উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/গল্পমালা/লাল সূতো আর নীল সূতো
লাল সুতো আর নীল সুতো
এক জোলা একদিন তাহার স্ত্রীকে বলিল, ‘আমি পায়েস খাব, পায়েস রেঁধে দাও।’ জোলার স্ত্রী বলিল, ‘ঘরে কাঠ নেই, কাঠ এনে দাও, পায়েস রেঁধে দিচ্ছি।’ জোলা কাঠ আনিতে গেল।
পথের ধারে একটা বড় আম গাছ ছিল, তাহার একটু শুক্নো ডালের আগায় বসিয়া জোলা তাহারই গোড়ার দিকটা কাটিতেছে। তাহা দেখিয়া পথের লোক একজন ডাকিয়া বলল, ‘ওহে ও ডাল কেটো না, কাটলে পড়ে যাবে।’ জোলা বিবক্ত হইয়া বলিল, ‘তুমি গুনতে জানো নাকি? ও ডাল কাটলে পড়ে যাব, তা তুমি কি ক’রে জানলে? আমি পায়েস খাব না বুঝি!’ পথের লোক আর কিছু না বলিয়া চলিয়া গেল। আর, খানিক পরে জোলাও ডালসুদ্ধ পড়িয়া গেল।
গাছ হইতে পড়িয়াই জোলা ভাবিল, ‘তাই ত! আমি প’ড়ে যাব, তা ও জানলে কি করে? ও নিশ্চয় একটা কেউ হবে।’ এই ভাবিয়া জেলা ছুটিয়া গিয়া সেই পথিকের পা জড়াইয়া ধরিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ‘প্রভু আপনি কে? আমি কবে মরব, সেটি আমাকে ব’লে দিন। পথিক ভারি মুশকিলেই পড়িল। জোলার খুব বিশ্বাস হইয়াছে যে, এ পথিক সামান্য পথিক নয়;সুতরাং তাহার প্রশ্নের উত্তর না পাইলে তাহাকে কিছুতেই ছাড়িতেছে না। শেষটা পথিক যখন দেখিল যে, একটা কিছু না বললে তাহার আর ঘরে যাওয়া হইতেছে না, তখন সে রাগিয়া বলিল, ‘তোর পেটের ভিতর থেকে লাল সুতো আর নীল সুতো যখন বেরুবে, তখন তুই মরবি।’ এই কথায় জোলা সন্তুষ্ট হইয়া বাড়ি ফিরিল।
এখন হইতে জোলা ঠিক হইয়া বসিয়া আছে যে, লাল সূতা আর নীল সূতা বাহির হইলেই তাহার মৃত্যু। সুতরাং সে রোজ পরীক্ষা করিয়া দেখে, তাহা বাহির হইল কি না। এইরূপ পরীক্ষা করিতে গিয়া একদিন সত্য সত্যই তাহার কাপড়ে একখণ্ড লাল সূতা আর একখণ্ড নীল সূতা পাইল। আর, অমনি সে চিৎকার করিয়া তাহার স্ত্রীকে বলিল, ‘ওগো শিগ্গির এস, আমি মরে গিয়েছি—আমার লাল সুতো নীল সুতো বেরিয়েছে।’ তাহার স্ত্রী আসিয়া দেখিল, সত্য সত্যই লাল সূতা আর নীল সূতা। তখন সে বেচারা কি করে, জোলাকে বিছানায় শোয়াইয়া কাপড় চাপা দিয়া সে কাঁদিতে বসিল। এর মধ্যে আর দুচারজন জোলা বেড়াইতে আসিয়া দেখে যে, জেলার স্ত্রী কাঁদিতেছে। তারপর জিজ্ঞাসা করিয়া যখন জানিল যে, লাল সূতা নীল সূতা পাওয়া গিয়াছে, তখন সকলে স্থির করিল যে, জোলা নিশ্চয় মরিয়া গিয়াছে। সুতরাং তাহার সুৎকারের চেষ্টা দেখিতে লাগিল।
কিন্তু ইহার মধ্যে ভারি মুশকিল দেখা দিল। পোড়ানোতে জোলা কিছুতেই রাজি নয়। পোড়ানোর কথা তুলিতেই সে বলে, ‘ওমা! পুড়ে যাব যে!’ মরিয়া গেলে তাকে পোড়ানো ছাড়া আর কি করা যায়? —গোর দেওয়া! কিন্তু জোলা তাহাতেও অসম্মত। বলে, ‘ওমা! দম আটকে যাবে যে!’ শেষে অনেক যুক্তির পর স্থির হইল যে, জোলাকে গোর দেওয়াই হইবে, কিন্তু মুখখানা জাগাইয়া রাখা যাইবে। জোলা তাহাতে রাজি হইল; কিন্তু সে বলিল যে ‘খিদে পেলে চারটি ভাত দিয়ো।’ এইরূপ পরামর্শের পর জোলাকে গোর দেওয়া হইল; অর্থাৎ তাহার মুখ জাগিয়া রহিল, আব-সব মাটি দিয়া ঢাকিয়া দিল।
এইরূপে সমস্ত দিন চলিয়া গেল। রাত্রিতে চারটি ভা৩ খাইয়া জোলা একটু নিদ্রার চেষ্টা দেখিল।
সেই বাত্রিতে সাত চোর রাজার বাড়িতে চুরি করিতে চলিয়াছে। চোরেরা ত আর বাবুদের মতন সদর রাস্তা দিয়ে চলে না—তাহা প্রায়ই ঝোপজঙ্গলের ভিতর দিয়া চলে, আর সে-সব জায়গা অনেক সময়ই নোংরা থাকে। চলিতে চলিতে একজন চোর কাদার মতন একটা কি জিনিস মাড়াইল, সে জিনিসটার বিশ্রী গন্ধ। সে পা মুছিবার জন্য একটা জায়গা খুঁজিতে লাগিল। উহার নিকটেই জোলাকে গোর দিয়াছে, সে চোর পা মুছিবি ত মোছ, সেই জোলার মুখে গিয়া মুছিতে লাগিল! ঘষার আর গন্ধে র চোটে জোলার ঘুম ভাঙ্গিয়া গেল; সে রাগিয়া বলিল, ‘উঃ—হুঁঃ—হুঁঃ— তোমার কি চোখ নাই না কি?’
