উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/বিবিধ প্রবন্ধ/জন্তুর পরিচয়
জন্তুর পরিচয়
লোকে বলে, বিড়াল নাকি বাঘের মাসি হয়; আর শেয়াল নাকি হয় তার ভাগ্নে। বিড়াল যে বাঘের মাসি, এ কথা মানতে আমি কতক রাজি আছি কিন্তু শেয়াল যে তার ভাগ্নে, এটা আমার কিছুতেই বিশ্বাস হচ্ছে না। সেই ছেলেবেলা থেকে শুনে আসছি যে, ভাগ্নের চেহারা তার মামার মতো হয়। কিন্তু শেয়ালের চেহারা কি বাঘের মতো? বাঘের মুখ হাঁড়িপানা, শেয়ালের মুখ ছুঁচাল। বাঘের মতো শেয়ালেরও বড়-বড় ধারাল দাঁত আছে বটে, কিন্তু সে তেমন ধারালও নয়, তেমন বড়ও নয়। তারপর পায়ের নখগুলোর দিকে চেয়ে দেখ। বাঘের বাঁকা বাঁকা নখগুলো কি ধারাল আর মজবুত, আর সেগুলোকে ইচ্ছামতো কেমন খাপে ঢুকিয়ে রাখতে আর বার করতে পারা যায়।
বাঘের নখ পরীক্ষা করে দেখবার সুবিধা হবে না? আচ্ছা, না হয় বিড়ালের নখই দেখ। তোমাদের ‘মেনী’ যখন তোমাদের সঙ্গে খেলা করে, তখন তার পায়ের দিকে চেয়ে দেখ তো। তখন সে যত্নের সহিত তার নখগুলিকে খাপে ঢুকিয়ে রাখে। তখন তো আর তার নখের দরকার নাই। সকল সময় নখ বার করে রাখলে সে ঘষায় ঘষার ভোঁতা হয়ে যাবে যে, তাহলে তো তার একটি মস্ত হাতিয়ারই মাটি হয়ে গেল। তাই কাজের সময় ছাড়া অন্যসময় মেনী তার নখ বার করে না। কিন্তু একটি ইঁদুর তার সামনে আসুক তো, তখন দেখবে সে কেমন নখ বার করে তাকে খাবলে মেরে ধরবে। আমি কতবার দেখেছি।
অবশ্যি তোমাদের মেনীটি পোশাকী হতে পারে। তার হয়তো ইঁদুর ধরার অভ্যাস নাই। আর অভ্যাস থাকলেও তোমাদের তামাশা দেখাবার খাতিরে এক্ষনি একটি ইঁদুর এসে তার সামনে হাজির হচ্ছে না। যাহোক এর আর একটা উপায় আছে। মেনীকে যদি এমন কোনো জায়গায় তুলে দিতে পার যে, সেখান থেকে তাকে পিছলে পড়তে হয়, তা হলে দেখবে সে কেমন নখ বার করে আটকে থাকবার চেষ্টা করে।
মেনীটি যদি শান্ত হয়, আর তার আঁচড়াবার অভ্যাস না থাকে, তা হলে, সকলের চেয়ে ভালো উপায় হচ্ছে, তাকে কোলে নিয়ে ধীরে সুস্থে তারা থাবা পরীক্ষা করে দেখ। থাবার উপরে আর নিচে আঙুল দিয়ে টিপ দাও, অমনি নখগুলি বেরিয়ে আসবে। টিপ ছেড়ে দাও, আবার সেগুলো ভিতরে ঢুকে যাবে। বাঘের থাবায় ধরে দেখাবার সুবিধা নাই; আর, থাকলেও সেকাজ করতে তোমাদের কখনো বলি না,—যদি সেটা মরা বাঘ না হয়। কিন্তু দেখতে পারলে বুঝতে যে, বাঘ আর বিড়াল একই রকমের জানোয়ার, খালি ছোট বড়র তফাত। বাঘ, সিংহ এরা সব বিড়ালেরই কুটুম্ব। গরম দেশে এরকমের জন্তু ঢের আছে। কোনোটা হলদে, কোনোটা ছেয়ে কোনোটা কটা, কোনোটা কালো, কোনোটার গায়ে ডোরা, কোনোটার গায়ে চক্র। কোনোটা মস্ত বড়, তাকে বলি বাঘ, কোনোটা ছোট, তাকে বলি বিড়াল। আসলে এরা সকলেই ভাই বেরাদর; এরা হচ্ছে বিড়াল বংশ।
