উনিশে মে: ভাষার সংকট/ধ্রুবপদ উনিশ/উনিশে মে: বাঙালি-চেতনার নবোন্মেষ

উনিশে মে: বাঙালি চেতনার নবোন্মেষ

এখন আজাদির কথা বললে দেশদ্রোহী হয়, তিহাড়ের খোঁয়াড়ে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়, আত্মহত্যার প্ররোচনায় মেরে ফেলা হয় কৃতি ছাত্রকে। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদকে তার স্বগৃহে হত্যা করা হয়। এদের অপরাধ একটাই, ‘এরা চেয়েছে ওদের ব্যক্তিত্বের পূর্ণ প্রকাশোপযোগী আজাদি’। কী আশ্চর্য পরিহাসের বিষয় যে ওদের চাওয়ার কথায় মৌলিকতা কোথাও কিছু নেই যে ভয় ধরিয়ে দেবে শাসকের মনে বরং নাগরিকের মৌলিক অধিকারের কথাই ওরা বলেছে, স্বতোৎসারে উচ্চারিত হয়েছে যৌথভাবে। ভারত ঐতিহ্যের এক কাব্যগ্রন্থের পঙক্তি কথাও হয়তো উচ্চারিত হয়েছিল তাদের সমবায়ী বক্তব্যে, তারা বলেছে মানুষের নিত্য কর্মাচরণের অধিকারে গ্লানি ধরা পড়লেই আমাদের অভ্যুত্থান, আমাদের লড়াই স্বাধীনতার স্বপক্ষে। তারা চেয়েছে শিকল ভাঙ্গতে, মহামতি রুশোর কথা মিথ্যা প্রমাণিত করতে, 'মানুষ স্বাধীন হয়ে জন্মায় কিন্তু সর্বত্রই সে শৃঙ্খলিত'। শেকল ভাঙার গান ওদের সহ্য হয় নি। এখন এক ধূসর সময়ে আমাদের বাস, মানুষের মৌলিক অধিকার হরণ হচ্ছে রাজ্যে রাজ্যে কেন্দ্রে বরাক উপত্যকায় তথা আসাম রাজ্যেও।

 নমামি ব্রহ্মপুত্র না বললে এখন আসামের বাঙালিকে ভেসে বেড়াতে হয় রাষ্ট্রহীন ১৮৭৬ এর প্রথম বঙ্গভঙ্গ যে বাঙালি জনগোষ্ঠীকে বাংলার রাষ্ট্রসীমা থেকে নির্বাস দেওয়া হয়েছিল, সেই বাঙালির বৃহদংশকে এখন খাদের কিনারায় দাঁড় করিয়ে রেখেছে এক পরাক্রমী রাষ্ট্রশক্তি তার প্রশাসন এবং বিচারব্যবস্থার ভয় দেখানো সঙ্গিন উঁচিয়ে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলকে বাঙালি-শূন্য করার চক্রান্ত শুরু হয়েছে যেদিন থেকে বেঙ্গল রেসিডেন্সি থেকে ছিন্ন করে নবার্জিত আসামের সঙ্গে যুক্ত করা হয় সিলেট কাছাড় গোয়ালপাড়াকে। স্বাধীনতার গন্ধ পেয়ে অসমিয়া উগ্রজাতীয়তাবাদ আবার আগ্রাসী হয়ে ওঠে, নইলে কেন তৎকালীন আসামের প্রধানমন্ত্রী গোপীনাথ বরদলৈর গোঁসা হয়। কেন তিনি সিলেট রেফারেণ্ডামের সপক্ষে চক্রান্ত করেন, কারণ বাঙালি নাকি গৌহাটি হাইকোর্ট ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার প্রতিবন্ধক হয়েছিল, নাকি জিন্নার চোখ থেকে গোটা আসামকে পাকিস্তান হওয়ার হাত থেকে বাঁচাতে পণ্ডিতের অর্দ্ধত্যাগ। এখন সংকটের সময় ওসব প্রশ্ন উঠেছে নতুন করে প্রফুল্ল-ভৃগু-সমুজ্জ্বলের গোঁসা ধরিয়ে দেওয়ার জন্য। নাকি আর এক শিশুনায়ক রাজীব গান্ধির পাকা ধানে কোনো বাঙালি ম‍ই দিয়েছিল বলে, শোনা যায় তখন এক বাঙালি প্রধানমন্ত্রী হতে চেয়েছিলেন। এসব আষাঢ় মাসের গল্পের সঙ্গে আর এক বিভ্রান্তির অপপ্রচার বাঙালি নাকি আসামকে অসম বা অহম বলে না। কেন বলে না, কলকাতার কাগজপত্র তো বলে, নইলে ব্যবসা বন্ধ, পিছিয়ে পড়তে হয়। এদেশের নাম যদি ফিলাডেলফিয়া কিংবা ফরাশি রিভিয়েরা হয় তাতেই বা কী আসে যায় নির্যাতিত বাঙালির। আসামে 'এনআরসি'র নামে বাঙালি বিতাড়নের প্রহসন তো বন্ধ হয় না। ভারতের কোন রাজ্যে রাষ্ট্রীয় নাগরিকপঞ্জি বা ন্যাশনেল রেজিস্টার অফ সিটিজেন্স এর নামে স্বদেশবাসীকেই হেনস্তা করা হয়েছে। আসলে এসব দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেওয়ার জন্য, ডিটেনশন ক্যাম্প ভরিয়ে দেওয়ার জন্য, লিগ্যাসি ডাটা খুঁজে না পেয়ে আত্মহত্যার সংখ্যা বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য, ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালিকে ভয় দেখিয়ে কোলে টানার প্রক্রিয়া। হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুত্ব যেমন এক প্রক্রিয়া তেমনি অসমিয়াত্বও। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশ এর বাঙালিরা যেমন উত্তর-পূর্বের বাঙালির কথায় বিশেষ শ্বাসাঘাত প্রবণতার জন্য তাকে অসমিয়া বলে থাকেন, তেমনি অসমিয়াদেরও বিশ্বাস ও অপপ্রচার যে উত্তর-পূর্বের বাঙালিরা মূলত অসমিয়া, তাই ফিরে এসো। নাম লেখাও অসমিয়ায়, সাত খুন মাপের একটা নবচক্রান্তের ধুয়ো তুলেছে নেতা মন্ত্রীরা। তাই বরাক উপত্যকার বাঙালি প্রধান এলাকায় শুরু হচ্ছে অসমিয়া গান আর সত্রীয়া নাচের উৎসব। হচ্ছে ব্যাণ্ড উৎসব। কলকাতার নামীদামী শিল্পীরা গিয়ে দামি টিকিটের বিনিময়ে করে এলেন উনিশে মে উৎসবও। একুশে ফেব্রুয়ারি কিন্তু কোনো আনন্দ উৎসবের রূপ নেয় না বাংলাদেশে, শহিদ দিবসে কিসের উৎসব। এসব কী হচ্ছে তবে, না'বরাক উপত্যকা তথা উত্তরপূর্বের বাঙালি জানে এসব চক্রান্তের শিকড় কোন জাতীয়তার উগ্রভূমি থেকে উত্থিত। এসব আসলে দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা।

