম। বই এর নামকরণের দ্বিধা কাটাতে ইংরেজি করেছেন ‘Tales of mirrorland' কী জানি, পাঠক থেকে তো বড়ো নয় অথর।
স্বপ্না ভট্টাচার্যকে লক্ষ করেছেন সবাই সভয়ে। বাংলা ভাষার এমন শক্তিমান লেখককে বরণ করতেও বুকের পাটা লাগে। জীবন দেখতে লণ্ডন, প্যারিস, দুবাই যেতে হয় না। মূল্যবোধ যখন ভাঙে শহর শিলচরেও ভাঙে। স্বপ্না ভট্টাচার্যর স্বপ্নলোকও তার প্রিয় শহর, উপত্যকা। বরাক ব্রহ্মপুত্র মহানন্দা যমুনার অভিজ্ঞ জলসঞ্চারী কথাকার যখন স্বপ্ন দেখেন সে স্বপ্নে লেগে থাকে শিকড়জলের ঘ্রাণ। তাই বৃহস্পতিবারের লক্ষ্মীপুজোর মতো অভ্যাসে উনিশে মে পালিত হতে দেখলে ক্রোধ হয় তার। স্বপ্না লেখক মানুষের ভাষায় রাগ প্রকাশ করেন বলেই তিনি আলাদা। প্রলোভন থাকলেও ভাষার চাতুর্য পরিহার করেন। সহজ নদী উজানে বইলেও ভাটির টানে গড়িয়ে দেন। লেখকের মুদ্রাদোষও সহজ মনে হয়। প্রিয় জীবিকা বারবার ফিরিয়ে এনেছেন, লালকমল, নীলকমল শীতবসন্তের মনখারাপ থেকে মহাজননীর উত্তরণে হারিয়ে গেছে মুদ্রাদোষ। ‘নোটবুক’-এর নির্যাতনে নারী প্রাধান্যও মানিয়ে যায়। নারীর কথা লিখেছেন তবু মনে হয় না তেমন নারীবাদী। দু-একটি ভ্রূণহত্যা ছাড়া কোনো মৃত্যুকথাও বর্ণিত হয় না তাঁর কথাবয়নে। ‘আজ বনভোজন' গল্পেও মৃত্যু ৯ ডিগ্রি হিমাঙ্কে শীত হাওয়া ও বৃষ্টিতে মাখামাখি।’ নরম মন নিয়েও দুনিয়ার অসঙ্গতি বদলে ফেলার ফাইট ছাড়েননি। নীল নীল মিঠে স্বপ্নই শুধু দেখেন না লেখক, পাল্টেও ফেলেন জীবনের ফরম্যাটে। বাস্তবতার দাসত্ব নয়, বাস্তবতা সৃষ্টিও করেন। নিজের সঙ্গে আলাপের ‘পয়োধীর' গল্পই বাঁক নেয় ‘উজান’-এর দ্বিরালাপে, ‘নোটবুক’ ‘মেড ইন আমেরিকা’র বহুস্বরে একটিমাত্র বৃত্ত সম্পূর্ণ হয়। ‘মানববর্তন’ ও 'বাস্তুহীন’ গল্পে বরাক উপত্যকা তথা আসাম-বাঙালির সংকটের স্বরূপ উন্মোচনে তিনি সত্যান্বেষী ও স্বেচ্ছাসেবক। তাই প্রত্যাশার উচ্চাশা জারী রেখে জানাতেই হয় স্যালুট এবং প্রিয় ভাষাভূমির অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাকারকে স্বদেশি পাঠকের ব্যক্তিগত ঈর্ষাও।
মিথিলেশ তো শাহেন-শা। তৃতীয় ভুবনের কথা সাম্রাজ্য একা শাসন করছেন প্রায় অর্দ্ধ শতাব্দী ধরে। জীবনকে মিথিলেশ দেখেন টুকরো টুকরো করে। ঘটনার ঘনঘটা দিয়ে জটিল থেকে জটিলতর হয় না তার কথা বয়ন। বরাক উপত্যকার মানব মনে নাগরিক চাতুর্য কম তাই উচ্চাবচতাও ধরা পড়ে না মিথিলেশের গল্পকুশীলবের নড়াচড়ায়। নিম্ন মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্ত মানুষের জীবনসুন্দরকে খুঁজে বেড়ানোই তার উদ্দিষ্ট। মিথিলেশের গল্পপাঠ এক অভিজ্ঞতা, এক শুদ্ধতা, তার