উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/বিবিধ প্রবন্ধ/আকাশের কথা: ২
আকাশের কথা ঃ ২
শুধু চোখে আকাশের যতখানি দেখা যায়, তাহার সম্বন্ধে আজ দুই-একটি কথা বলিব। আকাশে আমরা সচরাচর সূর্য, চন্দ্র, তারা ইত্যাদিকে দেখিতে পাই। মাঝে মাঝে এক-একটা ধুমকেতুও দেখা দেয়। সূর্য, চন্দ্র, ইত্যাদিকে চিনাইয়া দিবার বোধহয় দরকার হইবে না, ধুমকেতু আসিলে তাহাকে চিনিবার যথেষ্ট অবসর পাওয়া যাইবে।
তারাগুলি নিতান্তই ছোট-ছোট, আর ইহাদের সংখ্যাও খুব বেশি। কিন্তু তাই বলিয়া ইহাদিগকে চিনিবার চেষ্টার কোনো ত্রুটি হয় নাই। অতি প্রাচীনকাল হইতেই লোকে ইহাদের কথা জানিবার জন্য ব্যস্ত হইয়া আছে। আগে অনেকে বিশ্বাস করিত যে, ঐ তারাগুলি আর কিছুই নহে, ধার্মিক লোকের আত্মা। মহাভারতে ইহার প্রমাণ দেখিতে পাওয়া যায়। একবার ইন্দের সারথি মাতলি অর্জুনকে রথে করিয়া স্বর্গে লইয়া যাইতেছিলেন।[১] পৃথিবী ছাড়িয়া আকাশের ভিতর দিয়া যাইবার সময়, অর্জুন অনেকগুলি উজ্জ্বল মানুষ দেখিতে পাইলেন। তিনি আশ্চর্য হইয়া মাতলিকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ইহারা কে?’ তাহাতে মাতলি বলিলেন, তুমি পৃথিবী হইতে যে-সকল তারা দেখিয়াছ ঐ তারাসকল পুণ্যবান লোক। পৃথিবীতে থাকিতে তাঁহারা যে সকল সৎকার্য করিয়াছে, তাহার ফলে তাঁহারা এখন তারা হইয়াছে।
প্রাচীন গ্রীক পুরাণে পার্সিয়ুস এবং আণ্ড্রোমীডার গল্প আছে। আণ্ড্রোমীডা রাজকন্যা ছিলেন। মহারাজ কীফিয়ুস তাহার পিতা, রানী কাসিয়োপিয়া তাঁহার মাতা। বিনা দোষে আণ্ড্রোমীডার হাত-পা শিকলে বাঁধিয়া, একটা সামুদ্রিক রাক্ষসের আহারের জন্য তাহাকে সমুদ্রের ধারে ফেলিয়া রাখা হইয়াছিল। মহাবীর পার্সিয়ুস অনেক অসাধ্য সাধন করিয়া তাঁহাকে সেই বিপদ হইতে উদ্ধার করেন, এবং তৎপর তাঁহাকে বিবাহ করেন। প্রাচীন গ্রীক পুরাণে লিখিত আছে যে, ইহাদের মৃত্যুর পর গ্রীক-দেবতা আথেনী, ইহাদিগকে আকাশে তুলিয়া লয়েন। আজও পরিষ্কার রাত্রিতে তাঁহাদিগকে সেখানে দেখিতে পাওয়া যায়। আণ্ড্রোমীডার হাত-পা বাঁধা, পার্সিয়ুসের যুদ্ধের বেশ। কীফিয়ুস দণ্ড হাতে মুকুট মাথায় রাজকাজে নিযুক্ত, কাসিয়োপিয়া হাতির দাঁতের চেয়ারে বসিয়া চুল আঁচরাইতে ব্যস্ত।