 এমতাবস্থায় বেশি কথা বলার সময় নেই উত্তর-পূর্বের বাঙালির। বিকল্পও কম। অসমিয়া হয়ে যাওয়ার টোপটাও তো মুখের কথা, একদিনে হওয়া সম্ভব নয়, এ তো আর ধর্মান্তরণ নয়। ব্রহ্মপুত্রের চর অঞ্চলের বাঙালি মুসলমান ভিটেমাটি বাঁচাতে গ্রাসাচ্ছাদনের লোভে নিজেদের অসমিয়া লিখিয়ে হয়েছিল নতুন অসমিয়া। তারাই একসময় আক্রমণের মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়, বাঙালি ভোলেনি নেলির গণহত্যা। এছাড়া দ্বিতীয় উপায় আছে স্বেচ্ছায় আসাম ছেড়ে যাওয়া, উত্তরপূর্ব থেকে নির্বাসিত হওয়া, কিন্তু কোথায় যাওয়া। আর তৃতীয়, মৃত্যু বেছে নেওয়া রাষ্ট্রীয় খোঁয়াড়ে, যার নাম ডিটেনশন ক্যাম্প। ইহুদিদের যেমন ছিল নাজি জমানায় ইউরোপ জুড়ে। আর খাদের কিনারায় দাঁড়িয়ে শেষ উপায় প্রতিরোধ। শ্রদ্ধেয় আহমেদ শরীফ বাংলাদেশের হিন্দুদের ভিটে ছেড়ে না যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছিলেন একসময়, পড়ে পড়ে মার না খাওয়ার কথা বলেছিলেন। তিনি তাঁর অভিজ্ঞতার কথা বলেছিলেন গল্পচ্ছলে। কলকাতার বাগবাজারে বন্ধুর বাড়িতে নৈশাহার সেরে ফিরতে একটু রাত হয়ে যায়। ট্যাক্সিওলা এত রাতে রাজাবাজার যেতে রাজি নয়। তিনি বললেন সংখ্যালঘুর প্রতিরোধ এরকমও হয়। তাহলে কী করা, রাষ্ট্রশক্তি যখন তার সমুদয় স্তম্ভ উপড়ে নিয়ে এসে আঘাত করতে চাইছে তখন আর কেন আইন মান্য করা। জাতির পিতাও তো অমান্যের বিধান দিয়েছেন। তাহলে কেন লিগ্যাসি ডাটার পিছনে ছোটা, পিতামহ মাতামহ উর্দ্ধতন পুরুষ নারী কখন আসাম দেশে ছিলেন তার নথিপত্রের নাম উত্তরাধিকার তথ্য বা লিগ্যাসি ডাটা। বংশ বৃক্ষ সাজিয়ে দিতে হবে তবে মানবে দেশবাসী। এত সহজে নিশ্চিত হওয়া যায় না, ছল যেখানে অস্ত্র, নবীন ছল পুরনো দুরভিসন্ধি সরিয়ে প্রকট হবেই হবে, বলবে তোর ঠাকুরদাদা জল ঘোলা... ইত্যাদি। তপোধীর ভট্টাচার্য এখন আর জল ঘোলা করার পুরনো উপমায় বিশ্বাসী নন, তিনি বলেন,

 ‘হিটলারের প্রেতাত্মা ভর করেছে রাষ্ট্রীয় শাসকবর্গের উপর, তারা আজ অন্ধ সেজে বসে আছে, যেন অন্ধতার মড়ক লেগেছে সর্বত্র। নাগাল্যাণ্ডে মাত্র কিছুদিন আগে উন্মত্ত নাগা জনতা একজন বাঙালি মুসলমান কে জেলখানা থেকে বের করে প্রকাশ্য দিবালোকে পৈশাচিক ভাবে হত্যা করেছে...’

 ‘উত্তর-পূর্বের প্রতিটি রাজ্যেই এখন এরকম ঘটতে থাকবে। এদের পথ প্রদর্শক তো অসমিয়া আগ্রাসনবাদ যারা গণতন্ত্রকে প্রহসনে রূপান্তরিত করে দেশের সর্বোচ্চ আদালতেও শস্যের মধ্যেও ভূত ঢুকিয়ে দিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে এবং ভারতের অন্যত্র কজন বুদ্ধিজীবী জানেন যে আসামের পুলিশও গেস্টাপো বাহিনীর মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছে অসহায় বাঙালিদের উপর। আসামের মুখ্যমন্ত্রী সহ প্রভাবশালী মন্ত্রীরা চোরকে বলেছেন চুরি করো আর গৃহস্থকে বলেছেন সজাগ থাকো। এবং এরাই হিটলারের কুখ্যাততম ‘অউশহ্বিৎস’ বা মৃত্যু শিবিরের অনুকরণে নানা জায়গায় বন্দি-শিবির গড়ে তুলেছেন যেখানে ১০২ বছরের বৃদ্ধ, পাঁচদিনের নবজাত শিশু সহ তরুণী মা এবং সব ধরণের বৈধ নথিপত্র থাকা সত্ত্বেও হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে অসহায়, মানুষদের ঠেলে দেওয়া হচ্ছে পশুর খোঁয়াড়ের ভিতর। রোম যখন পুড়ছিল, সম্রাট নিরো নাকি বেহালা বাজাচ্ছিলেন। আর আমাদের প্রাজ্ঞ বুদ্ধিজীবী বহু পুরস্কারে ধন্য লেখক কবিরা এই সময়ে কী করছেন। ওইসব 'ডিটেশন ক্যাম্প' ডাউটফুল ভোটার (ডি-ভোটার) তকমা দিয়ে যেসব বাঙালিকে কুখ্যাত অপরাধীর সঙ্গে খোঁয়াড়ে ঢুকিয়ে দিয়েছে এরা কি 'অউশহ্বিৎস' এর নব্য ইহুদি নয়। এই ভারতবর্ষের জন্যই কি ক্ষুদিরাম বসু মাতঙ্গিনী হাজরা সহ হাজার হাজার বাঙালি আত্মত্যাগ করেছিলেন। বুদ্ধিজীবীরা কি 'আরণ্যক' এর ভানুমতীর মতো ‘ভারতবর্ষ কোনো দিকে’?—এই প্রশ্ন না তুলে কবি শান্তনু ঘোষের ভাষায় বলবেন ‘তুমি ক্রেডেলে রেখোনা হাত, পাশ ফিরে শোও’।

