উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/গল্পমালা/ঝানু চোর চানু

লুয়া ত্রুটি মডিউল:Header_template এর 348 নং লাইনে: bad argument #1 to 'next' (table expected, got nil)।

ঝানু চোর চানু

 ছেলেবেলা থেকেই চানু শয়তানের একশেষ, আশপাশের লোকজন তার জ্বালায় অস্থির। চানুর বাবা বড় গরিব ছিল, চানু ভাবল—বিদেশে গিয়ে টাকা পয়সা রোজগার করে আনবে। যেমন ভাবা তেমনি কাজ, একদিন সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়ল। খানিক দূর গিয়েই বনের ভিতর দিয়ে একটা নির্জন রাস্তা—চানু সেই রাস্তা ধরে চলল। সমস্ত দিন বৃষ্টিতে ভিজে শ্রান্ত ক্লান্ত হয়ে সন্ধ্যার সময় পথের ধারেই একটি কুঁড়েঘর ছিল, সেখানে এসে উপস্থিত।

 ঘরের ভিতরে আগুনের পাশে একটি বুড়ি বসেছিল, চানুকে দেখে জিজ্ঞাসা করল, ‘কি চাই বাপু তোমার?’

 চানু বলল, ‘চাইব আর কি, কিছু খাবার দাবার চাই, আর একটি বিছানা চাই।’

 বুড়ি বলল, ‘সবে পড় বাপু, এখানে কিছু পাবে না। আমার ছয়টি ছেলে, সারা দিন খেটেখুটে তারা এখনই বাড়ি ফিরবে। তোমাকে এখানে দেখতে পেলে তারা তোমার গায়ের চামড়া তুলে ফেলবে।’

 চানু। সেটা আর বেশি কথা কি? এই ঠাণ্ডায় বাইরে গাছের তলায় দাঁড়িয়ে মরার চাইতে গায়ের চামড়া তুলে ফেলবে সেইটাই বরং ভাল।

 বুড়ি দেখল সে সহজ লোকের পাল্লায় পড়ে নি; কি আর কবে, তখন চানুকে পেট ভরে খেতে দিল। শুতে যাবার সময় চানু বুড়িকে বলল, ‘দেখো বুড়ি! তোমার ছেলেরা এসে যদি আমার ঘুম ভাঙায় তা হলে কিন্তু বড় মুশকিল হবে বলছি।’

 পরের দিন ঘুম ভাঙলে চানু দেখল ছয় জন অতি বদ-চেহারার লোক তার বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে—সে তাদের দেখে গ্রাহ্যও করল না।

 দলের সর্দারটি তখন চানুকে জিজ্ঞাসা করল, ‘তুমি কে হে বাপু? কি চাও এখানে?’

 চানু। ‘আমার নাম সর্দার চোর, আমার দলের জন্য লোক খুঁজে বেড়াচ্ছি। তোমরা যদি চালাক চতুর হও তা হলে তোমাদের অনেক বিদ্যে শিখিয়ে দেব।’

 সর্দার বলল, ‘আচ্ছা বেশ, তুমি তা হলে এখন উঠে একটু খাও-দাও, তারপরে দেখা যাবে এখন কে সর্দার।’

 বিছানা থেকে উঠে সকলের সঙ্গে বসে চানু খেল। ঠিক তারপরই সকলে দেখল একটা সুন্দর ছাগল সঙ্গে নিয়ে একজন কৃষক বনের পাশে যাচ্ছে। তখন চানু বলল, ‘আচ্ছা তোমাদের কেউ কোনরকম জবরদস্তি না করে শুধু ফাঁকি দিয়ে ঐ লোকটার ছাগলটা নিয়ে আসতে পার?’ একজন একজন করে সকলেই বলল, ‘না ভাই, আমরা কেউ তা পারব না।’

 চানু। ‘বাস, তা হলেই দেখো আমি তোমাদের সর্দার কিনা—আমি এখনি ছাগলটা নিয়ে আসছি।’ এই বলে সে তখনই বনের ভিতর দিয়ে গিয়ে রাস্তার মোড়ে তার ডান পায়ের জুতোটা রেখে দিল, তারপর ছুটে গিয়ে কিছুদুর রাস্তার আর একটা মোড়ে বাঁ পায়ের জুতোটাও রেখে রাস্তার ধারে বনের ভিতর চুপ করে লুকিয়ে রইল।

