উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/বিবিধ প্রবন্ধ/জানোয়ারের শিক্ষা
জানোয়ারের শিক্ষা
সার্কাসওয়ালারা নানারকম জন্তুর তামাশা দেখায়। যাহারা দেখে, তাহারা খুবই আমোদ পায়, কিন্তু এই-সকল জন্তুকে শিখাইতে কত বুদ্ধি, কত পরিশ্রম, কি পরিমাণ সাহস এবং কতদূর অধ্যবসায়ের প্রয়োজন হইয়াছিল, তাহা অল্প লোকেই ভাবিয়া দেখে।
গাধা পিটিয়া ঘোড়া করিবার কথা আমরা শুনিয়াছি, কিন্তু বনের হিংস্র জন্তুকে, ধরিয়া আজকাল লোকে তাহার দ্বারা যে-সকল আশ্চর্য কাজ করাইয়া লইতেছে, তাহার কথা ভাবিয়া দেখিলে গাধা পিটাইয়া ঘোড়া করা (অর্থাৎ গাধার মতন র্নিবোধ এবং ঠ্যাটা জন্তুকে দিয়া ঘোড়ার ন্যায় বুদ্ধিমান এবং বাধ্য জন্তুর মতন কাজ করাইয়া লওয়া) তেমন আশ্চর্য বিষয় বলিয়া মনে হয় না। অন্তত এ কাজে বিশেষ কোনো বিপদের আশংকা নাই।
কিন্তু একটা বাঘকে বন হইতে ধরিয়া আনিয়া তাহাকে আদবকায়দা শিখাইতে গেলে যে, ব্যাপারখানা কিরূপ দাঁড়ায়, তাহা পরীক্ষা করিয়া দেখিতে কাহাকেও পরামর্শ দিই না। যাঁহারা এ কাজ কখনো করিয়াছেন, তাঁহাদের মুখে শুনা যায় যে, ইহার মতো বিপদজনক কাজ অতি অল্পই আছে। এ কথা তাঁহারা বিশেষ করিয়া না বলিলেও আমরা সহজেই অনুমান করিয়া লইতে পারি।
এ-সকল জন্তুর মেজাজের উপরে কোনোরূপ বিশ্বাস স্থাপন করা চলে না। নিতান্ত ভালোমানুষ সিংহটাও কখন যে হঠাৎ হাসি থামাইয়া তাহার গুরুর ঘাড় মটকাইয়া দিবে, তাহার কিছুই ঠিকানা নাই। বনের স্বাধীন সুখ ছাড়িয়া অবধি খাঁচার ভিতরে থাকিয়া সে যত অপমান সহ্য করিয়াছে, তাহা তাহার মনে চিরকাল থাকিয়া যায়, এবং কোন মুহূর্তে যে তাহার প্রতিশোধ লইবে, তাহা কেহই বলিতে পারে না।
কত অপমান? আচ্ছা মনে কর তো দেখি, কতখানি নাকাল হইলে তবে একটা মানুষের মাথা মুখের ভিতরে পাইয়াও বাঘের তাহা একটিবার চিবাইয়া দেখিতে ইচ্ছা করে না। প্রথম যখন সে বন হইতে আসিয়াছিল, তখন বুঝি তাহার মেজাজ এমনি ঠাণ্ডা ছিল! তখন তাহার স্বভাব কিরূপ ছিল, তাহা তাহার প্রথম কয়েকদিনের ব্যবহার হইতেই বুঝিতে পারা যায়। একটা ইংরাজি প্রবন্ধে এ সম্বন্ধে যাহা পড়িয়াছি, তাহা এইরূপ—
‘বাঘ সিংহকে পোষ মানান অনেক দিনের আর বড় বিপদের কাজ। কিন্তু তাহাকে প্রথম বাগ মানাইবার উপায়টি অতি সহজ এবং অদ্ভুত। জানোয়ারকে ধরিয়া আনা হইল। তাহার বাড়ি হইতে তাহাকে ছিনাইয়া লইয়া খাঁচার ভিতরে কয়েদ করা অবধি তাহার ভবিষ্যৎ প্রভুর নিকট পৌঁছানো পর্যন্ত প্রত্যেক মুহূর্তে তাহার রাগ বাডিয়া আসিয়াছে, সে রাগ কাহারো উপরে একবার ঝাড়িতে পারিলে হয়, তাই সে কেহ খাঁচার নিকটে গেলেই দাঁত খিচাইয়া গর্জন করিতে থাকে। এ সময়ে তাহার শিক্ষক খাঁচার ভিতরে গেলে তাহাকে তখনই খণ্ড খণ্ড করিয়া ফেলিবে।’