গল্প মিতকথায় বিশ্বাসী। জীবনানন্দকে ধ্যানজ্ঞান জেনেছেন শুরুর দিন থেকে। যেদিন মিথিলেশ লেখেন ‘ছারপোকা’, অসাধারণ জনপ্রিয়তার প্রথম ধাপ, নতুন রচনারীতির কথা প্রবেশ, এক ছোটোগল্প। বাংলা ভাষার এই দ্বীপভুবনে কেউ ভাবে নি যা, বরাক উপত্যকার রক্ষণশীল সমাজের জীবন ও যৌনতা নিয়ে এক নিটোল আখ্যান। তারপর একে একে ঝাঁপি ভরে ওঠে গল্পের, মিথিলেশ লেখেন ‘গোপাল যখন বিচারক’ ‘প্রাত্যহিকতার ডামাডোলে প্রতুল’ ‘কেশবলালের ভূমিকা’ 'আট বছর আগের একদিন’ ‘নষ্টশশার’ মতো বাঁক ফেরানা কথার নবীন বয়ান। নষ্টশশা নামের ব্যঞ্জনা এখনও অনেক কথা শুনিয়ে যায় গল্পশেষে। বরাক উপত্যকার ছোটোগল্পের আদিপর্বের গোলাকার ভুবনকে অনেকার্থ দ্যোতনায় ব্যাপ্তি দিয়েছেন মিথিলেশ। বরাকের গল্প বাড়ির স্থপতি মিথিলেশ ধারাবাহিকতায়ও সবার থেকে আলাদা। দু-হাজার তিনে তার দশটি গল্প নিয়ে বেরিয়েছিল গল্পগ্রন্থ ‘কক্ষপথ’, এবার বেরোল ‘চৈত্রপবনে’, বেরোল ‘স্বপ্নপুরাণ’, আপাতত একটি বৃত্ত সম্পূর্ণ। ‘দেশভাগের গল্প’ তার নবতম সংযোজন।
‘ঢিলে প্যাণ্টের অন্দরমহলে মরশুমি দাদ চুলকোতে চুলকোতে একেবারে টেনিস বল সাইজের হাই তুলল...কার্তিকচন্দ্র।’
কিংবা
‘....গলায় চেন বাঁধা দুই কুকুরের পেছনে কুৎসিত চেহারার একটি লোক এই দৃশ্য দেখতে দেখতেই পিচরাস্তা আড়মোড়া ভাঙে। যখন সদ্য পাপবিদ্ধ আধডজন ফ্রক রহস্যময় হাসিতে তেতে ওঠে, ডেভিল নামের কুকুরটা পেছনের পা তুলে একাগ্র হয় যখন, অপু তখন বুঝতে পারে একটা অন্ধকার সুর থেকে জন্ম নেওয়া হাজার হাজার ফড়িং মুহূর্তে তার সমগ্র মস্তিষ্কের দখল নিচ্ছে।’
গল্পের নাম ‘মাধুরীর স্বপ্নগুলো’ এবং ‘অপু ও ফড়িঙেরা’ যুগপৎ, দুটি মাত্র উদ্ধৃতি। আপাতত তিনটে মাত্র ছাপানো গল্পের লেখক রাহুল দাস অমিতাভ বচ্চন হতে আসেনি, বরং উচ্চাশায় বিগ বিকে ছাড়িয়ে যেতে চায়, বরাক উপত্যকার গল্প সাম্রাজ্যের দখল নিতে চায়। বিশাল হওয়ার সব লক্ষণই বর্তমান রাহুল দাস-এর কথাভাষায়। উপরের উদ্ধৃতি দুটি তো বরাক উপত্যকার মাপে বিস্ফোরক। গল্পকার রাহুল দাসকে নিয়ে মন্তব্য করেছেন এক কথাকার এরকম: ‘নতুন এক গল্পকার রাহুল দাসের কথা বয়নে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের রুক্ষতার মিঠে পাক। সব গাছ ছাড়িয়ে রাহুলই হয়ে উঠবে তৃতীয় ভুবনের জ্যোতিষ্ক। বিরাট তারকা। কথা থাকল।’