 খানিক পরেই সেই কৃষক এসে প্রথম জুতোটা দেখে মনে করল, ‘খাসা জুতোটা পড়ে রয়েছে কিন্তু এক পাটী দিয়ে কি হবে, আর এক পাটীও থাকলে ভাল হত।’

 খানিক দূর এগিয়ে গিয়ে কৃষক আর-এক পাটী জুতো দেখে ভাবল, ‘আমি কি বোকা, ও পাটীটা যদি নিয়ে আসতাম। যাই, তা হলে ওটা নিয়ে আসি গিয়ে।’ একটা গাছে ছাগলটা বেঁধে সে চলল জুতো আনতে। এদিকে চানু কিন্তু ছুটে গিয়ে আগেই সেটা নিয়ে এসেছে। তারপর কৃষক ছাগলটাকে বেঁধে রেখে যখন চলে গেল তখন চানুও বাঁ পায়ের জুতোটা নিয়ে ছাগলটার বাঁধন খুলে সেটাকেও নিয়ে বনের ভিতর দিয়ে বুড়ির কুটিরে এসে উপস্থিত।

 কৃষক গিয়ে প্রথম জুতোটাও পেল না, ফিরে এসে পরের জুতোটাও পেল না, তার উপর আবার যখন দেখল যে ছাগলটিও সেখানে নেই, তখন সে ভাবল, এখন করি কি? গিন্নীকে যে বলে এসেছি বাজারে ছাগলটা বেচে তার জন্যে একখানা গায়ের চাদর কিনে নিয়ে যাব! যাই তা হলে, চুপচাপ গিয়া আর-একটা জন্তু নিয়ে আসি, তা নইলে যে ধরা পড়ে যাব—গিন্নী ভাববে আমি বোকার একশেষ।

 এদিকে চানু ছাগল নিয়ে বুড়ির বাড়িতে যখন গেল তখন সেই চোরেরা ত একেবারে অবাক! চানুকে কত করে জিজ্ঞাসা করল, কিন্তু কিছুতেই সে বলল না কি করে সেই ছাগল আনল।

 খানিক বাদেই সেই কৃষক একটা মোটাসোটা সুন্দর ভেড়া নিয়ে এসে উপস্থিত। চানু বলল, ‘যাও দেখি, কে জবরদস্তি না করে ভেড়টা আনতে পারে।’ ছয় চোরের সকলেই অস্বীকার করল। তখন চানু বলল, ‘আচ্ছা দেখি আমি পারি কি না, আমাকে একটা দড়ি দাও দেখি।’ দড়ি নিয়ে চানু বনের ভিতরে ঢুকে পড়ল।

 এদিকে কৃষকটি তার ছাগল চুরির কথা ভাবতে ভাবতে রাস্তা দিয়ে চলেছে, মোড়ের কাছেই এসে দেখে গাছের ডালে একটা মড়া ঝুলছে। মড়া দেখেই তার গায়ে কাঁটা দিল, ‘রক্ষা করো বাবা! খানিক আগে ত এখানে মড়া-টড়া কিছু দেখতে পাই নি!’ সামনের মোড়ে গিয়ে কৃষক দেখল আর-একটা মড়া গাছের ডালে ঝুলছে। ‘রাম রাম রাম— এ হল কি? আমার মাথাটা গুলিয়ে যায় নি ত?’ কৃষক তাড়াতাড়ি চলল। কিন্তু কি সর্বনাশ! রাস্তার আর-একটা মোড়ে গিয়ে দেখে সেখানেও একটা মড়া ঝুলছে! পর পর তিন তিনটে মড়া এতটা কাছাকাছি ঝুলছে দেখে তার মনে সন্দেহ হল—‘নাঃ, এ কখনই হতে পারে না। আমারই বোধ করি মাথা খারাপ হয়েছে। আচ্ছা দেখে আসি আগের মড়া দুটো এখনো গাছে ঝুলছে কি না।’ কৃষক সবে মাত্র মোড়টা ফিরেছে তখন ডালের মড়া চট করে নেমে এসে বাঁধন খুলে ভেড়াটাকে নিয়ে বনের ভিতর দিয়ে একেবারে বুড়ির বাড়ি হাজির।

