উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/গল্পমালা/গুপি গাইন ও বাঘা বাইন

লুয়া ত্রুটি মডিউল:Header_template এর 348 নং লাইনে: bad argument #1 to 'next' (table expected, got nil)।

গুপি গাইন ও বাঘা বাইন

 তোমরা গান গাইতে পার? আমি একজন লোকের কথা বলব, সে একটা গান গাইতে পারত। তার নাম ছিল গুপি কাইন, তার বাবার নাম ছিল কানু কাইন। তার একটা মুদীর দোকান ছিল। গুপি কিনা একটা গান গাইতে পারত, আর সে গ্রামের আর কেউ কিছু গাইতে পারত না, তাই তারা তাকে খাতির করে বলত গুপি ‘গাইন’।

 গুপি যদিও একটা বই গান জানত না, কিন্তু সেই একটা গান সে খুব করেই গাইত সেটা না গেয়ে সে তিলেকও থাকতে পারত না, তার দম আটকে আসত। যখন সে ঘরে বসে গাইত, তখন তার বাবার দোকানের খদ্দেব সব ছুটে পালাত। যখন সে মাঠে গিয়ে গান গাইত, তখন মাঠের যত গরু সব দড়ি ছিঁড়ে ভাগত। শেষে আর তার ভয়ে তার বাবার দোকানে খদ্দেরই আসে না, রাখালেরাও মাঠে গরু নিয়ে যেতে পারে না। তখন একদিন কানু কাইন তাকে এই বড় বাঁশ নিয়ে তাড়া করতে সে ছুটে মাঠে চলে গেল সেখানে রাখালের দল লাঠি নিয়ে আসতে বনের ভিতর গিয়ে খুব করে গলা ভাঁজতে লাগল।

 গুপিদের গ্রামের কাছেই আরেকটা গ্রামে একজন লোক থাকত, তার নাম ছিল পাঁচু পাইন। পাঁচুর ছেলেটির বড় ঢোলক বাজাবার শখ ছিল। বাজাতে বাজাতে সে বিষম ঢুলতে থাকত, আর পা নাড়ত আর চোখ পাকাত আর দাঁত খিঁচোত, আর ভ্রূকুটি করত। তার গ্রামের লোকেরা তা দেখে হাঁ করে থাকত আর বলত ‘আহা। আহা। আহ। আহ হ্ হ্ হ্।’ শেষে যখন হা, হা, হা হা’ ব’লে বাঘের মত খেঁকিয়ে উঠত, তখন সকলে পালাবার ফাঁক না পেয়ে চিৎপাত হয়ে পড়ে যেত। তাই থেকে সকলে তাকে বলত ‘বাঘা বাইন’। তার এই বাঘা নামই রটে গিযেছিল, আসল নাম যে তার কি তা কেউ জানত না।

 বাঘা ঢোলক বাজাত আর রোজ একটা করে ঢোলক ভাঙত। শেষে আর পাঁচু তার ঢোলকের পয়সা দিয়ে উঠতে পারে না। কিন্তু বাঘার বাজনা বন্ধ হবে, তাও কি হয়? গ্রামের লোকেরা পাঁচুকে বলল, ‘তুমি না পার, নাহয় আমবাই সকলে চাঁদা করে ঢোলকের পয়সাটা দি। আমাদের গ্রামে এমন একটা ওস্তাদ হয়েছে, তার বাজনাটা বন্ধ হয়ে যাবে।’ শেষে ঠিক হল যে গ্রামের সকলে চাঁদা করে বাঘাকে একটা ঢোলক কিনে দেবে, আর সেই ঢোলকটি আর তার ছাউনি খুব মজবুত হবে, যাতে বাঘার হাতেও সেটা আর সহজে না ছেঁডে।

 সে যা ঢোলক হল’ তার মুখ হল সাড়ে-তিন হাত চওডা, আর ছাউনি মোষের চামড়ার। বাঘা সেটা পেয়ে যার পর নাই খুশি হয়ে বললে, ‘আমি দাঁড়িয়ে বাজাব।’

 তখন থেকে সে দাঁডিযে দাঁড়িয়ে সেই ঢোলক লাঠি দিয়ে বাজায়। দেড় মাস দিনরাত বাজিয়েও বাঘা সেটাকে ছিঁড়তে পারল না। ততদিনে তার বাজনা শুনে শুনে তার বাপ মা পাগল হয়ে গেল, গ্রামের লোকের মাথা ঘুরতে লাগল। আর দিনকতক এইভাবে চললে কি হত বলা যায় না। এব মধ্যে একদিন গ্রামের সকলে মিলে মোটা মোটা লাঠি নিয়ে এসে বাঘাকে বলল, ‘লক্ষ্মী, দাদা। তোমাকে দশ হাঁড়ি মিঠাই দিচ্ছি, অন্য কোথাও চলে যাও, নইলে আমরা সবাই পাগল হয়ে যাব।’

 বাঘা আর কি করে? তখন কাজেই তাকে অন্য একটা গ্রামে যেতে হল। সেখানে দুদিন থাকতে থাকতেই সেখানকার সকলে মিলে তাকে গ্রাম থেকে বার করে দিল। তারপর থেকে সে যেখানেই যায়, সেখান থেকেই তাকে তাড়িয়ে দেয়। তখন সে করল কি, সারাদিন মাঠে মাঠে ঘুরে বেড়ায়, ক্ষুধার সময় তার নিজের গ্রামে গিয়ে ঢোলক বাজাতে থাকে, আর গ্রামের লোক তাড়াতাড়ি তাকে কিছু খাবার দিয়ে বিদায় করে বলে, ‘বাঁচলাম।’ তারপর এমন হল যে আর কেউ তাকে খেতে দেয় না। আর তার ঢোলকের আওয়াজ শুনলেই আশপাশের সকল গ্রামের লোক লাঠি নিয়ে আসে। তখন বেচাবা ভাবল, ‘আর না! মূর্খদের কাছে থাকার চেয়ে বনে চলে যাওয়াই ভাল। না হয় বাঘে খাবে, তবুও আমার বাজনা চলবে!’ এই বলে বাঘা তার ঢোলকটিকে ঘাড়ে করে বনে চলে গেল।

 এখন বাঘার বেশ মজাই হয়েছে। এখন আর কেউ তার বাজনা শুনে লাঠি নিয়ে আসে না। বাঘে খাবে দূরে থাক, সে বনে বাঘ-ভাল্লুক কিছু নেই। আছে খালি একটা ভয়ানক জানোয়ার; বাঘা আজও তাকে দেখতে পায় নি, শুধু দূর থেকে তার ডাক শুনে ভয়ে থরথরিয়ে কাঁপে, আর ভাবে, ‘বাবা গো। ওটা এলেই ত ঢোলক সুদ্ধ আমাকে গিলে খাবে!’

 যে ভয়ানক জানোয়ার কিন্তু কেউ নয়, সে গুপি গাইন। বাঘা যে ডাক শুনে কাঁপে, সে গুপির গলা ভাঁজা। গুপিও বাঘার বাজনা শুনতে পায়, আর বাঘারই মত ভয়ে কাঁপে। শেষে একটু ভাবল, ‘এ বনে থাকলে কখন প্রাণটা যাবে, তার চেয়ে এই বেলা এখান থেকে পালাই।’ এই ভেবে গুপি চুপিচুপি বন থেকে বেরিয়ে পড়ল। বেরিয়েই দেখে আর-একটি লোকও এক বিশাল ঢোল মাথায় করে সেই বনের ভিতর থেকে আসছে। তাকে দেখেই ভারি আশ্চর্য হয়ে গুপি জিজ্ঞাসা কর, ‘তুমি কে হে?’

