উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/ছেলেদের মহাভারত/সভাপর্ব
সভাপর্ব
গ্নি আর ইন্দ্র চলিয়া গেলে পরে ময়দানব জোড়হাতে অর্জুনকে বলিলেন, “আপনি আমার প্রাণ বাঁচাইয়াছেন, অনুমতি করুন, আমি আপনার কি উপকার করিব?”
অর্জুন বলিলেন, “তুমি কৃষ্ণের কোনো কাজ করিয়া দাও, তবে আমাদের উপকার হইবে৷”
কৃষ্ণ বলিলেন, “তুমি মহারাজ যুধিষ্ঠিরের জন্য এমন একটা সভা-ঘর করিয়া দাও যে আর কেহ তেমন করিতে না পাবে৷”
ময় সন্তোষের সহিত এ কথায় রাজি হইল। তারপর কৃষ্ণ আব অর্জুন তাহাকে সঙ্গে করিয়া যুধিষ্ঠিরের নিকট লইয়া গেলেন। সেখানে অবশ্য তাহার আদর যত্নের কোনো ত্রুটি হইল না।
তারপর সভা-গৃহের আয়োজন আরম্ভ হইল। সভাটি যে কিরূপ তাহা ইহাতেই বুঝিতে পারিবে যে, সেটি পাঁচহাজার হাত লম্বা ছিল। এমন সভার আয়োজন কি যেখানে সেখানে মিলে? এ দেশে সে-সব জিনিস জন্মায়ই না। বহুকাল পূর্বে দানবরাজ বৃষপর্বা যজ্ঞের জন্য কৈলাস পবর্তের উত্তরে এই ময়কে দিয়াই এক অতি আশ্চর্য সভা প্রস্তত করান। যুধিষ্ঠিরের সভার জন্য ময় সেই সভার মণি-মুক্তা আর স্ফটিক লইয়া আসিল। সেখানে বিন্দু সরোবর নামে একটি সরোবরের ভিতরে বৃষপর্বার সোনার গদা আর বরুণের দেবদত্ত নামক বিশাল শঙ্খও ছিল৷
ময় ভীমের জন্য সেই গদা আর অর্জুনের জন্য বরুণের শঙ্খটিও আনিতে ভুলিল না৷
চৌদ্দ মাসে সভা-ঘর প্রস্তুত হইল। সে সভা কিরূপ সুন্দর হইয়াছিল তাহা আমি কি বলিব! ইটের বদলে তাহা স্ফটিক দিয়া গাঁথা। সেই স্ফটিকের উপরে সূর্যের আলোক পড়িয়া না জানি কেমন ঝক্-ঝক্ করিত! সেখানে বাগান তো ছিলই, তাহার গাছপালা ছিল সোনার, ফুল মণি-মাণিক্যের। আর ভিতরের সাজ কাজ, সে-যে কি আশ্চর্যরকমের ছিল, তাহা বুঝাইব কি, আমিই বুঝিতে পারিতেছি না। আমি তো গরিব মানুষ, বড়-বড় রাজাদেরই তাহাতে ধোঁকা লাগিয়া গিয়াছিল। স্ফটিকের পুকুর দেখিয়া তাঁহারা তাহাকে পুকুর বলিয়া বুঝিতে পারেন নাই, তাঁহারা গিয়াছিলেনতাহার উপর দিয়া হাঁটিতে। তারপর একটা হাসির কাণ্ড হইয়া গেলে তবে বুঝিলেন যে উহা জল!
এমনি সুন্দর বাড়ি, এমনি সুন্দর বাগান, আর তাহাতে তেমনি সুন্দর মাছের খেলা, ফুলের গন্ধ আর পাখির গান। বুঝিয়া লও, সভাটি কেমন ছিল। আটহাজার বিকট রাক্ষস সেই সভায় পাহারা দিত৷
সভা দেখিয়া পাণ্ডবেরা খুশি হইবেন তাহা আশ্চর্য কি? তেমন সভা খালি স্বর্গেই আছে, পৃথিবীতে তেমন আর কেহ দেখে নাই। পৃথিবীর রাজারাজড়া, মুনি-ঋষি, ইহারা সকলেই সে সভা দেখিতে আসিলেন। স্বর্গ হইতে নারদ, পারিজাত, রৈবত, সুমুখ,ধৌম্য প্রভৃতি দেবর্ষিরা অবধি সভা দেখিতে আসিবার লোভ সামলাইতে পারিলেন না৷
নারদ যুধিষ্ঠিরকে ইন্দ্র, যম, বরুণ, কুবের আর ব্রহ্মার সভার সম্বন্ধে অনেক আশ্চর্য সংবাদ শুনাইলেন। ইহা ছাড়া মহারাজ পাণ্ডুরও দু-একটি সংবাদ ছিল। স্বর্গ হইতে আসিবার সময় মহারাজ পাণ্ডুর সহিত তাঁহার দেখা হয়। তখন পাণ্ডু তাঁহাকে বলেন, “মহর্ষি! আপনি পৃথিবীতে যাইতেছেন, যুধিষ্ঠিরকে বলিবেন, যেন রাজসূয় যজ্ঞ করে। রাজসূয় যজ্ঞের গুণে রাজা হরিশ্চন্দ্র ইন্দ্রের সভায় কত সুখে বাস করিতেছে। যুধিষ্ঠির সে যজ্ঞ করিলে আমিও সেইরূপ সুখে সেখানে থাকিতে পাইব৷”
নারদ যুধিষ্ঠিরকে এই সংবাদ দিয়া সেখান হইতে চলিয়া গেলেন৷
রাজসূয় অতি কঠিন যজ্ঞ। পৃথিবীর তাবৎ রাজার নিকট হইতে কর আদায় করিয়া তাহার দ্বারা এই যজ্ঞ করিতে হয়, সুতরাং এই যজ্ঞে বাধা দিতে অন্য রাজারা বিধিমতে চেষ্টা করে। নিজের বল-বুদ্ধি আর বন্ধু বান্ধব খুব বেশিরকম না থাকিলে ইহা করা সম্ভবই হয় না। কাজেই রাজয়ের কথা শুনিয়া পাণ্ডবেরা বড়ই ভাবনায় পড়িলেন। এ যজ্ঞ না করিলেই নয়, অথচ কাজটি ভারি কঠিন৷
বল-বুদ্ধি পাণ্ডবদের যথেষ্ট, বন্ধু-বান্ধবেরও অভাব নাই। যুধিষ্ঠিরকে সকলে প্রাণ ভরিয়া ভালোবাসে। ভীম অর্জুনের সাহস আর ক্ষমতায় প্রজার সকল ভয় দূর হইয়াছে, শত্রুরা দেশ ছাড়িয়া পলাইয়াছে। নকুলের ন্যায়বিচারে আর সহদেবের মিষ্ট ব্যবহারে লোক মোহিত। সুতরাং এ সকল বিষয়ে পাণ্ডবদের বেশ ভরসাব কথাই ছিল। মন্ত্রীরা একবাক্যে যুধিষ্ঠিরকে যজ্ঞ করিতে উৎসাহ দিলেন৷
কিন্তু ইঁহাদের কথায় যুধিষ্ঠিরের চিন্তা দূর হইল না। পরামর্শ দিবার একটি লোক আছেন কৃষ্ণ। তিনি বলিলে তবে একাজে হাত দেওয়া যায়। এই ভাবিয়া যুধিষ্ঠির কৃষ্ণকে আনাইলেন৷
কৃষ্ণ আসিলে যুধিষ্ঠির তাঁহাকে বলিলেন, “ভাই রাজসূয় যজ্ঞ করিতে ইচ্ছা করিয়াছি, তুমি কি বল? আর সকলে তো খুবই উৎসাহ দিতেছে, কিন্তু ইহাদের কথায় আমার ভরসা হয় না। তুমি যাহা বলিবে, তাহাই আমি বুঝিব ঠিক৷”
কৃষ্ণ বলিলেন, “মহারাজ! আপনি রাজসূয় করিবার উপযুক্ত লোক তাহাতে সন্দেহ নাই। কিন্তু ইহার মধ্যে ভয়ের একটা কথা আছে। মগধের রাজা জরাসন্ধের এখন অসাধারণ ক্ষমতা। পৃথিবীর সকল রাজাকে সে পরাজয় করিয়াছে। শিশুপাল উহার সেনাপতি, একজন অসাধারণ যোদ্ধা। তারপর বক্র, ভগদত্ত, শল্য, পৌণ্ডক, ভীষ্মক, প্রভৃতি অনেক বড় যোদ্ধা উহার বন্ধু। উহার ভয়ে কত শত রাজা যে দেশ ছাড়িয়া পলাইয়াছে তাহার সংখ্যা নাই। এমন-কি, আমরা নিজে ইহার ভয়ে মথুরা ছড়িয়া দ্বারকায় আসিয়া বাস করিতেছি। অনেক রাজাকে ধরিয়া আনিয়া দুষ্ট তাহার দুর্গের ভিতরে বন্দী করিয়াছে। এ ব্যক্তি বাঁচিয়া থাকিতে আপনার রাজসূয় হওয়া অসম্ভব। ইহাকে আগে মারিয়া বন্দী রাজাদিগকে ছড়াইয়া দিতে চেষ্টা করুন, নহিলে রাজসূয় করিতে পারিবেন না৷”
যুধিষ্ঠির বলিলেন, “এই জরাসন্ধকে লইয়া তো বড় মুস্কিল দেখিতেছি তুমি নিজে উহাকে এত ভয় কর, আমাদের সাহস কিসে হইবে? তুমি, বলরাম, ভীম আর অর্জুন, এই চারিজনের কেহ কি উহাকে মারিতে পার না?”