আসলে এরকম রচনার একটি বড়ো বাধা আমাদের গল্পকারদের অপেশাদারিত্ব। ব্যাঙ্ক চাকুরে ভবিষ্যনিধি পিডব্লিউডি ই এণ্ড ডি ডাক বিভাগের চাকুরে হলে যৌথ পেশাদার কেন হতে পারি না। তাই আমরা পরিচিত একটি কিংবা দুইটি গল্পে, হয়তো একটি সাধারণ সংকলন গ্রন্থেও অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। অনেকের লেখা তো ছোটো কাগজের একটি কিংবা দুটি সংখ্যায় ছাপা হয়েছে, তারপর কাজের চাপে ভুলে গেছেন লেখালেখি। প্রাবন্ধিক তো আর ছোটো পত্রিকার আগারিক নন। তাই একক সংকলনের উপর নির্ভর করা যায়। লেখককে একান্তে পাওয়াও যায়। ভাবীকালের প্রয়োজনে সংকলন গ্রন্থ বড়ো জরুরি। বই না থাকায় অনেক জরুরি লেখকও থেকে যান আলোচনার বাইরে। পাঠকের দুর্ভাগ্য।
শ্যামলেন্দু চক্রবর্তী নিয়ে লিখতে গেলেই কলম দিক বদল করে। শ্যামলদার গল্প থেকে তার অন্য পরিচয়ে চলে যায়। শ্যামলদা না হলেও বরাক উপত্যকায় বরাক ব্রিজ হত, বিশ্ববিদ্যালয় হত, করিমগঞ্জের শ্যাওলা ও জকিগঞ্জ সীমান্ত হত বরাক নদীও তেমনি কুলুকুলু বয়ে যেত। কিন্তু গালভরা নামের সব গল্পকার হত না। হত না হত না হত না। তাই অনিশ সম্পাদক শ্যামলেন্দু চক্রবর্তীর লালন করা গল্পকার যূথ তখন যে ধারাবাহিকতার শুরু করে গেলেন সেই পাদপ এখন পত্রেপুষ্পে ফলে ছায়ায় পান্থসখা হয়েছে। এমন কি তপোধীর ভট্টাচার্যর মতো আলোচকও কৃতজ্ঞতার কথা বলার পর তার গল্পশরীরে প্রবেশ করেন। শ্যামলেন্দু চক্রবর্তীর গল্পগুলিতেও যে মানুষ শ্যামলদা উপস্থিত। শুধু মানুষ হওয়া, মানুষের পাশে দাঁড়ানোর গল্প ‘গ্রন্থি' আমাদের দিক নির্দেশ করে বলে দেয় গল্প শুধু একার কথা নয়। সবাইকে নিয়ে সুখে থাকার কথা বলে ছোটোগল্প। জুল ভের্ন ওদেশে আর আমাদের বাংলায় রায় পরিবারেরই অধিকার আছে কল্পবিজ্ঞানের গল্প লেখার। সুকুমার, সত্যজিতের পর কেউ নেই এমত জেনেছি আমরা। অদ্রীশ বর্ধন একটু ঘেটে দিয়েছেন বলেই হয়তো, কিংবা ‘রহস্য’ ‘রোমাঞ্চ’ ও ‘কল্পবিজ্ঞান’ নামে পত্রিকা কটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ভাঁটা পড়ে চর্চার। শ্যামলেন্দু চক্রবর্তী বরাক উপত্যকায় প্রথম ও শেষ কল্পবিজ্ঞানের গল্প লেখেন ‘শব্দহীন দেশে’। শ্যামলেন্দু চক্রবর্তীর গল্পপাঠ আবশ্যিক হওয়া উচিত এই ভাষাভুবনের শিক্ষাঙ্গনে। ‘যে গল্পের শেষ নেই’ গল্পগ্রন্থের মণিমুক্তোর আসলে নকল নেই একটিও।
একটি গল্প লিখেও কেউ কেউ গল্পকার, ওষধি কথার কথাকারকে মনে রাখার জন্য যুক্তি সাজাতে হয়। আমাদের লোভ এমন জিনিস, চৌদ্দটি গল্প পড়েও আশ মেটে না, একটি বলে অন্যটিকে দেখ। সংকলনের পরে আশা দৃঢ় হয় আরও লেখা হবে, পড়ব এর পরেও। আশঙ্কাও একটা হয় যখন অনেকদিন পত্র পত্রিকায় অনুপস্থিত থাকেন প্রিয় কথাকার। সংশয়ীমন ভাবে, আর কী লিখবেন না তবে। আমাদের আশঙ্কাকে সত্য করে অনেকদিন লিখছেন না দীপেন্দু দাস। ‘বৃত্তের বাইরে’ তার একমাত্র গল্প সংকলন। অসাধারণ সব