 বাঘা বললে, ‘আমি বাঘা বাইন; তুমি কে হে?’

 গুপি বললে, ‘আমি গুপি গাইন; তুমি কোথায় যাচ্ছ?’

 বাঘা বললে, ‘যেখানে জায়গা জোটে, সেইখানেই যাচ্ছি। গ্রামের লোকগুলো গাধা, গানবাজনা বোঝে না, তাই ঢোলটি নিয়ে বনে চ’লে এসেছিলাম। তা ভাই, এখানে যে ভয়ংকর জানোয়ারের ডাক শুনেছি, তার সামনে পড়লে আর প্রাণটি থাকবে না। তাই পালিয়ে যাচ্ছি।’

 গুপি বললে, ‘তাই ত! আমিও যে একটা জানোয়ারের ডাক শুনেই পালিয়ে যাচ্ছিলাম। বলো ত, তুমি জানোয়ারটাকে কোথায় বসে ডাকতে শুনেছিলে?’ বাঘা বললে, ‘বনের পূর্বধারে, বটগাছের তলায়।’

 গুপি বললে, ‘আচ্ছা, সে যে আমারই গান শুনেছ! সে কেন জানোয়ারের ডাক হবে? সেই জানোয়ারটা ডাকে বনের পশ্চিম ধারে, হরতুকীতলায় ব’সে।’

 বাঘা বললে, ‘সে ত আমার ঢোলকের আওয়াজ, আমি যে ঐখানে থাকতাম।’

 এতক্ষণে তারা বুঝতে পারল যে, তারা তাদের নিজেদের গান আর বাজনা শুনেই ভয়ে পালিয়ে যাচ্ছিল। তখন যে দুজনার হাসি! অনেক হেসে তারপর গুপি বললে, ‘ভাই, আমি যেমন গাইন, তুমি তেমনি বাইন! আমরা দুজনে জুটলে নিশ্চয় একটা কিছু করিতে পারি।’

 এ কথায় বাঘারও খুবই মত হল। কাজেই তারা খানিক কথাবার্তার পর ঠিক করল যে, তারা দুজনায় মিলে রাজামশাইকে গান শোনাতে যাবে, রাজামশাই যে তাতে খুব খুশি। হবেন, তাতে ত আর ভুলই নেই, চাই কি অর্ধেক রাজ্য বা মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দিয়ে ফেলতে পারেন।

 গুপির আর বাঘার মনে এখন খুবই আনন্দ, তারা রাজাকে গান শুনাতে যাবে। দুজনে হাসতে হাসতে আর নাচতে নাচতে এক প্রকাণ্ড নদীর ধারে এসে উপস্থিত হল, সেই নদী পার হয়ে রাজবাড়ি যেতে হয়।

 নদীতে খেয়া আছে, কিন্তু নেয়ে পয়সা চায়। বেচারারা বন থেকে এসেছে, পয়সা কোথায় পাবে! তারা বলল, ‘ভাই, আমাদের কাছে ত পয়সা-টয়সা নেই, আমরা নাহয় তোমাদের গেয়ে বাজিয়ে শোনাব, আমাদের পার করে দাও।’ তাতে খেয়ার চড়নদারেরা খুব খুশি হয়ে নেয়েকে বলল, ‘আমরা চাঁদা করে এদের পয়সা দেব, তুমি এদের তুলে নাও।’

 বাঘার ঢোলটি দেখেই নেয়েরও বাজনা শুনতে ভারি সাধ হয়েছিল, কাজেই সে এক কথায় আর কোনো আপত্তি করল না। গুপিকে আর বাঘাকে তুলে নিয়ে নৌকো ছেড়ে দেওয়া হল। নৌকো-ভরা লোক, বসে বাজাবার জায়গা কোথায় হবে? অনেক কষ্টে সকলের মাঝখানে খানিকটা জায়গা হতে হতে নৌকোও নদীর মাঝখানে এসে পড়ল। তারপর খানিক একটু গুনগুনিয়ে গুপি গান ধরল, বাঘা তার ঢোলকটিতে লাঠি লাগল, আর অমনি নৌকোসুদ্ধ সকল লোক বিষম চমকে গিয়ে গড়াগড়ি আর জড়াজড়ি করে দিল নৌকো খানাকে উলটে।

 তখন ত আর বিপদের অন্তই নাই। ভাগ্যিস বাঘার ঢোলকটি এত বড় ছিল, তাই আঁকড়ে ধরে দুজনার প্রাণরক্ষা হল। কিন্তু তাদের আর রাজবাড়ি যাওয়া ঘটল না। তারা সারাদিন সেই নদীর স্রোতে ভেসে শেষে সন্ধ্যাবেলায় এক ভীষণ বনের ভিতরে গিয়ে কূলে ঠেকল। সে বনে দিনের বেলায় গেলেই ভয়ে প্রাণ উঠে যায়, রাত্রির ত আর কথাই নেই। এখন বাঘা বলল, ‘গুপিদা, বড়ই ত বিষম দেখছি! এখন কি করি বল।’ গুপি বলল, ‘করব আর কি? আমি গাইব, তুমি বাজাবে। নিতান্তই যখন বাঘে খাবে তখন আমাদের বিদ্যেটা তাকে না দেখিয়ে ছাড়ি কেন?'

 বাঘা বলল, ‘ঠিক বলেছ দাদা। মরতে হয় ত ওস্তাদলোকের মতন মরি, পাড়াগেঁয়ে ভূতের মত মরতে রাজি নই!’

 এই ব’লে দুজনায় সেই ভিজা কাপড়েই প্রাণ খুলে গান বাজনা শুরু করল। বাঘার ঢোলটি সেদিন কিনা ভিজে ছিল, তাইতে তার আওয়াজটি হয়েছিল যার পর নাই গম্ভীর। আর গুপিও ভাবছিল, এই তার শেষ গান, কাজেই তার গলার আওয়াজটিও খুবই গম্ভীর হয়েছিল। সে গান যে কি জমাট হয়েছিল, সে আর কি বলব?এক ঘণ্টা দুঘণ্টা ক’রে দুপুর রাত হয়ে গেল, তবু তাদের সে গান থামছেই না।

 এমন সময় তাদের দুজনারই মনে হল, যেন চারদিকে একটা কি কাণ্ড হচ্ছে। ঝাপসা ঝাপসা কালো কালো, এই বড় বড় কি যেন সব গাছের উপর থেকে উঁকি মারতে লেগেছে তাদের চোখগুলো জ্বলছে, যেন আগুনের ভাটা, দাঁতগুলো বেরুচ্ছে যেন মুলোর সার। তা দেখে তখনই আপনা হতে বাঘার বাজনা থেমে গেল, তার সঙ্গে সঙ্গে দুজনার হাত-পা গুটিয়ে, পিঠ বেঁকে, ঘাড় ব’সে, চোখ বেরিয়ে মুখ হাঁ ক’রে এল। তাদের গায়ে এমনি কাঁপুনি আর দাঁতে এমনি ঠকাঠকি ধ’রে গেল যে আর তাদের ছুটে পালাবারও জো রইল না।

 ভূতগুলি কিন্তু তাদের কিছু করল না তারা তাদের গানবাজনা শুনে ভারি খুশি হয়ে এসেছে, তাদের রাজার ছেলের বিয়েতে গুপির আর বাঘার বায়না করতে। গান থামতে দেখে তারা নাকিসুরে বলল, ‘থামলি কেন বাপ? বাজা, বাজা, বাজা!’

