উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/গল্পমালা/তিনটি বর
তিনটি বর
এক দেশে এক কামার ছিল, তার মত অভাগা আর কোনো দেশে কখনো জন্মায় নি। তাকে এক জিনিস গড়তে দিলে তার জায়গায় আর-এক জিনিস গড়ে রাখত, একটা কিছু সারাতে দিলে তাকে ভেঙে আরো খোঁড়া করে দিত। আর লোককে ফাঁকি যে দিত, সে কি বলব! কাজেই কেউ তাকে কোনো কাজ করতে দিতে চাইত না, তার দুবেলা দুটি ভাতও জুটত না, লাভের মধ্যে সে তার গিন্নীর তাড়া খেয়ে সারা হত।
একদিন সে দোকানে বসে গালে হাত দিয়ে ভাবছে। ভয়ানক শীত, গায়ে জড়াবার কিচ্ছু নেই। খিদেয় পেট জ্বলে যাচ্ছে, ঘরে খাবার নেই। এমন সময় কোত্থেকে এক এই লম্বা সাদা দাড়িওলা বুড়ো লাঠি ভর করে কাঁপতে কাঁপতে এসে তার দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে বলল, ‘জয় হোক বাবা, দুঃখী বুড়োকে কিছু খেতে দাও।’
কামার বলল, ‘বাবা, খাবার যদি থাকত, তবে নিজেই দুটি খেয়ে বাঁচতুম। দুদিন পেটে কিছু পড়ে নি, ছেলেপুলে নিয়ে উপোস করছি তোমাকে কোত্থেকে দেব? তুমি নাহয় ঘরে এসে একটু গরম হয়ে যাও, আমি হাপর ঠেলে আগুনটা উসকিয়ে দিচ্ছি।’
বুড়ো তখন কাঁপতে কাঁপতে ঘরে এসে বলল, “আহা, বাঁচালে বাবা, শীতে জমে গিয়েছিলাম। তুমি দেখছি তবে আমার চেয়েও দুঃখী। আমার নিজে খেতে পেলেই চলে, তোমার আবার স্ত্রী আর ছেলেপুলেও আছে।’
এই বলে বুড়ো আগুনের কাছে এসে বসল, কামার খুব করে হাপর ঠেলে আগুন উসকিয়ে তাকে গরম করে দিল। যাবার সময় বুড়ো তাকে বলল, ‘তুমি আমাকে খেতে দিতে পার নি, তবু তোমার যতদূর সাধ্য তুমি করেছ। এখন তোমার যেমন ইচ্ছা, তিনটি বর চাও, আমি নিশ্চয় দেব।’
এ কথায় কামার অনেকক্ষণ বুড়োর মুখের দিকে চেয়ে মাথা চুলকোতে লাগল, কিন্তু কি বর চাইতে হবে, বুঝতে পারল না। বুড়ো বলল, ‘শিগ্গির বলো,আমার বড্ড তাড়াতাড়ি— ঢের কাজ আছে।’
তখন কামার থতমত খেয়ে বলল, ‘আচ্ছা, তবে এই বর দিন যে, আমার এই হাতুড়িটি যে একবার হাতে করবে, সে আর আমার হুকুম ছাড়া সেটি রেখে দিতে পারবে না। আর যদি তা দিয়ে ঠুকতে আরম্ভ করে, তবে আমি থামতে না বললে আর থামতে পারবে না।’
বুড়ো বলল, ‘আচ্ছ তাই হবে। আর কি বর চাই?’
কামার বলল, ‘আমার এই কেদারাখানিতে যে বসবে, সে আমার হুকুম ছাড়া তা থেকে উঠতে পারবে না।’
বুড়ো বলল, ‘আচ্ছা তাও হবে। আর কি?’
কামার বলল, ‘আমার এই থলিটির ভিতরে আমি কোনো টাকা রাখলে আমি ছাড়া আর কেউ তাকে তা থেকে বার করতে পারবে না।’
সেই বুড়ো ছিলেন এক দেবতা। তিনি এই শেষ বরটিও সেই কামারকে দিয়ে ভয়ানক রেগে বললেন, ‘অভাগা, তুই ইচ্ছা করলে এই তিন বরে পরিবার সুদ্ধ স্বর্গে চলে যেতে পারতিস, তার মধ্যে তোর এই দুর্মতি!’