‘সিংহ হইলে, এই সময়ে তাহার রাগ থামাইবার জন্য তাহাকে বেশ করিয়া খাওয়ানো হয়, আর এমন একটা-কিছু তাহাকে দেওয়া হয়, যাহার উপরে সে রাগ ঝাড়িতে পারে। সে জিনিসটা আর কিছু নহে, একখানি সাধারণ চেয়ার।’
‘চেয়ারখানিকে খুব সাবধানে খাঁচায় ঢুকাইয়া দেয়, আর নিমেষের মধ্যে সিংহটা তাহার উপরে লাফাইয়া পড়ে। তার পরের মুহূর্তে আর সে চেয়ারের কিছু অবশিষ্ট থাকে না, খালি তাহার টুকরাগুলি চারিধারে ছড়ানো থাকে। পরদিন ঐরূপে আর-একখানি চেয়ার খরচ করা হয়। তৃতীয় দিন আর-একখানি। এইরূপ দিনের পর দিন চলিতে থাকে। শেষে সিংহের ইহাই বিশ্বাস হয়, যে ঐ চেয়ারের আর শেষ নাই। কাজেই তাহার উৎসাহ কমিয়া যায়। সে মনে করে, যে এইরূপ বৃথা পরিশ্রম করিয়া লাভ কি? না হয়, এ বিষয়ের তর্ক ছাড়িয়াই দিলাম। সুতরাং শিক্ষকের এইটুকু লাভ।’
‘ইহার পর একদিন কৌশলে তাহাকে ঘুমের ঔষধ গিলাইয়া দেওয়া হয়, আর ঘুম আসিলে সেই অবস্থায় তাহাকে বেশ করিয়া মজবুত শিকল দিয়া খাঁচার শিকের সহিত বাঁধা
হয়। ঘুম হইতে উঠিয়া সে দেখে, যে তাহার মাস্টার খাঁচার ভিতরে চেয়ারে বসিয়া আছে।
সিংহটা গর্জন করিয়া তাহাকে ধরিবার জন্য লাফ দেয়, কিন্তু শিকলির টানে তাহা করিতে পারে না, বরং তাহার নিজেরই দম আটকাইয়া যায়। এইরূপ আট দিন চলে। মানুষকে ধরিবার বিফল চেষ্টায় সিংহের বলক্ষয় হয়, আর মানুষটা সিংহের আস্ফালন গ্রাহ্য না করিয়া স্থিরভাবে বসিয়া থাকে। কাজেই শেষটা সিংহকেই হার মানিতে হয়।
ইহার পরে সিংহের শিকল খুলিয়া দিয়া খাঁচায় প্রবেশ করিতে হয়। ইহাই সর্বাপেক্ষা সংকটের সময়, ইহাতে প্রাণ নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সিংহ প্রায়ই এই সময় তাহার শিক্ষকের প্রাণবধ করিতে চেষ্টা করে। কিন্তু শিক্ষকও অবশ্য তখন চুপ করিয়া বসিয়া থাকে না। পূর্বের অভিজ্ঞতা দ্বারা সে অনেকটা বুঝিয়া লইয়াছে যে, এইরূপ স্থলে কিরূপ বিপদের সম্ভানা। সুতরাং সে তাহার জন্য প্রস্তুত হইয়াই আসিয়াছে। গলায় পুরু চামড়ার গলাবন্ধ, শরীরে খরের বর্ম। (খড়ের মধ্যে সহজে নখ বসে না, পিছলাইয়া যায়)। জন্তুটা বেশি মারাত্মক স্বভাবের হইলে শিক্ষক নিজের মাথাটাকে একটা লোহার খাঁচার মতন আবরণের দ্বারা সুরক্ষিত করে।