 পাশ ফিরে শোয়ার সময় এখন নয়। বুদ্ধিজীবীদের বের করে আনতে হবে অতিবুদ্ধির বৃত্ত থেকে। কারণ ইহুদিকেও এখন কেউ ইহুদি বলে না। ওদেরও রাষ্ট্র আছে। অ্যাক্সোডাস থেকে অমিয়ভূষণ, আমরা শুনেছি প্রব্রজনের গল্প। উত্তর-পূর্বের বাঙালিও পাবে তার রাষ্ট্র এই ভারতে। দলিত বাঙালি বলে কেউ কেউ খণ্ড করছেন বাঙালির, আর কত খণ্ড হবে বাঙালির। এক এক টুকরো বাঙালি আছে কর্ণাটকে মহারাষ্ট্রে দণ্ডকবনে ঝাড়খণ্ডে বিহারে, ওরা প্রতিস্থাপিত হয়েছেন নেহেরু স্যারের সৌজন্যে, বাংলা নায়কদেরই বা বাদ দেব কেন। ওরা পারতেন না একখণ্ড ভূমিতে স্থাপিত করতে তাঁদের পাপে বিতাড়িত বাঙালিকে। যারা আন্দামান টান্দামানে গেলেন তাঁদের সবাইকে কি নাগরিকত্ব দেওয়া হয়েছে সম্মানের। হয়নি, থাকতে দেওয়া হয়েছে শুধু। হলোকাস্টের জন্য বাঙালিকে কাঁঠাল পাতা খাইয়ে রেখে দেওয়া হয়েছে। আর এখন ভান হচ্ছে যেন ঘুম ভেঙেছে, নবীন এই ধর্মীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থার উলঙ্গ রাজা বেহালা বাজাচ্ছেন অ্যারোপ্লেনে আর বাঙালির দহনকাণ্ডের নীল নক্সা সাজাচ্ছেন। তাই বরাক উপত্যকার বাঙালির, উত্তর-পূর্বের বাঙালির অন্য অপশন নেই, তাকে জোট বাঁধতেই হবে। গোমাংসের রাজনীতি যেমন বর্জন করেছে উত্তর-পূর্বদেশ তেমনি এনআরসি প্রহসনকেও প্রতিরোধ করবে বাঙালির যৌথ নেতৃত্ব। আর প্রতিরোধের জন্যও চাই স্বপ্নসঞ্চয়, বাংলার বাউলের গানকে সম্পদ করেই এগোতে হবে। আগের সুন্দর দিন ফিরিয়ে আনতে হবে।

 সেদিন ফেসবুকে একজন প্রশ্ন করলেন বাংলায় কোন গ্রন্থের আদিপর্ব আছে পরের পর্বগুলি নেই। উত্তর সবার জানা, নীহাররঞ্জন রায় এর বাঙালির ইতিহাস আদিপর্ব। আদি আছে, মধ্য নেই, উত্তরপর্ব রচনার বাসনা তো তাঁর কোনোকালেই ছিল না, স্বীকার করেছেন নীহাররঞ্জন। মধ্যপর্ব লেখাটা কি এতই সহজ, তিনি যতই স্পষ্ট ভাষায় বলুন ভাষাজ্ঞানের অক্ষমতাই কারণ। ফারসি পর্তুগীজ ওলন্দাজ জানা দরকার, ইংরেজি না হয় বাঙালির দ্বিতীয় ভাষা। কারণ এইসব বিচিত্র ভাষার দূরদেশী অভিযাত্রীদের বাংলায় অনুপ্রবেশ ঘটেছে মধ্যপর্বে। আর ওই পর্বেই বাংলার মুখের ভাষা পাল্টে পাল্টে গেছে, খাদ্যাভাস পাল্টেছে, আন্দিজ পর্বতের আলু পেঁয়াজ এসেছে, ওই সময় কিছু ডালও এসেছে বাঙালির রান্নাঘরে, নইলে মুসুরি কেন আমিষ হয়। ইউরোপীয়রা সাগর নদী শাসন করতে জানত। আরবরা আর আধা আরব ফারসিরা স্থল নৌকো দুটোতেই পটু। ইসলামের ধর্মীয় ভাষা যদি হয় আরবি, জ্ঞানের ভাষা ছিল ফারসি। সেই আদিকালে আলেকজাণ্ডার ছাড়া রণধারাবাহী সবাই ফারসি সাম্রাজ্যের কোনো না কোনো তালুক থেকে এসেছে। মোগলরাও তাই। স্বাভাবিক কারণেই মুসলমানরা নিয়ে আসে ফারসির সমৃদ্ধ ভাষা। বনিক প্রযুক্তিবিদ ও চিকিৎসক ওলন্দাজ পর্তুগীজ ও ইংরেজের মুখের ভাষাও ফারসির সঙ্গে বাঙালির মুখের ভাষায় মিশে যায়। শুধু লুণ্ঠন-পারগ ছিল না ওইসব অতিথিরা। বাঙালি জীবনে, বাংলার সমাজেও এক নবনির্মাণের কাণ্ডারি হয় ওরা। মুসলমান লুণ্ঠনের সঙ্গে ধর্মপ্রচারকেও প্রাধান্য দেয়, বিশেষ করে আকবর পরবর্তী মুঘল সম্রাটরা। ঔরঙ্গজেব এর আমলে তা হিংস্র রূপ নেয়। ইউরোপীয়রা এত সংগঠিত ভাবে আসে নি, ওরা মূলত বণিক ও জলদস্যু। ব্যবসা এবং ছোটোখাটো লুণ্ঠন নিয়েই সন্তুষ্ট ছিল। সংযত ছিল প্রাথমিক পর্যায়ে। অস্তমিত প্রায় মুসলমান গৌরবকে হাতিয়ার করে ওরা কৌশলে ক্ষমতালোভী হয়। ধর্মপ্রচার বিষয়ে রাষ্ট্রক্ষমতার অংশীদার হয় বা দখল নেয়। তখন ধর্মতন্ত্রও পরিকল্পিত ভাবে ডানা মেলে বিশেষত দুর্গম আদিবাসি অঞ্চলে। এদিকে বাংলার কাবুলি নরপতি শেরশাহ সুরি থেকে সিরাজউদৌলা পর্যন্ত ইসলাম প্রচার অব্যাহত রয়েছে। ইউরোপীয় শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনে আপাতদৃষ্টে এক স্থিতাবস্তার অবসান হয়। নীহাররঞ্জনবাবু আদিপর্বের পর এই সময়কালকে অন্ধকারে রেখে দিলেন কি অবিতর্কিত থাকতে। নাকি তাঁর জবানি মতো বয়সের ভারে লেখা হয়ে ওঠে নি। ভাষাশিক্ষার দোহাইও দিয়েছেন। ডাচ পর্তুগীজ ফার্সির মধ্যে একটা দুটো জানা না থাকায় পরিহার করলেন বাঙালির আত্মনির্মাণের ভিত্তিভূমি। আদিপর্বে তো কৌমতন্ত্র থেকে বৌদ্ধ এবং কর্ণাটকি সেন রাজবংশের হিন্দুতান্ত্রিক সমাজে হিন্দু ও বৌদ্ধ প্রাধান্যের লড়াই ছিল। শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ও বাঙালি সমাজের আদিপর্বের এক কালখণ্ড নিয়ে তাঁর মতো সাজালেন বাংলার সামাজিক ও রাজনৈতিক ইতিহাস। এত জটিলতা ছিল না সমাজ জীবনে তাই বর্তমান বাঙালি সমাজের সঙ্গে কোনো যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া যায় না। তুঙ্গভদ্রার তীরে আর গৌড়মল্লার নাম পাল্টে একই ইতিহাসের এপিঠ ওপিঠ ভাবা যেতেই পারে। আসলে ইতিহাসের না বলা, না সাজানো পর্বকে লুণ্ঠনের কাল ধরে নেওয়া থেকেই হয়তো আদিপর্বের হিন্দু সমাজে বিধর্মী শাসকের প্রতি এক বিজাতীয় ক্রোধের জন্ম। ইতিহাসের স্বাভাবিক বিবর্তন পথ জানা থাকলে এই বিদ্বেষ থাকত না। মনে হত ওরাও তো এ ধরণীর আত্মীয় বন্ধু স্বদেশবাসী। ধর্মীয় গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে এত কলহ থাকত না। অনির্মিত সামাজিক ইতিহাস গঠনে শুধু বাংলা নয় গোটা ভারতভূমিরই প্রচণ্ড অনীহা। যা কিছু তৈরি হয়েছে তাতে সবাই নিজের ধর্মগোষ্ঠীর কোলে ঝোল টেনেছে। ব্যতিক্রমী থাপার হাবিব সরকারদের এখন পড়তেই দেওয়া হয় না। অধুনা লিখিত বাংলাদেশের অধিকাংশ ইতিহাস বইতে হিন্দু প্রাধান্য খর্ব করা হয়েছে, যেমন হচ্ছে ভারতবর্ষে উল্টোটা। কে বলবে তাহলে মধ্যপর্বের কথা, সঠিক মূল্যায়ন করবে বাঙালির হয়ে ওঠার সময়কাল। নানান রঙের ফুল দিয়ে সাজানো ড্রইং রুমের বাহারি ফুলদানিটা দেখার চোখ কবে মেলবে। আক্ষেপ করার সময় নেই বাঙালির। সবার পরশে পবিত্র করা তীর্থনীরে মঙ্গলঘট ভরে রেখেছেন কবেই বাঙালির কবি। বাজিতপুরের জমিদার হলেও প্রকট কোনো বৈষম্য তখন দৃশ্যমান ছিল না তাঁর জমিদারির গ্রামে। কৃষক শ্রমিক কিংবা মেধাশ্রমিক যে যার মতো সৌহার্দ্যে বসবাস করেছে। হ্যাঁ রাজনীতির অধুনা গণতান্ত্রিক পদ্ধতি হয়তো ছিল না কিন্তু সুখ ছিল, বর্তমান গণতন্ত্রের নামে নিষ্পেষণ ছিল না। ধর্ম-কর্ম ছিল নিজের মতো, সে নিয়ে মাথা ব্যথা ছিল না হিন্দুতে মুসলমানে। একজাতি একপ্রাণ ছিল বাঙালি। বাঙালির মুখের ভাষাও তখন এক। জলপানি বিভেদ খুব ছিল না সিলেটে, সিলেটের গ্রামের প্রতিবেশি হিন্দুরাও পানিই বলত। বিশ্বযুদ্ধ শেষ হতেই যখন দর কষাকষির দুয়ার খুলল তখনই ঘোলাজলে মাছ ধরার জন্য পশ্চিম ভারত থেকে দ্বিজাতিতত্ত্বের রোপিত বীজের বিষবৃক্ষ দেশ আলাদা করে দিল ধর্মীয় বাঙালির। পশ্চিমা প্রলোভনে নেতৃত্বহীন বাঙালিকে মেনে নিতে হল বিদেশি ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে। তখন পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন ধর্মপ্রাণ ভাষাবিদ ডঃ মুহম্মদ শহিদুল্লাহ, তাঁর বিখ্যাত উক্তি—'আমরা হিন্দু এবং মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বড় সত্য আমরা বাঙালি'। হয়তো এই মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়েই শুরু হয়েছিল বাহান্নর ভাষা আন্দোলন, হয়েছিল একুশে ফেব্রুয়ারি ধর্মদেশে। যার ফলশ্রুতিতে হয় মুক্তিযুদ্ধ এবং ধর্মদেশ-এর বন্ধন ছিঁড়ে ভাষাদেশ হয় বাংলা। কাঁটাতারের বেড়ার কাঁটা দুই বাঙালিকে জখম করে কালক্রমে। ওপার বাংলায় স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ভাষার বিবর্তন হয়। ভাষা তো সামাজিক মত বিনিময়ের মাধ্যম। তাই ওপারে যখন আরব দেশের ধর্মমানুষ বাঙালি নব্বই শতাংশ তখন ধর্মীয় ভাষাই জীবনকে জড়িয়ে নেয়। এখন ওপারের বাঙালি নাস্তা করে গোসল করে দাওয়াত দেয় সুক্রিয়া বলে। ওপারে ধুতি পরা বারণ। পায়জামা যে জাতীয় পরিধান, এপারেও কি কেউ আর ধুতি পরে, পূজোর সময় পুরোহিত প্ল্যাস্টিকের ক্যারিব্যাগ এ নিয়ে যায়, পুজো শেষে আবার ক্যারি সাইকেলের হ্যাণ্ডেলে। এখন কেন্দ্রে রাজ্যে ধর্মীয় সরকারের প্ররোচনায় হয়তো নতুন বিভাজনের প্রক্রিয়া শুরু হবে, আবার ভাঙন, ব্রেক্সিটের পর এখন তো সবাই গণভোটের জিগির তুলতেই পারে। গণতন্ত্র মানেই কি শুধু ভাঙন তবে। তা কেন, তাহলে তো কবেই পৃথক বরাক উপত্যকা রাজ্য হয়ে যায়।

