উনিশে মে: ভাষার সংকট/ধ্রুবপদ উনিশ/একমুঠো দুরুণ ফুল

একমুঠো দুরণ ফুল

বনাম শব্দে একটা লড়াই লড়াই গন্ধ থাকে। আর, শিষ্ট চলিত বনাম মান্য আঞ্চলিক উপভাষা ইত্যাকার তাত্ত্বিক শব্দাবলী হলে তো কথাই নেই। কথাযুদ্ধের আর শেষ নেই। ঠাণ্ডা লড়াই চলতেই থাকে। হ্যাঁ, শিষ্ট চলিত ভাষার সঙ্গে আঞ্চলিক ভাষার একটা অভিমান থাকে। দুম করে কেউ সুয়োরাণী হয়ে গেলে কষ্ট হয়। উপেক্ষিত প্রান্তিকের অভিমানে ডালপালা ছড়ায়। সামাজিক অসাম্যের কেন্দ্র হয় দিকে দিকে। রাজনৈতিক আন্দোলনের রূপ নেয় অঞ্চল বিশেষে। হয়তো অশিক্ষা এবং ঈর্ষাজনিত কারণেই মুখের ভাষাকে উচিত শিক্ষা দিতে অস্ত্রের ভাষা প্রতিযোগী হয়। এক উপভাষার সার্বভৌমত্ব মেনে নিলেই তো আর দুয়োরাণীর দুঃখ ঘুচবে না। একই ভাষাগোষ্ঠীর গণদেবতা লড়ে বিচ্ছিন্ন হওয়ার লড়াই। পশ্চিম বাংলায় ঝাড়খণ্ডী, উত্তরবঙ্গে কামরূপী উপভাষা, কামতাপুরী, রাজবংশী, রাভারা লড়ছে।

 বরাক উপত্যকার আঞ্চলিক উপভাষা নিয়েও একটা উপেক্ষার যন্ত্রণা আছে। অপরিচিত এক কথ্যভাষা হয়েই থেকে গেল আঞ্চলিক উপভাষাটি। কোথাও কোনো মান্যতা নেই মূল ভাষাপ্রবাহের। দু-জন মানুষ হেঁটে গেলে পরিচয় হয় এরকম, একজন বাঙালি আর একজন কাছাড়ি (সাবেক বরাক উপত্যকার একটিই জেলা ছিল কাছাড়, সেই কাছাড়বাসী বাঙালিদেরও বলা হতো কাছাড়ি।) হয়তো এত সহজও নয় অভিযোগের মাত্রা। তবু প্রশ্ন থেকে যায়, কার সঙ্গে লড়াই, কার বিরুদ্ধে অভিযোগ। ঘরে বাইরে দু-দিক থেকে আক্রান্ত বরাক উপত্যকার বাঙালির মুখের ভাষা, আঞ্চলিক উপভাষা মুখ্যত।

 মূল ভূখণ্ড বলে প্রচলিত কলকাতার কথা, কিংবা দ্বিতীয় বলে প্রচলিত ঢাকার কথা বাদ দিতেই হয়, কারণ এককালের ভাষাঘরে এখন আর ঘর নেই তেমন, ঘরের আভাস আছে হয়তো। শুধু মাটির বাড়িটাই তো বাড়ি নয়, পুকুর ঘেরা বাগান, বিস্তীর্ণ উঠোন, দাওয়া, সব মিলিয়েই যে ভদ্রাসন এপার বাংলা, ওপার বাংলায় এখন শুধু চরভূমিটাই বর্তমান, সীমান্ত সামলাতেই ব্যস্ত দু-পারে। মান্য লেখাভুবন জোড়া এখন শুধু নির্জলা খরাকাল।

 তাই, সময় হয়েছে নিকট এখন, বাংলার ভাষাপতাকায় সুজলা সুফলা বরাক উপত্যকার নাম লিখে উড়িয়ে দেওয়ার সময় হয়েছে। ওরা যে যা বলুক, বরাক উপত্যকার সমৃদ্ধ উপভাষার জাদু ইতিমধ্যে ছড়িয়েও পড়েছে সম্পূর্ণ ভাষাভুবনে। তাই, বিরোধ কোথাও নেই, খটকা শুধু মান্যতা নিয়ে। যে-মান্যতা ভাষাতাত্ত্বিক নয়, পরিচয়ের মান্যতাকে চোখঠারার দিন শেষ হয়ে এল। তাই, উপভাষার এই বনাম কথায় বরাক উপত্যকাই প্রধান প্রতিযোগী। এই ভুবনে আলো জ্বেলে, এই পথেই...।