 এ কথায় গুপির আর বাঘার একটু সাহস হল; তারা ভাবল, ‘এ ত মন্দ মজা নয়, তবে একটু গেয়েই দেখি না।’ এই বলে যেই তারা আবার গান ধরেছে, অমনি ভূতেরা একজন দুজন করে গাছ থেকে নেমে এসে তাদের ঘিরে নাচতে লাগল।

 সে যে কি কাণ্ডকারখানা হয়েছিল, সে কি না দেখলে বোঝবার জো আছে! গুপি আর বাঘা তাদের জীবনে আর কখনো এমন সমজদারের দেখা পায় নি। সে রাত এমনিভাবেই কেটে গেল। ভোর হলে ত আর ভূতেদের বাইরে থাকবার জো নেই, কাজেই তার একটু আগেই তারা বলল, ‘চল্ বাবা মোদের গোদার বেটার বে’তে! তোদের খুশি করে দিব।’

 গুপি বলল, ‘আমরা যে রাজবাড়ি যাব!’ ভূতেরা বলল, ‘সে যাবি এখন, আগে মোদের বাড়ি একটু গানবাজনা শুনিয়ে যা! তোদের খুশি করে দিব।’ কাজেই তখন তারা দুজনে ঢোল নিয়ে ভূতেদের বাড়ি চলল। সেখানে গানবাজনা যা হল, সে আর বলে কাজ নেই। তারপর তাদের বিদায় করবার সময় ভূতেরা বলল, ‘তোরা কি চাস?’

 গুপি বলল, ‘আমরা এই চাই যে আমরা যেন গেয়ে বাজিয়ে সকলকে খুশি করতে পারি।’ ভূতেরা বলল, ‘তাই হবে, তাদের গানবাজনা শুনলে আর সে গান শেষ হওয়াব আগে কেউ সেখান থেকে উঠে যেতে পারবে না। আর কি চাস?’

 গুপি বলল, ‘আর এই চাই যে আমাদের যেন খাওয়া-পরার কষ্ট না হয়।’ এ কথায় ভূতেরা তাদের একটি থলে দিয়ে বলল, ‘তোরা যখন যা খেতে বা পরতে চাস, এই থলের ভিতরে হাত দিলেই তা পাবি। আর কি চাস?’

 গুপি বলল, ‘আর কি তা ত বুঝতে পারছি না!’ তখন ভূতেরা হাসতে হাসতে তাদের দুজনকে দুজোড়া জুতো এনে দিয়ে বলল, ‘এই জুতো পায়ে দিয়ে তোরা যেখানে যেতে চাইবি, অমনি সেখানে গিয়ে হাজির হবি।’

 তখন ত আর কোনো ভাবনাই রইল না। গুপি আর বাঘা ভূতদের কাছে বিদায় হয়ে, সেই জুতো পায়ে দিয়েই বলল, ‘তবে আমরা এখন রাজবাড়ি যাব!’ অমনি সেই ভীষণ বন কোথায় যেন মিলিয়ে গেল; গুপি আর বাঘা দেখল তারা দুজনে একটা প্রকাণ্ড বাড়ির ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এত বড় আর এমন সুন্দর বাড়ি তারা তাদের জীবনে কখনো দেখে নি। তারা তখনই বুঝতে পারল যে, এ রাজবাড়ি।

 কিন্তু এর মধ্যে ভারি একটা মুশকিল হল। রাজবাড়ির ফটকে যমদূতের মত কতকগুলো দরোয়ান দাঁড়িয়ে ছিল, তারা গুপি আর বাঘাকে সেই ঢোল নিয়ে আসতে দেখেই দাঁত খিঁচিয়ে বলল, ‘এইয়ো! কাঁহা যাতা হ্যায়?’ গুপি থতমত খেয়ে বলল, ‘বাবা, আমরা রাজামশাইকে গান শোনাতে এসেছি।’ তাতে দারোয়ানগুলো আরো বিষম চটে গিয়ে লাঠি দেখিয়ে বলল, ‘ভাগো, হিঁয়াসে।’ গুপি তখন নাক সিঁটকিয়ে বলল, ‘ঈস্! আমরা ত রাজার কাছে যাবই।’ বলতেই অমনি সেই জুতোর গুণে, তারা তৎক্ষণাৎ রাজামশায়ের সামনে উপস্থিত হল।

 রাজবাড়ির অন্দরমহলে রাজামহাশয় ঘুমিয়ে আছেন, রানী তাঁর মাথার কাছে বসে তাঁকে হাওয়া করছেন, এমন সময় কথা নেই বার্তা নেই, গুপি আর বাঘা সেই সর্বনেশে ঢোল নিয়ে হঠাৎ গিয়ে উপস্থিত হল। জুতোর এমনি গুণ, দরজা জানালা সব বন্ধ রয়েছে, তাতে তাদের একটুও আটকায় নি। কিন্তু আসবার বেলা আটকাক, আর নাই আটকাক, আসবার পরে খুবই আটকাল। রানী তাদের দেখে বিষম ভয় পেয়ে, এক চিৎকার দিয়ে তখনই অজ্ঞান হয়ে গেলেন, রাজামশাই লাফিয়ে উঠে পাগলের মত ছুটাছুটি করতে লাগলেন, রাজবাড়িময় হুলস্থূল পড়ে গেল। সিপাই সান্ত্রী সব খাঁড়া ঢাল নিয়ে ছুটে এল।

 বেগতিক দেখে গুপি আর বাঘার মাথায় গোল লেগে গেল। তারা যদি তখন শুধু বলে, ‘আমরা এখান থেকে অমুক জায়গায় চলে যাব,’ সেই তাদের জুতোর গুণে সকল ল্যাঠা চুকে যায়। কিন্তু সে কথা তাদের মনেই হল না। তারা গেল ছুটে পালাতে, আর দু-পা যেতে যেতেই বেচারারা যে মারটা খেল! জুতো, লাঠি, চাবুক, কিল, চড়, কানমলা তাদের বাকি রইল না। শেষে রাজামশাই হুকুম দিলেন, ‘বেটাদের নিয়ে তিন দিন হাজতে ফেলে রাখো। তারপর বিচার করে, হয় এদের মাথা কাটব, না হয় কুত্তা দিয়ে খাওয়াব।’

 হায় গুপি! হায় বাঘা! বেচারারা এসেছিল রাজাকে গান শুনিয়ে কতই বকশিশ পাবে ভেবে তার মধ্যে এ কি বিপদ? পেয়াদারা তাদের হাত বেঁধে মারতে মারতে একটা অন্ধকার ঘরে নিয়ে ফেলে রাখল। সেখানে পড়ে বেচারারা একদিন আর গায়ের ব্যথায় নড়তে চড়তে পারল না। তাতে তেমন দুঃখ ছিল না, কিন্তু বাঘার ঢোলটি যে গেল, সেই হল সর্বনাশের কথা! বাঘা বুক মাথা চাপড়িয়ে ভেউ ভেউ করে কাঁদছে, আর বলছে, ‘ও গুপিদা।—ওঃ-ওঃ-হ-হ-হ-হ-অ-অ! আরে ও গুপিদা! মার খেলাম, প্রাণ যাবে, তাতে দুঃখ নেই কিন্তু দাদা, আমার ঢোলকটি যে গেল!’