 এদিকে কৃষক দেখল মড়া-টড়া কিছুই গাছে ঝুলছেনা। ফিরে এসে দেখল তার ভেড়াটাও নেই, কে জানি দড়ি খুলে নিয়ে চম্পট দিয়েছে। তখন তার মনটা কেমন হল তা বুঝতেই পার! বেচারি মাথা খুঁড়তে লাগল ‘হায়, হায়! কার মুখ দেখে আজ বেরিয়েছিলাম, এখন গিন্নি কি বলবে? সমস্ত সকালটাই মাটি হয়ে গেল, ছাগল, ভেড়া দুটোই গেল; এখন করি কি? একটা কিছু এনে বাজারে বিক্রি করে গিন্নির শাল না কিনলেই চলবে না। আসবার সময় দেখেছিলাম ষাঁডটা মাঠে চরে বেড়াচ্ছে, যাই, সেটাই নিয়ে আসি—গিন্নিও দেখতে পাবে না।’

 চানু যখন চোরদের বাড়ি ভেড়া নিয়ে গিয়ে উপস্থিত, তখন চোরদের আক্কেল গুড়ুম হয়ে গেল। সর্দার চোরটি বলল, ‘আর-একটা যদি চালাকি এরকম খেলতে পার তাহলে তোমাকেই আমাদের সর্দার করব।’

 ততক্ষণে কৃষকটিও ষাঁড় নিয়ে এসে উপস্থিত, চানু বলল, ‘যাও ত, জবরদস্তি না করে কে ষাঁড়টা ফাঁকি দিয়ে আনতে পার?’ কেউ যখন ভরসা পেল না তখন সে বলল, ‘আচ্ছা দেখি, আমি পাবি কি না।’ চানু বনের মধ্যে ঢুকে পড়ল।

 কৃষকটি খানিক দূর এগিয়ে গিযেই বনের মধ্যে একটা ছাগলের ডাক শুনতে পেল। ঠিক তার পবেই একটি ভেড়াও ডেকে উঠল। আর তাকে রাখে কে একটা গাছে ষাঁড়টাকে বেঁধে রেখে ছুটল বনের ভিতর। কৃষক যত যায় ততই শোনে এই একটু আগেই ডাকছে, দেখতে দেখতে প্রায় আধ মাইল দূরে চলে গেল। তখন হঠাৎ সব চুপচাপ, ভেড়া ছাগলের ডাক আর শুনতে পাওয়া গেল না। এদিক-সেদিক খুঁজে খুঁজে কৃষক একেবারে হয়রান হয়ে গেল কোথা বা ছাগল আর কোথাই বা ভেড়া। বেচারি কাহিল হয়ে আবার ফিরে এল। কিন্তু কি সর্বনাশ! এসে দেখে ষাঁড়টিও সেখানে নেই। বন উলট পালট করে ফেলল, কিছুতেই আর ষাঁড়ের খোঁজ পেল না।

 চানু যখন ষাঁড় নিয়ে এসে উপস্থিত তখন আর কথাটি নেই। চোরেরা চানুকে তাদের সর্দার করল। তাদের আনন্দ দেখে কে, সমস্তটা দিন আমোদ করেই কাটিয়ে দিল। লুটপাট করে চোরেরা যা-কিছু আনত একটা গহ্বরের মধ্যে সব লুকিয়ে রাখত, রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর তারা চানুকে নিয়ে সেই সমস্ত টাকাকড়ি সব দেখিয়ে দিল—চানুই যে এখন তাদের সর্দার, তাকে সব না দেখালে চলবে কেন।

 দলের সর্দার হবাব প্রায় এক সপ্তাহ পরে চোরেরা একদিন চানুকে বাড়ির জিম্মায় রেখে চুরি করতে গেল। খালি বাড়ি, চানু সেই শয়তান বুডিকে জিজ্ঞাসা করল, ‘আচ্ছা তুমি যে এদের ঘর-সংসার দেখ, এরা তোমাকে তার দরুন কিছু বকশিশ-টকশিশ দেয় না?’

 বুড়ি। ‘বকশিশ দেয়, না ওদের মাথা দেয়!’

