উনিশে মে: ভাষার সংকট/ধ্রুবপদ উনিশ/বরাক উপত্যকার বাঙালি

বরাক উপত্যকার বাঙালি

বরাক উপত্যকার বাঙালি তথা উত্তর পূর্বাঞ্চলের বাঙালির সংকটের সঙ্গে জুড়ে যাচ্ছে আমার ব্যক্তিগত অসহায়তা। বছর পঁচিশেক হয় বরাক উপত্যকা থেকে নিরাপদদূরত্বের কলকাতায় আছি, তাও মনটা পড়ে থাকে শিলচর হাইলাকান্দি লক্ষ্মীপুর সোনাই করিমগঞ্জ শশীনগর কর্ণমধুতে। দশ বছরের অবসর জীবনে ভেবেই যাচ্ছি বরাক নদীর পারে কোথাও একটা বাড়ি করে বাকি জীবনটা কাটিয়ে দেব মাতৃভাষায় কথা বলে চেনাপদের ডালভাত পালই শাক রসা কড়ু মাছের ঝোল খেয়ে, কিন্তু হয়ে ওঠেনা, ফেরা হয় না শেকড়ে। কিছুটা নিজের কাছ থেকেই বাঁধা পাই, কিছুটা পাই রাষ্ট্রের চোখরাঙানি। কোথায় যাব, কোথায় থাকব, একটুকরো জমি তো আমায় কিনতে দেবে না আমারজন্মভূমিতে। আমি কিন্তু উদ্বাস্তু নই স্বাধীনতার দুবছর পর জন্ম হলেও আমার প্রপিতামহ সাবেক করিমগঞ্জ মহকুমার বাসিন্দা ছিলেন। আমার এক অসমীয়া আত্মীয় গৌহাটির মস্তবড় ডাক্তার, বেড়াতে এসে বলে গেল,

 —এনআরসিতে নামটা উঠিয়ে নাও মেশো, লিগ্যাসি ডাটা পাও কিনা দেখ।

 বললাম,

 —দেখি। কিন্তু কী হবে?