 নীহাররঞ্জন লেখেননি বলে যে বাঙালির ইতিহাস মধ্যপর্ব ধারণ করেনি তাও তো নয়। বিবর্তনের প্রক্রিয়া ছিল বলেই বাঙালি এখন এই পর্যায়ে, ঈশ্বরচন্দ্রের বাংলা বঙ্কিমের বাংলা মধুসুদনের বাংলা মীর মশারফের বাংলা কায়কোবাদ এর বাংলা থেকে আলালের বাংলা হাসন রাজার বাংলা থেকে ‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম' এর শাহ আব্দুল করিমের বাংলা তো বিবর্তনেরই ফসল। এর মধ্যে কিছু বিভ্রান্ত বাংলাও আছে। যেমন সিলেটি বাঙালির একাংশ বলছে তারা আলাদা জাতি, কারণ তাদের নিজস্ব লিপি আছে, সিলেটি নাগরি। সাতশ বছর আগে ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা হিন্দু দেবতা ব্রহ্মার মুখনিঃসৃত ব্রাহ্মীলিপিতে ধর্মীয় সাহিত্য রচনায় অস্বীকৃত হওয়ায় আরবি ফারসি ও সিলেটি বাংলার মিশ্রণে এক বিভাজনের লিপি এবং সাধনার লিপির সৃষ্টি করেন ধর্মীয় পদকর্তাদের পদরচনার মাধ্যমে। এর মধ্যে কয়েকজন মাত্র অসাধারণ সাহিত্য গুণান্বিত গীতরচনা করেছেন সিলেটিতে। বেশির ভাগই সিলেটি বাংলা থেকে আরবি ফার্সির প্রাধান্য। ধর্মজ্ঞানী ছাড়া বাকি বাঙালির কাছে দুর্বোধ্য। আত্মনির্মাণের ভিত্তিভূমি কেউ তৈরি করে রাখলেন না মধ্যপর্বের তাই আমরা যে যেমন পারছি, ইতিহাস বানাচ্ছি, মজার ব্যাপার খোদ সিলেটে নাগরি লিপি নিয়ে তেমন উচ্চবাচ্য নেই, বিলেত আমেরিকায় হচ্ছে। আসলে সামাজিক ইতিহাসের শূন্যস্থানে এক মাৎস্যন্যায় চলছে, বহুজনের মানে সংখ্যাগুরুর ন্যায়ে গড়ে উঠেছে ইতিহাস, সত্য গেছে নির্বাসনে। বাঙালি জীবনের মিসিং লিঙ্কটা অধরাও নয়, কিন্তু কেউ তাকে সাজানোর চেষ্টাই করলেন না, বললেন বাঙালি আত্মবিস্মৃত জাতি। সাজালে যদি কোনো পক্ষের কোলে ঝোল বেশি পড়ে, গেল গেল হলেই লঙ্কাকাণ্ড কারবালার যুদ্ধ। সমাজকে বিভাজিত করার পুরনো খেলা খেলতে দেওয়া হোক, লুটেপুটে খাক। ইদানীং আবার সোশ্যাল মিডিয়ায় অশিক্ষিত জনমতে তৈরি হচ্ছে বাঙালির খিচুড়ি ইতিহাস। সে কেমন কেউ বলতে পারবে না, অন্ধের হস্তীদর্শনে তবু হাতিটা ছিল স্থির। মোদ্দা কথা দিনের শেষে হিন্দু মুসলমানে বিভাজিত হচ্ছে সকল শুভ প্রচেষ্টা। শাসক শ্রেণি জানে কী করে হনুমানের ল্যাজে আগুন দিতে হয়। আসামের এই বিশাল বাঙালি জনগোষ্ঠীকে কী করে সামাল দিতে হয়। মোট জনসংখ্যার ত্রিশ শতাংশ হবে বাঙালি, জনা চল্লিশেক বিধায়ক নির্বাচনে নির্ণায়ক শক্তি। তাও বিধানসভায় বাঙালি বিধায়ক অসমিয়ায় শপথ নেয়। বাঙালি হয় না, আপৎকালেও বাঙালি এক হয় না, হয় সংস্কৃতমূলের হিন্দু বাঙালি নয় আরবিমূলের মুসলমান। এই বাঙালি কিন্তু আসল বাঙালি নয়, এদেরও দুইরূপ। এক জেনে, অন্য না জেনে জো হুজুর। প্রথম জন নগদ বিদায়ে বিশ্বাস করে এরা রাজনীতির কারবারি, আর অন্যপক্ষ বোড়ে বাঙালি, রাজনৈতিক বশ্যতার নজরানা দেয় জো হুজুর বলে। মধ্যবিত্ত আর বুদ্ধিজীবী বাঙালির হিন্দু মুসলমান নিয়ে সমস্যা নেই, বন্ধুত্ব থাকে গলায় গলায়। শুধু স্বার্থান্বেষীদের প্রয়োজনে ধর্মপ্রাণ বাঙালি ব্যবহৃত হয় গোমাংস রাজনীতিতে।