ইহা শুনিয়া ভীম বলিলেন, “কৃষ্ণের বুদ্ধি আছে, আমার বল আছে, আর অর্জুনের সাহস আছে। আমরা তিনজনে মিলিয়া জরাসন্ধ কে বধ করিব৷”
কৃষ্ণ বলিলেন, “জরাসন্ধ ছিয়াশিটি বড়-বড় রাজাকে আনিয়া ছাগলের মতো বাঁধিয়া রাখিয়াছে। আর চৌদ্দটিকে আনিতে পারিলেই একশতটি হয় তখন উহাদিগকে বলি দিবে। এইসকল রাজাকে ছাড়াইতে চেষ্টা করা উচিত হইতেছে। যে জরাসন্ধকে মারিয়া এ কাজ করিতে পারিবে, সে সম্রাট হইতে পারিবে, তাহাতে সন্দেহ নাই৷”
যুধিষ্ঠির বলিলেন, “আমি সম্রাট হওয়ার লোভে তোমাদিগকে এমন বিপদে ফেলিতে পারিব না। আমার রাজসূয়ে কাজ নাই৷”
এই সময়ে অর্জুন সেখানে আসিলেন। তিনি বলিলেন, “আমরা ভালো ভালো অস্ত্র পাইয়াছি, আমাদের বলও যথেষ্ট আছে। এ-সব থাকিতে শত্রুর সামনে চুপ করিয়া থাকা ভালো নহে। আমরা যুদ্ধ করিব৷”
জরাসন্ধ মগধের রাজা, উহার পিতার নাম বৃহদ্রথ। বৃহদ্রথের দুই রানী ছিলেন। অনেকদিন পর্যন্ত উঁহাদের সন্তান না হওয়ায় রাজার মনে বড় দুঃখ ছিল। ইহার মধ্যে একদিন মহর্ষি চণ্ডকৌশিক রাজবাড়ির নিকটে এক আম গাছের তলায় বসিয়া বিশ্রাম করিতেছিলেন। এ কথা শুনিবামাত্র রাজা মুনির নিকটে গিয়া তাঁহার অনেক সেবাপূর্বক নিজের দুঃখের কথা জানাইলেন। তখন মুনি ধ্যানে বসিতেই গাছ হইতে একটি সুন্দর আম তাঁহার কোলের উপর পড়িল। সেই আমটি রাজাকে দিয়া তিনি বলিলেন, “মহারাজ, রানীরা এই আম খাইলেই তোমার পুত্র হইবে৷”
দুই রানী সেই আমটিকে ভাগ করিয়া খাইলেন। ইহাতে তাঁহাদের দুজনের দুটি ছেলে হইল বটে, কিন্তু সে অতি অদ্ভুতরকমের ছেলে। তাহাদিগকে মানুষ বলা যায় না, আধখানা মানুষ বলিতে হয়। একখানা করিয়া পা, একটি মাত্র হাত, একটি চোখ, একটি কান, আধখানি মাথা, আধখানি শরীব। এমন ছেলে দিয়া কি হইবে? কাজেই তাহাদিগকে কাপড়ে মুড়িয়া চৌমাথায় ফেলিয়া দেওয়া হইল৷
জরা নামে এক রাক্ষসী সেই দুইখানি অর্ধেক ছেলে কুড়াইয়া পায়। রাক্ষসী ভাবিল, দুটাকে এক সঙ্গে জড়াইয়া লইলে বহিবার সুবিধা হইবে। এই ভাবিয়া যেই সে দুই অর্ধেক একত্র করিয়াছে, অমনি তাহা জুড়িয়া একটি ছেলে হইয়া গেল। বক্সের মতো শক্ত প্রকাণ্ড খোকা, রাক্ষসী তাহাকে কি সহজে বহিয়া নিতে পারে? সে খোকা আস্ত হইয়াই হাতের মুঠি মুখে ঢুকাইয়া ষাঁড়ের মতো চ্যাঁচাইতে আরম্ভ করিল৷
খোকার সেই ভয়ংকর চিৎকার শুনিয়া রাজা, মন্ত্রী, লোকজন সকলে সেখানে ছুটিয়া আসিল। রাক্ষসীও ছেলেটি অমনি রাজাকে দিয়া বলিল, “এই নাও, তোমার ছেলে৷”
সেই ছেলেই জরাসন্ধ (অর্থাৎ জরা যাহাকে জুড়িয়াছিল)। বড় হইয়া সেই বড়ই ভয়ংকর লোক হইয়াছে। হংস আর ডিম্ভক নামক দুইবীর তাহার বন্ধু ছিল। এই তিনজন একত্র হইলে ত্রিভুবন জয় করিতে পারিত৷
হংস আর ডিম্ভকের ভালোবাসার কথা বড় সুন্দর। হংস নামক আর একজন লোকের মৃত্যুর কথা শুনিয়া ডিম্ভক ভাবিল, বুঝি তাহার বন্ধুই মরিয়া গিয়াছে। সেই দুঃখে সে যমুনায় ডুবিয়া প্রাণ ত্যাগ করিল। সে সংবাদ পাইয়া হংসও যমুনায় ডুবিয়া মারা গেল৷
মগধের চারিধারে বৈহার, বরাহ, বৃষভ, ঋষিগিরি ও চৈত্যক নামে পাঁচটি প্রকাণ্ড পর্বত থাকাতে সৈন্য লইয়া গিয়া সে দেশ জয় করা একেবারে অসম্ভব তাহার উপরে আবার জরাসন্ধ নিজে এমন বীর আর তাহার এত সহায়। এইজন্য কৃষ্ণ বলিলেন যে, উহাকে অন্য উপায়ে মারিতে হইবে। কৃষ্ণ, ভীম আর অর্জুন এই তিনজন সাধারণ লোকের মতো মগধ দেশে গেলে সহজেই জরাসন্ধের দেখা পাওয়ার কথা। তখন ভীম যুদ্ধ করিয়া তাহাকে মারিবেন৷
এইরূপে পরামর্শের পর তিনজনে স্নাতক ব্রাহ্মণের বেশে ইন্দ্রপ্রস্থ হইতে যাত্রা করিলেন। সেখান হইতে তাঁহারা ক্রমে কুরুজাঙ্গল দেশে, তারপর গণ্ডকী, সরযূ নদী পার হইয়া কোশলায়, সেখান হইতে মিথিলায়, মিথিলা হইতে মালয়, তারপর চমতী, গঙ্গা আর শোন পার হইয়া শেষে মগধে আসিযা উপস্থিত হইলেন। নগরের সিংহদ্বারের পাশেই একটি সুন্দর চৈত্য (জয়স্তম্ভ) আর তিনটা বিশাল দুন্দুভি (ডঙ্কা) ছিল। সেখানে আসিয়া তাঁহাদের প্রথম কাজই হইল সেই জিনিসগুলিকে চুরমার করা। তারপর তাঁহারা খুব খুশি হইয়া নগরে প্রবেশ করিলেন। রাজপথের দুইধারে ময়রা, সওদাগর, মালাকর প্রভৃতির দোকান ছিল, তাহা হইতে জোর করিয়া মালা লইয়া তাঁহারা গলায় পরিলেন! এ-সকল কাণ্ড দেখিয়া সকলে আশ্চর্য হইয়া ভাবিতে লাগিল, না জানি ইহারা কে!
এইরূপে ক্রমে তাঁহারা জরাসন্ধের নিকটে আসিয়া উপস্থিত হইলে জরাসন্ধ তাঁহাদিগকে স্নাতক ব্রাহ্মণ ভাবিয়া অনেক আদর-যত্ন করিল। কিন্তু ভীম আর অর্জুন তাহার কোনো কথার উত্তর দিলেন না। কৃষ্ণ বলিলেন, “ইহাঁদের নিয়ম আছে, এখন কথা কহিবেন না। দুই প্রহর রাত্রির সময় আপনার সহিত ইহাদের কথাবার্তা হইবে৷”
রাত্রি দুই প্রহরের সময় জরাসন্ধের সহিত কথাবার্তা আরম্ভ হইলে জরাসন্ধ বলিল, “আপনাদের পোশাক স্নাতক ব্রাহ্মণের মতো। কিন্তু স্নাতক ব্রাহ্মণেরা তো এমন সময়ে মালা-চন্দন পরেন না। আপনাদের হাতে ধনুর্গুণের দাগ দেখিয়া ক্ষত্রিয় বলিয়াই বোধ হয়। অথচ আপনারা ব্রাহ্মণের বেশে আসিয়াছেন, আবার চৈত্যটি ভাঙিয়াছেন! আমি আদর-যত্ন করিলাম তাহারও আপনারা ভালো করিয়া উত্তর দেন নাই! যাহা হউক, আপনারা কিজন্য আসিয়াছেন?”