গল্প, যদিও তার স্বাক্ষর গল্পটি বলতে এখনও জানি ‘মালতী উপাখ্যান’। দীপেন্দুর মতো নাগরিক জীবন গ্রামীণ জীবন অন্ত্যজ জীবনকে মুখোমুখি এক অসহায়তায় দাঁড় করাতে পারেননি কেউ। এক উপন্যাসের উপাদান নাটকের উপাদান হেলা ভরে কেন জানি হতে দিলেন না বৃহৎকথা, ছোটোগল্পের বারুদেই ভরে দিলেন অনবদ্য ‘চাঁদ সদাগর’। বহুমুখী গল্পকার দীপেন্দু দাসকে এক সময় মনে হত যৌনতা তার গল্পের মুখ, আবার দেখা গেল সবকিছু ছাপিয়ে মানবিকতাই আসল অবয়ব, দ্বিবাচনিকতার সম্পর্কটাই সব। মানবমনের সমাজমনের অতল খোঁজার চশমাটি দীপেন্দু খুলে রাখবেন না প্লিজ।
হিমাশিসের নকশার বইয়ে গল্প ছিল না। নায়ারণ গঙ্গোপাধ্যায় গৌরকিশোর ঘোষ এককালে যেমন লিখতেন। দেখার চোখ এমন মর্মভেদী হলেই সুখপাঠ্য নক্শা আঁকা যায়। গল্পকার হওয়া যায়। হিমাশিসের গল্পের হাত যে এমন মজবুত জানতাম না। জানলাম যখন ছক্কা হাঁকিয়ে দিল। দেশ পত্রিকায় লিখলেই দক্ষ গল্পকার হয় না, কিন্তু হিমাশিস দেখিয়ে দিল দারুণ। বরাকের বন্যা নিয়ে তার কথা বয়নে স্বকীয়তা ছিল, নতুনের আবির্ভাব ছিল। আসামের সন্ত্রাস নিয়ে লেখা অপহরণ গল্পটিও অসাধারণ।
অমিতাভ দেব চৌধুরী, সুব্রত কুমার রায়, শুভঙ্কর চন্দ, পার্থপ্রতিম মৈত্র, পরম ভট্টাচার্যদের নিয়ে কিছু লিখতে গেলে ভাবতে হয়। এরা যে প্রস্তুত হয়ে এসেছেন বাংলা ভাষায় লিখবেন বলে। সবচেয়ে ভালো লিখবেন বলে। ওরা সময়ের চেয়ে এগিয়ে বলেই সমসাময়িকদের ঈর্ষার পাত্রও বটে এবং শ্রদ্ধারও যুগপৎ।
অমিতাভ কলিকাতায় থাকাকালীন লিখেছেন কলকাতার ছোটো এবং মাঝারি কাগজে। প্রমায় একটি লেখার কপি দিয়েছিলেন আমায়, তখন তার বয়স কম, লেখা পড়ে স্যালুট করেছিলাম, তখন ছিয়াশি। শিলচর যাওয়ার পর প্রতিদ্বন্দ্বীহীন সাম্রাজ্যে একটু হেলা ফেলা করেছেন। কিছু সময় হয়তো দিশাহীন দুরন্তপনায় কেটেছে তার লেখালেখি। কারণ তিনি জানতেন অমিতাভ যা লিখবে তাই লেখা। সলতে পাকানোর সময়টি কলকাতায় কেটেছে বলেই হয়তো মহানাগরিক অনুষঙ্গে সাবলীল তিনি আবার শিকড়ের প্রতি অনুগত একশ শতাংশ। ‘প্রসিদ্ধ রক্ত’ ও ‘দ্বি’ তার উল্লেখযোগ্য গল্প। উপন্যাসেও সিদ্ধহস্ত কবি অমিতাভ। নিজের প্রতি দায়বদ্ধতার টানাপোড়েন কাটিয়ে অমিতাভ দেব চৌধুরী এখন উপত্যকার প্রধান লেখক এবং মানবিক মুখ।
আকাশ যখন একটা, একটি সূর্যকে স্থাপিত করার দায় থাকলে অসহায় হন নির্বাচক। এমনি এক দোটানা ছিল বরাক উপত্যকার শ্রেষ্ঠ গল্পকার নির্বাচনে। শুভঙ্করের গল্পটিও ছিল দেদীপ্যমান, তবু সূর্য হয়নি। এর পরে যখন ‘সাহিত্য’ ‘প্রতিস্রোত’ এ শুভঙ্কর চন্দর গল্প পড়েছি অবাক হয়েছি। কী দুরন্ত বাংলাভাষার গল্প, অপর বয়ানের নির্মাণ। রাগী বামপন্থী বাস্তবতার রূপদক্ষ শিল্পী শুভঙ্করের কোনো গল্প সংকলন চোখে পড়েনি।