 বলল,

 —তুমি তো ফিরতে চাও আসামে।

 দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটু চেষ্টা চালাই, দেওয়ান বাগানের সুব্রতা ভোটার লিস্ট লিগ্যাসিডাটা কোড সহ পাঠিয়ে দেয়। একটা দিন যে কী আনন্দে কাটে বাবার নাম, মায়ের নাম,দাদার নাম ভোটার লিস্টে দেখে, যেন রাজ্য জয় করে ফেলেছি। তারপর বুঝেছি ওইকোড দিয়ে কী হবে। আমি তো থাকি না ওদেশে, আমার ঠিকানা নেই। তাই আবার মন বিষাদগ্রস্ত। এ কেমন দেশ কেমন রাষ্ট্র,যেখানে আমি জন্মেও পরবাসী। ভয়ও হয় সন্তানের জন্য ওদের জন্ম তো আসামে, যদি পশ্চিমবঙ্গ ওদের অস্বীকার করে, চাকরি করছে কর্ণাটকে,ওরাও যদি বলে, দেব গলাধাক্কা। এই সঙ্কট কি শুধু বরাকউপত্যকার বাংলা ও বাঙালির নাকি উত্তর পূর্ব ভারতের বাংলা ও বাঙালির না কি ভারত রাষ্ট্রের বাংলা ও বাঙালির। এরকম দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থা অন্য কোনো ভাষাভাষী মানবজাতির কি আছে এই পোড়া দেশে। মারী মন্বন্তর নিয়ে সুখেই তো ছিল বাঙালি দেশভাগের আগে, কিন্তু রাজনীতির ধর্মনীতির ভাষানীতির মঙ্গল কাটাকাটি উচ্ছন্নে নিয়ে গেল ভারত ভাগের বাঙালিকে। যে কোনো দশাপ্রাপ্তির এক একটা আঞ্চলিক কারণ থাকে, আত্মঘাতী জাতির উত্তর পূর্বাঞ্চলীয় অংশে আত্মহত্যার সঙ্গে যোগ হয়েছে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসে। যে রাষ্ট্র ব্যবস্থা নিরঙ্কুশ হতে গিয়ে চেয়েছিল যা, তা পারে নি বলে আক্রোশে দফায় দফায় চক্রান্ত করে বাঙালি শূন্য করতে চাইছে আসাম। এবং সামিল হয়েছে সবকটি সর্বভারতীয় রাজনৈতিক দল এবং আঞ্চলিক দলগুলিও পরোক্ষে তাদের মদতপুষ্ট। কিছু বাংলা সংবাদপত্র ও সাময়িক পত্র পর্যন্ত তাদের লুকনো অভিসন্ধিতে সবকিছুর অসমিয়াকরণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এদের সঙ্গে কিছু তথাকথিত সাহিত্যপত্র সামিল হয়ে সুখে পাশ ফিরে শুয়ে থাকছে আত্মহননেচ্ছু। হয়তো এসব কথা প্রমাণ ছাড়া বলার কোনো মানে হয় না, কিন্তু এটা তো সত্যি কথা যদি প্রমাণই থাকবে তাহলে আর চক্রান্ত কেন। আসলে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালির সংকটের নমুনা ভিন্ন, ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা মূলত শিক্ষক এবং চাকুরীজীবী। তাই তারা বাধ্যতামূলকভাবে আত্মরক্ষায় আত্মঘাতী। আর এদিকে, বরাক উপত্যকার উপনিবেশকে শোষণের পাঠশালা বানিয়ে মিড-ডে মিলের নামে ব্রডগেজ আর মহাসড়কের ললিপপ দেখাচ্ছে। সর্দার পড়োর দল কখনো গামছা গলায় দিয়ে ভোটবাক্স কব্জা করে ফেলছেন, কখনো আবার বিহু নাচ আর সত্রিয়া নাচের আসর বসিয়ে ঘোষণা করছেন ধামাইল বরাকের জাতীয় নৃত্য, ধামাইলকে যেন শংসাপত্র না দিলে ধামাইল হচ্ছিল না। এদিকে ডিটেনশন ক্যাম্প নামের এক পশুখামারে যখন যাকে ইচ্ছে ধরছে ‘ডি' দাগছে আর পুরছে। ডি মানে