উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/বিবিধ প্রবন্ধ/আকাশের-কথা: ১
আকাশের কথা: ১
অন্ধকার রাত্রিতে যদি আকাশ পরিষ্কার থাকে, তাহা হইলে তারাগুলি বড় সুন্দর দেখায়। তখন ছাতে বসিয়া আকাশের পানে তাকাইয়া থাকিতে বেশ লাগে। তারাগুলি কেমন মিট্মিট্ করে, দেখিয়াছ? দু-একজন হাসি-খুশি লোক আছে, তাহাদের যত হাসি সব চোখ দুটির ভিতরে। তারাগুলিকে দেখিলে আমার ঐরূপ লোকের চোখের কথা মনে হয়। বোধ হয়, যেন আমাকে দেখিয়া তাহাদের বড়ই হাসি পাইয়াছে।
বাস্তবিক, উহাদিগকে দেখিয়া আমরা যেমন আশ্চর্য হই, তাহা জানিতে পারিলে উহারা নিশ্চয়ই হাসিয়া ফেলিত। সেই কবে পৃথিবীতে প্রথম মানুষ জন্মিয়ছিল, আর আজ এই উনিশ শত সালের জুলাই মাস। এতদিন ধরিয়া ক্রমাগত তাহাদিগকে দেখিতেছে, তথাপি মানুষের দেখিবার সাধ মিটে নাই, বরং ক্রমাগত বাড়িয়াই চলিয়াছে। লোকে লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করিয়া দূরবীন তয়ের করে, সারারাত জাগিয়া সেই দূরবীন দিয়া আকাশ দেখে। যাহারা এরূপ করে, তাহার নিতান্ত ছেলেমানুষ নয়। অঙ্কশাস্ত্রে তাহাদের মতো বড় পণ্ডিত খুব কমই আছে।
আজকাল ভালো-ভালো দূরবীন এবং অন্যান্য অনেকরকম যন্ত্র হইয়াছে। আগে এ-সব ছিল না। তখন শুধু চোখে যাহা দেখা যাইত, তাহাতেই লোকে সন্তুষ্ট থাকিত। দেখিতে জানিলে শুধু চোখেই কি কম দেখা যায়? আমরা শুধু চোখে আকাশের যাহা দেখিতে পাই, তাহা কম আশ্চর্য নহে। রোজ দেখিয়া সেগুলি আমাদের কাছে পুরাতন হইয়া গিয়াছে, কাজেই আমরা তাহাদিগকে তেমন আশ্চর্য মনে করি না। চন্দ্র, সূর্য, তারা এ-সকল যদি কিছুই আগে না থাকিত, আর তারপর একদিন হঠাৎ আসিয়া দেখা দিত, তাহা হইলে নিশ্চয়ই খাবার ফেলিয়া ছুটিয়া দেখিতে আসিতাম।
তোমাদের সকলে ধুমকেতু দেখ নাই, কিন্তু ধূমকেতুর কথা অনেক শুনিয়াছ। আচ্ছা, বল দেখি ভাই, একটা ধূমকেতু দেখিবার জন্য তোমাদের মনটা ব্যস্ত হইয়া আছে কিনা? কিন্তু ধূমকেতু যদি রোজ উঠিত, তবে তাহার এত খবর কেহ লইত কি না সন্দেহ।’