 গুপির কিন্তু ততক্ষণে মাথা ঠাণ্ডা হয়ে এসেছে। সে বাঘার গায় মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, ‘ভয় কি দাদা? ঢোল গিয়েছে, জুতো আর থলে ত আছে। আমরা নিতান্ত বেকুব, তাই এতগুলো মার খেলাম। যা হোক, যা হবার হয়ে গিয়েছে, এখন এর ভিতর থেকে একটু মজা করে নিতে হবে।’ বাঘা এ কথায় একটু শান্ত হয়ে বলল, ‘কি মজা করবে দাদা?’ গুপি বলল, ‘আগে ত খাবার মজাটা করে নিই, তারপর অন্য মজার কথা ভেবে দেখব এখন।’

 এই বলে সে সেই ভূতের দেওয়া থলির ভিতরে হাত দিয়ে বলল, ‘দাও ত দেখি, এক হাঁড়ি পোলাও।’ অমনি একটা সুগন্ধ যে বেরুল! তেমন পোলাও রাজারাও সচরাচর খেতে পান না। আর সে কি বিশাল হাঁড়ি! গুপি কি সেটা থলির ভিতর থেকে তুলে আনতে পারে? যা হোক, কোনমতে সেটাকে বার করে এনে তারপর থলিকে বলল, ‘ভাজা, ব্যঞ্জন, চাটনি, মিঠাই, দই, রাবড়ি, শরবত।—শিগ্‌গির শিগ্‌গির দাও।’ দেখতে দেখতে খাবার জিনিসে আর সোনারূপোর বাসনে ঘর ভরে গেল। দুজন লোকে আর কত খাবে? সে অপূর্ব খাবার খেয়ে তাদের গায়ের ব্যথা কোথায় চলে গেল তার আর ঠিক নেই।

 তখন বাঘা বলল, ‘দাদা, চলো এই বেলা এখান থেকে পালাই, নইলে শেষে কুত্তা দিয়ে খাওয়াবে।’ গুপি বলল, ‘পাগল হয়েছ নাকি? আমাদের এমন জুতো থাকতেই কুত্তা দিয়ে খাওয়াবে? দেখাই যাক না, কি হয়।’ এ কথায় বাঘা খুব খুশি হল, সে বুঝতে পারল যে, গুপিদা একটা-কিছু মজা করবে।

 দুদিন চলে গেল, আর একদিন পরেই রাজা তাদের বিচার করবেন। বিচারের দিন রাত থাকতে উঠে গুপি থলের ভিতর হাত দিয়ে বলল, ‘আমাদের দুজনের রাজপোশাক চাই।’ বলতেই তার ভিতর থেকে এমন সুন্দর পোশাক বেরুল যে তেমন পোশাক কেউ তয়েরই করতে পারে না। সেই পোশাক তারা দুজনে পরে, তাদের পুরনো কাপড় আর বাসন কখানি পুঁটুলি বেঁধে নিয়ে, জুতো পায় দিয়ে তারা বলল, ‘এখন আমরা মাঠে হাওয়া খেতে যাব।’ অমনি দেখে, রাজবাড়ির বাইরের প্রকাণ্ড মাঠে চলে এসেছে। সে মাঠের এক জায়গায় তাদের পুঁটুলিটি লুকিয়ে রেখে, তারা বেড়াতে বেড়াতে এসে রাজবাড়ির সামনে উপস্থিত হল।

 দুর থেকে তাদের আসতে দেখেই রাজার লোক ছুটে গিয়ে তাঁকে খবর দিয়েছিল যে, ‘মহারাজ, দুজন রাজা আসছেন।’ রাজাও তা শুনে তাঁর ফটকের সামনে এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন। বাঘা আর গুপি আসতেই তিনি তাঁদের যার পর নাই আদর দেখিয়ে বাড়ির ভিতরে নিয়ে গেলেন। চমৎকার একটি ঘরে তাদের বাসা দেওয়া হল। কত চাকর, বামুন, পেয়াদা, পাইক তাদের সেবাতে লেগে গেল, তার অন্ত নেই।

 তাবপর গুপি আর বাঘা হাত-পা ধুয়ে জলযোগ করে একটু ঠাণ্ডা হলেই রাজামশাই আবার তাদের খবর নিতে এলেন। তাদের পোশাক দেখে অবধিই তিনি ভেবে নিয়েছেন যে, ‘না জানি এঁরা কত বড় রাজাই হবেন।’ তারপর শেষে যখন তিনি গুপিকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনারা কোন্ দেশের রাজা?’ তখন গুপি হাত জোড় করে তাঁকে বলল, ‘মহারাজ! আমরা কি রাজা হতে পারি? আমরা আপনার চাকর!’

 গুপি সত্য কথাই বলেছিল, কিন্তু রাজার তাতে বিশ্বাস হল না। তিনি ভাবলেন, ‘কি ভাল মানুষ, কেমন নরম হয়ে কথা বলে। যেমন বড় বাজা তেমনি ভদ্রলোকও দেখছি।’ তিনি তখন আর বিশেষ কিছু না বলে তাদের দুজনকে তাঁর সভায় নিয়ে এলেন। সেখানে সেদিন সে দুটো লোকের বিচাব হবে—তিনদিন আগে যারা গিয়ে তাঁর শোবার ঘরে ঢুকেছিল। বিচারের সময় উপস্থিত, আসামী দুটোকে আনতে পেযাদা গিয়েছে, কিন্তু তাদের আর কোথায় পাবে? এ তিন দিন তাদের ঘরে তালা বন্ধ ছিল, সেই তালা খুলে দেখা হল, সেখানে কেউ নেই, খালি ঘর পড়ে আছে।

 তখন ত ভারি একটা ছুটোছুটি হাঁকাহাঁকি পড়ে গেল। দারোগামশাই বিষম ক্ষেপে গিয়ে পেয়াদাগুলোকে বকতে লাগলেন। পেয়াদারা হাত জোড় করে বলল, ‘হুজুর! আমাদের কোনো কসুর নেই, আমরা তালা দিয়ে রেখেছিলাম, তার উপর আবার আগাগোড়া দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ও দুটো ত মানুষ ছিল না, ও দুটো ছিল ভূত, নইলে এর ভিতর থেকে কি করে পালায়।’

 এ কথায় সকলেরই বিশ্বাস হল। রাজামশাইও প্রথমে দারোগার উপর রেগে তাঁকে কেটেই ফেলতে গিয়েছিলেন, শেষে ঐ কথা শুনে বললেন, ‘ঠিক, ও দুটো নিশ্চয় ভূত। আমার ঘরও ত বন্ধ ছিল, তার ভিতর এতবড় ঢোল নিয়ে কি করে ঢুকেছিল?’

 তা শুনে সকলেই বলল, ‘হাঁ, হাঁ, ঠিক ঠিক, ও দুটো ভূত!’ বলতে বলতেই তাদের শরীর শিউরে উঠল, গা বেয়ে ঘাম পড়তে লাগল। তখন তারা বাঘার সেই ঢোলকটির কথা মনে করে বলল, ‘মহারাজ! ভূতের ঢোল বড় সর্বনেশে জিনিস! ওটাকে কখনো আপনার ঘরে রাখবেন না। ওটাকে এখনি পুড়িয়ে ফেলুন।’

 রাজামশাইও বললেন ‘বাপ রে! ভূতের ঢোল ঘরে রাখব এক্ষুনি ওটাকে এনে পোড়াও।’

 যেই এ কথা বলা, অমনি বাঘা দুহাতে চোখ ঢেকে ‘হাউ-হাউ-হাউ-হাউ’ করে কেঁদে গড়াগড়ি দিতে লাগল।

 সেদিন বাঘাকে নিয়ে গুপির কি মুশকিলই হয়েছিল। ঢোল পোড়াবার নাম শুনেই বাঘা কাঁদতে আরম্ভ করেছে, ঢোল এনে তাতে আগুন ধরিয়ে দিলে না-জানি সে কি করবে। তখন, সেটা যে তারই ঢোল, সে কথা কি আর বাঘা সামলে রাখতে পারবে? কি সর্বনাশ! এখন বুঝি ধরা পড়ে প্রাণটাই হারাতে হয়।