 সাহিত্যের ভাষা, লেখালেখির ভাষা বলতে যে-আদর্শ আঞ্চলিক উপভাষাকে গ্রহণ করেছে বাংলা, তার বাইরের অঞ্চল প্রধানরাও, শুধু কথা বলার বেগার খাটতে বসে নেই। আঞ্চলিক ভাষার কথা এবং লেখার বিভিন্নতাই ভাষাভুবনকে সমৃদ্ধ করে। প্রসারিত করে। বরাক উপত্যকার তরুণ ভাষাবিদ ও ভাষাতাত্ত্বিক শ্রী জগন্নাথ চক্রবর্তী ‘বরাক উপত্যকার আঞ্চলিক বাংলা ভাষার অভিধান ও ভাষাতত্ত্ব’ নামের সুবিশাল বই প্রণয়ন করে সেই সত্য প্রমাণিত করেছেন। সেই বই-এর ভূমিকা লেখক শ্রদ্ধেয় পবিত্র সরকার কিন্তু অন্য আঞ্চলিক উপভাষাকে লেখায় মান্যতা দিতে নারাজ। তাঁর কথায়, ‘একটু ছাড় দেওয়া যায় নাটকে, নাটকের ভাষায় ব্যবহৃত হতে পারে, উপন্যাসের সংলাপেও ব্যবহার হতে পারে।’ কিন্তু সেখানেও সংশয়, লিখছেন, ‘যেমন বরাক উপত্যকার বাংলাও চমৎকার ব্যবহার করেছেন তীর্থঙ্কর চন্দ তার একাধিক নাটকে। কিন্তু নাটক যেহেতু অধিকাংশ দৃশ্য-শ্রাব্য মাধ্যম, তা বিশেষ এলাকার প্রান্তস্থিত উপভাষায় লেখা হলে অন্য এলাকার শ্রোতা-দর্শকদের কাছে তার রসগ্রহণে ব্যাঘাত তৈরি হয়।’ এ কেমন কথা, ‘চমৎকার’ বলেও ‘ব্যাঘাত’-এর কথা। স্ববিরোধ কেন। আবার আদর্শ বাংলার স্বপক্ষের যুক্তিটাও বেশ শক্তপোক্ত, যেমন, তবে প্রয়াত কবি শক্তিপদ ব্রহ্মচারীর মতো কবি এবং তপোধীর ভট্টাচার্যের মতো প্রাবন্ধিক যে উপভাষায় কবিতা ও প্রবন্ধ লেখেন তা বাংলার মান্য উপভাষা, তা যে-কোনো বাংলাভাষীর কাছে পাঠযোগ্য।” তবে পাঠক বিভ্রান্ত হওয়ার পক্ষে এই দুফলা যুক্তিই যথেষ্ট। কিন্তু দ্বিতীয় স্বতঃসিদ্ধ উপস্থাপনে কোন উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়। অনাচারিক আঞ্চলিক উপভাষা শুধু কথাই বলে যাবে। তাহলে, ময়মনসিংহ গীতিকা থেকে বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিমের গান কোথায় দাঁড়ায়। আঞ্চলিক উপভাষার অনাচারিক রূপ শুধু। গীতিকা তো গান নয়, সমৃদ্ধ সাহিত্যও বটে।

