উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/বিবিধ প্রবন্ধ/পুরাতন কথা: ৩
পুরাতন কথা: ৩
এতক্ষণ যাহা বলা গিয়াছে, তাহা হইতে কি শিখিলাম, দেখা যাউক—
১ পৃথিবীর পৃষ্ঠদেশে ক্রমাগত পরিবর্তন হইতেছে। দেশ ডুবিয়া সাগর হইতেছে, সাগর ডুবিয়া দেশ হইতেছে৷
২ জল থিতাইয়া পলি পড়ার দরুন নানারূপ গাছপালা জীবজন্তু ইত্যাদির চিহ্ন থাকিয়া যাইতেছে৷
এই দুইটি কথা বেশ করিয়া মনে রাখ। তারপর যাহা বলি শ্রবণ কর৷
অনেক সময় জলে এমন সব জিনিস সব মিশ্রিত থাকে যে, তাহার সাহায্যে জলে ডোবা বস্তুগুলি পাথর হইয়া য়ায়। একবার এইরূপে পাথর হইতে পারিলে আর সে-সব জিনিসের ধ্বংস হয় না—যুগ-যুগান্তর ধরিয়া তাহাদের চিহ্ন বর্তমান থাকে। পাথর মানুষের অতিশয় প্রয়োজনীয় বস্তু, সুতরাং মানুষেরা তাহা সংগ্রহ করিতে যায়। এইরূপে পাথর আনিতে গিয়া তাহার ভিতরে অনেক সময় নানাপ্রকার জীবজন্তুর হাড় পাওয়া যায়। সেই সকল হাড় দেখিয়া পণ্ডিতেরা স্থির করিতে পারেন, তাহা কিরূপ জন্তুর হাড় ছিল। লক্ষ লক্ষ বৎসর পূর্বে কোনো নদীর তলায় পলি পড়িয়ছিল, তখন একটা জন্তুর মৃতদেহ তাহাতে ঢাকা পড়িয়াছিল। জলে এমন কোনো পদার্থ ছিল, যাহার জন্য ঐ-সকল পলি এবং হাড় পাথর হইয়া গেল। কালক্রমে সে স্থানের মাটি উচু হইয়া সেখানে একটা পাহাড় হইল। আজকাল সেই পাহাড়ের কাছে মানুষ বলিয়া একরকম জন্তু চলাফেরা করে। তাহদের ঘরদোর তয়ের করিবার জন্য পাথরের দরকার হয়, সেই পাথর তাহার ঐ পাহাড়ের গা হইতে কাটিয়া বাহির করিতে গিয়া ঐ হাড়গুলি পাইল। অনতিবিলম্বে পলিয়ণ্টলজিস্ট নামক একপ্রকারের পণ্ডিত মানুষ আসিয়া চশমা চোখে, নোটবই হাতে তাহাদের পরীক্ষা করিতে লাগিল। পরীক্ষায় স্থির হইল যে, এ হাড় যে জানোয়ারের, তাহার মতন জন্তু আর এখন পৃথিবীতে নাই।
কোটি বৎসর পূর্বে হয়তো কোনোস্থানে প্রকাণ্ড বন ছিল। একদিন তাহ ধসিয়া গিয়া জলাতে পরিণত হইল। লক্ষ বৎসর ধরিয়া সেই জল হইতে ঐ বনের গাছপালার উপর পলি পড়িল, তাহার ঢাকা পড়িল। কালে জলার চিহ্ন পর্যন্ত লোপ হইয়া সেস্থান সমান জমিতে পরিণত হইল। তাহার নীচে সেই যে বহুকালের পুরাতন বনের গাছপালাগুলি ঢাকা পড়িয়াছে এতদিনে তাহাদের কি হইয়াছে জান? এতদিনে তাহাদের শরীরের গঠনের উপকরণগুলি রূপান্তরিত হইয়া পাথর-কয়লার আকার ধারণ করিয়াছে। এই-সকল পাথর-কয়লার মধ্যে স্থানে স্থানে এক-একটা আস্ত গাছের গোড়া, নানারকমের পাতা ইত্যাদি পাওয়া যায়। তাহার আকৃতি ঠিক বজায় রহিয়াছে, কিন্ত তাহারা পাথর-কয়লা হইয়া গিয়াছে। এই সকল গাছপালার চিহ্ন দেখিয়াও পণ্ডিতেরা স্থির করিয়াছেন যে তাহাদের অনেকেই বর্তমান গাছপালা হইতে অনেকাংশে বিভিন্ন৷