পৃথিবীর যেমন ম্যাপ আছে, আকাশেরও তেমনি ম্যাপ আছে। পৃথিবীতে যেমন নানাদেশ আর নানান সমুদ্র, আকাশেও তেমনি অনেকগুলি নক্ষত্রমণ্ডলী (Constellation) কল্পনা করা হইয়াছে। এই-সকল নক্ষত্রমণ্ডলীর প্রত্যেকটার এক একটা নাম আছে। সে-সকল নাম শুনিলে হয়তো তোমাদের হাসি পাইবে। মানুষের নাম আর জন্তুর নাম তাহাতে বেশি, মাঝে মাঝে দুই একটা জিনিসপত্রের নামও দেখা যায়। মানুষের মধ্যে পার্সিয়ুস, আণ্ড্রোমীডা, কীফিয়ুস, কাসিয়োপিয়া, ওরায়ণ, হার্কিউলিস্ ইত্যাদির নাম দেখা যায়। জন্তুর মধ্যে বড় সিংহ, ছোট সিংহ বড় ভল্লুক, ছোট ভল্লুক, বড় কুকুর, ছোট কুকুর, ষাঁড়, ভেড়া, ছাগল, নেকড়ে, বাঘ, জিরাফ, খরগোশ, ঈগল, হাঁস, পায়রা, গোসাপ, কাঁকড়া, বিছে ইত্যাদি। জিনিসপত্রের মধ্যে মুকুট, বীণা, দাঁড়িপাল্লা, জাহাজ ইত্যাদি।
এইসকল নাম কি দেখিয়া রাখা হইয়াছিল, তাহা এখন বলিবার উপায় নাই। কোন কোনো স্থলে দেখা যায় যে, তারাগুলি মিলিয়া কোনো-একটা মানুষ বা জিনিসের চেহারার মতন হইয়াছে, কিন্তু অনেক স্থলেই এরূপ চেহারার মিল দেখা যায় না। যাহা হউক ইহাতে কাজের সুবিধা হইয়াছে তাহার ভুল নাই। সুতরাং ওসকল নাম কে রাখিয়াছিল, কেন রাখিয়াছিল, এত কথার আমাদের দরকার কি?
নক্ষত্রমণ্ডলীর যেমন এক-একটা নাম আছে, তেমনি অনেকগুলি নক্ষত্রের নিজের একএকটা নাম আছে। একটা নক্ষত্র আছে, তাহার নাম ‘ধ্রুব’ অর্থাৎ স্থির। এই নক্ষত্রের উদয় অস্ত নাই, চিরকাল ইহা প্রায় একই স্থানে থাকে, এইজন্য ইহার ঐরূপ নাম হইয়াছে। ইহার সম্বন্ধে পরে আরো কিছু বলিব।
সকলের চাইতে বড় যে নক্ষত্র তাহার নাম সিরিয়স। আমাদের দেশে জ্যোতিষশাস্ত্রে ইহাকে বলে মৃগব্যাধ। এখানে একটা কথা বলার নিতান্ত আবশ্যক হইয়াছে। তারা বলিতে মোটামুটি আমরা আকাশের যতগুলি জিনিসকে বুঝিয়া লই, তাহাদের সবগুলি ঠিক এক জিনিস নহে। যতগুলিকে আমরা তারা বলি, বাস্তবিক তাহাদের কতকগুলি গ্রহ, আর বাকি নক্ষত্র।
আমাদের সূর্য যেমন,নক্ষত্রগুলির সকলেই তেমনি এক-একটি সূর্য। ইহাদিগকে যতবার দেখ একই স্থানে দেখিতে পাইবে।[২] কিন্তু একটা গ্রহকে আজ যদি এক স্থানে দেখ, কাল দেখিবে সে সেস্থান হইতে একটু দূরে চলিয়া গিয়াছে। অবশ্য বেশি দূরে নয়, কিন্তু এতটা দুরে যে, নক্ষত্রগুলির সঙ্গে তুলনা করিয়া বেশ বুঝিতে পারা যায় যে সে নড়িয়াছে।