 মেনে নেওয়া যাক, সাহিত্যে বর্ণনার ভাষা হবে লেখার ভাষা। মানে, কথ্য ও লেখ্য মান্য উপভাষা। এখানেও দেখা যায় পক্ষপাত, বাংলার অন্য সমাজভাষা, যেমন, রাঢ়ী, বরেন্দ্রী, কিছু কামরূপীও যা উত্তরবঙ্গের কথ্যভাষাকে ছাড় দেওয়া হয়েছে সংলাপে, ‘রসগ্রহণে ব্যাঘাত হয়নি কোথাও’। এক কৃত্রিম উপেক্ষার ‘ব্যাঘাত’ দিয়ে ওপারের সিলেটি আর এপারের বরাক উপত্যকার আঞ্চলিক উপভাষাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে। শুধু রাজনৈতিক রাষ্ট্রসীমার বাইরে বলে কি। নাকি, ভৌগোলিক দূরত্বের অচেনা। তবে, দাবায়ে রাখতে পারবা না। দাবিয়ে রাখা যায়নি। ওপার সিলেটির এক কবি ও ঔপন্যাসিক মুজিব ইরম, কবিতা লিখছেন আঞ্চলিক উপভাষা সিলেটিতে, উপন্যাসের বর্ণনা থেকে সংলাপ পর্যন্ত লিখছেন সিলেটিতে। কব্জির জোর আছে বলে পেরেছেন। তবে এও ঠিক, মান্যভাষার লেখ্যরূপকে শিষ্টতার আধার দেওয়া হয় বানান ও প্রয়োগবিধির মাধ্যমে। বিধির বাঁধন থাকে, আঞ্চলিক কথ্যভাষা যেহেতু ‘মৌখিক এবং অনাচারিক’ মূলত, তাই মৌখিক ভাষায় বর্জ্যও থাকে। ধর্ম সাম্প্রদায়িকও হয়, ভাষাকে বদ্ধ করে। আবার অসাম্প্রদায়িক রূপও আছে, যার মনে যেমন। আঞ্চলিক উপভাষার সাম্প্রদায়িক প্রয়োগ সর্বার্থে বর্জনীয়ও নয়, দোষণীয়ও নয়। বরাক উপত্যকায় হিন্দুমুখে ‘তুই’ শব্দ ‘তুই’ই থাকে, প্রান্তিক নিম্নবর্গের মুসলমান কিন্তু বলে ‘তুইন’। মুজিব ইরম স্ববৃত্তে আবদ্ধ হয়েছেন। লেখার ভাষা আরও মুক্তি দাবি করে। আবার মান্য লেখার ভাষায়ও রাষ্ট্রসীমা ব্যাঘাত সৃষ্টি করে এপার বাংলার জলকে ওপারে বলে পানি, নিমন্ত্রণকে বলে দাওয়াত, জলখাবারকে নাস্তা, দিদিকে আপা, বাবাকে কোথাও কোথাও আব্বা। বাক্যগঠনেও বিভিন্নতা থাকে, ‘ফোন করা’কে ওপারে বলে ‘ফোন দেওয়া’। তাহলে। শিষ্টতায় কে ঠিক। এপার বাংলা ওপার বাংলা। একই ভাষা। একই ভাষার আলাদা সার্বভৌমত্ব। কিন্তু, বরাক উপত্যকার বাংলায়, তথা ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাংলায় রয়েছে এক কৃত্রিম পরাধীনতার জ্বালা, আসাম রাজ্যের রাষ্ট্রশক্তির ক্রমাগত তর্জনি নির্দেশকে অগ্রাহ্য করে এগিয়ে যেতে হচ্ছে ভাষাকে। মাতৃভাষাকে সচল রাখতে বরাক উপত্যকার ভাষামানুষ বারবার রক্ত ঝরিয়েছে। শহিদ হয়েছে। তাই, এ উপত্যকার আঞ্চলিক উপভাষার অবস্থান স্বতন্ত্র। এখানে, এই দুর্দশাগ্রস্ত ভাষাকে বহমান রাখছে তার আঞ্চলিক উপভাষাভাষী মানুষ, তাদের মুখের ভাষায়, বুকের রক্তে।

 ত্রিপুরাতেও বাংলা ভাষার এক নতুন আঞ্চলিক রীতির প্রবর্তন হয়েছে দেশভাগ পরবর্তী সময়ে। কুমিল্লা, ময়মনসিংহ ও সিলেটের উপভাষা মিলে তৈরি হয়েছে নতুন আঞ্চলিক উপভাষা। রাজনৈতিক ও ভৌগোলিক সীমান্ত পেরিয়ে এ সমাচার রাজার কানে পৌঁছতে সময় লেগে যায় বিস্তর। অপরিচয় কমে না। এখনও, এপারের পশ্চিমবাংলায় কেউ বরাক উপত্যকার আঞ্চলিক উপভাষায় কথা বললে, পাশাপাশি শ্রোতার কৌতূহলে হয় কৌতুক, এ কে রে বাবা। এ তো শুদ্ধভাষায় কথা বলছিল, এখন এ কোন সংকেতে কথা কয়। আপনি কি অসমিয়া। আপনি ত্রিপুরা ছিলেন। ত্রিপুরা চেনে, আসামও চেনে, বরাক উপত্যকা চেনে না। কৌতুক পাল্টে বলা যায়, আসাম ও চেনে না, ত্রিপুরা চেনে না, বরাক উপত্যকা তো নয়ই।

