উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/গল্পমালা/বেচারাম কেনারাম

বেচারাম কেনারাম

প্রথম দৃশ্য

(জামা রিপু করিতে করিতে কেনারাম চাকরের প্রবেশ)

 কেনা। ঐ যা! আবার খানিকটা ছিঁড়ে গেল! ছুঁতেই ছিড়ে যায়, তা রিপু করব কি? ভাল মনিব জুটেছে যাই হোক, এই জামাটা দিয়েই ক’বছর কাটালে। তিন বছর ত আমিই এইরকম দেখছি, আরো বা ক’বছর দেখতে হয়। তবু যদি চারটে পেট ভরে খেতে দিত! তাও কেমন? সকালে মনিব চারটি ভাত খান, আমি ফ্যানটুকু খাই, রাত্তিরে তিনি হাঁড়ি চাটেন আমি শুঁকি তার উপর শ্রবণশক্তিটি কি প্রখর! বাড়িওয়ালা সেদিন টাকার জন্যে কি-ই না বললে! বাড়িওয়ালা বলে, ‘টাকা দেও, ঢের টাকা বাকি।’ মনিব বলেন ‘তা ভাল ভাল, তোমার বাড়ি আজ নেমন্তন্ন?’ বাড়িওয়ালা বলে, ‘এমন করে ভাড়া ফেলে রাখলে চলে কই?’ মনিব বলেন, ‘তা আচ্ছ, চাকরটিও সঙ্গে যাবে।’ বাড়িওয়ালা বেচারী, রেগেমেগে চলে গেল। বড়লোক হতে হলে বোধহয় আমার মনিবের মতই কত্তে হয়, কিন্তু এঁর কাছে থেকে বড়লোক হওয়ার কায়দাটাই শেখা হবে। বড়লোক হওয়ার ভরসা বড় নেই। রাখবার সময় কত আশাই দিয়েছিলেন, আর আজ এই তিন বছরে একটি পয়সা মাইনে দিলেন না! দেখি আজ যদি মাইনে না দেয়, তবে আর এর কাজ করা হচ্ছে না।

[প্রস্থান]

(বেচারাম মনিবের প্রবেশ)

 মনিব। চাকরটা জামাটা নিয়ে কত কথা বলছিল! সব শুনেছি। বেটা ভেবেছে, আমি সত্যিই কালা। আরে আমার মত যদি কান থাকত তা হলে আর চাকরি কত্তে হত না। আমি যা করে খাই, তাই করে খেতে পাও। ঘরের ভিতবে ক’জন জেগে আছে ক’জন ঘুমুচ্ছে, দাওয়ায় কান পেতে সব বুঝে নি। কোথায় সিন্দুকের ভেতর আরশুলা কড়কড় কচ্চে, বাইরে থেকে বুঝে নি। বাপু হে। কানে শুনি, কানে শুনি। কানে শোনাটা ত বেশ ভালই, কিন্তু না শোনার যে সুবিধা আছে তা ত বুঝবে না? এই সেদিন বাড়িওয়ালা বেটা ফাঁকি দিয়ে টাকা আদায় কত্ত। কানে না শোনার কত সুবিধা দেখো, পাওনাদারের টাকা দিতে হয় না, বাড়ি ভাড়া দিতে হয় না, চাকরের মাহিনা দিতে হয় না—

(কেনারামের প্রবেশ)

 কেনা (উচ্চৈঃস্বরে)। মশাই, হয় এই তিন বছরের মাইনে দিন, নাহয় আপনার এই-সব রইল, আমি চললেম।

 মনিব। ডাকওয়ালা? চিঠি? দেখি?

 কেনারাম (স্বগত)। এই মুশকিল কল্লে! তা এবারে বাপু এক ফন্দি এঁটেছি— সব লিখে এনেছি। (প্রকাশ্যে) চিঠিই বটে, এই নিন্।

 মনিব (পাঠ)। ‘মনিব মহাশয়, কানে শুনেন না, কিন্তু পড়িতে অবশ্যই পারেন। তিনটি বৎসরের বেতন চুকাইয়া বিদায় দিতে আজ্ঞা হয়। শ্রীকোরাম চাকর।’—তাই ত, তোমার বেতনটা দিতে হল। তা রাখবার সময় ত কোন বন্দোবস্ত হয় নি, কাজকর্মও তেমন ভাল করে কর নি। তিন বছরে তিন পয়সার বেশি তোমার প্রাপ্য হয় না। তা এই নেও। (তিন পয়সা প্রদান ও ধাক্কা দিয়া বহিষ্করণ)

দ্বিতীয় দৃশ্য

(কেনারামের প্রবেশ)

 কেনা। এই বড়লোক হলাম আর কি! তিন-তিন বছরের মাইনে; ঢের টাকা-ঢের টাকা। এক দুই তিন, চার পাঁচ ছয়, সাত আট নয়, দশ এগার বার। (পয়সা তিনটি পকেটে স্থাপন)

(ছদ্মবেশী স্বর্গীয় দুতের প্রবেশ)

 স্বর্গীয় দূত। আরে ভাই, তোর যে ভারি ফুর্তি?