 বাঙালির ইতিহাস কিন্তু অসহিষ্ণুতার কথা বলে না। বাঙালি খুব একটা যুদ্ধ বিগ্রহও জানে না, হেরে ভূত হয়ে যায় শশাঙ্কদেব এর মতো। আদিপর্বের ইতিহাস তো তাই বলে। তাই ইতিহাসের অন্ধকার থেকে এক লাফে আসাম এনআরসি তে পৌঁছে যায় বাঙালি। মাঝখানে দেশভাগ নামক এক আদিপাপের বোঝা টেনে চলেছে খণ্ডিত বাঙালি এই ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে, আসাম রাজ্যে। আশার কথাও যে নেই তাও নয়। রক্তঋণে অর্জিত হল অনেক কিছু বাঙালির, ওপারের বাঙালি যখন পূর্ব পাকিস্তানি তখন হল ভাষা আন্দোলন, হল মুক্তিযুদ্ধ। নবীন রাষ্ট্র তো বেশ ভালই কাটছিল, ‘নওযোয়ান, হিন্দু মুসলমান'। চলতে চলতে থমকে গেল ইসলামি জাতিতত্ত্ব হাতিয়ার করে এক সামরিক শাসক জাতিধর্ম বহির্ভূতদের তাড়াতে শুরু করে। একই কণ্ঠস্বরে পূর্বতন সামরিক শাসকের বিধবাও নিদান হাঁকেন, মুক্তিযুদ্ধের নায়কের কন্যাও একই ফাঁদে পা দিলেন। পঁয়ত্রিশ শতাংশ অমুসলমান বাঙালি কমে কমে এখন আট। এরা কোথায় যায়, কিছু পশ্চিমবঙ্গের উত্তরে। কাঁটাতারে ঘেরা ত্রিপুরা ও আসামের দুই নদী উপত্যকায় কি। এদের কী পরিচয়, বিশ্বরাজনীতিতে শরণার্থীর বিশেষ মর্যাদা থাকে। আসাম দেশে তা নেই, দেশ ভাগের যন্ত্রী নায়কের দৌহিত্র করেন এক উদ্ভট চুক্তি ১৯৮৫ র স্বাধীনতা দিবসে। বলা হয় স্বাধীনতার পরে আসা আসামের সব বাঙালি বিদেশি, যেহেতু নাগরিকপঞ্জী হয় ১৯৫১ তে তাই ওটাই ভিত্তিবর্ষ। তাদের প্রমাণ করতে হবে তারা বিদেশি নয় তাহলেই মিলবে চিট কাগজ, নাগরিকত্বের শংসাপত্র। কোনো কোনো বাঙালি বুদ্ধিজীবী চাপলুসি করে বলেছেন, এসব কোনো চক্রান্ত নয়, ভারতের জাতীয় নাগরিকপঞ্জীও তৈরি হচ্ছে। এটা সর্বভারতীয় পঞ্জি, আসামের নয় শুধু। ১৯৫১ এর পর এবার হচ্ছে, আসাম দিয়ে শুরু। এই জনগণনায় কিছু বিশেষ শর্ত থাকবে নাগরিকত্বের এবং তা তদারকি করবে কেন্দ্রীয় সরকার, আসাম সরকার সর্বোচ্চ আদালত ও একটি ছাত্র সংগঠন। সুপ্রিম কোর্টের দুজন বিচারপতি থাকবেন তত্ত্বাবধায়ক। এর জন্য কত আনুষঙ্গিক কর্মকাণ্ড হল। বিদেশি ট্রাইব্যুনেল হল, সীমান্তে নিয়োজিত হল আসাম পুলিশ। মোতায়েন হল অসমিয়াভাষী পুলিশ, বাঙালি হলে চলবে না। সন্দেহবশে ধরে ধরে রাখা হবে ডিটেনশন ক্যাম্পে, নাৎসি জার্মানির কনসেণ্ট্রেশন ক্যাম্প এর আদলে। বিচারের প্রহসন হচ্ছে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে। করিমগঞ্জ জেলায় তেমন এক আদালত বয়কট করছেন উকিলরা বিচারকের বদলি চেয়ে। তাতেও বিচারের প্রক্রিয়া বন্ধ হয় না বিনা বিচারে, বিতাড়ন প্রক্রিয়া যে বন্ধ করা চলবে না কিছুতেই। সুপ্রিম কোর্টের ব্লা ব্লা ধারায় নির্দিষ্ট সময়ে প্রক্রিয়া শেষ করার বিধান দেওয়া আছে। শেষ করতে হবে এনআরসি, ন্যাশনেল রেজিস্টার অফ সিটিজেন্স তৈরি করতে হবে। এখন প্রশ্ন বাঙালিকে যে বিতাড়ন করা হবে, এরা যাবে কোথায়। প্রতিবেশি রাষ্ট্র কেন নেবে, তাহলে উপায়। উপায় আছে, জেলায় জেলায় তৈরি করা হচ্ছে ডিটেনশন ক্যাম্প। ধুবড়ি জেলায় হয়েছে দেশের সর্ববৃহৎ খোঁয়াড়। মানবাধিকার বলে কিছু থাকবে না যেখানে। সারাজীবন সসম্মানে শিক্ষকতা করে অবসর কাটানো বৃদ্ধ থেকে শ্রমিক কৃষক ও গৃহবধূদের নির্বিচারে পুরে দেওয়া হচ্ছে নির্যাতন শিবিরে।

