উনিশে মে: ভাষার সংকট/ধ্রুবপদ উনিশ/দেশভাগ ও উত্তরপূর্বের বাঙালির বিপন্নতা
মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টির এক এবং প্রধানতম হাতিয়ারটি হল অন্ধবিশ্বাস, আর ভ্রান্তবিশ্বাসের নিবন্ধীকৃত প্রধান রূপটির নাম ধর্ম, সাধারণ মানুষের গোষ্ঠীবদ্ধতার অবলম্বন ও ভরসার সহজ এক নিত্যকর্ম পদ্ধতি। এক অলীক সুখসমৃদ্ধ পরজন্মের আশ্রয়স্থল। মিশরের প্রাচীন ধর্মের মূল ভিত্তিই ছিল আফটার লাইফ বা পরজীবন কিংবা আসল জীবন যা শুরুই হয় মৃত্যুর পর, নীলনদীর অজানা পারে আছে সেই সব পেয়েছির দেশ। সেই পরজীবনে প্রবেশের জন্য ফারাও রাজাদের কী প্রস্তুতি, ধনরত্ন মণিমুক্তো খাবার দাবার নিয়ে পিরামিড প্রবেশের আয়োজন। পরম্পরাগতভাবে মানুষ ধর্মভীরু আর ধর্মব্যবসায়ীরা সুযোগসন্ধানী। ছলের পরাক্রমে গোষ্ঠীধর্ম রক্ষায় রাজশক্তি পৃষ্ঠপোষক এবং সহায়ক হয়ে ওঠে। এরাই তৈরি করে জাতি, জাতিরাষ্ট্র, তৈরি করে মানচিত্র এবং তাদের ইচ্ছেমতো ইতিহাসের গতিপথও পরিবর্তিত হয় ভুলপথে।
ভারত উপমহাদেশেও ১৯০৫-এ প্রথম ধর্মের ভিত্তিতে বঙ্গভঙ্গ হয় ভাগ করে শাসন করার পরাক্রমী শাসক লর্ড কার্জনের রাজত্বকালে। একজাতি বাঙালির সম্মিলিত প্রতিবাদে লর্ড হার্ডিঞ্জের আমলে ১৯১১-তে তা রদ হয়। ৩৬ বছর পর আবার পাকাপাকিভাবে মানচিত্র বদল হয় বাঙালির ১৯৪৭-এ। হয় দেশভাগ, ১৯৭১-এ আবার বাঙালি দ্বিজাতি-তত্ত্ব ভুল প্রমাণিত করে ঘোষনা করে স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের। প্রমাণিত হয় বুদ্ধি ও বিবেকের উপর ধর্ম কখনও স্থায়ী ছাপ ফেলতে পারে না, এও সত্য যে নবীন রাষ্ট্র শত্রু হিসেবেও চিহ্নিত করতে পারে না ধর্মবিশ্বাসকে।
যেদিন সাধারণ মানুষ ধর্মকে তার প্রধান শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করবে সেদিন থেকেই বিভেদ আর দেশভাগের মতো আদিপাপ থেকে মুক্ত হতে পারবে মানব। একেক সময় মনে হয় থাকুক না যেমন আছে তেমন যার যার অন্ধবিশ্বাস, ওদেশ বাংলা দেশেও দেখেছি শ্লোগান লেখা হয় 'ধর্ম যার যার, উৎসব সবার' এই বাংলায়ও লেখা হচ্ছে ‘ধর্ম আমার ধর্ম তোমার উৎসব সবার’। এরকম জোড়াতালি চলতেই পারে যতদিন না ধর্মব্যবসা চিরতরে বিলুপ্ত হয়। বছর পঁচিশেক আগে ওপার বাংলার বগুড়ার এক প্রখ্যাত মুক্তমনা সাহিত্যিককে বলেছিলাম ওরা কেন ধর্মীয় আচার আচরণ মান্য করে, একটু ঘুরিয়ে সন্তোষজনক জবাব পেয়েছিলাম। ঠিকই তো ফজরের নামাজটা পড়ে বলেই কাকভোরে ওঠে কৃষক, ধর্মাচরণ করে চাষআবাদে যায়, এর চেয়ে উন্নত বিকল্প দিতে না পারলে কেন তার নিত্যকর্মে ব্যাঘাত ঘটানো। খণ্ডযুক্তি হিসেবে মন্দ না, কিন্তু জবাব মেলেনি একজাতি কেন দুই হল, কেন দেশভাগ হল। নানাজনের নানা মত যে।
মতের তর্কে এতদূর যাওয়ার ধৈর্য বাঙালির নেই। আমার সাধারণী মায়ের কথা জানি, তিনি কোনো বিখ্যাত মানুষ ছিলেন না, তাই তাঁর কোনো দায়ও ছিল না বাঁধা বুলির রাজনৈতিক শুদ্ধ কথা বলার। অসাম্প্রদায়িক কিংবা নিরপেক্ষ হওয়ার জন্য কোনো কেতাব পুঁথির পাঠ তেলাওয়াত শিখতে হয়নি তাঁকে। তাঁকে কেউ বিদ্রোহিনী বলে সম্মান বা বিদ্রূপও করেনি কোনোদিন। তিনি বিশ্বাস করতেন ধর্মে আলাদা হলেও বাঙালি এক জাতি। তিনি তাঁর ধর্মগোষ্ঠীর অন্ধতাকে অমান্য করার মতো সাহসিনীও ছিলেন না। দাদার বিয়েতে এক স্ত্রী আচার অনুষ্ঠান 'পানখিলি'তে মজিদদার স্ত্রীকে নিমন্ত্রণ করেন মা। এই অনুষ্ঠানে ধর্মীয় অনুষঙ্গ প্রায় নেই বললেই চলে, কোনো ঠাকুর দেবতা নেই মন্ত্রপাঠ নেই কয়েকজন এয়োস্ত্রী বসে বসে পানের খিলি বানাবে, সোনার কাঠি রূপোর কাঠি গুঁজে দেবে চুন খয়ের ছাড়া সাজা খিলিপানের গায়ে। জাহানারা বউদি পাড়ার মহিলামহলে খুব প্রিয় জানতাম, উপস্থিত এয়োতিদের সঙ্গেও তো খুব ভাব। কিন্তু দেখা গেল একসঙ্গে বসে খিলি বানানোয় উশখুশ। কেউ কেউ তো বলেই ফেললেন, পান তাম্বুল দিয়ে দেবতাকে আমন্ত্রণ জানানোর অনুষ্ঠান করতে হয় শুদ্ধাচারে, যার অর্থ দেবতা যেখানে সেখানে কেন ভিনধর্মী। আমার স্পষ্টভাষী মা কোনো নাটক করেননি, রাগারাগিও না, জাহানারা বউদিকে কাছে ডেকে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছিলেন।
আমার দিদিমার ছিল ছোঁয়াছুঁতের বাতিক, মানে কুসংস্কার। শৈশবের এক শীতের রাতের কথা মনে পড়লে এখনও আতঙ্কিত হই। প্রতিবেশি এক নিঃসন্তান দম্পতির বাড়িতে খিচুড়ি খেয়েছিলাম রাতের বেলা, অপরাধ এত গুরুতর বুঝিনি, কনকনে ঠাণ্ডাজলে চান করার পর বুঝলাম আমি শুদ্রজাতির হলেও কৌলিন্যের একটা ব্যাপার আছে যা ছুতোর মিস্ত্রি থেকে কয়েক ধাপ উপরে। আমার মা সে রাতে তাঁর মাকে বাধা দেননি আমাকেও কোনো স্তোকবাক্যে আদর করেননি, কয়েক বছর পর, বুঝদার হওয়ার পর বিজয়া দশমীর দিন বিশুকাকু আর কাকিমাকে প্রণাম করে আসতে বলেন।