 চানু। ‘বটে, কিচ্ছু দেয় না। আচ্ছা এসো আমার সঙ্গে, আমি তোমাকে ঢের টাকা দেব।’ বুড়িকে সঙ্গে করে চানু টাকার ঘরে গেল। জন্মেও বুড়ি এত ধন কোনোদিন দেখে নি— মুখ হাঁ করে সেই রাশি রাশি টাকা মোহরের দিকে বুড়ি খানিকক্ষণ চেয়ে রইল। তারপর বুড়ির আহ্লাদ আর ধরে না। হাঁটু গেড়ে মাটিতে পড়ে দুই হাতে টাকাগুলো ঘাঁটতে লাগল। সময় বুঝে চানুও তার পকেট বোঝাই ত করলেই, তারপর একটা থলে মোহর দিয়ে ভর্তি করে চুপি চুপি ঘর থেকে বেরিয়ে এসে বাইরের দিকে থেকে দরজায় চাবি লাগিয়ে দিল—বুড়ি সেই টাকার ঘরেই আটকা পড়ে রইল।

 বেরিয়ে এসেই চানু সুন্দর একটা পোশাক পরলে, তাবপব সেই ছাগল, ভেড়া আর ষাঁড়টাকে নিয়ে একেবারে সেই কৃষকের বাড়ি গিয়ে উপস্থিত। কৃষক তার স্ত্রীকে নিয়ে বাড়ির দরজায়ই বসে ছিল, তারপর সেই হারানো জন্তুগুলিকে দেখে আহ্লাদে লাফিয়ে উঠল।

 চানু বল, ‘জন্তুগুলো কার বলতে পার কি?’

 ‘এগুলো যে আমাদের আপনি কোথায় পেলেন মশায়?’

 ‘এই বনের ভিতর চরে বেড়াচ্ছিল। আচ্ছা, ছাগলটার গলায় একটা থলে ঝুলছে, তাতে দশটা মোহর রয়েছে-ওগুলিও কি তোমাদের?’

 ‘না মশায়। আমরা গরিব দুঃখী লোক, মোহর কোথা পাব?’

 ‘আচ্ছা, মোহরগুলোও তোমরা নাও, আমার কিছু দরকার নেই।’ মোহরগুলি নিয়ে দুইহাত তুলে কৃষক চানুকে আশীর্বাদ করল।

 সমস্ত দিন চলে চানু প্রায় সন্ধ্যার সময় তার বাড়িতে এসে উপস্থিত, বাড়ির ভিতরে গিয়ে দেখল তার মা-বাবা বসে আছেন। চানু বলল, ‘ভগবান আপনাদের ভাল করুন, আজ রাতটা আপনাদের বাড়িতে থাকতে পারি কি?’

 ‘আপনার মত ভদ্রলোক কি এখানে থাকতে পারবেন? আমরা যে বড় গরীব।’

 চানু আর চুপ থাকতে পারল না, ‘বাবা, তুমি কি তোমার ছেলেকেও চিনতে পারছ না?’

 চানুর মা বাবা খানিকক্ষণ অবাক হয়ে রইল, তারপর চানুকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘এমন সুন্দর পোশাক তুমি কোথা পেলে বাবা?’

 চানু। ‘পোশাক দেখেই অবাক হয়ে গেলে, তা হলে এই টাকাগুলো দেখে কি করবে?’ এই বলে চানু পকেট খালি করে সব মোহর টেবিলের উপর রাখল।

 এতগুলো মোহর দেখে চানুর বাবার বড্ড ভয় হল। চানু তখন সব কথা খুলে বলল— তার আশ্চর্য বুদ্ধির কথা শুনে চানুর মা বাপের আনন্দ আর ধরে না।

 পরের দিন সকালে চানু বাবাকে বলল, ‘বাবা, যাও জমিদারবাড়ি। বলো গিয়ে আমি তাঁর মেয়েকে বিয়ে করতে চাই।’

 চানুর কথা শুনে তার বাবার চোখ বড় হয়ে গেল, ‘বলিস কিরে বেটা। তা হলে যে আমার পিছনে কুকুর লেলিয়ে দেবে।’

 ‘না! তুমি বোলো যে আমি সর্দার চোর, আমার মত ঝানু চোর দুনিয়ায় নেই, জবরদস্ত ও ওস্তাদ চোরদের ফাঁকি দিয়ে লাখ টাকা রোজগার করে এনেছি। দেখো বাবা, যখন দেখবে জমিদারের মেয়েও সেখানে আছে তখনই এ-সব কথা বোলো।’

 ‘আচ্ছ, এত করে যখন বলছ যাচ্ছি, কিন্তু কিছু হবে বলে মনে হয় না।’ প্রায় দুই ঘণ্টা পরে চানুর বাবা ফিরে এল। চানু বলল, ‘কি করে এলে বাবা?’

