উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/বিবিধ প্রবন্ধ/আদবকায়দা
আদবকায়দা
দেশ ভেদে আদব কায়দার কত প্রভেদ হয়! আবার একস্থানেই ভিন্ন ভিন্ন শ্রেণীর লোকের ভিতরে এ বিষয়ে কত মতভেদ দেখা যায়। গল্প আছে যে, একবার অতিশয় নিম্নশ্রেণীর একজন লোক লেখাপড়া শিখিয়া বড়লোক হইয়াছিল। তাহার বড়ই ইচ্ছা হইল যে স্বজাতীয় লোকদিগকে নিমন্ত্রণ করিয়া আপ্যায়িত করিবে। আয়োজন অনেক হইল, সমাদরের সীমা নাই। ইহাতে কিন্তু হিতে বিপরীত হইল। তাহারা সহজবুদ্ধি লোক। তাহারা যখন দেখিল যে, যে-সকল কথা বলিয়া দশ জায়গায় নিমন্ত্রণের সময় তাহাদিগকে আদর করে, যে-সকল জিনিস চিরকাল ঐরূপ স্থলে তাহারা খাইয়া থাকে, এ জায়গায় তাহার কিছুই নাই, তখন তাহাদের বড়ই বেখাপ্পা বোধ হইতে লাগিল। তাহার বলিল, ‘এরা আদবকায়দা কিছু জানে না, এখানে খাওয়া হবে না৷’—এই বলিয়া সকলে যাইতে উদ্যত হইল। বাড়ির কর্তা ইহাতে বড় ব্যস্ত হইলৈন, কি করিবেন কিছুই ভাবিয়া ঠিক করিতে পারিলেন না। এই সময়ে একজন বুদ্ধিমান ব্যক্তি বলিলেন, ‘কোনো চিন্তা নাই, আমি সব করিয়া দিতেছি। এই বলিয়া তিনি ‘আপনি’ ‘মহাশয়’ ইত্যাদি সম্ভ্রার্থক শব্দ পরিত্যাগ করিয়া ‘তুই’ ‘তোরা’ ইত্যাদি শব্দে তাহাদিগকে সম্বোধন করিতে লাগিলেন। বসিতে আসন দেওয়া হইয়াছিল, সে-সব তুলিয়া ফেলিলেন। লুচির পরিবর্তে মোটা ভাত, শুকনো মাছ আর লঙ্কার চচ্চড়ি, আর কিঞ্চিৎ দধির জোগাড় করিলেন। নিমন্ত্রিতগণ অমনি মহানন্দে কোলাহল করিয়া খাইতে বসিয়া গেল৷
পথে দেখা হইলে, ভক্তিভরে কাহারও পায়ের ধূলা নিই, কাহাকে একটি ‘কুডুলে’ নমস্কার করিয়াই যথেষ্ট মান্য হইয়াছে মনে করি, আবার কোনো অল্পভাগ্য লোককে কেবলমাত্র দন্তপঙ্ক্তি দেখাইয়া বিদায় দিই৷
ফ্রান্স দেশে ভদ্রলোকে ভদ্রলোকে দেখা হইলে, অনেক স্থলে পরস্পরকে চুম্বন করিবার রীতি আছে। একজন ফরাসী একবার তাঁহার এক ইংরাজ বন্ধুকে দেখিতে গেলেন। ফরাসী আসিয়াছেন শুনিয়াই ইংরাজ তাড়াতাড়ি স্নানের ঘরে গিয়া মুখময় সাবান মাখিয়া আসিলেন। ফরাসীকে অগত্যা বন্ধুর টাক পড়া তালুতে চুম্বন করিয়া ভদ্রতা রক্ষা করিতে হইল৷
আফ্রিকা দেশে এক জাতীয় লোক আছে। তুমি যদি তাহাদের বাড়িতে যাও, আর যদি গৃহস্বামী তোমাকে যৎপরোনাস্তি সমাদর করিতে ইচ্ছা করেন, তবে চাকরকে দুই বাটি রঙ আনিতে বলিবেন, একবাটিতে সাদা রঙ অপর বাটিতে কালো রঙ। রঙ আসিলেই তিনি তাহার কিঞ্চিৎ কিঞ্চিৎ লইয়া যত্নের সহিত মুখে মাখিতে থাকিবেন। তুমিও যদি তাঁহার সঙ্গে সঙ্গে ঐরূপ না কর, তবে তোমাকে ভারি অসভ্য, আদবকায়দা-বিহীন জংলী জানোয়ার মনে করিবেন৷
একবার একজন বড় ইংরাজ কোনো অসভ্য জাতির সহিত সন্ধি করিতে গিয়াছিলেন। সেই জাতির দলপতির দরবারে সাহেবকে লইয়া যাওয়া হইল। দলপতি পরম সমাদরে গাত্রোত্থান করিয়া সাহেবকে অভ্যর্থনা করিলেন। সাহেবও অবিকল সেইরূপ অঙ্গভঙ্গি করিয়া প্রতিনমস্কার জানাইলেন। নিকটস্থ হইলে দলপতি সস্নেহে সাহেবের হাতখানি টানিয়া লইলেন, এবং ধীরে ধীরে তাহার ঠিক মধ্যস্থলে অতি সুন্দর এক বিন্দু থুথু ফেলিলেন, সাহেবের অন্তরাত্মা শিহরিয়া উঠিল, কিন্তু পাছে অসভ্যতা হয়, তাই বাহ্যিক কিছু প্রকাশ করিলেন না। দলপতি নিবৃত্ত হইবামাত্রই সাহেব তাঁহার হাতখানি টানিয়া লইয়া নূতন শিক্ষিত প্রণালী অনুসারে যথাসাধ্য সদ্ভাব জ্ঞাপন করিলেন। সাহেবের এই ব্যবহারে উপস্থিত সকলেই যারপরনাই খুশি হইলেন এবং সন্ধি হইতে আর কোনো গোল হইল না।