উনিশে মে: ভাষার সংকট/ধ্রুবপদ উনিশ/ভাষাসঙ্গীত
এই উপমহাদেশে বাঙালির মতো নিপীড়িত জাতি আর দুটো নেই। দেশভাগের আগে নিতান্ত সুখেই ছিল বাঙালি, বঙ্গদেশ ছিল বিশাল এক রাজ্য। ভাগ হল পূর্ব পশ্চিমে। পূর্ব পাকিস্তান আর পশ্চিমবঙ্গ। চলে গেল আসাম থেকে সিলেটও পাকিস্তানে। পশ্চিমের ভাগও নিয়ে নিল কিছু কিছু বিহার উড়িষ্যা। মানভূমেও আন্দোলন হল ভাষার জন্য। দুভাগ করে পুরুলিয়া জেলা গঠিত হল, পশ্চিমবঙ্গে এল। আসামের সাবেক কাছাড় জেলায় নিরঙ্কুশ বাঙালি। সারা আসামে ছড়িয়ে ছিটিয়ে প্রচুর বাঙালি, আসাম সরকার ভাষা আইন জারি করল, অসমিয়াই হবে আসামের একমাত্র রাজ্যভাষা। অধুনার বরাক উপত্যকায় তখন যে অভূতপূর্ব গনজাগরণ হয়েছিল ১৯৬১-র উনিশে মে সেদিন থেকেই শুরু হয়েছিল ভাষা সংগ্রাম, সেদিনই শিলচর রেলওয়ে স্টেশনে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছিলেন এগারো জন নিরীহ সত্যাগ্রহী। বরাক উপত্যকার শোকস্তব্ধ জনতা কিন্তু এরপরও সত্যাগ্রহের পথ পরিত্যাগ করেনি, হত্যাকাণ্ডের পর শহিদের শেষকৃত্য সমাপন হওয়ার পর থেকে প্রতিদিন ভোরবেলা শহরের পথ পরিক্রমা হত গান গেয়ে, সেই প্রভাত ফেরির উদ্দীপক গানটি আজও ষাট বছর পরও সমান জোর্তিময় আমাদের কাছে—
শোনো ডাকে ওই একাদশ শহিদেরা ভাই
আর দেরি নয় দেরি নয় দেরি নয়
সুপ্তি ভেঙে পথে ছুটে আয়
হবে জয় হবে জয় আর দেরি নয়
শোনো ডাকে ওই শহিদেরা ভাই
আরও প্রাণ আরও প্রাণ আরও প্রাণ
ওই বেদিমূলে দিতে হবে বলিদান
গাও ভাষাজননীর জয়গান
সে-রক্তধারায় ধুয়ে করো লয়
আর দেরি নয় দেরি নয় দেরি নয়
শোনো পরপার হতে ডাক দিয়ে কয়
একদশ শহিদের দলআমাদের শোণিত স্রোতে
আজ অত্যাচারীর তরী টলোমল
একতায় হও সবে বলীয়ান
বলো দিব প্রাণ দিব না জবান
গাও ভাষাজননীর জয়গান
ঘুচিবে সকল পরাজয়
হবে জয়।
আর দেরি নয়...
এই গান গেয়ে উজ্জীবিত বরাক উপত্যকার মাতৃভাষাপ্রেমি মানুষ সেদিন আদায় করেছিল মাতৃভাষার অধিকার, আংশিক হলেও বরাক উপত্যকার জন্য সুরক্ষিত হয়েছিল বাংলা ভাষা, যদিও চোরাগোপ্তা আঘাতে বারবার রক্তাক্ত হয়েছে বরাকের ভাষাজননীর হৃদয়, আরও দুবার কোল খালি হয়েছে দুঃখিনি বর্ণমালার, তিন দুলাল শহিদ হয়েছেন এরপরও।
‘উনিশে মে উনিশো একষট্টি পরে ঘটলেও এর আগে ঘটে গেছে বন্দী বাঙালির নিরঙ্কুশ দুর্গ পূর্ব পাকিস্তানে আর এক মহাবিস্ফোরণ। ১৯৫২-র একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজের কাছে। সেদিনও ছিল সাধারণ ধর্মঘট, সেদিন ছিল রাষ্ট্রভাষা দিবস উদযাপন। সেদিনই শহিদ হন সালাম রফিক বরকত জব্বার সহ নামহীন অনেক। একুশে ফেব্রুয়ারিও একদিনে হয় নি, দেশভাগ করে পূর্ববাংলাকে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল পাকিস্তানের লেজুড় করে। সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্রের ভাষাকে ওরা জুড়তে চেয়েছিল ধর্মের সঙ্গে, ১৯৪৮-এ পাকিস্তান পার্লামেণ্টে উর্দুকে রাষ্ট্র ভাষা করার কথা ঘোষিত হয়, প্রায় ষাট শতাংশ বাঙালির মুখের ভাষা উপেক্ষা করে। বিক্ষোভ চলছিল অনেক আগে থেকেই, পাকিস্তান গণ পরিষদে সরকারি কাজে বাংলা ভাষা ব্যবহারের দাবী প্রথম উত্থাপন করেন বীরেন্দ্রনাথ দত্ত। কিন্তু জিন্না ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে জানিয়ে দেন উর্দু একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা অন্য কোনো ভাষা নয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলেও তিনি এই কথা বলেন। কেমন মিলে যাচ্ছে না আসামের সঙ্গে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খানও একই কথা বলেন, আর রাষ্ট্রপ্রধান খাজা নাজিমুদ্দিনও বীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। যদিও মাঝে মধ্যে কিছু উদ্ভট কথাও শোনানো হয়, নাকি বাংলা লিখতে হবে আরবি হরফে। এরমধ্যে খাজা ঢাকার পল্টন ময়দানে এসে জিন্নার কথার পুনরুক্তি করেন। ১৯৪৯ থেকে ১৯৫২ পর্যন্ত বাঙালির দীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস। শেষ পর্যন্ত অনড় সরকারকে ধাক্কা দিতে ২১ ফেব্রুয়ারির সংগ্রামের কর্মসূচি গৃহীত হয়। সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে ২০ ফেব্রুয়ারির রাতে দমনের হাতিয়ার হিসেবে। কিন্তু গণজাগরণ কি কোনো সরকারি ফতোয়া মান্য করে কিংবা করেছে কখনও। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মিছিল করে বের হয় রাজপথে আর তখনই এক কিশোর সহ শহিদ হলেন অনেক বাঙালি যুবক। শোকস্তব্ধ বাঙালি শহিদ বরকতের পরিবার শহিদমিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন, একরাতে সম্পূর্ণ হয় শহিদ স্মৃতিস্তম্ভ। রচিত হয়, উজ্জীবনের সঙ্গীত, প্রভাত ফেরির গান, আব্দুল গাফ্ফরার চৌধুরীর কলমে—
আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো, একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলতে পারি।
ছেলে হারা শত মায়ের অশ্রু গড়ায়ে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
আমার সোনার দেশের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি॥
জাগো নাগিনীরা জাগো নাগিনীরা জাগো কালবোশেখীরা
শিশু হত্যার বিক্ষোভে আজ কাঁপুক বসুন্ধরা,
দেশের সোনার ছেলে খুন করে রোখে মানুষের দাবী
দিন বদলের ক্রান্তিলগ্নে তবু তোরা পার পাবি?
না, না, না, না খুন রাঙা ইতিহাসে শেষ রায় দেওয়া তারই
একুশে ফেব্রুয়ারি একুশে ফেব্রুয়ারি।
সেদিনও এমনি নীল গগনের বসনে শীতের শেষে
রাত জাগা চাঁদ চুমো খেয়েছিল হেসে,
পথে পথে ফোটে রজনীগন্ধা অলকানন্দা যেন,
এমন সময় ঝড় এলো এক ঝড় এলো খ্যাপা বুনো॥
সেই আঁধারের পশুদের মুখ চেনা,
তাহাদের তরে মায়ের, বোনের, ভায়ের চরম ঘৃণা
ওরা গুলি ছোঁড়ে এদেশের প্রাণে দেশের দাবীকে রোখে
ওদের ঘৃণ্য পদাঘাত এই সারা বাংলার বুকে
ওরা এদেশের নয়,
দেশের ভাগ্য ওরা করে বিক্রয়
ওরা মানুষের অন্ন, বস্ত্র, শান্তি নিয়েছে কাড়ি।
একুশে ফেব্রুয়ারি একুশে ফেব্রুয়ারি॥
তুমি আজ জাগো তুমি আজ জাগো একুশে ফেব্রুয়ারি
আজো জালিমের কারাগারে মরে বীর ছেলে বীর নারী
আমার শহিদ ভায়ের আত্মা ডাকে
জাগো মানুষের সুপ্ত শক্তি হাটে মাঠে ঘাটে বাটে
দারুণ ক্রোধের আগুনে আবার জ্বালবো ফেব্রুয়ারি
একুশে ফেব্রুয়ারি একুশে ফেব্রুয়ারি॥
বাঙালি সংস্কৃতির ধারক এবং বাহক হয়ে একুশে ফেব্রুয়ারির ভোরে নগ্নপদে শহিদের কবর জিয়ারত, শহিদমিনারে পুস্পার্ঘ আলপনা দেওয়া সমবেত সংগীতে আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো গাওয়া তার উপর বইমেলা। আসলে শহিদের রক্তে ভাষা জননীর জয় ঘোষিত হল যে। পশ্চিমা প্রভুরা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার সম্মান দিতে বাধ্য হল। উর্দু এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করে সংবিধান রচিত হল।
মার খেতে খেতে পাকিস্তানের কবলচ্যুত হয়ে বাংলা নামে দেশ গঠিত হল। এপারে এখনও বাঙালির উপর আঘাতের শেষ হয়নি, কিন্তু আমরা জানি করব জয়। এসব উইপোকা অনুপ্রবেশকারী বাঙালিকে দমিয়ে রাখা যাবে না। বাঙালির চেতনার সবুজে আমার উনিশ আমার একুশ দেবে অদম্য অনুপ্রেরণা।