ডাউটফুল কিংবা ডুবিয়াস ভোটার। ঠাকুরদাদা জল ঘোলা করার কেস বদলে এখন ঠাকুরদাদার লিগ্যাসি ডাটার সোনার হরিণ ধরার ব্যবসা হচ্ছে রমরমা। পাশ আর কেউ বলে না, সবাই বলে হযবরল, বলে ফেল ফেল ফেল। এই সেদিন দন্ত্য স দিয়ে নাম হওয়ার অপরাধে এক ভদ্রমহিলা ঢুকে গেলেন খোঁয়াড়ে। অন্য এক মহিলার পিতৃভূমি ভারতবর্ষের অন্য রাজ্য হওয়ায় নাগরিক পঞ্জিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়া থেকে বঞ্চিত হয়ে গেলেন। এই একজন কিন্তু একজন নয়, শহর উজাড় করা। নেহেরু জিন্না আলি প্যাটেলরা কিন্তু অন্য কথা বলেছিলেন, বেশ মিষ্টি করে ক্ষমতা দখল করেছিলেন। এসব তো গেল প্রশাসনিক সন্ত্রাস, যা একটি ক্রমাগত প্রক্রিয়া, থেমে থাকে না, চলে। সামাজিক সন্ত্রাস তো আরও মারাত্মক, জানান দিয়ে আসে না, ক্যানসার ডিটেকশনের মতো নিদান হয়। রফতানি বাণিজ্যের মতো, পাঠিয়ে দেওয়া হয়। যখনই দেখা যায় জাতিগত প্রশ্নে ভাষার প্রশ্নে বরাক উপত্যকায় বাঙালির সমবায় কার্যকরী শক্তি হিসেবে প্রতিরোধে দাঁড়িয়ে গেছে, তখনই আমদানির বিভেদ দিয়ে অন্ধ করে দেওয়া হয় দুচোখের দৃষ্টি। শুভবুদ্ধি সক্রিয় থাকায় চিকিৎসা প্রক্রিয়া ছাড়াই ঝাপসা দুচোখ পরিষ্কার হয়ে যায়, হিন্দু মুসলমান এক থাকে। এর উপর আছে রাজনীতির ওঠাপড়া, যোগ বিয়োগ, সাধারণ ভোটদাতাকে বিভ্রান্ত করতে একজন বলে গেলেন চলছে না অন্যজন বললেন চলবে না। বিভ্রান্ত বাঙালি বুঝতেই পারে না চলছে না চলবে না-য়ে নতুনত্ব কী। এই তো কিছুদিন আগেই একজন মুখ্যমন্ত্রী পদলোভী বলে দিলেন এই নাগরিক পঞ্জি কি আসামের নাগরিক পঞ্জি। গদগদ হয়ে ভুক্তভোগী বললেন কেমন বিশ্বপ্রেমের রাজনীতি। তিনি আজ আর একধাপ এগিয়ে গিয়ে বললেন সুপ্রিম কোর্টে যাবেন। ভোটের ঢাকে কাঠি পড়ল বলে। এবার কী একটু সাহিত্যের সন্ত্রাস না করলেই নয়। বুদ্ধিজীবীদের মগজ ধোলাই করতে এখানে ফি বছর কার্নিভ্যাল জমে ওঠে, কলকাতা থেকে নামী সাহিত্যিক আসেন তারা সব বানীময়। তারাও আসেন যেন দিল্লিশ্বরের মতো জগদীশ্বর। বিনোদনে চটকে দিয়ে চলে যান। একবার কেউ প্রশ্নও করেন না আপনারা কেমন আছেন। তবে কলকাতার বাজারেও এখন দুর্দিন, সাহিত্যে কোনো উত্তমকুমার নেই, সেই শীর্ষেন্দু ছাড়া। আবার ভোটে এমপি দেব এমপি শতাব্দী এমপি মুনমুন আবার আসবেন হয়তো। নতুন করে আসবেন মিমি নুসরত। যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম এসব কথা কী সব তালগোল পাকানো নয়। কোনো মাথামুণ্ডু নেই। কী লিখব কী বলব। মনের কথা কেন বলব, কেউ কী বলে আজকাল। এরকম দোলাচলের সময় একজনই এসে আমাদের পথরুধে দাঁড়িয়ে পড়েন। তার কথাই মনে পড়ে, তার গান গুনগুনিয়ে উস্কানি দেয়। অসহায়ের সহায় হয়। জানি না কেন তার এই গানটি এই মুহূর্তে বড় প্রয়োজনীয় মনে হচ্ছে। মনে হচ্ছে মনের কথা, নাই কথার কথা।

