উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/পুরাণের গল্প/কৃষ্ণের কথা
কৃষ্ণের কথা
পূতনা বলিয়া একটা বড়ই ভীষণ রাক্ষসী কংসের রাজ্যে বাস করত। ছোট ছোট ছেলেদিগকে কৌশলে বধ করাই ছিল ইহার ব্যবসায়। রাত্রিকালে কোনো খোকাখুকি এই হতভাগিনীর দুধ পান করিলে আর তাহাদের রক্ষা ছিল না। সে সব খোকাখুকির দেহ তখনই চূর্ণ হইয়া যাইত।
যখন জানা গেল যে কংসকে মারিবার লোকের জন্ম হইয়াছে। অমনি সে দুষ্ট এই পূতনাকে ডাকিয়া বলিল যে যত ষণ্ডা-ষণ্ডা খোকা দেখিবে, সকলকেই বধ করিতে হইবে। তদবধি সেই হতভাগিনী কেবলই লোকের ছোট ছোট খোকা মারিয়া বেড়ায়। এমনি করিয়া কত খোকার প্রাণ যে সে হরণ করিল, তাহার সংখ্যা নাই।
নন্দের একটি খোকা হইয়াছে শুনিয়া, এই রাক্ষসী একদিন গোকুলে আসিয়া উপস্থিত হইল। তখন কিন্তু তাহার রাক্ষসী মূর্তি ছিল না। সে এমনি সুন্দর একটি মেয়ে সাজিয়া, এমনি সুন্দর বেশভূষা করিয়া, এমনি মিষ্ট হাসি হাসিয়া আসিয়াছিল যে তাহাকে দেখিয়া সকলে ভাবিল, নিশ্চয় স্বয়ং লক্ষ্মী গোকুলে আসিয়াছেন। সে যেদিকে যায়, সকলে তাহাকে পথ ছাড়িয়া দিয়া জড়সড়ভাবে সরিয়া দাঁড়ায়। দুষ্ট রাক্ষসী ধীরে ধীরে সূতিকা ঘরে ঢুকিল, কেহই তাহাকে নিষেধ করিল না। সে ঘরে যশোদা ছিলেন, বলরামের মা রোহিণীও ছিলেন, তাঁহারা তাহাকে দেখিয়া অবাক হইয়া চাহিয়া রহিলেন।
রাক্ষসী এক পা দু পা করিয়া আসিয়া বিছানার পাশে বসিল ও হাসিতে হাসিতে যেন কতই আদরে, খোকাটিকে কোলে তুলিয়া দুধ খাওয়াইতে লাগিল। যশোদাও কিছু বলিলেন না, রোহিণীও কিছু বলিলেন না, রাক্ষসীর মায়ায় তাঁহারা ভুলিয়া গিয়াছিলেন।
কিন্তু খোকা সে মায়ায় ভোলে নাই। যিনি স্বয়ং বিষ্ণু, রাক্ষসীর মায়া তাঁহার কাছে খাটিবে কেন! রাক্ষসী হাসিতে হাসিতে খোকাকে দুধ খাইতে দিল, খোকা সেই দুধের সঙ্গে অভাগীর প্রাণ অবধি চুষিয়া লইল। তখন সে রাক্ষসী চ্যাঁচাইয়া ছিল, তেমন চীৎকার আর গোকুলের কেহ কোনোদিন শুনে নাই। তাহারা সকলি ভয়ে কাঁপিতে কাঁপিতে তখনই ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটিয়া আসিয়া দেখিল কি ভীষণ ব্যাপার। বিকট রাক্ষসী মৃত্যু যন্ত্রণায় ছট্ফট্ করিতেছে, তিন গব্যুতি (ছয় ক্রোশ) পরিমিত স্থানের গাছপালা তাহার দেহের চাপনে চূর্ণ হইয়া গিয়াছে। রাক্ষসীর এক একটা দাঁত যেন একেকটি লাঙ্গলের ফাল, নাকের ছিদ্র যেন পর্বতের গুহা চোখদুটা যেন দুটা কুয়া। সেই রাক্ষসীর বুকের উপর শুইয়া খোকা আনন্দে হাত পা ছুঁড়িতেছে। তখনই সকলে খোকাকে কোলে তুলিয়া লইল। আর ক্রমাগত ষাট্ ষাট্ বলিতে বলিতে কত দেবতার নাম যে করিল তাহার অন্তই নাই।
উহারা যদি জানিত যে সেই খোকাটাই রাক্ষসীটাকে মারিয়াছে, তবে না জানি কত আশ্চর্য হইত।