কৃষ্ণ বলিলেন, “স্নাতক তো ক্ষত্রিয় আর বৈশ্যেরাও হইতে পারে, আমাদিগকে ব্রাহ্মণ মনে করিবার প্রয়োজন কি? মালা পরিলে দেখায় ভালো, তাই আমরা মালা পরিয়াছি। গায়ের জোর দেখানো ক্ষত্রিয়ের উচিত কাজ, তাই কিছু দেখাইয়াছি, আপনার দেখিবার ইচ্ছা থাকিলে আজই আরো ভালো করিয়া দেখিতে পাইবেন। শত্রুর ঘরে আসিয়া তাহার নিকট হইতে আদর লওয়া আমরা ভালো মনে করি না, তাই আপনার আদর-যত্নের উত্তর দেই নাই৷”
এ কথায় জরাসন্ধ আশ্চর্য হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, “আমি কি করিয়া আপনাদের শত্রু হইলাম তাহা তো বুঝিতে পারিতেছি না। আপনাদের বোধহয় ভুল হইয়া থাকিবে।”
কৃষ্ণ বলিলেন, “তুমি ক্ষত্রিয় রাজাদিগকে ধরিয়া বলি দিতে আনিয়াছ, সুতরাং তুমি সকল ক্ষত্রিয়েরই শত্রু। তাই তোমাকে বধ করিতে আসিয়াছি। আমরা ব্রাহ্মণ নহি! আমি বসুদেবের পুত্র কৃষ্ণ, আর ইঁহারা দুজন মহারাজ পাণ্ডুর পুত্র। এখন, হয় এই সকল রাজাদিগকে ছাড়িয়া দাও, না হয় আমাদের সহিত যুদ্ধ করিয়া যমের বাড়ি যাও৷”
জরাসন্ধ বলিল, “আমি যাহাদিগকে ধরিয়া আনিয়াছি, তাহাদিগকে লইয়া আমার যাহা খুশি করিব। আমি কাহাকেও ভয় করি না। আমি একেলা দুই তিন মহারথীর (খুব বড় বীরের) সহিত যুদ্ধ করিতে পারি৷”
কৃষ্ণ বলিলেন, “আমাদের কাহার সহিত যুদ্ধ করিবে?”
জরাসন্ধ ভীমকে দেখাইয়া বলিল, “ইহার সহিত৷”
তখন পুরোহিত আসিয়া স্বস্ত্যয়ন (জরাসন্ধের মঙ্গলের জন্য দেবতার পূজা) করিলে, জরাসন্ধ বর্ম আঁটিয়া, চুল বাঁধিয়া, বলিল, “আইস ভীম! যুদ্ধ করি৷”
তারপর দুজনে কি ভয়ানক যুদ্ধই আরম্ভ হইল! যতরকম কুস্তির প্যাঁচ আছে, সমস্তই দুজন দুজনের উপর খাটাইলেন। ঝড়ের মতন করিয়া তাঁহাদের নিশ্বাস বহিতে লাগিল, কপালে কপালে ঠেকিয়া আগুন বাহির হইতে লাগিল৷
তেরো দিন এইরূপ যুদ্ধের পর চৌদ্দ দিনের রাত্রিতে জরাসন্ধ ক্লান্ত হইয়া পড়িল। তাহা দেখিয়া কৃষ্ণ বলিলেন “আহা! বড় কাহিল হইয়া পড়িয়াছ! ভীম, আর মারিও না, তাহা হইলে মরিয়া যাইবে!
আসল কথা ভীমকে জানাইয়া দেওয়া যে জরাসন্ধ কাহিল হইয়াছে। তাহা বুঝিতে পারিয়া ভীম বলিলেন, “হতভাগা এমনি কাপড় জড়াইয়াছে যে উহাকে বধ করা কঠিন দেখিতেছি।”
কৃষ্ণ বলিলেন, “তোমার জোর একবার ভালো করিয়া দেখাও না৷”
তখন ভীম আগে জরাসন্ধ কে শূন্যে তুলিয়া একশত পাক ঘুরাইলেন। তারপর হাঁটু দিয়া তাহার পিঠ ভাঙ্গিলেন। শেষে দুই পা ধরিয়া তাহাকে দুই ভাগে চিরিয়া ফেললেন। সে সময়ে জরাসন্ধের চিৎকারে অতি অল্প লোকই টিকিয়া থাকিতে পারিয়াছিল৷
আর সেই বন্দী রাজাদের কথা কি বলিব? তাঁহারা দারুণ অপমান আর মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত, ইহার মধ্যে হঠাৎ তাঁহাদের সকল দুঃখ দূর হইয়া গেল। তাহারা কৃষ্ণ, ভীম আর অর্জুনের অশেষ স্তুতি করিয়া জোড়হাতে বলিলেন, “এখন আপনাদের এই ভৃত্যেরা আপনাদের কি সেবা করিবে, অনুমতি করুন৷”
কৃষ্ণ বলিলেন, “মহারাজ যুধিষ্ঠির রাজসূয় যজ্ঞ করিতে চাহেন, আপনারা অনুগ্রহ করিয়া তাহাতে সাহায্য করিবেন৷”
রাজারা পরম আনন্দের সহিত এ কথায় সম্মত হইলেন। জরাসন্ধের পুত্র সহদেব কৃষ্ণ আর ভীমার্জুনকে বিস্তর ধনরত্ন উপহার দিয়া বিনয়ের সহিত বলিলেন,“আমিও যজ্ঞে সাহায্য করিব৷” তাঁহারা তাঁহাকে মগধের সিংহাসনে বসাইয়া ইন্দ্রপ্রস্থে ফিরিলেন৷
তারপর যজ্ঞের আয়োজন আরম্ভ হইল। রাজাদিগের নিকট হইতে কর আনাই প্রথম কাজ। এজন্য মহাবীর চারি ভাই অসংখ্য সৈন্য লইয়া চারিদিকে ছুটিয়া চলিলেন। অর্জুন উত্তরে, ভীম পূর্বদিকে, সহদেব দক্ষিণে, নকুল পশ্চিমে৷
অর্জুন ক্রমে কুলিন্দ, কালকুট, আনর্ত, শালদ্বীপ প্রভৃতি জয় করিয়া শেষে প্রাগজ্যোতিষ দেশে উপস্থিত হইলেন। সেখানকার রাজা ভগদত্ত কিরাত, চীন ও সাগরপারী সৈন্য লইয়া আটদিন তাঁহার সহিত ঘোরতর যুদ্ধ করেন। তারপর অর্জুনের ক্ষমতা আর সাহসে আশ্চর্য হইয়া বলিলেন, “আমি ইন্দ্রের বন্ধু! লোকে বলে, আমার ইন্দ্রের সমান ক্ষমতা। কিন্তু তবুও তো তোমাকে কিছুতেই আটিতে পারিতেছি না! তুমি কি চাও?”