ওলো সই ওলো সই
আমারও ইচ্ছে করে তোদের মতো মনের কথা কই।
ছড়িয়ে দিয়ে পা দুখানি কোণে বসে কানাকানি
কভু হেসে কভু কেঁদে চেয়ে বসে রই,
ওলো সই ওলো সই,
তোদের আছে মনের কথা, আমার আছে কই
আমি কী বলিব কার কথা কোন সুখ কোন ব্যথা—
নাই কথা, তবু সাধ শতকথা কই।

 কী বলিব বলে থেমে থাকায় বুদ্ধি আছে, কারণ মনের কথা বলার অনেক নিষেধ আছে, উত্তর-পূর্বের বাঙালি সোজা কথা বলতে পারে না। এদিকে বললে ওদিক উদলা হয়ে যাবে। এখন এদেশের বাঙালি সমঝোতা কথায় করে খায়। মায়ের ভাষায় কথা বলায় প্রতিবন্ধকতা আছে যে। তবু বলতে হয়, কিছু কিছু কথা না বললে তো ইতিহবাস মার্জনা করবে না, প্রজন্মও ছেড়ে কথা কইবে না। আমরা যে এত যন্ত্রণা সয়েও আসামনামক রাজ্যের লেজুড় হয়ে কেন আছি সে ইতিহাসের অনৃত কথা নয় উচ্চারণ করলাম না। কিন্তু আইনের শাসন কেন পাবে না নাগরিক বাঙালি। আসলে আসাম নামক রাজ্যে নেতার উদয় হয় জনজীবন সমৃদ্ধ করতে নয়, বাঙালির ডানা ছাঁটতে তারা ব্রিটিশদেরবিষের তিরে শান দেয় আর মহারথী হয়ে ওঠে। তারা হয়ে ওঠে লোকপ্রিয়, হয়ে ওঠে অম্বিকাগিরি বিমলাপ্রসাদ বিষ্ণুরাম সিদ্ধেশ্বর, তারাই ছাত্র নেতা দুলাল, গোরেশ্বরের মহানায়ক। তারপর তো শিশুনায়ক প্রধানমন্ত্রী, ছাত্র মন্ত্রীসভা। এসব কী রাজধর্ম। নায়কোত্তম ছাত্রনেতা উচ্চতম আদালতে আসামের অসমিয়া বিচারপতির রায়ে বিজয়ী হওয়ায় খুলে যায় বিদ্বেষের মহাকোষ। গণতন্ত্রের স্তম্ভ দখল করে করে এগোতে থাকে রাজার হস্ত। তিনি এখন রাজ্যপ্রধান। আসাম নাগরিক পঞ্জি নবায়নের চক্রান্তে গণতন্ত্রের মুখটাও অপসারিত। এক দুই তিন চার সবকটি স্তম্ভই এখন বাঙালির বিপক্ষে। তাই মনের কথা কওয়ার, ভাষার বিরুদ্ধে পরিকল্পিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধাচারণ করার ক্ষমতা নেই ভাষাসৈনিকের। মাতৃভাষা নিয়ে মাতৃভাষার অধিকার নিয়ে আন্দোলন করলে বলা হয় আঞ্চলিকতা, একুশে ফেব্রুয়ারি হয় আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস। বরাক উপত্যকার বাঙালি বড় নিরপেক্ষ, যুক্তি দিয়ে নিজেকে শাসন করে। কিন্তু ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার অসমিয়া বুদ্ধিজীবীর দল একযোগে খুলে ফেলেছেন মুখোশ, যুক্তিবুদ্ধির প্রগতিশীল একজন হীরেন গোঁহাইও তাই। আমাদের ‘আঞ্চলিক' অভিধানে বুদ্ধিজীবী শ্রেণিটাইহয়তো নেই, আছেন কিছু স্বার্থান্ধ রাজনীতির কারবারি, যারা ভোটের বাক্সে তাকিয়ে থাকে শকুন চোখে, বক্তৃতার জ্বালায় তাতিয়ে দেয় ভোটারকে তারপর একমাস দ্বৈপায়ন হ্রদের ঠাণ্ডা জলে ডুব দিয়ে জনতার তাপ উপশম করে। এরা চোরকে বলে চুরি কর গৃহস্থকেও আধো ঘুমে থাকতে বলে। এরা রাবড়ি বানায়, কড়া আঁচের দুধে পাখার বাতাস দেয়। এরা চেমা-ইমানদার। ইমানদার কথাটা কথার কথা, ইমানের লেশমাত্র নেই। নইলে আঞ্চলিক আন্দোলন অভিধার দুর্নাম ঘুচিয়ে কী ভাষা আন্দোলনের ছেচল্লিশ বছর পরও একটা রেলওয়ে স্টেশনের নাম বদল করতে পারে না মন্ত্রী সাংসদ বিধায়ক। আমরাও ভোট দিয়ে জিতিয়ে যাচ্ছি, একই মুখ, মুখের সন্তান। তাদেরও দুএকজন ছাড়া সবার মাতৃভাষা বাংলা, যে ভাষায় দুই স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রগীত গাওয়া হয়। যে রাষ্ট্রগানের স্রষ্টাও সেই মহামহিম, বাংলা ভাষায় কবিতা লিখে যিনি নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। আর কী কেউ আছেন এমন দুর্লভ সম্মানের ভাগীদার এই পোড়া মহাদেশে সেই কবির মুখের ভাষায় কথা বলার, পড়াশুনা করার অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে বিশ্বের সর্ববৃহৎ গণতন্ত্রে শুরু হয়েছে এক অগণতান্ত্রিক ছেলেখেলা। বাঙালি স্বাধীনতাচেয়েছিল, সবচেয়ে বেশি আত্মত্যাগও করেছে বাঙালি। স্বাধীনতা পেয়েছে বড় কষ্ট সয়ে, বুকের ভিতর হৃদয়টাকে দুভাগ করে।

