উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/গল্পমালা/ছোট ভাই

লুয়া ত্রুটি মডিউল:Header_template এর 348 নং লাইনে: bad argument #1 to 'next' (table expected, got nil)।

ছোট ভাই

 সাতটি ভাই ছিল, তাহাদের সকলের ছোটটির নাম ছিল রুরু। দেশের মধ্যে তারা সাতটি ভাই দেখতে আর সকল ছেলের চেয়ে সুন্দর ছিল; তাদের মধ্যে আবার রুরু ছিল সকলের চেয়ে সুন্দর। রুরুকে সকলেই কেন এত সুন্দর বলে আর তাদের বলে না, এই জন্য রুরুর বড় ভাইয়েরা তাকে বড্ড হিংসা করত। ভাল ভাল কাপড়গুলো সব তারা ছ’জনায় পরে বেড়াত, রুরুকে পরতে দিত শুধু ছেঁড়া ন্যাকড়া। যত বিচ্ছিরি নোংরা কাজ, সব তারা রুরুকে দিয়ে করাত, আর নিজেরা বাবুগিরি করে বেড়াত। তবু সকল লোকে রুরুকেই বেশি ভালবাসত, বড় কটিকে কেউ দেখতে পারত না। তাতে তারা আরো চটে রুরুকে যখন তখন ধরে ঠ্যাঙাত। বেচারাকে এক দণ্ডও সুখে থাকতে দিত না।

 রুরুদের গ্রাম থেকে ঢের দূরে ররঙ্গা বলে একটি মেয়ে থাকত। এমন সুন্দর মেয়ে এই পৃথিবীতে আর কোথাও ছিল না। তার কথা শুনেই রুরুর দাদারা বলল, ‘চল্, আমরা সেই মেয়েকে দেখতে যাব। আমাদের মত সুন্দর ছেলে আর কোথায় আছে?আমাদের দেখলেই নিশ্চয় সেই মেয়ে আমাদের একজনকে বিয়ে করে ফেলবে।’

 তখন ত তাদের খুবই আনন্দ আর উৎসাহ হল। ছ’জনের প্রত্যেকে ভাবল, ররঙ্গা নিশ্চয়ই আমাকেই বিয়ে করবে। কত গহনা এনে যে তারা তাদের ছ’টি পুঁটুলির ভিতরে পুরল, তার লেখাজোখা নেই। মস্ত বড় পানসি তাদের জন্য তয়ের হল। ছ’ভাই মিলে আজ কতরকম করেই পোশাক পরেছে আর চুল আঁচড়েছে; একটু পরে পানসিতে চড়ে বউ আনতে যাবে।

 তাদের মা জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হ্যাঁরে, তোরা রুরুকে সঙ্গে নিবি না?’ অমনি তারা ছ’জন একসঙ্গে বলল, ‘নেব বইকি। নইলে আমাদেব রান্না কে করবে? ররঙ্গাকে দেখতে যাবার সময় আমরা তাকে আমাদের বাসায় রেখে যাব। ও যে ছেঁড়া কাপড় পরে, ও আমাদের ভাই, এ কথা জানলে লোকে কি বলবে?’

 রুরু সবই শুনল, কিন্তু কিছু বলল না। সেও তার দাদাদের সঙ্গে সেই পানসি চড়ে ররঙ্গাদের দেশে গিয়ে উপস্থিত হল। সেখানকার লোকেরা এর আগেই শুনতে পেয়েছিল যে, কয়েকটি খুব সুন্দর ছেলে তাদের দেশে বউ খুঁজতে যাচ্ছে। তারা সেই পানসি পৌছিবামাত্রই এসে রুরুর দাদাদের আদর করে তাদের গ্রামে নিয়ে গেল। সেখানে তারা বাড়ি ঘর সাজিয়ে মস্ত ভোজের আয়োজন আগেই করে রেখেছিল।

 ছ’ভাই হাসতে হাসতে দুলতে দুলতে তাদের সঙ্গে চলে গেল। রুরুকে বলে গেল, ‘আমাদের জন্য একটি বাসা ঠিক করে জিনিসপত্র তাতে নিয়ে রাখবি।’

 তারপর তাদের খাওয়া দাওয়া, আমোদ-আহ্লাদ খুবই হল। সেখানে অনেক মেয়ে ছিল, কিন্তু তাদের কোনটি যে ররঙ্গা, ছ’ভাইয়ের কেউ তা বুঝতে পারল না। তাদের প্রত্যেকেই তার পাশের মেয়েটিকে চুপি চুপি জিজ্ঞাসা করল, ‘কোন্‌টি ররঙ্গা?’ সেই মেয়েদের প্রত্যেকে বলিল, ‘আমিই ররঙ্গা কাউকে বোলো না।’

 এ কথা শুনে ত আর ভাইদের আনন্দের সীমাই রইল না। অত সহজে ররঙ্গাকে পেয়ে যাবে, তা তারা মোটেই ভাবে নি। তারা তখনই সেই মেয়েগুলোর সঙ্গে বিয়ের কথা ঠিক করে ফেলল। তাবপর কয়েক দিনের মধ্যেই তাদের বিয়ে হয়ে গেল। সকলেই ভাবল, ররঙ্গা কে বিয়ে করেছে। ঠকেছে যে, সে কথা কারুরই মনে হল না।