এক হাতে একটা মজবুত ত্রিশূলের মতন জিনিস আর-এক হাতে সেই চেয়ার। এবারে চেয়ার ঢালের কাজ করিবে। সিংহ লাফাইয়া খাইতে আসিবে ঐ চেয়ার দিয়া তাহার মাথাটাকে চাপিয়া ধরিতে হয়, আর সেই সময়ে কোনো কোমল স্থানে ত্রিশূলের খোঁচা লাগাইতে হয়। সিংহ খালি হওয়ায় থাবা মারিয়াই ফিরিয়া গিয়া আবার লাফাইবার জন্য প্রস্তুত হয়। শিক্ষক গলদ্ঘর্ম হইলেও কিছুমাত্র বিচলিত না হইয়া ত্রিশূলের গোডা দিয়া সিংহের নাকে মারে, ঐখানটায় সিংয়ে বড় লাগে। তাহাতে বেদনায় আর্তনাদ করিয়া সিংহ আবার হটিয়া যায়।
এইরূপে ক্রমাগত কয়েকদিন করিতে পারিলে শেষে সে জানোয়ারকে হার মানিতেই হয়। তাহার পর আর সে তাহাকে মারিতে চেষ্টা করে না, কিন্তু চিরদিনই তাহাকে বিষ নজরে দেখে।
একজন প্রসিদ্ধ জানোয়ার-ব্যবসায়ীকে জিজ্ঞাসা করা হইয়াছিল যে, বনের জন্তুকে ধরিয়া আনিয়া তাহাকে রাজি করিতে শিখাইতে তাহার প্রতি নিষ্ঠুর আচরণ কর কিনা? তিনি তাহার উত্তরে বলিয়াছিলেন, ‘তাহা তো নয়ই, বরং ইহাতে তাহাদের বেশ আমোদ হয়, আর শরীরও ভালো থাকে।’ কিন্তু উপরের বর্ণনায় সিংহের আমোদ কোন্খানটায় তাহা তো বুঝিলাম না।
আমাদের চাইতে ভয়ের কথাই অধিক সঙ্গত বলিয়া বোধ হয়। বেড়া ডিঙ্গানো শিখাইবার সময় প্রথমে জ্বলন্ত লোহা দিয়া বেচারার পিছনে ‘ছ্যাকা’ লাগাইয়া দেয়। তাহার পর জ্বলন্ত লোহার পরিবর্তে কোনো-একটা উজ্জ্বল পদার্থ দেখিলেই তাহার ভয়ে সে বেড়া ডিঙ্গায়। শিক্ষকের হাতের ছড়ির আগায় কোনো-একটা উজ্জ্বল পদার্থ এমন-কি, সাদা পালক বাঁধিয়া দিলেই সিংহের ‘ছ্যাঁকা’ লাগার কথা মনে হয়। ইহার মধ্যেও আমাদের কোনো সম্পর্ক নাই।
অনেক স্থলে কোনো-একটা কঠিন কাজ শিখাইতে হইলে আগে জানোয়ারটাকে ঘুমের ঔষধ দিয়া তাহার হাত-পা বাঁধা হয়। তাহার পর সেই বাঁধা অবস্থায় বলপূর্বক দড়ির আর কপিকলের সাহায্যে তাহাকে শিক্ষকের ইচ্ছানুরূপ করিয়া হাত-পা নাড়িতে বাধ্য করে। শেষে দড়ি খুলিয়া লইলেও সে ঐরূপ করিয়া হাত-পা নাড়িতে পারে, এই উপায়ে গোলার
উপর চড়া ট্রাইসিকলে চালানো প্রভৃতি শিখানো হয়।
আমাদের কথা না বলিলেই ভালো ছিল। অন্তত সিংহ বাঘ প্রভৃতির পক্ষে এ কথা খাটে না। তবে ভালুকগুলি নাকি এ-সব তামাশা করিতে অনেক সময় আমোদ পায়। তাহা হইতে পারে, কিন্তু সে কি এমন আমোদ, যে তাহাতে তাহার কারাবাসের দুঃখ কিছুমাত্র কমে? তাহা যদি হইত, তবে শিক্ষকের উপরে তাহাদের এত রাগ হইত বলিয়া বোধ হয় না। শিক্ষক তাহাদের ভালোবাসা আকর্ষণ করিবার জন্য নানারূপ উপায় অবলম্বন করে। নিজের হাতে সর্বদা জন্তুকে খাওয়ায়। তথাপি এমন তো শুনিতে পাই না যে, এ-সকল শিক্ষকের একজনকেও তাহার