 গুপির বড়ই ইচ্ছা হচ্ছিল যে বাঘাকে নিয়ে ছুটে পালায়। কিন্তু তার ত আর জো নেই, সভায় বসবার সময় যে সেই জুতোগুলো পা থেকে খুলে রাখা হয়েছে।

 এদিকে কিন্তু বাঘার কাণ্ড দেখে সভাময় এক বিষম হুলুস্থুল পড়ে গেছে। সবাই ভাবছে, বাঘার নিশ্চয় একটা ভারি অসুখ হয়েছে, আর সে বাঁচবে না। রাজবাড়ির বদ্যিঠাকুর এসে বাঘার নাড়ি দেখে যার পর নাই গম্ভীরভাবে মাথা নাড়লেন। বাঘাকে খুব করে জোলাপের ওষুধ খাইয়ে তার পেটে বেলেস্তারা লাগিয়ে দেওয়া হল। তারপর বদ্যিঠাকুর বললেন, ‘এতে যদি বেদনা না সারে, তবে পিঠে আর-একটা, তাতেও না সারলে দুপাশে আর দুটো বেলেস্তারা লাগাতে হবে।’

 এ কথা শুনেই বাঘার কান্না তৎক্ষণাৎ থেমে গেল। তখন সকলে ভাবল যে, বদ্যিঠাকুর কি চমৎকার ওষুধই দিয়েছে, দিতে দিতেই বেদনা সেরে গেছে।

 যা হোক, বাঘা যখন দেখল যে তার কান্নাতে ঢোল পোড়াবার কথাটা চাপা পড়ে গেছে, তখন সেই বেলেস্তারার বেদনার ভিতরেই তার মনটা কতক ঠাণ্ডা হল। রাজামশাই তখন তাকে খুব যত্নের সহিত তার ঘরে শুইয়ে রেখে এলেন, গুপি তার কাছে বসে তার বেলেস্তারায় হাওয়া করতে লাগল।

 তারপর সকলে ঘর থেকে চলে গেলে গুপি বাঘাকে বলল, ‘ছি, ভাই, যেখানে-সেখানে কি এমন করে কাঁদতে আছে? দেখ দেখি, এখন কি মুশকিল হল।’ বাঘা বলল, ‘আমি যদি না কাঁদতুম, তা হলে ত এতক্ষণে আমার ঢোলকটি পুড়িয়ে শেষ করে দিত। এখন না হয় একটু জ্বলুনি সইতে হচ্ছে, কিন্তু আমার ঢোলকটা ত বেঁচে গেছে!’

 বাঘা আর গুপি এমনি কথাবার্তা বলছে। এদিকে রাজামশাই সভায় ফিরে এলে দারোগামশাই তার কানে কানে বললেন, ‘মহারাজ, একটা কথা আছে, অনুমতি হয় ত বলি।’ রাজা বললেন, ‘কি কথা?’ দারোগা বললেন, ‘মহারাজ, ঐ যে লোকটা গড়াগড়ি দিয়ে কাঁদল, সে আর তার সঙ্গের ঐ লোকটা, সেই দুই ভূত আমি তাদের চিনতে পেরেছি।’ রাজা বললেন, ‘তাই ত হে, আমারও একটু যেন সেইরকমই ঠেকছিল। তা হলে ত বড় মুশকিল দেখছি। বলো ত এখন কি করা যায়?’

 তখন এ কথা নিয়ে সভার মধ্যে ভারি একটা কানাকানি শুরু হল। কেউ বলল, ‘রোজা ডাকো, ও দুটোকে তাড়িয়ে দিক।’ আর-একজন বলল, ‘রোজা যদি তাড়াতে না পারে, তখন ত সে দুটো ক্ষেপে গিয়ে একটা বিষম কিছু করতে পারে। তার চেয়ে কেন রাত্রে ঘুমের ভিতরে ও দুটোকে পুড়িয়ে মারুন না।’

 এ কথাটা সকলেরই খুব পছন্দ হল, কিন্তু এর মধ্যে একটু মুশকিল এই দেখা গেল যে, ভূতদের পোড়াতে গেলে রাজবাড়িতেও তখন আগুন ধ’রে যেতে পারে। শেষে অনেক যুক্তির পর এই স্থির হল যে, একটা বাগানবাড়িতে তাদের বাসা দেওয়া হবে; বাগানবাড়ি পুড়ে গেলেও বিশেষ ক্ষতি হবে না। রাজামশাই বললেন, ‘সেই ঢোলকটাকেও তা হলে সেই বাগানবাড়িতে নিয়ে রাখা যাক বাগানবাড়ি পোড়াবার সময় একসঙ্গে সকল আপদ চুকে যাবে।’

 বাগানবাড়ি যাবার কথা শুনে গুপি আর বাঘা খুব খুশি হল। তারা ত জানে না যে এর ভিতর কি ভয়ানক ফন্দি রয়েছে; তারা খালি ভাবল যে বেশ আরামে নিরিবিলি থাকা যাবে, সংগীতচর্চারও সুবিধা হতে পারে। জায়গাটি খুবই নিরিবিলি আর সুন্দর। বাড়িটি কাঠের, কিন্তু দেখতে চমৎকার। সেখানে গিয়ে দেখতে দেখতে বাঘা ভাল হয়ে গেল। তখন গুপি তাকে বলল, ‘ভাই, আর এখানে থেকে কাজ কি? চলো আমরা এখান থেকে চ’লে যাই।’ বাঘা বলল, ‘দাদা, এমন সুন্দর জায়গায় ত আর থাকতে পাব না, দুদিন এখানে রইলাম বা। আহা, আমার ঢোলকটি যদি থাকত!’

 সেদিন বাঘা বাড়ির এঘর-ওঘর ঘুরে বেড়াচ্ছে, গুপি বাগানের এক জায়গায় ব’সে গুনগুন করছে, এমন সময় হঠাৎ বাঘা ভয়ানক চেঁচামেচি ক’রে উঠল। তার সকল কথা বোঝা গেল না, খালি ও গুপিদা! ও গুপিদা!’ ডাকটা খুবই শোনা যেতে লাগল। গুপি তখন ছুটে এসে দেখল যে, বাঘা তার সেই ঢোলকটা মাথায় ক’রে পাগলের মত নাচছে, আর যা-তা আবোল-তাবোল বলতে বলতে ‘গুপিদা গুপিদা’ ব’লে চেঁচাচ্ছে। ঢোলক পেয়ে তার এত আনন্দ হয়েছে যে, সে আর কিছুতেই স্থির হতে পারছে না, গুছিয়ে কথাও বলতে পারছে না। এমনি ক’রে প্রায় আধঘণ্টা চ’লে গেলে পর বাঘা একটু শান্ত হয়ে বলল, ‘গুপিদা, দেখছ কি, এই ঘরে আমার ঢোলকটি—আর কি মজা—হাঃ হাঃ হাঃ’ বলে আবার সে মিনিট দশেক খুব নেচে নিল। তারপর সে বলল, ‘দাদা, এত দুঃখের পর ঢোলকটি পেয়েছি, একটা গান গাও, একটু বাজিয়ে নি।’ গুপি বলল, ‘এখন নয় ভাই, এখন বড্ড খিদে পেয়েছে। খাওয়া দাওয়ার পর রাত্রে বারান্দায় ব’সে দুজনায় খুব ক’রে গানবাজনা করা যাবে।’

 রাজামশাই কিন্তু ঠিক করেছেন, সেই রাত্রেরই তাদের পুড়িয়ে মারবেন। দারোগার উপর হুকুম হয়েছে যে, সেদিন সন্ধ্যার সময় সেই বাগানবাড়িতে মস্ত ভোজের আয়োজন করতে হবে। দারোগামশায় পঞ্চাশ-ষাট জন লোক নিয়ে সেই ভোজে উপস্থিত থাকবেন, খাওয়াদাওয়ার পর গুপি আর বাঘা ঘুমিয়ে পড়লে, তারা সকলে মিলে একসঙ্গে সেই কাঠের বাড়ির চারিদিকে আগুন দিয়ে তাদের পালাবার পথ বন্ধ করবেন।

