উনিশে মে: ভাষার সংকট/ধ্রুবপদ উনিশ/উনিশে মে

ধ্রুবপদ উনিশ

উনিশে মে

ঐতিহ্য একটি বহমান ধারা, চৈতন্য একটি স্বতশ্চল প্রবাহ, যা মানবেতিহাসকে উর্বরা করে। আবার ধারাবেগ প্রবল হলে জলা’র আকার নেয়, হয় বন্যা। বহমানতা এতোল বেতোল হয়, মনে হয় সৃষ্টির বুঝি এবার লয়। ভারতবর্ষের উত্তর-পূর্বের শ্যাম বাংলার শান্তির দ্বীপে সব বাঁধ ভেঙেছিল উনিশে মে ১৯৬১ ইংরেজি। বহু ভাষাভাষীর বাসভূমি বরাক নদীর তীরে, প্রধান ভাষা বাংলার পরিবারে সুখ ছিল, শাস্তি ছিল। কী জানি, কী ছিল নবীন শাসকদের মনে, স্বাধীন দেশের ঈশান কোণ থেকে উড়িয়ে দিতে পারতেন পারাবত, শান্তির দূতকে বলতে পারতেন যাও পাখি বলো তারে—পারতেন মিল করিয়ে দিতে একই হরফে লেখা, একই ভাষা পরিবারের ‘তুতো' ভাইদের। পাশাপাশি বেড়ে উঠতে পারত লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়ার দুঃখহরণ মাতৃভাষা আর রবিঠাকুরের সোনার বাংলা। স্ব স্ব পরিবেশে এবং সম্মিলিত অঙ্গনে। তা না করে জারি করলেন ভাষা বিল। বললেন দারিদ্র্য নয়, শোষণ নয়, বাঙালিই একমাত্র শত্রু, তাই ‘বঙাল খেদা'। পুলিশ ও ফৌজি বন্দুকের নলে বিপ্লব এল, কেড়ে নিল এগারোটি তরতাজা ভাষা সেনানীর প্রাণ। মুখের ভাষা রক্ষায় বুকের রুধির ঢেলে দিল বরাক উপত্যকার বাঙালি! স্বজন হারানোর বেদনা বুকে নিয়ে প্রান্তিক বাঙালি গাইল গান, ‘আরও প্রাণ, আরও প্রাণ, আরও প্রাণ। ওই বেদীমূলে দিতে হবে বলিদান।’ মানুষ ভুলে গেল সব, জীবন জীবিকা তুচ্ছ করে প্রতিদিন প্রভাতফেরি, প্রতিদিন শপথ নিতে হাজির হল গান্ধিবাগ, মধুরামুখ ও অন্যান্য জমায়েত স্থানে। শহিদের চিতাভস্ম নিয়ে হল নীরব মিছিল, সন্ধ্যায় ঘরে ঘরে একাদশ প্রদীপ জ্বালিয়ে গাইল 'শোনো ডাকে ওই একাদশ শহিদেরা ভাই, গাইল, ‘হবে জয়, হবে জয়, হবে জয়'। এরপর চার-চারটে যুগ চলে গেছে, পঞ্চাশ বছর ধরে, বরাক উপত্যকার বাঙালির ধমনীতে এখনও উনিশে মে-র ঐতিহ্য এবং চেতনা স্বতঃবহমান। সময় পলি ফেলেছে, স্মৃতির উর্বর জমি চাপা পড়ে গেছে হয়তো। অর্ধশতবর্ষ তো কম কথা নয়, সার্ধশতবর্ষের কবিকেই আমরা কতটুকু মনে রেখেছি। গান গেয়েছিলেন বলে হয়তো এখনও ছাড়ায়ে যেতে পারিনি। চুরি যাওয়া স্মৃতি ফিরে পাওয়ার জন্য সিবিআই কিছু করতে পারেনি ঠিক। কিন্তু ধারণার তস্করকে খুঁজে পেয়েছেন কেউ কেউ। বলছেন, ধরে আন্ চোর। বলছেন, বিশ্বায়নকে ধরে আনো। সেই তো সব মন ভোলানোর ঘটি, সব ‘কণ্ডল' সেই করেছে। তা, বিশ্বায়নটা কে হে, বাঙালির মন চুরি করবে এতো ক্ষমতাধর।

 সে তো আর রবিঠাকুরের নোবেল নয়, এক সোনার চাকতি, যে ম্যাজিক করবে!