যাহা রোজ ঘটিতেছে, তাহাও অতিশয় আশ্চর্য। এই যে আমরা পৃথিবীর পিঠে চড়িয়া ঘুরপাক খাইতে খাইতে শূন্যে ছুটিয়া চলিয়াছি, বলিতে গেলে এটাই কি একটা কম আশ্চর্যের ব্যাপার? আমাদের পৃথিবী ঘুরিতে ঘুরিতে বৎসরে একবার সূর্যের চারিদিক বেড়াইয়া আইসে। সূর্যটা যদি এক জায়গায় স্থির হইয়া বসিয়া থাকিত, আর পৃথিবী তাহার চারিদিকে ঘুরিত, তবে পৃথিবীর পরিশ্রম একটু কম হইত। কিন্তু এ জগতে কাহারও স্থির হইয়া বসিয়া থাকিবার হুকুম নাই। সুতরাং সূর্য ও পৃথিবীকে লইয়া নিজে ঘুরিতে ঘুরিতে আকাশের একদিক পানে ছুটিয়া চলিয়াছে।
পৃথিবীর চারিধারে চন্দ্র ঘোরে, চন্দ্রকে লইয়া পৃথিবী সূর্যের চারিধারে ঘোরে, আবার চন্দ্রসুদ্ধ পৃথিবীকে লইয়া সূর্য কোথায় চলিয়াছে। শেষে গিয়া সে কোথায় ঠেকিবে। আর এই আকাশটাই কত বড় যে, এতদিন ছুটয়াও সূর্য তাহার শেষ পাইল না। একটা তারার দিকে সূর্য ছুটিয়া চলিয়াছে। কিন্তু সেই তারাটা দুশো বৎসর আগে যত দূরে দেখাইত, এখনও তত দূরেই দেখায়। সেই তারাটাই বা কত দূরে যে, এতকাল ছুটিয়াও সূর্য তাহার কিছুমাত্র কাছে পৌঁছতে পারিল না। সূর্য এত দূরে থাকিলে আমরা তাহাকে দেখিতে
পাইতাম কি না সন্দেহ। সেই তারাটা বোধ হয় সূর্যের চাইতেও অনেকখানি বড় আর উজ্জ্বল। সেটা খুব বড় সূর্য, আমাদের এটি একটি ছোট সূর্য।
ঐ তারাগুলি কি তবে সকলেই সূর্য? সূর্যের মতন বড় আর জমকালো না হইলে এত দূরে তাহাদিগকে দেখাই যাইত না। উহারা সকলেই সূর্য। আমাদের সূর্যের চারিধারে যেমন পৃথিবী, মঙ্গল, বুধ, বৃহস্পতি, শনি, প্রভৃতি গ্রহ ঘোরে, উহাদের চারিধারেও হয়তো তেমনি অনেক গ্রহ ঘোরে, কিন্তু এত দূরে থাকিয়া সে-সকল গ্রহকে দেখিবার আমাদের কোনো উপায় নাই। যাহা হউক, এইটুকু দেখা গিয়াছে যে, ঐ-সকল সূর্যের কোনো কোনোটার চারিধারে আর-একটা সূর্য ঘুরিতেছে। এমন প্রমাণও পাওয়া গিয়াছে যে, ঐ-সকল তারার কোনো কোনোটার এমন এক-একটি সঙ্গী আছে যে, তাহাদের নিজেদের আলো নাই। নিজেদের আলো নাই বলিয়া তাহারা আমাদিগকে দেখা দিতে পারিতেছে না, কিন্তু অন্য উপায়ে আমরা জানিতে পারিয়াছি যে, তাহারা আছে। উহাদের নিজেদের আলো নাই সুতরাং উহারা সূর্য নহে, গ্রহ, অর্থাৎ, আমাদের পৃথিবী যাহা, তাহাই। আমাদের এই ছোটখাটো সূর্যের সঙ্গে এতগুলি গ্রহ, ঐ-সকল বড়-বড় সূর্যের সঙ্গে গ্রহ নাই? এটা একটা কথাই নহে!
