উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/কবিতা ও গান/কমলা নাপিত

কম্‌লা নাপিত

ঘোড়া চেপে কম্‌লা নাপিত যাচ্ছে তাড়াতাড়ি,
রাত না হতেই কোনমতে ফিরতে হবে বাড়ি।
বন-জঙ্গল পেরিয়ে যেতেই সন্ধ্যা হল অতীত,
বনের পাশের গাঁয়ে গিয়ে রাত্রে হল অতিথ।
রাত পোহাবার আগে ঘরে না ফিরলেই নয়,
যেতেই হবে শেষ রাত্রে, ভাবল কিসের ভয়?
বাঘ একটা এমন সময় ঘোড়ার গন্ধ পেয়ে,
বন থেকে এল চলে আস্তাবলে ধেয়ে।
কম্‌লা নাপিত উঠে তখন লাগাম চাবুক নিয়ে,
ঘোড়ায় চড়বে বলে হাজির আস্তাবলে গিয়ে।
বাড়ির লোক বলে, “কমল, রাত্রে কোথা যাবে?
পথে আছে বন-জঙ্গল, বাঘে ধরে খাবে।”
হেসে বললে কম্‌লা নাপিত, “আমি বাঘের চাঁই,
বাঘের ঘাড়ে চড়ি আর সিংহ ধরে খাই।”
চাঁইয়ের কথা শুনে বাঘ বিপদ গণে মনে,
ভয়ে হয়ে জড়সড় দাঁড়াল এক কোণে।
“আয়, ঘোড়া, আয়” বলে কথা কয় মিঠে।
আঁধার ঘরে দিল হাত বুড়া বাঘের পিঠে।
থরহরি কাঁপে বাঘ, লাগাম নিল মুখে,
কম্‌লা নাপিত বসল তার পিঠে চেপে সুখে।
বাঘ দেখলে কম্‌লা নাপিত! নয়কো বাঘের চাঁই।
কম্‌লা নাপিত দেখলে বাঘ! ভাবে কোথা যাই।
ধরে একটা আমের ডাল, লাফিয়ে উঠল গাছে,
রেগেমেগে বাঘ তখন গেল বনের মাঝে।
যেতে যেতে বললে বাঘ, “তুই একটা ঠক ত!
আচ্ছা থাক। বাগে পেলেই খাব তোর রক্ত।”

(২)


একদিন কিনা কম্‌লা নাপিত লাঙ্গল নিয়ে কাঁধে
ক্ষেতে গেছল চাষ করতে। আব কে লাঙ্গল ফাঁদে।
বাঘ এসে বললে তখন, “তুই না বেটা চাঁই?
কোথা যাবি কম্‌লা নাপিত, তোরে ধরে খাই!”

নাপিত বললে, “ওরে বাঘ! তুই যে ভারি বোকা!
ভরবে না পেট এখন খেলে, দেখছিস্‌ আমি রোগা।
ধান হলে ভাত খেয়ে হব মোটা তাজা;
তখন বরং আমায় খেয়ে দিস্ রে ব্যাটা সাজা।”
বাঘ ভাবলে ভালই কথা, “ধান হবে কবে?”
“তোমরা এসে লাঙ্গল টান, জলদি হবে তবে।”
বুড়া বাঘ বন থেকে আরেক বাঘ এনে,
চাষ করে দিল ক্ষেত, লাঙ্গল টেনে টেনে।
তারপরে হল ধান; বাঘেরা সব মিলে
ধানের বোঝা বয়ে নিয়ে ঘরে পৌছে দিলে।
ঘরের দুয়ার বন্ধ করে বললে নাপিত আস্তে,
“ল্যাজে বেঁধে ফুটো দিয়ে, দাও ত বাঘ, কাস্তে।’
বুড়া বাঘ লেজ বাড়িয়ে কাস্তে যেই দিল,
অমনি নাপিত কুচ করে লেজটি কেটে নিল।
বেজায় রেগে বাঘের পাল বলে, “ওরে দুষ্ট!
বাগে পেলেই করব তোরে ভাত খাইয়ে পুষ্ট!”
বনে গেলে বাঘের পাল, নাপিত বলে হেসে—
“আমি হচ্ছি বাঘের চাঁই, নইকো আমি যে সে।”

(৩)



জামালপুরের বাজার থেকে ফিরছে নাপিত একা,
ঘিরল তারে বাঘের পালে লাগল ভেবা-চাকা!
তালের গাছ ছিল সেথা চন্দনা তীরে,
উঠল নাপিত সেই গাছে, বাঘ বলল, “কি রে,
গাছে উঠেই পার পাবি? একের পিঠে অন্যে
উঠে আজকে ধরব তোরে, এসেছি স-সৈন্যে।”
বাঘের উপর উঠছে বাঘ, বুড়া রইল নীচে,
নাপিত দেখলে এখন আর ভাবা-চিন্তে মিছে।
ক্ষুর দিয়ে তালের কাঁদি কেটে নিয়ে ধীরে
বললে, “আজ বাঘের মবণ ভরা গাঙ্গের তীরে।
ব্রহ্ম তাল, বিষ্ণু তাল, আব তাল হেঁড়ে,
পড় গিয়ে বাঘের ঘাড়ে, নীচে আছে বেঁডে!"
লেজকাটা ভাবল মনে আমায় মাল্লে আগে,
অমনি কিনা বুড়ো বাঘ জলদি করে ভাগে।
টপাটপ পড়ল বাঘ, মরল আছাড় খেয়ে,
বেঁড়ে পড়ল হোঁচট খেয়ে, নাপিত চলল ধেয়ে।

ক্ষুর দিয়ে গলা কেটে, চন্দনার জলে
ফেলে দিল যত বাঘ। জিৎ বুদ্ধির বলে