 সেদিনকার খাওয়া বেশ ভালমতই হল। গুপি আর বাঘা ভাবল যে লোকজন চ’লে গেলেই তারা গান-বাজনা আরম্ভ করবে, দারোগামশাই ভাবলেন যে গুপি আর বাঘা ঘুমোলেই ঘরে আগুন দেবেন। তিনি তাদের ঘুম পাড়াবার জন্য বড়ই ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। তাঁর ভাব দেখে যখন স্পষ্টই বোঝা গেল যে, তারা না ঘুমোলে তিনি সেখান থেকে যাবেন না, তখন গুপি বাঘাকে নিয়ে গিয়ে বিছানায় প’ড়ে নাক ডাকাতে লাগল।

 একটু পরেই গুপি আর বাঘা দেখল যে লোকজন সব চ’লে গেছে, আর কারু সাড়াশব্দ নেই। তারপর আর-একটু দেখে, যখন মনে হল যে বাগান একেবারে খালি হয়ে গেছে, তখন তারা দুজনে বারান্দায় এসে ঢোল বাজিয়ে গান জুড়ে দিল।

 এদিকে দারোগামশাই তাঁর লোকদের ব’লে দিয়েছেন, ‘তোরা প্রত্যেক দরজায় বেশ ভাল ক’রে আগুন ধরাবি;খবরদার, আগুন ভাল ক’রে না ধরলে চ’লে যাস নি যেন!’ তিনি নিজে গিয়েছেন সিঁড়িতে আগুন ধরাতে। আগুন বেশ ভাল মতই ধরেছে। দারোগামশাই ভাবছেন, ‘এই বেলা ছুটে পালাই’ এমন সময় বাঘার ঢোল বেজে উঠল, গুপিও গান ধ’রে দিল। তখন আর দারোগামশাই বা তার লোকদের কারু সেখান থেকে নড়বার জো রইল না, সকলকেই পুড়ে মরতে হল। ততক্ষণে গুপি আর বাঘাও আগুন দেখতে পেয়ে, তাদের জুতোর জোরে, তাদের ঢোল আর থলেটি নিয়ে সেখান থেকে চম্পট দিল।

 সেদিনকার আগুনে দারোগামশাই ত পুড়ে মারা গিয়েছিলেনই, তাঁর দলের অতি অল্প লোকই বেঁচেছিল। সেই লোকগুলো গিয়ে রাজামশাইকে এই ঘটনার খবর দিতে তাঁর মনে বড়ই ভয় হল। পরদিন আর দু-চারজন লোক রাজসভায় এসে বলল যে, তারা সেই আগুনের তামাশা দেখতে সেখানে গিয়েছিল; তারা তখন ভারি আশ্চর্যরকমের গান-বাজনা শুনেছে, আর ভূত দুটোকে শূন্যে উড়ে পালাতে স্বচক্ষে দেখেছে। তখন যা রাজামশায়ের কাঁপুনি! সেদিন তাঁর সভা করা হল না। তিনি তাড়াতাড়ি বাড়ির ভিতরে এসে ভূতের ভয়ে দরজা এঁটে লেপ মুড়ি দিয়ে শুয়ে রইলেন, এক মাসের ভিতরে আর বাইরে এলেন না।

 এদিকে গুপি আর বাঘা সেই আগুনের ভিতর থেকে পালিয়ে একেবারে তাদের বাড়ির কাছে সেই বনে এসে উপস্থিত হয়েছে, যেখানে প্রথমে তাদের দেখা হয়েছিল। তাদের বড় ইচ্ছা যে এত ঘটনার পর একবার তাদের মা-বাপকে দেখে যায়। বনে এসেই যাঘা বলল, ‘গুপিদা, এইখানে না তোমায় আমায় দেখা হয়েছিল?’ গুপি বলল, ‘হ্যাঁ!’ বাঘা বলল, ‘এমন জায়গায় এসে কি একটু গান বাজনা না ক’রে চলে যেতে আছে?’ গুপি বলল, ‘ঠিক বলেছ ভাই, তবে আর দেরি কেন? এই বেলা আরম্ভ ক’রে দাও।’ এই ব’লে তারা প্রাণ খুলে গানবাজনা করতে লাগল।

 এর মধ্যে এক আশ্চর্য ঘটনা হয়েছে। এক দল ডাকাত হাল্লার রাজার ভাণ্ডার লুটে, তার ছোট ছেলে দুটিকে সুদ্ধ চুরি ক’রে নিয়ে পালিয়ে এসেছিল, রাজা অনেক সৈন্য নিয়ে তাদের পিছু পিছু প্রাণপণে ছুটেও ধরতে পারছিলেন না। গুপি আর বাঘা যখন গান ধরেছে ঠিক সেই সময়ে সেই ডাকাতগুলোও সেই বনের ভিতর দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু সে গান একবার শুনলে ত আর তার শেষ অবধি না শুনে চ’লে যাবার জো নেই;কাজেই ডাকাতদের তখনি সেখানে দাঁড়াতে হল। সারা রাত্রের ভিতরে আর সে গান-বাজনাও থামল না, ডাকাতদেরও সেখান থেকে যাওয়া ঘটল না। সকালে হাল্লার রাজা এসে অতি সহজেই তাদের ধরে ফেললেন। তারপর যখন তিনি জানলেন যে, গুপি আর বাঘার গানের গুণেই তিনি ডাকাত ধরতে পেরেছেন, তখন আর তাদের আদর দেখে কে? রাজকুমারেরাও বললেন, ‘বাবা, এমন আশ্চর্য গান আর কখ্‌খনো শোন নি; এদের সঙ্গে নিয়ে চলো।’ কাজেই রাজা গুপি আর বাঘাকে বললেন, ‘তোমরা আমার সঙ্গে চলো! তোমাদের পাঁচশো টাকা করে মাইনে হল।’

 এ কথায় গুপি জোড়হাতে রাজামশাইকে নমস্কার ক’রে বলল, ‘মহারাজ, দয়া করে আমাদের দুদিনের ছুটি দিতে আজ্ঞা হোক। আমরা আমাদের পিতা-মাতাকে দেখে তাঁদের অনুমতি নিয়ে আপনার রাজধানীতে গিয়ে উপস্থিত হব।’ রাজা বললেন, ‘আচ্ছা এ দুদিন আমরা এই বনেই বিশ্রাম করছি তোমরা তোমাদের মাবাপকে দেখে দুদিন পরে এসে এইখানেই আমাদের পাবে।’

 গুপিকে তাড়িয়ে অবধি তার বাবা তার জন্য বড়ই দুঃখিত ছিল, কাজেই তাকে ফিরে আসতে দেখে তার বড় আনন্দ হল। কিন্তু বাঘা বেচারার ভাগ্যে সে সুখ মেলে নি। তার মা বাপ এর কয়েকদিন আগেই মারা গিয়েছিল। গ্রামের লোকেরা তাকে ঢোল মাথায় ক’রে আসতে দেখেই বলল, ‘ঐ রে! সেই বাঘা বেটা আবাব আমাদের হাড় জ্বালিয়ে মারবে;মাব বেটাকে!’ বাঘা বিনয় ক’রে বলল, ‘আমি খালি আমার মা বাবাকে দেখতে এসেছি দুদিন থেকেই চলে যাব, বাজাব টাজাব না।’ সে কথা কি তাবা শোনে? তারা দাঁত খিঁচিয়ে তার মা বাপের মৃত্যুর কথা বলে এই বড় লাঠি নিয়ে তাকে মারতে এল, সে প্রাণপণে ছুটে পালাতে পালাতে ইট মেরে তার পা ভেঙে মাথা ফাটিয়ে রক্তারক্তি করে দিল।