জানোয়ারগুলি বড় ভালোবাসে। বাঘ সিংহকে যাহারা খাওয়ায় তাহাদের প্রতি সেই-সকল জন্তুর ভালোবাসা হওয়ার কথা অনেক শুনিয়াছি। কিন্তু এই সকল শিক্ষকের জন্য এরূপ ভালোবাসা কেন হয় না? ভালোবাসা হওয়া দুরে থাকুক, বরং এরূপই শুনিতে পাই যে, ইহারা শিক্ষকের ঘাড় ভাঙ্গিবার জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকে। এ সম্বন্ধে উপরের উল্লিখিত ইংরাজি প্রবন্ধে এইরূপ মন্তব্য আছে।
‘মানুষ বনের জন্তুকে পোষ মানায় আর তাহার সহিত যথেচ্ছ ব্যবহার করে, এ কথা সত্য। কিন্তু সমুদ্র যেমন ঝড়ে মাতিয়া তাহার কর আদায় করে (অর্থাৎ অনেক মানুষের প্রাণ সংহার করে), সেইরূপ সিংহ ব্যাঘ্র অথবা অপর হিংস্র জন্তুরাও তাহাদের অপহৃত স্বাধীনতার এবং যে অপমান তাহারা ক্রমাগত সহিয়া আর সহিতে পারে নাই, তাহার মূল্যের দাবি করে এবং তাহা আদায়ও করিয়া থাকে। উত্তেজক আমোদর ব্যবস্থা করিতে গিয়া যে-সকল লোক হত আহত হইয়াছে, তাহার তালিকা দীর্ঘই হইবে।
এই-সকল জন্তুকে শিখাইবার সময় কোনোরূপ অনাবশ্যক নিষ্ঠুর ব্যবহার করা হয় না, কিন্তু বাধ্য হইয়া যেটুকু ক্লেশ দেওয়া হয়, তাহার জন্যই তাহারা অসন্তুষ্ট থাকে। ইহার অতিরিক্ত কর্কশ ব্যবহার করিলে উহারা একেবারেই সহ্য করিতে পারে না। অত্যাচারের সময় কিছু না বলিলেও তাহা মনে করিয়া রাখে এবং সুযোগ পাইলে প্রতিশোধ লয়।
একটা হাতিকে একজন শিক্ষক অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে অঙ্কুশের খোঁচা মারিয়াছিল। হাতিটা তখন তাহাকে কিছুই বলিল না। পরদিন শিক্ষকটি ছয় সপ্তাহের ছুটি লইয়া চলিয়া গেল। ছুটির পরে ফিরিয়া আসিয়া সে যেই হাতিগুলির কাছে গিয়াছে, অমনি সেই হাতিটা হুঙ্কার করিয়া তাহাকে আক্রমণ করিল। শুঁড় দিয়া তাহার কোমর জড়াইয়া ধরিয়া নিকটবর্তী মাঠে একটা পুকুরের দিকে গেল। সেখানে গিয়া মাষ্টারমহাশয়কে ক্রমাগত তিনবার যথোচিত গাম্ভীর্যের সহিত জলে ছোপাইয়া আবার তাহাকে সার্কাসে লইয়া আসিল। সেখানে আসিয়া একরাশ করাতের গুড়ার মধ্যে তাঁহাকে খানিক গড়াইয়া লইয়া, নিজের জায়গায় গিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। হাতি অতিশয় মহানুভব জন্তু, তাই শিক্ষকমহাশয়কে যৎকিঞ্চিৎ শিক্ষা দিয়াই ছাড়িয়াছিল। বাঘ কিম্বা সিংহ হইলে সে যাত্রা তাহার প্রাণ থাকিত কি না সন্দেহ।
সিংহের চাইতে বাঘ আবার আরো বেশি হিংস্র। সিংহের কতকটা মহত্ব আছে, সদয় ব্যবহার করিলে তাহার একেবারে ভুলিয়া যায় না। কিন্তু বাঘের কাছে নাকি ভদ্রতার কোনোরূপ মূল্য নাই। সিংহীগুলির মন নাকি অনেকটা ভালো। একবার একটা সিংহ তাহার শিক্ষককে (শিক্ষয়িত্রী) আক্রমণ করিয়াছিল, এমন সময় একটা সিংহী আসিয়া সিংহটার ঘাড়ে পড়িয়া শিক্ষককে বাঁচাইয়া দিল।