পরম ভট্টাচার্য হয়তো সেই অর্থে নিজেকেও গল্পকার ভাবেন না। পরম ভট্টাচার্য প্রকৃত অর্থে এক সমাজতাত্ত্বিক। স্মার্ট গদ্য, অনেকার্থদ্যোতক রচনায় তিনি সামাজিক অসাম্য, নাগরিক মধ্যবিত্তের হিপোক্রিসি স্নবারির মুখোশ খুলে দেখাতে পছন্দ করেন। ‘আহা যদি অহর্নিশি দাঙ্গা হতো’ এই একটি গল্প লিখেই রাজনীতি ও ধর্মব্যবসায়ীদের বিরাগভাজন হন উপত্যকার পাঠক প্রিয় কথাকার। দায়বদ্ধতার কথা বলেন বলেই পরম উপত্যকার একজন আবশ্যিক গদ্যকার।
আকাশে যখন সূর্যস্থাপন করার প্রশ্ন উঠেছিল দেবব্রত চৌধুরীর ছটায় আমরা আচ্ছন্ন হয়েছিলাম। বিপুল সম্ভাবনার ছোটোগল্প ‘সাধভক্ষণ’ নিয়ে যার আবির্ভাব, ‘চোরাঘূর্ণি’র মতো গল্প লেখার পরও দেখিল সে কোন মায়া, সিনেমা করতে গেল গল্পের সংসার ভাসিয়ে। সিনেমা করার কোনো কেন্দ্র নেই শিলচরে কিন্তু বিখ্যাত লেখকরা সিনেমার মাধ্যমকে আরও দুরন্ত ভেবে মজে গেছেন। যেমন শেখর দাশ, যেমন দেবব্রত। তবে ছোটোগল্পে তো আর সিনেমার মতো তড়িঘড়ি নেই, ফিরে আসুন পার্থপ্রতিম, দেবব্রত বলার মতা সময় দিল না দেবব্রত, ২০১৭-র ফেব্রুয়ারিতে চলে গেল উপত্যকা ছেড়ে গল্পভুবন ছেড়ে না ফেরার দেশে।
‘নিখিলেশদের বেঁচে থাকা' ‘আমাদের বাড়ি’ গল্পের সৌমিত্র বৈশ্য ধারাবাহিকভাবে লিখছেন শুনেছি। তার গল্পসংকলনটি এখনও পাইনি বলে তার সিগনেচার গল্পটি ছাড়া অন্য খোঁজ দিতে পারছি না। সৌমিত্রের মতো নিভৃতচারী কথাকারকে নিয়ে অনেক কথা বলার থাকে। বিশেষ করে তার গল্পভাবনা, পরীক্ষা নিরীক্ষা, গল্পে ন্যারেশন থাকবে কিনা, থাকলেও কতখানি। সৌমিত্র ‘খ’ নামে একটি অভিজাত বৌদ্ধিক কাগজের সম্পাদনার প্রধান স্তম্ভ।
কৃষ্ণা মিশ্রর গল্প ‘সাপ শিশির খায়’ প্রকাশের পরই পাঠকের মুগ্ধতা আদায় করেছেন। বিয়ের পর অনেকদিন লেখেননি কৃষ্ণা মিশ্র ভট্টাচার্য, এখন লিখছেন আমাদর মাঝারি মধ্যবিত্ত থেকে দামী মধ্যবিত্তদের নিয়ে। হাইলাকান্দি থেকে দিল্লির পথে কৃষ্ণাকে চিনতে ভুল হয়নি। দামী মানুষ ও তার সামাজিক ভণ্ডামি দেখতে হলে এক মরমী এবং সংবেদ্য মন থাকতে হয়। কৃষ্ণার দেখার চোখটি কিন্তু নিউজ রিডারের নয় পুলিশেরও নয়, তিনি এক ব্যতিক্রমী কথাশিল্পী।