এসব ব্যাপার যে মুসলমান সমাজে আছে জানা ছিল না, বাংলাদেশ ঢাকার এক প্রকাশক বন্ধুর সঙ্গে আড্ডায় আমার মাকে প্রগতিশীল বোঝাতে গিয়ে ওসব গল্প বলেছিলাম। সেই বন্ধুটিও সঙ্গে সঙ্গে শোনালেন এক অজানা তথ্য। বললেন তাঁদের বাড়িতেও এরকম ছ্যুত অচ্ছ্যুত অজাত কুজাত অশুচির অন্ধ সংস্কার বর্তমান ছিল এই সেদিন পর্যন্ত। তাদের নড়াইল বাড়িতে হিন্দুদের আনাগোনো খানাপিনা ছিল সবসময়। আতিথেয়তার কমতি থাকত না, তবে যেটা কেউ জানত না সে হল হিন্দুর এঁটো ধোয়া মাজার পর গৃহকর্ত্রীকে চান করে শুচি হতে হত। এসব ছিল, ঢাকার বাড়িতে নেই, না হলে আমরা গিয়ে থাকি কী করে ভূতের গলিতে। এসব গল্পের যে একটি ইতিবাচক দিক আছে সে সত্যিও জানাতে ভুলেন নি বন্ধুটি যে নানির চান করে শুচি হওয়ার কুপ্রথায় অতিথির প্রতি অসম্মানের কোনো ব্যাপারই ছিল না, ধর্মের অন্ধ বাধ্যবাধকতাই ছিল প্রধান। সামাজিক কুপ্রথাই যে ক্রমান্বয়ে ধর্মের নামে জমা হয়, দূরত্ব বাড়িয়ে দেয়। ঘর ভাগ হওয়ার প্ররোচনা দেয়। মুসলমানরা গোরুর মাংস খায় বলে বাঙালিরা চিচিঙ্গে নামের সুন্দর সবজি খায় না গোরুর শিঙ্গের মতো দেখতে বলে, বাচা মাছের মতো রুপোলি লাড়িয়া মাছটিও মুসলমানদের জন্য বরাদ্দ, যেমন পাঁঠা ছাড়া বাকি সব চারপেয়ে হিন্দুর অভক্ষ্য, দুপেয়ে হাঁস চলতে পারে মুরগি অচল। হাঁসের ডিমে বারণ নেই মুরগির ডিম নৈব নৈব চ।
তখন বেশ বড়ো হয়েছি কলেজে পড়ি, চৌদ্দ বছর বয়স, হাফপ্যাণ্ট থেকে ফুলপ্যাণ্ট পরার প্রমোশন একদিকে, খালি পা থেকে সদ্য বেরোনো হাওয়াই চটি পরার আনন্দ, দু'একটা সিগারেট খাওয়ার লুকোচুরি আর ছেলেদেরে স্কুল থেকে কো-এডুকেশন কলেজে পড়ার উত্তেজনায় দুম করে টাইফয়েড বাঁধিয়ে বসি। ডাক্তার ঔষধপত্র লিখে দিলেন, বলবর্ধক পথ্যাদি দিয়ে বললেন রোজ একটি করে মুরগির ডিম খাওয়াতে হবে হাফবয়েল। এবারও আমার ধর্মমতি দিদিমা হিন্দুমতে তওবা করলেন, তবে নাতির নিরাময়ের স্বার্থে ভেঙে ফেললেন বেড়া প্রাচীর, পাশের মেসবাড়ির রাঁধুনি সাধুর সঙ্গে রফা করলেন অর্ধ সিদ্ধ অগুভক্ষনের এক অস্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়। সাধু ডিম ছাড়িয়ে নুন মেখে চামচের ডগায় করে খাওয়াবে, জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে খপাৎ করব, এইটুকুই আমার পরিশ্রম। শরীর পেট বাইরে থাকুক মুখটিতো বাইরে রইল। শ্যাম কুল দুইই রক্ষা হল। এসব অনেক বাধা নিষেধ প্রতিবন্ধকতা ছিল সেকালে।
দেশভাগের বিপর্যয় সময়ে আমার কট্টরপন্থি দিদিমা ছিলেন একা সহায়হীনা মহিলা, কিছু টাকা পয়সা কুড়িয়ে বাড়িয়ে এদেশের কাছাড় জেলায় চলে এলেন, সঙ্গে অবিবাহিত ছোটোমাসি আর সদ্যযুবক দুই মামাকে নিয়ে। ভুলু মামা যে আমার আপন মামা নয় বাড়ির কাজের মানুষ মাত্র সে বুঝিনি কোনোদিন, এমনকি আমার শুদ্ধাচারী দিদিমা যখন তাকে কলাইকরা থালায় খেতে দিতেন রান্নাঘরের ভিতর থেকে বাইরে তখনও বুঝিনি দিদিমার ছোঁয়া বাঁচানো ব্যঞ্জন পরিবেশনে। মাকে দিদি আর মাসিকে ভুলু ডাকেও ভাইবোনের সম্পর্ক জেনেছি, আমরা আদরের ভাগ্নেদেরও যে মাথায় উঠিয়ে নিয়ে যেতেন বরাকের নদীস্নানে। শুধু একটাই খটকা ছিল, ভুলুমামার নাম আর ছোটোমাসির নামও ভুলু হয় কী করে। ভুলুমামা আমাদের অনেকটা বড় করে একদিন চলেও যান কোথায়, পরে শুনেছি পাকিস্তানের সিলেটে তাঁর বাড়ি, তিনি ভুলু মিয়া।
হাইলাকান্দি শহরে আমার মায়ের দাদুর বাড়ি, প্রায়ই যাওয়া হয় ওখানে, কত কত আত্মীয়, মামা আর মাসির বাড়ি এখানে ওখানে। খোকামামা দারোগার বাড়ি স্টেশনের উল্টোদিকে, আমার পছন্দ দুই মামাতো ভাই গোপাল বলাই, তাই ওখানেই যাওয়া। বিকেলে দেখতাম মামার বাড়িতে চাঁদেরহাট বসে যেত। বিশাল বারন্দায় বসত মামাদের আড্ডা, সঙ্গে চা ও তামাক খাওয়া। ললিত মামা আনোয়ার মামা মকবুল মামা আরও কত যে মামা আমার এখন আর নাম মনে নেই। তখন একটু বড় হচ্ছি, দেখেছি হিন্দু মামা আর বাঙাল মামাদের জন্য আলাদা চায়ের কাপ আলাদা হুঁকোর ব্যবস্থা রয়েছে। এ নিয়ে কোনো মালিন্যের ঘটনা ঘটেনি কোনোদিন। মুসলমান বাঙালিকে বরাক উপত্যকায় এখনও কেন বাঙাল বলা হয় জানি না। আমরাও তো বাঙাল।
কলাভবনের ছাত্র ময়নূল হক বড়ভূঁইয়া ছিল নেহুর শিক্ষক শিলং-এ, শিলচর এলে আমার বাড়িতেই উঠত, থাকত। দিদিমার বাড়াবাড়িতে ডাক্তারের নিদানে মুরগির ডিম খাওয়ানো নিয়ে আতান্তরে পড়েছিলেন যে মা, ডিম সেদ্ধ করে খাওয়াতে পারেননি ছেলেকে, সেই তিনিই ময়নুলকে তাঁর রান্নাঘরে হাতাখুন্তি নাড়াচাড়া করতে দেওয়ায় মোটেও অবাক হইনি। বরং মুগ্ধ হয়েছি ময়নূল আর আমার মায়ের স্বতস্ফুর্ত বন্ধুত্বে। গর্ব হয়েছিল দেশভাগ-বিভাজিত বাঙালিকে দ্বিজাতি ভাবনার অস্পৃশ্যতা থেকে মুক্ত রাখতে পেরেছেন এক মাতা ও পুত্র, এর মধ্যে একজন আমার গর্ভধারিনী অন্যজনও আমার প্রিয়সখা। আশার কিরণ রয়েছে এখানে ওখানে সবখানে, আহরণ করতে যেটুকু সময়। এসব দেখে দেখেই হয়ত দেশভাগ নিয়ে অপর এক ভাষ্য রচনার ক্ষেত্র প্রস্তুত হচ্ছিল, নির্যাসের সংকেত সদর্থক হয়ে ধরা দিচ্ছিল সেই শৈশব থেকে। দেশভাগ যে ধর্মভাগ নয় এ সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দৃঢ়মূল। কিছু স্বার্থান্বেষী রাজনীতি আর ধর্মের দালালদের সুড়সুড়ির জন্যই যে কাঁটাতারের বন্দোবস্ত এ সত্য বাঙালির বোধগম্য এখন।