 স্মৃতি থেকে পলি সরিয়ে নতুন প্রজন্মকে নিয়ে যেতে হবে উত্তরাধিকারের মুখোমুখি। পঞ্চাশ বছর পর নবীনের অধিকার রয়েছে তথ্য জানার। তাই মাতৃদুগ্ধসম মাতৃভাষার গরিমা রক্ষায় একাদশ শহিদের কথা নতুন করে শোনানো হোক। বারবার জানানো হোক। পথে পথে, ঘরে ঘরে, পার্কে পার্কে গড়ে উঠুক নতুন নতুন শহিদবেদী, বড়ো বড়ো করে লেখা হোক শচীন, কমলার নাম। লেখা হোক হীতেশ, সত্যেন্দ্র, চণ্ডীচরণ, সুনীল, সুকোমল, তরণী, কানাইলাল, কুমুদ, বীরেন্দ্রর নাম। লেখা হোক বাচ্চু, যিশু-জগনের নাম। কিন্তু এমন ছিল না আষাঢ় শেষের বেলা। একশো পাঁচ বছর আগে এমন ছিল না।

 বঙ্গভঙ্গ প্রস্তাবের পর থেকেই বিষময় ঝড়ের প্রতিকূলতা বইতে হয়েছে বাঙালিকে। বাঙালি জীবনে দুঃখের সেই শুরু। বাঙালি কেন যে হিন্দুও হইল, মুসলমানও হইল, শুধু বাঙালি হইল না।

 ও-পারে যারা ভঙ্গ বঙ্গ নিয়ে গেলেন তারাও কি সর্বসুখে আছেন, এপারের ভঙ্গ ভারতেও বাঙালিকেই শুধু ভাষার প্রশ্নে বারবার অগ্নিপরীক্ষা দিতে হচ্ছে। এক সম্মিলিত চক্রান্তের শিকার হয়ে ভাষা জননীর বেদী বারবার রক্তাক্ত হচ্ছে। অখণ্ড থাকলে এমন হত না।

 ও-পারে শুরু হয়েছিল ৫২-র একুশে ফেব্রুয়ারিতে, এবং দ্বি-জাতিতত্ত্বের বিষবৃক্ষের উৎপাটন হয়েছিল। ভাষাশহিদের রক্তে ধুয়েমুছে গিয়েছিল মহম্মদ আলির আস্ফালন—উর্দু, শুধু উর্দুই হবে পাকিস্তানের ভাষা। বাঙালির ভাষা। এ-পারেও ভাষাবেদী অপবিত্র করার আর এক চক্রান্ত শুরু হয়েছিল গোপীনাথ বরদলৈর উচ্চাকাঙ্ক্ষী বাগাড়ম্বরে, আসাম শুধু অসমিয়া ভাষীর। জাতির পিতা দূর থেকে স্মিতহাস্যে বলেছিলেন, ভারত তবে কার। এ যেন দ্যূতসভায় দৌপদ্রীর বস্ত্রহরণ দেখে পিতামহর স্বগতোক্তি, ধর্মের গতি সূক্ষ্ম।

 একুশে করে দেখিয়েছে উর্দু নয়, পাকিস্তান নয়, বাঙালির নিজস্ব ভুবনের নাম এখন ‘বাংলা’ ‘বাংলাদেশ’। একুশের আত্মত্যাগ বিশ্ববাসীকে শিখিয়েছে মাতৃভাষার গরিমা। শিখিয়েছে পারস্পরিক সহাবস্থানের ভিত্তিতেই যা টিকে থাকবে দৃঢ়ভাবে। একুশ তাই বিশ্ব মাতৃভাষা দিবস এখন। বাঙালি না হলে মাতৃভাষার অমৃতভাণ্ডারের কথা জগতে জানাত কে। আর এ-পারে স্বাধীন ভারতবর্ষেও খণ্ড ছিন্ন বাংলা ভুবনের সংখ্যা কম নয়। পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা ছাড়া অসম প্রদেশেও বাংলা ভাষীর সংখ্যা বিপুল। স্বাধীনতার শর্তে বাঙালিকে বারবার পঙ্গু করার শপথ যে নিয়েছিলেন দেশনেতারা। হয়তো নেতারাও তখন ছিলেন অসহায়। সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো মানসিকতা ছিল না, মনে ছিল অনেক সমীকরণের অঙ্ক। তাই, সাহেবদের কথায় দেশভাগের লাইন কেটেছেন, গণভোটের প্রহসন করেছেন। হয়তো সময়ের চাহিদা ওরকমই ছিল নেতাহীন বাঙালির ভাগ্যে। তাই পূর্বপুরুষের ঘাড়ে দায় চাপিয়ে ছিন্ন মূলমন্ত্রকে প্রবোধ দেয় উত্তরপুরুষ। সরল সমাধানে শান্তি খোঁজে।