অবশ্য, শিক্ষকের ভরসা কেবলমাত্র তাহার অকুতোভয়তা এবং প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব ছাড়া আর কিছুরই উপরে নহে। তাহা ছাড়া আর কিছু যদি থাকে, তবে তাহা একটি স্বাভাবিক শক্তি, যাহার প্রভাবে কেবলমাত্র তাহার একটি ভ্রুকুটিতেই হিংস্র জন্তুর মনে আতংকের সঞ্চার করিয়া দিতে পারে।
যেমন করিয়াই হউক, জন্তুগুলির মনে এমন একটা বিশ্বাস থাকা চাই যে, ‘ইহাকে আমরা কিছুতেই আঁটিতে পারিব না। এ ব্যক্তি যাহা বলে, তাহাই আমাদের করিতে হইবে।’ কোনো কারণে এ ভয় একবার ভাঙ্গিয়া গেলে আর সে ব্যক্তির সে জন্তুর উপরে কোনো প্রভুত্ব থাকে না। শিক্ষক যদি কখনো মাতাল হইয়া জন্তুর খাঁচায় ঢোকে, জন্তুগুলি অমনি তাহার দুরবস্থা বুঝিতে পারে। তখন যদি ঈশ্বরের বিশেষ কৃপায় সে প্রাণ লইয়া খাঁচার ভিতর হইতে বাহির হইয়া আসিতে পারে, তাহা হইলেই তাহার সৌভাগ্য বলিতে হয়।
প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের কথা বলিতেছিলাম, তাহার একটি দৃষ্টান্ত দিই। একজন শিক্ষক কোনো কারণে ভয়ানক রাগিয়া গিয়া একটি বাঘকে চাবুকের সীসে বাঁধান গোড়াটা দিয়া কয়েকটা কঠিন আঘাত করিয়াছিল। ইহাতে মুহূর্তের জন্য বাঘটা একটু কাহিল হইল বটে, কিন্তু তাহার পরক্ষণেই হাঁ করিয়া শিক্ষককে আক্রমণ করিল। শিক্ষক তখন আর কি করে, তাড়াতাড়ি তাহার চাবুকের গোড়াটা সেই হাঁ-র ভিতর দিয়া একেবারে বাঘের গলার ভিতরে ঢুকাইয়া দিল। ইহাতে বাঘটা ক্ষণেকের জন্য ভারি অপ্রতিভ হইয়া গেল। ততক্ষণে শিক্ষকের চিৎকার শুনিয়া দুইজন লোক ছুটিয়া আসিল। সৌভাগ্যক্রমে সেখানে আগুন ছিল, আর তাহাতে একটা লোহা তাতিয়া একেবারে লাল হইয়াছিল। একজন লোক তাড়াতাড়ি সেই জ্বলন্ত লোহাটা লইয়া খাঁচার ভিতরে ঢুকিয়া বাঘটাকে সেই লোহা দিয়া খোঁচা মারিল। তাহার পর বাঘটা যেই ভয়ানক গর্জন করিয়া তাহার দিকে ফিরিয়াছে, অমনি একেবারে, তাহার মুখে লাল লোহার “ছ্যাঁকা” লাগাইয়া দিল। বাঘ পৃষ্ঠভঙ্গ দিয়া খাঁচার কোণে গিয়া লুকাইল, আর অমনি শিক্ষক আর তাহার লোক খাঁচার বাহিরে আসিয়া দরজা আটকাইয়া দিল।
অনেক সময় বিনা কারণে অথবা অতি সামান্য কারণেও এক-একটা জানোয়ার হঠাৎ ক্ষেপিয়া যায়। বাস্তবিক, যাহারা ইহাদের খাঁচার ভিতরে যায় তাহাদিগকে প্রতি মুহুর্তেই মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকিতে হয়। নিতান্ত ভালো জানোয়ারটাও কখন হঠাৎ ক্ষেপিয়া আক্রমণ করিবে, তাহার ঠিক নাই। আবার একটা যদি আক্রমণ করে, তাহা হইলে অন্যগুলিও খুব সম্ভবত তাহার পক্ষ হইয়া তাহাতে যোগ দিবে।