 গুপি তাদের ঘরের দাওযায় ব’সে তার বাপের সঙ্গে কথা বলছিল, এমন সময় সে দেখল যে বাঘা পাগলের মত হয়ে খোঁড়াতে খোঁড়াতে ছুটে আসছে; তার কাপড় ছিঁড়ে ফালি ফালি আর রক্তে লাল হয়ে গেছে। অমনি সে তাড়াতাড়ি বাঘার কাছে ছুটে গিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘কি হয়েছে? তোমার এ দশা কেন?’ গুপিকে দেখেই বাঘা একগাল হেসে ফেলেছে। তারপব সে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, ‘দাদা, বড় বেঁচে এসেছি! মূর্খণ্ডলো আর একটু হলেই আমার ঢোলটি ভেঙে দিয়েছিল। গুপিদের বাড়ি এসে গুপির যত্নে আর তার মা বাপের আদরে বাঘার দুদিন যতটা সম্ভব সুখেই কাটল। দুদিন পরে গুপি তার মা-বাপের কাছ থেকে বিদায় নেবার সময় ব’লে গেল, ‘তোমরা তয়ের হয়ে থাকবে; আমরা ছুটি পেলেই এসে তোমাদের নিয়ে যাব।’

 তারপর কয়েক মাস চ’লে গিয়েছে। গুপি আব বাঘা এখন হাল্লার রাজার বাড়িতে পরম সুখে বাস করে। দেশ বিদেশে তাদের নাম রটে গিয়েছে—‘এমন ওস্তাদ আর কখনো হয় নি, হবেও না।’ রাজামশাই তাদেব ভারি ভালবাসেন তাদের গান না শুনে একদিনও থাকতে পারেন না। নিজের দুঃখ সুখের কথা সব গুপিব কাছে বলেন। একদিন গুপি দেখল রাজামশায়ের মুখখানি বড়ই মলিন। তিনি ক্রমাগতই যেন কি ভাবছেন, যেন তাঁর কোনো বিপদ হয়েছে। শেষে একবার তিনি গুপিকে বললেন, ‘গুপি বড় মুশকিলে পড়েছি, কি হবে জানি না। শুণ্ডীর রাজা আমার রাজ্য কেড়ে নিতে আসছে।’

 শুণ্ডীর বাজা হচ্ছেন সেই তিনি যিনি গুপি আর বাঘাকে পুড়িয়ে মারতে চেয়েছিলেন। তাঁর নাম শুনেই গুপির মনে একটা চমৎকার মতলব এল। সে তখন বাজামশাইকে বলল, ‘মহারাজ! এর জন্য কোন চিন্তা করবেন না। আপনার এই চকরকে হুকুম দিন, আমি এ থেকে হাসির কাণ্ড ক’রে দেব।’ রাজা হেসে বললেন, ‘গুপি, তুমি গাইয়ে বাজিয়ে মানুষ, যুদ্ধের ধারও ধারে না, তার কিছু বোঝও না। শুণ্ডীর বাজার বড় ভারি ফৌজ, আমি কি তার কিছু করতে পারি?’ গুপি বলল, ‘মহারাজ, হুকুম পেলে একবার চেষ্টা করে দেখতে পারি। ক্ষতি ত কিছু হবে না।’ রাজা বললেন, ‘তোমরা যা ইচ্ছা তাই তুমি করতে পার।’

এ কথায় গুপি যার পর নাই খুশি হয়ে বাঘাকে ডেকে পরামর্শ করতে লাগল।

 গুপি আর বাঘা সেদিন অনেকক্ষণ ধরে পরামর্শ করেছিল। বাঘার তখন কতই উৎসাহ! সে বলল, ‘দাদা, এবারে আমরা দুজনে মিলে একটা কিছু করবই করব। আমার শুধু একটা কথায় একটু ভয় হচ্ছে;হঠাৎ যদি প্রাণ নিয়ে পালাবার দরকার হয়, তবে হয়ত আমি জুতোর কথা ভুলে গিয়ে সাধারণ লোকের মত কষে ছুট দিতে যাব, আর মার খেয়ে সারা হব। এমনি করে দেখনা সেবারে আমাদের গাঁয়ের মূর্খগুলোর হাতে আমার কি দশা হ’ল!’

 যা হোক, গুপির কথায় বাঘার সে ভয় কেটে গেল, আর পরদিন থেকেই তারা কাজে লাগল। দিনকতক ধরে রোজ রাত্রে তারা শুণ্ডী চলে যায়, আর রাজবাড়ির আশেপাশে ঘুরে সেখানকার খবর নেয়। যুদ্ধের আয়োজন যা দেখতে পেল সে বড়ই ভয়ংকর; এ আয়োজন নিয়ে এরা হাল্লায় গিয়ে উপস্থিত হলে আর রক্ষা নেই। রাজার ঠাকুরবাড়িতে রোজ মহাধুমধামে পুজো হচ্ছে। দশ দিন এমনিতর পুজো দিয়ে, ঠাকুরকে খুশি করে তারা হাল্লায় রওনা দেবে।

 গুপি আর বাঘা এর সবই দেখল, তারপর একদিন তাদের ঘরে ব’সে দরজা এঁটে, সেই ভূতের দেওয়া থলিটিকে বলল, ‘নতুন ধরনের মিঠাই চাই খুব সরেস।’ সে কথায় থলির ভিতর থেকে মিঠাই যা বেরুল, সে আর বলবার নয়। তেমনি মিঠাই কেউ খায় নি, চোখেও দেখে নি। সেই মিঠাই নিয়ে বাঘা আর গুপি শুণ্ডীর রাজার ঠাকুরবাড়ির বিশাল মন্দিরের চুড়োয় গিয়ে বসল। নীচে খুব পুজোর ধুম—ধুপধুনো শঙ্খঘণ্টা কোলাহলের সীমা নেই, আঙিনায় লোকে লোকারণ্য। সেই সব লোকের মাথার উপরে ঝড়াৎ ক’রে মিঠাইগুলো ঢেলে দিয়ে বাঘা আর গুপি মন্দিরের চুড়ো আঁকড়ে বসে তামাশা দেখতে লাগল। অন্ধকারে মধ্যে সেই ধুপধুনো আর আলোর ধোঁয়ার ভিতর দিয়ে কেউ তাদের দেখতে পেল না।

 মিঠাই গুলি আঙিনায় পড়তেই অমনি কোলাহল থেমে গেল। অনেকেই লাফিয়ে উঠল, কেউ কেউ চেঁচিয়ে ছুটও দিল। তারপর দু-চারজন সাহসী লোক কয়েকটা মিঠাই তুলে, আলোর কাছে নিয়ে ভয়ে ভয়ে দেখতে লাগল। শেষে তাদের একজন চোখ বুজে তার একটু মুখে পুরে দিল; দিয়ে আর কথাবার্তা নেই—সে দুহাতে আঙিনা থেকে মিঠাই তুলে খালি মুখে দিচ্ছে আর নাচছে আর আহ্বাদে চেঁচাচ্ছে। তখন সেই আঙিনা-সুদ্ধ লোক মিঠাই খাবার জন্য পাগলের মত কাড়াকাড়ি আর কিচিরমিচির করতে লাগল।