 সমাধান এত সরল ছিল না। সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের অতলে যাওয়া বাঙালি দেশ নেতার অগম্য ছিল। এমনকি অসমিয়া বা দিল্লিবাসী নায়কদেরও। তাই দোষ কারো নয় বলে অদৃষ্টের পরিহাস ধরে নিয়ে, কালস্রোতে নির্বাসিতা বরাকভূমিকে বাঙালির এক মাতৃভুবন হিসেবে গড়ে তোলার শপথ এই প্রান্তিক বাঙালিকেই নিতে হচ্ছে।

 অদৃষ্ট যে নয়, নইলে কেন, সিলেট জেলার একটি মহকুমা আর সাবেক কাছাড় জেলা নিয়ে একদা সংখ্যা গরিষ্ঠজনেরা নতুন সমীকরণে সংখ্যালঘু ভূখণ্ডের আবাসিক থেকে গেলেন আসাম প্রদেশের উপনিবেশ হয়ে।

 সংখ্যালঘুদের পদানত করার কথা গণতন্ত্রের সনদে না থাকলেও, বাস্তবের চাতুর্যে ঘটে। বাংলাভাষী ভূখণ্ডকে অসমিয়াকরণের প্রক্রিয়া চলছে। ভাষা বিল যেমন গৃহীত হয়েছিল সংখ্যাগরিষ্ঠের জোরে প্রায় দুই শতাধিক অন-অসমিয়া ভাষাগোষ্ঠী এবং বিশেষ করে বাংলা ভাষাকে উপেক্ষা করে। তাই বরাক উপত্যকার আপামর মানুষ গর্জে উঠে জানিয়েছিল, জান দেব জবান দেব না।

 উচ্চ বিদ্যালয় শিক্ষার পরীক্ষা ম্যাট্রিক শেষ হয়েছে আঠারোই মে। উনিশ তারিখ ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই স্বেচ্ছাসেবকের দল সরকারি অফিস-কাছারি, রেলস্টেশনে জমায়েত হয়েছে সংগ্রাম পরিষদের নির্দেশে। শান্তিপূর্ণ হরতাল পালনের জন্য। মুখের ভাষায় কথা বলা, পড়াশুনা, সরকারি কাজ করার অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে।

 নবীন গণতন্ত্রে তখন কিন্তু সুখেই ছিল দ্বিশতাধিক ভাষাগোষ্ঠীর জনপদ। কেউ একনায়ক হতে চাইল বলে, একভাষিক হতে চাইল বলে আসাম শুধু অসমিয়াভাষীর বলে আস্ফালন করল বলে বরাক উপত্যকার মানুষ একজোট হয়ে সংগ্রামে সামিল হল। বরাক উপত্যকার বদরপুর থেকে নির্বাচিত আসামের মুখ্যমন্ত্রী বিমলাপ্রসাদ চালিহা নির্বাচন ক্ষেত্রকে উপেক্ষা করলেন। বিশ্বাসঘাতকতা করলেন। বরাক উপত্যকার বিধায়কদের আপত্তি উপেক্ষা করে ভাষা বিল পাশ করিয়ে নিলেন।