চোর আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “তুই কে রে?
জোলা বলিল, ‘আমি জোলা।’
‘এখানে কি করছিস?’
‘আমি যে মরে গিয়েছি;আমার লাল সুতো নীল সুতো বেরিয়েছে—তাই আমাকে গোর দিয়েছে।’
এই কথা শুনিয়া চোরেরা খুব হাসিতে লাগিল। তারপর তাহাদের একজন বলিল, ‘একে আমাদের সঙ্গে নিয়ে চল।’
চোররা জোলাকে বুঝাইয়া দিল যে, তাহার মৃত্যু হয় নাই, আর তাহাদের সঙ্গে গেলে পেট ভরিয়া খাইতে পারিবে। জোলা জিজ্ঞাসা করিল, কি খাওয়াবে? পায়েস? ‘চোরেরা বলিল, ‘হ্যাঁ, পায়েস—চল্’ পায়েসের কথা শুনিয়া জোলা কোন আপত্তি করিল না। চোরেরা তাহাকে উঠাইয়া লইয়া চলিল।
রাজার বাড়িতে গিয়া চোরেরা রাজার ঘরে প্রকাণ্ড সিঁদ কাটিল! তারপর জোলাকে ঐ সিঁদের ভিতর ঢুকাইয়া দিয়া বলিল, রাজার মাথার মুকুটটা নিয়ে আয়।’ রাজার খাটে মশারি খাটানো ছিল, তাহা দেখিয়া জোলা ভারি আশ্চর্য হইয়া গেল। সে মশারির চারিদিক ঘুরিয়া কোথাও তাহার দরজা দেখিতে পাইল না; সুতরাং চোরেদের নিকট ফিরিয়া আসিয়া বলিল,‘ হল না; ওর ভিতরে আর একটা ঘর আছে, তার দরজা নেই।’
চোরেরা বলিল, ‘দূর বোকা! ওটা ঘর নয়, মশারি। ওটাকে তুলে দেখলি না কেন?’ জোলা আবার ঘরের ভিতরে গেল।
এবার জোলা মশারি তুলিতে অনেক চেষ্টা করিল, কিন্তু সেটাকে নাড়িতেও পারিল না—কারণ সে খাটসুদ্ধ ধরিয়া টানাটানি করিয়াছিল। সে আবার ফিরিয়া আসিয়া বলিল, ‘না ভাই, ওটা বড্ড ভারি।’
‘আরে এমন গাধাও আর দেখি নি! তুই বুঝি খাটসুদ্ধ তুলতে গিয়েছিল? শুধু ওর কাপড়টা টানতে হয়।’
এবারে জোলা আর কোন ভুল করিল না। মশারির কাপড় ধরিয়া টানিতেই সেটা উঠিয়া আসিল। ভিতরে খুব উঁচু গদির উপরে রাজা শুইয়া আছেন, তাঁহার গায়ে ঝালর-দেওয়া অতিশয় পুরু লেপ। দেখিয়া জোলার মনে ভারি দুঃখ হইল। সে ভাবিল, বুঝি রাজাকে গোর দিয়েছে। তারপর দেখিল, মুখখানি জাগিতেছে! তখন সে ভাবিল যে, ‘ঠিক ত আমারই মতন করেছে দেখছি! এরও লাল সুতো নীল সুতো বেরিয়েছিল নাকি?’ জোলা যত ভাবে, ততই আশ্চর্য হয়, আর ততই তাহার জানিতে ইচ্ছা করে, রাজা মহাশয়েরও লাল সূতা নীল সূতা বাহির হইয়াছিল কি না। শেষটা এমন হইল যে, এই খবরটা তাহার না জানিলেই নয়। সুতরাং সে রাজাকে ঠেলিয়া জাগাইল। আর, তিনি চোখ মেলিবামাত্রই, জিজ্ঞাসা করিল ‘লাল সুতো নীল সুতো বেরিয়েছিল?’
ইহার পর একটা মস্ত গোলমাল হইল। রাজবাড়ির সকলে জাগিয়া গেল, সাত চোর ধরা পড়িল, তাহার সঙ্গে সঙ্গে জোলাও ধরা পড়িল।
পরদিন বিচারে সাত চোরের উচিত সাজা হইল। আর জোলাকে পেট ভরিয়া উত্তম উত্তম পায়েস খাওয়াইয়া বিদায় দেওয়া হইল।