এপার উত্তরপূর্বে সিলেট বিদায় হয়েছিল বাঙালি-বিদ্বেষের পরাকাষ্ঠা হিসেবে তৎকালীন গোয়ালপাড়া জেলা সম্পূর্ণ এবং নওগাঁ জেলার দক্ষিণ ভাগ তো বাঙালি ভূমিই ছিল। কত ছলনার আশ্রয়ে বাঙালিকে আত্মরক্ষায় বাধ্য করা হয়েছে, এসব স্থানে বাঙালি হয়তো উচ্ছেদ হয় নি কিন্তু এক ভীতির পরিবেশ তৈরি করে রাখা হয়েছে,মাঝেমাঝেই গোরেশ্বর নেলির ভয় দেখানো হয়। যাতে ত্রাসের প্রথম দর্শনে সবাই আসাম ছেড়ে চলে যায়। কোথায় যাবে বাঙালি নিজবাসভূমি ছেড়ে। বরাক উপত্যকার তিন জেলাকেও বাঙালি শূন্য করার অলীক আনন্দে মেতেছে দেশমুখ্য থেকে, আশায় বাঁচা চাষা লেতিপেতি নেতৃবৃন্দ পর্যন্ত। অসমিয়া ভোটাররাও কী করে এতো সহজে ভুলে যাচ্ছেন নবীন দুলাল ভৃগু সমুজ্জ্বলদের চাতুর্য বাক্যে। কোথায় যাবে যদি নাগরিক পঞ্জি বাঙালিকে আসামের নাগরিকত্ব দিতে অস্বীকার করে। বাংলাদেশ নেবে, পশ্চিমবঙ্গ নেবে, নেবে দণ্ডকারণ্য। দিবাস্বপ্ন দেখিয়ে বিভ্রান্ত করার নামই আসাম রাজনীতি যেখানে জনগণের কল্যাণ হল আবেগের সুড়সুড়ি। ক্ষুধার অন্ন নয়, নাগরিক জীবনের মানোন্নয়ন নয়, একমাত্র লক্ষ্য বিদ্বেষ। ওদিকে বরাক উপত্যকা ও ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালির মধ্যেও বিভাজন সৃষ্টি করা হচ্ছে। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালির মেরুদণ্ডে চিড় ধরিয়ে নয়া অসমিয়া তৈরি করা হয়েছিল একসময় এখন সেই প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। অধুনা চরনিবাসী বাঙালিদের কিংবা নতুন অসমিয়াদের নিধন যজ্ঞেও কিন্তু অসমিয়া নেতৃত্ব নিশ্চুপ। এখন নতুন এক বুদ্ধিজীবী বাঙালি সমাজের উদ্ভব হয়েছে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায়। হাঁসজারু বললে আঁতে ঘা দেওয়া হয়, কিন্তু সত্যিই তো তারা আত্মসমর্পণ করেন নি অসমিয়া ভাষিক আগ্রাসনের কাছে। সাময়িক সমঝোতায় বিহু সত্রিয়ায় মজে আছেন হয়তো সঠিক সময়ে ফুটে বেরোনোর জন্য। তবে পরিতাপেরও কিছু ব্যাপার আছে, অস্তিত্ব রক্ষায় ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালিরা প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে বরাকের বাঙালির মুণ্ডচ্ছেদ করে থাকেন কেন। আসাম আন্দোলনের সময় বাধ্যতামূলকভাবে বাঙালিকে আন্দোলনে মিছিলে স্লোগান দিতে হয়েছে, খেদিবই লাগিব। মানে তাড়াতেই হবে বাঙালি বোকার মতো স্লোগান সাজিয়েছিল সেদিন 'বুঝলাম তো যাইতাম কই”।