এই বলে দেবতা চলে গেলেন, কামার আবার বসে বসে ভাবতে লাগল। হঠাৎ তার মনে হল যে, তাই ত, এই তিন বরের জোরে ত আমি বেশ দুপয়সা রোজগার করে নিতে পারি।
তখন সে দেশময় এই কথা রটিয়ে দিল যে, আমার দোকানে এলে আমি বিনি পয়সায় কাজ করে দেব। দেশের যত কিপটে পয়সাওয়ালা লোক, সে কথা শুনে তার দোকানে এসে উপস্থিত হতে লাগল। এক-একজন আসে, আর কামার তাকে দুহাতে লম্বা লম্বা সেলাম করে তার সেই কেদারাখানায় নিয়ে বসতে দেয়। বিনি পয়সায় কাজ করিয়ে চলে যাবার সময় সে বেচারা তা থেকে উঠতে পারে না, কামারও বেশ ভালমতে তার কাছ থেকে কিছু টাকা আদায় না করে তাকে উঠতে দেয় না। এমনি করে দিনকতক সে খুব টাকা পেতে লাগল। কাউকে এনে চেয়ারে বসায়, কারু হাতে তার হাতুড়িখানা তুলে দেয়, তারপর টাকা না দিলে আর তাকে ছাড়ে না।
যা হোক, ক্রমে সকলেই তার দুষ্টুমি টের পেয়ে ফেলল;তখন আর কেউ তার কাছে আসে না, কাজেই আবার তার দুর্দশার একশেষ হতে লাগল। এই সময় কামার একদিন একটা বনের ভিতর বেড়াতে গিয়ে একটি সাদাসিধি গোছের বুড়োকে দেখতে পেল। বুড়োকে দেখে সে আগে ভাবল, বুঝি কোনো উকিল হবে। কিন্তু তখনই আবার কোনো উকিলের সেই বনের ভিতর আসা তার ভারি অসম্ভব মনে হল। তারপর সে আবার ভাল করে চেয়ে দেখল যে সেই লোকটার পা দুখানিতে ঠিক ছাগলের পায়ের মত খুর আছে। তখন তার আর বুঝতে বাকি রইল না যে, সেই বুড়ো আর কেউ নয়; স্বয়ং শয়তান। শয়তানের পা ঠিক ছাগলের মত থাকে, এ কথা সেই কামার ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছিল।
আর কেউ হলে তখনই সেখান থেকে ছুটে পালাত। কিন্তু সেই কামার তেমন কিছু না করে জোড়হাতে শয়তানকে নমস্কার কবে বলল, ‘প্রণাম হই।’
শয়তান বলল, ‘বটে! তুমি এতই কষ্ট পাচ্ছ? তুমি কেন আমার চাকরি কবো না, আমি তোমাকে ঢের টাকা দেব।’
ঢের টাকার নাম শুনে কামার তখনই শয়তানের কথায় রাজি হল, যদিও সে জানত যে তার কাজে একবার ঢুকলে আর কেউ ছেড়ে আসতে পারে না। শয়তান তখন তাকে তিন থলি মোহর দিয়ে বলল, ‘এখন গিয়ে এই টাকা দিয়ে খুব আরামে খাও-দাও,সাত বছর পরে আমি তোমার কাছে আসব, তখন তোমাকে আমার সঙ্গে যেতে হবে।’ এই বলে শয়তান চলে গেল। কামারও হাসতে হাসতে টাকার থলি নিয়ে ঘরে ফিরল।
সেই তিন থলি মোহর নিয়ে কামার যার পর নাই খুশি হয়ে নাচতে নাচতে বাড়ি এল। ভাবল, এখন সাত বছর এই মোহর দিয়ে খুব ধুমধাম করে নেবে। সাতবছর পরে শয়তানের তাকে নিতে আসবার কথা, তখন তার সঙ্গে যেতেই হবে।
তারপর লোকে দেখল যে কামার কেমন করে রাতারাতি বড়লোক হয়ে গেছে। এখন আর সে হাপরও ঠেলে না, লোহাও পেটে না; এখন তার গাড়ি ঘোড়া চাকরবাকরের অন্ত নেই। দিন যাচ্ছে আর তার বাবুগিরি ক্রমেই বেড়ে উঠছে। সে বাবুগিরিতে সাত বছর শেষ হবার ঢের আগেই শয়তানের দেওয়া সব টাকা ফুরিয়ে গেল, আর ঘরে একটি পয়সাও নেই, একমুঠো চালও নেই। তখন কাজেই তাকে আবার যে কামার সেই কামারই হতে হল, নইলে খাবে কি?
তারপর একদিন সে তার দোকানে বসে একটা লোহা পিটছে আর ভাবছে, কখন খদ্দের আসবে, এমন সময় একজন বুড়ো-হেন লোক ধীরে ধীরে এসে তার কাছে দাঁড়াল। কামার আগে ভাবল, ‘এই রে, খদ্দের!’ তারপর চেয়ে দেখল, ‘ওমা! এ যে শয়তান!’