বড়-বড় জলার ধারে কত জানোয়ার জল খাইতে আসে। জলে যে সব লতা-পাতা জন্মে তাহা খাইতেও ছোট-বড় কত জন্তু আসে। এইসকল জলাতে প্রায়ই ভয়ানক কাদা হয়। আজকালও অনেকের গোরু-বাছুর এইরূপ কাদায় ডুবিয়া মারা যায়। প্রাচীনকালে এইরূপ ঘটনা ঘটিত, তাহা সহজেই বুঝা যায়। জলার ধারে আসিয়া একবার যদি গভীর কাদায় পা পড়িল, তবে আর রক্ষা নাই। যতক্ষণ জন্তুটি পানাহারে ব্যস্ত, ততক্ষণে পাগুলি অজ্ঞাতসারে অনেক দূর বসিয়া গিয়াছে। চলিয়া যাইবার সময় পা উঠে না। ভয়ে জন্তুটি যতই হুড়াহুড়ি করিতেছে, পাগুলি ততই অধিক বসিয়া যাইতেছে। অবশেষে শরীরটি অবধি ডুবিয়া সেই ভয়ানক কাদার ভিতরে চিরদিনের জন্য অদৃশ্য হইল। আমেরিকায় এরূপ অনেক জলা ছিল, তাহাদের অনেকগুলি আজ একেবারে শুকাইয়া যায় নাই। এই সকল স্থান খুঁড়িয়া পণ্ডিতেরা অনেক অত্যাশ্চর্য জন্তুর অস্থি, কঙ্কাল, এমন-কি, অনেক সময় আস্ত শরীর অবধি পাইয়াছেন। আয়র্ল্যাণ্ড এবং স্কটল্যাণ্ডের স্থানে স্থানেও এমন হইয়াছে। সাইবেরিয়াতেও সময় সময় এরূপ ঘটনার চিহ্ন পাওয়া যায়৷
পূর্বকালে কিরূপ জন্তুসকল ছিল, তাহা কিরূপে জানা যায়, এখন তাহা বুঝিতে পারিতেছ। অনেক সময় কেবলমাত্র পদচিহ্ন দেখিয়া জন্তুবিশেষের পরিচয় পাওয়া গিয়াছে। কোনো সময় অস্থিখণ্ডমাত্র দেখিয়া তাহার স্বভাব-চরিত্র নির্ণয় করিতে হইয়াছে। কোনোস্থানে আস্ত কঙ্কাল পাওয়া গিয়াছে, কোনোস্থানে সমস্ত শরীরটাও পাওয়া গিয়াছে। তখন তাহদের পেট কাটিয়া পরীক্ষা করা গিয়াছে। একবার একজন পণ্ডিত এইরূপে প্রাপ্ত একটা জন্তুর হাড় হইতে সুপ প্রস্তুত করিয়া অন্যান্য পণ্ডিতদের উপহার দিয়াছিলেন। তাঁহারা খাইয়া কি বলিলেন, জানিতে পারি নাই৷
পৃথিবীর সকল স্থানেই এইরূপ লুপ্ত জন্তুর চিহ্ন পাওয়া যায়। ভারতবর্ষেও তাহা নিতান্ত বিরল নহে। ঐ-সকল জন্তু কতদিন হইল লোপ পাইয়াছে, তাহ অবশ্য সকল স্থলে বলা যায় না। কিন্তু কোনটি পুরাতন, কোনটি অপেক্ষাকৃত আধুনিক, এ কথা অনেক স্থলেই বলা সম্ভব। আবার দুইশত বৎসর পূর্বে লোকেরা দেখিয়াছে এখন তাহা নাই, এরূপ জন্তুও নিতান্ত কম নহে। পুরাতন প্রাণীবৃত্তান্তের পুস্তকে, এবং প্রাচীন নাবিকদিকের লিখিত প্রবন্ধাদিতে অনেক সময় অনেক জন্তুর বিবরণ এবং চিত্র পাওয়া যায়। আজকাল সে-সকল জন্তুর চিহ্ন পর্যন্ত লোপ পাইয়াছে৷