ভাগের আগে অখণ্ড দেশে মানুষ ছিল তুলনায় অজটিল, সাদাসিধে। নিজেদের ধর্মাচরণ করত সংস্কার ও কুসংস্কার সহ, পাশাপাশি থাকতো আত্মীয়তার বন্ধনে, তাই এখনও এই শতবর্ষের দোরগোড়ায় এসে মা আমার ভুলুমামার জন্য চোখের জল ফেলে, প্রিয় পদ রান্না হলে ময়নুলের কথা বলে। হয়তো সংবেদনশীল কথকের বয়ান বলে, শৈশব থেকে হিন্দু মুসলমান এক হয়ে থাকার ছবি দেখেই বড়ো হয়েছি বলে নেতিবাচক চিন্তা স্থান পায় না মনে। হতে পারে তা ফলিত সত্যকে অস্বীকার করে কিন্তু ক্ষতিকারক তো নয়, হোক না স্বপ্ন বোনা। একদিন আসবে বলে অপেক্ষায় থাকাই যায় কারণ একদিন যে ছিল সে সত্য তো গেয়ে গেছেন বাউলসম্রাট শাহ আব্দুল করিম তাঁর গানে,―
‘আগে কী সুন্দর দিন কাটাইতাম
গ্রামের নওজোয়ন হিন্দু মুসলমান
মিলিয়া বাউলা গান আর মুর্শিদি গাইতাম
হিন্দু বাড়িতে যাত্রা গান হইত
নিমন্ত্রণ দিত আমরা যাইতাম’
আবার একদল আছে সহজ সমাধানের যুক্তিবাদী, যারা বলে পাকিস্তান হওয়ার জন্য যারা অত্যচারিত হয়েছে তারা কাছাড়ে এসে হয়েছে কট্টর হিন্দু মানে মুসলমান বিদ্বেষী জয়শ্রীরাম আর একদল হয়েছে কম্যুনিস্ট। এরকম হয় না, কিছু জাতির নিজস্ব বৈশিষ্ট্য থাকে, বাঙালির যুক্তিবাদী ধারাটি প্রবল বলেই মুক্তমনারাই সংখ্যাগরিষ্ট। দেশভাগের পর প্রথম নির্বাচনের সময় খুব ছোটো ছিলাম, শিক্ষক বাবার বুকপকেটে কাস্তে ধানের শিষ আঁকা একটি প্রতীক আবিষ্কারের আনন্দ স্নান করে জুটেছিল গালে চটাস এক থাপ্পড়। পরে বুঝেছিলাম কম্যুনিস্ট হওয়ার ছিল অনেক বিপদ। কম্যুনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ না হলেও ওটা প্রকাশ্যে দেখানো ছিল বারণ। দেশভাগ হলেও ধর্মহীন বর্ণহীন সমাজের স্বপ্ন দেখা মানুষেরা তখন যেমন ছিলেন এখনও আছেন সংখ্যালঘু হয়ে। বাবা নেই, মা বেঁচে আছেন একশ ছুঁই ছুঁই। মাকে এখন সব কথা বলা যায় না তাঁর বধিরতার জন্য। ভালোই হয়েছে এখনও যে বাঙালির এক হওয়ার কথা বলতে পারছি না বড়োমুখ করে।
বাঙালির জন্য দেশভাগ কতোটা অপরিহার্য ছিল সে সত্য ওপারে একরকম এপারে অন্যরকম। হয়তো তখন উচ্চবর্ণের ভূস্বামীদের অন্ত্যবর্ণ ও গরীব মুসলমানদের উপর অত্যাচার এবং অবিচারের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছিল বলে। হয়তো জাতি হিসেবে বাঙালির কোনো অভিভাবক ছিলেন না মোক্ষম সময়ে। অনেক রকম বিকল্পও তো ছিল, বাংলা কিংবা বঙ্গ নামে বাঙালির আলাদা দেশ হতে পারত। উড়ে এসে জুড়ে বসতেন না তের নদীর পার থেকে কোন মহাম্মদ আলি জিন্না। দেশের নেতাও ভারত বাঁচাতে বলেছিলেন দেশভাগ প্রস্তাব তাঁর মৃতদেহের উপর দিয়ে গৃহীত হবে, বিকল্প হিসেবে তিনি জিন্নাকেও অখণ্ড ভারতের মন্ত্রিসভা গঠন করতে বলেছিলেন। তাঁর কথা তখন আর কে শোনে, তাঁকে বিগ্রহ বানাতে প্রস্তুত তখন মাঝারি দেশনেতারা। তিনিও হয়তো তখন তাঁর বিখ্যাত পোজগুলি দেওয়ায় ব্যস্ত ছিলেন। জিন্না সাহেবও খেদের সঙ্গে বলেছিলেন ‘সংখ্যাগরিষ্ঠের সঙ্গে সমঝোতা সম্ভব ছিল না, কারণ কোনো হিন্দু নেতারই সদিচ্ছা ও কর্তৃত্ব ছিল না।’ তাই হয়তো ইতিহাসের গতিপথ পালটে দেওয়ার কৃতিত্ব তাকে দেওয়া হল, মানচিত্র পালটে দিলেন, দুহাজার মাইল দূরত্বের এক অবাস্তব জাতিরাষ্ট্র গঠনকেও বাস্তব বলে ধন্য ধন্য করা হল।
ভারতবর্ষে তখন দেশনেতার বড়ই অভাব, সবাই কনুই দিয়ে এ ওকে গুঁতোচ্ছে। আর বঙ্গপ্রদেশও তথৈবচ। রবীন্দ্রনাথ নেই দেশবন্ধু নেই সুভাষচন্দ্র নেই নজরুল থেকেও নেই। চূড়ান্ত অবিশ্বাস আর লোভ থেকে রক্ষার উপায় নেই। হিন্দুর হাতে রাজ্যপাট দিলে মুসলমানের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে, আবার মুসলমান প্রধানমন্ত্রী হলে হিন্দুকে নামাজ পড়তে হবে। বরং দুভাগ হলে কর্মসংস্থান হবে, দুদিকে দুই রাজধানি, দুই রাষ্ট্রপ্রধান, মন্ত্রী সাস্ত্রী সচিবালয়। রাজনীতির ঘোলা জলপানি তখন।
বাঙালির জাতীয় চরিত্রে মারামারি হানাহানির ইতিহাস বড়ো কম। তাই বিস্মিত হতে হয় কী করে যে নোয়াখালির দাঙ্গা হয়, কলকাতায় হয় দ্য গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং। দেশভাগের অব্যবহিত পরে আসাম প্রদেশ থেকে ভুল গণভোটে ছিটকে যাওয়া সিলেটের চা শিল্পের দেশ শ্রীমঙ্গলের রেলস্টেশনে হয় নৃশংস নরসংহার। কারণ ইতিহাস দুরকমভাবে গড়ে উঠেছে ভারতবর্ষের দুই প্রান্তে, পুর্বে আর পশ্চিমে। পশ্চিমের নৃশংসতার কাছে কলকাতা নোয়াখালি শ্রীমঙ্গল তো নিতান্তই ছোটো ঘটনা। ঔপন্যাসিক আঁচল মালহোত্রার বর্ণনায় শিহরিত হতে হয় যখন এপার থেকে ওপারে প্রায় সমহারে যাচ্ছে শরণার্থী বোঝাই ট্রেন। রেলগাড়ির ভিতরের বর্ণনায় উত্তেজনা, ‘প্রতিবার যখন এক একটি স্টেশনে থামছে ট্রেন, আমরা বন্ধ দরজার ভিতর চুপ করে থাকি যাতে কোনো শব্দ বাইরে না যায়। আমরা ক্ষুধার্ত, তৃষ্ণায় গলা শুকিয়ে আসছে। বন্ধ কামরার ভিতর থেকে আমরা শুধু শুনতে পাই হিন্দু জল আর মুসলমান পানির আওয়াজ এমাথা থেকে ওমাথায় ঘুরছে। শুধু দেশ নয়, তার অধিবাসী নয় এবার জলও বিভাজিত হয়ে গেল।’