তাই বলছিলাম, বিড়াল যে বাঘের মাসি, এ কথা আমি কতক মানি। কিন্তু শেয়াল যে বাঘের ভাগ্নে, এটা নিতান্ত বাজে কথা; শেয়াল বাঘের কেউ নয়। শেয়ালের দাঁত নখ ছোটছোট আর সরু-সরু। বাঘের নখ দাঁতের সঙ্গে তার তুলনাই হয় না। আর শেয়ালের এমন ক্ষমতা নাই যে ইচ্ছামতো তার নখ বার করে বা গুটিয়ে রাখে। তার সোজা নখগুলো খোঁটার মতো তার আঙ্গুলের আগায় বসান থাকে।
ভেবে দেখতে গেলে, কুকুরের সঙ্গে শেয়ালের চেহারা খুব মিলে। কুকুরের নখ দাঁত শেয়ালেরই মতো। নেকড়েরও তাই। এরা সব ভাই বেরাদর —এরা কুকুর বংশ।
এক হিসাবে কিন্তু বাঘ বিড়াল আর শেয়াল কুকুর এক বংশ না হলেও, একদল বলা যেতে পারে। এরা সকলে মাংস খায়। গোরু ঘোড়া মাংস খায় না, তারা আরেক দল। এদের দাঁত আর নখও মাংস-খেকো জানোয়ারের দাঁতের মতো ধারাল নয়। যাহোক এখন আমাদের অত খুঁটিনাটির খবর না নিলেও চলবে। তার চেয়ে কাজের কথা এই হচ্ছে যে এই যে বাঘ শেয়াল আর গোরু ঘোড়ার দুটো দল হল, এদের মধ্যে আবার এক বিষয়ে মিল আছে—এরা সকলেই শিশুকালে মায়ের দুধ খায়। কাজেই এদের দুটো দল হলেও, ধর্মটা একই দেখা যাচ্ছে। পাখিরা শিশুকালে মায়ের দুধ খায় না, মাছেরাও খায় না তাদের ধর্ম অন্যরকম। আবার, বাঘ, শিয়াল, গোরু, ঘোড়া, পাখি, মাছ, এদের মধ্যেও একটা মস্ত কথায় এমন মিল আছে যে, তাতেই এদের সকলের এক জাত করে দিয়েছে। পিঠে একটি শিরদাঁড়া, আর গায়ে হাড় এদের সকলেরই আছে।
হাড় কি সকল জন্তুর থাকে? ফড়িঙের হাড় নাই, কেঁচোর নাই, শামুকের নাই,—আরো কত জন্তুর নাই। যাদের শিরদাঁড়া আছে, আর যাদের নাই, এই হল তবে প্রাণীদের দুই জাত। একটা জন্তুর পরিচয় জানতে হলে, দেখ, কত কথার, কত খবর নিতে হয়। আগে দেখব সে কোন জাতের, তারপর দেখব সে কোন ধর্মের, তারপর দেখব সে কোন দলের, তারপর দেখব সে কোন বংশের। এত করে তবে তার যথার্থ পরিচয়টি পাওয়া যাবে। ঠিক যেন চিঠির ঠিকানা— অমুক শহরে, অমুক গলিতে, এত নম্বরের বাড়িতে, পরমকল্যাণীয়, শ্রীমান অমুকের হাতে পঁছছে। তা হলে তো শ্রীমান চিঠিখানি পাবেন, নইলে শুধু খাম টিকিটের পয়সা খরচ।