 রুরু বেচারা এত কথার কিছু জানে না, আর তার জানবার দরকারই বা কি? প্রথম দিন বাসা ঠিকঠাক কবে সে কলসী হাতে জল আনতে বেরিয়েছিল। জল কোথায় আছে তা ত সে আর জানে না, তাই সে একটি ছোট্ট মেয়েকে জিজ্ঞাসা করল, ‘হ্যাঁ গা, কোথায় জল পাব?’ মেয়েটি বলল, ‘ঐ যে ররঙ্গার বাড়ি, তারই পাশে ঝবনা আছে।’

 রুরু সেই দিকে জল আনতে চলল। যেতে যেতে সে ভাবল, ‘ররঙ্গা ত ভোজে গিয়েছে এর মধ্যে আমি একটু উঁকি মেরে দেখে নিই না, তার বাড়িটি কেমন।’ এই ভেবে সে আস্তে আস্তে সেই ঘরটির দরজার কাছে গিযে উঁকি মারল। উঁকি মেরে আর তার সেখান থেকে চলে আসবার কথা মনে বইল না। সে দেখল, ঘরের ভিতরে ররঙ্গা বসে আছে! নিশ্চয়ই সে ররঙ্গা নইলে এত সুন্দর আর কে হবে?

 ররঙ্গা তাকে দেখেই ভারি খুশি হয়ে অমনি তাকে ডাকল, ‘এসো, এসো, ঘরে এসো।’ রুরু জড়সড় হয়ে ঘরে গেল। তখন ররঙ্গা জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি কে?’ রুরু বলল, ‘সেই যে ছ’জন লোক বউ খুঁজতে এসেছে, যাদের জন্য ভোজ হচ্ছে, আমি তাদের ছোট ভাই।’ ররঙ্গা বলল, ‘তুমি কেন তবে ভোজে যাও নি?’ রুরু বলল, ‘আমাকে তারা নিয়ে যায় নি, কাজ করবার জন্য বাসায় রেখে গেছে। আমার এর চেয়ে ভাল কাপড় নেই। এগুলো কাজ করতে করতে ময়লা হয়ে ছিঁড়ে গেছে।’

 রুরুকে দেখেই ররঙ্গার যার পর নাই ভাল লেগেছিল, তার কথা শুনে তার বড়ই দুঃখ হল। সে বুঝতে পারল যে রুকর দাদারা বড় দুষ্টু, তাকে কষ্ট দেয়। তখন রুরুকে তার আরো ভাল লাগল। দুদিন পরে তাদের বিয়েও হয়ে গেল।

 তার পরদিন রুরুর দাদারা বউ নিয়ে ঘরে যাবে। রুরু যে তার আগেই ররঙ্গাকে নিয়ে নৌকার তলায় লুকিয়ে রেখেছে, সে কথা তাদের কেউ টের পায় নি। তারা ভারি ধুমধাম করে দেশে এল। তারপর বউ নিয়ে বাড়িতে পা দিয়েই সকলের বড় ভাই তাদের মাকে বলল, ‘এই দেখ মা, ররঙ্গাকে বিয়ে করে এনেছি।’ অমনি তার ছোটভাই তার চেয়ে বেশি করে চেঁচিয়ে বলল, ‘না মা, ও মিছে কথা বলছে, আমি ররঙ্গাকে এনেছি।’

 তখন ত ভারি মজা হল। সবাই বলছে, ‘ওদের কথা মিথ্যে, আমি ররঙ্গাকে এনেছি।’

 ভয়ানক চটাচটি, মারামারি হয় হয়। বউ কটি থতমত খেয়ে মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে, তারা ভাবেনি যে অত সহজে ধরা পড়ে যাবে।

 তখন মা বললেন, ‘বাবা, ররঙ্গা ত ছটি নয়, আর এদের একটিও তেমন সুন্দরী নয়। তোমরা ঠকে এসেছ।’ রুরু এতক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়েছিল, মার কথা শুনে সে বলল, ‘ঠিক বলেছ মা, ঠকে এসেছে। আমার সঙ্গে এসো, আমি ররঙ্গাকে দেখিয়ে দিচ্ছি।’

 এ কথায় রুরুর দাদারা ত হেসেই গড়াগড়ি দিতে লাগল; কিন্তু মা বললেন, ‘আচ্ছা গিয়েই দেখি না।’ বলেই তিনি রুরুর সঙ্গে নৌকোয় এলেন, আব একটিবার ররঙ্গার মুখের দিকে চেয়েই তাকে কোলে নিয়ে আনন্দে নাচতে লাগলেন। সে খবর দেখতে দেখতে গ্রামময় ছেয়ে ফেলল। তখন পাড়ার ছেলে বুড়ো, গিন্নি বউ সকলে ছুটে এসে ররঙ্গাকে ঘিরে নাচতে লাগল।

 এ-সব দেখে দাদারা চোখ লাল করে, দাঁত খিচিয়ে তাদের স্ত্রীদের বলল, ‘বটে? ফাঁকি দিয়েছিস?’ শুনে সকলে হো হো করে হাসল। তাদের মা বললেন, ‘আর কেন বাছা চুপ করো! তোমরা যেমন, তোমাদের তেমনি জুটেছে।’