ঝুমুর পাণ্ডেও ব্যতিক্রমের গণ্ডিভুক্ত লেখক। লিখে চলেছেন দু-হাতে। কাটলিছড়া চা বাগানের জন্মসূত্র তাকে দিশা দিয়েছে। বামপন্থী পরিবারের কন্যা ঝুমুরের চা শ্রমিক অধিকার ও লড়াই-এর নিরলস যোদ্ধা পরিচয়টাই প্রধান। কিন্তু সত্যের মুখে একটি আবছা আস্তরণ এটা, চা শ্রমিকের জীবন নিয়ে তার মতো কেউ ধারাবাহিক লেখেন নি ঠিকই, তবে শুধু চা শ্রমিক নয়, তামিলনাড়ুর দরিদ্র শুক্লবৈদ্য পরিবার নিয়ে তার অসাধারণ ছোটোগল্প কিংবা ‘গাঙগাথা’র মতো মহৎ উপন্যাসেও চা শ্রমিক নয় কিন্তু অন্ত্যজ মানুষের বেঁচে থাকার লড়াই কথাই লিখেছেন। ঝুমুরের গল্প ‘গেরাম থানের মানুষটা ও দুলিয়া’, ‘সুখ গাছের গল্প’গুলিতে তিনি চা শ্রমিকের অচেনা জীবন যাপনের বিশ্বস্ত চিত্র এঁকেছেন, বাংলা ছোটোগল্প সমৃদ্ধ হয়েছে নতুন দিগন্ত দিশারীর কথাশিল্পে, এত চেনা জীবন তবু কাছে যাননি কেউ।
কাজল দেমতা বাংলায়ও লেখেন সাদরি বাংলাও লেখেন। চা শ্রমিকের দুঃখের কথাই লেখেন গল্পে। ভাষার বিন্যাস থেকে প্রধান হয় সহজ কথায় পাঠকের মর্মে পৌঁছে দেওয়া বার্তা। কথাকার একজন সামাজিক ব্যক্তিত্বও বটে।
বিজয়া দেব এর গল্প পড়েছি উপন্যাস পড়েছি। এত সহজ সামাজিক ও মানবিক সম্পর্ক নিয়ে লেখালেখি হয়তো কেউ কেউ করেছেন তবে তার মতো শুধু নারীদের নিয়ে লিখতে দেখিনি। মেয়েদের নিয়ে হাহুতাশ নয়, পরাশ্রয়ের বাঁধন ছেঁড়া নারীর স্বাবলম্বী হওয়ার বার্তায় মুখর থাকে বিজয়ার লেখা। ‘এবং নয়না’ পড়ে পরম্পরা সম্পাদক মারফৎ স্যালুট জানিয়েছিলাম। না পেয়ে থাকলে আবার।
অনুশ্রী সেন ছিলেন। তাকে মনে না করলে বরাক উপত্যকার গল্পচর্চা অসম্পূর্ণ থাকে। প্রায় বিয়াল্লিশ বছর আগে তার লেখা সাহসিক গল্পগুলির একটা সংকলন না হলে, সময়ের থেকে এগিয়ে থাকা গল্পকারকে ভুলে গেলে ইতিহাস ক্ষমা করবে না।
আশুতোষ দাস ‘আব্বাজানের হৃদপিণ্ড’ ও ‘লীলাবতী রিয়াং’ এর মতো গল্প লিখেছেন। এখন চিত্রনাট্য সিনেমা ও উপন্যাস রচনা করছেন। কবিতায়ও আছেন স্থির। শতক্রতুর দিন থেকে এখনও ‘বেলাভূমি’ সম্পাদক আশুতোষের ভাষাচর্চার বহুমুখী দিকটি উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হচ্ছে।
কল্লোল চৌধুরী হাইলাকান্দি থেকে নিভৃতে গদ্যসাধনা করে যাচ্ছেন। সামাজিক ডামাডোলে আহত মানবিক সম্পর্ক নিয়ে তার ছোটোগল্প ‘হাফলঙের পাহাড় ও দীপঙ্কর মিনতি’। এ তো গল্প নয় এক দলিল। পাহাড়ের মানুষের সঙ্গে সমতল মানুষের সম্পর্ক নিবিড় করার দূতিয়ালি করে। কল্লোল একটি চমৎকার অনুবাদ গ্রন্থের সম্পাদনা করেছেন তার ও কয়েকজন নির্বাচিত গল্পকারের গল্প ইংরেজিতে অনুবাদ করে। ‘এ গ্নিমসেস: বেঙ্গলি শর্টস্টোরিজ অফ আসাম’ দেশের গণ্ডি ছেড়ে বিদেশেও আদৃত হয়েছে শুনেছি।
মিহির কান্তি রায় একজন উল্লেখযোগ্য গল্পকার। সত্তরের সময় বা তারও আগে থেকে লিখছেন। সম্পর্কের টানাপোড়েন তারও প্রিয় বিষয় এবং উপজীব্য। মিহির কান্তি উপন্যাসকারও বটে। ইদানীংকার লেখা ‘সামনে শালবন’ মানবিক সম্পর্কের ভাঙাগড়ার এক নির্মম দলিল। ইংরেজি অনুবাদটিও যে দারুণ হয়েছে মুখোমুখি বলার মতো সময়ই দিলেন না, চলে গেলেন।