শয়তান বলল, ‘মনে আছে ত? সাত বছর শেষ হয়েছে, এখন আমার সঙ্গে চলো।’
কামার বলল, ‘তাই ত, আমি গেলে আমার ছেলেপুলেগুলো কি খাবে? তোমার ত কতই লোক আছে, আমাকে দয়া করে ছেড়ে দাও।’
শয়তান বলল, ‘সে হবে না! আমাকে ফাঁকি দেওয়া বড় শক্ত কাজ;চলো, এখনই চলো।’
কামার বলল, ‘তুমি ছাড়বেই না যখন তখন ত চলতেই হবে, কিন্তু আমার হাতের এই কাজটি শেষ করে যেতে পারলে আমার ছেলেগুলোর পক্ষে বড় ভাল হত— এর দরুন কিছু পয়সা পাওয়া যাবে। তুমি দাদা আমার উপকারটুকু করো না—আমি সকলের কাছে বিদায় হয়ে নিই, ততক্ষণ তুমি বসে এই হাতুড়িটা দিয়ে এই লোহাখানাকে পেটো।’
শয়তান কাজে এমন দুষ্টু হলেও কথাবার্তায় ভারি ভদ্রলোেক, সে কামারের কথা শুনে তখনই তার হাত থেকে হাতুড়িটি নিয়ে লোহাটাকে পেটাতে লাগল। সে জানত না যে সেটা সেই দেবতার বর দেওয়া সর্বনেশে হাতুড়ি, তা দিয়ে একবার পিটতে আরম্ভ করলে আর কামারের হুকুম ছাড়া থামবার উপায় নেই। কামার তার হাতে সেই হাতুড়ি দিয়েই অমনি যে ঘর থেকে বেরুল, আর একমাসের ভিতরে সেই মুখোই হল না।
একমাস পরে কামার দোকানে ফিরে এসে দেখল যে শয়তান তখনো ঠনাঠন ঠনাঠন করে বেদম হাতুড়ি পিটছে, আর তার দশা যে হয়েছে! খালি শয়তান বলে সে এতক্ষণ বেঁচে আছে, আর কেউ হলে মরেই যেত। কামারকে দেখে সে অনেক মিনতি করে বলল, ‘ভাই ঢের ত হয়েছে আমাকে মেরে ফেলে তোমার লাভ কি? তার চেয়ে তোমাকে আরো তিন থলি মোহর দিচ্ছি আরো সাত বছরে ছুটি দিচ্ছি, আমাকে ছেড়ে দাও।’
কামার ভাবল, মন্দ কি। আর তিন থলি মোহর দিয়ে সাত বছর সুখে কাটানো যাক। কাজেই সে শয়তানকে বলল, ‘আচ্ছা, তবে তাই হোক।’
তখন শয়তান কামারকে আবার তিন থলি মোহর দিয়ে তাড়াতাড়ি সেখান থেকে চলে গেল, কামারও সেই টাকা দিয়ে আবার ধুমধাম জুড়ে দিল। তারপর সে টাকা শেষ হতেও আর বেশি দেরি হল না, তখন আর হাতুড়ি-পেটা ভিন্ন উপায় নেই। এমনি করে আবার সাত বছর কেটে গেল।
এবার শয়তান কামারকে নিতে এসে দেখে তার বাড়িতে ভারি গোলমাল। কি কথা নিয়ে কামার তার গিন্নির উপর বিষম চটেছে, আর তাকে ধরে ভয়ানক মারছে। কামারের গিন্নিও যেমন-তেমন মেয়ে নয়, পাড়ার সকলে তার জ্বালায় অস্থির থাকে। কামারকে সে ঝাঁটা দিয়ে কম নাকাল করছেনা, কিন্তু কামারের হাতে কিনা হাতুড়ি তাই জিত হচ্ছে তারই। শয়তান এসে এ-সব দেখে কামারকে ভয়ানক দুই থাপ্পড় লাগিয়ে বলল, ‘বেটা পাজি, স্ত্রীকে ধরে মারিস? চল্, আমার সঙ্গে চল্।’