যাহারা সর্বদা এ কাজ করে, তাহাদের এত বিপদ। কিন্তু এমন পাগলও পৃথিবীতে আছে, যে কখনো এ কাজ করে নাই, অথচ খাঁচার ভিতরে গিয়া বাহাদুরি উপার্জন করিবার জন্য ব্যস্ত। একবার একজন ধর্মযাজক এইরূপে প্রাণ হারাইয়াছিল। বেচারা স্বভাবতই একটু উকন্দ্র, ইহার মধ্যে আবার একদিন তাহার কেমন খেয়াল চাপিল, সে মনে করিল যে, বাঘের খাঁচায় ঢুকিয়া বক্তৃতা করিতে পারিলে অনেক লোক শুনিতে আসিবে, আর তাহাতে খুব জমাট প্রচার হইবে। সুতরাং সে নিকটবর্তী এক সার্কাস ওয়ালার সঙ্গে বন্দোবস্ত করিল যে, অমুক দিন তাহার বাঘের খাঁচার ভিতর হইতে সে বক্তৃতা করিবে। সার্কাসওয়ালা প্রথমে রাজি হয় নাই। সে বলিল, “তুমি ভয় পাইবে।
ধর্মযাজক বলিল, “আমার কিছুতেই ভয় নাই।”
সার্কাসওয়ালা বলিল ‘আচ্ছা তবে যাও। আমরা সেখানে থাকিব। আশা করি, কিছু হইবে না। মনে রাখিও, তিন মিনিটের বেশি বক্তৃতা করিতে পাইবে না। আর দোহাই, অঙ্গভঙ্গি করিও না!'
সে রাত্রিতে অসম্ভব লোক হইল। পাদ্রি বেচারা শুষ্ক মুখে খাঁচায় প্রবেশ করিবার জন্য প্রস্তুত। হয়তো তখন তাহার ভয় হইয়াছিল, কিন্তু আর ফিরিবার সময় নাই। প্রকাণ্ড খাঁচা, তাহাতে দুটা বাঘ, তিনটা সিংহ আর তাহাদের ‘শিক্ষয়িত্রী’ ছিলেন। বক্তৃতা আরম্ভ হইল। প্রথমে গলার আওয়াজ একটু কাঁপিতে ছিল। জন্তুগুলি শান্তভাবে শুনিয়া যাইতেছিল। ইহাতে সাহস বাড়িয়াই হউক বা অন্য কোনো কারণেই হউক, পাদ্রি বেচারা সুর চড়াইয়া হাত ছুঁড়িতে লাগিল। সেই মুহূর্তেই বাঘিনীটা তাহার উপরে লাফাইয়া পড়িল। তাহাকে সাহায্য করিবার সময় পর্যন্ত পাওয়া গেল না। অনেক কষ্টে বাঘ তাড়াইয়া দেখা গেল, যে পাদ্রির তাহার পূর্বেই প্রাণ বাহির হইয়া গিয়াছে। বাঘিনী আক্রমণ করিবার সময় সামান্য একটু চকিত চিৎকার ভিন্ন বেচারা আর একটি শব্দ করিবারও অবসর পায় নাই।
কেবল জানোয়ারের খাঁচার ভিতর গেলেই যে বিপদ, তাহা নহে, আরো বিপদের কারণ আছে। অনেক সময় জানোয়ারগুলি খাঁচা ভাঙ্গিয়া বাহির হইয়া পড়ে। তখন তাহারা কাহার প্রাণ নাশ করে, তাহার ঠিক নাই। এক বার একজন সহকারীর অসতর্কতায় দরজা খোলা পাইয়া এক সার্কাস হইতে একটা হাতি, তিনটা বাঘ, দুটো সিংহ আর দুটো মার্কিন ভল্লুক বাহির হইয়া পড়িয়াছিল। সার্কাসের লোকদের কিরূপ আতঙ্ক হইয়াছিল, বুঝিতেই পার। আর শহরের লোকদের আতংকের কথা