অর্জুন বলিলেন, “আপনি ইন্দ্রের বন্ধু, সুতরাং আমার গুরু লোক। আপনাকে কি আমি কিছু বলিতে পারি? আপনি স্নেহ করিয়া কিছু কর দিন৷”
ভগদত্ত অতিশয় আহ্লাদিত হইয়া বলিলেন, “কর তো দিবই। আর কি করিতে হইবে বল৷”
এইরূপে ভগদত্তকে বশ করিয়া, অর্জুন আবার উত্তর দিকে চলিলেন। অন্তর্গিরি, বহির্গিরি, উলুক, কাশ্মীর, ত্রিগর্ত, দারু, কোকনাদ, বাহ্রিক, দরদ, কাম্বোজ, লোল, পরম, ঋষিক প্রভৃতি কত দেশ জয় হইল, করই-বা কতরকম আদায় হইল। হিমালয় পর্বতের ওপারে কিম্পুরুষবর্ষ, হাটক প্রভৃতি কোনো দেশ হইতেই কর না লইয়া ছাড়া হইল না। তারপর অর্জুন উত্তর কুরুদেশে উপস্থিত হইলেন, সে অতি অদ্ভুত দেশ, সেখানে কোথায় কি আছে, কিছুই দেখিতে পাওয়া যায় না, সুতরাং যুদ্ধ কি করিয়া হইবে? সেখানে তিনি উপস্থিত হইবামাত্র পর্বত প্রমাণ প্রহরীগণ আসিয়া হাসিতে হাসিতে তাঁহাকে কহিল, “আপনি যে এখানে আসিয়াছে, তাহাতেই বুঝিয়াছি যে আপনি সামান্য মানুষ নহেন। ইহাতেই আপনার এ দেশ জয় করা হইয়াছে। এখন আপনার কি চাই বলুন, আমরা তাহাই দিতেছি৷”
অর্জুন বলিলেন, “মহারাজ যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞের জন্য আমাকে কিছু কর দিলেই হইবে, আমি আর কিছু চাহি না৷”
এই কথা শুনিয়াই উহাৱা নানারূপ আশ্চর্য কাপড় আর হবিণের ছাল প্রভৃতি আনিয়া অর্জুনের নিকট উপস্থিত করিল। এইরূপে ক্রমে সমস্ত উত্তর দিক জয় করিয়া অর্জুন কত ধনরত্ন যে দেশে আনিলেন, তাহার লেখাজোখা নাই৷
ভীম পূর্বদিকে গিয়া, পাঞ্চাল, বিদেহ, গণ্ডক, দশার্ণ, অশ্বমেধ, পুলিন্দ, চেদী, কুমার, কোশল, অযোধ্যা, গোপালকক্ষ, মল্ল, প্রভৃতি অল্পদিনের ভিতরেই জয় করিয়া ফেলিলেন৷
ভাট, শক্তিমান, বৎসদেশ, ভর্গ প্রভৃতি আরো কত দেশ দেখিতে দেখিতে তাঁহার বশে আসিল। কর্ণকেও যুদ্ধে পরাজয় করিয়া তাঁহার নিকট হইতে কর আনিতে বাকি রইল না৷
এইরূপে মণি-মুক্তা, চন্দন, কাপড়, কম্বল, সোনা, রূপা প্রভৃতি নানারূপ জিনিস আনিয়া ভীম ভাণ্ডার বোঝাই করিয়া ফেলিলেন৷
সহদেবও সমস্ত দক্ষিণদিক জয় করিয়া কর আনিলেন। কিষ্কিন্ধ্যার বানরদিগের সহিত তাঁহার ক্রমাগত সাতদিন যুদ্ধ হইয়াছিল, তথাপি বানরেরা হটে নাই বা ভয় পায় নাই। কিন্তু সহদেবের যুদ্ধ দেখিয়া তাহারা বড়ই সন্তুষ্ট হইল। আর সহদেবকে অনেক ধনরত্ন দিয়া বলিল, “এ-সব লইয়া তুমি এখান হইতে চলিয়া যাও। তোমার ভালো হউক৷”
দক্ষিণে যাইতে যাইতে সহদেব শেষে সমুদ্রের ধারে উপস্থিত হন। সেইখানে লঙ্কা, বিভীষণ তখনো সেখানে রাজত্ব করিতেছিলেন। এখানে কোনোরূপ যুদ্ধের প্রয়োজন হয় নাই, কারণ, বিভীষণ সংবাদ পাইবামাত্র আহ্লাদের সহিত বোঝয় বোঝায় মহামূল্য মণি-মুক্তা দিয়া সহদেবকে বিদায় করিলেন৷
নকুলও পশ্চিমদিক হইতে কম কর আনেন নাই। একহাজার হাতি সে সকল ধন অতিকষ্টে বহিয়া আনিয়াছিল৷
যজ্ঞের সময় ক্রমে যতই কাছে আসিল, ততই নানা দেশের রাজারা, মুনিরা আর ব্রাহ্মণেরা দলে দলে উপস্থিত হইতে লাগিলেন৷
কৃষ্ণ ইহার পূর্বেই আসিয়া, সকলরকম আয়োজন আরম্ভ করাইয়াছে। রাজাদিগের নিকট নিমন্ত্রণ গিয়াছে, পুরোহিতেরা প্রস্তুত হইয়াছে, যজ্ঞের জন্য চমৎকার স্থান প্রস্তুত হইয়াছে, ভোজনের ঘটা লাগিয়া গিয়াছে৷
নকুল হস্তিনায় গিয়া জোড়হাতে, মিষ্ট কথায়, ভীষ্ম, ধৃতরাষ্ট্র, বিদুর, দুর্যোধন প্রভৃতিকে নিমন্ত্রণ করিয়া আসিয়াছেন। তাঁহারাও আনন্দের সহিত যজ্ঞে উপস্থিত হইয়াছে। অন্য রাজারাজড়া কত আসিয়াছে, তাহার সংখ্যা নাই। ইহাঁদের জন্য সুন্দর বাগানে ঘেরা, মণি-মুক্তার কাজ করা, সোনার দরজা জানালা দেওয়া বিশাল বিশাল পুরী পূর্বেই বহুমূল্য আসন, গালিচা, পালঙ্ক প্রভৃতি দিয়া সাজানো ছিল। মিঠাই মণ্ডার তো কথাই নাই। আর সুগন্ধের কথা কি বলিব। ফুলের গন্ধ, চন্দনের গন্ধ, ধূপের গন্ধ, লুচি সন্দেশের গন্ধ!
এক-একজন এক একটা কাজে বিশেষ মজবুত, তাঁহাদের উপরে সেই সেই কাজের ভার পড়িয়াছে। দুঃশাসনের উপর খাবার জিনিস দেখাশুনার ভার, অশ্বত্থামার উপর ব্রাহ্মণদিগের আদর-যত্নের ভার, সঞ্জয়ের উপর রাজাদিগের সেবার ভার। ভীষ্ম, দ্রোণ কাজের কুম দিবেন, কৃপাচার্য ধন রত্ন রক্ষা করিবেন। উপহার আসিলে দুর্যোধন লইবেন, আর নিজে কৃষ্ণ ব্রাহ্মণ দিগের পা ধোওয়ার ব্যবস্থা করিবেন৷
ক্রমে যজ্ঞের পূজা অর্চনার কাজ শেষ হইয়া গেল। মহারাজ যুধিষ্ঠির, যে যাহা চাহিল, তাহাকে তাহাই দিয়া সন্তুষ্ট করিলেন।
তারপর ভীষ্ম যুধিষ্ঠিরকে বলিলেন, “রাজাদিগকে এবং যাঁহারা অর্ঘ্য (মান্য দেখাইবার জন্য উপহার) পাইবার উপযুক্ত, তাঁহাদিগকে এক-একটি করিয়া অর্ঘ্য আনিয়া দাও। তারপর এখানে যিনি সকলের চেয়ে বড় তাঁহাকে আর-একটি অর্ঘ্য দিতে হইবে৷”
যুধিষ্ঠির বলিলেন, “সকলের বড় বলিয়া অর্ঘ্য কাহাকে দিব?”
ভীষ্ম বলিলেন, “কৃষ্ণই সকলের চেয়ে বড়। তাঁহার সমান মান্য লোেক এখানে আর কেহই উপস্থিত নাই৷”
তারপর ভীষ্মের কথায় সহদেব কৃষ্ণকে অর্ঘ্য আনিয়া দিলেন। কিন্তু চেদীর রাজা শিশুপালের ইহা কিছুতেই সহ্য হইল না। তিনি যুধিষ্ঠিরকেই-বা কত বকিলেন, ভীষ্মেরই বা কত নিন্দা করিলেন, আর কৃষ্ণকেই-বা কত অপমানের কথা বলিলেন। তারপর আর-আর রাজাদিগকে লইয়া সেখান হইতে চলিয়া যাইবার চেষ্টা করিতেও ছড়িলেন না৷
রাজাদের মধ্যে অনেকে শিশুপালের সঙ্গে জুটিয়া যজ্ঞ ভাঙ্গিবার আর কৃষ্ণকে মারিবার জন্য পরামর্শ আরম্ভ করিলেন। যুধিষ্ঠির, ভীষ্ম, ইঁহারা শিশুপালকে বুঝাইয়া থামাইতে পারিলেন না, তাহাতে সহদেব রাগিয়া বলিলেন, “যে কৃষ্ণের সম্মান সহ্য করিতে না পারে, আমি তাহার মাথায় পা তুলিয়া দিই৷”
এইরূপ তর্ক আরম্ভ হইয়া ক্রমে বিষম কাণ্ড উপস্থিত হইল। কৃষ্ণের উপর শিশুপালের অনেকদিন হইতেই রাগ ছিল, আর তিনি নানারকমে তাঁহাকে অপমান করিতেও ত্রুটি করেন নাই। কৃষ্ণ এতদিন তাহা সহিয়া থাকিবার কারণ এই যে, তিনি শিশুপালের মায়ের নিকট প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলেন যে, ‘আপনার পুত্রের একশত অপরাধ ক্ষমা করিব৷’
শিশুপালের একশত অপরাধ ইহার পূর্বেই হইয়া গিয়াছে, সুতরাং আর তাঁহাকে ক্ষমা করিবার কোনো কারণ নাই।
শিশুপাল ভয়ানক অপমানের কথা বলিয়া কৃষ্ণকে গালি দিতে দিতে শেষে বলিলেন, “আইস! আজ তোমাকে আর পাণ্ডবদিগকে যমের বাড়ি পাঠাইতেছি৷”
তখন কৃষ্ণ সভার সকলকে বলিলেন, “আমি অনেক সহিয়াছি, কিন্তু এতগুলি রাজার সম্মুখে এমন অপমান আমি কিছুতেই সহিতে পারিব না৷”
তাহা শুনিয়া শিশুপাল হো হো শব্দে হাসিতে হাসিতে আরো বেশি অভদ্রভাবে কৃষ্ণকে গালি দিতে লাগিলেন৷
এমন সময় চাকার মতন একটা অতি ভয়ংকর জিনিস সভায় আসিয়া উপস্থিত হইল! কৃষ্ণ তাহাকে হাতে করিয়া লইলেন। ইহা কৃষ্ণের সেই সুদর্শন চক্র নামক অস্ত্র, কৃষ্ণ তাহাকে মনে মনে ডাকাতে অমনি ছুটিয়া আসিয়াছে। আজ আর শিশুপালের রক্ষা নাই৷
চক্র হাতে লইয়া কৃষ্ণ সকলকে বলিলেন “এই দুষ্টের একশত অপরাধ ক্ষমা করিয়াছি আর ক্ষমা করিব না। এই দেখুন ইহাকে বধ করিলাম৷”
এ কথা বলিবামাত্রই চক্র ছুটিয়া গিয়া শিশুপালের মাথা কাটিয়া ফেলিল। সভার সকল লোক পুতুলের ন্যায় দাঁড়াইয়া তাহা দেখিল, কাহারো মুখে কথা সরিল না৷
এইরূপে যুধিষ্ঠিরের রাজসূয় যজ্ঞ শেষ হইল। তারপর রাজারা দেশে চলিয়া গেলেন৷
সকলে চলিয়া গিয়াছে, দুর্যোধন আর শকুনি তখনো যান নাই, তাঁহারা সভা দেখিতেছেন। এমন সভা দুর্যোধন আর কখনো দেখেন নাই, যত দেখেন, ততই তাঁহার ধাঁধা লাগিয়া যায়। ইহারই মধ্যে কয়েকবার তিনি স্ফটিকের মেঝেকে জল মনে করিয়া কাপড় গুটাইয়াছেন, আবার জলকে স্ফটিক ভাবিয়া, কাপড়-চোপড়সুদ্ধ তাহাতে হাবুডুবুও খাইয়াছেন। সকলে হাসিয়াছে ও যুধিষ্ঠিরের চাকরেরা তাড়াতাড়ি তাঁহাকে অন্য কাপড় আনিয়া দিয়াছে৷
স্ফটিকের দেওয়াল, তাহাকে দুর্যোধন মনে করিলেন, বুঝি দরজা। তাহার ভিতর দিয়া বাহির হইতে গিয়া মাথায় ঠকাস্ করিয়া এমনি লাগিল যে, একেবারে মাথা ঘুরিয়া পড়িবার গতিক। তারপর বেচারার আর ভালো করিয়া চলিতেই ভরসা হয় না, খালি ‘কানা মাছি ভোঁ ভো’র মতন হওয়াতে হাত বুলাইতে বুলাইতে পা বাড়াইতেছে। এমনি করিয়া শেষে একবার একেবারে বাহিরে গিয়া ধপাস! তারপর দরজা দেখিলেই আগে থাকিতে দাঁড়ান৷
বাস্তবিক এমন করিয়া নাকাল হইলে বড্ড রাগ হয়! অথচ সে রাগ দেখাইবার জো নাই, কারণ তাহাতে লোকে আরো হাসে। কাজেই দুর্যোধন জিব ঠোট কামড়াইয়া কোনমতে রাগ হজম করিয়া সেখান হইতে বিদায় হইলেন। এদিকে কিন্তু হিংসায় তিনি জ্বলিয়া মরিতেছেন। পথে শকুনি তাঁহাকে কত কথা বলিয়াছেন, তিনি কিছুরই উত্তর দেন নাই। শেষে শকুনি জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কি হইয়াছে দুর্যোধন, কথা কহিতেছ না যে?’