নিষ্ঠুর পরিহাসপ্রিয় দেশভাগের ‘ইতিহাস’কে খলনায়ক করে প্রিয় লেখক গুলজার সাহেবের মন্তব্য আরও সুচিমুখ,
‘উদ্ধত এবং অহংকারী ইতিহাস যখন মেঘের কোলে মুখ লুকোয় সে তো আর নিচের দিকে তাকিয়েও দেখে না, বুঝতেই পারে না কখন তার পায়ের নিচে লক্ষ কোটি সাধারণ মানুষ দলিত হয়ে গেছে। সে বুঝতেই পারে না পাহাড় কেটে দুভাগ করা যত সহজ মানুষের ক্ষেত্রে তত সহজ নয়, মানুষ রক্তাক্ত হয়।’
গুলজার কথিত রক্তক্ষরণ শুধু দেশভাগেই শেষ হয় নি, ভাগের দেশ ভারতবর্ষের আর এক রাজনৈতিক বিভাগ আসাম প্রদেশের বাঙালিরা এখনও ক্ষতবিক্ষত হয়ে চলেছে, পুর্বপুরুষের ভুলের মাশুল দিয়ে যাচ্ছে। ১ নভেম্বর ২০১৮-য় আপাতত শেষ কিস্তির পাঁচজন ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে রক্তঋণ শোধ করলেন উজান আসামের ধলা শহরে। ভারতের নাগরিক প্রমাণ করতে না পেরে যারা প্রতদিনি আত্মহত্যা করে চলেছেন তাদেরই বা রক্ষা করবে কে। এই উদ্ধত এবং অহংকারী ইতিহাসকেও এবার ধৈর্য ধরে শোনতে হবে অপর এক বাঙালির অপার লাঞ্ছনার কথা।
১৮২৬ খ্রিস্টাব্দে ব্রহ্মদেশের সঙ্গে ইয়াণ্ডাবু চুক্তির মাধ্যমে আসাম ব্রিটিশ ভারতের অন্তর্গত হয়। ১৮৩৬-এ বাংলাকে আসামের রাজ্যভাষা করে দেয় ইংরেজরা। বাঙালির আসামে মূল প্রব্রজনের শুরুর সময়কালও তাই ধরে নেওয়া যায় ১৮২৬। তখন পূর্ববঙ্গ থেকে বহু চাষি জমিদার মৌজাদাররা আসামে এসে বসবাস শুরু করে, যাদের বেশিরভাগ ছিল মুসলমান। ব্রিটিশের সহযোগী হিন্দুবাঙালি বা বাবুবাঙালি সমাজেরও উদ্ভব হয় আসামের শহরগুলিতে। সেই সময় থেকে অসমিয়া ভাষা সংস্কৃতি বাংলার সাহচর্যে নিজের পরিচিতি তৈরি করছে। নইলে কেন সাহিত্যরথী লক্ষ্মীনাথ বেজবরুয়া কলকাতায় পড়তে গিয়ে ঠাকুরবাড়ির ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠবেন, প্রজ্ঞাসুন্দরীকে বিয়ে করবেন। উনিশ শতকের শেষদিকে আসামের প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী গুণাভিরাম বড়ুয়ার পুত্রের সঙ্গে দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাতনির বিয়ে পর্যন্ত হয়, প্রব্রজন নিয়ে তিনিও বলেছেন—‘এরকম অভিবাসন খুবই ইতিবাচক।’ বিংশ শতাব্দীর শুরুতে ১৯২১-এ আর এক বুদ্ধিজীবী জগন্নাথ বেজবরুয়া বলেছেন, ‘অভিবাসনের ফলে বরপেটার প্রচুর উন্নতি হয়েছে।’ দুঃখের বিষয় এর পরের দশক থেকেই শুরু হয় উলটো পুরাণ। রাজনৈতিক প্রচার ও পরিসংখ্যানের কারচুপিতে চোখের মনি বাঙালি হয়ে যায় অসমিয়া জাতির চোখের বালি। দেশভাগের পর স্বাভাবিক কারনেই শরণার্থীর আগমন হতে থাকে আসামে যেহেতু পাকিস্তান গঠন ছিল মূলত ধর্মীয় প্রস্তাবের বাস্তবায়নে। বাঙালির বোঝা কমাতে গিয়ে তো উলটো হয়ে গেল সব, নিরঙ্কুশ হওয়া আর হল না। তখন থেকেই শুরু বাঙালির প্রতি বিভাজনের রাজনীতি। সেই সময়, দেশভাগের অব্যবহিত পর থেকেই আবার অসমিয়া জাতীয়তাবাদী নেতৃত্ব বাঙালি নিয়ে বিভ্রান্ত। তখন নিম্ন আসামে মুসলমান প্রব্রজন নিয়ে আনন্দিত জাতীয়তাবাদী আসাম। নেতারা বললেন—'নিরক্ষর মুসলমানরা আসামে স্বাগত, ওরা অকারণ রাজনীতিতে নাক গলায় না, অসমিয়া ভাষা সংস্কৃতির উপর চড়াও হয় না, বরং ওরা নিজেদের অসমিয়া পরিচয় দিতেও রাজি হয়ে গেছে।’ তৎকালীন কামরূপ গোয়ালপাড়া জেলা বাঙালি মুসলমান প্রধান হয়ে যায়। হিন্দু অনুপ্রবেশ নিয়ে হয় মাথাব্যাথা, ওদের বেশিরভাগই মধ্যবিত্ত। বাঙালি মধ্যবিত্তরা সব কিছুতে মাথা গলায়। ওদের জন্যই মূলত শুরু হয় শহরভিত্তিক বিতাড়ন প্রকল্প, বঙ্গাল খেদা। আসামের বিখ্যাত সাহিত্যিক বিরিঞ্চি কুমার বড়ুয়া তখন জাতির শুদ্ধিকরণে ব্যস্ত। বললেন, ‘সাংস্কৃতিক জাতিগত ও ভাষাগত দিক দিয়ে প্রত্যেক অনঅসমিয়া আসামের কাছে বিদেশি। আমাদের মনে রাখতে হবে যে অতি প্রাচীনকাল থেকেই আসাম কখনই ভারতের অংশ ছিল না।’ কিন্তু বাঙালি যে খ্রিস্টিয় চতুর্থ শতক থেকে আসামের নাগরিক সমাজ আলো করে আছে তার প্রমাণ পাওয়া যায় ইতিহাসে, আর ব্রহ্মদেশ থেকে আহোমদের আগমন তো সেদিন, ১২২৮-এ।
গণভোটে সিলেটের ওপার বাঙালি কিন্তু নির্বিঘ্ন দেশ পেল না, ভেঙে টুকরো করা হল। বড় অংশ গেল পাকিস্তানে, তিন থানা আর অর্দ্ধেক ভারতে এলো। পাকিস্তানপন্থীরা তো হাইলাকান্দিও চেয়েছিল, সে ভিন্ন ইতিহাস। তখন কত গান, দুঃখের ছড়া,
‘ভেঙে দিও না সোনালি সিলেট।’
‘আসাম ছেড়ে ভঙ্গুর বাংলায় যেয়ো না।’
‘পূর্ববঙ্গে যাব না নালিশাক খাব না।’
‘পূর্ববঙ্গে যাব না ঘোড়ার ঘাস খাব না।’
‘ও সজনী সিলেট ভেঙে গুড়া করতায় নি?’