আমরা নিতান্তই ছোট, কিন্তু আমাদের বিশ্বাস যে আমরা খুব বড়। আমরা ভাবি, আমরা যে মানুষ! আহা, আমাদের মতন আর-একটি জন্তু বুঝি হয় না! আমাদের যে পৃথিবী ইস্! সে কতখানি বড়!’ কিন্তু আমরা যে যথার্থই কত ছোট, তাহা বুঝাইয়া দিবার জন্য ঈশ্বর আকাশকে রাখিয়াছেন। দেখ, ওখানে কত সূর্য। ঐ-সকল সূর্যের সঙ্গে কত পৃথিবী আছে। আর, তাহাতে মানুষের মতন, বা, তাহার চাইতে ঢের বেশি বুদ্ধিমান জীব থাকা কোনমতেই অসম্ভব নহে। উহারা হয়তো আমাদের চাইতে ঢের বেশি কথা জানে, আর এখানকার দূরবীনের চাইতে অনেক বড়-বড় দূরবীন দিয়া আকাশ দেখে। কিন্তু আমাদের খবর কি তাহারা পাইয়াছে? তাহার ভরসা নিতান্তই কম বলিতে হইবে। উহাদের মধ্যে যাহারা আমাদের একটু কাছে থাকে, তাহা হয়তো আমাদের সূর্যকে একটি ছোট তারার মতো দেখিতে পায়। কিন্তু ইহার বেশি দেখা সম্ভব নহে। পৃথিবী, চন্দ্র, বুধ, বৃহস্পতির কথা তাহারা কিছুই জানে না।
আর মানুষ? হায় হায়, আমাদের কথাও তাহারা জানে না। কোনোদিন যে জানিবে তাহারও আশা নাই। ডাকিলে তো উহারা শুনিবেই না। পৃথিবীর সকল মানুষ জুটিয়া চ্যাঁচাইলেও শুনিবে না। চিঠি লিখিয়াও জানাইবার উপায় নাই। চিঠি কে লইয়া যাইবে? কোন পথে যাইবে? আর যদিই বা লোক মিলে আর পথ হয়, তবে সে চিঠি কয় দিনে পৌঁছাইবে? তোমার চিঠিওয়ালা যদি রেলে চড়িয়া ঘণ্টায় ষাট মাইল করিয়া যায়, তাহা হইলেও সকলের চাইতে কাছের তারাটিতে সে সাড়ে চার কোটি বৎসরের কমে পৌঁছাইতে পারিবে না! সেই চিঠির জবাব আসিতে আর সাড়ে চার কোটি বৎসর লাগিবে!
সকলের চাইতে নিকটের তারাটির সম্বন্ধে যদি এমন হয়, তবে দূরের তারাগুলির কথা কি বলিবে! চক্ষে যাহাদিগকে দেখিতে পাই, তাহারা যে আমাদের কাছে, মোটের উপরে এ কথা মানিয়া লওয়া যায়। কিন্তু এই কাছে তারাগুলিও কত দূরে, তাহা উপরের ঐ দৃষ্টান্তটির দ্বারাই বুঝিতে পার। বাস্তবিকই উহারা এত দূরে যে, সকলের চাইতে বড় দূরবীন দিয়াও উহাদিগকে আমরা কিছুমাত্র বড় দেখিতে পাই না। শুধু চোখে যেমন একটা কিছু মিট মিট্ করিতেছে দেখি, দূরবীন দিয়াও তেমনি একটা কিছু মিটমিট করতে দেখি। একটু উজ্জ্বল দেখি বটে, কিন্তু কিছুমাত্র বড় দেখি না।
অবশ্য শুধু চোখে যাহা দেখি, দূরবীন দিয়া তাহার চাইতে অনেক বেশী তারা দেখিতে পাই। দূরবীন যত ভালো হয়, তাহাতে তত বেশি তারা দেখা যায়। এত দুরেও তারা আছে যে, সেখানে দূরবীনেরও দৃষ্টি পৌঁছায় না। তাহারা যে কত দূরে, তাহা ভাবিতেও পারি না। বাস্তবিক আকাশের কথা অতি আশ্চর্য। কিন্তু শুধু আশ্চর্য বলিয়াই যে লোকে আকাশের খবর এত করিয়া লয়, তাহা নহে। এ-সকল কথা জানাতে আমাদের বিস্তর উপকারও আছে। এমন-কি, আকাশের সম্বন্ধে লোকে এতদিন ধরিয়া যত কথা শিখিয়াছে, এখন যদি হঠাৎ তাহার সমস্তই ভুলিয়া যাওয়া যায়, তবে ভারি মুস্কিল হইবে। প্রথম কথা দেখ, আমাদের সময়ের ঠিক থাকিবে না। সূর্যের দিকে চাহিয়া আমরা সময় ঠিক করি। মোটামুটি সকাল, দুপুর, বিকাল, সন্ধ্যা, রাত, সকল কথাই সূর্যের মুখ চাহিয়া। তাহার চাইতে বেশি হিসাবের কথা—অর্থাৎ ঘণ্টা, মিনিট, সেকেণ্ড ইত্যাদি ঘড়ির হিসাবের কথা—যদি বল, সেখানেও দেখিবে, আকাশকে ছাড়িয়া কাজ চলে না।