আমাদের পৃথিবীও একটা গ্রহ। আর গ্রহগুলিও এক-একটা পৃথিবী। ইহারা সকলেই সূর্যের চারিদিকে ঘোরে। এইজন্যই ইহাদিগকে আকাশে স্থান পরিবর্তন করিতে দেখা যায়।
আমি বলিতেছিলাম যে, সকলের চাইতে বড় নক্ষত্রটার নাম সিরিয়স্। আমি যখন নক্ষত্রের কথা বলিতেছি তখন গ্রহগুলিকে অবশ্যই বাদ দিয়া লইতে হইবে। দুটি গ্রহ আছে, যাহারা সিরিয়সের চাইতে উজ্জ্বল। ইহাদের একটি বৃহস্পতি, আর একটি শুক্র—যাহাকে শুকতারা বলে। ইহারা গ্রহ, সুতরাং ইহারা স্থান পরিবর্তন করে। অতএব ইহাদিগকে চিনিতে বেশি মুস্কিল হইবে না। অবশ্য এ কথা মনে রাখিতে হইবে যে, একবার বসিয়া ঘণ্টাখানেক তাকাইয়া থাকিলেই ইহাদিগকে স্থান পরিবর্তন করিতে দেখা যাইবে না। কারণ, ইহারা খুব ধীর গতিতে চলে। ক্রমাগত দুই-তিন দিন মনোযাগ করিয়া দেখলে, অনায়াসেই ইহাদের চঞ্চলতা ধরা পড়িবে।
আকাশের ম্যাপ প্রস্তুত করিবার সময় গ্রহগুলিকে বাদ দিয়া সইতে হয়। যে নড়িয়া বেড়ায় তার একটা স্থান নির্দেশ করা সম্ভব কি? যে ময়রার দোকানের সামনে একটা ষাঁড় দাঁড়াইয়া আছে, সেই ময়রার নিকটে গিয়া সন্দেশ খাইতে যদি কেহ আমাকে হুকুম দেয়, তবে আমার মিষ্টমুখ করার ভরসা বড়ই কম থাকে। কারণ, ষাঁড়টির ততক্ষণে ময়রার দোকান ছাড়িয়া জুতাওয়ালার দোকানের সামনে চলিয়া যাওয়া কিছুই বিচিত্র নহে। গ্রহগুলিও মনে কর যেন এই চলন্ত ষাঁড়ের মতন, উহারা কখন কোথায় থাকে তাহা ম্যাপে লিখিয়া দেওয়া সম্ভব নহে। তবে ষাঁড়ের সঙ্গে ইহাদের একটা মস্ত তফাত আছে। ষাঁড়ের চলাফেরার একটা হিসাব কিতাবনাই, যখন যেখানে খুশি চলিয়া যায়। কিন্তু গ্রহেরা ভারি আইনজ্ঞলোকের মতন চলে, বেহিসাবী এক পাও ফেলে না। সুতরাং উহাদের কে কখন কোথায় থাকিবে তাহা হিসাব করিয়া স্থির করা যায়। এ সম্বন্ধে এর পরে আরো কথা হইবে। এখন আমরা আকাশের সঙ্গে আর একটু পরিচয় করিতে চেষ্টা করি।
যখন অন্ধকার রাত্রিতে আকাশ খুব পরিষ্কার থাকে, তখন কি আমরা খালি গ্রহ আর নক্ষত্রগুলিকেই দেখিতে পাই? আর কিছুই দেখি না? আর একটা জিনিস আছে, সেটাকে হয়তো তোমাদের কেহ কেহ দেখিয়াও থাকিবে। এই জিনিসটার চেহারা পাতলা সাদা মেঘের মতন, সুতরাং অনেকেই ইহাকে মেঘ মনে করিয়া অগ্রাহ্য করে। আচ্ছা, এখন হইতে এই জিনিসটার একটু খোঁজ লইতে চেষ্টা কর দেখি? দুদিন (দুদিন কেন কয়েক ঘণ্টা) ধরিয়া দেখিলেই বুঝিতে পারিবে যে, আকাশে এমন একটা জিনিস আছে যাহাকে এতদিন হয়তো মেঘ মনে করিয়া আসিয়াছ, অথচ সে মেঘ নহে। মেঘ চলিয়া যায়, কিন্তু উহা নক্ষত্রগুলির ন্যায় স্থির থাকে। মেঘের আকার বদলায়, কিন্তু উহার আকার সর্বদাই একরকম থাকে। এই জিনিসটার নাম ‘ছায়াপথ। আকাশের এক ধার হইতে আর এক ধার পর্যন্ত ছায়াপথ নদীর আকারে বিস্তৃত রহিয়াছে। একবার দেখিলে উহাকে আর ভুলিবার জো নাই।
তোমরা অবশ্য পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ ইত্যাদি দিক চিনিতে পার। যদি না পার তবে—চুপ! অন্য কাহাকেও বলিয়ো না—চুপিচুপি মার কাছে জানিয়া আইস। যাহারা বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ‘বোধোদয়’ পড়িয়াছ, তাহারা নিশ্চয় জান যে, যেদিকে ভোরে সূর্য উঠে, সেটা পূর্বদিক। পূর্বদিকে ডান হাত করিয়া দাঁড়াইলে, সম্মুখে উত্তর, বামে পশ্চিম আর পিছনে দক্ষিণ দিক থাকে।
আমাদের সূর্যের মতন কোটি কোটি সুর্য লইয়া ছায়াপথের সৃষ্টি। সেসকল সূর্য কত দূরে, কে বলিবে? আমরা এখানে থাকিয়া তাহাদিগকে স্বতন্ত্রভাবে দেখিতে পাইতেছি না, খালি মোটের উপরে ছায়াপথের স্থানটা একটু ফরসা দেখি।
আকাশের গলায় পৈতার মতন ছায়াপথ তাহার চারিদিক বেষ্টন করিয়া আছে। একবারে আমরা তাহার অর্ধেকের বেশি দেখিতে পাই না, কিন্তু কিছুদিন অপেক্ষা করিলে উহার অপর অর্ধেকও দেখিতে পাইব। আজকাল রাত সাড়ে নয়টার সময় যে অর্ধেককে মাথার উপরে দেখিতে পাও, ক্রমাগত কয়েকদিন ধরিয়া দেখিলে দেখিতে পাইবে যে, উহা আর ঐ সময়ে আমাদের মাথার উপরে থাকে না, কিন্তু আরো পশ্চিমে চলিয়া যায়। কিছুদিন পরে দেখিবে যে সে সন্ধ্যার সময়ই আমাদের মাথার উপরে আসিয়া হাজির হয়। তখন শেষরাত্রিতে আকাশের পূর্বদিকে ছায়াপথের অপর অর্ধেককে দেখিতে পাওয়া যাইবে। আজকাল সেই অর্ধেক দিনেরবেলায় উঠে (অর্থাৎ আকাশের যে ভাগে সূর্য সেই ভাগে সে আছে) বলিয়া আমরা তাহাকে দেখিতে পাই না। শীতকালে সেই অর্ধেক সমস্ত রাত্রি আকাশে থাকিবে। সন্ধ্যাবেলা সে পূর্বদিকে দেখা দিবে, মধ্যরাত্রে আমাদের মাথার উপরে আসিবে, ভোরের বেলা পশ্চিমে অস্ত যাইবে।
এই ছায়াপথ আমাদিগকে ঘিরিয়া রহিয়াছে আমরা ইহারই ভিতরে বাস করিতেছি। আকাশের রাজ্যে যেমন দূরের জিনিস লইয়া কারবার, তাহাতে এ কথা সহজেই মনে হয় যে, আমরা হয়তো ঐ ছায়াপথেরই লোক। আমাদের সূর্য হয়তো এই ছায়াপথেরই একটি অতি গরিব অধিবাসী!