দুর্যোধন বলিলেন, ‘মামা! কথা কহিব কোন লজ্জায়? আমার কি আর বাঁচিয়া লাভ আছে? যে শত্রুকে মারিতে এত চেষ্টা করিলাম, তাহারই কিনা শেষে এত বাড়াবাড়ি!’
শকুনি বলিলেন, ‘সে কি কথা দুর্যোধন? উহারা নিজের গুণে বড় হইয়াছে, তাহাতে তোমার দুঃখ কেন? ইচ্ছা করিলে তুমিও তো ঐরূপ করিতে পার৷’
দুর্যোধন বলিলেন, ‘মামা! যুদ্ধ করিয়া উহাদের সভা আর রাজ্য কাড়িয়া লই৷’
শকুনি বলিলেন, ‘কৃষ্ণ, অর্জুন, ভীম, যুধিষ্ঠির, নকুল, সহদেব, দ্রুপদ আর ধৃষ্টদ্যুম্ন ইহাদিগকে দেবতারাও যুদ্ধে পরাজয় করিতে পারেন না। তুমি কি করিয়া করিবে? ইহাদিগকে জব্দ করিবার অন্য উপায় আছে৷’
দুর্যোধন বলিলেন, ‘কি উপায় মামা?’
শকুনি বলিলেন, ‘যুধিষ্ঠিরের পাশা খেলায় বড় সখ, অথচ তিনি ভালো খেলিতে জানেন না। আবার, পাশা খেলায় ডাকিলে তাঁহার ‘না’ বলিবারও জো থাকিবে না। একটিবার আনিয়া তাঁহাকে খেলিতে বসাইতে পারিলে, আমি ফাঁকি দিয়া তাঁহার রাজ্যপাট সব জিতিয়া লইতে পারি। আমার মতো পাশা পৃথিবীতে কেহ খেলিতে জানে না। আগে তুমি তোমার বাবাকে বলিয়া খেলার অনুমতি লও, তারপর আমি সব ঠিক করিয়া দিব৷’
দুর্যোধন বলিলেন, ‘আমার বাবাকে বলিতে সাহস হয় না, আপনি বলুন।’
শকুনি বাড়ি আসিয়াই ধৃতরাষ্ট্রকে বলিলেন, ‘দুর্যোধন তো বড়ই রোগা হইয়া যাইতেছে! আপনি সে খবর নেন না?'
অমনি ধৃতরাষ্ট্র নিতান্ত ব্যস্ত হইয়া দুর্যোধনকে বলিলেন, ‘আহা! বাছার তো তবে বড়ই অসুখ হইয়াছে! কি অসুখ তোমার বাবা?’
দুর্যোধন বলিলেন, ‘বাবা! আমার ভয়ানক অসুখ হইয়াছে! আপনার চেয়ে পাণ্ডবেরা বড় হইয়া গেল, এ কথা ভাবিলে কি আর আমি ভালে থাকিতে পারি? উহাদের বাড়িতে রোজ দশহাজার লোক সোনার থালায় পোলাও খায়। উহাদের মতো এত ধন ইন্দ্রেরও নাই, যমেরও নাই, বরুণেরও নাই, কুবেরেরও নাই। কাজেই আমার যারপরনাই ভয়ানক অসুখ হইয়াছে৷’
তখন শকুনি বলিলেন, ‘আমি পাশা খেলিয়া উহাদের সব ধন জিতিয়া দিতে পারি। ক্ষত্রিয়কে যুদ্ধে বা পাশায় ডাকিলে তাহার ‘না’ বলিবার জো থাকেনা। যুধিষ্ঠিরকে আমরা পাশায় ডাকিলে তাহাকে আসিতেই হইবে। অথচ সে খেলিতে জানে না, কাজেই আমি ফাঁকি দিয়া তাহার সর্বস্ব কাড়িয়া লইতে পারিব৷
এ কথায় ধৃতরাষ্ট্র সহজে রাজি হন নাই। তাহার নিজেরও এ কাজটা ভালো লাগিল না, তারপর বিদুরকে ডাকিলে, তিনিও বারবার নিষেধ করিলেন। কিন্তু দুর্যোধনের পীড়াপীড়িতে ধৃতরাষ্ট্র আর স্থির থাকিতে পারিলেন না। আর তাঁহার নিজের মনেও পাণ্ডবদের প্রতি যথেষ্ট হিংসা ছিল। কাজেই তিনি শেষে বলিলেন, ‘হাজার থাম আর একশত দুয়ারওয়ালা একটা খুব জমকালো সভা প্রস্তুত করাও৷’
সভা অল্পদিনের মধ্যেই প্রস্তুত হইল। তখন ধৃতরাষ্ট্র বিদুরকে বলিলেন, ‘বিদুর! শীঘ্র ইন্দ্রপ্রস্থে গিয়া যুধিষ্ঠিরকে পাশা খেলিবার জন্য নিমন্ত্রণ করিয়া আইস৷’
বিদুর বলিলেন, ‘মহারাজ! ইহা তত ভালো কথা হইল না। পাশা খেলা বড় অন্যায়৷ উহাতে বিবাদ উপস্থিত হইতে পারে৷’
ধৃতরাষ্ট্র বলিলেন, ‘কি হইবে? আমরা তো থাকিব। তুমি শীঘ্র যাও৷’
বিদুর আর কি করেন? তিনি কাজেই ইন্দ্রপ্রস্থে গিয়া যুধিষ্ঠিরকে বলিলেন, ‘ধৃতরাষ্ট্র তোমাকে পাশা খেলিতে ডাকিয়াছে, তুমি চল৷’
এ কথা শুনিয়া যুধিষ্ঠির বলিলেন, ‘কাকা, পাশা খেলা কি ভালো? আপনি কি অনুমতি করেন?’