 ‘নেহাত মন্দ নয়। মেয়েটি যে বড় অনিচ্ছুক তা ত মনে হল না, বোধকরি বাবাজি তুমি এর আগেও তার কাছে এ প্রস্তাবটি করেছ—না? যা হোক, জমিদারমশায় বললেন আসছে রবিবারে তাঁরা নাকি একটি হাঁস ভেজে খাবেন, তুমি যদি কড়া থেকে হাঁসটা বেমালুম চুরি করতে পার, তা হলে তিনি তোমার কথা ভেবে দেখবেন।’

 ‘এ আর তেমন শক্ত কাজ কি? দেখা যাবে এখন।’

 রবিবার দিন জমিদার এবং বাড়ির সকলে রান্নাঘরে রয়েছেন—হাঁস ভাজা হচ্ছে, এমন সময় রান্নাঘরের দরজা খুলে গেল। একটা অতি কুৎসিত বুড়ো ভিখারি, পিঠে তার একটা মস্তবড় থলে ঝুলছে, সে এসে রান্নাঘরের দরজায় উঁকি মেরে বলল, ‘জয় হোক বাবা! আপনাদের খেয়ে-দেয়ে কিছু থাকলে আমি বুড়োে ভিখারি কিছু খেতে পাব কি?’

 জমিদারমশায় বললেন, ‘অবশ্যি পাবে। রান্নাঘরের দাওয়ায় একটু বোসো।’

 জানালার পাশে একজন লোক বসেছিল। খানিক পরে সে চেঁচিয়ে উঠল ‘আরে মস্ত বড় একটা খরগোশ ছুটে বাগানের দিকে যাচ্ছে- এটাকে মারলে হয় না?’

 জমিদার ধমক দিয়ে বললেন, ‘খরগোশ মারবার ঢের সময় মিলবে, এখন চুপ করে বসে থাকো।’

 খরগোশটা বাগানে গিয়ে ঢুকল। ভিখারি পোশাক-পরা চানু থলের ভিতর থেকে আরএকটা খরগোশ ছেড়ে দিল। একটু পরেই চাকর আবার চেঁচিয়ে উঠল, ‘বাবু বাবু খরগোশটা এখনো রয়েছে-এখনো চেষ্টা করলে মারা যায়।’

 আবার জমিদার ধমক দিলেন, ‘চুপ করে থাকো বলছি।’

 খানিক বাদে চানু আরো একটা খরগোশ থলে থেকে বের করে ছেড়ে দিল। চাকরও চেঁচিয়ে উঠল। —আর যায় কোথা! একজন একজন করে সবকটি চাকর রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে খবগোশের পেছনে তাড়া কবল, জমিদারমশায়ও বাদ পড়লেন না।

 খরগোশ তাড়িয়ে সকলে ফিরে এসে দেখে ভিখারিও নেই, কড়ার মধ্যে হাঁসও নেই। জমিদারমশাই বললেন, ‘আচ্ছা ফাঁকিটা দিয়েছে চানু, সত্যি সত্যি আমাকে জব্দ করেছে।’

 একটু পরেই চানুদের বাড়ি থেকে একজন চাকর এসে জমিদারমশায়কে বলল, ‘আজ্ঞে, আমার মনিব বলে পাঠিযেছে, আপনারা অনুগ্রহ করে আমাদের বাড়ি গিয়ে খাবেন।’

 জমিদার বড় চমৎকার সাদাসিধে লোক ছিলেন, মনে একটুও অহংকার ছিল না। স্ত্রী ও মেয়েকে নিয়ে চানুদেব বাড়ি এলেন এবং সকলের সঙ্গে বসে নানারকম ভাল ভাল খাবার জিনিসের সঙ্গে তাঁর সেই হাঁস ভাজাটিও খেলেন। চানুর চালাকির কথা বলে জমিদারমশায় হাসতে হাসতে পাঁজরে ব্যাথা ধরিয়ে ফেললেন। মেয়েটি ত আগে থেকেই চানুকে পছন্দ করত, এখন তার পোশাক দেখে এবং তার আদবকায়দা দেখে মনে মনে আরো খুশি হল।