 আলাপ-আলোচনায় যখন কাজ হল না, তখন অহিংস সংগ্রামকে হাতিয়ার করলেন বরাকবাসী এবং পরিকল্পিতভাবেই বিনা প্ররোচনায় রহস্যজনকভাবে একটি গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়। উনিশে মে-র দ্বিপ্রহরে সত্যাগ্রহীদের উপর লাঠি ও কাঁদানে গ্যাস ছোঁড়া হয়। গুলিবর্ষণে এগারোটি তাজা প্রাণ চলে যায়। অসংখ্য আহতও হন।

 কুম্ভীরাশ্রু নিয়ে আসা আসামের মন্ত্রীদের ফিরিয়ে দেওয়া হয় সদরঘাটের ও-পার থেকে। এলেন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী। শাস্ত্রী ফর্মুলা মেনে ছেলে-ভুলানো মোয়া দেখিয়ে আন্দোলন থামিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হল। মানুষ মানল না, বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষা স্বীকৃত হল।

 কিন্তু সংখ্যাগুরু আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে ভাষা আগ্রাসন চলছে এখনও। পাঠ্যপুস্তকে, বিজ্ঞাপনে অসমিয়াকরণ প্রক্রিয়া চলছে।

 প্রতিরোধ প্রক্রিয়াও চলছে। ভাষা শহিদের রক্তে তাই বারবার সিক্ত হচ্ছে পুণ্যভূমি। ১৯৭২-এ বাচ্চু চক্রবর্তী আর ১৯৮৬-তে জিসু-জগনকে শহিদ হতে হয়েছে।

 ১৯৬১-র উনিশে মে-র গুলিচালনায় একাদশ শহিদের মৃত্যুবরণ এবং অসংখ্য আহতদের দুর্দশার কারণ অনুসন্ধানকারী তদন্ত কমিশনের রায় এখনও প্রকাশিত হয়নি পঞ্চাশ বছর হয়ে গেলেও। সেদিনের কিশোর গণতন্ত্র তো এখন চৌষট্টি বছরের প্রৌঢ়। ভারতবর্ষে বাংলা ও বাঙালি এখন উপেক্ষিত। দক্ষিণ ভারতে দক্ষিণী ভাষা ছাড়া অন্য ভাষায় লেখা হয় না সাইনবোর্ড কিংবা বাসের গন্তব্য। সাহিত্য অ্যাকাডেমির সভাপতি দোকানে দোকানে ঘুরেও বাংলায় লেখাতে পারেননি পশ্চিমবাংলার রাজধানী শহরের কোনো সাইনবোর্ড। কেন পারলেন না। এই কেন প্রশ্নের ওপারে নিশ্চয়ই আছে বাংলা ও বাঙালির দুর্দশাকামী কোনো শত্রু। চিহ্নিত করার সময় কি এখনও আসেনি। ‘পানিত ছেদ মারলে হাঁটুত পড়ে’, বাঙালির শত্রু তো আর বাইরের কেউ নয়। নিজের ক্ষতি নিজে না করলে, কার সে ক্ষমতা করে দেশভাগ, করে টুকরো টুকরো। যা হয়েছে তা নিয়ে ভাবতে বসলে ভূগোল পাল্টাবে না। জুড়ে যাবে না আবার। মনের ভূগোল পাল্টাতে তাই বার বার কামনা করা যায়, পুণ্য হোক, পুণ্য হোক এবং এক হোক বাঙালির মন।

 সব শেষে যে কথা বলার, বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার অর্থ কিন্তু অন্য ভাষার বৈরিতা নয়। সমৃদ্ধ অসমিয়ার মতো প্রতিবেশি পেয়ে বাংলাও চায় আরও বিকশিত হয়ে উঠতে। চায় ছোটো ছোটো ভাষাগোষ্ঠীর শ্রীবৃদ্ধি, যেন কেউ হারিয়ে না—যায় অনাদরে। বরাক উপত্যকার বহুভাষিক চরিত্রকে একবৃত্তে গেঁথে রাখার দায়িত্বও প্রধান ভাষা বাংলার। কারণ ১৯শে মে-র সংগ্রাম শুধু বাঙালির ছিল না। বাংলাভাষাকে ঘিরে আমাদের সবার সংগ্রাম ছিল। তাই সকল ভাষার অগ্রগতির মধ্যেই নিহিত আছে আবহমান বাংলা তথা অখণ্ড বাংলাভাষার চেতনা।

আরম্ভ মে ২০১২