আর একদিন খোকাকে একটা গাড়ির নীচে, একটি ছোট্ট খাটে শোয়াইয়া রাখা হইয়াছিল। বোধহয় এইভাবে তাহাকে প্রায়ই শোয়াইয়া রাখা হইত। সেদিন বাড়িতে কিসের উৎসব ছিল, সকলে তাহাতেই মত্ত, খোকার কথা আর কাহারও মনে নাই; খোকার কিন্তু এদিকে বড়ই ক্ষুধা হইয়াছে, তাহার দরুন সে পা ছুঁড়িয়া কাঁদিতে আরম্ভ করিয়াছে। পা ছুঁড়িতে ছুঁড়িতে একবার তাহার লাথি লাগিয়া, হাঁড়ি কলসীতে বোঝাই সেই প্রকাণ্ড গাড়িখানা উলটিয়া গেল। সে সব হাঁড়ি কলসী তখনই খান্ খান্ হইয়া ভাঙ্গিয়া গেল। আর শব্দও অবশ্য যেমন তেমন হইল না। তাহা শুনিয়া সকলে ছুটিয়া আসিয়া দেখিল যে খোকা চিৎ হইয়া শুইয়া পা ছুঁড়িতেছে। তাহার পাশে গাড়িখানা উলটান, আর হাঁড়ি কলসী চুর্ণ হইয়া তুমুল কাণ্ড উপস্থিত। এত বড় গাড়ি কি করিয়া উলটিল, এ কথা সকলেই তখন ব্যস্তভাবে জিজ্ঞাসা করিতে লাগিল। সেখানে আর কয়েকটি বালক ছিল, তাহারা খোকাকে দেখাইয়া বলিল, “এই খোকা পা ছুঁড়িতে ছুঁড়িতে গাড়ি উলটাইয়া ফেলিয়াছে আমরা দেখিয়াছি।” শুনিয়া সকলে হাঁ করিয়া একবার খোকার দিকে একবার গাড়িখানার দিকে তাকাইতে লাগিল।
খোকাটি একটু বড় হইলে তাহার ‘কৃষ্ণ’ নাম রাখা হইল। রোহিণীর খোকার নাম যে বলরাম’ তাহাও এই সময়ে রাখা হয়। কি দুরন্ত দুটি খোকাই তাহারা ছিল।
যখন কৃষ্ণ আর বলরাম একসঙ্গে হামাগুড়ি দিয়া বেড়াইতে শিখিলেন, তখন হইতে আর এক মুহূর্তের জন্যেও কাহারও নিশ্চিন্ত থাকিবার জো রহিল না। ছাই আর গোবর দেখিলেই দুটি খোকা অমনি তাহা লইয়া গায়ে মাখাইবে, যশোদার সাধ্য কি যে তাহাদিগকে বারণ করেন। একটু চোখের আড়াল হইলেই তাহারা গোয়াল ঘরে ঢুকিয়া ছোট ছোট বাছুরগুলির লেজ ধরিয়া টানাটানি আরম্ভ করিত। ইহাদের পিছুপিছু ছুটাছুটি করিয়া যশোদা নাকালের একশেষ হইতে লাগিলেন। শেষে একদিন তিনি আর কিছুতেই ইহাদিগকে সামলাইতে না পারিয়া, রাগের ভরে বকিতে বকিতে লাঠি হাতে কৃষ্ণকে তাড়া করিলেন। তারপর তাঁহাকে ধরিয়া মোটা দড়ি দিয়া একটা উদূখলের সঙ্গে বাঁধিয়া বলিলেন, “পালা দেখি এখন!”
এই বলিয়া যশোদা নিশ্চিন্ত মনে ঘরের কাজে গিয়াছেন, আর কৃষ্ণও অমনি সেই উদূখল টানিয়া উঠান পাড়ি দিতে আরম্ভ করিয়াছেন। উদূখল টানিতে টানিতে তিনি দুটি অর্জুন গাছের মধ্য দিয়া চলিয়া গেলেন। কিন্তু গাছ দুটি খুব কাছাকাছি থাকায় উদূখলটি সেখান দিয়া গলিতে না পারিয়া আটকাইয়া গেল। তখন কৃষ্ণের টানাটানিতে সেই প্রকাণ্ড গাছ দুটি মহাশব্দে ভাঙ্গিয়া পড়ায় সকলে ভাবিল না জানি কি হইয়াছে। তাহারা নিতান্ত ব্যস্তভাবে ছুটিয়া আসিয়া দেখিল যে খোকা দুইগাছের মাঝখানে বসিয়া, তাহার ছোট ছোট দাঁতকটি বাহির করিয়া হাসিয়া অস্থির, তাহার পেটের সঙ্গে দড়ি দিয়া উদূখল বাধা। সেই হইতে কৃষ্ণের একটি নাম হইল দামোদর, কিনা ‘পেটে দড়ি’ (দাম—দড়ি, উদর—পেট)। যা হোক, সে প্রকাণ্ড গাছ ভাঙ্গা যে সেই খোকার কাজ এ কথা কেহ বুঝিতে পারিল না। বুড়ারা বলিল, “এখানে বড়ই উৎপাত আরম্ভ হইয়াছে দেখিতেছি; গাড়ি উলটিয়া যায়, বিনা ঝড়ে গাছ ভাঙ্গিয়া পড়ে। এখানে আর থাকা উচিত নয়; চল আমরা বৃন্দাবনে চলিয়া যাই।” এই বলিয়া তখনই সকলে গোকুল ছাড়িয়া বৃন্দাবনে চলিয়া গেল।