উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/পুরাণের গল্প/পৃথিবীর পিতা

পৃথিবীর পিতা

 সকলের আগে যাহাকে লোকে রাজা বলিয়াছিল, তাহার নাম ছিল পৃথু। তিনি সূর্যবংশের লোক ছিলেন, তাঁহার পিতার নাম ছিল বেণ। ‘রাজা’ কিনা, যে ‘রঞ্জন’ করে অর্থাৎ খুশি রাখে। পৃথু নানারকমে প্রজাদিগকে খুশি করিয়াছিলেন, তাই সকলে মিলিয়া তাঁহাকে ‘রাজা’ নাম দিয়াছিল। পৃথুর পূর্বে লোকের দিন বড়ই কষ্টে যাইত। সেকালে গ্রাম নগর পথঘাট কিছুই ছিল না, ঝোপে জঙ্গলে, পর্বতের গুহায় সকলে বাস করিত। পৃথু তাহাদিগকে বাড়ি-ঘর বাঁধিয়া এক জায়গায় থাকিতে শিখান। আর পথ বানাইয়া চলাফেরার সুবিধা করিয়া দেন। সেই হইতে শহর বস্তির সৃষ্টি হইল। সে কালের লোকে চাষবাস করিতে জনিত না। ফলমূল খাইয়া অতি কষ্টে দিন কাটাইত।

 জমিতে কাঁকর, আকাশে মেঘ নাই; খট্‌খটে শুকনো মাটি ফাটিয়া চৌচির হইয়া আছে, তাহাতে শস্য জন্মাইতে গেলেও তাহা হয় না। প্রজারা পৃথুকে বলিল, “হে রাজা, পৃথিবী সকল শস্য খাইয়া বসিয়াছে, আমরা কেমন করিয়া বঁচিব? ক্ষুধায় বড়ই কষ্ট পাইতেছি আমাদিগকে শস্য আনিয়া দাও।”

 পৃথু বলিলেন, “বটে, পৃথিবীর এমন কাজ? শস্য সব খাইয়া বসিয়াছে? আচ্ছা এখনি ইহার সাজা দিতেছি। আন তো রে ধনুক, নিয়ে আয় তো তীর।”

পৃথিবী ভাবিল, “মাগো, মারিয়াই ফেলে বুঝি।”

 সে প্রাণের ভয়ে গাই সাজিয়া লেজ উঁচু করিয়া ছুটিয়া পালাইতে লাগিল। কিন্তু পৃথুর বড়ই রাগ হইয়াছিল, তিনি তাহাকে কিছুতেই ছড়িলেন না। আকাশ পাতাল ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিল, ব্রহ্মলোক অবধি ছুটয়া গেল; কিছুতেই সে তাঁহাকে এড়াইতে পারিল না। তখন পৃথিবী কাঁপিতে কাঁপিতে বলিল, “দোহাই মহারাজ! আমি স্ত্রীলোক, আমাকে মারিলে আপনার পাপ হইবে।”

 পৃথু বলিলেন, “তুমি ভারি দুষ্ট। তোমাকে মারিলে অনেক উপকার হইবে। কাজেই ইহাতে পাপ নাই বরং পুণ্য আছে।”

 পৃথিবী বলিল, “প্রজাদের যে উপকার হইবে বলিতেছেন, আমি মরিলে তাহারা থাকিবে কোথায়?”

 পৃথু বলিলেন, “কেন? আমি তপস্যা করিয়া তাহদের থাকিবার জায়গা করিব।”

 পৃথিবী বলিল, “আমাকে মারিলে শস্য পাওয়া যাইবে না; শস্য পাইবার উপায় আমি বলিতেছি। সে আর এখন শস্য নাই, আমার পেটে হজম হইয়া দুধ হইয়া গিয়াছে। আমাকে দোহাইলে সেই দুধ পাইতে পারেন। কিন্তু একটি বাছুর চাই, নহিলে দুধ বাহির হইবে না। আর জমির উঁচু নিচু দূর করিয়া দিন, যেন দুধ দাঁড়াইতে পারে, গড়াইয়া না চলিয়া যায়।”

 রাজা তখনই ধনুকের আগা দিয়া জমির উপরকার টিপি সরাইয়া দিলেন। তাহাতে জমি সমান হইল, আর ঢিপি সকল এক এক জায়গায় জড় হইয়া পর্বতের সৃষ্টি হইল। সমান জমির উপরে দুধ ছড়ান যাইতে পারে। সেই বাছুর হইলেন স্বয়ম্ভূব মনু। এমন বাছুর তো আর সহজে পাওয়া যায় না, তাঁহাকে দেখিয়াই গাইয়ের বাঁট দিয়া দুধ ঝরিতে লাগিল। তখন পৃথু নিজ হাতে গাই দোহাইতে লাগিলেন। সে আশ্চর্য গাই না জানি কতই দুধ দিয়াছিল। সংসারে যত শস্য, সকলই তাহাকে দোহাইয়া পাওয়া গেল, সেই শস্য খাইয়া এখনো আমরা বাঁচিয়া আছি। শুধু তাহাই নহে, পৃথুর পরে দেব, দানো, যক্ষ, রাক্ষস প্রভৃতি সকলে আসিয়া সেই গাই দোহাইতে লাগিল। সকলেই নিজের নিজের বাসন আনিল। নিজেদের এক একটি বাছুর ঠিক করিয়া আনিল, দোহাইবার লোক অবধি আনিতে ভুলিল না। কেহ সোনার বাসনে, কেহ রূপার বাসনে, কেহ লোহার হাঁড়িতে, কেহ পাথরের বাটিতে, কেহ লাউয়ের খোলায়, কেহ পদ্মপাতায় এমনি করিয়া তাহারা কতরকমের জিনিসে যে দোহাইয়া নিল, তাহা বলিয়া শেষ করা যায় না। তথাপি দুধে কম পড়ে নাই।

পৃথিবীও বঁচিয়া গেল। এত জিনিস যাহার কাছে পাওয়া যায়, তাহাকে কি বুদ্ধিমান লোকে মারে? কাজেই পৃথু তাহাকে ছাড়িয়া দিলেন।

পৃথু তাহাকে প্রাণদান করিয়াছিলেন, তাই আজও পৃথিবী বাঁচিয়া আছে— আর, প্রাণ দিয়াছিলেন বলিয়াই পৃথু পৃথিবীর পিতার তুল্য হইলেন। সেইজন্যই পৃথিবীকে পৃথুর কন্যা বলা হয়, আর তাহার নাম হইয়াছে ‘পৃথিবী’ বা ‘পৃথ্বী’।

যাহা হউক, পৃথিবীর নামের অন্যরূপ অর্থও দেখা যায়। পৃথ্বী বলিতে খুব বড়ও বুঝায়। পৃথিবী যে খুবই বড় তাহাও তো আমরা দেখিতেই পাইতেছি। সুতরাং পৃথিবী নাম যথার্থই হইয়াছে।