 কেনা। কে ও? ছোট্ট মানুষ? দাঁড়াও চশমাটা বার করে নি।

 দূত। কেন! চোখে কম দেখ বুঝি?

 কেনা। তা কেন? বড়লোক হয়েছি যে, ছোটমানুষ আর তেমন চট করে চোখে মালুম পড়ে না।

 দূত। বটে। এত বড়লোক কি করে হলি ভাই?

 কেনা (পকেট চাপড়াইয়া— তি—ন—টি ব—ছ—রের মা—ই—নে। (এক-একটি পয়সা বহিষ্করণ ও গম্ভীরভাবে গণন) এ—এ—এ—ক, দু—উ—উ—ইতি—ই—ই—ই—ন (পকেট উল্টাইয়া গম্ভীরভাবে অবস্থান)।

 দূত। তাই ত ভাই, এত টাকা নিয়ে তুই কি করবি? আমি গরীব, আমাকে কিছু দেনা।

 কেনা। নিবি? এই নে; ভগবান আমাকে খেটে খাবার শক্তি দিয়েছেন, খেটে খাব। (পয়সা তিনটি প্রদান)

 দূত। তুই ভাই বেশ লোক, তোর মনটা খুব খোলা। আমি ঈশ্বরের দূত, ভাল লোক দেখলে পুরস্কার দি। তোর ব্যবহারে খুব খুশি হয়েছি তুই কি চাস বল, যা চাস তাই পাবি।

 কেনা। অ্যাঁ, আপনি ঈশ্বরের দূত? তবে ত আপনার সম্মুখে আমি বড় বেয়াদবি করেছি?

 দূত। তোর কিছু ভয় নেই, তুই আমাকে ‘তুই’ ‘তুমি’ যা খুশি বল্, কিছুতেই বেয়াদবি হবে না; এখন তুই কি নিবি বল্।

 কেনা। তা দাদা, যদি দেবে তবে এমন একখানা বেহালা দাও যে, যে তার আওয়াজ শুনবে তাকেই তিড়িং তিড়িং করে নাচতে হবে।

 দূত। (ঝুলি হইতে বেহালা বাহির করিয়া)। এই নে।

 কেনা। বাঃ। বেশ হল, আমাকে ত সঙ্গে সঙ্গে নাচতে হবে না?

 দূত। না, সে ভয় তোর নেই, যা এখন ফুর্তি করগে। (দূতের প্রস্থানোদ্যম ও কেনারামের বাদ্যোদ্যম) আরে দূর হতভাগা, আমারই উপর পরীক্ষা করে বসলি।

 কেনা। তুমিই যে ফুর্তি করতে বললে দাদা!

 দূত। আমি আগে যাই, তাবপর করিস।

 কেনা। আ — চ্ছা।

তৃতীয় দৃশ্য

(বেচারামের প্রবেশ)

 বেচা। ঐ ঝোপটাতে ফেলে গিছলুম। পুলিশ বেটা এমনি তাড়া কল্লে ধরেই ফেলেছিল আর কি চট করে টাকার থলেটি ঐ ঝোপটাতে ফেলে পালালুম, এখন পেলে বাঁচি। (থলি খুঁজতে ঝোপে প্রবেশ) বাপ রে, কি ভয়ানক কাঁটা—এই পেয়েছি!

(কেনারামের প্রবেশ)

 কেনা (স্বগত)। ঐ যে বেচুবাবু কাঁটাবনে ঢুকেছেন, এইবারে এক গৎ বাজিয়ে নি, পুরোনা মনিবটে। (বেহালাবাদন)

 বেচা (নৃত্য করিতে করিতে)। আরে! আরে। ও কী? উঃ আঃ! আরে তুমি কি—উঃ হু হু —আরে আর না—জামাটা-উঃ—হু জামাটা গেল যে, উঃ-গায়ের চামড়াও যে ছিঁড়ে গেল— উঃ!

 কেনা। আজ্ঞে, আমি আপনার বকেয়া চাক্র কেনারাম, মাইনে চুকিয়ে দিয়েছেন বলে কি এমন মনিবকে ভুলতে পাবি? আপনাকে বাজনা শুনিয়ে আমার বেয়ালা সার্থক হল। (পুনরায় দ্বিগুণ উৎসাহে বাদন)

 বেচা (নৃত্য)! কি মুশকিল। বাবা কেনারাম, রক্ষে করো বাবা। এ কি বাজনা যে শুনলেই নাচতে হয়! বাবা আর কাজ নেই, আমি খুব খুশি হয়েছি, এই টাকার থলি তোমায় দিচ্ছি, তোমার মাইনে এ থেকে পুষিয়ে নাও, দোহাই বাবা, আমায় নাচিও না। (টাকার থলি কেনারামের হাতে প্রদান।)

 কেনা (বিনীত অভিবাদন করিয়া)। আজ্ঞে, না হবে কেন? আপনার মত মনিব না হলে গুণ কে বোঝে! দেখছি বেয়ালার আওয়াজে আপনার ‘কানে খাট’র ব্যারামটাও বেশ সেরে গেল। ভাল ভাল, আর এ ব্যারামের সুত্রপাত দেখলে আমায় খবর দেবেন, আমি বেয়ালা নিয়ে এসে চিকিৎসা করব। (দীর্ঘ অভিবাদন করিয়া প্রস্থান)

 বেচা। হতভাগা বেটা, লক্ষ্মীছাড়া বেটা, জোচ্চর, বাটপাড়, ডাকাত-বেটাকে দেখাচ্ছি। পুলিশ! পুলিশ! চোর—চোর!