 এদিকে কয়েকজন ছুটে গিয়ে রাজামশাইকে বলেছে, ‘মহারাজ! ঠাকুর আজ পূজোয় তুষ্ট হয়ে স্বর্গ থেকে প্রসাদ পাঠিয়ে দিয়েছেন। সে যে কি অপূর্ব প্রসাদ, সে কথা আমরা বলতে পারছি না।’ সে কথা শুনবামাত্রই রাজামশাই প্রাণপণে কাছা গুঁজতে গুঁজতে ঊর্ধ্বশ্বাসে এসে ঠাকুরবাড়িতে উপস্থিত হলেন।

 কিন্তু হায়! ততক্ষণে সব প্রসাদ শেষ হয়ে গিয়েছিল। সমস্ত উঠোন ঝাঁট দিয়েও রাজামশাইয়ের জন্য একটু প্রসাদের গুঁড়ো পাওয়া গেল না। তখন তিনি ভারি চটে গিয়ে বললেন, ‘তোমাদের কি অন্যায়। পুজো করি আমি, আর প্রসাদ খেয়ে শেষ কর তোমরা! আমার জন্যে একটু খুঁড়োও রাখ না! তোমাদের সকলকে ধ’রে শুলে চড়াব!’ এ কথায় সকলে ভয়ে কাঁপতে কাপতে জোড়হাতে বলল, ‘দোহাই মহারাজ! আপনার প্রসাদ কি আমরা খেয়ে শেষ করতে পারি? বাপ রে! আমরা খেতে না খেতেই ঝাঁ ক’রে কোন্‌খান দিয়ে ফুরিয়ে গেল! আজ আমাদের প্রসাদগুলো আপনি মাপ করুন;কালকের যত প্রসাদ, সব মহারাজ একাই খাবেন!’ রাজা তাতে বললেন, ‘আচ্ছা তাই হবে। খবরদার মনে থাকে যেন।’

 পরদিন রাজামশাই প্রসাদ খাবেন, তাই একপ্রহর বেলা থাকতেই তিনি ঠাকুরবাড়ির আঙিনায় এসে আকাশের পানে তাকিয়ে বসে আছেন। আর সকলে ভয়ে ভয়ে একটু দূরে ব’সে তাঁকে ঘিরে তামাশা দেখছে। আর পূজোর ঘটা অন্যদিনের চেয়ে শতগুণ; সবাই ভাবছে, দেবতা তাতে খুশি হয়ে রাজামশাইকে আরো ভাল প্রসাদ দেবেন।

 রাত-দুপুরের সময় গুপি আর বাঘা আরো আশ্চর্যরকমের মিঠাই নিয়ে এসে মন্দিরের চুড়োয় বসল। আজ তাদের পরনে খুব জমকালো পোশাক, মাথায় মুকুট, গলার হার, হাতে বালা, কানে কুণ্ডল তারা দেবতা সেজে এসেছে। ধোঁয়ার জন্য কিছুই দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু তবু রাজামশাই আকাশের পানে তাকিয়ে আছেন। এমন সময় গুপি আর বাঘা হাসতে হাসতে তাঁর উপরে সেই মিঠাইগুলো ফেলে দিল। তাতে রাজামশাই প্রথমে একটা চিৎকার দিয়ে তিন হাত লাফিয়ে উঠেলেন, তারপর তাড়াতাড়ি সামলিয়ে নিয়ে, দুহাতে মিঠাই তুলে মুখে দিতে লাগলেন, আর ধেই ধেই ক’রে নাচটা যে নাচলেন!

 এমন সময় গুপি আর বাঘা হঠাৎ মন্দিরের চুড়ো থেকে নেমে এসে রাজার সামনে দাঁড়াল। তাদের দেখে সকলে ’ঠাকুর এসেছেন’ ঠাকুর এসেছেন ব’লে কে আগে গড় করবে ভেবে ঠিক পায় না; রাজা মশায়ই ত লম্বা হয়ে মাটিতে পড়েই রয়েছেন, আর খালি মাথা ঠুকছেন। গুপি তাঁকে বলল, ‘মহারাজ! তোমার নাচ দেখে আমরা বড়ই তুষ্ট হয়েছি; এসো তোমার সঙ্গে কোলাকুলি করি।’ রাজা তা শুনে যেন হাতে স্বর্গ পেলেন; দেবতার সঙ্গে কোলাকুলি, সে কি কম সৌভাগ্যের কথা?

 কোলাকুলি আরম্ভ হল। সকলে ‘জয় জয়’ বলে চেঁচাতে লাগল। সেই অবসরে গুপি আর বাঘা রাজামশাইকে খুব ক’রে জড়িয়ে ধ’রে বলল, ‘এখন তবে আমাদের ঘরে যাব!’ বলতে বলতেই তারা তাঁকে সুদ্ধ একেবারে এসে তাদের নিজের ঘরে উপস্থিত। ঠাকুরবাড়ির আঙিনায় সেই লোকগুলো অনেকক্ষণ ধ’রে হাঁ করে আকাশের পানে চেয়ে রইল। তারপর যখন রাজা মশাই আর ফিরলেন না, তখন তারা যে যার ঘরে এসে বলল, ‘কি আশ্চর্যই দেখলাম! রাজামশাই সশরীরে স্বর্গে গেলেন। দেবতারা নিজে তাঁকে নিতে এসেছিলেন!’

 এদিকে রাজামশাই গুপি আর বাঘার কোলে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন, তাদের ঘরে এসেও অনেকক্ষণ তাঁর জ্ঞান হয় নি। ভোরের বেলায় তিনি চোখ মেলে দেখলেন যে, সেই দু’টো ভূত তাঁর মাথার কাছে ব’সে আছে। অমনি তিনি তাদের পায়ে প’ড়ে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, ‘দোহাই বাবা! আমাকে খেয়ো না! আমি দুশো মোষ মেরে তোমাদের পুজো করব।’

 গুপি বলল, ‘মহারাজ, আপনার কোন ভয় নেই। আমরা ভূতও নই, আপনাকে খেতেও যাচ্ছি না।’ রাজামশাইয়ের কিন্তু তাতে একটুও ভরসা হল না। তিনি আর কোনো কথা না বলে মাথা গুঁজে ব’সে কাঁপতে লাগলেন।

 এদিকে বাঘা এসে হাল্লার রাজাকে বলল, ‘কাল রাত্রে আমরা শুণ্ডীর রাজাকে ধ’রে এনেছি; এখন কি আজ্ঞা হয়? হাল্লার রাজা বললেন, ‘তাঁকে নিয়ে এসো।’

 দুই রাজায় যখন দেখা হল, তখন শুণ্ডীর রাজা বুঝতে পারলেন যে তাঁকে ধরে এনেছে। হাল্লা জয় করা ত তাঁর ভাগ্যে ঘটলই না, এখন প্রাণটিও যাবে। কিন্তু হাল্লার রাজা তাঁকে প্রাণে না মেরে শুধু তাঁর রাজ্যই কেড়ে নিলেন। তারপর তিনি গুপি আর বাঘাকে বললেন, ‘তোমরাই আমাকে বাঁচিয়েছ, নইলে হয়ত আমার রাজ্যও যেত, প্রাণও যেত। আমি আর তোমাদের কি উপকার করতে পারি? শুণ্ডীর রাজ্যের অর্ধেক আর আমার দুটি কন্যা তোমাদের দুজনকে দান করলাম।’

 তখন খুবই একটা ধুমধাম হল। গুপি আর বাঘা হাল্লার রাজার জামাই হয়ে আর শুণ্ডীর অর্ধেক রাজ্য পেয়ে পরম আনন্দে সঙ্গীত চর্চা করতে লাগল। গুপির মা-বাপের মান্য আর সুখ তখন দেখে কে?