বিদুর বলিলেন, ‘আমি অনেক নিষেধ করিয়াছিলাম, তথাপি আমাকে পাঠাইলেন। এখন তোমার যাহা ভালো মনে হয়, কর৷’
যুধিষ্ঠির অনেক চিন্তা করিয়া বলিলেন, ‘আমাকে যখন পাশা খেলিতে ডাকিয়াছে, তখন আর না গিয়া উপায় নাই। কিন্তু উহারা বড় ধূর্ত। খেলার সময় ফাঁকি দেয়। না যাইবার উপায় থাকিলে আমি কখনই যাইতাম না৷’
পরদিন ভীম, অর্জুন, নকুল, সহদেব, কুন্তী, দ্রৌপদী প্রভৃতিকে লইয়া যুধিষ্ঠির বিদুরের সহিত হস্তিনায় আসিলেন। তাহার পরের দিন সকালে খেলা হওয়ার কথা। এই খেলা পণ অর্থাৎ বাজি রাখিয়া হয়। খেলিবার পূর্বে কথা থাকে যে, আমি হারলে তোমাকে এই জিনিস দিব, আর তুমি হারিলে আমাকে এই জিনিস দিবে। এইভাবে যথা সময়ে খেলা আরম্ভ হইল৷
যুধিষ্ঠিরের পাশা খেলা দেখিবার জন্য সভায় লোকের বড়ই ভিড় হইয়াছে। অনেক রাজা, ব্রাহ্মণ, পণ্ডিত এবং সাধারণ লোক সেখানে উপস্থিত। পাণ্ডবেরা পাঁচ ভাই সভার মাঝখানে বসিয়াছে, তাহাদের সামনেই শকুনিকে সর্দার করিয়া দুর্যোধনের দল। শকুনি বলিলেন, ‘যুধিষ্ঠির, সকলে বসিয়া আছে, খেলা আরম্ভ কর৷’
যুধিষ্ঠির বলিলেন, ‘তোমরা সরল ভাবে খেলা করিও, ফাঁকি দিও না যেন৷’
শকুনি বলিলেন, ‘যাহাব বেশি বুদ্ধি সেই ফাঁকি দেয়। ইহাতে দোষের কথা কি হইল? তোমার যদি ভয় থাকে, তবে নাহয় খেলিও না৷’
যুধিষ্ঠির বলিলেন, ডাকিয়াছ যখন, তখন খেলিতেই হইবে। কাহার সহিত খেলিব, বল। এ কথায় দুর্যোধন বলিলেন, ‘পণের জিনিস সব আমি দিব, কিন্তু আমার হইয়া মামা খেলিবেন৷’
যুধিষ্ঠির বলিলেন, ‘একজনের হইয়া আর-একজনের খেলা অন্যায়। যাহা হউক, খেলা আবম্ভ কর৷’
খেলা আরম্ভ হইলে পর ধৃতরাষ্ট্র সভায় আসিলেন। ভীষ্ম, দ্রোণ, কৃপ, বিদুর প্রভৃতিও দুঃখিত ভাবে তাঁহার সঙ্গে আসিলেন৷
তারপর যুধিষ্ঠির দুর্যোধনকে বলিলেন, ‘আমার এই গলার হার পণ রাখিলাম, তুমি কি রাখিলে?’
দুর্যোধন বলিলেন, ‘আমারও ধনরত্ন অনেক আছে। এখন তুমি বাজি জিতিলেই হয়।’
এই কথা বলিতে বলিতেই অমনি শকুনি পাশা ফেলিলেন, ‘এই দেখ, জিতিলাম৷’ সকলে দেখিল বাস্তবিকই শকুনির জিত৷
ইহাতে যুধিষ্ঠির বলিলেন, ‘আইস, আবার খেলিতেছি। এবারে এক লক্ষ আট হাজার সোনার কুম্ভ, আর আমার ভাণ্ডারের সকল ধনরত্ন পণ রহিল।’
শকুনি তখনই ‘এই জিতিলাম' বলিয়া সে-সব জিতিয়া লইলেন। তাঁহার ফাঁকি কেহ ধরিতে পারিল না৷
হায় হায়! পাশায় কি সর্বনাশ হইল! যুধিষ্ঠির যত হারেন, ততই তাঁর জেদ চড়িয়া যায়, আর ততই তিনি বলেন, ‘আরো খেলিব!’ ধূর্ত শকুনির জুয়াচুরি কাহারো ধরিবার সাধ্য নাই। পণ রাখিবামাত্রই তিনি ‘এই জিতিলাম’ বলিয়া পাশা ফেলেন, আর যুধিষ্ঠির হারিয়া যান৷
এইরূপে ক্রমে তাঁহার দাসী গেল, চাকর গেল, হাতি গেল, ঘোড়া গেল, রথ গৈল, সৈন্য গেল—সব গেল৷
সর্বনাশ উপস্থিত দেখিয়া বিদুর ধৃতরাষ্ট্রকে বলিলেন, ‘মহারাজ! মরিবার সময় রোগী ঔষধ খাইতে চাহে না, আমার কথাও হয়তো আপনার ভালো লাগবে না। দুর্যোধন যে মারা যাইবার জোগাড় করিতেছে, তাহা কি আপনি বুঝিতে পারিতেছেন না? পাণ্ডবেরা একবাব ক্ষেপিয়া দাঁড়াইলে ছেলেপিলে চাকরবাকর সুদ্ধ যমের বাড়ি যাইতে হইবে। এই বেলা দুর্যোধনকে সাজা দিয়া পাণ্ডবদিগকে তুষ্ট করুন। একে তো পাশা খেলায় এত দোষ, তাহাতে শকুনি, এমন জুয়াচোর, উহাকে শীঘ্র চলিয়া যাইতে বলুন৷’
এ কথায় দুর্যোধন ক্রোধভরে বিদুরকে গালি দিতে আরম্ভ করিলে বিদুর বলিলেন, ‘তোমাদের ভালোর জন্যই দুটো কথা বলিয়াছিলাম। দেখিতেছি তাহা তোমার পছন্দ হয় নাই। কাজ কি বাপু, তোমার যাহা খুশি তাহাই কর। তোমাকে নমস্কাব৷’
কাজেই আবার খেলা চলিল। যে মহাবাজ যুধিষ্ঠিরেব মতো বিদ্বান, বুদ্ধিমান, আব ধার্মিক এই পৃথিবীতে ছিল না, সেই যুধিষ্ঠির পাশার ধাঁধায় পড়িয়া শেষে অবোধ মাতালেব মতো কাজ করিতে লাগিলেন৷
ধন গেলে গাই বাছুর, তারপর লোকজন, তারপব রাজ্য। এইরূপে সর্বস্ব হারিযা ফকির হইয়াও চৈতন্য নাই। শেষে একটি-একটি করিয়া ভাইদিগকে হারিতে লাগিলেন।
কি দুর্দশা! শেষে শকুনিই তাঁহাকে বিদ্রুপ করিয়া বলিতে লাগিলেন, ‘পাশা খেলিতে গিয়া লোকে এমন পাগলামি করিতে পারে, এ কথা তো স্বপ্নেও জানিতাম না।’
কিন্তু ইহাতেও যুধিষ্ঠিরের দুর্গতির শেষ হয় নাই। ভাইগিকে হারিয়া শেষে নিজেকে পর্যন্ত হারিলেন, তথাপি তাহার জেদ থামে না৷
ভাবিতেও দুঃখ আর লজ্জা হয়, যখন আর কিছুই অবশিষ্ট রহিল না তখন দয়া, ধর্ম, সদাচার সকল ভুলিয়া যুধিষ্ঠির বলিলেন, ‘এবার দ্রৌপদীকে পণ রাখিলাম৷’
এ কথা শুনিবামাত্র সভার লোক ‘ছি! ছি!’ করিয়া উঠিল, রাজাগণের চোখে জল আসিল, লাজে দুঃখে আর অপমানে ভীষ্ম, দ্রোণ এবং কৃপের শরীর ঘামিয়া গেল, বিদুর হেঁট মুখে বসিয়া সাপের মতন নিশ্বাস ফেলিতে লাগিলেন৷
ভালোলোকেদের মনে এইরূপ কষ্ট আর নির্লজ্জ ধৃতরাষ্ট্র আনন্দে অস্থির হইয়া বার বার জিজ্ঞাসা করিতেছো, ‘জয় হইল নাকি? জয় হইল নাকি?’
কর্ণ, দুঃশাসন প্রভৃতি তখন কিরূপ আনন্দ করিতেছিলেন তাহা ধৃতরাষ্ট্রের ব্যবহারেই বুঝিতে পার।
ধূর্ত শকুনি যখন পাশা ফেলিয়া দ্রৌপদীকে অবধি জিতিয়া লইলেন অমনি দুর্যোধন বিদুরকে বলিলেন, ‘শীঘ্র দ্রৌপদীকে লইয়া আইস, হতভাগী আমার চাকরানীদের সঙ্গে গিয়া ঘর ঝাঁট দিক।’
বিদুর বলিলেন, ‘মুর্খ! তোমার যে মরিবার গতিক হইয়াছে, এ কথা না বুঝিতে পারিয়াই তুমি এরূপ বলিতেছ। এমন কথা নিতান্ত নীচ লোক ছাড়া আর কেহ বলে না৷’
ইহাতে দুর্যোধন বিদুরকে গালি দিয়া একটা দরোয়ানকে বলিলেন। তুই দ্রৌপদীকে লইয়া আয়! তোর কোন ভয় নাই৷
দরোয়ান দ্রৌপদীর নিকট গিয়া বলিল, ‘যুধিষ্ঠির পাশা খেলায় আপনাকে দুর্যোধনের নিকট হারিয়াছে। আপনি আমার সঙ্গে চলুন, ধৃতরাষ্ট্রে ঘর ঝাঁট দিতে হইবে৷’
এ কথায় দ্রৌপদী আশ্চর্য হইয়া বলিলেন, ‘তুই একি পাগলের মতো কথা বলিতেছিস! রাজারা কি স্ত্রীকে পণ রাখিয়া খেলা করে? যুধিষ্ঠিরের কি আর জিনিস ছিল না?