দৃশ্যমান আটটি গল্পগ্রন্থের মালিক বিকাশ দের শেষতম বইটি বেরিয়েছে কলকাতা থেকে। ‘এক শীতের রাতে’ সংকলনে চৌদ্দটি অনুপম গল্প গ্রন্থিত। বিকাশ দে রসবোধ আর দৈনন্দিন জীবনের খুঁটিনাটির এক সূক্ষ্ম দর্শক। গল্প পড়ার পর শেষ হয়েও হইল না শেষ রেশ টুকু থাকে।
শর্মিলা দত্তর পরিচয় মূলত অণুগল্প লেখক হিসেবে। অণুগল্পের এক ঘরানা তৈরি হয়ে গেছে তার হাতে। পনেরোটি গল্পের এক সংকলনগ্রন্থ ‘নিঝুম মাইলংডিসা’র নাম গল্পটিও বহরে ছোটো কিন্তু মনে হয়েছে অনন্তে পৌঁছে যাবে তার স্থান কাল পাত্রের অপার্থিব যাত্রা। এরকম মন ছুঁয়ে যাওয়ার গল্প একটি লেখা হলেও সার্থক লেখা যাত্রা।
যাকে নিয়ে বিস্তর লিখব ভেবে শুরুতে রাখিনি নাম। লেখা শেষ করার পর রোল কলে দেখছি প্রধান মানুষটিই অনুপস্থিত। মলয় কান্তি দে-কে দিয়েই যে আলোচনা শুরু করার কথা তাকে বাদ দেওয়ার উদ্দেশ্য একটাই, প্রাণের মানুষ তো থাকে প্রাণে তাকে কেন লেখার পাতায় টেনে আনা। মলয় কাত্তি দের গল্প 'আসরাফ আলীর স্বদেশ' বরাক উপত্যকায় দেশভাগ ও মানবিক সম্পর্কের মর্মভেদী বয়ান। চাবুকের মতো গদ্য লিখতে পারেন একমাত্র তিনিই ‘আত্মপরিচয়’ এর গ্রন্থকার। ‘আক্রান্ত’ ‘মনু সংহিতার’ মতো গল্প লিখেও মলয় কাস্তি লেখেন কম। তবু তিনি রাজার রাজা, মলয় কান্তি না পড়লে বরাক উপত্যকার গল্পবিশ্বের পরিক্রমন সম্পূর্ণ হয় না।
মেঘমালা দে উত্তরাধিকার বহন করে এসেছেন গল্পকথার আসরে। প্রথম শতক্রতু ছোটোগল্প প্রতিযোগিতার প্রথম স্থান অধিকারী। ‘মানবী’ পত্রিকায় ছোটো একটি অণুগল্প দিয়েই যাত্রা শুরু, মনে হয় লাইন তিনেকের গল্প, সেটিই বিস্তৃত হয়ে পরবর্তীকালে ‘আনারকলি’ নামে তার সিগনেচার গল্প। এরপরে আর থামা নেই।
সুব্রতা মজুমদার দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছিলেন শতক্রতু গল্প প্রতিযোগিতায়। দুটি গল্প লিখেছেন এখন পর্যন্ত, প্রকৃতির সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে রাখেন গল্পে। বিশেষ করে পাখির অনুষঙ্গ।
আদিমা মজুমদারের গল্প পড়লে পাঠক সতর্ক হবেন। সামাজিক বৈষম্য, বিশেষ করে নারীর প্রতি বৈষম্যই তার লেখার সচেতন প্রয়াস। এরকম অসাম্প্রদায়িক কথা রচনার ধারা বরাক উপত্যকার সাহিত্যকে নতুন পথ দেখাবে নিঃসন্দেহে।
দোলনচাপা দাসপাল এক উল্লেখযোগ্য কথাকার এ উপত্যকায়। সহজ ভাষায় সমাজের সহজ সমস্যার উপস্থাপনা তার বৈশিষ্ট্য। সমাপ্তি বিষয়ে অতি সচেতনতা তার গল্প অন্যমাত্রা চিহ্নিত করে।