পাকিস্তান পন্থীরাও স্লোগান দিল,
‘আসামে আর থাকব না, মশার কামড় খাব না।’
‘আসামে আর থাকব না, পুলিশের গুলি খেয়ে মরব না।’
‘পাকিস্তান ঝিঙার ঝাড়, গাইয়ে খার বদলে চার’।
‘কংগ্রেস সরকার জুলুম করে নামাজেতে গুলি করে, ভুটের ঘরে কুড়াল মার।’
‘হিন্দু মুসলমান ভাই ভাই চল দুয়ে মিলে গরু খাই।’
ভাগের সিলেট থাকল কিছু পূর্ব পাকিস্তানে, কিছু চলে এল কাছাড়ে। সারা দেশ যেমন উদ্বাস্তুর ভাগ বহন করল আসামের ভাগেও থাকল সমহারে। আসামের জন সংখ্যায় বাঙালির নাম খুব একটা কিছু কমল না গণভোট হয়ে। এতেই আবার গোঁসা হয় আসামের জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বের।
১৯৬০-এ কাছাড়ের কংগ্রেস সভ্য ও বিধায়কের অমতে আসাম প্রদেশ কংগ্রেস আসামের ভাষা আইনের খসড়া অনুমোদন করে। এবং পরবর্তীতে মন্ত্রসভায়ও গৃহীত হয়। প্রস্তাবে বলা হয় অসমিয়া হবে একমাত্র রাজ্যিক ভাষা সঙ্গে ইংরেজি থাকবে। দ্বিতীয় বৃহত্তম ভাষা গোষ্ঠীর প্রতি এই অবিচারের জবাবে কাছাড় জেলার জনতা ভাষা ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে গর্জে ওঠে। এক অভূতপূর্ব প্রতিবাদের কর্মসূচি গৃহীত হয়। ত্রিস্তরীয় আন্দোলনের সুচিন্তিত কর্মসূচি। সংকল্প, পদযাত্রা ও সর্বাত্মক হরতাল। নবীন রাষ্ট্রের এক বৃহৎ ভাষা গোষ্ঠীর প্রান্তিকায়িত খণ্ডের তখন মন্ত্র ‘হতে পারি দীন তবু নহি মোরা হীন'। এক মহাজাগরণের উদগীথ উচ্চারিত হয় কাছাড় জেলার গ্রামে গ্রামে পদযাত্রার মাধ্যমে। বলা হয় জান দেব জবান দেব না। উনিশে মে উনিশশো একষট্টির দুপুর দুটো পঁয়ত্রিশে শিলচর রেলওয়ে স্টেশনে বিনা প্ররোচনায় নিরীহ এবং নিরস্ত্র সত্যাগ্রহীদের উপর গুলি চালানো হয়। এগারোটি তাজা প্রাণ শহীদের মৃত্যুবরণ করে। বাংলাভাষার অমর একাদশ শহীদের রক্তে অর্জিত হয় কিছু অধিকার, কাছাড় ভেঙে ততক্ষণে তিন জেলা হয়েছে কাছাড় হাইলাকান্দি ও করিমগঞ্জ। এই নবগঠিত বাংলাভাষী প্রশাসনিক অঞ্চলের নবনাম হয় বরাক উপত্যকা। উপত্যকার জন্য সরকারি ভাষা বাংলার স্বীকৃতি আদায় হয়।
ছলের কারবারিরা এরপর মোক্ষম আঘাতে বাংলাভাষাকে নিশ্চিহ্ন করার প্রয়াস পায়। গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয় একটি বিজ্ঞাপ্তি করে জানিয়ে দেয় আসামে স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মাধ্যমে হবে অসমিয়া ও ইংরেজি। আবার আন্দোলন হয় বরাক উপত্যকায় আবার শহিদ। শহিদের রক্তে আবার অর্জিত হয় নতুন বিশ্ববিদ্যালয় শিলচরে। ইতিমধ্যে অসমিয়া ছাত্র সংগঠন আসু আর বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন আলফা শুরু করে বিদেশি বিতাড়ন আন্দোলন। একসময় হতদ্যোম সমস্ত আন্দোলন যখন স্তিমিত প্রায়, শান্তির বাতাবরণ ব্রহ্মপুত্র বরাক উপত্যকায় বিরাজমান, কংগ্রেসি মুখ্যমন্ত্রী হিতেশ্বর শইকিয়া দৃঢ় হস্তে দমন করছেন নৈরাজ্য। আচমকা তখনই বিনা মেঘে পড়ে বাজ, ১৯৮৫-র ১৫ আগস্ট ভারত দেশের শিশুনায়ক রাজীব গান্ধী এক চুক্তির মাধ্যমে আসুর সমস্ত দাবি মেনে নেন এবং নবপর্যায়ে শুরু হয় রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্তে বাঙালি বিতাড়নের কার্যক্রম, বাঙালি হয় ঘোষিত বিদেশি। নিজবাসভূমে আবার পরবাসী হওয়ার উপক্রম। এখানে বলে রাখা ভালো তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধান রাজীব গান্ধির মাতামহ জওহরলাল নেহেরু দেশভাগের বেদনায় মধ্যরাত্রে বলেছিলেন ‘ওপারে আজ যারা আমার ভাইরা থাকলেন, আমাদের সঙ্গে স্বাধীনতার আনন্দ উপভোগ করতে পারলেন না, তারা আমাদেরই আপনজন। যখনই তারা এপারে চলে আসতে চাইবেন তাদের জন্য দ্বার চিরদিন উন্মুক্ত থাকবে। এখানে এসে ভারতীয় নাগরিকের প্রাপ্য মর্যাদাই তারা ভোগ করতে পারবেন।’ এমনকি তাঁর মাতামহী ইন্দিরা গান্ধি পর্যন্ত আততায়ীর গুলিতে মৃত্যুর আগে বলেছেন 'আসাম সমস্যার সমাধান শুধু আসু আর অগপর ইচ্ছের কাছে আত্মসমর্পণ করে হবে না। আসামে বসবাসকারী সকল শ্রেণীর নাগরিকের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তা সম্ভব হতে পারে।’ এও হল আর এক ধরনের পারিবারিক পরিহাস।
চুক্তি তো হল, বাঙালি বিদেশি চিহ্নিত হল কই। আইএমডিটি আইন মানে Illigal Migrants (Determinations by Tribunal) Act 1983-এ নাকি যথেষ্ট ফাঁকফোকর আছে, তাই বাঙালিকে বিদেশি চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। সেই মর্মে তখনকার আসু সভাপতি বর্তমান বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়াল সুপ্রিম কোর্টে নালিশ করলেন যাতে ফাঁক ভরাট করতে আইনটি বাতিল করা হয়। সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে আইএমডিটি বাতিল হয়। সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে আসামে জাতীয় নাগরিক পঞ্জি নবায়নের কাজ শুরু হয়, যার পারিভাষিক গিলোটিনের নাম এনআরসি। একেবারে জার্মানির মডেলেই, সমাজতন্ত্রী নায়ক