চতুর্থ দৃশ্য

(বিচারালয়। ব্যস্তভাবে বেচারামের প্রবেশ)

 বেচা। দোহাই হুজুর, আমাকে ধনে-প্রাণে মেরেছে। ও হো হো (ক্রন্দন)

 বিচারক। আরে ব্যাপার কি? তোমার কি হয়েছে?

 বেচা।(কাঁটার আঁচড় ও ক্ষতবিক্ষত শরীর দেখাইয়া)—আর কি হবে, আমি ধনে-প্রাণে গিয়েছি। বড় রাস্তাব ধারে ঐ কেনা বেটা আমাকে মেরে ধরে টাকাকড়ি কেড়ে নিয়েছে এঁ হেঁ হেঁ (ক্রন্দন)। বেটাকে তিন বছর আমি খাইয়ে মানুষ কলুম, আর তার এই প্রতিশাধ দিলে। বেটা দিনরাত বেহালা নিয়ে ফেরে, এখনি ধরতে পাঠান, তাকে দেখলেই চিনতে পারবেন।

 বিচারক। চারজন লোক এখনি গিয়ে কেনারামকে ধরে নিয়ে এসো।

(কেনারামকে লইয়া চারজন লোকের প্রবেশ)

 বেচা। ঐ! ঐ! ঐ বেটা। হুজুর! কেনারাম বেটা আমার সর্বনাশ করেছে, বেটাকে আচ্ছা করে—

 বিচারক। চুপ। (কেনার প্রতি) তুমি একে মেরে এর টাকা কেড়ে নিয়েছ?

 কেনা। সে কি? হজুর! উনি আমার বেয়ালা বাজানো শুনে আমায় এক থলি টাকা পুবস্কার দিয়েছন— আমি যথার্থ বলছি।

 বিচারক। ওর যে চেহাবা দেখছি, তাতে ও যে বেহালা শুনে তোমায় এতগুলো টাকা দিয়েছে তা আমি কিছুতে বিশ্বাস কত্তে পারি নে। আর ওর গায়েও এই-সব দাগ দেখছি। সুতরাং প্রমাণ হচ্ছে তুমিই ওকে মেরে টাকার থলি কেড়ে নিয়েছ। এ ডাকাতি; ডাকাতির শাস্তি ফাঁসি—তোমার ফাঁসি হবে। এখন তোমার যদি কোন আকাঙ্খা থাকে ত বলো।

 কেনা। হুজুর, আমার আর কোন সাধ নেই। খালি এ জন্মের মত বেয়ালাখানা একবার বাজাতে চাই।

 বেচা। সর্বনাশ! হুজুর এমন হুকুম দেবেন না।

 চাপরাসী। (বেচারামকে রুলের গুঁতা মারিয়া) চুপ্ রও।

 বিচারক। আর কোন সাধ তোমার নেই? আচ্ছা বাজাও।

 (কেনারামের উৎসাহের সঙ্গে বেহালাবাদন ও বিচারক হইতে চাপরাসী পর্যন্ত সকলের নৃত্য)

 বিচারক (হাঁফাইতে হাঁফাইতে)। আরে বাপু! থাম্ থাম্; শিগগির থাম্; তোকে বেকসুর খালাস দিচ্ছি, প্রাণ যায়—থাম্। বাপরে, এ কিরকম বেহালা বাজনা!

 কেনা (সেলাম করিয়া)। হুজুর বেচুবাবুকে এখন সমস্ত সত্য ঘটনা বলতে হুকুম হয়। নইলে আমি পুনরায় বেয়ালায় ছড়ি দিলাম।

 বিচারক (বেচারামেব প্রতি সরোষে)। বল্ বেটা কি হয়েছিল, সত্যি করে এখনি বল্।

 বেচা। ওগো, না গো, আর বেহালা ধরো না। ও টাকা আমিই দিয়েছি— দিয়েছি।

 বিচারক। তুই এত টাকা কোথা পেলি, বল্।

 বেচা। আমি—আমি—

 কেনা। এই বেয়ালা ধরছি।

 বেচা। না না— আমি, হুজুর আমি— কাল রাত্তিরে হুজুর, চুরি করেছিলাম। দোহাই হুজুর।

 কেনা। ধর্মের ঢাক আপনি বাজে। দেখলেন ত বেচুবাবু?

 বিচারক। একে পঁচিশ বেত মারো।