 পরিতাপ এবং পরিহাসের ব্যাপার হল যেসব আইন প্রণেতারা এই বিতাড়নের আইন রক্ষায় সামিল হয়েছে তারাও কিন্তু এসব তথাকথিত বিদেশি কিংবা সন্দেহ ভোটারদের দ্বারাই নির্বাচিত। এরা রাজ্য মন্ত্রীসভার বাঙালি মন্ত্রী, এ-জমানার ও-জমানারও। এসব বাঙালি কালিদাসের দল নিজের ভোটারের নাম কাটায় উৎসাহী নগদ বিদায়ের লোভে। এখন প্রশ্ন, এই বিশাল সংখ্যক বাঙালি কেন প্রতিরোধে যাচ্ছে না, কাঁকড়াতন্ত্রের নিয়ম মেনে একে অপরকে পিছনে টানছে কেন। সেখানেই কি তবে নিয়মের রাজত্ব। দ্বিজাতিতত্ত্বের বিষময় প্রয়োগ। বরাক উপত্যকায় এই নাড়ির হিসাব চলছে। কামরূপে বাঙালি মুসলমান। নওগাঁ জেলায়ও তাই লামডিং এ ভিন্ন। এবার হোজাই শামিল। গোয়ালপাড়ায় ভিন্ন বাঙালি। ওখানে তো বাঙালি যারা বাড়িতে বাংলায় কথা বলে সামাজিক পরিচয়ে অসমিয়া, খাতায়পত্রেও নতুন অসমিয়া। এত আটঘাট বেঁধেও শেষরক্ষা হয় না। ভাগের কিল খেতেই হয়। এই হল জগার চাল ও ডালে বাঙালি খিচুড়ি। এই বিশাল বাঙালি সমাজ এক হতে পারে না বলে এনআরসি-র সাংবিধানিক শংসাপত্র পেতে এত ছলচাতুরি, আইনের বেআইনি প্যাঁচ।

 রুখে দাঁড়ানোর শক্তি নেই কে বলে, আসামের বাঙালি পরীক্ষা দিয়েছে, বিভাজনের রাজনীতিকে পরাস্ত করেছে বরাক উপত্যকা। ভোটের রাজনীতিতে ধর্মীয় এবং উগ্র জাতীয়তাবাদী শক্তির সাময়িক উত্থানেও আশঙ্কার কিছু নেই। জাতি হিসেবে বাঙালি এতে একজোট হবে। অসমিয়া জাতিও হয়তো দেয়ালের লিখন পড়তে পারবে একসময়, এখন তাদের হীনবল হওয়ার পর্ব। কারণ নিছক ধর্মীয় আবেগ আর বাঙালি বিতাড়নের উগ্রজাতীয়তাবাদী আফিম খাইয়ে একটা জাতিকে বশীভূত রাখা যায় না, যাবে না। পাঁচ বছরের জন্য অ-বাক আসামকে উন্নয়নের মানচিত্রের বাইরে রাখা কোনো কাজের কথা নয়। ইত্যবসরে ছড়িয়ে থাকা বাঙালি ধর্মীয় পরিচয়ের ব্যক্তিগত পরিসরের বাইরে ভাষিক পরিচয়কে প্রধান করে বলীয়ান হয়ে উঠবেই। এবং একজাতি একপ্রাণ হয়ে বাঙালির ইতিহাসের উত্তরপর্বে পৌঁছে যাবে সরাসরি।