 স্বাধীনতার পর বাংলা ভাষা ও বাঙালির অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই ছিল বেঁচে থাকার লড়াই। তৎকালীন করিমগঞ্জ মহকুমা থেকে শুরু হয়েছিল আন্দোলন, করিমগঞ্জ মহকুমায় তখন নেতার মতো নেতা ছিলেন ভরবয়সী, আন্দোলন হাইলাকান্দিও পৌঁছে যায়, শিলচরে কোন্দল ছিল কিন্তু স্বাভাবিক নেতৃত্বের ভূমি কী করে বঞ্চিত হয়। যৌথ নেতৃত্বের দাপট দেখেছে তখন বরাকভূমি। কথায় কথায় ওরা গণতান্ত্রিক লড়াইয়ে সামিল হয়েছেন। বিধানসভায় দলের বিরুদ্ধে গিয়ে পদত্যাগ পর্যন্ত করেছেন। বাঙালি তখন ভাষার প্রশ্নে এক হতে পেরেছিল তাই হয়েছিল অভূতপূর্ব ভাষা আন্দোলন। উনিশ শ একষট্টির উনিশে মে থেকে যার শুরু। শুরু হয়ে এক বছরেই থিতু হয়ে গেল মেহরোত্রা কমিশন বাক্সবন্দী হওয়ার পর। এনসি চ্যাটার্জি কমিশনের আবেগ থাকতে থাকতে। অগ্নিমূর্তি নেতারা সব হয়তো রক্তের স্বাদ পেয়ে গেলেন দলবদল থেকে আরম্ভ করে পদের লোভে অনেকে অনেক কীর্তিকাহিনি করলেন। বিশ্বাসঘাতকতা হল। তবু বাঙালির রক্ত বীজে বাঙালিত্ব বহমান বলে আন্দোলন থেমে থাকে নি। দফায় দফায় আরও চারজন শহিদ হলেন ভাষা সংগ্রামে। দু'বছর আগেও আবার এক বিতর্কিত সার্কুলার জারি করেও উঠিয়ে নিতে বাধ্য হয় উগ্রজাতীয়তাবাদী শাসকদল। যদিও অন্য উপায়ে বরাক উপত্যকার বাঙালির প্রতি বৈষম্য বজায় রেখেছে সংখ্যাগুরু শাসক। বরাক উপত্যকাকে ভাতে মারার চেষ্টা হয়েছে ব্রডগেজ আর মহাসড়ক প্রকল্প দীর্ঘায়িত করে। ধর্মে মারারও চেষ্টা হয়েছে। কিন্তু এসব তো পুরনো চাল দিয়ে ভাত বাড়ানোর খেলা। বরাকের বাঙালি ধর্মের বিভাজন আর মানে না। তাহলে কোথায় থাকল জট। বরাকের বাঙালি তো শান্তিতে থাকতে চায়। কারো হাতে অস্ত্র তুলে দিতে চায় না, তাই পৃথক রাজ্যের দাবিও প্রত্যাখ্যান করে। তবু কেন পাঠ্যপুস্তকে অসমীয়া ভাষার অনুপ্রবেশ, হোর্ডিংয়ে সাইনবোর্ডে আগ্রাসন। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পৌঁছে গেছে গামোছা সংস্কৃতি। কে কবে কোথায় কোন বাঙালি গামোছা ব্যবহার করেছে প্রীতির বিনিময়ে। রাজনীতিতেও জনগণের স্বার্থে মাতৃভাষার স্বার্থ কোনো ঐক্য নেই। এখন শুধু সুদিনের স্লোগান। বিবেকের দায় নেই। এখন রাজনীতি মানেই ক্ষমতা। আর ক্ষমতা হাতে থাকলেই মানুষের পরিচয় বেরিয়ে পড়ে। আব্রাহাম লিঙ্কন এরকম কথা বলেছিলেন। তাই এখন শুধু ভোটারকে বিভক্ত করে সূচিত করা হচ্ছে জাতি উপজাতি ধর্মে। স্বাধীনতার পর পূর্বতন সুরমা উপত্যকার প্রধান শহর শিলচরের পথেঘাটে নাগরিক সুযোগ সুবিধা বলে কিছুই থাকল না, তুলনামূলক বিচারে সিলেটের সদর সিলেট শহরের উন্নয়ন হল চোখে পড়ার মতো, আন্তর্জাতিক মানের শহর হয়ে উঠেছে এখন। বরাক উপত্যকার দুর্ভাগ্য বর্তমান সময়ে একজন পথপ্রদর্শক নেতার দেখা পাওয়া গেল না গোটা উপত্যকায়। এমন একজন সাহসী নেতা নেই যে পিআরসি আর এনাআরসির নামে ডি ভোটারের নামে আতঙ্কিত উপত্যকাবাসীকে বরাভয় দিয়ে নেতৃত্ব দেবেন। বাংলা ভাষার শহিদের পূণ্যভূমি বরাক উপত্যকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি জনজাগরণের আন্দোলন করেছিল একসময়। আকসার নেতৃত্বে সেই স্বপ্নের বিশ্ববিদ্যালয় কেন বৌদ্ধিক নেতৃত্ব দিতে পারছে না এই সংকটের সময়। আসলে সবই এক প্রক্রিয়া, চক্রান্তের পরিকল্পনা, খাদের কিনারায় পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে ধীরে ধীরে, বিষ দেওয়া হচ্ছে ধীরে ধীরে। বলা হচ্ছে ১৯৫১-র ভোটার লিস্টে পূর্বপুরুষের নাম থাকতে হবে ১৯৭১-এর ২৪ মার্চের মধ্যরাত পর্যন্ত থাকতে হবে নাম, তবেই ভারতীয়ত্বের উত্তরাধিকার, লিগ্যাসি। তাই যুব সমাজ প্রাণপণ খুঁজছে উত্তরাধিকার উপাত্ত। খুঁজে পেতে পেয়ে গেলেই ব্যক্তিগত জয় নিয়ে চলে যাচ্ছে সুখের গৃহকোণে। স্বার্থপর প্রজাতি তৈরির এও এক প্রকল্প।