দরোয়ান বলিল, ‘যুধিষ্ঠির আগে ধনদৌলত, তারপর ভাইদিগকে, তারপর নিজেকে হারিয়া, শেষে আপনাকে হারিয়াছেন৷’
দ্রৌপদী বলিলেন, ‘তুই সভায় গিয়া যুধিষ্ঠিরকে জিজ্ঞাসা কর, তিনি আগে নিজেকে, কি আমাকে হারিয়াছেন৷’
দারোয়ান আবার সভায় আসিয়া যুধিষ্ঠিবকে বলিল, ‘দ্রৌপদী আপনাকে জিজ্ঞাসা করিতেছেন যে, আপনি কাহাকে আগে হরিয়াছেন? আপনার নিজেকে, না দ্রৌপদীকে?’
যুধিষ্ঠির চুপ করিয়া রহিলে, এ কথার কোন উত্তর দিলেন না। তখন দুর্যোধন বলিলেন, ‘দ্রৌপদীর কিছু জিজ্ঞাসা করিবার থাকে, এখানে আসিয়া করুক৷’
দারোয়ান নিতান্ত দুঃখিত হইয়া আবার দ্রৌপদীর নিকট গিয়া বলিল, “মা! এবার দেখিতেছি কৌরবদের সর্বনাশ হইবে। দুষ্ট দুর্যোধন আপনাকে সভায় ডাকিয়াছেন৷”
দ্রৌপদী বলিলেন, “বাছা, ভগবানই সব করেন। এ সময়ে আমি যেন ধর্ম রাখিয়া চলিতে পারি। তুমি আর একটিবার সভায় গিয়া ধার্মিক গুরুজনদিগকে জিজ্ঞাসা কর, এখন আমার কি করা উচিত। তাঁহারা যাহা বলিবেন, আমি তাহাই করিব৷”
দারোয়ান সভায় দ্রৌপদীর কথা বলিলে, সকলে মাথা হেঁট করিয়া রহিলেন। দুর্যোধনের ভয়ে কাহারো মুখ দিয়া কথা বাহির হইল না। সেই দুষ্ট আবার বলিল, “তুই দ্রৌপদীকে এখানে লইয়া আয়৷”
দরোয়ান দুর্যোধনের চাকর, তথাপি সে তাঁহার কথায় কান না দিয়া আবার সকলকে জিজ্ঞাসা করিল, “আমি দ্রৌপদীকে কি বলিব?”
তখন দুর্যোধন বিরক্ত হইয়া বলিলেন, “এ বেটা দেখিতেছি বড়ই ভীতুঃ দুঃশাসন, তুমি গিয়া দ্রৌপদীকে লইয়া আইস৷”
বলিবামাত্র সেই দুষ্ট দুই চোখ লাল করিয়া দ্রৌপদীর নিকট গিয়া বলিল, “আমরা তোমাকে জিতিয়াছি। চল! সভায় চল!"
দুঃশাসনের ভাবগতিক দেখিয়া দ্রৌপদী ভয়ে তাড়াতাড়ি গান্ধারী প্রভৃতির নিকট আশ্রয় সইতে গেলেন। কিন্তু সেখানে পৌঁছিবার পূর্বেই দুরাত্মা তাঁহার চুলের মুঠি ধরিয়া টানিতে টানিতে তাঁহাকে সভায় লইয়া চলিল। তিনি ভয়ে কাঁপতে কাঁপিতে কত মিনতি করিয়া বলিলেন, “দুঃশাসন, তুমি আমাকে এমন করিয়া সভায় লইয়া যাইও না!” কিন্তু হায়। সে দুষ্টের মনে কিছুতেই দয়া হইল না। সে দাঁত কড়মড় করিয়া বলিল, “তোকে জিতিয়া লইয়াছি! এখন তো তুই আমাদের দাসী! চল্!” এই বলিয়া দুরাত্মা আরো নিষ্ঠুরভাবে তাঁহার চুল ধরিয়া টানিতে লাগিল৷
হায় হায়! তখন কেহই সেই দুরাত্মার মাথা কাটিয়া তাঁহাকে উদ্ধার করিতে আসিলেন না! দ্রৌপদী “হা কৃষ্ণ! হা অর্জুন।” বলিয়া কত কাঁদিলেন, সকলই বৃথা হইল৷
এইরূপে দুঃশাসন তাঁহাকে সভায় উপস্থিত করিলেও কেহই তাহাকে নিষেধ করিলেন না। তখন দ্রৌপদী বলিলেন, “ক্ষত্রিয়ের যে ধর্ম, আমার স্বামী তাহার মতোই কাজ করিয়াছেন, তাঁহার দোষ কি? কিন্তু এই দুরাত্মা আমাকে অপমান করিতেছে দেখিয়াও যখন সভার সকলে চুপ করিয়া আছে, তখন বুঝিলাম যে কুরুবংশের লোকেরা ধর্ম ভুলিয়া গিয়াছে, ভীষ্ম, দ্রোণ, বিদুর, ইহাদের আর কিছু তেজ নাই।”
দ্রৌপদীর অপমানে পাণ্ডবেরা ক্রোধে অধীর হইয়াছেন, কিন্তু তাহাদের মুখে কথা নাই। এদিকে সেই পাষণ্ড দুঃশাসন দ্রৌপদীর চুল ধরিয়া টানিতে টানিতে তাঁহাকে অজ্ঞানপ্রায় করিয়া ‘দাসী! দাসী!’ বলিয়া আসিতেছে, আর কর্ণ, শকুনি বলিতেছে ‘বেশ! বেশ!’
ভীষ্ম দ্রৌপদীকে বলিলেন, “যুধিষ্ঠির তোমাকে পণ রাখিয়া খেলিতে পারেন কি না, এ কথা আমি ঠিক বুঝিতে পারিতেছি না। তিনি অতিশয় ধার্মিক, কখনো অধর্মের কাজ করেন নাই। তিনি নিজেই শকুনির সহিত খেলিতে আসিয়াছে, আর তোমাব অপমান দেখিয়াও চুপ করিয়া আছে। কাজেই আমি বুঝিতেছি না, কি বলিব৷”
দ্রৌপদী বলিলেন, “উঁহাকে দুষ্টেরা ডাকিয়া আনিল, তথাপি কি করিয়া বলিতেছেন যে উনি নিজেই খেলিতে আসিয়াছে? আর তাঁহাকে ফাঁকি দিয়া হারাইয়াছে! আপনাদের অনেকেরই পুত্র আর পুত্রবধু আছে, তাঁহাদের দিকে চাহিয়া আমার কথার বিচার করুন৷” এই বলিয়া তিনি কাঁদিতে থাকিলে দুঃশাসন তাঁহাকে আরো অপমান করিতে লাগিল৷
তখন ভীম আর সহিতে না পারিয়া বলিলেন, “দেখ যুধিষ্ঠির! তোমার দোষেই দ্রৌপদীর এত অপমান হইল। যে হাতে তুমি পাশা খেলিয়াছ, সে হাত আজ পোড়াইয়া ফেলিব। সহদেব! শীঘ্র আগুন আন!”
অর্জুন তখনি ভীমকে বুঝাইয়া বলিলেন, “কর কি দাদা! চুপ চুপ! ক্ষত্রিয়ের ধর্ম রাখিতে গিয়াই উনি এরূপ করিয়াছে, তাহা কি বুঝিতেছ না?”
