উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/গল্পমালা/দুষ্ট দানব
দুষ্ট দানব
এক দানব আর এক চাষা, দুজনে পাশা খেলছিল। খেলায় চাষার হার হল।
পাশায় হেরে চাষা হায় হায় করতে লাগল। খেলবার আগে সে বাজি রেখেছিল যে, সে হারলে দানব তার ছেলেটিকে নিয়ে যাবে। এখন উপায় কি হবে? দানব কিছুতেই ছাড়বে না; সে বলছে, ‘কালই এসে আমি ছেলে নিয়ে যাব। যদি তাকে রাখতে চাও, তবে এমন করে তাকে লুকিয়ে রেখে দাও যাতে আমি খুঁজে বার না করতে পারি। খুঁজে পেলে কিন্তু আর তাকে ফেলে যাব না।’
হায়, কি বিপদ! ছেলেটিকে কোথায় লুকোবে? যেখানেই রাখুক, দানব নিশ্চয় তাকে খুঁজে বার করবে। চাষা ভেবে কিছু বুঝতে না পেরে শেষে দেবতার রাজাকে ডাকতে লাগল। দেবতার রাজা তার দুঃখ দেখে দয়া করে বললেন, ‘তোমার কোনো চিন্তা নেই আমি তোমার ছেলেটিকে এমন করে লুকিয়ে দেব যে দানবের বাবাও তাকে খুঁজে বার করতে পারবে না।’
এই বলে তিনি ছেলেটিকে গমের ক্ষেতে নিয়ে গিয়ে তাকে একটা ছোট্ট গমের ভিতরে লুকিয়ে রাখলেন। তার পরদিন দানব এসে চাষার ঘরে, বাগানে, পুকুরে, বাক্স, উনুনে, হাঁড়িতে, হুঁকোর ভিতরে কতই খুঁজল, কোথায়ও ছেলেটিকে দেখতে পেল না। কিন্তু সে এমনি দুষ্ট দানব ছিল—সে তখনি বুঝে নিল যে, তবে নিশ্চয় গমের ক্ষেতে গমের ভিতরে লুকিয়ে রেখেছে! অমনি সে কাস্তে নিয়ে গিয়ে ঘ্যাঁশ ঘ্যাঁশ করে গম কাটতে লাগল! সব গম কেটে, তারপর তার এক-একটি করে দানা হাতে নিয়ে উলটেপালটে দেখে, সে দুদণ্ডের মধ্যেই ধরে ফেলল যে, এই গমটার ভিতর চাষার ছেলে বসে আছে।
আর-একটু হলেই সে সেই গমটার ভিতর থেকে চাষার ছেলেটিকে বার করে নিয়ে যেত। এর মধ্যে দেবতার রাজা এসে তার হাত থেকে সেটা কেড়ে নিয়ে ছেলেটিকে তাড়াতাড়ি চাষার হাতে দিয়ে বললে, ‘আমার যা সাধ্য আমি তা করেছি এর বেশি আর পারব না।’ দানব ছেলেটিকে নিতে না পেরে ভারি চটে বলল বটে, আমাকে ফাকি দিলে সে হবে না, আমি কাল আবার আসব।’
দেবতার রাজা যখন পারলেন না, তখন চাষা আলোর দেবতার কাছে গেল। আলোর দেবতা এসে তার ছেলেটিকে একটি রাজহাঁসের গলায় পালক বানিয়ে রেখে দিলেন। কিন্তু তাতে কি সে দানবকে ঠকাবার জো আছে? সে এসেই হাঁসের গলা ছিড়ে সেই পালকটি সুদ্ধ তাকে মুখে দিতে গিয়েছে। ভাগ্যিস পালকটি তখন তার ঠোঁটে লেগে রইল, নইলে আর উপায়ই ছিল না। পালকটিকে দানবের ঠোঁটে লাগাতে দেখেই আলোর দেবতা সেটিকে উড়িয়ে নিয়ে চাষার কাছে পৌঁছে দিলেন, আর বললেন, ‘আমি আর কিছু করতে পারব না।’ দানব সেদিনও ঠকে গেল, কিন্তু যাবার সময় বলে গেল, ‘কাল আবার আসব।’
দেবতার রাজা হেরে গেলেন, আলোর দেবতা হেরে গেলেন। চাষা তখন আগুনের দেবতাকে ডেকে বলল, ‘ঠাকুর! আপনি আমার ছেলেটিকে বাঁচান! আগুনের দেবতা তখন ছেলেটিকে সমুদ্রে নিয়ে গিয়ে একটা মাছের পেটের মধ্যে তার একটি ডিমের ভিতর লুকিয়ে রাখলেন।
দানব কিন্তু এর সবই টের পেয়েছে, আর তাই এবাবে সে ছিপ নিয়ে তয়ের হয়ে এসেছে। সমুদ্রে কত কোটি কোটি মাছ, তার ভিতর থেকে সে সেই মাছটাকে দেখতে দেখতে ধরে ফেলল। সেই মাছটার পেটে কত কোটি কোটি ডিম, তার ভিতর থেকে সে সেই ডিমটাকে দেখতে দেখতে খুঁজে বার করল।
তখন আগুনের দেবতা সেই ডিমটি তার তার হাত থেকে ছিনিয়ে নিয়ে চুপি চুপি ছেলেটিকে বললেন, ‘শিগগির ঘরে পালিয়ে যা;ভেতরে ঢুকেই দরজা বন্ধ করে দিস।’ এ কথা তখন দানব শুনতে পায় নি। তারপর ছেলেটি পালিয়ে অনেক দূরে গেলে সে তাকে দেখতে পেল। অমনি ঘোঁত করে লাফিয়ে উঠে সে তার পিছু পিছু ছুটল। কিন্তু ছেলেটি ততক্ষণে ঘরে ঢুকে গিয়েছে দানবটাও তাকে ধরবার জনা তাড়াতাড়ি গেল সেই ঘরে ঢুকতে, সে জানত না যে আগুনের দেবতা এর আগেই কখন সেই ঘরের দরজায় তিন হাত লম্বা এক লোহার খোঁচ বসিয়ে রেখেছেন। দানব রাগে ভূত হয়ে ঘরে ঢুকবার সময় সেই খোঁচ আগাগোড়া গেল তার মাথায় ঢুকে। তখন সে ভয়ানক চেঁচিয়ে চিতপাত হয়ে পড়ে যেতেই আগুনের দেবতা ছুটে এসে তার একটা পা কেটে ফেললেন।
কিন্তু পা কাটলে কি হবে? দুষ্ট দানব তাকে কি জাদুই করে রেখেছে— সে কাটা পা তখনি এসে আবার জোড়া লেগে গেল! যা হোক আগুনের দেবতা সেই দানবের থেকে বড় জাদুকর ছিলেন; তিনি জানতেন যে কাটা জায়গায় লোহা আর পাথর ফেলে দিলে আর তা জোড়া লাগতে পারে না। কাজেই তিনি তাড়াতাড়ি দানবের আব একটা পা কেটেই লোহা আর পাথর দিয়ে কাটা জায়গা চাপা দিয়ে ফেললেন। তখন আব দনবের জাদু খাটল না, দেখতে দেখতে তার প্রাণ বেরিয়ে গেল।
তখন ত চাষার খুব আনন্দ হল। সে আগুনের দেবতাকে কত প্রণাম যে করল তা গুণে শেষ করা যায় না। তারপর থেকে সে সকলকে বলত যে, এই দেবতাটির মত দেবতা নেই।