শয়তান ভেবেছিল, এতে কামারে স্ত্রী খুব খুশি হয়ে তার সাহায্য করবে। কিন্তু কামারের স্ত্রী তার কিছু না করে, ‘বটে রে হতভাগা, তোর এত বড় আস্পর্ধা! আমার স্বামীর গায়ে হাত তুলছিস!’ বলে, সেই ঝাঁটা দিয়ে শয়তানের নাকে মুখে এমনি সপাংসপ মারতে লাগল যে বেচারার দমই ফেলা দায়। সে তাতে বেজায় থতমত খেয়ে একটা চেয়ারের উপর বসে পড়ল সেই চেয়ার, যাতে একবার আর বিনা হুকুমে ওঠবার জো নেই।
কামার দেখল যে, শয়তান এবারে বেশ ভালমতেই ধরা পড়েছে, হাজার টানাটানিতেও উঠতে পারছে না। তখন সে তার চিমটেখানি আগুনে তাতিয়ে নিয়ে তা দিয়ে আচ্ছা করে তার নাকটা টিপে ধরল। তারপর তারা স্বামী-স্ত্রী দুজনে মিলে ‘হেঁইয়ো’ বলে সেই চিমটে ধরে টানতেই নাকটা রাবারেব মত লম্বা হতে লাগল। এক হাত, দু হাত, চার হাত, আট হাত—নাক যতই লম্বা হচ্ছে, শয়তান বেটা ততই ষাঁড়ের মত চেঁচাচ্ছে। নাকটা যখন কুড়ি হাত লম্বা হল তখন শয়তান আর থাকতে না পেরে নাকিসুরে বলল, ‘দোহাই দাদা! আর টেনো না, মরে যাব।’
কামার বলল, ‘আরো তিন থলি টাকা, আর সাত বছরের ছুটি— দেবে কিনা বলো।’ শয়তান ব্যস্ত হয়ে বলল, ‘এক্ষুনি, এক্ষুনি, এই নাও।’ বলতে বলতেই তিন থলি ঝকঝকে মোহর এসে কামারের কাছে হাজির হল; কামার সেগুলো সিন্দুকে তুলে শয়তানকে বলল, ‘আচ্ছা তবে যাও।’ শয়তান ছাড়া পেয়েই সেখান থেকে এমনি ছুট দিল যে, ছুট যাকে বলে।
তখন কামার আর তার স্ত্রী মেঝেয় গড়াগড়ি দিয়ে যে হাসিটা হাসল! আর সাত বছরের জন্য তাদের কোনো ভাবনা রইল না। সাত বছর যখন শেষ হল, তখন কামারের টাকাও ফুরিয়ে গেল, তাকে আবার তার ব্যবসা ধরতে হল, ততদিনে শয়তানও আবার তাকে নেবার জন্য এসে উপস্থিত হল।
সাত বছর পরে শয়তান আবার কামারকে নেবার জন্য এসে উপস্থিত হয়েছে। কিন্তু গত বারে সে নাকে যে চিমটি খেয়ে গিয়েছিল, তার কথা ভেবে আর সে সোজাসুজি কামারের সামনে এসে দাঁড়াতে ভরসা পাচ্ছে না, তাই এবারে সে ভারি এক ফন্দি এঁটে এসেছে।
শয়তান জানে যে, কেউ যদি তাকে নিজে থেকে আদর করে নিয়ে যায় তা হলে আর সে কিছুতেই তার হাত ছাড়াতে পারে না। এখন শয়তান করল কি, একটি ঝকঝকে মোহর হয়ে ঠিক কামারের দোকানের সামনে রাস্তায় গিয়ে পড়ে রইল। সে ভাবল যে কামার খেতে পায় না, মোহরটি দেখলে সে পরম আদরে তাকে এসে তুলে নিয়ে যাবে, তারপর আর সে শয়তানকে ফাঁকি দিয়ে যাবে কোথায়?
যে কথা সেই কাজ। কামার সেই মোহরটিকে দেখতে পাওয়া মাত্রই ছুটে গিয়ে সেটিকে তুলে এনে তার থলেয় পুরল। তখন থলের ভিতর থেকে শয়তান হেসে তাকে বলল, ‘কি বাপু, এখন কোথায় যাবে? নিজে ধরে আমাকে ঘরে এনেছ, তার মজাটা এখনই দেখতে পাবে।’
কামার বলল, ‘কী রে বেটা? তুই বুঝি আর মরবার জায়গা জোটে নি, তাই আমার থলের ভিতরে এসেছিস? দাঁড়া, তোকে দেখাচ্ছি!’