 বরাক উপত্যকার বাঙালি আসামের বাঙালি উত্তর-পূর্বের বাঙালির দুর্দশা কথার সাতকাহন শুরু করতে গিয়ে ১৮৭৬ এর প্রথম বঙ্গভঙ্গের উল্লেখ ছিল, ছিল উনিশে মের মহাবিস্ফোরণ এর কথা। সেই তো শুরু, পটভূমি না জানলে উপরোক্ত ব্যথার কথা শূন্যগর্ভ অপাঠ্য মনে হবে। তাই স্বল্প পরিসরে প্রত্যাশার উচ্চাশায় আপাতত প্রাপ্তির ঘরে শূন্য বসিয়ে শুনিয়ে দেওয়া যাক শুরুর কথা। ১৮৭৬ এ শ্রীহট্ট জেলাকে প্রশাসনিক সুবিধার জন্য এবং অর্থনৈতিক ভাবে উদ্বৃত্ত জেলা হিসেবে আসাম প্রদেশের সঙ্গে জুড়ে দেয় বৃটিশ সরকার, বেঙ্গল রেসিডেন্সির ভাগ হয়। হয় প্রথম বঙ্গভঙ্গ। তারপর ১৯৪৭ এর জুলাই মাসে হয় গণভোট এবং ১২ জুলাই তার ফলাফলে সিলেটের পাকিস্তান ভুক্তি নির্ধারিত হয়। এতেও ছিল কারচুপি, ১৯৪৬ এ আসামের প্রধানমন্ত্রী গোপীনাথ বরদলৈ কংগ্রেস হাইকমাণ্ডকে জানিয়ে দেন সিলেট আর কাছাড়ের সমতল ভাগ বাংলার সঙ্গে যুক্ত করে দেওয়ার জন্য, উদ্দেশ্য মহৎ ছিল না কারণ পাকিস্তান প্রবক্তা মহম্মদ আলি জিন্নার মনে যে গোটা আসাম প্রদেশকে পাকিস্তানভুক্ত করার স্বপ্ন। সে খোয়াবকে খণ্ডিত করার প্রয়াসে তার এই সুপারিশ। গণভোটের ফল কিন্তু উল্টো হওয়ারই কথা, কিন্তু আবার চক্রান্ত এবং তৎকালীন সিলেটের তিন লক্ষ আদিবাসী হিন্দু চা শ্রমিককে ভোটদানের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয় এই অজুহাতে যে তারা স্থানীয় অধিবাসী নয়। পাকিস্তানপন্থীরা জিতে যায় ৫৫,৫৭৮ ভোটের ব্যবধানে। তারও আগে ১৯৩৭ এ আসামের জাতীয়তাবাদী নেতারা বলেছিল তারা কংগ্রেসকে অকুণ্ঠ সমর্থন করবে একটি মাত্র শর্তে যদি সিলেট এবং কাছাড় জেলার সমতল ভাগ আসাম থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিতে রাজি থাকে। তখন সেই রাজনৈতিক ও ভাষিক ভূভাগের পরিচিতি ছিল সুরমা উপত্যকা নামে, ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বিপরীতে। কারণ সিলেট বিচ্ছিন্ন না হলে যে বাঙালি জনগোষ্ঠী আসামে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে যায়। সেই শর্ত পালিত হয় গণভোটের সুচতুর চক্রান্তে। এদিকে সিলেটের কয়েকটি মহকুমা কিন্তু পাকিস্তানের বিপক্ষ ভোট দেয়, এবং ১৫ই আগস্ট পর্যন্ত বিভ্রান্তি থাকে কে কোথায় যাবে তাই কিছু কিছু জায়গায় ভারতের জাতীয় পতাকা উত্তোলিত হয়, কোথাও বা পাকিস্তানের। সেই ১৯৩৭ এর শর্তধারী নেতা অম্বিকা গিরি রায়চৌধুরী তখন সীমানা নির্ধারক কমিশনের প্রধান রেডক্লিফকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন এসব চলবে না, সিলেট যাবে হাইলাকান্দিও যাবে পাকিস্তানে, যার অর্থ বাঙালি শূন্য হবে আসাম, আসামের সরকার এবং প্রশাসন। সিলেটহীন স্বাধীন দেশের আসাম রাজ্যের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী গোপীনাথ বরদলৈ ও আসাম সরকারের অধীনে কাজ করতে ইচ্ছুক সিলেটের এক দল কর্মচারীকে সরাসরি জানিয়ে দিলেন, অসম্ভব Assam is for Assamase বাঙালির কোনো স্থান নেই। জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধী মর্মাহত হয়ে মন্তব্য করেছিলেন আসাম যদি শুধু অসমিয়ার তাহলে ভারতবর্ষ কার। সেই লোকপ্রিয় মুখ্যমন্ত্রী ভারতরত্ন হয়েছিলেন স্বাধীন দেশে। আসাম বিধানসভার প্রথম অধিবেশনে আসামের রাজ্যপাল আকবর হায়দারি উদ্বোধনী ভাষণে বলেন 'এখন অসমিয়া ভাষা ও সংস্কৃতি মুক্ত, বাঙালি আর শাসন ক্ষমতায় নেই'। আসামের কংগ্রেসি সাংসদ নীলমণি ফুকন বলেন, 'এখন আসামের রাজ্যিক ভাষা হবে অসমিয়া এবং অন্যান্য ভাষা ও জাতিগোষ্ঠীর মানুষ অসমিয়া ভাষায় মিশে যাবে।’ সিলেটকে পাকিস্তানে ঠেলে দিয়ে খুব উল্লাস হল আহ্লাদ হল উগ্র অসমিয়া জনমানসে, কিন্তু সেও ক্ষণস্থায়ী। সিলেট জেলা সংলগ্ন সমতল কাছাড় ভারতেই থেকে যায়, আসামের জেলা হিসেবে থেকে যায় তার বিশাল বাঙালি জনগোষ্ঠী সহ, সঙ্গে রেডক্লিফ রোয়েদাদে সিলেটের সাড়ে তিনটি থানাও ভারতে থেকে যায় করিমগঞ্জ নামের পৃথক মহকুমা হয়ে, এবং যেহেতু কাছাড়ের সঙ্গে সিলেটের সীমান্ত স্বাভাবিকভাবেই উন্মুক্ত থাকে এবং দেশভাগের ফলে ভীতসন্ত্রস্ত সংখ্যালঘুর দল সদ্য হওয়া পাকিস্তান ছেড়ে ভারতবর্ষের কাছাড় জেলায় চলে আসে। আসামের বাঙালি জনসংখ্যার খুব হেরফের হয় না। ওদিকে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার গোয়ালপাড়া জেলা দিয়ে উদ্বাস্তু স্রোত চলে আসে এপারে। স্বাধীনতার আনন্দে উৎসবের পরিবেশ গড়ে ওঠার সময় হয় নি আসামে, নবীন দেশ জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই নিজের দেশবাসীর সঙ্গে দাঙ্গায় লিপ্ত হয়, ভাই এ ভাই এ লড়াইয়ে। ১৯৪৮-এর মে মাসে গৌহাটিতে সবচেয়ে বড় দাঙ্গা হয়, ১৯৫০ এ গোয়ালপাড়ায় শুরু হয় 'বঙ্গাল খেদা'। কাছাড় জেলা কিংবা বর্তমানে যাকে বলা হয় বরাক উপত্যকা ওখানে অসমীয়া বাঙালি দাঙ্গা হওয়ার কারণ ঘটেনি ভাষিক বণ্টন একপেশে হওয়ার কারণে, সব যে বাঙালি। বাঙালিপ্রধান জেলা সিলেটকে দিয়েও অসমীয়া জাতীয়তাবাদির শঙ্কা ঘুচে না, একক সংখ্যাগরিষ্ঠ হয় না, তাই ১৯৫১র জনগণনায় ব্যাপক কারচুপি, হুমকি এবং প্রশাসনিক তাণ্ডবের ফলে ঘটে যায় Biological Miracle, শতাংশের হিসেবে অসমীয়া হয় ৫৫। স্বাধীনতার পর ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালি প্রধান ছয় সাতটি শহরাঞ্চলের বাংলা ভাষার বিদ্যালয় পরিকল্পিত ভাবে বন্ধ করে দেওয়া হয় যাতে বাংলাভাষীরা ধীরে ধীরে অসমীয়া ভাষায় মিশে যায়, গোয়ালপাড়া জেলার বাঙালিদের ক্ষেত্রে সফল হলেও সিলেটি মূলের বরাক উপত্যকায় তা সম্ভব হয় নি। প্রশাসনিক কার্যালয় উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মচারি পুলিশ এবং বিচারবিভাগে একচেটিয়া অসমিয়া ভাষীর নিয়োগে সরকারি প্রশাসন যন্ত্রের অসমীয়াকরণের পর ১৯৬০ এর এপ্রিল মাসে প্রদেশ কংগ্রেস কমিটি অসমিয়াকে একমাত্র সরকারি ভাষারূপে স্বীকৃতি প্রদানের প্রস্তাব গ্রহন করে। তখন গোটা দেশের মতো আসামেও কংগ্রেসের একচ্ছত্র আধিপত্য। প্রায় বিরোধীশূন্য। বরাক উপত্যকার বেশির ভাগ সদস্যই এই প্রস্তাবের বিরোধিতা করলেও ধ্বনি ভোটে প্রস্তাব গৃহীত হয়। অসমিয়া জাতীয়তাবাদে একমাত্র ঘোষিত প্রতিপক্ষ যেহেতু বাঙালি এবং বাংলা ভাষার ভূত, তাই গৌহাটিতে আবার দাঙ্গা পরিস্থিতি, এক সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয়। বারবার ঘুরে ফিরেই যার নাম হয় বঙ্গাল খেদা। পথে ঘাটে বাজারে বাঙালি দেখলেই শুরু হয় অত্যাচার। উচ্চশিক্ষায় আগত বাঙালি ছাত্ররা আক্রান্ত হয়ে বাড়ি ফিরতে বাধ্য হয় মেডিকেল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ায় ইতি টেনে। ইতিহাসের সবচেয়ে বড় পরিহাস ঘটে যায় বরাক উপত্যকার বদরপুর থেকে নির্বাচিত বিধায়কের হাত দিয়ে, যিনি ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার নাজিরা বিধানসভা কেন্দ্রে পরাজিত হয়ে বাঙালির ভোটে বরাক উপত্যকার বদরপুর বিধানসভা ক্ষেত্র থেকে নির্বাচিত হয়ে থেকে যান আসামের মুখ্যমন্ত্রী, তিনি বিমলা প্রসাদ চালিহা। বিধানসভায় বিতর্কিত ভাষা বিল ১৯৬০ পাশ হওয়ার সময় বরাক উপত্যকার বিধায়কদের মধ্যে দুজন, মুখ্যমন্ত্রী চালিহা একজন আর অন্যজন এক বাঙালি বিধায়ক আব্দুল মতলিব মজুমদার সরকার পক্ষে ভোট দেয়। এরপরই আসামের সকল বঙ্গভাষী অঞ্চলকে নিয়ে এক পৃথক রাজ্য গঠনের আন্দোলন গড়ে তোলার প্রয়াসে বরাক ও ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার দলমত নিরপেক্ষ বাঙালি নেতাদের এক দুইদিবসীয় সম্মেলন হয় করিমগঞ্জ শহরে। কিন্তু বারবার প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তীরে এসে তরী কূল পায় না, দানা বাঁধে না বাঙালির নিজস্ব ভূমির স্বপ্ন। ১৯৬১ র ১৫ই জানুয়ারি করিমগঞ্জে আর একটি অভিবর্তন হয় শীলভদ্র যাজির সভাপতিত্বে, অভিবর্তনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বরাক উপত্যকাকে নিয়ে এক পৃথক প্রশাসনিক বিভাগ গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। এক কথায় পৃথক রাজ্যের ভাবনা চিন্তা হয় কিন্তু আবার দ্বিজাতিতত্ত্বের ভূত দর্শনে নেতারা এই প্রস্তাব কার্যকরী করতে উদ্যোগী হন না। এরপরও হাইলাকান্দি শহরে আর একটি অভিবর্তন হয়, তাতেও আসামের অনঅসমীয়া অঞ্চলগুলি নিয়ে পৃথক প্রশাসনিক বিভাগ তৈরির প্রস্তাব নেওয়া হয় এবং ঠিক হয় আসাম রাজ্যিক কাঠামোর ভিতর থাকতে হলে বাংলা ভাষার পূর্ণ স্বীকৃতি দিতে হবে। এক ডু কিংবা ডাই সংগ্রামের শপথে গঠন করা হয় গণসংগ্রাম পরিষদ কাছাড় জেলার তিন মহকুমা কাছাড় করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দিতে। গণসংগ্রাম পরিষদ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে লোক গণনায় কারচুপির অভিযোগ জানিয়ে আসে। এবং সংবিধানের ৩৪৭ ধারায় রাষ্ট্রপতির বিশেষ ক্ষমতা প্রয়োগ করে বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাজভাষার স্বীকৃতি দাবী করে। সঙ্গে সঙ্গে বৃহত্তর আন্দোলনের প্রস্তুতি হিসেবে ১৩৬৮ বঙ্গাব্দের পয়লা বৈশাখে মানে ১৯৬১ র ১৫ই এপ্রিল সংকল্প দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বরাক উপত্যকায়। এক অভিনব ও অভূতপূর্ব পদযাত্রার আয়োজন হয় মহকুমা শহরগুলি থেকে গ্রামে গ্রামে গণজাগরণের প্রস্তুতিতে। এর পরেও সরকারের তরফ থেকে কোনো সদর্থক প্রতিক্রিয়া পাওয়া না যাওয়ায় সর্বাত্মক হরতালের সিদ্ধান্ত হয় ম্যাট্রিক পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরদিন ১৯ শে মে থেকে। তারপর তো ইতিহাস। জেলা জুড়ে হরতাল পালিত হয় ভোর থেকেই, করিমগঞ্জ ও শিলচরে সত্যাগ্রহীরা কারাবরণ করেন। শিলচর স্টেশনে পুলিশের বন্দুক সত্যাগ্রহীরা ছিনিয়ে নিয়ে যাওয়ার গুজব ছড়িয়ে গুলি বর্ষণ করা হয়, ঘটনা স্থলেই নয়জনের মৃতদেহ পাওয়া যায় পরদিন স্টেশন সংলগ্ন জলাধারে একজনের দেহ পাওয়া যায় আর হাসপাতালের একজনের মৃত্যু হয়। এক কিশোরী কমলা ভট্টাচার্য সহ শচীন্দ্রচন্দ্র পাল কানাইলাল নিয়োগী সুনীল সরকার সুকোমল পুরকায়স্থ কুমুদ দাস চণ্ডীচরণ সূত্রধর তরণী দেবনাথ হিতেশ বিশ্বাস বীরেন্দ্র সূত্রধর এবং সত্যেন্দ্র দেব শহিদদের মৃত্যুবরণ করেন। কার্ফর ভারি বুটের আস্ফালন অবজ্ঞা করে শিলচরের আপামর জনতা মহামিছিলে সমবেত হয়ে একাদশ শহিদকে সশ্রদ্ধ শেষ বিদায় জানায়, চিতাভস্ম মধুরা ঘাটে বিসর্জন দেওয়া হয়। শহিদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে এক কালজয়ী সঙ্গীত রচনা করেন শ্যামাপদ ভট্টাচার্য,