 খাওয়া দাওয়ার পর জমিদার বললেন, ‘চানু, শুধু হাঁস চুরি করেই আমার মেয়ে পাবে না। কাল রাত্রে আমার আস্তাবল থেকে আমার ছয়টি ঘোড়া যদি চুরি করতে পার তা হলে দেখা যাবে এখন। ছজন সহিস কিন্তু ছয়টি ঘোড়ার পিঠে চড়ে পাহারা দেবে মনে রেখো।’

 চানু বলল, ‘আচ্ছা, চেষ্টা করে দেখব এখন।’

 সোমবার রাত্রে জমিদারের আস্তাবলে ছয়জন সহিস ছয়টি ঘোড়ার পিঠে বসে আছে। বেজায় ঠাণ্ডা, রক্ত যেন জমে যেতে চায়;তাই প্রত্যেকের জামার পকেটে একটি করে মদের বোতল, খানিক পরে পরে একটু করে মদ খেয়ে গা গরম করে নিচ্ছে। ঘুমিয়ে পড়লে চলবে না, তাই সকলে মিলে মহা গল্প জুড়ে দিল—চানুর জন্য আস্তাবলের দরজা খোলাই রেখেছিল। রাত যত বেশি হতে লাগল ঠাণ্ডাটাও যেন বাড়তে লাগল। মদে আর শানায় না, গায়ে কাঁপুনি ধরে গেল এমন সময় ঠক্‌ঠক্ করে কাঁপতে কাঁপতে একটা কদাকার বুড়ো এসে দরজায় উঁকি মেরে বলল, বাবাসকল, শীতে জমে গেলাম, এক মুঠো খড় দাও ত, আস্তাবলের এককোণে রাতটা পড়ে থাকি, তা না হলে বুড়ো মানুষ—শীতে মরেই যাব। বুড়োর পিঠে ছয়টা থলে, মুখে প্রায় দু আঙ্গুল লম্বা দাড়ি—চেহারাটি কুৎসিতের একশেষ।

 বুড়ো আস্তাবলের দরজায় উঁকি মেরে বলল, ‘লক্ষী বাপ আমার, বুড়ো মানুষ শীতে মরে গেলাম, ঐ কোণটাতে একটু জায়গা দাও, একমুঠো খড় নিয়ে পড়ে থাকব এখন।’

 সহিসরা ভাবল, এলই বা বুড়ো, বেচারি শীতে জমাট বেঁধে গেল—‘ও ত আর কোনো অনিষ্ট করবে না।’ আস্তাবলের কোণে খড় পেতে বুড়ো বেশ আরামে বসল। সহিসেরা দেখল বুড়ো খানিক পরেই একটা কালো বোতল বের করে একটু মদ খেল-তার মুখে আর হাসি ধরে না, যেন সে খুবই আরাম বোধ করেছে! সহিসদের বুড়ো বলল, ‘বাবা, তোমাদের সব বোধ করি শেষ করে ফেলেছ, তা আমার কাছে ঢের আছে। তবে কিনা তোমরা পাছে কিছু মনে কর তাই তোমাদের দিতে ভরসা পাচ্ছি না।’ একে বজায় শীত, তার উপরে সত্যি সতাি তাদের মদ শেষ হয়ে গেছে, বুড়োর কথা শুনে সহিসরা যেন হাতে চাঁদ পেল—‘সে কি দাদু, তুমি যদি দাও তা হলে ত বেঁচে যাই—ঠাণ্ডায় মরে গেলাম।’

 বুড়ির বোতলটি দেখতে দেখতে শেষ হয়ে গেল, তবুও সহিসদের শীত গেল না। শয়তান বুড়ো তখন আর একটি বোতল বের করে তাদের দিল। এ বোতলটার মদের সঙ্গে কি মেশানো ছিল, খাওয়া মাত্র সব কটা সহিস ঘোড়ার পিঠে গদির উপরে বসেই নাক ডাকিয়ে ঘুম দিল।

 তখন বুড়ো উঠে সবকটা সহিসকে খড়ের উপর শুইয়ে ঘোড়াগুলোর পায়ে মোজা পরিয়ে দিল। তারপর সবগুলিকে নিয়ে একেবারে চানুদের বাইবের একটা ঘরে গিয়ে হাজির।

 পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে জমিদারমশায় প্রথমেই কি দেখলেন? তাঁর বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়েই চানু ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছে আর তার ঘোড়ার পিছনে পিছনে অপর পাঁচটা ঘোড়াও চলেছে।