হিটলারের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের আদলে তৈরি হয় ডিটেনশন ক্যাম্প। খাদ্য বস্ত্র ছাড়া কিছুই দেওয়া হবে না বন্দীশালায়। ভারত প্রজাতন্ত্রে অনেক কিছুই হয় সৃষ্টিছাড়া, ভোটার তালিকায় ট্যাড়া দেওয়া হয় ‘ডি’, মানে ডাউটফুল, সন্দেহজনক, সন্দেহ দূর করতে না পারলে সবরকম নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। তাড়ানো হবে দেশ থেকে। আর নাগরিক পঞ্জি নবায়ন প্রক্রিয়ার তত্ত্বাবধানে থাকবেন সুপ্রিম কোর্টের দুই বিচারপতি, যার মধ্যে একজন আসামেরই সম্মানিত ভূমিপুত্র। এখন তিনি প্রধান বিচারপতি হয়েছেন। ২০১৭-র ৩১ ডিসেম্বর নাগরিক পঞ্জির প্রথম তালিকা প্রকাশিত হয়, যাতে এক কোটি উনচল্লিশ লক্ষ নাগরিকের নাম নেই, যার সিংহভাগ নামহীনরাই বাঙালি। সেই পোকায় কাটা নাগরিক পঞ্জিতে বিচ্ছিন্নতাবাদি নিষিদ্ধ দল আলফার শীর্ষনেতাদের নাম আছে, কিন্তু নাম নেই অনেক বিশিষ্ট বাঙালির। আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য তপোধীর ভট্টাচার্য ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নাম নেই, কী আশ্চর্যের ব্যাপার শ্রীভট্টাচার্যের পিতা শ্রীতারাপদ ভট্টাচার্য ছিলেন আসামের একজন শ্রদ্ধেয় জননেতা এবং বিধায়ক। নাম নেই আর এক প্রাক্তন বিধায়কপুত্র বিখ্যাত বুদ্ধিজীবী সঞ্জীব দেব লস্করের পরিবারের নামও, বিশিষ্ট সাংবাদিক ও দৈনিক সাময়িক প্রসঙ্গ সম্পাদক তইমুর রাজা চৌধুরীর নামও।
আসামের বুদ্ধিজীবী সমাজ এখন জাতীয়তাবাদের অন্ধতায় আক্রান্ত। উনবিংশ শতাব্দীর মুক্তমনা সমাজের বিলয়ের ফলে এখন আর আনন্দরাম ঢেকিয়াল ফুকন কিংবা গুণাভিরাম বরুয়ার জন্ম হয় না। আসামের বামপন্থাও ভুল জাতীয়তার যাঁতাকলে বিদ্ধ, তাই সুপ্রতিবেশী বাঙালির উপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে কোনো মানবিক প্রতিবাদ জানানোর মঞ্চও খুঁজে পাওয়া যায় না।
ছাত্র সংগঠন আসুর বিগ ভাই অগপ এখন বিজেপির সঙ্গে রাজনৈতিক এবং প্রশাসনিক ক্ষমতার অধিকারী আসামে। রাজশক্তির প্রধান হাতিয়ারই হল বিভাজন, বাঙালিকে বিভাজিত কর, হিন্দু-মুসলমান কৈবর্ত-বর্ণহিন্দু সিলেটি-কাছাড়ি। তাই এখন বদলে গেল জাতীয়তাবাদের কৌশলী মতবাদ। হিন্দুত্ববাদি দলের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের বাধ্যবাধকতায় যদিও বাঙালি মাত্রেই এখন বিদেশি এবং সন্দেহজনক। তবু তখনকার দৃষ্টিভঙ্গি একপাক ঘুরে গেছে, এখন বাঙালি মুসলমান নিয়ে পূর্বপ্রীতি নিঃশেষ। ওরা তখন ছিল স্নেহের ‘মিয়া, নেলি গহপুর শিলাপাথার চাউলখোয়া মুকালমুয়া ঘুরে এখন গালাগালির ‘মিয়া' শব্দে পর্যবসিত। কবি হাফিজ আহমেদ তার রাগকথা অসমিয়ায় শুনিয়েছেন এরকম,—
‘লেখো
লিখে রাখো
আমি একজন মিয়া
এনআরসি ক্রমিক নং ২০০৫৪৩
দুই সন্তানের বাপ আমি
পরের গ্রীষ্মে জন্ম নেবে আর একজন
তাকেও তুমি ঘেন্না করবে নাকি
যেভাবে আমাকে করো?’
আর একজন লিখেছেন বাংলায়,
‘আমাগো তোমরা গাইল পার
লাগলে লাথিও মার।
নীরবে কিন্তু আমরা তোমাগ
অট্টালিকা রাস্তা, দালান বানাইতে থাকুম
তোমাগ অস্থির, ঘামে ভিজা, চর্বিযুক্ত
শরীলডারে আমরা কিন্তু রিক্সায় টানতে থাকুম
তোমাগ তাজা সবজি ফলমুল খিলামু
টপাজুরি চরের গাখির, ঘি, সরও খিলামু।’
অসমিয়া জনজীবন সচল রাখতে, ঘরে ঘরে দৈনন্দিন খাবার পৌঁছে দিতে এই সব মিয়া বাঙালিরাই কিন্তু ভরসা। ওরা কাজ করে নগরে প্রান্তরে।
এমন কি যে বৃহত্তম ডিটেনশন ক্যাম্পটি তৈরি হয়েছে গোয়ালপাড়া সীমান্তে তারও মজুর কিন্তু এই বিদেশি তকমাধারী বাঙালি মিয়া।
মিয়ারাই এখন বড় শত্রু। বিভেদের চিরাচরিত নীতি মেনে বলা হচ্ছে, হিন্দু বাঙালিদের সুরক্ষা দেওয়া হবে মিয়াদের নয়। শরিকদল অগপ বলছে মানবে না, তাদের কাছে বাঙালি মানেই বিদেশি, হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে। এখন এক অস্থির সময়, কেন্দ্র কিংবা রাজ্য হোক কোনো সরকারই সংবিধানসম্মত কথা বলে না। বিজেপি বললেই যেন হিন্দুকে সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব, ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ১৯৫৫-র নাগরিক আইনের সংশোধনী চেয়ে নতুন নাগরিকত্ব বিল ২০১৬ এখন সংসদের বিচারাধীন। প্রস্তাবিত বিলে মুসলমান ও নাস্তিক ছাড়া অন্য ধর্মাবলম্বী যেমন হিন্দু শিখ বৌদ্ধ জৈন পার্শি এবং খ্রিস্টান যারাই আফগানিস্তান বাংলাদেশ ও পাকিস্তান থেকে আগত অবৈধ অনুপ্রবেশকারীরা ভারতীয় নাগরিকত্বের দাবিদার হতে পারবে। দাবিদার হতে পাবরে কিন্তু নাগরিকত্ব পাবে না। এককথায় ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্বের টোপ ধর্মদেশ হিন্দুস্থানে। ভারতীয় সংবিধানের প্রস্তাবনা ও অনুচ্ছেদ ১৪-র ধর্মনিরপেক্ষতার নীতিবিরোধী। নতুন নাগরিকত্ব আইন আর রাজীব গান্ধির আসাম চুক্তি আইনের ফারাকটাও কিছুতেই ঘুচছে না। নতুন আইন পুরনোকে খারিজও করছে না। শুধু হিন্দু ভোটারকে দিল্লির মোয়া দেখিয়ে ২০১৯-এর ভোট বৈতরণী পার হওয়া। প্রতিবেশী রাজ্যের এক বাঙালি রাজ্যপালও স্পর্ধাভরে বলে দিলেন এতো কিসের জাত্যভিমান, ওসব ভুলে অসমিয়া ভাষা গ্রহণ করলেই তো পারে আসামের বাঙালি। কী সহজ সমাধান, বাঙালির শত্রু বাঙালি না হইলে কে হইবে।