“শোনো ডাকে একাদশ শহিদেরা ভাই
আর দেরি নয় দেরি দেরি নয়,
সুপ্তি ভেঙে পথে ছুটে আয়
হবে জয় হবে হবে জয়...'

 উনিশে মে গণহত্যার পর বরাক উপত্যকায় আন্দোলন আরও তীব্র আকার ধারণ করায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রীকে শিলচর আসতে হয়, এবং একটি আপোষ রফায় আন্দোলন স্থগিত হয়, যে আপোষের নাম শাস্ত্রী ফর্মুলা। সংগ্রাম পরিদের দাবী ছিল গোটা আসাম রাজ্যের জন্য অসমিয়ার সঙ্গে বাংলা ভাষার সমান মর্যাদা, সেটা মানা হয় নি, বরাক উপত্যকার সরকারি কাজ কর্মে এবং শিক্ষায় বাংলার বিশেষ অধিকার স্বীকৃত হয়। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অগ্রাধিকারে প্রতিশ্রুতিও ছিল যা রক্ষিত হয় নি আজও। যদিও এই অধিকার সুরক্ষিত রাখতে ১৯৭২ এবং ১৯৮৬ তে আরও তিনজন বাচ্চু চক্রবর্তী জগন ও যীশু শহিদ হন করিমগঞ্জ শহরে।

 ১৯শে মের ঐতিহ্য বহন করে উত্তর পূর্বের বাঙালি এখনও নিজের ক্রুশ নিজেই বহন করে চলেছে, কারণ সে জানে বিদ্ধ হওয়ার পর আছে পুনরুত্থান।