 জমিদারমশায় অবাক হয়ে রইলেন, মনে মনে বললেন, ‘গোল্লায় যা তুই চানু, আর যাদের চোখে ধুলো দিয়েছিল সে বেচারারাও গোল্লায় যাক।’ আস্তাবলে গিয়ে সহিস বেটাদের জাগাতে জমিদারমশায়কে বেগ পেতে হয়েছিল।

 সকালবেলা জমিদারমশায় খেতে বসেছেন, চানুকেও ডেকে এনেছেন, খেতে খেতে চানুকে বললেন, ‘কতকগুলো বোকা পাঁঠার চোখে ধুলো দিয়েছ। এতে তেমন বাহাদুরি নেই। আচ্ছা, আজ বেলা একটা থেকে তিনটে পর্যন্ত আমি ঘোড়ায় চড়ে বাড়ির সামনে ঘুরে বেড়াব, নিও দেখি বাপু আমার ঘোড়াটা চুরি করে! তা হলে বুঝব তুমি বাহাদুর এবং আমার জামাই হবার উপযুক্ত।’

 চানু মাথা নিচু করে উত্তর করল, ‘যে আজ্ঞে, একবার চেষ্টা করে দেখব এখন।’

 একটার পর থেকে জমিদার ঘোড়ায় চড়ে পাইচারি করে করে একেবারে কাহিল হয়ে পড়লেন, তিনটে বেজে গেল, চানুর টিকিটিও দেখতে পেলেন না। মনে করলেন এবারে বাড়ি ফিরে যাবেন, এমন সময় তাঁর একটা চাকর পাগলের মত উর্ধ্বশ্বাসে ছুটে এসে হাজির—‘কর্তা শিগ্‌গির বাড়ি যান, মা ঠাকরুনকে বুঝি বা আর দেখতে পেলেন না;সিঁড়ির উপর থেকে তিনি পড়ে গেছেন। বোধ করি হাত-পা সব ভেঙে গেছে, তিনি অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন। আমি চললাম ডাক্তারের বাড়ি।’

 জমিদারের চোখ বড় হয়ে গেল, ‘বলিস কিরে বেটা, কি সর্বনাশ। ডাক্তারের বাড়ি যে ঢের দূর—তুই আমার ঘোড়াটা নিয়ে ছোট শিগগির। ঘোড়ায় চড়ে চাকর তখন ডাক্তারের বাড়ি ছুটল।

 জমিদারমশাই হোঁচট খেতে খেতে বাড়ি এসে উপস্থিত। বাড়ি এসে দেখলেন সাড়া শব্দ কিছু নেই, সব চুপচাপ। ব্যস্ত সমস্ত হয়ে বাড়ির ভেতর গেলেন, সেখানে বসবার ঘরে গিন্নি আর মেয়ে দিব্যি আরাম করে বসে আছেন। ততক্ষণে জমিদারমশায়ের চৈতন্য হল। তিনি বুঝতে পারলেন এ-সব চানু বেটারই চালাকি-বেটা তাকে আচ্ছা ঘোল খাইয়েছে।

 খানিক পরেই দেখলেন, চানু তাঁর ঘোড়ায় চড়ে বাড়ির সামনে দিয়ে যাচ্ছে। সেই চাকর বেটার কিন্তু আর কোন উদ্দেশ পাওয়া গেল না। চাকর তার জন্য একটুও কেয়ার করে না, নাইবা করল তার চাকরি—চানু যে তাকে দশটা মোহর দিয়েছিল তা দিয়ে তার অনেক দিন চলবে।

 পরের দিন চানু এসে জমিদার বাড়ি উপস্থিত, জমিদার বললেন, ‘তুমি বাপু এবারে নেহাত ফাঁকি দিয়াছ, ওতে তোমার উপর আমার বড্ড রাগ হয়েছে। যা হোক আজ রাত্তিরে যদি আমাদের বিছানার থেকে চাদরখানা চুরি করতে পার তা হলে কালকেই বিয়ের আয়োজন করব।’

 চানু বলল, ‘আজ্ঞে আচ্ছা, একবার চেষ্টা কবে দেখব, কিন্তু এবারেও যদি ফাঁকি দেন তাহলে কিন্তু আপনার মেয়েকেই চুরি করে নিয়ে যাব।’