একথায় শয়তান এমনি রেগে গেল যে, পারলে সে তখনই কামারকে মেরে শেষ করে। কিন্তু থলের বাইরে এলে তবে ত শেষ করবে! সে যে সেই বিষম থলে— তার ভিতরে ঢুকলে আব বেরোবার হুকুম নেই। শয়তান বেচারার খালি ছটফটিই সার হল, সে আর থলের ভিতর থেকে বেরুতে পারল না। ততক্ষণে কামার সেই থলেটি তার নেহাইয়ের উপর রেখে গিন্নীকে ডেকে দুজনে দুই প্রকাণ্ড হাতুড়ি নিয়ে, দমাদ্দম দমাদ্দম এমনি পিটুনি জুড়ল যে পিটুনি যাকে বলে। পিটুনি খেয়ে শয়তান খানিক খুব চেঁচাল। তাবপর যখন আর চেঁচানি আসে না, তখন গোঙাতে গোঙাতে বলল, ‘ছেড়ে দাও দাদা, তোমাব পায়ে পড়ি। এবার তোমাকে বিশাল বিশাল ছয় থলে ভরা মোহর দেব, আর -আর কখনো তোমার কাছে আসব না।’
এ কথায় কামারের গিন্নি বলল, ‘ওগো, সে হলে নেহাত মন্দ হবে না,দাও হতভাগাকে ছেড়ে।’ তখন কামার বলল, ‘কই তোর মোহবের থলে?’ বলতে বলতেই এমনি বড় বড় মোহরের থলে এসে হাজির হল যে তারা দুজনে মিলেও তার একটাকে তুলতে পারে না। তখন কামার একগাল হেসে, তার থলের মুখ খুলে দিয়ে বলল, ‘যা বেটা। ফের তোর পোড়া মুখ এখানে দেখাতে আসবি ত টের পাবি।’ ততক্ষণে শয়তান থলের ভিতর থেকে বেরিয়ে এমনি ব্যস্ত হয়ে ছুট দিল যে, কামারের সবকথা শুনতেও পেল না।
সেই ছ’টা থলের ভিতর এতই মোহর ছিল যে, কামার হাজাব ধুমধাম করেও তা শেষ করতে পারল না। চার থলে ভাল করে ফুরুতে না ফুরুতেই সে বুড়ো হয়ে শেষে একদিন মরে গেল। মরে গিয়ে ভূত হয়ে সে ভাবল যে এখন ত হয় স্বর্গে না হয় নরকে দুটোর একটায় যেতে হবে। আগে স্বর্গের দিকে গিয়েই দেখি, যদি কোনোমতে সেখানে ঢুকতে পারি।
স্বর্গের ফটকের সামনে গিয়ে তার সেই দেবতাটির সঙ্গে দেখা হল, যিনি তাকে সেই তিনটি বর দিয়েছিলেন। তাঁকে দেখে কামার ভারি খুশি হযে ভাবল, ‘এই ঠাকুরটি না আমাকে সেই চমৎকার বরগুলো দিয়েছিলেন? ইনি অবশ্যি আমাকে ঢুকতেও দেবেন।’
কিন্তু দেবতা তাকে দেখেই যার পর নাই রেগে বললেন, ‘এখানে এসেছিস্ কি করতে পালা হতভাগা, শিগগির পালা।’
কাজেই তখন বেচারা আর কি করে? সে সেখান থেকে ফিরে নরকের দিকে চলল। সেখানকার ফটকের সামনে উপস্থিত হলে শয়তানের দরোয়ানেরা তাকে জিজ্ঞাসা করল, ‘তোমার নাম?’
কামার তার নাম বলতেই পাঁচ-ছয়টা দরোয়ান ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে গিয়ে শয়তানকে বলল, ‘মহারাজ! সেই কামার এসেছে।’ তা শুনে শয়তান বিষম চমকে গিয়ে একটা লাফ যে দিল। তারপর পাগলের মত ফটকের কাছে ছুটে এসে দরোয়ানদের বলল, ‘শিগ্গির দরজা বন্ধ কর। আঁট হুড়কো। লাগা তালা। খবরদার। ও বেটাকে ঢুকতে দিবি না।’ ও এলে আর কি আমাদের রক্ষা থাকবে।’
শয়তানের গলা শুনে কামার গরাদের ভিতর দিয়ে উকি মেরে হাসতে হাসতে বলল, ‘কি দাদা কি খবর?’ সে কথা শেষ না হতেই শয়তান এক লাফে এসে এমনি তার নাক মলে দিল যে কি বলব! কামার তখনই সেখান থেকে চেঁচাতে চেঁচাতে ছুটে পালাল, কিন্তু তার আগেই তার নাকে আগুন ধরে গিয়েছিল। সে আগুন আজও নেবে নি। কামার তার জ্বালায় অস্থির হয়ে জলায় জলায় নাক ডুবিয়ে বেড়ায়। লোকে সেই আগুন দেখতে পেলে বলে, ‘ঐ আলেয়া।’