 এবার লেখকের বিড়ম্বনা। এক, কথাসাহিত্যের বর্ণনায় না হয় শিষ্টচলিত কিংবা সাধুভাষার প্রয়োগ স্বতঃসিদ্ধ হিসেবে মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু সংলাপে যখন বরাক উপত্যকার আঞ্চলিক ভাষার প্রয়োগ হবে, তখন। এপার বাংলা এবং সিলেট ছাড়া ওপার বাংলার পাঠকের কী হবে। সংযোগ কোথায়। ‘রসগ্রহণের ব্যাঘাত’ দূর করার উপায়। বরাক উপত্যকায় যে মোচাকে ‘থোড়’ বলে, লঙ্কাকে মরিচ বলে। কী করে পৌঁছয় তবে কণ্ঠস্বর। রস, রূপ, বর্ণ ও গন্ধসহ লেখা কী করে পৌঁছে একই ভাষাপাঠকে ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে। তাহলে কি চলতেই থাকবে একমুখি যান চলাচল। বরাক উপত্যকাই পড়বে দুই ভুবনের রচনা, ভুবনধর প্রধানদের কোনো দায় নেই। তাহলে কি আত্মসমর্পণই পন্থা। কথায় আছে, কলকাতায় ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি হলে, শিলচর, আগরতলা, গুয়াহাটিতে বর্ষাতি কেনার ধুম পড়ে যায়। কলকাতার কাছাকাছি বলে, পুরুলিয়া, কাটোয়া, দখনো, রাঢ়, মেদিনীপুরের কথ্যভাষা, মূলভাষার বর্ণনা ও সংলাপে ঢুকে যায় অবলীলায়, কিন্তু তীর্থঙ্কর চন্দর নাটক, ছোটগল্প থাকে 'অন ওয়েটে’। তীর্থঙ্করের ভাষাও তো বাংলাই। একই ভাষাসন্তানের মাতৃদুগ্ধ।

 দুই, বাংলা ভাষা-পরিবারের সমৃদ্ধ সদস্য, বরাক উপত্যকার, ত্রিপুরা, ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাংলাভাষী লেখকের মুখের ভাষায় তো আর কলম চলে না তরতরিয়ে গঙ্গাজলের মতো! উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বাংলা উপভাষার লেখককে, সুরমা, কুশিয়ারা, মনু, ধলেশ্বরী, ব্রহ্মপুত্র, জিয়াভরলির ডিঙা বেয়ে পৌঁছতে হয় মূল স্রোতে। এও এক প্রক্রিয়া, এই প্রক্রিয়ায় লেখকের লেখামুখ ব্যাহত হয় কিছুটা। মুখের ভাষা সরাসরি নামে না কলমের ডগায়। লেখার ভাষায় তর্জমা হয়। এই পরিশীলনে, পুনর্নির্মাণে, মূল চিন্তাস্রোত কিছুটা ব্যাহত হয়। কথার আর লেখার ভাষা এক হলে যা হয় না।

 তিন, দুর্বলতার কথা। কৌতুকের কথা। শ্যামবাজারের বিখ্যাত ‘শ’ কথা যেমন আছে কলকাত্তাই বুলিতে, বরাক উপত্যকারও আছে ‘ফাগল’ কথা। সে থাক, কথ্য ভাষাপুষ্পের বিভিন্নতা দিয়েই তো মূলভাষার স্তবক। সে থাকবে। কিন্তু লেখার ভাষায় যদি অনুপ্রবেশ ঘটে পাগল শশীবাবুর। সে বিপদ থেকে রক্ষা পেতে দরকার ভাষা শিক্ষার। বিদ্যায়তনে বাংলা পঠনের আয়োজনে বিদ্যাসাগর থেকে পবিত্র সরকার, সবাই তো আছেন। পদ্ধতিগত কোনো ত্রুটির জন্যই কি শিক্ষা সম্পূর্ণ হচ্ছে না। বিস্তর ভুল সাইনবোর্ড লেখা হচ্ছে, ভুল বাংলায় ইস্তাহার ছাপা হচ্ছে, খবরের কাগজে বানানের নৈরাজ্য চলছে। কথার ভাষায়, লেখার ভাষায় ঠোকাঠুকি চলছে।

 তাই, বনাম নয়, লড়াই নয়। ভাষাশিক্ষাকে গুরুত্ব দিলেই আরও সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে আঞ্চলিক উপভাষা এবং মূল ভাষাপ্রবাহেরও গতি হবে অবিরত। ভাষাফুলের জলসায় ঢাকা কলকাতার ডালিয়া, জিনিয়া, রজনীগন্ধার পাশে বরাক উপত্যকার একমুঠো ‘দুরন’ ফুলও তখন হয়ে উঠবে বন্ধনীমুক্ত ছুটি পাওয়া নটী।

দ্বিরালাপ ৩৬। ফেব্রুয়ারি ২০১০