 রাত্রে জমিদার আর তাঁর গিন্নি শুয়েছেন, দিব্যি জ্যোৎস্না, কাঁচের জানালার ভিতর দিয়ে চাঁদের আলো এসে ঘরে পড়েছে। জমিদারমশায় দেখলেন হঠাৎ যেন একটা মাথা জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখতে যাচ্ছিল; তাঁদের দেখতে পেয়েই আবার সরে পড়ল।

 জমিদার গিন্নিকে বললেন—‘দেখলে ত? এ বেটা নিশ্চয় চানু। তারপর বন্দুকটা হাতে করে নিয়ে বললেন, ‘দেখো, আমি বেটাকে এখনি চমকে দিচ্ছি।’ বন্দুক দেখেই জমিদার গিন্নি ব্যস্ত হয়ে বললেন, ‘কর কি, চানুকে গুলি করবে না কি?’

 জমিদার বললেন, ‘আরে না, তুমি কি পাগল হলে নাকি? বন্দুকে কি আর গুলি পুরেছি শুধু বারুদ।’

 খানিক পরেই আবার জানালায় মাথা উঁকি মারল, দড়াম করে জমিদার বন্দুক ছুঁড়ে দিলেন সঙ্গে সঙ্গে শুনতে পেলেন ধপ করে কি নীচে পড়ে মাটিতে গড়াগড়ি দিতে লেগেছে।

 জমিদার গিন্নি চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘হায় ভগবান, বেচারি বোধ করি মরে গেছে, আর নাহয় জন্মের মত খোঁড়া কানা হয়ে থাকবে।’

 জমিদার মশায় বোধ করি তখনো বাইরের জানালার কাছে পৌঁছান নি, কিন্তু গিন্নিঠাকরুন শুনলেন কর্তা ফিরে এসে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে বলেছেন, শিগগির বিছানার চাদরখানা দাও, বেটা মরে নি বোধ হয়, কিন্তু বেজায় রক্ত পড়ছে—একটু পরিষ্কার করে বেঁধে ঠেঁধে ওকে নিয়ে আসব।

 গিন্নিঠাকরুন একটানে চাদরখানা বিছানা থেকে তুলে দরজায় ছুঁড়ে দিলেন। চাদর নিয়ে জমিদার মশায় আবার ছুটলেন, কিন্তু কি আশ্চর্য সেই মুহূর্তেই তিনি ফিরে এসে ঘরে উপস্থিত-সে সময়ের মধ্যে বাগানে জানালার কাছে গিয়ে ফিরে আসা একেবারে অসম্ভব।

 ঘরে ঢুকেই জমিদার রেগে মেগে বলতে লাগলেন-‘বেটা পাজি চানু তোকে ফাঁসি দেওয়া দরকার।’

 কর্তার কথা শুনে গিন্নি অবাক হয়ে বললেন-‘বেচারির বেজায় লেগেছে আর তুমি কিনা তাকে গালাগালি দিচ্ছ!’

 ‘ওর বাস্তবিক লাগাটাই উচিত ছিল। বেটার বদমাইশি দেখেছ? খড় দিয়ে একটা মানুষ বানিয়ে সেটাকে কাপড়-চোপড় পরিয়ে এনে জানলায় ধরেছিল।’

 ‘কী ছাই মাথা মুণ্ডু বলছ, আমি বুঝতেই পারছি না। খড়ের মানুষ হলে তার রক্ত মুছবার জন্য আবার বিছানার চাদর চেয়ে নিয়ে গেলে কেন?’

 ‘বিছানার চাদর —বলছ কি আমি ত বিছানার চাদর-টাদর চাইতে আসি নি।’

 ‘চাদর চাইতে আস আর না আস আমি সে সব কিছু জানি না। তুমি এসে দরজায় দাঁড়িয়ে চাদর চাইলে আর আমিও তোমাকে দিয়েছি।’

 গিন্নির কথা শুনে জমিদার মশায় মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন—‘কি ভীষণ শয়তান রে বাবা চানু—ওর সঙ্গে আর পেরে উঠব না। কাল সকালেই বিয়ের বন্দোবস্ত করতে হবে দেখছি।’

 এরপর চানুর সঙ্গে জমিদার কন্যার বিয়ে হয়ে গেল। বিয়ের পর চানু খুব ভাল হয়ে গেল—তার মত জামাই সচরাচর মেলে না। জমিদার মশায় এবং তাঁর গিন্নি শতমুখে চানুর সুখ্যাতি করেন আর লোকের কাছে বলেন-‘আমার ঝানু চোর চান।’