একটার সময় কলিকাতায় তোপ পড়ে। তখন সকলে নিজের ঘড়ি ঠিক করিয়া লয়। তোপ কি করিয়া পড়ে জান? আকাশের সম্বন্ধে যত কথা জানা গিয়াছে তাহা লইয়া জ্যোতিষশাস্ত্রের সৃষ্টি হইয়াছে। ইংরাজিতে ইহাকে বলে Astronomy। সূর্য, চন্দ্র, গ্রহ, তারা ইহাদের কোনটা আকাশের কোন স্থানে কোন সময়ে থাকে, জ্যোতিষশাস্ত্রের দ্বারা অঙ্ক কষিয়া তাহা স্থির করা যায়। ঐরূপে অঙ্ক কষিয়া এ-সকল কথা স্থির করিয়া পুস্তকে লিখিলে তাহাকে বলে পঞ্জিকা। কোনদিন ঠিক কোন সময়ে সূর্য আমাদের মাথার উপরে আসিবে, পঞ্জিকা দেখিয়া জানা যায়। সূর্য আমাদের মাথার উপরে আসিবার সময় যদি ঘড়িতে ঠিক সেই সময়টি দেখায়, তবেই বলিতে পারি, ঘড়ি ঠিক। তাহা যদি না হয়, তবে ঐ সময় পঞ্জিকার সঙ্গে মিলাইয়া ঘড়ি ঠিক করিয়া দিতে হয়। সময় দেখিবার জন্য একটা আপিস আছে। এই আপিসে একটা ভালো ঘড়ি আছে। সূর্য মোটামুটি বারোটার সময় আমাদের মাথার উপরে আইসে। ঐ সময়ে ঐ আপিসের লোকের দুরবীন দিয়া সূর্য দেখিয়া ঘড়ি ঠিক করে। তারপর একটার সময় ঐ ঘড়ি দেখিয়া তোপ ফেলা হয়। সূর্য, তারা, এ-সকলের সাহায্য না পাইলে ঘড়ি ঠিক রাখা সম্ভব হইত না। তার ফল এই হইত যে, তোমরা কেহ দশটার সময়ই ইস্কুলে গিয়া বসিয়া থাকিতে, আর কেহ বারোটার সময় যাইতে। মাস্টারমহাশয়ের নিতান্তই অসুবিধা হইত, তোমাদেরও পড়াশুনা ভালো করিয়া হইত না। যখন ইস্কুলে জলখাবারের ছুটি হইত, বাড়ির লোক হয়তো তখন খাবার পাঠাইত না। রেলে যাইতে হইলে আরো মুস্কিল হইত!
সমুদ্রে জাহাজগুলি যদি আকাশ দেখিতে না পায়, তবে তাহাদের পথ চিনিয়া চলাই অসম্ভব হয়। আজ যদি সকলে আকাশের কথা ভুলিয়া যায়, তবে সমুদ্রে জাহাজ চলাও বন্ধ হইয়া যাইবে। যে-সকল জাহাজ এখন সমুদ্রে আছে, তাহারা সকলেই পথ ভুলিয়া যাইবে। আমরা যে নুনটুকু খাই, তাহাও জাহাজে আসে। সুতরাং জাহাজ চলা বন্ধ হইলে বড়ই মুস্কিল হইবে।
আকাশের কথা জানিলে যেমন আনন্দ, তেমনি উপকার। এইজন্যই লোকে এত কষ্ট করিয়া আকাশের খবর লইতে ব্যস্ত হয়। ভালো করিয়া আকাশের খবর লইতে হইলে অনেক রকম যন্ত্র আর অনেক লেখাপড়া জানিবার দরকার। আমাদের যদিও তাহার কিছুই নাই, তথাপি আমরা এই বিষয়ের অতি সামান্য একটু চর্চা করিতে পারি, তাহাতেও যথেষ্ট আনন্দ আছে।
আকাশকে আমরা সচরাচর যেমন করিয়া দেখি, তাহাতে তাহার সম্বন্ধে বেশি কথা জানিবার সম্ভাবনা নাই। তাহাকে রোজ দেখিতে হয়, আর খুব সতর্ক হইয়া দেখিতে হয়। এইরূপ করিয়া কিছুদিন দেখিলেই অনেক আশ্চর্য কথা জানিতে পারিবে।