না বলিলেও চলে! তাহারা ঘরে দরজা আঁটিয়া ছাতে উঠিয়া তথাপি নিশ্চিন্ত নহে। সার্কাসের লোকেরা অবশ্য অস্ত্রশস্ত্র লইয়া প্রাণপণে ছুটিয়া তখন সেখানে উপস্থিত হইল। কিন্তু ইহারই মধ্যে একটা ভালুক একটা মানুষ মারিয়া ফেলিয়াছে। একটা বাঘ একটি ছোট ছেলেকে মুখে করিয়া লইয়া আবার কি মনে করিয়া তাহাকে রাখিয়া দিল। সেই অবসরে সার্কাসের একজন লোক গুলি করিয়া বাঘটাকে মারিয়া ফেলিল। আশ্চর্যের বিষয়, ছেলেটির গায়ে একটি আঁচড়ও লাগে নাই। হাতিটা ইতিমধ্যে এক খেলনার দোকানে ঢুকিয়া অনেক খেলনাই পরীক্ষা করিয়াছে, কিন্তু বাহির হইবার পথ পাইতেছে না। আর অবশেষে বাঘ আর সিংহগুলি এক কসাইর দোকান পাইয়া এতই মোহিত হইয়াছে যে, তাহাদিগকে সেখানে আটকাইতে কোনো মুশকিল হইল না।
জিজ্ঞাসা করিতে পার যে, এত বিপদ সহ্য করিয়া লোকে এ কাজ করিতে যায় কেন? এ কথার উত্তরে তাহার বলে যে, এ কাজ তাহাদের এতই ভালো লাগে যে, বিপদ-সত্ত্বেও তাহারা ইহা না করিয়া পারে না। একজন জানোয়ার শিক্ষক তাহার পুত্রকে ধর্মযাজক করিবার জন্য অনেক চেষ্টা করিয়াছিল, আর মনে একরকম নিশ্চিন্ত ছিল যে ছেলে বড় হইলেই পাদ্রি হইবে। ইহার মধ্যে একদিন দেখে যে সেই ছেলে জানোয়ারের খাঁচায় ঢুকিয়া আছে। ভয়ে বেচারার প্রাণ উড়িয়া গেল, সে ছেলেকে বলিল, ‘বাবা যদি প্রাণ নিয়ে বাহিরে আসিতে পার, এমন ঠেঙ্গানি দিব, যে জন্মে তেমন ঠেঙ্গানি খাও নাই।’ কিন্তু ছেলে বাহিরে আসিলে তাহাকে আর কিছু বলিল না। সুতরাং সে ছেলেও কালে জানোয়ারের ব্যবসায়ই অবলম্বন করিল।
কিন্তু এই ব্যবসায় যাহারা সৃষ্টি করিয়াছিল তাহাদের অন্য কারণও ছিল দেখা যায়। মার্টিন নামক এক ব্যক্তি এই ব্যবসায়ের পথপ্রদর্শকদিগের মধ্যে একজন। সে যে কারণে ইহাতে হাত দিয়াছিল, তাহা এই — মার্টিন সহিসের কাজ করিত, এক সার্কাসওয়ালার ভগ্নীর প্রতি তাহার ভালোবাসা জন্মিল। কিন্তু সার্কাসওয়ালা সহিসের কাছে ভগ্নীর বিবাহ দিতে রাজি হইল না। মাটিন কিন্তু নিরাশ না হইয়া ইহার এক উপায় স্থির করিল। দিন কয়েক পরে সে সার্কাসওয়ালাকে এক বাঘের খাঁচার ভিতরে তাহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে নিমন্ত্রণ করিল। সার্কাসওয়ালা মনে করিল, বেচারা পাগল হইয়াছে। কিন্তু গিয়া দেখিল, যে মাটিন সহাস্যবদনে সেখানে বসিয়া আছে, আর বাঘ অতিশয় স্নেহের সহিত তাহার হাত চাটিতেছে। এই এক ঘটনাতেই মার্টিনের মনুষ্যত্ব এবং ভবিষ্যৎ উন্নতির লক্ষ্মণ দেখিয়া সার্কাসওয়ালা আর তাহার ভগ্নীকে তাহার সহিত বিবাহ দিতে আপত্তি করিল না।