 বরাক উপত্যকার নবীন গল্পকার মেঘমালা দে একটি গল্প লিখেছেন মোক্ষম এই বিষয়ে, সমাজ শাসনের যার যেমন হাতিয়ার। আরও অনেকের দক্ষ কলমও প্রস্তুত হচ্ছে প্রতিরোধে। তাহলে আর কেন অভিযোগ। দেশের সুরক্ষা কী শুধু মিলিটারি দিয়ে হয়, সেনাবাহিনি তো একটি বাহিনী, পদাতিক। নৌবাহিনীও আছে। আছে বিমানবহর। তাই ভাষা রক্ষার দায় শুধু রাজনৈতিক নেতার নয়, শুধু প্রশাসকের নয়, শুধু বিচার ব্যবস্থার নয় শুধু সংবাদমাধ্যমের নয়। আছে অন্য একটি স্তম্ভও, পঞ্চম স্তম্ভ, সাহিত্য সংস্কৃতির প্রহরা। সুখের কথা বরাক উপত্যকায় বুদ্ধিজীবী সমাজের নতুন প্রজন্ম এখন প্রস্তুত। বরাকের বাঙালির প্রাণ এত ঠুনকো নয়, ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার বাঙালিরও দেয়ালে ঠেকে গেছে পিঠ তারাও প্রস্তুত হচ্ছেন প্রতিরোধে। ভারত বহির্ভূত এনআরসি, পিআরসি-র ভয় আর ডিটেনশন ক্যাম্পের নির্যাতন দিয়ে তাড়ানো যাবে না বাঙালি। এই সার্বভৌম দেশের ভূমিপুত্র প্রতিটি নাগরিক এদেশেই থাকবে, কোনো পুশব্যাকে যাবে না, ভুয়ো ডিটেনশনেও যাবে না।

 আমার এখন খুব ইচ্ছে সবার নাম সব লেখাকর্মী, সাংস্কৃতিক কর্মীর নাম লিখে জানিয়ে দিই আপনারা সবাই মিলিত হোন, গান্ধিবাগে একটি সম্মেলন হোক, বিরোধীশূন্য হোক সাহিত্য সংস্কৃতির অঙ্গন। বরাক উপত্যকার তথা ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার সমস্ত লেখাকর্মীদের আমি চিনি ব্যক্তিগত ভাবে, সংস্কৃতিকর্মীদেরও চিনি, যোগাযোগ করতে পারি অনুরোধ জানাতে পারি। আমার প্রিয় বরাক ভূমির সৃষ্টিশীল সাহিত্য ও সংস্কৃতি কর্মী যে যেখানেই আছি একসাথে এক নবীন এবং অভিনব আন্দোলন গড়ে তুলতেই পারি কোনো বাধ্যবাধকতা ছাড়া। যার যেমন অস্ত্র, আমাদের অস্ত্রেই আমরা আঘাত করব। আমাদের তো কারো সঙ্গে অকারণ বিরোধ নেই, তাই মাননীয় চারটি স্তম্ভের সহযোগী হয়েই কেন এগোব না আমরা পাঁচ। পঞ্চম।