ভীম বলিলেন, “ধর্ম রাখিতে গিয়াছিলেন বলিয়াই তো এতক্ষণ উহার হাত পোড়াই নাই৷”
এমন সময় ধৃতরাষ্ট্রের পুত্র বিকর্ণ বলিলেন, “আপনারা চুপ করিয়া আছে কেন? দ্রৌপদীর কথার বিচার করুন। আমার তো বোধহয় যুধিষ্ঠিরের দ্রৌপদীকে ওরূপ করিয়া পণ রাখার কোনো ক্ষমতা ছিল না। সুতরাং তিনি হারিলেও দ্রৌপদীর তাহা মানিয়া চলার কথা নহে৷”
এ কথায় সভার লোক চিৎকার করিয়া বিকর্ণের প্রশংসা আর শকুনির নিন্দা করিতে লাগিল। কিন্তু কর্ণ বিকর্ণকে গালি দিয়া, দুঃশাসনকে বলিলেন, “দুঃশাসন, তুমি ইহাদের সকলের গায়ের কাপড় কাড়িয়া লও৷”
এ কথা বলিবমাত্র পাণ্ডবেরা নিজ নিজ চাদর কয়খানি ছাড়িয়া দিলেন। দ্রৌপদীর গায়ের কাপড় দুঃশাসন নিজেই কাড়িয়া লইতে গিয়াছিল। কিন্তু কি আশ্চর্য! দেবতার কৃপায় সে সময়ে তাঁহার গায় এতই কাপড় হইল যে, দুঃশাসন প্রাণপণে টানিয়াও তাহা শেষ করিতে পারে না। সে যত টানে, ততই লাল, নীল, হলদে, সোনালি, নানা রঙ্গের হইয়া কাপড় বাড়িয়া যায়। শেষে অপ্রস্তুত হইয়া হতভাগা বসিয়া পড়িল৷
এদিকে এই আশ্চর্য ব্যাপার দেখিয়া সভায় ঘোরতর কলরব উপস্থিত হইয়াছে। রাজাগণ দ্রৌপদীর প্রশংসা করিতে করিতে দুঃশাসনকে গালি দিতেছেন, আর ভীম রাগে অস্থির হইয়া কাঁপিতেছেন। তারপর সভাব সকলকে ডাকিয়া তিনি বলিলেন, “তোমরা সকলে শোন! আমি ভীষণ যুদ্ধে এই দুরাত্মা দুঃশাসনের বুক চিরিয়া তাহার রক্ত খাইব, তবে ছাড়িব। যদি না খাই, তবে যেন আমার স্বর্গলাভ না হয়৷”
এমন সময় বিদুর হাত তুলিয়া সকলকে থামাইয়া বলিলেন, “দ্রৌপদী এমন করিয়া কাঁদিতেছে, তবুও আপনারা কথা কহিতেছেন না, একাজটা কি ভালো হইল? শীঘ্র ইহার কথার বিচার করুন৷”
তথাপি সকলে চুপ করিয়া রহিলেন। তখন কর্ণের কথায় আবার দুরাত্মা দুঃশাসন দ্রৌপদীকে ঘরে লইয়া যাইবার জন্য টানাটানি করিতে লাগিল। এইরূপে তাহারা দ্রৌপদীকে কত অপমান, আর পাণ্ডবদিগকে কতপ্রকার বিদ্রুপ করিল, তাহা বলিয়া আর তোমাদিগকে কষ্ট দিব না। যুধিষ্ঠির, অর্জুন, নকুল আর সহদেব সমস্তই চুপ করিয়া সহ্য করিলেন। কিন্তু ভীম রাগী লোক, তিনি তাহা সহিতে পারিবেন কেন? যখন যুধিষ্ঠিরকে অপমান করিয়াও দুর্যোধনের মন উঠিল না, তখন হাসিতে হাসিতে আবার দ্রৌপদীকে পা দেখাইলেন—আবার তাহা দেখিয়া কর্ণ হাসিতে লাগিলেন—তখন ভীম আর কিছুতেই স্থির থাকিতে পারিলেন না তিনি ভয়ংকর শব্দে সভা কাঁপাইয়া বলিলেন, “আমি যদি গদা দিয়া এই দুষ্টের উরু না ভাঙ্গি তবে যেন আমার স্বর্গে যাওয়া না হয়!”
এতক্ষণে আর কাহারো বুঝিতে বাকি রহিল না যে এ-সকল ঘটনার ফল বড়ই ভয়ংকর হইবে। তখন ধৃতরাষ্ট্র প্রাণের ভয়ে আর নিন্দার ভয়ে দুর্যোধনকে তিরস্কার করিয়া দ্রৌপদীকে বলিলেন, “মা! তুমি আমার বধূগণের সকলের বড় বল, তুমি কি চাহ৷”
দ্রৌপদী বলিলেন, “যদি আপনার দয়া হইয়া থাকে তবে যুধিষ্ঠিরকে ছাড়িয়া দিন৷”
ধৃতরাষ্ট্র বলিলেন, “তাহাই হইবে। তুমি আর কি চাহ বল!”
দ্রৌপদী বলিলেন, “ভীম, অর্জুন, নকুল আর সহদেবকে তাঁহাদের অস্ত্র-শস্ত্র সুদ্ধ ছাড়িয়া দিন৷”
ধৃতরাষ্ট্র বলিলেন, “তাহাই হইবে। তুমি আর কি চাহ বল!”
দ্রৌপদী বলিলেন, “আমি আর কিছুই চাহি না। ইহারা মুক্তি পাইলেই আমার সব পাওয়া হইল৷”
তারপর যুধিষ্ঠির ধৃতরাষ্ট্রকে বলিলেন, “মহারাজ! এখন আমাদিগকে কি অনুমতি করেন?”
ধৃতরাষ্ট্র বলিলেন, “তোমার মঙ্গল হউক। তুমি রাজ্যধন সমস্ত লইয়া গিয়া সুখে রাজত্ব কর৷”
এইরূপে যুধিষ্ঠির সেখান হইতে বিদায় হইয়া ইন্দ্রপ্রস্থ যাত্রা করিলেন। কিন্তু দুর্যোধন, কর্ণ আর শকুনির ইহা সহ্য হইবে কেন? তাঁহারা বলিলেন, “এত কষ্ট করিয়া যাহা জিতিলাম, এত সহজেই তাহা লইয়া যাইবে? এ কখনই হইতে পারে না।”
দুষ্ট লোকে না করিতে পারে এমন কাজ নাই। তিন দুষ্ট মিলিয়া তখনই আবার ধৃতরাষ্ট্রের মত ফিরাইয়া দিলেন, স্থির হইল, আবার যুধিষ্ঠিরকে পাশায় ডাকিতে হইবে। এবারের পণ বনবাস। যে হারিবে সে হরিণের ছাল পরিয়া তেরো বৎসর বনবাস করিবে। এই তেরো বৎসরের শেষ বৎসর অজ্ঞাতবাস, অর্থাৎ এমনভাবে লুকাইয়া থাকা, যেন কেহ সন্ধান না পায়। সন্ধান পাইলে আবার বারো বত্সর বনবাস। বনবাসের পরে অবশ্য আবার আসিয়া রাজ্য পাইবার কথা রহিল। কিন্তু দুযোধন স্থির করিয়া রাখিলেন যে, একবার পাণ্ডবদিগকে তাড়াইতে পারিলে আর তাঁহাদিগকে রাজ্যে ঢুকিতে দিবেন না৷
ডাকিলেন যখন খেলিতে হইবে, তখন কাজেই যুধিষ্ঠিরকে আবার আসিতে হইল, আর সেই ধূর্ত শকুনির ফাঁকিতে হারিয়া তেরো বৎসরের জন্য বনেও যাইতে হইল! যাইবার সময় দুষ্টেরা সকলে মিলিয়া পাণ্ডবদিগকে কম বিদ্রুপ করে নাই। পাণ্ডবেরা তখন কিভাবে চলিতেছে, দুর্যোধন কতই ভঙ্গিতে তাহার নকল করিলেন৷
তাহাতে ভীম বলিলেন, “মুর্খ! তোমার বিদ্রুপে আমাদের কোনো ক্ষতি হইবে না। আমি আবার বলিতেছি, যুদ্ধের সময় তোমাকে বধ করিব, আর দুঃশাসনের বুক ভাঙ্গিয়া রক্ত খাইব৷”
অর্জুন বলিলেন, “আমি কর্ণকে মারিব। হিমালয়ও যদি নড়িয়া যায়, সূর্যও যদি নিভিয়া যায়, তথাপি আমার এ কথা মিথ্যা হইবে না৷”
সহদেব শকুনিকে বলিলেন, “দুষ্ট! তুই নিশ্চয় জানিস, আমি তোকে বধ করিব৷”
যুধিষ্ঠির সকলের নিকট, এমন-কি, ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের নিকটেও বিনয়ের সহিত বিদায় চাহিয়া বলিলেন, “আবার আসিয়া আপনাদের সহিত দেখা করিব।” লজ্জায় কেহ তাঁহার কথায় উত্তর দিতে পারিলেন না। কিন্তু মনে মনে সকলেই তাঁহাকে অনেক আশীর্বাদ করিলেন। বিদুর বলিলেন, “কুন্তী বনে গেলে বড় ক্লেশ পাইবেন, তাঁহাকে আমার নিকটে রাখিয়া যাও৷”
যুধিষ্ঠির বলিলেন, “আমাদের পিতা নাই, আপনিই আমাদের পিতার মতন। আপনি যাহা বলিলেন, তাহাই হউক। আমাদিগকে আর কি উপদেশ দেন?”
বিদুর বলিলেন, “তোমাদের মতো ধার্মিক লোককে আর বেশি উপদেশ কি দিব? আশীর্বাদ করি, তোমাদের ভালো হউক৷”
কুন্তীর নিকট বিদায় লইবার সময় সকলেরই খুব কষ্ট হইয়াছিল, বিশেষ কুন্তীর। তাঁহার কান্নায় বুঝি তখন পাষাণ গলিয়াছিল৷
এইরূপে সকলের নিকট বিদায় হইয়া পাণ্ডবেরা দ্রৌপদী ও ধৌম্যের সহিত বনবাসে যাত্রা করিলেন।
দুষ্ট দুঃশাসনের টানে দ্রৌপদীর মাথার বেণী খুলিয়া গিয়াছিল, সে বেণী আর তিনি বাঁধেন নাই, প্রতিজ্ঞা করিয়াছেন যে, এই দুরাত্মাগণের উচিত শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত তাহা আর বাঁধিবেন না।
পাণ্ডবেরা চলিয়া গিয়াছে, ধৃতরাষ্ট্র বিদুর প্রভৃতিকে লইয়া কথাবার্তা কহিতেছেন, এমন সময় হঠাৎ নারদ অন্যান্য অনেক মুনির সহিত তাঁহার সম্মুখে উপস্থিত হইয়া বলিলেন, “আজ হইতে তেরো বৎসর পরে, চতুর্দশ বৎসরে, দুর্যোধনের দোষে ভীমাৰ্জুনের হাতে কৌরবদের সকলের মৃত্যু হইবে৷”
এই বলিয়া নারদ চলিয়া গেলেন, আর ধৃতরাষ্ট্র বসিয়া নিজের দুর্বুদ্ধির কথা ভাবিতে লাগিলেন৷