সে সব সত্য জানে বিজেপি, জানে বলেই মিথ্যার মতো স্তোকবাক্যে ভুলিয়ে রাখছে বাঙালিকে। এক গৃহযুদ্ধের পরিবেশ তৈরি করেছে, দ্বিতীয় এবং চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের আগে সেনাবাহিনির মহড়া দেওয়ানো হয়েছে। আসামের বাঙালির শঙ্কা সত্য করে কোটি না হোক পঞ্চাশ লক্ষ বাঙালিও যদি নাগরিকত্ব বঞ্চিত হয়, খোঁয়াড়ে পুরে দেওয়া হয় বিনাশের পথে, তার দায় কার উপর বর্তাবে। দেশভাগের কুচক্রীরা তো এখন আর ধরাছোঁয়ায় নেই সুতরাং এসব অতীতমুখি ক্রোধেরও কোনো ভিত্তি নেই।
এত করেও কিছু হয় না দেখে মরিয়া উগ্র জাতীয়তাবাদীর দল বাঙালি শায়েস্তা করতে শেষ অস্ত্র প্রয়োগ করে এনআরসি নবায়ন চক্রান্তে। ভারতবর্ষে কোথাও যা হয় নি, আসামে তাই হয়। আসাম জাতীয় নাগরিক পঞ্জি নবায়নের নামে আসামের বৃহৎ বাঙালি জনগোষ্ঠীকে দেশহীন নাগরিক করার এক অভিসন্ধির সূত্রপাত হয় রাষ্ট্রশক্তির মদতে। বিদেশি শনাক্তকরণ প্রক্রিয়া। ১৯৫১-র নাগরিক পঞ্জিতে যার নাম আছে কিংবা ১৯৬৬-র ভোটার সূচিতে যার নাম আছে কিংবা ১৯৭১-এর ২৪ মার্চ মধ্যরাত পর্যন্ত যে এদেশের নাগরিক সে-ই বৈধ নাগরিক হিসাবে গ্রাহ্য হবে। এ হল ভিত্তি বর্ষ। ২৫ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের নামে রাষ্ট্র অস্তিত্বহীন হয়ে যাওয়ায় দায়দায়িত্ব থাকল না, যুক্তি কয় এরে। চুক্তির পর সব চলছিল যেমন চলে, ঢিমেতালে। বাঙালিও নিশ্চিত ছিল এসব কী মুখের কথা ভেবে। লক্ষ লক্ষ বাঙালি বিতাড়ন কি সম্ভব, কোথায় যাবে এরা। কে নেবে, যেমন আছে তেমনই থাকবে অসমের স্বদেশে। অতিপ্রত্যয়ী ছিল বাঙালি, কিছুই হবে না। তখনই ছাত্রনেতারা আবার ভোটের রাজনীতিতে নড়ে চড়ে বসে। আসুর ছাত্র নেতা সর্বানন্দ সোনোয়াল সুপ্রিম কোর্টে মামলা করেন ইললিগ্যাল মাইগ্রেণ্টস (ডিটারমিনেশন বাই ট্রাইব্যুনাল) অ্যাক্ট ১৯৬৩ বা আইএমডিটি অ্যাক্ট বাতিল করে তথাকথিত বিদেশি বিতাড়ন ত্বরান্বিত করতে, এবং তিনি জিতেও যান। তখন ডি ভোটার মানে ডাউটফুল ট্যাড়া পড়ত শুধু ভোটার তালিকায়। সন্দেহজনক নির্বাচক। এখন বলা হল সুপ্রিম কোর্টের তত্ত্বাবধানে এনআরসি হবে মানে আসামের জন্য ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেন্স। এবং ভূতের বদ্যিরা বিদেশি বাছাই করতে সবরকম সর্বে ঝাড়াই বাছাই শুরু করলেন। উত্তরাধিকার সূত্র বা লিগ্যাসি ডাটা তারপর বংশবৃক্ষ তৈরি করে দিতে হবে, সেই বংশের ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা বংশধরদের যাতে এক গাছের তলায় পাওয়া যায়, নইলে বিদেশি, ঠাঁই খোঁয়াড়ে, ডিটেনশন ক্যাম্পে। এতসব পরীক্ষা নিরীক্ষার পর ৩১/১২/২০১৭-তে খসড়া পঞ্জি প্রকাশিত হয়। বাকি থাকে এক কোটি ঊনচল্লিশ লক্ষ আবেদনকারির নাম। যার মধ্যে বেশির ভাগই বাঙালি কারণ অসমীয়ারা যে রাজার জাত তারা অরিজিননেল ইনহ্যাবিটেণ্ট বা ওআই। তাদের জন্য কোনো বাছবিচার নেই। বাঙালি এনওআই মানে ‘নন' আদি বাসিন্দা বা খিলঞ্জিয়া নন। এবার দ্বিতীয় এবং চূড়ান্ত পঞ্জি প্রকাশিত হওয়ার কথা ত্রিশ জুন ২০১৮। যাদের নাম থাকবে না তাদের কী হইবে তবে। ভাবতেও ভয় হয়, নব রোহিঙ্গিয়া বাঙালির জন্য হচ্ছে বড় বড় ডিটেনশন ক্যাম্প। এশিয়ার সর্ববৃহৎ। ওখানে থাকবে সর্ব সুখ, ভাত কাপড় শুধু আর কিছু না। যতদিন পর্যন্ত অপুষ্টিতে ভোগে মৃত্যু না হয়। কোনো নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্য থাকবে না। সমস্ত নাগরিক পরিষেবার জন্য এনআরসি বাধ্যতামূলক হয়ে যাবে। ভারতে আধার আসামে এনআরসি। উচ্চতম ন্যায়ালয়ের নির্দেশে নিযুক্ত এনআরসি সমন্বয়ক প্রতীক হাজেলা বাবু জানিয়েছেন যাদের নাম থাকবে না তাদের গতিবিধি নিয়ন্ত্রিত হবে। রেল বাস ট্রেনের টিকিট কাটতে এনআরসি পড়াশোনায় এনআরসি ব্যাবসা করতে এনআরসি এমনকি চিকিৎসা পরিষেবা পেতেও চাই এনআরসি। জার্মানির আউসভিৎসের বৃহৎ সংস্করণ রচিত হচ্ছে পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের অঙ্গরাজ্য আসামে। এসব ঘটতে চলেছে একুশে ফেব্রুয়ারি আর উনিশে মের উজ্জ্বল উত্তরাধিকারকে রহস্যময় অন্ধকারে ডুবিয়ে দিতে, নিজ দেশে বাঙালিকে পরবাসী করে রাখতে। অসম দেশে বাঙালির অখণ্ড সত্তা এখন ধ্বংসের মুখোমুখি এক পরিকল্পিত নিধনযজ্ঞের আয়োজনে। আসামের বাঙালি সেদিনও, উনিশে মের আন্দোলন করেছে শান্তিপূর্ণ, ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে। এখন হাজারো অজুহাতে দেশহীন সাব্যস্ত করার প্রক্রিয়াকেও শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদ করছে, একবারও বিচার ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন করেনি, প্রশাসনিক ব্যবস্থায় সমর্থন ও সহযোগিতা করেছে, লিগ্যাসি ডাটা আর বংশবৃক্ষ নিয়ে হাজার মাইল দূর পর্যন্ত ছুটে গেছে। আইন হাতে তুলে নেওয়ার কথা ভাবেনি, আসাম থেকে পৃথক হয়ে যাওয়ার কথা ভাবেনি। যদিও বাঙালি জানে খাদের কিনারায় গেলে ঘুরে দাঁড়াতেই হবে, যদি না রাষ্ট্র তার নাগরিককে সুরক্ষা দিতে পারে। হিন্দু মুসলমান বিভাজন না করে। ভাওতায় বলা হচ্ছে হিন্দুদের ভয় নেই, ওরা ভারতীয় নাগরিকত্ব পাবে। মুসলমানদের ফিরে যেতে হবে। এখন আরএসএস পড়েছে ফাঁপড়ে। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রে তো তা সম্ভব নয়, অন্যান্য রাজনৈতিক দলও তথৈবচ, ভোট বড় বালাই। কংগ্রেস আর বামপন্থীদের অবস্থা শ্যাম রাখি না কুল, বরাক উপত্যকায় একরকম ব্রহ্মাপুত্রয় ভিন্ন। সংখ্যাগুরুকে ছেড়ে যায় না ভোটের কাঙালি। তার মানে, অসহায় বাঙালিকে একা চলতে হচ্ছে, তোর ডাক শুনে যদি কেউ না আসে তবে একলা চলো রে। গণতন্ত্রের চার চারটি স্তম্ভই আসামে নড়বড়ে, বাঙালির বিপক্ষে। তবুও অনন্ত জাগে। আছে ভারতের সংবিধান গ্রন্থিসূত্র হয়ে। তাই হয়তো সাময়িক মানসিক যন্ত্রনায় ফেলা যাবে, নিঃশেষ করা যাবে না পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম ভাষাগোষ্ঠীকে।
আইনের দরজায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষায় আছে বাঙালি। বিশ্ববরেণ্য কথক কাফকার মোক্ষম উচ্চারণ ছিল তাঁর সৃষ্টিতে এক রূপক অণু আখ্যানে। হয়তো লেখকের ব্যক্তিগত সংকটের কথাই রহস্যের মোড়কে ঢেকে দিয়েছিলেন। তিনি ছিলেন জার্মান ভাষার সাহিত্যিক। জন্মেছিলেন দেড়শ বছর আগে বোহেমিয়ায়। তার মাতৃভাষা কিন্তু জার্মান ছিল না, আসামেও অনেক বাঙালি যারা অসমীয়া বাংলা দুই ভাষায় লিখেছেন এখনও লিখছেন, সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার পেয়েছেন অসমিয়া থেকে বাংলায় অনুবাদ করে। সেই বোহেমিয়ায় জন্ম লেখকের ইহুদি হওয়ার জন্য জার্মানিতেও দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হয়ে ছিলেন, গেস্টাপোরা তার লেখালেখি ছিনিয়ে নিয়ে যায়। তবু তিনি জার্মান ভাষার আনুগত্য ছাড়েন না, মার্কসবাদে দীক্ষিত ছিলেন যে। তার কিছু ব্যক্তিগত সমস্যা ছিল, পিতার সঙ্গে অবনিবনা, সুস্বাস্থ্যও ছিল না, টিবি রোগী ছিলেন, প্রেম করেছেন গণ্ডায় গণ্ডায়, বিয়ে করতে ভয় পেয়েছেন, বেশ্যাগমন করেছেন। আবার প্রিয় বন্ধুতে অনুগত থেকেছেন। একটি কল্পিত বিচারের আখ্যান কথা লিখেছেন। মানবিক সম্পর্কের ক্ষয় দেখাতে যুবা নায়কের মাকড়সার মতো পোকায় রূপান্তরের গল্প লিখেছেন। সেই তিনি একসময় দুম করে বলে বসলেন, চলে যাবেন তেল আবিব, নিজের দেশ গড়তে দেশ খুঁজতে চলে গেলেন, নিজের মাতৃভাষা হিব্রুতে লিখতে শুরু করলেন। তারপর একসময় ক্ষয়রোগে মারাও গেলেন। বন্ধুকে বলেছিলেন মৃত্যুর পর যেন তার সব লেখাপত্র পুড়িয়ে ফেলা হয়, বিশ্বসাহিত্যের পাঠক সেই বন্ধুর প্রতি কৃতজ্ঞ যে তিনি কথা রাখেননি। তাঁর রচনা আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি। সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে নিরসনের পথ খোঁজার চেষ্টা করতে পারছি। নিজ দেশে পরবাসী হয়ে জন্মালেন, লিখেছিলেন মানবিকতার অমানবিক মুখ।
আসল কথা, শোনাতে হবে, বলার মতো করে বলতে হবে, যার যেমন অস্ত্র তাই দিয়ে লড়তে হবে, লিখতে হবে, একা না পারলে সমবায়ী প্রচেষ্টায় আমরা বলতে পারি যথেষ্ট হয়েছে আর নয়। এত আস্ফালন ভালো নয় রাষ্ট্রশক্তি। ইহুদি হত্যার শাস্তি তো পেতে হয়েছিল হিটলারকে।
ফ্রানজ কাফকার রূপক অণুগল্প ‘বিফোর দ্য ল’র সারকথাটি এখানে বলে দেওয়া প্রাসঙ্গিক হবে,
একটা লোক আইনকে জানার জন্য যায় আইনের দরজায় যেমন গিয়েছিল উপনিষদের নচিকেতা। তাকে যেতে দেওয়া হয় না, আটকে রাখা হয় একটেরেতে, তারও একই গোঁ সে জানতে চায়, সে দরজা খুলে ঢুকতে চায়। তাই সে ধর্নায় বসে যায় আর একদিন মারাও যায়। তবে মরার আগে জেনে যায় যে আর কাউকে কোনোদিন আইনের দরজায় ধর্নায় বসতে দেওয়া হবে না বলে দরজাটি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে কারণ ওটা বানানোই হয়েছিল তার জন্যে।
রূপক গল্পের নায়ক যুগে যুগে পালটায়। এবার কিন্তু মরার আগে আর মরবে না বাঙালি, আইনের দরজাই পথ দেখাবে আসামের বিপন্ন বাঙালিকে।
তাই, এগিয়ে যাওয়াই একমাত্র পথ, প্রতিরোধ সম্বল, বিশ্বের এক বিপন্ন কোণঠাসা জনগোষ্ঠী আত্মরক্ষায় নিজস্ব স্বদেশের দাবি করতেই পারে। পৃথক রাজ্য হোক তবে বরাক উপত্যকায়। ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় অনুরূপ স্বদেশের তোড়জোড় করারও সময় অতি নিকট এখন। এতদিন তো বিনীত ভাবে বলা হয়েছে আসাম চুক্তি আমরা মানি না। বাঙালিকে বিদেশি তকমা দিয়ে সন্ত্রস্ত করে নির্মূল করার অপচেষ্টা সমূলে উৎপাটিত করতে হবে, এবার হবে গর্জন। উনিশে মের গণজাগরণকে একবার ভয় পেয়েছিল আসামের উদ্ধত রাষ্ট্রশক্তি, সেই মন্ত্র নিয়ে আবার জেগে ওঠার সময় এখন আসামের অখণ্ড বাঙালির।