সায়ন বিশ্বাস, বিশ্বরাজ ভট্টাচার্যর নাম শুনেছি বিস্তর। নবীন কথাকারদের নিয়ে পাঠক মহলের ঔৎসুক্য ঈর্ষাজনক।
দীপেন্দু দাস বলেছেন সায়ন গল্প বলতে জানে। এক বহুমুখী প্রতিভাধর সঙ্গীতশিল্পী সায়ন কথারাজ্যেরও সম্ভ্রান্ত নাগরিক।
বিশ্বরাজ ভট্টাচার্য সুরকার গায়ক এবং কথাকার যুগপৎ। সায়ন বিশ্বরাজ ও আদিমা নবীন প্রতিভা। বরাক উপত্যকার ছোটোগল্পের নতুন প্রজন্ম। খুব শক্তিশালী হৃদয় ও মেধা। ‘রিডাকশন’ তার সইসাবুদের গল্প। মন কেড়ে নেয়।
‘ইচ্ছেডানা’র শ্রেষ্ঠ কবি পুরস্কার পেয়েছেন রাজীব ভট্টাচার্য। ইদানীং অণুগল্প লিখছেন।
কপোতাক্ষী ব্রহ্মচারী চক্রবর্তী মুন্নিও লিখছেন অণুগল্প, উত্তরাধিকারের উত্তম শর্ত মেনে।
উষসী দাসের লেখাও এখন দেখা যায় না, স্মার্ট লেখা 'ছু মন্তর' 'ফাঁদ' কিংবা 'আড়াই অক্ষর' গল্পে ‘অথই' এর ভাষা দারুণ।
ঋতা চন্দের লেখাও পাইনা ইদানীং। 'দাগ' ‘হারমনিয়ম’ ‘অপরাধী’ ও ‘পৃথুলার দিন’এর লেখক ন্যারেশনের নিপুণতায় গল্পশরীরে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করেন। দীর্ঘ গল্প লেখার ঘরানায় তিনি বিশিষ্ট।
দেবযানী ভট্টাচার্য ছোটো ছোটো নকশা এঁকেছেন গল্পের আদলে, ‘সুরানা মহলে একদিন' আর 'কালো হিরে' গল্পে প্রতিশ্রুতি রয়েছে।
মধ্যবিত্ত জীবনের প্রেম দৈনন্দিনতার গল্প ‘দ্বীপবাসিনী’ ‘বোবা অনুভূতি' 'বাবা থাকেন ওপারে' লিখেছেন হাইলাকান্দির মহাশ্বেতা দেব।
একসময় ‘এক ছুটির সকাল বেলা’ আর ‘উদয়াচলের পাখি’ পড়ে ভাল লেগেছিল যে কথাকারকে, সেই লীনা নাথ এখন স্বনামখ্যাত লেখক।
‘বিষাদে চৈত্রমাস’ গল্পের অপর্ণা দেব এতদিন লেখেননি কেন কিংবা লিখলেও হয়তো চোখে পড়েনি। অনেক অণুগল্প লিখেছেন যা মনের সূক্ষ্ম অনুভূতির দ্যোতক। বয়স্ক নাগরিক অধিকার এর সঙ্গে নারী অধিকার সচেতনারও দিশারি হয়ে রইলেন এই কথাকার।
মঞ্জরী হীরামনি রায়ের নামেই মুগ্ধতার শুরু। ‘ঊষর বন্ধন’ গল্পের বিষয়ে অপর পরিসরের আভাস দিয়ে জাত চিনিয়েছেন।
হয়তো এক নতুন আরম্ভ হবে মৌপিয়া চৌধুরীর কথাবয়নে। নানান পরীক্ষা নিরীক্ষা করছেন কথাসাহিত্যের। সেন ভ্রাতৃদ্বয় তৃণময় ও মেঘদূতও এলেন লিখলেন ও জয় করলেন।
‘যা কিছু গল্পের সব আমার’ এই বাক্যবন্ধ শুধু কথার কথা নয়। কথাকার হিসেবে নিজের সার্থকতার হিসেব রাখিনি কিন্তু বরাক উপত্যকার কথারচনার ইতিহাস জানতে ও জানাতে আমার ঔৎসুক্য রয়েছে নিরন্তর। নবীনদের প্রতি অবিচারের আশঙ্কা একটা থাকলই, ভৌগোলিক দূরত্বজনিত অক্ষমতার জন্য অনেকই হয়তো থেকে গেলেন অনুচ্চারিত, চেনা পৃথিবীর এক খণ্ডিত রূপরেখা হয়েই না হয় থাকুক এই অসম্পূর্ণ প্রিয় নামের পুনরুচ্চারণ।